বহেনজি

রাকিবুল হাসান:

আকাশটা আজ বড্ড মেঘলা। কিন্তু বৃষ্টি নামবে নামবে করেও নামছে না। থম মেরে আছে পরিবেশ। ফাঁপা একটা গরম স্বস্তি দিচ্ছে না কাউকে। হাসপাতালে আসতে আসতে মকবুল জান ভাবছিলো, বৃষ্টি যদি নামেই, ফরিদার রিপোর্টও যদি ঠিকঠাক থাকে, ফরিদাকে নিয়ে সে বৃষ্টিতে ভিজবে। বিয়ের পর একবারও ফরিদা তার সঙ্গে বৃষ্টিতে ভেজেনি। একদিন মকবুল জান বলেছিল, ‘যখন বৃষ্টি নামে, কাশ্মীর তখন জলে ভেজা লস্যময়ী হুরের মতো লাগে।’

ফরিদা ঠোঁট বাঁকা করে বলেছিল, ‘আমি তো কাশ্মীর না। কাশ্মীরের মেয়ে।’

‘কাশ্মীরের চেয়েও কাশ্মীরের মেয়েরা সুন্দর।’

‘উহু।’

‘ধরো, কাশ্মীরের মানুষগুলো যদি কালো কুচকুচে হতো, কাশ্মীরের সৌন্দর্য কেমন বেমানান দেখাতো না?’

‘একটু একটু।’

‘আল্লাহ তোমাকে কম রূপ দেননি। মনে হচ্ছে সৌন্দর্যের সবচে কোমল প্রলেপটা তিনি খুব যত্ন করে তোমাকে দিয়েছেন।’

ফরিদা আলতো করে চিমটি কাটে মকবুল জানের পেটে। আগুন রূপ নিয়ে সে জন্মেছে ঠিক, কিন্তু দরিদ্র পরিবারে বেড়ে উঠার কারণে রূপের দিকে তেমন মনোযোগ দিতে পারেনি। পিতা ইউসুফ বেগ এবং মাতা সাঈদা বেগমের বড় সন্তান সে। তারপর জন্ম নিয়েছে তিনভাই—বেলাল, শাকিল, ফিরোজ। এক বোন ডেইজি। অসুখ ছিল তাদের নিত্যসঙ্গী। দারিদ্রের কষাঘাতে দিনগুলো ছিল কেমন মলিন, বিবর্ণ, একপেশে। মকবুল জানের সঙ্গে বিয়ে হবার পর আস্ত একটা স্বর্গ যেন পেয়ে গেছে সে। অসুখ ছাড়া বাকিসব দুঃখ ধুয়ে মুছে গেছে শ্রাবণের জলের মতো। ফরিদা মকবুল জানের বুকে মাথা রেখে বললো, ‘অসুখটা সারিয়ে দাও। তোমার সঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজবো।’

ফরিদার অদ্ভুত সুন্দর হাসিটা মনে পড়তেই মকবুল জানের ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। গাড়ির জানালা একটু ফাঁক করে সে মনে মনে প্রার্থনা করলো, ‘আল্লাহ মেঘ দে, পানি দে, ছায়া দে রে তুই।’

রিপোর্ট হাতে পাবার পর সব সুখ-কল্পনা নিমিষেই যেন উড়ে গেলো। ফরিদা মকবুল জানের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে। সবকিছু হারিয়ে ফেলা বানভাসী যেমন আকড়ে ধরে আশ্রয়ের সামান্য কাঠখণ্ড। মাথায় হাত বুলিয়ে মকবুল জান বললো, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে। এই রিপোর্ট ভুল।’ ফরিদা আরও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। মকবুল জানকে আরেকটু চেপে ধরে বললো, ‘জান, আমি মা হতে পারবো না।’

শ্রীনগরের হাসপাতালের করিডোরে, দুজন মানুষের বুকে কী প্রচণ্ড ঝড়ের তাণ্ডব চলছে, কেউ দেখছে না। বাইরের ঝড় দেখা যায়, ভেতরের ঝড় কখনো দেখা যায় না। মানুষ তাই দুঃখ লুকিয়ে সুখের অভিনয় করতে পারে।

মকবুল জান আস্তে আস্তে বললো, ‘সুস্থ হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। রিপোর্টে ভুল হতে পারে।’

ফরিদা দু হাতে চোখের জল মুছে বললো, ‘ডাক্তার সব চেকাপ করেই রিপোর্ট দিয়েছেন। আমাকে ক্ষমা করে দিও জান।’

মকবুল জান বললো, ‘ফরিদা, তোমাকে ভালোবাসি। ভালোবাসায় রাগ দুঃখ অভিমান থাকে। ক্ষমা থাকে না। ইটস নট ইউর ফল্ট।’

ফরিদা বললো, ‘তবুও। বাবা না হতে পারার দুঃখ তোমাকে বয়ে বেড়াতে হবে।’

মকবুল জান বললো, ‘যাকারিয়া আ. এর স্ত্রী বন্ধ্যা ছিল। তাকে আল্লাহ সন্তান দিয়েছেন। আমরা অপেক্ষা করবো। আল্লাহ যখন কবুল করবেন, তখনই আমরা মা-বাবা হবো।’

ইদানিং ফরিদা কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করছে। আপন এই সংসার কেমন অচেনা লাগছে তার। মকবুল জান সেই সকালে বেরিয়ে যায় কাজে, ফিরে রাতে। সংসার নামের অথৈ সমুদ্রে একাকী সে হাবুডুবু খায়। একাকী সময়টা বিষিয়ে উঠছে শশুড়-শাশুড়ির অযাচিত আচরণে। তারা তাকে একপ্রকার অপায়া-অলক্ষুণে ভাবতে শুরু করেছে। পান থেকে চুন খসলেই আর রক্ষা নেই। একরাতে ফরিদা মকবুলের কাঁধে মাথা রেখে বললো, ‘আমি অলক্ষুণে?’

মকবুল জান কপাল কুঞ্চিত করে বললো, ‘তুমি অলক্ষুণে হতে যাবে কেন?’

‘তাহলে?’

‘তুমি আমার লক্ষী। তুমি আমার সংসারে আসার পর তোমার ছোঁয়ায় বদলে গেছে জীবন। পার্টনারশিপের ব্যবসা ছেড়ে একক ব্যবসা শুরু করেছি।’

‘আমি না থাকলেও এসব হতো।’

মকবুল বললো, ‘তাহলে তুমি আসার আগে হয়নি কেন?’

ফরিদা কোনো উত্তর দিতে পারে না। নিজের ওপর তার যতটুকু বিশ্বাস, মকবুল জান তাকে তারচেয়ে বেশি বিশ্বাস করে। বিশ্বাসের চেয়ে বড় কোনো শক্তি এই পৃথিবীতে নেই। পরদিন মকবুল জান বুঝতে পারলো ফরিদা কেন গতরাতে ওই প্রশ্ন করেছিলো। তার সামনে সব স্পষ্ট হয়ে গেলো।

মকবুলের মা মকবুলকে বললো, ‘কী ভাবছিস?’

‘কী ভাববো?’

‘সন্তান-সন্ততি দরকার নেই?’

‘আছে।’

‘তাহলে অপয়াটাকে ঘরে রেখে লাভ কী?’

মকবুল কপাল কুঞ্চিত করে বললো, ‘মানে?’

‘মানে তোর বউ। তাকে বিদায় করে নতুন কাউকে আনতে হবে না? নয়তো নাতি-নাতনির মুখ দেখবো কবে?’

‘ফরিদাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না। সে আমার সঙ্গেই থাকবে।’

মকবুলের মা অভিমানী স্বরে বললো, ‘তাহলে মায়ের ইচ্ছে, শখের কোনো মূল্য নেই তোর কাছে?’

মকবুলের খুব রাগ হচ্ছিল। তবুও নিজেকে সামলে বললো, ‘তোমার যেমন মূল্য আমার কাছে, ঠিক তেমনি আমার স্ত্রীর মূল্যও। কাউকেই আমি ছাড়তে পারবো না।’

ফরিদার মনে হচ্ছে, অচিরেই সে একা হয়ে পড়বে, খুব একা। একটা সন্তান জন্ম দিতে না পারার অপরাধে তাকে হারাতে হবে স্বামী, সংসার। একাকী দুপুরে জানালা খুলে বাইরে তাকিয়ে থাকে সে। শিরশির বাতাস তাকে উদাস করে দেয়। এলোমেলো করে দেয় তার চিন্তা-ভাবনা। আজকাল মকবুল জানের সঙ্গেও খুব বেশি কথা বলে না ফরিদা। কথা বললেই যদি ভুল হয়ে যায়। তাহলে উলটা-পালটা হয়ে যাবে সবকিছু। তাই ইচ্ছে করেই চুপ থাকে সে। নিজের ভেতরেই নিজে গুটিসুটি মেরে পড়ে থাকে।

ফরিদাকে তালাক দেবার জন্য মকবুল জানকে ক্রমাগত চাপ দিতে থাকে তার মা। ফরিদাও অপেক্ষা করতে থাকে এক মহা দুঃসংবাদের। কিন্তু মকবুল জান দুঃসংবাদের বদলে শোনালো সুখ সংবাদ। একদিন এসে বললো, ‘ফরিদা, এখানে থাকলে আমিও ভালো থাকবো না, তুমিও ভালো থাকবে না। অথচ দুজন দুজনকে নিয়ে ভালো থাকতে চাই। তাই চলো কিছুদিন তোমার বাবার বাড়ি গিয়ে থাকি। নতুন বাড়ি কেনার কথা চলছে। কেনা হয়ে গেলে ওখানে উঠে যাবো।’ তারপরদিনই তারা দুজন এসে উঠে উঠলো শ্রীনগরের আলুচাবাগে, ফরিদার বাবার বাড়িতে।

আলুচাবাগের বাড়িতে আসার কিছুদিন পরই নতুন একটা বাড়ি কিনে মকবুল জান। এর কয়েক বছর পর ব্যবসায় প্রভূত উন্নতি হলে এই বাড়িটি বিক্রি করে দেয়। তারপর নটিপুরায় দেলসুজ কলোনিতে কয়েক কাঠা জমি কিনে গড়ে তুলে দৃষ্টিনন্দন একটি বাড়ি। একদম নিজের মতো করে। ফরিদা এই বাড়িতে সাজিয়ে তুলে সংসার, ভালোবাসার মনোরম দরবার। দুটি মানুষ মিলে তাদের বুকের লালিত মমতা দিয়ে বাড়িটিকে করে তুলে রাজমহল।

নটিপুরার বাড়িতে উঠার কিছুদিন পর এক রাতে প্রবল বৃষ্টি নামে। ফরিদা মকবুল জানকে টেনে ছাদে নিয়ে যায়। বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে দুজন। ফরিদা মকবুলকে কাছে টেনে বললো, ‘আমার চোখে তাকাও।’

দুটো চোখ বড় করে মকবুল জান বললো, ‘তাকালাম।’

‘কী দেখতে পাচ্ছো?’

‘আনন্দ।’

‘কিসের আনন্দ বলতে পারো?’

‘বৃষ্টিতে ভেজার। আমাকে আপন করে পাবার।’

ফরিদা মকবুলের কপালে চুমু খেয়ে বললো, ‘এত বোকা কেন তুমি?’

‘বোকাই তো তোমার পছন্দ।’

‘উহু। এখন থেকে চালাক পছন্দ।’

‘কেন?’

‘তুমি বাবা হতে যাচ্ছো। চালাক হতে হবে না?’

মকবুল কানকে বিশ্বাস করাতে পারছিলো না। রাজ্যের অবিশ্বাস নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, সত্যি?

ফরিদা বললো, ‘সত্যি। তোমার আশীর্বাদে ডাক্তারের রিপোর্ট ভুল প্রমাণিত হয়েছে। জিতে গেছে তোমার বিশ্বাস।’

ফরিদা কান্না করছে। বৃষ্টির জল আর চোখের জল আলাদা করা যাচ্ছে না। ছাদের শক্ত কংক্রিটে লুটোপুটি খাচ্ছে দুরকম জলের দুটি ধারা। জোছনায় নাকি বৃষ্টি এবং চোখের জল দুটো দুরকম দেখায়। জোছনার স্পর্শে বৃষ্টির চেয়ে চোখের জল বেশি ঝলমল করে। আজ জোছনা নেই। তাই কোনো পার্থক্য করা যাচ্ছে না। মকবুল ফরিদার কপালে কপাল রেখে বললো, ‘এইবার বিশ্বাস হলো, তুমি অলক্ষুণে নয়?’

ফরিদা বললো, ‘উমমম।’

বাড়িতে পত্রিকা আসতে আসতে সকাল দশটা বাজে প্রতিদিন। ততক্ষণে ফরিদা খানিকটা অবসর হয়। মকবুল জান কারখানায় চলে যায়। বড় ছেলে মুদ্দাসির এবং ছোট ছেলে মুসাররাত যায় স্কুলে। একমাত্র মেয়ে সায়মা এখনো ছোট, কখনো স্কুলে যায়, কখনো যায় না। আজ সায়মা স্কুলে গেছে। অবসর হয়ে পত্রিকাটা খুলে বসলো ফরিদা। প্রথম পাতায় কাশ্মীরের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আব্দুল্লাহর খবর হেডলাইন করেছে পত্রিকাটি।

খবরটি পড়ে মুচকি হাসলো ফরিদা। ফারুক আব্দুল্লাহর বাবা শেখ আব্দুল্লাহ কাশ্মীরের সবচে বড় ক্ষতিটি করে দিয়ে গেছেন। ১৯৪৭ সালের ২৭ অক্টোবর কাশ্মীরের ইতিহাসে কলঙ্কিত সেই দিন। এই দিন  উপত্যকার মহারাজা হরিসিংকে সহায়তা করতে ভারতীয় মিলিটারি ডেকে আনেন শেখ আব্দুল্লাহ। এর বিনিময়ে নেহরুর কাছ থেকে কব্জায় নেন শাসনক্ষমতা। তারপর একসময় জেলবন্দী হন। তার দল ন্যাশনাল কনফারেন্স নিষিদ্ধ হয়। জেল থেকে বেরিয়ে কংগ্রেসের ইন্ধিরা গান্ধীর সঙ্গে আবার আঁতাত করেন। এবার বিনিময়ে লাভ করেন জম্মু-কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব। গতবছর, ১৯৮২ সালে তিনি ইন্তেকাল করার পর মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন তার ছেলে ফারুক আব্দুল্লাহ।

গত ৩১ মে ফারুক আব্দুল্লাহ বেজওয়ারাতে বিরোধী দলের একটি গোপন মিটিংয়ে যোগ দেয়ায় ক্ষুব্ধ ইন্ধিরা গান্ধী। তিনি চাইছেন ১৩ জন বিধায়ক ডিঙিয়ে ফারুক আব্দুল্লাহর সরকার ভেঙে দিতে। কিন্তু পারছেন না কাশ্মীরের রাজ্যপাল পন্ডিত বি কে নেহরুর কারণে। পন্ডিত এত তাড়াতাড়ি ফারুক আব্দুল্লাহকে সরিয়ে দিতে নারাজ। বিরাশিতে তার বাবা মারা গেছেন। এখন তিরাশি। সরকার থেকে এখনই ফারুককে সরিয়ে দিলে সমালোচনার জন্ম হতে পারে। কিন্তু তর সইছে না ইন্ধিরা গান্ধীর। ব্যবহৃত টিস্যুর মতো তিনি ছুঁড়ে ফেলতে চাইছেন ফারুক আব্দুল্লাহকে। ডাল কাটতে না পারলে শেকড় উপড়ে ফেললেই হয়। তাই ইন্ধিরা গান্ধী বদলে দিলেন খোদ রাজ্যপালকেই। কাশ্মীরের নতুন রাজ্যপাল করে পাঠালেন তার ছেলে সঞ্জয়ের ঘনিষ্ঠ বিজেপি নেতা জগমোহন মালব্যকে।

সুদূরপ্রসারী এক পরিকল্পনা নিয়ে রাজ্যপালের আসনে সমাসীন হন জগমোহন মালব্য। ক্ষমতায় এসে তিনি সরকারি পদে মুসলমানদের নিয়োগ পঞ্চাশ শতাংশ কমিয়ে দিলেন। ঘোষণা করলেন, মুসলিম সংখ্যাগুরু এলাকায় হিন্দু পরবের দিন গরুর মাংস বিক্রি করা যাবে না। এই ঘোষণায় ভেতরে ভেতরে ফুঁসতে থাকে কাশ্মীরের জনগণ। সামান্য এদিক সেদিক হলেই মুসলিমদের ওপর জগমোহন চালায় নির্মম নির্যাতন। কেউ কিছু বলতে পারে না। প্রতিবাদ করতে পারে না।

একদিন দুপুরে দৌড়তে দৌড়তে বাড়ি এসে উপস্থিত হলো ফরিদার বড় ছেলে মুদ্দাসির। কোনো কারণে মুসাররাত সেদিন স্কুলে যায়নি। ঘরে ঢুকেই কাঁধের ব্যাগ ফেলে ডাকলো, ‘মা।’

ফরিদা রান্নাঘর থেকেই উত্তর দিলো, ‘কী হয়েছে? আজ এত তাড়াতাড়ি চলে এলি যে!’

