বশির মেসবাহ : শিল্পের অনুসন্ধিৎসা মিশে আছে তার স্বভাবে

শরীফ মুহাম্মাদ :

আমি যখন কামরাঙ্গীরচর নুরিয়া মাদরাসায় পড়ি, আমার দুই বছরের সিনিয়র ছিলেন বশির মেসবাহ। খুব কাছে ঘেঁষতাম না, দূর থেকেই দেখতাম। মাদরাসায় বড় ভাইদের প্রতি যেমন ভয় এবং সমীহ থাকে, আমারও তেমনই ছিলো। তিনি মাদরাসার দেয়াল পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। আমার বয়স অল্প, পত্রিকায় লেখা জমা দেই, লেখা ছাপা হয়। এতটুকুই। সম্পাদনা সহকারী কিংবা পত্রিকা সংশ্লিষ্ট প্যানেলে আমার কোনো সংযুক্তি ছিলো না।

আমরা ঘনিষ্ঠ হই দাওরা ফারেগ হবার পর। বিভিন্ন উপলক্ষে, বিভিন্ন পারপাসে। পল্টনে তিনি যখন অফিস নিলেন, তার অফিস হয়ে উঠলো আমাদের আড্ডার প্রধান কেন্দ্রস্থল। আমি, আহলুল্লাহ ওয়াসেল, বশির মেসবাহ—তিনজন মিলে জমে উঠতো তুমুল আড্ডা। আড্ডার কোনো বিষয় ছিলো না, বাইন্ডিংস ছিলো না কোনো। সাহিত্য, রাজনীতি, শিল্প, সমাজ, দেশ—কোনো বিষয় বাদ যেতো না। দারুণ আড্ডা দিতে পারেন বশির মেসবাহ। যে কয়টি জায়গায় আমি নিজেকে রাখডাকহীন প্রকাশ করতে পারি, বশির মেসবাহ তাদের অন্যতম একজন। আমরা একসাথে হলে গল্পের জোয়ার শুরু হয়। সময়ের হিসাব থাকে না। মিরপুর থেকে পল্টন এসেছি, ভেবেছি মাগরিব পড়েই রওয়ানা হয়ে যাব। কিন্তু মাগরিব পার হয়ে এশাও পার হতো। ঘড়ির কাটা ছুঁয়ে ফেলতো এগারোটার ঘর। তারপর দেখা যেত আমরা মাত্র অফিস থেকে নিচে নামছি, সিএনজি খুঁজছি, সিএনজি পর্যন্ত তিনি আমাকে এগিয়ে দিচ্ছেন।

পেশাদারিত্বের খাতিরে হয়তো কখনও তাকে কঠিন হতে হয়। কিন্তু আমাদের সঙ্গে সবসময় তিনি দিলখোলা মুক্তপ্রাণ। তিনি দারুণ আলাপী, মিশুক ও মেহমান নেওয়াজ। দেখা হলেই উদার হস্তে খরচ করেন। হয়তো কাজের খুব চাপ, আমি তার অফিসে গিয়েছি, তারুণদের মতো উচ্ছ্বলতায় তিনি বলছেন, চলেন বাইতুল মোকাররমের উত্তর গেইটে। আমি তার সঙ্গে চলে যাই, আকাশ দেখি, হাঁটি। গল্পের তালে বয়ে চলে সময়। মহা গুরুত্বপূর্ণ কোনো গল্প না। নিতান্তই উজির-নাজির মারার গল্প। কখনো কোথায় কী পড়ছেন, সেসব গল্প। একদিন গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজে ফোন দিয়েছি। তিনি তখনও বলছেন, ‘শরীফ ভাই, আনিসুল হকের লেখাটা পড়লাম। তিনি বিষয়টা অর্ধেক বলেছেন, অর্ধেক বলার সাহস করতে পারেননি। নয়াদিগন্তের অমুক লেখাটা পড়েছি ভালো লেগেছে।’