‘বাইরে অবস্থা খারাপ। পুলিশ রাস্তায় মুসলমান দেখলেই জেরা করছে, পেটা করছে।’

ফরিদা খানিক বিস্মিত হলো। পুলিশ হাত তুলছে কাশ্মীরের জনগণের ওপর? তা-ও বেছে বেছে মুসলমানদের গায়ে? কণ্ঠে বিস্ময় নিয়ে ফরিদা জিজ্ঞেস করলো, ‘ঘটনা কী?’

মুদ্দাসির হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, ‘অনন্তনাগে হিন্দু এবং হিন্দুদের উপাসনালয়ে কে যেন হামলা করেছে। মানুষ বলাবলি করছে, মুসলিমরা নাকি হামলা করেছে।’

ইতোমধ্যে মকবুল জানও এসে ঘরে ঢুকেছে। তার কপাল থেকে ঘাম ঝরছে। ফরিদা এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী শুনছি।’

মকবুল জান বললো, ‘সত্য-মিথ্যা ওপরওয়ালা জানেন। বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে মুসলিমরা মন্দিরে হামলা করেছে। রাজ্যপাল জগমোহন নাকি এর শেষ দেখে ছাড়বেন।’

ফরিদার মনে কোথায় যেন খটকা লাগছে। কাশ্মীরে বাইরের মানুষেরা বারবার আক্রমণ করেছে। কিন্তু কাশ্মীরে এক ধর্মের মানুষ আরেক ধর্মের মানুষের ওপর হাত তুলেনি। এই উপত্যকায় হিন্দু, মুসলিম, পন্ডিত, শিখ সবাই একসঙ্গে বসবাস করছে। কারো মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। হঠাৎ কী হলো যে, মুসলিমরা আক্রমণ করে বসলো হিন্দুদের মন্দিরে!

দু তিনদিন স্কুলে যাওয়া বন্ধ থাকে মুদ্দাসির ও মুসাররাতের। মকবুল জানকেও কারখানায় যেতে না করে ফরিদা। কিন্তু মকবুল জান কারখানায় কাজ করতে যায় প্রতিদিনই। সেদিন কারখানায় গিয়ে পা রেখেছে মাত্র। এক মুসলিম কর্মচারী এসে বললো, ‘স্যার, শুনছেন নি কিছু?’

কপাল কুঞ্চিত মকবুলের, ‘কী?’

কর্মচারী বললো, ‘কাম তো ঘটাইসে কংগ্রেসই।’

কৌতূহল সইতে না পেরে ধমক দিয়ে উঠলেন মকবুল, ‘সঠিক কথাটা খুলে বল। নইলে দিব একটা।’

কর্মচারী মুচকি হেসে বললো, ‘এনজিও আসছিল গতকাল। ভাঙা মন্দির দেখতে। তদন্ত করতে। তারা বলে গেছে, মুসলিমরা না, বরং এই মন্দির ভাঙার পেছনে কংগ্রেসের হাত আছে। তারা ১০ হাজার টাকাও তুলে দিয়ে গেছে মন্দির ঠিক করার জন্য।’

মকবুল বললো, ‘জগমোহন এবার কংগ্রেসকে কী বলবেন?’

কর্মচারী হেসে বললো, ‘স্যার দেখি একদম সোজা মানুষ। কংগ্রেস তো জগমোহনকে দিয়েই কাণ্ডটা ঘটাইসে। কে কারে কী বলবো। আমরারে নিয়া তলে তলে মনে হয় খারাপ কিছু হইতেছে।’

মকবুল মাথা দোলায়।

ইতিহাসের জ্ঞান খুব বেশি নেই মকবুলের। তাই সে বর্তমানের চোখে কিছুই দেখতে পারে না। সে ভাবে, দাঙ্গা বাঁধিয়ে কে কী করতে চাইছে? এইযে হঠাৎই অশান্ত হয়ে উঠলো উপত্যকা, ভয়ে কুঁকড়ে উঠলো হিন্দুরা—এইটাতো বেখাপ্পা, লাগামহীন ঘোড়ার মতো উদভ্রান্ত লাগছে। সে অপেক্ষা করতে থাকে, দুপুরে বাড়ি গিয়ে ফরিদাকে তথ্যটা জানিয়ে চমকে দিবে। আমার খবর শুনে ফরিদা চমকাবে, নাকি আমার আগেই খবরটা তার কানে পৌঁছে যাবে? যাক পৌঁছে, তবুও সে বলবে।

১৯৮৭ সাল। ঘনিয়ে এসেছে ভারতের প্রাদেশিক নির্বাচন। ফারুক আব্দুল্লাহ এবং তার দল ন্যাশনাল কনফারেন্স ভারতীয় দল কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধেছে। কিন্তু কাশ্মীরের জনগণ এই মেরুদণ্ডহীন পদলেহির পেছনে থাকতে চায় না।  তারা চায় আইনগতভাবে এ্যাসেম্বলির দখল নিয়ে ভারতের চ্যালেঞ্জ করতে। যেখানে তাদের নিজস্ব শাসন থাকবে, জগমোহনের মতো নির্মম ধুরন্ধর বাইরের কেউ এসে আগুন দিতে পারবে না। তাই কাশ্মীরের বড় বড় সব রাজনৈতিক দল মিলে ন্যাশনাল কনফারেন্সের বিপরীতে জোট গঠন করে। জোটের নাম ‘মুসলিম ইউনাইটেড ফ্রন্ট’। এই ফ্রন্ট উপত্যকার মানুষের আশার প্রদীপ হিসেবে, লড়াইয়ের মাধ্যম হিসেবে বরিত হয়।

ফ্রন্টের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় নামে ফরিদা। কাশ্মীরি মহিলাদের সংগঠিত করতে আত্মনিয়োগ করে সে। মকবুল জান তাকে বাধা দেয়নি। ফরিদাকে ছেড়ে দিয়েছে তার আপন কক্ষপথে। মকবুল জানে, ফরিদা তার কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে অন্য কোথাও গড়িয়ে পড়বে না। নিজেদের সত্তা বলিষ্ঠ করার যে সংগ্রামে নেমেছে কাশ্মীরি জনগণ, আমার স্ত্রীও সেই সংগ্রামে শামিল। এতে ক্ষোভ নেই, আছে আনন্দ। নিজেকে বিলিয়ে নিজেদের খুঁজে পাবার আনন্দ। এই নির্বাচনে ফ্রন্ট যদি ক্ষমতায় আসতে পারে, সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন কায়েম করবে ভারতকে চ্যালেঞ্জ করে। নয়তো ভারত যে শোষণ শুরু করেছে, মুসলিমদের এই উপত্যকায় বেঁচে থাকাটাই দায় হয়ে যাবে।

প্রাদেশিক এবং কেন্দ্রীয় সরকার টের পেলো—বিরাট কিছু ঘটতে যাচ্ছে উপত্যকায়। কাশ্মীরি জনগণ সব মুসলিম ইউনাইটেড ফ্রন্টের পক্ষে। তার মানে ন্যাশনাল কনফারেন্সের হার নিশ্চিত। কিন্তু ভারতের স্বার্থ প্রতিষ্ঠার জন্য ন্যাশনাল কনফারেন্সকেই বিজয়ী করতে হবে। নয়ত কাশ্মীর হাতছাড়াও হয়ে যেতে পারে। তড়িঘড়ি করে জাতীয় নির্বাচন কমিটির প্রধান ন্যাশনাল কনফারেন্স এবং কংগ্রেসের প্রতি তার সমর্থন ঘোষণা করেন। এক গোপন মিটিংয়ে ফারুক আব্দুল্লাহকে প্রতিশ্রুতি দেন, ফ্রন্টকে পরাজিত করে দেয়া হবে।

জাতীয় নির্বাচন কমিটির এ ঘোষণাটিই ইঙ্গিত দিয়ে দেয়—নির্বাচনে গোলমাল হতে যাচ্ছে। কাশ্মীরি জনগণ ভেতরে ভেতরে ফুঁসতে থাকে। তাদের ভেতর দানা বাঁধতে থাকে বিদ্রোহের বীজ। এই সময় মুসলিম ইউনাইটেড ফ্রন্টের কয়েকজন কর্মীকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় পুলিশ। কারাগারে তাদের ওপর চলে নির্মম নির্যাতন। এদিকে ব্যাপক ভোট কারচুপি করে নির্বাচবে কং-কনফারেন্স জোট সরকারের তরফে মুখ্যমন্ত্রী হন ফারুক আব্দুল্লাহ।

কাশ্মীরি জনগণ বুঝে যায়, শাসন ক্ষমতায় তাদের কোনো অধিকার নেই। তাদের বঞ্চিত করতেই ভোটে কারচুপি করে ফারুক আব্দুল্লাহর হাতে তুলে দেয়া হয়েছে শাসনভার। শেখ আব্দুল্লাহ যেমন কাশ্মীরে ডেকে এনেছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনী, স্বার্থের টানে হাত মিলিয়েছিলেন নেহরুর সাথে, ঠিক তেমনি একটি বিভৎস কাজ করলো তার ছেলে ফারুক আব্দুল্লাহ। মুসলমানদের বিজয়ের পথ রুদ্ধ করে দিয়ে জিতিয়ে দিলো ভারতকে। নিজে সে জিতেনি, ব্যবহৃত হয়েছে কেবল।

কাশ্মীরের চারজন যুবক পরামর্শে বসেছে। তাদের সবার কপালেই চিন্তার ভাঁজ। এরা চারজনই নতুন অস্ত্রের ট্রেনিং নিয়ে এসেছে সীমান্তের ওপার আজাদ কাশ্মীর থেকে। তাদের চোখজুড়ে প্রতিশোধের আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। মৌনতা ভেঙে যুবনেতা এজাজ ডার বললো, ‘নির্বাচনের পর নির্বিচারে গ্রেফতার চলছে। ফ্রন্টের কর্মীদের ওপর চলছে জুলুম-নির্যাতন। আমাদের ভূমিতে ভারতীয়রা এসে এমন করছে—সহ্য হয় না।’

সালিম খান বললো, ‘সবচে বেশি বাড় বেড়েছে পুলিশ অফিসারটি।’

এজাজ ডার বললো, ‘নাম যেন কী তার।’

সালিম খান বললো, ‘আলী মুহাম্মাদ বাটালি।’

এজাজ ডার বললো, ‘পথ থেকে তাকে সরিয়ে দিতে হবে।’

সালিম বললো, ‘তাকে সরিয়ে দিলে তারচে ভয়ংকর কাউকে নিয়োগ দেবে কেন্দ্র।’

এজাজ আলী বললো, ‘তা ঠিক। কিন্তু একটাকে সরিয়ে দিলেই সবাই জানতে পারবে, কাশ্মীরিরা প্রতিরোধ শুরু করেছে।’

বাকি দুজন যুবকের চোখে-মুখে অচেনা এক আনন্দের আভাস দেখা যাচ্ছে। কাশ্মীরিদের পক্ষ থেকে সশস্ত্র আন্দোলনের সূচনা করতে যাচ্ছে তারা। ভাবতেই অদ্ভুত শীতল একটা শিহরণ বয়ে গেলো তাদের শিরায় শিরায়। তাদের একজন বলে উঠলো, ‘কাশ্মীরে ফারুক আব্দুল্লাহ তো অবৈধ। কারচুপি করে কেন্দ্র তাকে জয় দেখিয়েছে। নিজেদের বৈধ অধিকার খুঁজতে কিছু একটা করতে হবে। অবৈধ শাসকের পদপিষ্ট হওয়ার কোনো মানে হয় না।’

সায় দিলো সালিম। সঙ্গে মাথা নাড়িয়ে সমর্থন জানানো এজাজ ডার। সিদ্ধান্ত হলো—আলী মুহাম্মাদের বাড়িতেই আক্রমণ চালানো হবে। সালিম কপাল কুঞ্চিত করে বললো, ‘প্রথম আক্রমণে এত সাহস দেখানো ঠিক?’

এজাজ ডার বললো, ‘আমরা অগ্রগামী দল। আদর্শ তৈরী করছি। আমরা যা করছি, আমাদের পরে অনেকেই এটা করবে।’

এক যুবক বললো, ‘একদম।’

এজাজ ডার বললো, ‘হেলাল বেগ উপত্যকার যুবকদের সংগঠিত করছে। তাদেরকে রিক্রুট করে আজাদ কাশ্মীর পাঠাচ্ছে ট্রেনিংয়ের জন্য। তার মানে আমরা একা নই। আমরা সাহস দেখালে সবাই সাহসে উদ্দীপিত হবে।’

আলী মুহাম্মদের বাসবভনে রাত নয়টায় আক্রমণ চালালো চার যুবক। আক্রমণটা পরিকল্পনামাফিক যুতসই হয়েছিল। কিন্তু ভাগ্যগুণে বেঁচে গেলো পুলিশ অফিসার। সংঘর্ষে শাহাদাত বরণ করলো যুবনেতা এজাজ ডার। সালিম এবং এজাজ ডার একটা দেয়াল টপকাচ্ছিল। তখনই গুলিটা লাগে তার বুকে। সালিম আতঙ্কে ডাকলো, ‘ভাই।’

এজাজ ডার ক্রমশ নিভে যাওয়া কণ্ঠে বললো, ‘রক্ত দিয়ে বিপ্লবের চারাটা রোপণ করে গেলাম। শত্রুর হাত থেকে চারাটা রক্ষা করতে হবে তোমাদের। এই চারা আরও বড়ও করে তুলতে হবে, আরও বিস্তৃত আকার দিতে হবে।’

সালিম দেখলো রক্তে ভেসে যাচ্ছে এজাজের বুক। ফোয়ারার মতো বইছে লাল স্রোত। দু হাতে ফোয়ারার মুখ বন্ধ করতে করত সালিম বললো, ‘এই মাটি যখন শহীদের রক্তের স্পর্শ পেয়েছে, দেখবেন কেমন ঝড় উঠে। আমরা আমাদের স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনবোই। ইনশাআল্লাহ!’

এজাজ ডার মুখ নাড়লো। মনে হলো পড়লো লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলাল্লাহ।

সকালে হতেই উপত্যকায় আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়লো খবর। কাশ্মীরি যুবকেরা পুলিশ অফিসারের বাড়িতে ঢুকে আক্রমণ করেছে। সবকিছুই অবিশ্বাস্য লাগছিলো। ঠোঁট বাঁকিয়ে কেউ বললো ‘গুজব’। কপালে চোখ তুলে কেউ বললো ‘অসম্ভব’। কাশ্মীরি যুবকদের কী আছে? সত্যিই কি তারা আক্রমণ করেছে? কিন্তু ফরিদা মিটিমিটি হাসছে। সে ঠিকই জানে আক্রমণটা হেলাল বেগের পরামর্শ ক্রমেই হয়েছে। লোকমুখে হেলাল বেগের কথা ইতোমধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে।

হেলাল বেগ হেংলা-পাতলা একটা মানুষ। মনে হয় একটু জোরে বাতাস বইলেই মাটিতে উবু হয়ে পড়ে যাবে। কিন্তু তার ভেতর যে এত বারুদ জমা হয়ে আছে, এত সাহস টগবগ করছে—কেউ ধরতেও পারেনি। তার বাড়ি আলুচাবাগে। শৈশবে ফরিদা তার সঙ্গে অনেক আড্ডা দিয়েছে। তখন হেলাল ছিল লাজুক। তবে ফরিদার মনে হতো তার চেহারায় লুকোনো একটা সৌন্দর্য আছে। যে সৌন্দর্য প্রথম পলকেই ধরা পড়ে না। ধ্যানীর মতো অনেক্ষণ ধ্যান নিয়ে তাকিয়ে থাকলেই তবে ধরা পড়ে। হেলাল কখনো তার দিকে ধ্যানীর চোখে তাকায়নি। কিন্তু সে হেলালের দিকে তাকিয়েছে। তার সমস্ত ধ্যান নিয়ে। আজ হেলালের মুখটা মনের আয়নার ভেসে উঠতেই গর্বে বুকটা ফুলে উঠছে। লাজুক ছেলেটা উপত্যকার স্বাধীনতার দায়িত্ব হাতে নিয়েছে। বুকে কী গভীর সাহস পুষে আন্দোলন শুরু করেছে!

পুলিশ অফিসারের বাড়িতে হামলার দায়ে উপত্যকায় প্রশাসনের কড়াকড়ি শুরু হয়েছে। খুঁজে খুঁজে মুসলিম ইউনাইটেড ফ্রন্টের কর্মীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। একসময় পুলিশ হানা দেয় আলুচাবাগে, হেলাল বেগের বাড়িতে। হেলাল বেগ ততক্ষণে সটকে পড়েছে। আন্ডারগ্রাউন্ডে লা-পাত্তা হয়ে গেছে। তাকে ধরা পড়লে চলবে না। তাকে বেঁচে থাকতে হবে। তাকে না পেয়ে পুলিশ তার বৃদ্ধ মা-বাবাকে বেদম প্রহার করে। হেলালের বাবা তখন বললো, ‘পুরা কাশ্মীর তো আপনারা দখল করে রেখেছেন। সবখানেই আপনাদের কর্তৃত্ব। খুঁজে বের করুন। আমাকে বলে যায়নি হেলাল কই গেছে।’

হোমরা-চোমরা একটা পুলিশ হেলালের বাবার মুখ বরাবর একটা লাথি মারলো। বুটের আঘাতে তার ঠোঁট কেটে রক্ত পড়তে থাকে। চুয়ে চুয়ে। তিনি রক্ত মুছেন না। উবু হয়ে পড়ে থাকেন মাটিতে। তার রক্তাক্ত ঠোঁটের ছাপ পড়ে যায় মাটিতে। মনে হয় যেন তিনি তার রক্তাক্ত ঠোঁটে ইচ্ছে করেই চুমু খেলেন তার মানচিত্রে। আপন জন্মভূমিতে।

বেলাল কাজ করতো তার বোন জামাই মকবুল জানের কারখানায়। ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বরের কোনো একদিন। বেলাল তার ছোট ভাই ফিরোজের হাত দিয়ে একটি চিঠি পাঠালো বাড়িতে। চিঠি হাতে পাবার পর মাতম শুরু হয়ে গেছে আলুচাবাগের এই বাড়িটিতে। বাবা ইউসুফ বেগ আনমনা হয়ে গেছেন। মা সাঈদা বেগম মুখে আচল চাপা দিয়ে কান্না করছেন। শাকিল চিঠি পড়ে শুনালো—

‘মা, বাবা!

আমি ভারতের বিরুদ্ধে লড়াই করার লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ এক মিশনে যাচ্ছি। আপনারা আমাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করবেন না। আমি যে নিরুদ্দেশ, এই কথাও কাউকে জানতে দিবেন না। ইনশাআল্লাহ, আমি একমাস পর ফিরে আসবো।’

ইতি 

বেলাল বেগ

খবর পেয়ে ছুটে এসেছে ফরিদা। হেলাল বেগ বেলালকে আজাদ কাশ্মীরে পাঠাবে, এটা সে আগেই জানতো। কিন্তু বিভিন্ন কারণে বেলালের তারিখ পেছাচ্ছিলো। এবার হয়তো তারিখ হয়ে গেছে। সে বুঝতে পারছে, কাশ্মীরের স্বাধীনতা যুদ্ধে সে এবং তার পরিবার ক্রমশ জড়িয়ে যাচ্ছে। ইউসুফ বেগ তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘বেলাল আর ফিরবে?’

ফরিদা বললো, ‘ইনশাআল্লাহ। ফিরবে। তুমি চিন্তা করো না বাবা।’

‘চিন্তা তো হয়। খুব চিন্তা।’

‘বেলাল একা যায়নি। আরও অনেকে গেছে তার সঙ্গে।’

‘আরও অনেকে?’

‘হুম।’

‘তারা ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ করবে?’ ইউসুফ বেগের কপালে বিস্ময়।

ফরিদা বললো, ‘হুম। করবে। ভবিষ্যতে অনেক অসম্ভব সম্ভব হবে এই উপত্যকায়। এই তো শুরু।’

কিন্তু বাবা-মায়ের মন, উচাটন উচাটন। ছেলে যুদ্ধে গেছে ভাবলেই তারা কাতর হয়ে পড়েন। সমূহ বিপদের শঙ্কায় ভেঙ্গে পড়েন। আলুচাবাগে রাখা তাদের ঠিক হবে না। সারাদিন বসে বসে কান্না করবেন। তাই ফরিদা বাবা-মাকে তার নটিপুরার বাড়িতে নিয়ে এলো। কাছে থাকলে তাদেরকে অন্তত সান্ত্বনা দিতে পারবে। কিন্তু মেয়ের কাছে এসেও স্থির থাকতে পারলেন না সাঈদা বেগম। কিছুদিন যেতেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। প্রবল জ্বর তাকে ঘোরগ্রস্ত করে তুললো। চেতনে-অবচেতনে তিনি কেবল জপেন—’বেলাল! বেলাল!’

বেলালের মায়ের অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে লুকিয়ে দেখতে এলো হেলাল বেগ। সাঈদা বেগম আবেগ সংবরণ করতে পারলেন না। হেলালকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘মনে হচ্ছে আমি বেলালকে জড়িয়ে ধরেছি।’

হেলাল বললো, ‘আমিও তো আপনার সন্তান।’

সাঈদা বেগম বললেন, তা ঠিক। কিন্তু আমার ছেলে আসে না কেন? তাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে।’

হেলাল বললো, ‘আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। তাকে আমি আপনার বুকে ফিরিয়ে আনবো।’

সাঈদা বেগম হেলালের মাথায় আলতো করে চুমু খেয়ে বললেন, ‘তাড়াতাড়ি নিয়ে এসো।’

হেলাল বললো, ‘আপনার এক  ছেলে আপনার আরেক ছেলেকে অবশ্যই আপনার কোলে ফিরিয়ে আনবে।’

কিছুদিন পর শোনা গেলো বেলাল ফিরে এসেছে। ভাইকে দেখার জন্য ফরিদা পাগল হয়ে আছে। কিন্তু বেলাল বাড়ি না এসে কোথায় গেলো। কেউ সঠিক তথ্য দিতে পারছে না। তখন খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন সাঈদা বেগম। একমাস পেরিয়ে যাবার পরও বেলাল আসছে না দেখে আরও উতলা হয়ে উঠেছেন তিনি। ভাইয়ের খোঁজে না বেরিয়ে ফরিদা তার মাকে নিয়ে বের হলো হাসপাতালে উদ্দেশ্যে।

পথে এক জায়গায় ফরিদার ট্যাক্সিকে ঘিরে ধরে চারটি ট্যাক্সি। আঁৎকে উঠে ফরিদা। গ্রেফতারের ভয়ে চারদিকে মানুষ এমনিতেই তটস্থ হয়ে আছে। এই পরিস্থিতিতে যে কেউ আঁৎকে উঠবে। কিন্তু একটু পরই ভয় কেটে গেলো ফরিদার। সামনের একটা টেক্সি থেকে বেরিয়ে এলো বেলাল, আলতাফ, মুশতাক, শাহীন। বেলালকে দেখতেই সাঈদা বেগম ঝড়ের গতিতে ট্যাক্সির দরজা খুলে বেরিয়ে যান। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে শুরু করেন। বেলাল বললো, ‘রাস্তায় এমন করলে লোকে সন্দেহ করবে। বাড়ি চলো। আমরাও বাড়ি আসছি।’

ফরিদার আজ খুশীর অন্ত নেই। আনন্দে তুলার মতো তার উড়তে ইচ্ছে করছে। তার ঘরে বসে আছে কাশ্মীরের সশস্ত্র কয়েকজন যুবক। স্বাধীনতার জন্য যারা জীবন উৎসর্গ করতে চাইছে। বেলাল, হেলাল, আলতাফ খান, ওমর মুখতার, শাহীন, মুশতাক, শাহীন, নেসার জোগি। বেলাল সদ্যই ‘স্টুডেন্টস লিবারেশন ফ্রন্টে’র দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। তার একটা আস্তানা দরকার। নির্বিঘ্ন, নিরাপদ।

ফরিদা বললো, ‘আজ থেকে আমার ঘরই আপনাদের প্রধান কার্যালয়।’

হেলাল বললো, ‘আপনি আমাদের ‘বেহেনজি’। আপনার ঘর কার্যালয় হলে মন্দ হয় না।’

ফরিদা হাসলো, ‘তাহলে আজ থেকে আমি আপনাদের বহেনজি। যখন যা প্রয়োজন হবে, চেয়ে নিবেন। আমার ঘর আমি মুজাহিদদের জন্য ওয়াকফ করে দিলাম।’

নটিপুরার এই বাড়িতে শুরু হয়ে যায় কাশ্মীরের মুজাহিদদের আনাগোনা। ফরিদা এখন মুজাহিদদের বহেনজি। এলাকার মানুষজনও ধীরে ধীরে যুক্ত হতে থাকে স্বাধীনতার এই আন্দোলনের সঙ্গে। সাহস বাড়তে থাকে তাদের। মসজিদে মসজিদে স্বাধীনতার স্লোগান উঠে। একদিন নটিপুরা, দেলসুজ কলোনি এবং আবাদ বস্তির  বিপুল সংখ্যক লোক স্বাধীনতার স্লোগান দিয়ে বেরিয়ে আসে রাস্তায়। ফরিদাও বেলাল এবং নেসার জোগির সঙ্গে শামিল হয় এই মিছিলে।

বেলাল বললো, ‘আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না, স্বাধীনতার জন্য এত লোক নেমে এসেছে পথে।’

নেসার জোগি বললো, ‘আমারও বিশ্বাস হচ্ছে না। এত তাড়াতাড়ি এক লোক আমাদের ডাকে সাড়া দিবে।’

বেলাল বললো, ‘এখন ফিরে যাবার পথ নেই।’

নেসার জোগি বললো, ‘স্বাধীনতার জন্য এখন আমাদের শুধু এগিয়ে যেতে হবে।’

বেলাল বললো, ‘একদিন এই স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে যাবে অনাহুতদের। অনেক দূরে, অনেক দূরে।’

নেসার জোগি তার হাতের রাইফেলটি উর্ধ্বে তুলে ধরে। রাইফেলের বাট আকাশমুখী দেখে ঝাঁঝালো স্লোগানে ফেটে পড়ে মিছিল। চিকমিক করতে থাকে রোদ্দুর। শাঁইশাঁই করতে থাকে হাওয়া। জোগি আনন্দের আতিশয্যে খোলা আকাশে কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুড়ে। অমনি উচ্ছ্বসিত জনতা তাকে কাঁধে তুলে নেয়। একটা ঢেউ আছড়ে পড়ে কাশ্মীরের পথে পথে—আজাদী, আজাদী। এই আবেগঘন দৃশ্য দেখে ফরিদার চোখে জল এসে যায়। তার স্বপ্নের মতো লাগে সব। কেমন বাস্তব, কেমন সুন্দর। জলে ভেজা ঝাপসা চোখ বোরকার ওড়না দিয়ে মুছতে শুরু করে ফরিদা।

খবরটা এলো সন্ধ্যায়। মাগরিবের একটুখানি আগে। ফরিদা ইফতারি সাজিয়ে বসেছে তখন। আজ রান্না হয়েছে মকবুল জানের সবচে পছন্দের খাবার ‘কাশ্মীরি খিচুরি’। ফরিদার হাতের খিচুরী নাকি অমৃতের মতো লাগে। এই সময় হেলাল এসে বললো, ‘নেসার জোগিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।’

বিচলিত হয়ে ফরিদা বললো, ‘তাহলে?’

হেলাল সান্ত্বনা দিয়ে বললো, ‘বিচলিত হবেন না। আমরা জোগিকে ছাড়িয়ে আনবো।’

ফরিদা প্রশ্ন করলো, ‘কীভাবে?’

ফরিদার প্রশ্নটি এড়িয়ে গেলো হেলাল বেগ। তবে মুচকি হেসে বললো, ‘আমি বলতে হবে না। কিভাবে ছাড়িয়ে আনবো কয়েকদিন পরই জেনে যাবেন।’

কয়েকদিন পর পত্রিকায় খবর এলো—কাশ্মীর ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর মুশিরুল হক, তার প্রাইভেট সেক্রটারী আবদুল গণি এবং এইচএমটির জেনারেল ম্যানেজার খিড়া অপহৃত হয়েছেন। খবরটি দেশের সংবাদপত্র নয় কেবল, বিদেশি সংবাদপত্রেও ফলাও হয়। প্রশাসনে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। চারদিক থেকে অপহৃতদের উদ্ধারের দাবি জানানো হয়। কাশ্মীরের সশস্ত্র সংগ্রামে অপহরণের ঘটনা এই প্রথম। কাশ্মীরে কেন্দ্রীয় সরকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এই ঘটনা কেউ ঘটাতে পারে, কারও কল্পনায়ও ছিলো না। খবরটি পড়ে ফরিদা ভাবতে থাকে, এই অপহরণের কথাই লুকাচ্ছিলো হেলাল বেগ?

অপহরণের দায় স্বীকার করে ‘স্টুডেন্টস লিবারেশন ফ্রন্ট’। তারা এর বিনিময়ে নেসার জোগি, গোলাম নবি ভাট এবং ফাইয়াজ আহমাদের মুক্তির দাবি জানায়। পুলিশ সংগঠনের দায়িত্বশীলদের গ্রেফতার করতে মরিয়ে হয়ে উঠে। পরিস্থিতির ভয়াবহতা আঁচ করে ফরিদা তার ছেলে মেয়েদের নিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যায়। পুলিশের চোখে পড়ে যায় নটিপুরার এই বাড়ি। বাড়িতে কাউকে না পেয়ে পুলিশ হানা দেয় ফরিদার বাবার বাড়ি আলুচাবাগে। তার বাবা-মা, ভাই-বোনদের ওপর শুরু করে নির্যাতন।

রাজ্যপাল জগমোহন মালব্য মুজাহিদদের সঙ্গে কোনোভাবেই আপসে যেতে চাইছেন না। তিনি মূলত চাইছেন কান টেনে মাথা টানতে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাই মুজাহিদদের পরিবারের ওপর নির্যাতন চালানোর নির্দেশ দেন তিনি। পাশাপাশি উপত্যকায় জোরদার করেন নজরদারি। তার নিশ্ছিদ্র নজদারির কারণে মুজাহিদদের চলাফেরায় ব্যাপক বিঘ্ন ঘটতে থাকে। মুজাহিদরাও হুমকি দেয়, যদি দাবি পূরণ না করে বন্দী মুজাহিদদের মুক্তি দেয়া না হয়, অপহৃতদের হত্যা করা হবে।’

কিন্তু প্রশাসন যখন নমনীয় হচ্ছে না, পুলিশের নজদারিতে তারাও কিছু করতে পারছে না, বাধ্য হয়ে তখন অপহৃতদের ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় মুজাহিদরা। তারা খিড়াকে ছেড়ে দিয়ে আসে বটামালনা নামক স্থানে। পোশাক পাল্টিয়ে তাকে মুক্তি দেবার সময় বলে দেয়া হয়, পুলিশ কন্ট্রোল রুমে গিয়ে বলবেন, জঙ্গল থেকে অপহরণকারীদের আস্তানা থেকে পালিয়ে এসেছেন। খিড়া কন্ট্রোল রুমে না গিয়ে পাশ্ববর্তী একটি টহল বাহিনীর কাছে নিজের পরিচয় দেন। টহলবাহিনী ওয়ারলেস তুলে হেডকোয়ার্টারে সংবাদটি জানায়। রিপ্লাই পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা খিড়াকে গুলি করে হত্যা করে।

পুলিশের হাতে খিড়ার নিহত হওয়ার সংবাদ পেয়ে বিচলিত হয়ে পড়ে মুজাহিদরা। তার টের পেয়ে যায়, জগমোহন মালব্য কঠিন ষড়যন্ত্র করছে। যেহেতু হত্যার হুমকি দিয়েছিলো লিবারেশন ফ্রন্ট, জগমোহন এই হত্যার দায় চাপাবে মুজাহিদদের ওপর। ওদিকে অন্য জায়গায় ছেড়ে দিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে মুশিরুল হক ও তার প্রাইভেট সেক্রেটারিকে। যদি মুসলিম দুজন বেঁচে থাকে, খিড়ার নিহতের ঘটনায় নিশ্চিত দাঙ্গা বেঁধে যাবে। জগমোহন দাঙ্গা বাঁধাতে উসতাদ। মুজাহিদরা খবর পাঠায় অপর দুজনকেও হত্যা করে ফেলতে। কিন্তু যতক্ষণে খবর পৌঁছেছে, তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। তবে দাঙ্গা বাঁধার মতো কিছু হয়নি। জগমোহন অপর দুজনকেও হত্যা করে ফেলে।

নেসার জোগি কিংবা অন্য কারও মুক্তি হলো না। জগমোহনের চালে ব্যর্থ হলো মুজাহিদদের প্রথম অপহরণ। অপহৃতদের খুন করলো সরকার, কিন্তু দায় চাপানো হলো মুজাহিদদের ওপর। হেলাল বেগের মনটা একটু খারাপ। তবে তিনি আশাহত নন। গোপন ডেরায় এসে দেখে বেলালও বসে আছে গালে হাত দিয়ে।

হেলাল বললো, ‘তাদেরকে সাংবাদিকদের হাতে তুলে দিলে ব্যাপারটা এমন হতো না। বরং আরও জমতো বেশি।’

বেলাল মাথা নাড়লো, ‘আসলে জগমোহন এমন একটা চাল চালবে, আমরা বুঝতেই পারিনি।’

হেলাল বললো, ‘আরও সতর্ক হতে হবে আমাদের।’

বেলাল বললো, ‘জগমোহনের প্রতিও ‍বিশেষ নজর রাখতে হবে। দেখলেন, কিভাকে দান উলটে দিলো?

হেলাল বললো, ‘চ্যালেঞ্জ একটু বেড়ে গেলো আরকি!’

কাশ্মীরজুড়ে নেমে এলো পিনপতন নীরবতা। ঝড়ের পর যেমন শান্ত হয়ে যায় পরিবেশ। ফরিদা নটিরাপুরায় ফিরে এলো। ফরিদার বাড়ি আবার জমতে শুরু করলো। প্রতিদিনই বিশ-বাইশজন মুজাহিদের রান্না করতে হতো ফরিদার। যে পাতিলে মুজাহিদদের জন্য রান্না করা হয়, তার নাম রাখা হয় ‘জান বাবা পাতিল’। হেলাল একদিন খেতে বসে জিজ্ঞেস করলো, ‘বহেনজি, পাতিলের এই নাম কেনো?’