বশির মেসবাহ আমার চলার পথে সবসময় আমাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছেন। হয়তো কোনো প্রকাশক আমার কাছ থেকে একটি বই নিতে চান। তিনি তাকে গিয়ে ধরলেন, এডভান্স টাকাও দিয়ে এলেন। বশির মেসবাহ আগে কাজের বিবরণ শুনবেন। পর্যবেক্ষণ করবেন আমার জন্য বিষয়টা উপযুক্ত কিনা। তারপর দেখা হলে আমার সঙ্গে সুন্দরভাবে আড্ডা দিবেন। ভূমিকা নির্মাণ করে বলবেন, ‘কাজটা চাইলে আপনি করতে পারেন। সময়ের কোনো বাইন্ডিংস নেই। যদি আপনার রুচির সঙ্গে না যায়, সমস্যা নেই। কাজটা আমি এমনিতেই রেখেছি, ফিরিয়ে দিব।’ অধিকার খাটানো না, চাপও না—কেবল আমাকে তাড়িত করা।

২০০৬ সালের কথা। আমি দৈনিক আমার দেশে কাজ করি। অভিমান করে একটা মাসিক পত্রিকার দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছি। তখনো মাসিক আল কাউসারে যুক্ত হইনি। আমার ইচ্ছে—নিজেই একটি মাসিক করবো। ইতিউতি করছি। বশির মেসবাহ বললেন, ‘মাসিক পত্রিকা শুরু করে দেন। আমার অফিস থেকেই শুরু করেন। আমি সঙ্গে আছি।’ তিনি তখন সফল ডিজাইনার; নিজের ডিজাইন হাউসে ব্যস্ত সময় কাটছে। মাসিক পত্রিকার তার দরকার নেই। কিন্তু তিনি লক্ষ্য করলেন আমার স্বপ্ন, আমার ইচ্ছা। আমার স্বপ্নকে পূর্ণতা দিতেই তিনি আমাকে তাড়া করতে লাগলেন। তাকে প্রকাশক করে ‘যমযম’ নামে একটি পত্রিকা শুরু করলাম। কিন্তু আর্থিক সঙ্কটের কারণে পত্রিকাটি চালু রাখা সম্ভব হয়নি।

লেখালেখির অঙ্গনে বিরাট একটি সম্ভাবনার নাম ছিলেন বশির মেসবাহ। বড় বড় ম্যাগাজিনে তার গল্প প্রকাশিত হতো। যেসব ম্যাগাজিনে লেখার সাহসই করতাম না আমরা। তখন এত পত্রিকা ছিলো না। গুটিকয়েক সাময়িকী চালু ছিল—সেসব পত্রিকায় ছাপা হতো সম্পাদকদের পরিচিত বড় লেখকদের লেখা। কিন্তু পরিচিতি ছাড়াই বশির মেসবাহের গল্প ছাপতেন তারা। তার গল্পে থাকতো প্রেম, জীবন-যন্ত্রণা ও দাম্পত্য জীবনের জটিল নিরীক্ষা। পরবর্তীতে তার দু’একটা অনুবাদগ্রন্থও বের হয়েছে, কিন্তু মৌলিক বই করেননি তিনি। ডিজাইন ও ক্যালিগ্রাফির ব্যস্ততায় লেখালেখিতে আর তেমন সময় দিতে পারেননি।

তার জীবনের পুরো অংশজুড়েই ডিজাইন ও ক্যালিগ্রাফি। সেই ছাত্রকাল থেকেই। এখন বিভিন্ন মাদরাসায় যাই, দেয়ালে টাঙানো পত্রিকাগুলো দেখি, কিন্তু কোনটাকেই নুরিয়া মাদরাসার দেয়াল পত্রিকার মতো পরিণত মনে হয় না। নুরিয়ায় দেয়াল পত্রিকা পরিণত হবার পেছনে তখন সবচে বড় মূল ভূমিকা পালন করেছেন বশির মেসবাহ। পত্রিকার নাম কেমন হবে, লেখাগুলোর মেকাপ-বিন্যাস কেমন হবে, হস্তলিপি কেমন হবে—সব দেখতেন তিনি। তার হাতের ছোঁয়ায়, রং-তুলির পরশে ও শিল্পের সৃজনশীলতায় দেয়াল পত্রিকাটি মুগ্ধকর একটি আবেশ তৈরী করে রাখতো।