ফরিদা হেসে বললো, ‘জান বাবা নামে একজন বুজুর্গ ছিলেন। তার খানকায় নাকি সবসময় লঙ্গরখানা চালু থাকতো। আমিও যেহেতু মুজাহিদদের সেবা করছি, তাই এই নাম।’

হেলাল টিপ্পনি কাটলো, ‘তার মানে আমরা লঙ্গরখানায় খাচ্ছি?’

ফরিদা বললো, ‘না। তোমরা তোমাদের বহেনজির বাড়িতে খাচ্ছো।’

হেলাল বললো, ‘বহেনেজির রান্না কিন্তু দারুণ। একবেলা খাবারের স্বাদ দিয়ে কয়েকবেলা  অনায়াসে পার করে দেয়া যায়।’

১৯ জানুয়ারি, ১৯৯০। রাজ্যপাল জগমোহন মালব্যের অফিসের সামনে এসে একটি গাড়ি থামলো। মাঠে এসে গাড়িটা থামতেই অফিসের সবগুলো লাইট জ্বালিয়ে দিলো কেরানি। জগমোহন বাইরে এসে দেখেন, কাশ্মীরের কয়েকজন পন্ডিত নেতা গাড়ি থেকে নামছেন। দরজায় দাঁড়িয়ে লম্বা আদাব জানালেন জগমোহন। অভিবাদন জানিয়ে বললেন, ‘এতক্ষণ আপনাদের অপেক্ষায় ছিলাম। আসুন আসুন।’

পন্ডিত নেতা আচার্যের মুখে বিস্তৃত একটা হাসি ফুটে উঠলো। গলা বেয়ে পড়া উত্তরীটা কাঁধে রাখতে রাখতে তিনি বললেন, ‘আপনি ডাকবেন, আমরা আসবো না, তা হয় নাকি?’

জগমোহন ওজরখাহি করে বললেন, ‘বিষয় সেটা না। গুরুত্বপূর্ণ আলাপ বলে ডেকেছি।’

পন্ডিতদের নিজের অফিস রুমে নিয়ে বসালেন জগমোহন। গুরুত্বপূর্ণ আলাপ শুনার জন্য উসখুস করছেন পন্ডিতগণ। সবার সামনে এক কাপ করে চা দেয়া হয়েছে। চায়ে আদা একটু বেশি। চুমুক দিয়েই আচার্য বললেন, ‘দারুণ টেস্ট!’

জগমোহন হাসলেন, ‘পৃথিবী উলটে গেলেও, আপনাদের মূল্যায়ন আমরা করি। আপনাদের পছন্দ-অপছন্দের খোঁজ আমাদের রাখতে হয়।’

আচার্য বললেন, ‘গুরুত্বপূর্ণ আলাপটা করে ফেলেন।’

জগমোহন ঝট করে বললেন, ‘কাশ্মীর ছেড়ে পন্ডিতদের চলে যেতে হবে।’

এক পন্ডিত আরেক পন্ডিতের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করছেন। তারা কি সত্যিই শুনেছেন? নাকি বিভ্রম? সবার বিস্মিত মুখ দেখে জগমোহন বললেন, ‘কাশ্মীরে স্বাধীনতাকামী মুসলিমদের দমন করতে ভারতীয় সেনারা বড় অভিযান পরিচালনা করবে। এ সময় আপনাদের নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব নয়। তাই সরে পড়াটাই সবচে যুক্তিযুক্ত।’

আচার্য বললেন, ‘উপত্যকায় এক লাখ চল্লিশ হাজারের মতো পন্ডিত আছেন। তারা একসঙ্গে কিভাবে উপত্যকা ছেড়ে যাবে?’

জগমোহন বললেন, ‘নগদ টাকা এবং বিভিন্ন সুযোগ দেয়া হবে আপনাদের। সময় হলে আপনাদেরকে আবার আমরাই ফিরিয়ে আনবো। তবে এখন আপনাদের যেতে হবেই।’

অফিসের গোপন সেই মিটিংয়ে পন্ডিতদের কাশ্মীর ত্যাগ করতে রাজি করায় জগমোহন। পরদিন স্থানীয় একটি দৈনিকে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। নামহীন, ঠিকানাহীন। বিজ্ঞপ্তিতে লেখা—’পন্ডিতরা কাশ্মীর ছাড়ো। নয়ত তোমাদের হত্যা করা হবে।’ চতুর জগমোহন ছড়িয়ে দিলেন বিবৃতি দিয়ে, এই বিজ্ঞপ্তি মুজাহিদদের। প্রশাসনের সঙ্গে না পেরে তারা পন্ডিতদের হত্যায় উস্কানি দিচ্ছে। পন্ডিতদের জন্য নিরাপদ নয় এই উপত্যকা। বিবৃতি দিয়েই ক্ষান্ত হননি। ঝটপট খুলে ফেলেন ত্রাণ শিবির। ঘোষণা করেন, যেসব পন্ডিত বিপদ বোধ করছেন, তারা শিবিরে এসে থাকতে পারেন। চাকরিরত পন্ডিতরা শঙ্কাবোধ করলে স্টেশন ছেড়ে চলে যেতে পারেন। বেতন ঠিকভাবে দেয়া হবে।

জুজুর ভয় পেয়ে বসে পন্ডিতের। যতটা না পরিস্থিতি দেখে, তারচে বেশি আয়োজন দেখে তারা ভয় পেয়ে যায়। নটিপুরায় ফরিদার বাড়ির নিকটেই একজন পন্ডিত থাকতেন। নাম সঞ্জয় টিকুর। এক সকালে ঘুম থেকে উঠে তিনি দেখলেন তার দরজায় উর্দুতে কী যেন লেখা। তিনি তার দাদুকে ডাকলেন। দাদু চশমাটা লাগিয়ে পড়লেন, ‘কাশ্মীর ছাড়ো। নয়ত হত্যা করা হবে।’

দরজায় হুমকি দেখে ভয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে পন্ডিত টিকুর পরিবার। তারা তাদের সবকিছু গোছাতে শুরু করে। খবর পেয়ে ফরিদা দৌড়ে এলো। তার সঙ্গে এলো পাড়ার আরও কয়েকজন মুসলমান। ফরিদা বললো, ‘আমরা কখনো আপনাদের ওপর জুলুম করেছি?’

টিকুর দাদু বললেন, ‘না। কখনও না।’

ফরিদা বললো, ‘তাহলে চলে যাচ্ছেন কেনো? আমরা এই হুমকি দেইনি। কাশ্মীর তো আপনাদেরও। ছেড়ে যাবেন কেন?’

টিকুর দাদু উত্তর খুঁজে পেলেন না। তাইলে এই হুমকি কে দিলো। তিনি মাথা চুলকালেন। ফরিদা বললো, ‘আপনারা থাকুন, কোথাও যাবেন না। আমাদের মতো আপনারাও থাকবেন।’

টিকুর দাদু বললেন, ‘পরে সমস্যা হলে?’

ফরিদা বললো, ‘তার সব দায় আমাদের। আপনাদেরকে কাশ্মীরে রাখার জন্য আমরা যতটুকু সম্ভব করবো।’

টিকুর দাদু বিনীত হয়ে বললেন, ‘তাহলে আমরা থেকে যাচ্ছি।’

টিকুর পরিবার থেকে গেলো ঠিক। কিন্তু এই ভয়, হুমকি ছড়াচ্ছে কারা? ফরিদা চিন্তায় পড়ে যায়। তার মনে হয় জগমোহন নতুন কোনো চাল চালছে। যেভাবে অনন্তনাগে নিজেরা মন্দিরে হামলা করে মুসলমানদের ওপর দোষ চাপিয়েছিলো। রাগে কখনো হয়তো মুসলিমরা হিন্দুবিরোধী স্লোগান দেয়। তাই বলে উপত্যকা ছেড়ে যাবার মতো অবস্থা তো হয়নি। বিষয়টা খতিয়ে দেখা দরকার। মানুষকে বুঝাতে হবে, এই হুমকি মুসলিমরা দিচ্ছে না। দিচ্ছে কুচক্রী কোনো মহল।

চিন্তাটা প্রথম বেলালের মাথায় আসে। জম্মু-কাশ্মীর সরকারের বরিষ্ঠ অধিকারিক ওয়াজাহাত আব্দুল্লাহ। তিনি অনন্তনাগে স্পেশাল কমিশনার হিসেবে কর্মরত। তার দফতরের সামনে গিয়ে আমরা একটা মানববন্ধন করবো। আমাদের দাবি থাকবে—পন্ডিতদের এখানেই রাখতে হবে। তাদের নিরাপদ রাখতে সরকারকেই। মুসলিমদের পক্ষ থেকে কোনো হুমকি দেয়া হয়নি। আর পন্ডিতদের তাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে ঢালাওভাবে মুসলিমদের ওপর হামলা চালানোর জন্য।

১৯৯০ সালের মার্চ মাসের এক মধ্যদুপুর। কয়েকশ মানুষ নিয়ে স্পেশাল কমিশনারের দফতরে যায় মুসলিমদের একটি দল। দলটির পরিচালক মুজাহিদরা হলেও সামনে রাখা হয় সাধারণ মানুষদের। পন্ডিতদের স্বপক্ষে দাবি পেশ করা হয়। দাবির প্রেক্ষিতে কমিশনার জগমোহনকে আবেদন করেন, কাশ্মীরে পন্ডিতদের থেকে যাওয়ার জন্য বলা হোক। তাদেরকে নিরাপদ বসবাসের আশ্বাস দেয়া হোক। কিন্তু জগমোহন এমন কোনো ঘোষণা দেননি। বরং কাশ্মীর ত্যাগ করতে পন্ডিতদের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করেছেন। ত্রাণ শিবির খুলে কাশ্মীর ত্যাগে উৎসাহ যুগিয়েছেন। ফলে রাস্তায় রাস্তায় দেখা যায় পন্ডিতদের দল। নিজের আবাসভূমি ছেড়ে পাড়ি জমাচ্ছে অনিশ্চিত এক গন্তব্যে। কেউ জুজুর ভয়ে, কেউ রাজ্যপালের ধমকে। যেতে যেতে পেছন ফিরে দেখছে। বেদনার জলে বিদায় জানাচ্ছে একটু একটু করে গড়ে তোলা আপন জন্মভূমি।

হেলাল দৌড়াচ্ছে। তার পেছনে দৌড়াচ্ছে কয়েকজন পুলিশ। মার্চের কনকনে শীত, তার ওপর পায়ে লেগেছে গুলি। কিন্তু তবুও দৌড়াতে হচ্ছে। পুলিশের হাতে ধরা দেয়া যাবে না।

কিছুদিন ধরেই নটিরাপুর এলাকায় ব্যাপক নজরদারি করছে প্রশাসন। ফরিদার বাড়িটা সবসময় ট্রিগারের টার্গেটে। দিনে থাকতে পারলেও রাতেই বাড়িতে থাকা যায় না। ফরিদা রাত কাটাতে চলে যায় এক প্রতিবেশীর বাড়িতে। মকবুল তার ছেলেকে নিয়ে চলে যায় আরেক বাড়িতে। আজও ফরিদা প্রতিবেশীর বাড়িতেই ছিলো। হৈ হৈ শুনতে পেয়ে জানলা খুলে তাকালো। দৃশ্যটা দেখতে পেয়ে তার রক্ত হিম হয়ে গেলো।

গুলিবিদ্ধ পা টানতে টানতে একটা দেয়াল টপকে বাড়ির ভেতরে পড়লো হেলাল। চারদিকে শোরগোল পড়ে গেছে—নটিপুরা এলাকা পুরাটাই ঘিরে রেখেছে পুলিশ। বাড়ি বাড়ি তল্লাশি করছে। ফরিদা ঝট করে বাইরে বেরিয়ে এলো। হেলালকে টেনে ঘরে এনে শুইয়ে দিলো। হেলালের পা থেকে রক্ত পড়ছে। এভাবে রক্ত ঝরতে থাকলে বেশিক্ষণ টিকবে না। ঘরেও গুলি খোলার কোনো যন্ত্র নেই। ফার্স্ট এইডও নেই সঙ্গে। বাইরে পুলিশের তল্লাশি। ঘরে ডাক্তার আনতে গেলেও বিপদ। কিন্তু এই সময় বিপদের কথা ভেবে বসে থাকলে চলবে না। প্রথমে হেলালের পায়ে মোটা একটা কাপড় বেঁধে দিলো ফরিদা। তারপর বোরকা পড়ে বেরিয়ে গেলো।

ডাক্তার নিয়ে ফিরে এলো ফরিদা। সে তাকিয়ে দেখলো ডাক্তার হেলালের পা থেকে বুলেট খুলছেন। চিৎকারের যেন শব্দ না হয়, তাই নিজের মুখে নিজেই কাপড় ঢুকিয়ে দিয়েছে হেলাল। ডাক্তার যখন বুলেট খুলছেন, পুলিশ বাড়ি বাড়ি তন্ন তন্ন করে হেলালকে খুঁজছে। একটু শব্দ হলেই বুকটা কেঁপে উঠছে। এই বুঝি পুলিশ হামলে পড়লো। হেলালের কষ্ট দেখে তারও প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে। গুলি খোলা শেষ হলে হেলাল ডাকলো, ‘বহেনজি।’

ফরিদা বললো, ‘এইতো আমি।’

হেলাল ক্লিষ্ট কণ্ঠে বললো, ‘আপনাকে ধন্যবাদ। আমাকে বাঁচানোর জন্য।’

ফরিদা মুচকি হাসলো, ‘আপনাকে বাঁচানোটা আমার কর্তব্য। ডাক্তারও ধন্যবাদ পাবার যোগ্য। রিস্ক নিয়ে চিকিৎসা দিতে এসেছেন।’

হেলাল ম্লান হেসে বললো, ‘স্বাধীনতার জন্য যেন কাজ করতে পারি,  আল্লাহ তাই আমাকে আজ বাঁচিয়ে দিয়েছেন।’

প্রশাসন, সরকার, পুলিশ, আর্মি সব অফিসে ফরিদা বেগম ‘বহেনজি’ নামে পরিচিত হয়ে গেলেন। কিন্তু নাম চিনলেও চেহারা কেউ চিনতো না। শ্রীনগরের ছোটবড় অনেক ডাক্তার বেহেনজির ডাক শুনলেই ছুটে আসে। বিভিন্ন হাসপাতালের সঙ্গেও সম্পর্ক হয়েছে বেহেনজির। পুলিশের ইন্টারোগেশন থেকে যারা মুক্তি পেতো, তাদের ভর্তি করানো হতো কেন্দ্রীয় পঙ্গু হাসপাতালে। পুলিশি নির্যাতনে গুপ্তাঙ্গ যাদের ক্ষতিগ্রস্ত হতো, তাদের ভর্তি করা হতো এইচএস হাসপাতালে। ইন্টারোগেশনের সময় প্রায়ই নির্যাতন করা হয়। এ সময় হৃদপিণ্ডে যাদের আঘাত লাগতো, তাদের ভর্তি করা হতো সুরা মেডিকেল ইনস্টিটিউটে। বিচারাধীন মুজাহিদদের জন্য নিয়োগ দিতে হতো উকিল। এ ক্ষেত্রে বেহেনজির পাশে দাঁড়ায় বার এসোসিয়েশন। কাশ্মীরের স্বাধীনতা আন্দোলনে যে যেখান থেকে পারছে, সাহায্য করছে মুজাহিদদের। ফরিদা হাত তুলে সবার জন্য দোয়া করে।

কিছুদিন পর পুলিশ গ্রেফতার করে ফরিদার বড় ছেলে মুদ্দাসিরকে। হেলাল বেগের সন্ধান বের করার জন্যই তাকে গ্রেফতার করা হয়। ইন্টারোগেশন রুমে ঢুকতেই ভয়ে গাটা কেমন ছমছম করে উঠলো তার। শুরুতেই তার পাজামা খুলে ফেলা হলো। পাজামার ফিতা দিয়ে পিঠমোড়া করে বাঁধা হলো দু হাত। চোখ দুটো বেঁধে দেয়া হলো কালো একটি কাপড় দিয়ে। তারপর পুলিশ ফুটবলের মতো তাকে পা দিয়ে শট দিতে থাকে। দেয়ালের সঙ্গে মাথাটা ধাক্কা লাগতেই মুদ্দাসির বিকট এক চিৎকার দেয়। তার মনে হতে থাকে মাথা ফেটে বেরিয়ে এসেছে মস্তক।

পুলিশ জিজ্ঞেস করলো, ‘মজা লাগছে?’

মুদ্দাসির বললো, ‘আমি ছোট। আমি ছাত্র। আমাকে ছেড়ে দিন।’

পুলিশ মুদ্দসিরকে ধরে বিদ্যুতের শক দিলো। মুদ্দাসির আবারও বিকট চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারালো। যখন জ্ঞান ফিরলো, দেখলো মাথায় বন্দুকের নল ঠেকিয়ে একজন বলছে, শালা, ঢং করছে! পিপাসায় মুদ্দাসিরের তখন ছাতি ফেটে যাচ্ছে। ইশারায় সে দেখালো জল খাবে। পুলিশ একটা লোটা এগিয়ে বললো, ‘এই নে পানি।’ মুদ্দাসির গলগল করে পান করতে লাগলো। কিন্তু পানিটা মুখে দিতেই কেমন গরম এবং নোনা নোনা লাগছে। দুর্গন্ধটাও কেমন বিভৎস। নাড়িভুড়ি সব যেন উলটে আসতে চাইছে। সে বুঝতে পারে, এটা পানি নয়, প্রস্রাব। প্রস্রাব খেতে অস্বীকার করায় দুজন ধরে তাকে শুইয়ে দিলো। সাদা একটা পাউডার ছিটিয়ে দিলো তার শরীরে। সঙ্গে সঙ্গে ফোসকা পড়ে ঝলসে গেলো শরীর। মুদ্দাসির গলাকাটা মুরগির ন্যায় লাফাতে থাকে। একসময় কেমন বিভ্রমের মতো লাগতে শুরু করে সবকিছু।

মুদ্দাসির হেলালের খোঁজ কখনোই দিবে না। কিন্তু সবধরণের চেষ্টাই করে যাচ্ছে প্রশাসন। এবার তাকে পা বেঁধে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। মুখের নিচে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে স্টোভ। গরমে মনে হচ্ছে মস্তিষ্ক গলে যাবে এখুনি। মুদ্দাসির আশা হারিয়ে ফেলে জীবনের। তার চোখের সামনে এখন মৃত্যুর হাতছানি। তার গায়ে সুঁই ফোটানো হচ্ছে। চিৎকার করতে করতে আর আওয়াজ বেরুচ্ছে না মুখ দিয়ে। শুধু একটা ভয়ংকর গোঙানি ইন্টারোগেশন রুমে বড় করুণ হয়ে বাজছে।

একদিকে হেলাল গুলিবিদ্ধ। সেরে উঠেনি এখনো। অন্যদিকে ইন্টারোগেশন রুমে নির্যাতনের তীব্রতায় কাতর ধ্বনি করছে মুদ্দাসির। অবশেষে মুদ্দাসিরের মুক্তির ব্যবস্থা করা হলো ১৫ হাজার টাকার মাধ্যমে। টাকার বিনিময়ে মুক্তির ব্যবস্থা করে দেন আর্মি, বিসিএফ এবং সিআরপির কমিশন এজেন্ট নাজির সিদ্দিকী। সেল থেকে সরাসরি হাসপাতালে নেয়া হলো মুদ্দাসিরকে। দীর্ঘ এক মাস হাসপাতালের চিকিৎসা শেষ করে বাড়ি ফিরে মুদ্দাসির।

অনেকদিন হলো স্বামী সন্তানদের সঙ্গে রাত কাটায় না ফরিদা। উড়ে বেড়ানো এই দিনগুলো কেমন কেমন লাগছে। ভয়ে আতঙ্কে বিবর্ণ লাগছে সবকিছু। মুদ্দাসির বাড়ি ফিরে এসেছে। ফরিদা মকবুল জানকে বললো, ‘কয়েকদিন হলো পুলিশ হানা দিচ্ছে না। আজ থেকে যাও ঘরে।’

মকবুল জান বললো, ‘তুমি বললে থেকে যাই।’

ফরিদা বললো, ‘আমিই তো বলছি।’

রাত তখন একটা। লাইট বন্ধ করে মাত্রই শুয়েছে ফরিদা। মাথা ব্যথায় তার ঘুম আসছে না। এমন সময় সিঁড়িতে অকস্মাৎ শোনা গেলো বুটের শব্দ। শব্দগুলো দরজার কাছে এসে থামলো। দরজায় ধাক্কা দিয়ে বললো, ‘দরজা খোলেন।’

ধক করে উঠে ফরিদার বুক। এতদিন কাউকে কাছে রাখেনি। আজ রেখেছে, আজই এসে হাজির ফোর্স। ফরিদা সবাইকে সতর্ক করে দরজা খুলে দিলো। ঘরে ঢুকেই পুলিশ কজন হামলে পড়ে মকবুল এবং মুদ্দাসিরের ওপর। বন্দুকের নল দিয়ে আঘাত বসায় মুদ্দাসিরের ঘাড়ে। কাটা গাছের মতো পড়ে যায় সে। আরেকজন লাথি মারে ফরিদার কোমর এবং পিঠ বরাবর। ঘুষি বসায় বুকের মধ্যখানে। ফরিদা ঢলতে ঢলতে পড়ে গেলো মাটিতে।

মকবুল জানের ওপর এলোপাথাড়ি নির্যাতন চালায় নেশাগ্রস্ত পুলিশ কজন। রক্তবমি হতে শুরু করে মকবুলের। ফরিদা মকবুল জানকে বিছানায় শুইয়ে দেয়। অফিসার জিজ্ঞেস করে, হেলাল বেগ কই?

ফরিদা বললো, ‘আমরা জানি না।’

‘তোরা সবই জানিস।’

‘সারা ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজুন। পেলে নিয়ে যান।’

‘খুঁজবো। তবে এখানে না পেলে কিন্তু বলতে হবে কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস।’

‘না লুকিয়ে থাকলে বলবো কী করে?’

‘বলতে হবে।’

হেলালকে না পেয়ে মকবুল জানকে নিয়ে যেতে চায় অফিসার। ফরিদা পথ আটকে দাঁড়ায়। বাঘিনির মতো চোখ বড় করে বলে, ‘নিলে সবাইকে নিয়ে যাও। একজনকে নিয়ে যেতে পারবে না।’ মকবুল জান আবার রক্তিবমি করতে শুরু করে। সঙ্গে শরীরে কাঁপন উঠতে থাকে ক্রমাগত। অবস্থা বেগতিক দেখে সিপাহিদের নিয়ে চলে গেলো অফিসার। হেলাল তখন উপর তলায়, তার গোপন ডেরায় বসে ছিলো।

হেলাল এসে ক্ষমা চেয়ে বললো, ‘আমার জন্য এত কষ্ট হচ্ছে আপনাদের।’

মকবুল বললো, ‘স্বাধীনতার জন্য সব কুরবান। তোমার আন্দোলনে আমরা সাহায্য করছি কেবল।’

মুদ্দাসির বললো, ‘যে জাতির স্বাধীনতার জন্য লড়ছেন আপনি, আমরা সে জাতিরই অংশ। লড়াইয়ে অংশ নিতে পারছি, এটা আমাদের সৌভাগ্য।

ফরিদা ছেলের মনোবল দেখে আনন্দে কেঁদে ফেলেন। তাকে বুকে জড়িয়ে বলেন, ‘বেঁচে থাক বাবা, বেঁচে থাক।’

১৯৯০ সালের মে মাসের পড়ন্ত বিকেল। মকবুল জানের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে ফরিদা। মকবুলের শরীরটা আজকাল ভালো যাচ্ছে না। বারবার পুলিশের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। নির্যাতনে সে অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে। কোথাও কোনো অঘটন ঘটলেই দায় এসে পড়ে নটিপুরার এই বাড়ির ওপর। ফরিদার ভাই বেলাল বেগকে গ্রেফতার করা হয়েছে। হেলাল এবং বেলাল দুজনকে সহোদর ভাই মনে করছে প্রশাসন। হেলালকে না পেয়ে তাই বেলালকে গ্রেফতার করেছে। অনেক্ষণ চুপ করে আছে ফরিদা। মনে মনে সে মকবুলের প্রশস্ত বুকের ধুকপুকানি গুনছে। সেকেন্ডের কাটার শব্দের মতো যেন শব্দ হচ্ছে মকবুলের বুকের তলায়। এই শব্দটা ফরিদার খুব চেনা। একদিন মকবুল বলেছিলো, ‘তুমি বুকে মাথা রাখলে আমার বুকে তখন শব্দ হয়। ভালোবাসলে ওই শব্দ তুমি শুনতে পাবে।’ ফরিদা শব্দটা শুনতে পাচ্ছে, প্রতিদিনই শুনতে পায়। কিন্তু আজকাল প্রতিদিন শব্দটা শুনার সুযোগ হয় না। পুলিশের নজরদারি, নির্যাতনে এই বাড়িতে এখন বসবাস করাটাই মুশকিল হয়ে পড়েছে। পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে।

ফরিদা বললো, ‘বাড়িটা এখন সরকারের হটলিস্টে। এক মিনিটও আমরা এখানে নিরাপদ নই। চলো আরেকটা ঠিকানা খুঁজে নেই।’

মকবুল ফরিদার চুলে হাত বুলিয়ে বললো, ‘শখের বাড়িটা বিক্রি করে দিতে চাও?’

‘হুম। এটা বিক্রি করে অন্য কোথাও আরেকটা বাড়ি বানাবো।’

‘আমাদের ছেলেদের জন্য তো বাড়িটা প্রয়োজন।’

‘আমার ছেলে দুজন নয়, অনেক। তাদের নিরাপত্তা দিতে আমার একটা গোপন ঠিকানা প্রয়োজন।’

‘নতুন বাড়ি কেন বানাতে হবে। রেডিমেট বাড়ি কিনে নিলেই পারি।’

‘বাড়ির চেয়ে আমার আন্ডারগ্রাউন্ড বেশি দরকার। তুমি তো জানো—একজন গ্রেফতার হলে চেনা বাড়িতে সবাই হামলে পড়ে।’

‘হুম। তাও কথা। তুমি হেলাল বেগের সঙ্গে পরামর্শ করো—কোথায় আন্ডারগ্রাউন্ড হলে ভালো হয়। ওখানে জমি কিনে নতুন বাড়ি করবো।’

ফরিদা আনন্দে মকবুলকে আরও কাছে টানলো। খুব গভীর করে চুমু খেলো তার ঠোঁটে। তারপর বললো, ‘ধন্যবাদ।’

হেলাল বেগের পরামর্শে বামনায় জমি কেনা হলো। অল্প সময়েই তৈরী হয়ে গেলো বাড়ি। শ্রমিক এবং মিস্ত্রিরা চলে যাবার পর শুরু হলো আন্ডারগ্রাউন্ড নির্মাণের কাজ। সন্ধ্যা নামার পর থেকে শুরু হয় কাজ, চলে ফজর পর্যন্ত। হেলাল বেগ, মকবুল জান এবং পিতা ইউসুফ বেগ রাতের পর রাত ঘাম ঝরানো পরিশ্রম করে। দীর্ঘ একমাস খাটার পর সম্পন্ন হলো চারকক্ষ বিশিষ্ট আন্ডারগ্রাউন্ড। চোখ বন্ধ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ফরিদা। গোপন ডেরা নয়, সে ভাবে ইবাদাতের জন্য তৈরী করেছে মসজিদ। এখান থেকে কাফেরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ছক আঁকা হবে। ভয় ধরানো সব অপারেশন পরিচালনা করা হবে। কাকপক্ষীও জানতে পারলো না এখানে এমন একটি গ্রাউন্ড তৈরী করা হয়েছে। অস্ত্র সরবরাহ এবং তার হিসাবের জন্য নিযুক্ত করা হলো শাব্বির আহমদ ভাট নামের এক মুজাহিদ।

মুজাহিদদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলে গ্রেফতার করা হয়েছে ফরিদার ভগ্নিপতি পীর জাফর আহমাদকে। এক অমানিশা যেন নেমে আসছে ফরিদার পরিবারের ওপর। যেন মুজাহিদ হওয়া নয়, বরং এই পরিবারের হওয়াটাই অপরাধের। বেলালের গ্রেফতারের পর আত্মগোপন করে আছে শাকিল। ফিরোজ আজাদ কাশ্মীর গিয়েছে ট্রেনিং নিতে। জাফরের গ্রেফতারে মাতম শুরু হয়ে গেছে আলুচাবাগের বাড়িতে। ফরিদা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছে।

আলুচাবাগের বাড়িতে অনেক মানুষের সমাগম। মহিলারা মুখে আচল দিয়ে দাঁড়িয়ে ভিড় করছে। সান্ত্বনা দেয়ার বদলে তার টিপ্পনি কাটছে—এবার বুঝো মজা! ফরিদার কর্মের ফল সব। তার সঙ্গে তাল না মেলালে এই দশা কখনো হতো না। কই আমরা তো দিব্যি আছি। এসব কথা শুনে ফরিদা গা জ্বালা করছে। হঠাৎ সে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলো—মায়েরা, বোনেরা! এখন তো শুধু গ্রেফতার করা হচ্ছে। একটা সময় আসবে—মায়ের সামনে ছেলেদের জবাই করা হবে। স্বামীর সামনে স্ত্রীর, পিতার সামনে কন্যার সম্ভ্রম লুট করা হবে। কাশ্মীরি মুসলিমদের ওপর ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালানো হবে। আমরা তো কেবল চেষ্টা করছি যেন এমন পরিস্থিতি তৈরী না হয়। আপনাদেরও চেষ্টা করতে হবে। আজ আমার ঘরে, কাল আপনার ঘরে হাত দিবে না, এর কী গ্যারান্টি?’

ফরিদার বক্তব্যের পর পরিবেশ পাল্টে যায়। সবাই চোখ চাওয়া-চাওয়ি করে। কোলের ছোট মেয়েটাকে আকড়ে ধরে। তারাও যেন তাদের সামনে এক বিপন্ন ভবিষ্যতের করুণ দৃশ্য দেখতে পায়। তাদের বুক চিরে তখন বেরিয়ে আসে স্লোগান—আজাদী, আজাদী!

নিউ এয়ারপোর্টের ইন্টারোগেশন সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে জাফরকে। খুলে ফেলা হয়েছে তার গায়ের কাপড়। গাট্টাগোট্টা এক অফিসার জিজ্ঞেস করলো, ‘স্বীকার করে নে তুই পাকিস্তানি মুজাহিদ।’ জাফর অস্বীকার করে বললো, ‘কোনো মুজাহিদের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্কই নেই।’

অফিসার ইঙ্গিত করতেই জাফরকে শুয়ে দেয়া হলো। তার ওপর চাপিয়ে দেয়া হলো রোলার। জাফরের মনে হতে থাকে শরীরের হাড্ডিগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। আজরাইল মনে হয় রূহ টান দিয়ে কবজ করছে। রোলারের চাপে চিৎকারের শব্দও বেরুচ্ছে না মুখ দিয়ে। রোলার সরিয়ে পেশাবের ছিদ্রপথে ঢুকিয়ে দেয়া হলো সুঁই। পেশাবের সঙ্গে গলগল করে বেরুতে থাকলো রক্ত। জাফর জ্ঞান হারালো।

জাফরের জ্ঞান ফিরেছে। তাকে যেই রুমে রাখা হয়েছে, সেখানে আরও কয়েকজন যুবককে ধরে আনা হয়েছে। তাদেরকেও চাপ দেয়া হচ্ছে নিজেদেরকে পাকিস্তানি মুজাহিদ বলে পরিচয় দেয়ার জন্য। যাদের মুখে দাঁড়ি, তাদের ওপর নির্যাতনটা বেশি চলছে। কালো দাঁড়িমণ্ডিড এক যুবককে পা বেঁধে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। জ্বলন্ত সিগারেট দিয়ে পুরো শরীরে দাগ দেয়া হচ্ছে। মোমবাতির আগুন দিয়ে পুড়ে ফেলা হচ্ছে তার দাঁড়ি। কখনও আগুন রেখে প্লাস দিয়ে টেনে টেনে তুলে ফেলা হচ্ছে। জাফর চোখ বন্ধ করে। কিন্তু আরেকজন বন্দীর চিৎকারের কারণে চোখ খুলে ঝট করে। যে দৃশ্যটা সে দেখতে পেলো, তার আর চোখ খুলে রাখার সাহস হলো না।

পাকিস্তানি মুজাহিদ বলে স্বীকারোক্তি না দেবার কারণে এক যুবকের পা জ্বলন্ত স্টোভে রাখা হয়েছে। আগুনে জ্বলে দু পা থেকে চর্বি গলে গলে পড়ছে। তার চিৎকারে দেয়ালগুলো কেঁপে কেঁপে উঠছে। অবশেষে সহ্য করতে না পেরে যুবক স্বীকারোক্তি দিলো। ভয়ানক এই দৃশ্য দেখে জাফর তার সেলের সবার সঙ্গে পরামর্শ করে। এরপর জাফর এবং তার সেলের সব কজন বন্দী নিজেদেরকে পাকিস্তানি মুজাহিদ বলে স্বীকার করে।

জাফরের ওপর টর্চার বন্ধ হয়েছে। কিন্তু আগের নির্যাতনের প্রতিক্রিয়া এখন খুব তীব্রভাবে দেখা দিচ্ছে। নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে। পেশাবের রাস্তা দিয়ে পড়ছে পুঁজ। বলতে পারছে না, সইতে পারছে না। ডাক্তার এসে কিছু জিজ্ঞেসও করেননি। নিজ থেকেই খেতে দিয়েছেন Noveigen ট্যাবলেট। ট্যাবলেট হাতে নিয়ে জাফরের মনে পড়ছে তার স্ত্রী ডেইজির কথা। ডেইজির মুখখানি মনে পড়ার পর তার আরও বেশি কষ্ট হচ্ছে। মানুষ যখন অসহায়, অসুস্থ থাকে, আপনজনদের খুব মনে পড়ে। জাফরের মনে হচ্ছে এই মনে পড়াটা ক্ষতিকর। এতে কষ্ট কমে না, বাড়ে।