ক্যালিগ্রাফির গ্রামার বুঝেন বাংলাদেশে এমন দু’তিনজন লোক আছেন। তারা হলেন—আরিফুর রহমান, শহীদুল্লাহ ফজলুল বারী, বশির মিসবাহ। ফজলুক বারী গত হয়ে গেছেন। আরিফুর রহমান বাংলাদেশের প্রথম ক্যালিওগ্রাফার, বাংলাদেশের হয়ে যিনি বিদেশের মাটিতে প্রতিযোগিতায় গিয়েছেন। তিনি বশির মেসবাহর সিনিয়র। কিন্তু তাদের দু’জনের মাঝে বোঝাপড়াটা খুব ভালো। বশির মেসবাহ যখন পল্টনে অফিস নেননি, ক্লায়েন্টের ডিজাইন আঁকতে তিনি তখন মাঝেমধ্যে আরিফুর রহমানের অফিসে চলে যেতেন। তার চিন্তা ও চলাফেরা সবক্ষেত্রেই একটা শিল্পমানস লক্ষ্য করা যায়। গল্পের সময় গল্প করছেন, কাজের সময় কাজে একদম ডুবে যাচ্ছেন। তিনি তার ক্যালিগ্রাফির গ্রুপ এক্সিবিশন করেছেন, একক এক্সিবিশন করেছেন। ক্যালিগ্রাফির সঙ্গে এখন ইসলামি বইয়ের অনেক প্রচ্ছদও করছেন তিনি।

কম্পিউটারের চল যখন হয়নি, তখন থেকেই প্রচ্ছদ করেন বশির মেসবাহ। আমি দেখেছি—লেটার কম্পোজ করতেন তিনি। এর জন্য প্রথমে কাঠ দিয়ে অক্ষরের আকৃতিতে ব্লক বানাতে হতো। তারপর ওই ব্লকের ছাপ নেয়া হতো। এখনকার তরুণ প্রচ্ছদশিল্পীরা নেটে বিভিন্ন আইডিয়া পান, রং নিয়ে, স্টাইল নিয়ে যেমন ইচ্ছে তেমন খেলা করার সুযোগ পান। কিন্তু তখন এই সুযোগ ছিলো না। তাই তার প্রচ্ছদে, ডিজাইনে ঐতিহ্যবাদিতা, আভিজাত্য ও ইসলামি প্রতীকের প্রাচীন ধারার সুনিপুণ ব্যবহার খুব উজ্জ্বল। দুই কারণে মানুষ তাকে দিয়ে কাজ করান। এক—তার ইসলামি ঐতিহ্যবাদী ডিজাইন। দুই—তার আরবি হরফের শেপ খুব দারুণ। তার এই ঐতিহ্যবাদী কাজ আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়।

আপাদমস্তক শিল্পী মনের মানুষ বশির মেসবাহ। শিল্পের অনুসন্ধিৎসা তার স্বভাবেই মিশে আছে। পথ হাঁটতে হাঁটতে কোনো ডিজাইন দেখে থমকে দাঁড়ান। পুরাতন বইয়ের হলুদ হয়ে যাওয়া পাতায় একটি হরফের আঁকা দেখে ঝুঁকে পড়েন। অন্তর্জালের পাতায় নতুন ডিজাইন দেখে জিজ্ঞেস করেন, এইটা কেমন, ওইটা কেমন। হয়তো ক্যালিগ্রাফির কোনো জিনিস দেখলেন, যত দামই হোক, কিনে ফেলবেন। এই আমাদের শিল্প অনুসন্ধিৎসু এক অসাধারণ শিল্পী বশির মেসবাহ।

শ্রুতিলিখন : রাকিবুল হাসান 

আগের সংবাদবশির মেসবাহ : শিল্পে আঁকা একটি নাম
পরবর্তি সংবাদবশির মেসবাহর সঙ্গে আলাপ