১০

খবরটি শুনে জগমোহন মালব্য দাঁড়িয়ে গেলেন। এবার অপহৃত হয়েছেন ভারতীয় গ্যাস ও পেট্রোলিয়াম অফিসার দোরায়ে সোয়ামি। খবরটি ইতোমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। এইসব খবর বাতাসের আগে ছড়ায়। প্রশাসনকে বসে থাকতে দেয় না। বিড়বিড় করে জগমোহন বললেন, ‘বহেনজি, এবার আপনার পালা। ইন্টারোগেশন সেলে ঢুকালেই বুঝতে পারবেন, কতটুকু রস বের হয়।’

ফরিদা ভেবেছিল—জাফর যেহেতু মুজাহিদ নয়, খুব তাড়াতাড়ি তাকে মুক্ত করা যাবে। কিন্তু এক বছর পেরিয়ে যাবার পরও যখন মুক্তি মিললো না, কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। অপহরণের জন্য লটারিতে নাম উঠে এলো দোরায়ে সোয়ামির। এবার খুব সতর্কতার সঙ্গে কাজটি সম্পন্ন করা হয়। ঘটনার পরপরই অপহরণের দায় স্বীকার করে ইখওয়ানুল মুসলিমীন। এর বিনিময়ে তারা জাফর, জাভেদ এবং বেলালের মুক্তির দাবি জানায়।

জগমোহন চাইছিলো আগের মতোই আপোষহীন থাকতে। কিন্তু দোরায়ে সোয়ামির উদ্ধার দাবিতে শহরজুড়ে শুরু হয় পেট্রোলিয়াম কর্মচারীদের বিক্ষোভ। বাধ্য হয়ে সরকার ইখওয়ানুল মুসলিমিনের সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি হয়। আলোচনায় সরকার দুজনকে মুক্তি দিতে রাজি হয়। তবে সেটা জাফর এবং জাভেদের পরিবর্তে অন্য দুজন মুজাহিদ হতে হবে। কিন্তু ইখওয়ানুল মুসলিমিনের আমীর হেলাল বেগ আপন অবস্থানে অনড়—এ দুজনকেই মুক্তি দিতে হবে। শর্ত চলবে না।

জেল কর্মকর্তার অফিসে দুজন সিবিআই কর্মকর্তা বসে আছেন। তারা জাফর আহমাদের ফাইলগুলো দেখছেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। একজন বললেন, ‘জাফরকে ডেকে আনুন।’

জাফর এসে বললো, ‘আমার নাম জাফর।’

কর্মকর্তা বললেন, ‘মুজাহিদদের খুব পাওয়ার?’

জাফর বললো, ‘আমি তো মুজাহিদ নই।’

কর্মকর্তা ভেঙচি কাটলো, ‘তাই বুঝি মুজাহিদরা তোর মুক্তি চায়? ইখওয়ানুল মুসলিমিন সরকারি কর্মকর্তাকে অপহরণ করেছে। তোর মুক্তি দাবি করছে। আজকালের মধ্যে প্যারোলে তোকে মুক্তি দেয়া হবে।’

পরদিন জাফরকে আবার ডাকা হয় আরেকটি কক্ষে। তাকে ডেকে নিয়ে যায় সিবিআইয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা। কক্ষে নিয়ে গিয়েই তার পরনের পাজামা খুলে ফেলা হয়। খোলা পাজামা দিয়ে তার মুখ ঢেকে দেয়া হয়। তারপর শুরু হয় নারকীয় নির্যাতন। নির্যাতনের তীব্রতায় নাক-কান থেকে গলগল করে বেরুতে থাকে রক্ত। পাজামার কারণে গড়িয়ে পড়তে পারে না মাটিতে। জমাট বেঁধে থাকে নাকের ত্বকে, কানের পর্দায়। মুখ থেকে পাজামাটি সরিয়ে দিলে জাফর দেখলো তার সামনে বিশ-পচিশজন অফিসার আসে আছে।

একজন জিজ্ঞেস করলো, ‘দোরায়ে সোয়ামিকে অপহরণ করে কোথায় রেখেছিস?’

জাফর বললো, ‘চৌদ্দ মাস হলো আপনাদের হাতে আমি বন্দী। আমি জানব কী করে—কারা অপহরণ করেছে এবং কোথায় রেখেছে?’

স্বীকার না করায়  আবার শুরু হয় নির্যাতন। পিপাসায় বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে জাফরের। গত চব্বিশ ঘন্টায় তাকে একফোঁটা পানিও দেয়া হয়নি। শুকিয়ে গেছে জিভ, ঠোঁট। রক্তের নোনতা স্বাদ লেগে আছে পানির আর্দ্রতার বদলে। এখানে জগতটাই আলাদা। জাহান্নামকে খুব অনুভব করা যায়। তবে সে মুক্তি পাচ্ছে, এইটুকু তার শান্তি।

নটিপুরা থেকে মুজাহিদদের কার্যালয় স্থানান্তরিত হয়েছে বামনায়। ফরিদার নতুন বাড়িতে। মুজাহিদদের সুরাহা করা গেলেও নরক নেমে আসে ফরিদার পরিবারে। পরপর গ্রেফতার করা হয় ফরিদার দুই ভাই ফিরোজ এবং শাকিলকে। তিন ছেলেকে হারিয়ে ফরিদার বাবা ইউসুফ বেগ ভেঙে পড়েন। তবে নতুন চেতনায় তিনি আবার জেগে উঠেন। তিনিও শামিল হন কাশ্মীর স্বাধীনতার আন্দোলনে। তিনি বলেন, ‘সবাই যখন চলে গেলো, আমি বসে থেকে কী করবো। আমিও নিজেকে উৎসর্গ করে দিলাম দেশের জন্য। এখন অস্ত্র হাতে লড়াই করবো রণাঙ্গণে।’

১১

ফরিদাকে খুব অস্থির লাগছে। আজকের অস্থিরতা অন্যদিনের মতো নয়। রূপটা ভিন্ন, সংবেদনশীল। ন্যাশনাল কনফারেন্সের পার্লামেন্ট সদস্য সাইফুদ্দিন সোজের কন্যা নাহিদা সোজকে অপহরণ করেছে ইখওয়ানুল মুসলিমিন। ইখওয়ান যদি কোনো পুরুষকে অপহরণ করতো, তার এত অস্থির হবার কারণ ছিলো না। কিন্তু এখানে একটি যুবতি মেয়ের ব্যাপার। মেয়ের নিরাপত্তা এবং দেখাশোনাটা ফরিদা করতে চায়।

ফরিদা তার বোন ডেইজিকে বললো, ‘নাহিদার দেখাশোনা তোমার করতে হবে।’

ডেইজি বললো, ‘অবশ্যই করবো। তার নিরাপত্তার দায়িত্ব আমাদের।’

ফরিদা বললো, ‘তুমি চব্বিশ ঘন্টা তার সঙ্গে থাকবে। একসঙ্গে খাবে, ঘুমাবে। তার সুবিধা-অসুবিধার খেয়াল রাখবে।’

ডেইজি ফরিদার হাত ধরে বললো, ‘আমি জানি তোমার ব্যস্ততা না থাকলে তুমিই দেখাশোনা করতে। এখন আমি তোমার হয়ে দেখাশুনা করবো।’

শ্রীনগর থেকে সোয়া ঘন্টা দূরে একটা বিজন এলাকায় নাহিদাকে রাখা হয়েছে। পুরো এলাকায় ছড়িয়ে আছে মুজাহিদ। নাহিদার রুমের বাইরেও দাঁড়িয়ে আছে চারজন। ইখওয়ান আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো, নাহিদার দেখাশোনার দায়িত্ব কোনো মেয়ের হাতেই দিবে। ফরিদা যেহেতু তার বোনকে পাঠিয়েছে, তাই অন্য কোনো মেয়ের হাতে নাহিদাকে সোপর্দ করতে হয়নি। বেশি চাপ সৃষ্টি করতেই মেয়ে অপহরণ করা হয়েছে। এর বিনিময়ে ইখওয়ান কয়েকজন মুজাহিদের মুক্তি দাবি করেছে। এরমধ্যে ফরিদার ভাই বেলালও আছে।

ডেইজি নাহিদার রুমে ঢুকতেই নাহিদার চোখে-মুখে আনন্দের ঝিলিক ফুটে উঠলো। নিঃসঙ্গতা তার ভালো লাগছিলো না। এই বন্দী ঘরে অন্তত গল্প করার জন্য হলেও একজন পাওয়া গেলো। নাহিদা জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমাকে কোত্থেকে অপহরণ করেছে।’

ডেইজি হাসলো, ‘আমাকে অপহরণ করা হয়নি। আমি তোমার বোন হয়ে তোমার দেখাশোনার জন্য এসেছি।’

‘আমি ভাবছি তুমিও আমার মতোই।’

‘উহু।’

‘তোমার নাম কি?’

‘ইয়াসমিন।’ আসল নাম লুকোলো ডেইজি।

‘থাকো কোথায়?’

‘হজরতবালে।’

‘তোমাকে দেখে ভালো লাগলো।’

‘তোমাকে দেখেও ভালো লাগলো। তবে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। আমরা দুজন এখন থেকে বোন।’

নাহিদা নিজেও জানে, এইসব অপহরণ দাবি আদায়ের জন্য। দাবি আদায় হয়ে গেলে তাকে ছেড়ে দেয়া হবে। তবে প্রশাসনের সঙ্গে নাহিদাকে কোনো কথা বলতে দেয়া হতো না। বরং প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলতো ইখওয়ান। তার সঙ্গে চব্বিশ ঘন্টা গল্পের সঙ্গী হয়ে থাকতো ডেইজি। ডেইজি এবং ইখওয়ানের মোলায়েম আচরণে নাহিদা মুগ্ধ হতে শুরু করে। মুক্তি পাবার জন্য তার মধ্যে ক্রোধ কিংবা অস্থিরতা দেখা যায় না।

নাহিদার অপহরণের সংবাদ চাউর হবার পরই নটিপুরা এবং দেলসুজ কলোনি ঘেরাও করে ফেলে পুলিশ। তার আগে নিরাপদ আন্ডারগ্রাউন্ডে সরে যায় ফরিদা, মাকবুল এবং বড় ছেলে মুদ্দাসির। ঘরে থাকে ফরিদার মা সাঈদা বেগম, ছোট মেয়ে সায়মা এবং ছোট ছেলে মুসাররাত। এক প্লাটুন বিসিএফ হুঁইসেল বাজাতে বাজাতে এসে দাঁড়ায় ফরিদার বাড়ির সামনে। তাদের সঙ্গে এক প্লাটুন মহিলা পুলিশও নিয়ে এসেছে। এসেই তারা হামলে পড়েছে সাঈদা বেগমের ওপর।

‘বহেনজি কোথায়?’

‘এখানে নেই।’

‘কোথায় আছে?’

‘ভাইদের সঙ্গে দেখা করার জন্য জুধপুর গেছে। তার স্বামীও তার সঙ্গে আছে। জুধপুর থেকে যাবে মধ্যেপ্রদেশ। দুই জায়গায় তার দুই ভাই আটক।’

‘আপনি তার কী হন?’

সাঈদা বেগম আসল পরিচয় লুকালেন, ‘আমি তার শ্বাশুরি। তার মা এখানে নেই।’

মহিলা পুলিশ সাঈদা বেগমের পিঠে লাঠি দিয়ে আঘাত করতে শুরু করে। তাকে পেটাতে দেখে কান্না করতে শুরু করে সায়েমা। পুলিশ টেনে হিঁচড়ে তাকে দূরে সরিয়ে দেয়। সায়েমাকে যখন দূরে সরিয়ে দিচ্ছে, সাঈদা বেগম খানিকটা শঙ্কা বোধ করলেন। তিনি নাহয় কৌশল করে মিথ্যে বলেছেন, সায়েমা ছোট, সে যদি সত্যি বলে দেয়! আমার কথা মিথ্যা প্রমাণ হলে তো রক্ষা নেই।

পুলিশ সায়মাকে অন্য রুমে নিয়ে যায়। তাকে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি বহেনজির কী হও?’

সায়েমা বললো, ‘বহেনজি আমার ফুপি হন। আমি সুরায় থাকি। এখানে বেড়াতে এসেছি আজ। ফুপি জুধপুর গেছেন তার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে।’

সায়েমা ছোট হলেও মায়ের কর্মকাণ্ডের প্রত্যক্ষ সাক্ষী সে। সে ভেবেছে, তার নানি যা বলেছে, সেও তাই বলবে। কৌশলে নিজের মাকে ফুপি বলে দাবি করেছে। সাঈদা বেগম খানিকটা স্বস্তিবোধ করেন। অন্তত তার মিথ্যাটা প্রকাশ হলো না। পুলিশ বহেনজির নামটাই চিনতো। তার পরিবার, মা-বাবা তেমন একটা চিনতো না। ফলে না চেনার সুযোগে অনেক সময় প্রশাসনের চোখে ধূলো দেয়া যেতো।

বহেনজিকে পাওয়া যাচ্ছে না। ফোর্স ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাওয়াকে লজ্জা মনে করছে। তাই তুলে নিয়ে গেলো সাঈদা বেগমকে। পাপাটু একটু অফিসারের সামনে তাকে উপস্থিত করা হলো। অফিসারের সামনে সাঈদা বেগমের চোখের পট্টি খুলে দেয়া হয়। অফিসারকে বলা হয়, ‘ইনি বহেনজির শ্বাশুড়ি। শ্বাশুড়িকে নিতে বহেনজিকে আসতে হবেই।’

অফিসার জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার বয়স কত?’

‘ষাট বছর।’

ওড়না সরিয়ে চুলে হাত দিয়ে অফিসার বললেন, ‘তোমার চুল তো কালো। ষাট বছরে চুল পেকে যাওয়ার কথা।’

সাঈদা বেগম চুপ করে রইলেন। খেকিয়ে উঠলেন অফিসার,’ সত্যি করে বলো, বহেনজি কোথায়?’

‘বউ জুধপুর গেছে।’

‘নাহিদাকে কোথায় রেখেছে, বলো।’

‘নাহিদা কে আমি চিনি না। কোথায় তাকে রাখা হয়েছে, তাও জানি না।’

‘জানতে হবে। হেলাল বেগের সঙ্গে তোমার নিশ্চয় দেখা হবে। তাকে বুঝাবে মেয়ে অপহরণ মানবতাপরিপন্থী কাজ। তাকে বুঝানোর দায়িত্ব নিলে তোমাকে ছেড়ে দিব।’

অফিসার নির্দেশ দিলেন, তাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে ঘরের ছোট ছেলেটাকে নিয়ে আসো। পুলিশ মুসাররাতকে তুলে নিয়ে গেলো। তাকে যখন তুলে নিয়ে যাচ্ছিল, ফরিদা পাশের বাড়ি থেকে দৃশ্যটা দেখছিলো। তার আদরের ছোট ছেলেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ, সে কিছু বলতে পারছে না। বুকটা তার ফেটে যাচ্ছে। ডানাভাঙা পাখির মতো ছটফট করছে। বন্দী না, তবুও যেন বন্দীত্বের যন্ত্রণা তার সমস্ত দেহ বিষিয়ে তুলছে।

পুলিশ চলে যাবার পর ফরিদা ঘরে আসে। জানালার পাশে বসে সাঈদা বেগম পথের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তার চোখে জল। মুখটা কেমন বিষণ্ন, শুকনো। ফরিদা বললো, ‘তুমি বললে আমি নিজেকে ধরা দিয়ে মুসাররাতকে ছাড়িয়ে আনি।’

সাঈদা বেগম বললেন, ‘এই কথা মুখেও আনবে না। এত মিথ্যা বলেছি, নির্যাতন সহ্য করেছি তুমি ধরা দেবার জন্য?’

ফরিদা বললো, ‘তাহলে তোমার চোখে জল কেন?’

সাঈদা বেগম চোখ মুছতে মুছতে বললেন, ‘এমনিতেই।’

ফরিদা তার মাকে জড়িয়ে ধরে। তার বুকে যে বয়ে যাচ্ছে ঝড়, তা কাউকে দেখাতে চায় না। এখন আবেগের চেয়ে যুক্তিকে প্রাধান্য দিতে হবে। কিছু কিছু সময় আসে, মানুষ তখন অসহায় হয়ে পড়ে। নিজের আবেগকে নিজেই মূল্য দিতে পারে না। চাপা দিয়ে রাখতে হয়। বুকের ভেতর শক্ত দেয়াল তুলে আড়াল করে রাখতে হয়। কিন্তু সবাই কি আড়াল করতে পারে? ফরিদার চোখ চিকচিক করে উঠে। বাইরে মাগরিবের আজান পড়ে। পাখিগুলো নীড়ে ফেরার আয়োজন কর। আজানের সম্মানে ফরিদা ঘোমটা তুলে দেয় মাথায়।

১২

গভর্নর সাকসিনা মুসাররাতের সামনে একটা বিস্কুট এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘নির্দোষ মেয়েকে অপহরণ করা অন্যায়। তোমার মাকে যদি কেউ অপহরণ করে, তোমার কেমন লাগবে?’

বিস্কুটে কামড় বসিয়ে মুসাররাত বললো, ‘খুব খারাপ লাগবে। কান্না করব আমি।’

‘নাহিদার মা-বাবারও খুব মন খারাপ। তারাও কান্না করছে। বলতে পারো নাহিদাকে কোথায় রাখা হয়েছে?’

‘আমি কিছু জানি না।’

‘তোমার মনে হয় অপহরণকারীরা অন্যায় করেছে?’

‘হুম।’

‘তাহলে তুমি তোমার মাকে বলো, নাহিদাকে ছেড়ে দিতে।’

‘ মা মামাকে দেখতে গেছেন।’

‘তুমি মিথ্যা বলছো। তোমার মা শহরেই আছেন। টেলিফোনে কথা বলো মায়ের সঙ্গে।’

‘মা যেখানে আছেন, ফোন আছে কিনা জানি না।’

‘কোথায় তোমার মা?’

‘মামার বাড়ি।’

‘মাকে বলো হেলাল বেগের সঙ্গে কথা বলে নাহিদাকে ছেড়ে দিতে। নেক কাজে তুমি আমাকে সাহায্য করো।’

‘আমি সাহায্য করতেই চাই। কিন্তু মা কোথায় আছে, সেটা তে নিশ্চিত জানি না।’

সাকসিনা এবার একটু কঠিন হলেন, ‘নাহিদা ছাড়া না পেলে কিন্তু আমরাও তোমাকে ছাড়ব না। নাহিদাকে খুন করা হলে আমরাও তোমাকে খুন করবো।’

তখন রাত হয়ে এসেছে। বাইরে অমাবশ্যার ঘুটঘুটে অন্ধকার। সাকসিনা বললো, ‘মামার দোকানের ঠিকানা দাও।’

‘দোকানের ঠিকানা জানি না। বাড়ির ঠিকানা জানি।’

‘তাহলে বাড়িটা দেখিয়ে দাও।’

‘এই অন্ধকারে বাড়ি খুঁজে পাব কোথায়?’

এক অফিসার ঠাস করে চড় বসিয়ে দিলেন মুসাররাতের গালে। সে কান্না করতে লাগলো। একটু পর কান্নাভেজা কণ্ঠে বললো, ‘লাইট হলে দেখিয়ে দিতে পারব।’

‘লাইট আছে। চলো।’

গভর্নর সাকসিনা এক প্লাটুন বিসিএফের সঙ্গে মুসাররাতকে আলুচাবাগে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু আলুচাবাগে ইউসুফ বেগ এবং তার পরিবারের কাউকে পাওয়া যায় না। বিসিএফরা ইউসুফ বেগের প্রতিবেশীদের মারধর করে। কয়েকজন যুবককে গ্রেফতার করেও নিয়ে আসে। এরপর নাহিদা সোজের বিনিময়ে পাঁচজন মুজাহিদকে মুক্ত করে  দেয় সরকার। কিন্তু বেলালকে মুক্তি দেয়নি। মুক্তি দেয়নি ফিরোজকেও। কারাগারের নির্মম প্রকোষ্ঠে এখনো পরীক্ষার মুখোমুখি তারা।

১৩

জেলখানায় ফিরোজকে তার পছন্দনীয় খাবার দেয়া হয়েছে আজ। কাশ্মীরি নান এবং গ্রীল। এই ভালো খাবার দেখে ফিরোজের  মনে সন্দেহ জাগছে। নিশ্চয়ই কিছু গড়বড় আছে। সাবধান থাকতে হবে। মনে মনে সে সম্ভাব্য সব প্রশ্নের উত্তর তৈরী করে রাখে। গড়বড় টের পেলো ফিরোজ একটু পরেই।

এক অফিসার এসে বললো, ‘মাত্র তিনজন লোকের সন্ধান দাও। হেলাল বেগ, জাভেদ শালাহ, বহেনজি। তিনজনের বিনিময়ে তোমাকে প্রচুর অর্থ, দিল্লিতে থাকার কোয়ার্টার এবং হ্যান্ডসাম চাকরি দিব।’

না চেনার ভান করে ফিরোজ বললো, ‘এই বহেনজিটা কে?’

অফিসার বললো, ‘চেননা? তোমার বোন ফরিদা!’

‘এ নামে আমার কোনো বোন নেই।’

‘ফরিদা যদি বেলালের বোন হয়, তোমার বোন নয় কেন?’

‘এতকিছু জানি না। তবে ফরিদা নামে আমার কোনো বোন নেই।’

‘আচ্ছা, বেলালের বহেনজির খোঁজ দাও।’

‘বহেনজি কোথায় আমি কি করে জানবো? আর বেলাল তো কতজনই আছে। কোন বেলালের কথা বলছেন?’

‘তুমি জানো সবই। বললে পুরষ্কার পাবে। জাভেদ শালাহ এবং খোরশেদ বেগ কোথায় থাকেন?’

‘খোরশেদ বেগকে চিনি, কিন্তু কোথায় থাকেন বলতে পারি না। জাভেদ শালাহকে দেখিনি কখনও।’

‘হেলাল বেগকে চিনো?’

‘হুম। তাকে চিনি ভালো করেই।’

‘এখন তাকে চিনবে?’

‘চিনব না কেন?’

‘তাহলে চলো, দেখিয়ে দাও।’

‘তিনি তো পাকিস্তান চলে গেছেন।’

হেলাল বেগ পাকিস্তান চলে যাবার পর ফরিদার দায়িত্ব আরও বেড়ে গেছে। আন্ডারগ্রাউন্ডের বাড়িতে ইতোমধ্যেই চারবার হানা দিয়ে ফেলেছে ফোর্স। তবে কেউ কিছু বুঝতে পারেনি। ফিরোজ এই আন্ডারগ্রাউন্ড সম্পর্কে সবই জানে। ফরিদার শঙ্কা হচ্ছে—ইন্টারোগেশন সেলে ফিরোজ যদি সব বলে দেয়! ২৫ হাজার টাকার বিনিময়ে শাকিলকে মুক্ত করা গেছে। ফিরোজকে এখনো মুক্ত করা যায়নি।

প্রশাসন হন্যে হয়ে বহেনজিকে খুঁজছে। রাস্তায় রাস্তায় বসিয়েছে টহল। পথচারীদের পরিচয়পত্র দেখা হচ্ছে বারবার। কিন্তু বহেনজিকে হাতের নাগালে না পেয়ে প্রশাসন হাত চুলকাচ্ছে। তাদের মনে হচ্ছে—তাদের সামনে দিয়েই সবকিছু করে যাচ্ছে ফরিদা ওরফে বহেনজি। কিন্তু তারা কোন এক যাদুকরের যাদুর বিভ্রমে আটকে আছে। না পারছে বিভ্রম কাটাতে, না পারছে বহেনজিকে ধরতে।

ফিরোজকে নিয়ে যে শঙ্কা করছিল ফরিদা, তার কিছুই ঘটেনি। ১৯৯২ সালের ১৭ মার্চ; ফিরোজকে মুক্তি দেয়া হয়। মুক্তি পেয়ে ফিরোজ দুএকদিন ওয়ান্টাপুরায় কাটায়। তারপর বামনা চলে চলে আসে, ফরিদার কাছে।

১৪

২৪ মার্চ, ১৯৯২। বামনায় ফরিদার বাড়িতে থৈ থৈ করছে আনন্দ। ইউসুফ বেগ তার ছেলে শাকিলকে নিয়ে বেড়াতে এসেছেন।  মুহাম্মদ সিদ্দিক সুফি, মুহাম্মদ হোসাইনকে নিয়ে এসেছেন জাবেদ আহমাদ শালাহ। বাড়িতে আগে থেকেই আছেন আলতাফ খান, শাব্বির আহমাদ, ফিরোজ আহমাদ। বলতে গেলে এই প্রথম বাড়িটি মুখর হয়ে উঠেছে। রাতের খাবার খেয়ে মুজাহিদরা চলে গেছে আন্ডারগ্রাউন্ডে। ঘরে বসে পারিবারিক আড্ডায় মেতে উঠেছেন ইউসুফ বেগ, মকবুল জান, ফরিদা বহেনজি।

এমন সময় দরজায় ঠুকঠুক শব্দ হলো। সঙ্গে কয়েক ডজন বুটের শব্দ। ফরিদার বুকটা কেঁপে উঠলো। কাঁপা কাঁপা বুকে ফরিদা বললো, ‘কাপড় পড়ে দরজা খুলছি।’

সিপাহি তাড়া দিলো, ‘জলদি দরজা খোল।’

কাপড় পড়ার অজুহাত দিয়ে মুজাহিদদের জিনিসপত্রগুলো সরিয়ে ফেললো ফরিদা। তারপর দরজা খুলে দিলো। কয়েকজন বিসিএফ জোয়ান হুড়মুড় ঘরে ঢুকে পড়লো। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলো না, কিছু জানতে চাইলো না। ঢুকেই লাথি, কিল, ঘুষি দেয়া শুরু করলো ইউসুফ বেগ, মকবুল জান, শাকিল আহমাদ, মুদ্দাসির ও মুসাররাতের ওপর। তারা একেকজন যন্ত্রণায় কুকিয়ে উঠছেন। তাদের আর্তচিৎকারে মনে হচ্ছে ফরিদার কান ফেটে যাবে।

ফরিদা বিসিএফ অফিসারকে বললো, ‘কী চান আপনারা?’

‘আমরা মিলিট্যান্ট আর অস্ত্র চাই।’

‘এখানে এসব পাবেন কোথায়?’

‘এখনই দেখছি, কোথায় আছে।’

‘তল্লাশি নিতে হলে তল্লাশি নিবেন। কিন্তু আপনারা তো নির্যাতন শুরু করেছেন।’

‘আমাদের কী করতে হবে, তা তোমাকে বলতে হবে না। তুমি বলো মিলিট্যান্ট আর অস্ত্রগুলো কোথায়?’

‘আপনারা নিজেরাই খুঁজে নেন।’

তন্ন তন্ন করে তল্লাশি শুরু হলো। সায়েমা তার মাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। আগে তার খুব ভয় লাগত। ভয় পেতে পেতে এখন সয়ে গেছে। এখন আর ভয় লাগে না, চ্যালেঞ্জ নিতে ইচ্ছে করে। সমস্যার চূড়ান্ত রূপটার মুখোমুখি হতে মন চায়। তারা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। একচুল নড়ার অধিকারও তাদের নেই। ফরিদা গতকাল-ই শুনেছিল, বামনা ক্র্যাকডাউনের প্রস্তুতি চলছে। কিন্তু অন্যবারের মতো এবারও সাহস রেখেছিলো। জোয়ানরা আন্ডারগ্রাউন্ডের খোঁজ না পেলেই হয়।

রেকে পাঁচ-ছয় জোড়া বুট রাখা ছিল মুজাহিদদের। সময়ের অভাবে সরানো যায়নি। অফিসারের চোখ পড়লো একদম রেকে। খেকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘এতগুলো বুট কেন? সত্যি করে বলো তারা কোথায়?’

নিরুত্তাপ গলায় ফরিদা বললো, ‘এগুলো আমাদের। শীতের সময় আমরা সবাই বুট ব্যবহার করি।’

ফরিদা জানে, তন্ন তন্ন করে খুৃঁজলে এই বাড়িতে মুজাহিদদের আরও অনেক চিহ্ন পাওয়া যাবে। কিন্তু ফরিদাকে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। কখন কোন চিহ্নে জোয়ানদের হাত পড়ে যায়, বলা যায় না। ঠিক তখুনি এক জোয়ান পেয়ে গেলো জাভেদ আহমাদ শালাহের পরিচয়পত্র। অফিসার জিজ্ঞেস করলো, ‘এই লোকটি কে?’

ফরিদা নিষ্কম্প স্বরে বললো, ‘এটা বেলাল আহমাদ বেগের পরিচয়পত্র। সে এখন হেরানগর জেলে বন্দী।’

অফিসার বললো, ‘বেলালের তো নাম লেখা নেই।’

ফরিদা বললো, ‘এটা মনে হয় তার কোডনাম।’

অফিসার চোখ গরম করে বললো, ‘কোডনামটা নিশ্চয়ই তোমার জানা আছে।’

ফরিদা বললো, ‘না,  জানা নেই।’

একটা বইয়ের ভেতর থেকে একটা পাসপোর্ট নিয়ে এলো সিপাহি। এটা রফিক খানের পাসপোর্ট। অফিসার ফরিদাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘এই লোকটা কে?’

‘আমার দেবর।’

‘তার পাসপোর্ট এখানে কেন?’

‘বারে, এটা তার ভাইয়ের বাড়ি। রাখতেই পারে।’

‘কোথায় থাকে সে।’

‘নওয়াব বাজারে।’

‘কী কাজ করে।’

‘গাড়ি ক্রয়-বিক্রয়।’

‘মিথ্যে হলে মাথার চুল একটাও থাকবে না। বলে দিলাম।’

এক সিপাহিকে পিস্তল হাতে দুতলা ঘেকে নামতে দেখে পিলে চমকে উঠলো ফরিদার। আজ গুরুত্বপূর্ণ সব প্রমাণ হাতে পেয়ে যাচ্ছে সিপাহিরা। এই পিস্তলটি শাব্বির আহমাদ ভাটের। রাতের খাবার খেয়ে হয়ত পিস্তলটি নিতে ভুলে গেছে। শাব্বির সহ সব মুজাহিদরা এখন আন্ডারগ্রাউন্ডে। ‘তোমার ঘরে পিস্তল কেন?’ বলতে বলতেই অফিসার ফরিদার চুলগুলো মুঠি করে ধরলো। তারপর দুহাতে তুলে ধরে মাটিতে আছাড় দিলো। মাটিতে ফেলে এলোপাথাড়ি লাথিও দিতে শুরু করলো। কিছুক্ষণ পর অফিসার ফরিদার চুল টেনে তাকে দাঁড় করালো। দেয়ালের সঙ্গে চেপে ধরে নির্লজ্জের মতো বুকের ওপর চাপ দিলো। মায়ের সঙ্গে এমন পাশবিক আচরণ দেখে শিশুমনে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলো সায়েমা। দৌড়ে এসে দু হাত খামচে ধরে বললো, ‘আমার আম্মুর সঙ্গে এমন করছো কেন?’ অফিসার সায়েমার গালে ঠাস করে চড় মারে। সায়েমা একটু দূরে গিয়ে সিটকে পড়ে। ফরিদা কিছু বলতে যাচ্ছিলো। অফিসার তার মুখ চেপে ধরে বললো, ‘জিহ্বা বের কর। কেটে ফেলব।’ এবার ফরিদা আর চুপ থাকতে পারলো না। রাগী বাঘিনীর মতো অফিসারের শার্টের কলার ধরে ধাক্কা দিলো। মাটিতে পড়তে পড়তে বেঁচে গেলো অফিসার। দাঁত কড়মড় করে ফরিদা বললো, ‘আরেকটু যদি অসংযত আচরণ করতে আসো, তোমাকে কাঁচা চিবিয়ে খাবো।’

অফিসার এবার নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে জিজ্ঞেস করলো, ‘একটা অস্ত্র পাওয়া গেছে। তার মানে আরও অস্ত্র আছে।’

ফরিদা বললো, ‘আমি যদি জানতাম পিস্তলটা বাড়িতে আছে, আমি আপনাদের সামনে রেখে দিতাম?’

অফিসার কপাল কুঞ্চিত করলো, ‘আপনার ঘরে পিস্তল আপনিই জানেন না?’

ফরিদা বললো, ‘কয়েকদিন আগে বিসিএফের ধাওয়া খেয়ে এক মুজাহিদ আমার ঘরে এসেছিল। সে হয়তো রেখে গেছে ভুলে।’

অফিসার বললো, ‘সন্ত্রাসীর ব্যাপারে তাহলে বিসিএফকে জানালেন না কেন?’

ফরিদা বললো, ‘তার হাতে অস্ত্র। তার বিরুদ্ধে গেলে সে আমাকে মেরে ফেলতে পারতো। এখন যেমন তোমরা মারছো।’

তিনঘন্টার টানা তল্লাশিতে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে ফরিদার সাজানো ঘর। মনে হয় এইমাত্র একটা ঝড় বয়ে গেছে। একেরপর এক যেভাবে প্রমাণগুলো ধরা পড়ছিলো, খুব কৌশলে সামলাতে হয়েছে সব। এখানে কাঁচের প্লেট ভাঙা, ওখানে আলমারির কাঁচ। ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কাপড়চোপড়, তালা-চাবি, ঘটি-পাতিল। ঘরের এক ইঞ্চিও বাকি রাখেনি, তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে। অবশেষে ক্লান্ত হয়ে ঘর ঘেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠলো জোয়ানরা।

তখন মধ্যরাত। চব্বিশ তারিখ শেষ হয়ে পঁচিশ তারিখে পড়েছে ঘড়ির কাটা। সব জোয়ানরা গাড়িতে উঠেছে। হঠাৎ এক সিপাহি তীব্র নিম্নচাপ অনুভব করলো। তল্লাশির তাড়নায় এতক্ষণ তার মনেই পড়েনি। অবসর হবার সঙ্গে সঙ্গেই নিম্নচাপ ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠলো। গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে সে টয়লেটে চলে গেলো।

টয়লেট থেকে একটু দূরে সমতল মাটিতে আন্ডারগ্রাউন্ডের সামান্য একটু ফাঁক। ফাঁকটুকু রাখা হয়েছে ভেতরে আলো-বাতাস প্রবেশের জন্য। তবে জানালার মতো পাল্লা সাটানো আছে এখানে। পাল্লাটা এত নিখুঁতভাবে সাটানো থাকে, বাইরে থেকে কেউ বুঝতেই পারবে না। দুর্ভাগ্যক্রমে জানালার পাল্লাটা আজ সাটানো হয়নি, খোলাই ছিলো। হুট করেই সিপাহির চোখে পড়ে গেলো ফাঁকটা। ভেতরে আলো এবং কয়েকজন মানুষের ছায়াও দেখতে পেলো উঁকি দিয়ে। অমনি সে চিৎকার করে উঠলো, ‘স্যার, কুইক, কুইক। পেয়ে গেছি, পেয়ে গেছি!’

গাড়ি থেকে ইয়াজুজ-মাজুজের মতো তীব্র গতিতে নেমে আসে জোয়ানরা। হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে। সব অস্ত্র এবং মিলিট্যান্ট এনে জমা করে বাড়ির আঙিনায়। মুজাহিদদের লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে তাদের চোখ বেঁধে দেয়া হয়। আটক করা হয় ঘরের সবাইকে। মকবুল, ইউসুফ বেগ, শাকিল, ফিরোজ, মুসাররাত এবং মুদ্দাসিরকে। চোখ বেঁধে তাদের চালানো হয় নির্যাতন।

নির্যাতনের চোটে মকবুলের রক্তবমি শুরু হয়েছে। গলগল করে রক্ত পড়ছে। ফরিদা গিয়ে তাকে ধরে শুইয়ে দিতে গেলো। অমনি এক সিপাহি ফরিদার চুল ধরে ঝটকা টান দিয়ে মাটিতে ফেলে দিলো। তারপর পিঠ ও কোমরে একের পর এক বুটের আঘাত করতে লাগলো। অফিসার বললো, ‘মকবুলকে নিয়ে আয়। তাকে উলঙ্গ করে গুলি করে হত্যা কর।’ সিপাহি মকবুলের কাপড় খুলতে শুরু করে। তখন তার সামনে দাঁড়িয়ে স্ত্রী, মেয়ে, শ্বশুর, শালা এবং অন্যান্য মুজাহিদরা। লজ্জায় মকবুল মিইয়ে যাচ্ছিলো। যদিও সবার চোখ বাঁধা, তবুও। ফরিদা তখন দৃপ্ত কণ্ঠে বললো, ‘ভয় পেও না। লজ্জা তো নয়ই। শাহাদাতের মর্যাদা পেতে লজ্জা কিসের। মাথা পেতে শাহাদাতের পেয়ালায় চুমুক দাও। জান্নাতে দেখা হবে আমাদের।’

ফরিদার মুখে শাহাদাতের বাণী শুনতে পেয়ে আরও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলো অফিসার। এবার সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে দিলে মকবুলকে। সায়েমা চোখ বন্ধ করে ফেললো। মকবুলের আবার রক্তবমি শুরু হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে অফিসার মকবুলকে কাপড় পড়ে নিতে বলে। ফরিদা এগিয়ে গিয়ে কাপড় পড়িয়ে দেয়। নির্যাতনের চোটে মকবুলের হাত পা কেমন জড়পদার্থের মতো হয়ে গেছে। নিজের কাপড়টুকু নিজে পড়তে পারছে না। অফিসার ফরিদার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘বহেনজির নাম শুনেছি এতদিন, চোখে দেখিনি। আজ দেখলাম কতটা ভয়ংকর তুমি। সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দিয়েছো, অস্ত্রের যোগান দিয়েছো। এখন আর রক্ষা নেই তোমার।’

ফরিদা কিছু বললো না। তার বলার ভাষা হারিয়ে গেছে। সহসা ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে সব স্বপ্ন। একটু একটু করে গড়ে তোলা আয়োজন, বাতাসের উদ্ধত থাবায় চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে। তার বুকের ভেতর কান্নার ঝড়, বেদনার অগ্নুৎপাত। দেহের প্রত্যেকটা অঙ্গ জ্বলছে ক্ষোভে, দুঃখে, অসহায় আস্ফালনে। তার সামনে ঘরের সব পুরুষ এবং মুজাহিদদের বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এতদিনের জমানো সব অস্ত্র তোলা হচ্ছে বিসিএফের গাড়িতে। মূক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ফরিদা। গাড়িতে উঠতে গিয়ে মুসাররাত ডাকলো, ‘মা!’ ফরিদা উত্তর দেবার ফুরসত পেলো না। তার আগেই বিসিএফের গাড়ি চলতে শুরু করেছে। তবুও ফরিদা শীর্ণ গলায় বললো, ‘বেঁচে থাকিস বাবা।’

১৫

শীতের মওসুম। বাইরে প্রচণ্ড তুষারপাত। শীতে শরীরের রক্ত জমে যাবার উপক্রম। এই তীব্র শীতে শীতল ফ্লোরে শুইয়ে রাখা হয়েছে শাকিলকে। শাকিলের চোখ বাঁধা। কিছুই দেখতে পারছে না। তবে মাঝেমধ্যে কানে আসছে পিতা ইউসুফ বেগের চিৎকার, ভগ্নিপতি মকবুল জানের কাতরধ্বনি, ভাগিনা মুদ্দাসির ও মুসাররাতের ভয়ংকর কান্না। একেরপর এক সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। নির্যাতন করা হচ্ছে। ইন্টারোগেশন রুমে ডাক পড়লো শাকিলের। অন্যান্য মুজাহিদদের ঠিকানা বলার জন্য সেদিন প্রচণ্ড নিযাতন করা হলো তাকে।

পরদিন আরেকটি রুমে আবার ডাকা হলো শাকিলকে। তার পিঠ হাতমোড়া করে বাঁধা। চোখে কালো কাপড়ের পট্টি, কিছুই দেখা যায় না। রুমে ঢুকেই পিতার কণ্ঠ শুনতে পেলো শাকিল। সে বললো, ‘বাবা, আমি শাকিল। আপনার পাশে দাঁড়িয়ে।’ শাকিল কথাটা শেষ করতে পারলো না। তার আগেই এক সিপাহি প্রচণ্ড এক লাথি বসিয়ে দিলো তার ঘাড়ে। শাকিল মাটিতে পড়ে যায়। চিৎকার করে উঠে। ইউসুফ বেগ তখন বললেন, ‘তোমরা আমাদেরকে এমন নির্যাতন করছো কেন?’ শাকিল অফিসারের কোনো উত্তর শুনতে পেলো না। শুধু শুনতে পেলো বন্দুকের বাঁট দিয়ে মাথায় আঘাত করার শব্দ। তারপর স্পষ্ট সে শুনতে পেলো, তার বাবা কালেমায়ে শাহাদাত পাঠ করছেন। ডাক্তার এসে শিরা পরীক্ষা করে বলছেন, ‘তিনি আর নেই।’

শাকিল চিৎকার দিতে গিয়েও দিতে পারে না। বুকের ভেতর সব শব্দ জমাট বেঁধে যায়। তার সামনে শহীদ করা হয়েছে তার বাবাকে। সে শুনতে পেয়েছে বাবার সর্বশেষ কাতরধ্বনি। কিন্তু সে তাকে ছুঁতে পারেনি, দেখতে পারেনি, বাবার মুখে তুলে দিতে পারেনি পানির একটি ফোঁটাও। ছেলের সামনে খুন করা হচ্ছে বাবাকে—এরচে নির্মম, এরচে বেদনার আর কিছু হতে পারে পৃথিবীতে?

বিসিএফ শুধু অস্ত্র নেয়নি, লুট করে নিয়ে গেছে ফরিদার ঘরের সবকিছু। বিছানা ছাড়া আর কিছুই নেই ঘরে। স্বর্ণের বাক্স খালি, ওয়ার্ডরব শূন্য, মানিব্যাগে টাকা নেই। নেই ফ্রিজ, ওয়াশিন মেশিন। সিপাহিরা লুট করে নিয়ে গেছে মটর সাইকেল ও বাইসাইকেলও। ফরিদা এই রুম থেকে ওই রুমে, ওই রুম এই রুমে দৌড়াচ্ছে। কোথাও কিছু রেখে যায়নি সিপাহিরা। তার মাথায় রক্ত উঠে গেছে। এক সিপাহি মুখ ভেঙচিয়ে বললো, ‘তুই খুব ভয়ংকর নারী। সবচে বড় সন্ত্রাসী তুই।’ ফরিদা রাগ সংবরভ করতে না পেরে কর্কশ গলায় বললো, ‘তোরা সব বদমাশ। ডাকাত। আমার টাকা-পয়সা, সোনা-গহনা সব লুট করেছিস। অস্ত্র আর মুজাহিদ ধরতেই যদি আসিস, টাকা-পয়সা ডাকাতি করলি কেন? তোরাই তো সবচে বড় সন্ত্রাসী। আজাদী আমাদের রক্তের অধিকার। এটা যে-ই কেড়ে নিতে চাইবে, সে-ই হবে আমাদের শত্রু। শত্রুর হাতে আমরা আমাদের দেশ তুলে দিয়ে বসে থাকবো?’

দুদিন পেরিয়ে গেছে ঘটনার। গত দুদিন শুধু পানি খেয়ে রোজা রেখেছে ফরিদা। এখন ইফতার নিয়ে বসেছে। তার বাড়িতে গিজগিজ করছে সিপাহি। এলাকার মানুষও আসা-যাওয়া করছে। ফরিদাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছে। এই সময় মানুষের ভীড় ঠেলে ভেতরে ঢুকলো মুসাররাত। ফরিদা মুসাররাতকে জড়িয়ে ধরলো। কান্নাভেজা কণ্ঠে বললো, ‘বাকিরা কেমন আছে?’

মুসাররাত বললো, ‘সবাই ভালো আছে। আমাকে ছেড়ে দিয়েছে।’

ফরিদা জিজ্ঞেস করলো, ‘সবাইকে খাবার দেয়?’

দুদিন ধরে বিসিএফ ক্যাম্পে তাদেরকে খাবার দেয়া হয়নি। তবুও মিথ্যা বললো মুসাররাত, ‘খাবার দেয়। আমি খাবার খেয়েই এসেছি।’

ফরিদা এবং সায়মা ইফতার করলো। সাধার পরও ইফতার করতে বসলো না মুসাররাত। মাগরীব পড়ে ফরিদা মুসলায় বসে আছে।  হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলো এক মহিলা। সে খবর দিলো, ‘এই ঘরের মালিক মারা গেছে।’

সংবাদটি শুনার পর ঘরে মাতম পড়ে গেছে। এই ঘরের মালিক মকবুল জান। সিপাহিরা তাকে মেরেই ফেললো? সায়মা, সাঈদা বেগম বিলাপ করছে। কিন্তু শোকে পাথর হয়ে গেছে ফরিদা। আত্মভোলার মতো বসে আছে। কাঁদছে না, বিলাপ করছে না। তার দুচোখে অচীন কোনো দেশের অচীন কোনো কুয়াশা গাঢ় হয়ে আছে। বৈধব্যের নিঃসীম বেদনা যেন অবশ করে দিয়েছে তার চোখ। ফরিদা গা ঝারা দিয়ে উঠলো। কেউ কিছু বললো না। সে কমান্ডারের কাছে গিয়ে বললো, ‘গাড়ির ব্যবস্থা করুন। কন্ট্রোল রুমে গিশে স্বামীর লাশ আনতে চাই।’

বাড়ির সামনে তখন অনেক মানুষের ভীড়। সবাই বিধ্বস্ত, নিঃস্ব ফরিদাকে দেখতে এসেছে। পুলিশ কর্মকর্তা ভীড় ঠেলে ফরিদাকে গাড়িতে তুলে রওয়ানা হয়ে গেলো। কন্ট্রোল রুমের সামনে একটা ট্রাকে রাখা ছিল লাশ। সাদা চাদর দিয়ে ঢাকা। লাশের সামনে দাঁড়িয়ে ফরিদা আজ বড্ড দুর্বল হয়ে পড়েছে। এমন দুর্বলতা, অসহায়ত্ব তার কোনোদিন অনুভূত হয়নি। তার চোখ ছলছল করছে জলে। সারাজীবন একসঙ্গে থেকে শেষ সময়টা পাশে থাকতে পারলো না। মকবুলের খুব ইচ্ছে ছিল ফরিদার কোলে মাথা রেখে বিদায় নেবার। হয়নি। অনেক সাহস আর শক্তি নিয়ে ফরিদা লাশের মুখ থেকে চাদরটা সরালো। ফরিদা বিদ্যুচ্চমকের মতোই চমকে উঠলো। এটা তো মকবুল নয়, তার বাবা ইউসুফ বেগের লাশ!

ফরিদা আর তাকিয়ে থাকতে পারলো না। তার দুচোখ জুড়ে নেমে আসছে অন্ধকার। গাঢ় অন্ধকার। প্রলয়ংকরী ঝড়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে তার কলজে, হৃদপিণ্ড। আলুচাবাগে যখন লাশ নিয়ে পৌঁছল, শেষ বিদায় জানাতে তখন সেখানে লোকে লোকারণ্য। এত লোক, এত মানুষ, ফরিদার তবুও শূন্য শূন্য লাগছে। প্রবল হাহাকার রনিয়ে রনিয়ে উঠছে। বড় ভাই বেলাল, মেঝো ভাই শাকিল, ছোট ভাই ফিরোজ কেউ নেই এখানে। তারা সবাই চৌদ্দশিকের ভেতর বন্দী। মাকে সান্ত্বনা দেবার কোনে ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না ফরিদা। সান্ত্বনার তো কিছু বাকি নেই-ও। কূর্পূর হাওয়ায় মিলিয়ে গেলে তার গন্ধ ছাড়া আর কিছুই থাকে না। মানুষ মরে গেলে তার স্মৃতি ছাড়াও আর কিছু থাকে না।

ফরিদা নিজেই বাবার লাশের খাটিয়ে নিজের কাঁধে তুলে নিলো। সবাই নানা না করলো। মেয়ে মানুষের খাটিয়া কাঁধে নিতে নেই। কিন্তু ফরিদার মনে হচ্ছে সে এখন আর নারী নেই। বরং প্রবল প্রদীপ্ত পুরুষ। ছেলের শূন্যতা পূরণ করছে কাঁধে লাশ নিয়ে। পৃথিবী দেখুক ছেলেরা জালিমের কারাগারে বন্দী। তাই মেয়ে তার কাঁধে তুলে নিয়েছে বাবার লাশ। কবরস্থানের সীমানায় গিয়ে নিজের ভারটা অন্যের কাঁধে তুলে দিলো ফরিদা।

ফরিদা চাইছিলো না তার বাবার ‘চারদিনা’  অনুষ্ঠান করতে। প্রথমত, এটা শরীয়ত সিদ্ধ নয়। দ্বিতীয়ত, ঘরের পুরুষ সবাই জেলে। তৃতীয়ত, বিসিএফের লুটের কারণে হাত শূন্য। কিন্তু এলাকাবাসীর উদ্যোগেই ‘চারদিনা’ অনুষ্ঠান হবে আগামীকাল। সকাল নয়টায় ফাতেহাখানি। ফরিদাও বাঁধা দিতে পারলো না। ইফতারির সময় ঘনিয়ে এসেছে। ইফতার নিয়ে বসে আছে ঘরের সবাই। এই সময় মসজিদের মাইকে ঘেষণা করা হলো—’কন্ট্রোল রুমে চারটি লাশ এসেছে। স্বজনরা এসে লাশ শনাক্ত করে নিয়ে যান।’

ফরিদা থ হয়ে গেলো। তাহলে বাকীদের লাশও পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে? বোরকা গায়ে জড়িয়ে বেরুতে যাচ্ছিল ফরিদা। কিন্তু ফরিদাকে কেউ বেরুতে দিলো না। এক আত্মীয় খোঁজ নিয়ে জানালো, কন্ট্রোল রুমে বেগ পরিবারের কোনো লাশ নেই। বামনা থেকে যে মুজাহিদদের গ্রেফতার করা হয়েছিল, তাদেরও কারও লাশ নেই। ফরিদার বিশ্বাস হচ্ছিল না। তার মনে হচ্ছে, তার কাছে সত্যটা লুকানো হচ্ছে। আসলে ওই লাশগুলো বেগ পরিবারেরই। ফরিদার ভেতর ঘোর কাজ করে। সে দেখতে পায়, মকবুল তাকে ডাকছে। মুদ্দাসির তাকে ডাকছে। তার তিন ভাই বেলাল, শাকিল, ফিরোজ তাকে ডাকছে। সবার ডাকের সাড়া দিতে দিতে সে ঘুমিয়ে পড়ে। নিবিড় নিশ্চুপ হয়ে। অনেকদিন ধরে তার এমন ঘুম হয় না।

আগের সংবাদঈদসংখ্যার গল্পলেখক শওকত ও তার স্ত্রী রেবেকার মিলন অথবা বিচ্ছেদ-কাহিনী
পরবর্তি সংবাদঅভিশাপ