খন্দকার রাকিব। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ ও মেধাবী লেকচারার। পড়াশোনা করেছেন মাদরাসায়ও। বাংলাদেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপচারিতায় বসেছিলেন ইফতেখার জামিল।
বাংলাদেশে দুই হাজার তেরো সালের পর থেকে একটা কালচারাল পরিবর্তন এসেছে বলে অনেকে দাবি করেন, একে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
২০১৩ সালে শাহবাগ আর শাপলার যে ঘটনা আমরা দেখেছি, বাংলাদেশের জনপরিসরে এর বড়সড় একটা প্রভাব যে পড়েছে সন্দেহ নাই। একটা উদাহরণ দি, মূলধারার গণমাধ্যমে যখন এদেশের ইসলামি ঘরানার মানুষজনের চিন্তা–ভাবনা আলাপ–আলোচনা এক অর্থে সংকুচিত হয় গিয়েছিল, সেখান থেকে দেখেন ইসলামি ঘরানার মানুষজনের মধ্যে অনেক নিও–মিডিয়ার জন্ম হয়েছে। ফাতেহ টোয়েন্টি ফোর ডট কমের বাইরেও, ইনসাফ, ইসলাম টাইমস, আওয়ার ইসলামসহ এমন অনেক অনলাইন মিডিয়ার জন্ম এর বড়সড় প্রমাণ। আমি এসব মিডিয়া নিয়মিত ফলো করি, এবং এসবের ভিউজ, শেয়ার দেখলেই বুঝবেন সমাজে এর বড় প্রভাব পড়েছে।
এ ছাড়া ২০১৩ সালের পর হেফাজতে ইসলামসহ চরমোনাইয়ের ইসলামী আন্দোলন থেকে নানান ধারার ইসলামি গ্রুপগুলোকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে লক্ষ করবেন, তাঁরা আধুনিক রাজনীতি আর পাবলিক ইস্যুগুলোকে নিয়ে নিয়ত নিজেদের চিন্তা–চেতনা হাজির করছেন। এসময়কার দুনিয়ার নানান প্রশ্নের মোকাবেলায় তাঁরা ভালোই কায়দাকানুন রপ্ত করেছেন। এ ছাড়া রাষ্ট্রের দিক থেকে বললে, রাষ্ট্রও ইসলামপ্রশ্ন নিয়ে আগের থেকে এখন অনেক কনসার্ন হয়েছে।
এই সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের সাথে সাথে আরও অনেক কিছু হচ্ছে। নিরাপত্তা-সংকট বাড়ছে, পাশাপাশি অনেকে এই উত্থানকে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ হিসেবেও আখ্যা দিচ্ছেন। একে কীভাবে দেখবেন?
হ্যাঁ, এটা তো দুনিয়াজুড়েই ঘটেছে ওয়ার অন টেররের পরে, একটা কাঠামোগত পদ্ধতিতে। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ, সংখ্যালঘিষ্ঠ নির্বিশেষে সকল দেশেই ইসলাম ধর্মীয় চিহ্ন, নিশানা জনপরিসরে নিরাপত্তা সংকট এবং নজরদারির বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে এখন দেখেন, যেকোনো ‘ইসলামি সাবজেক্ট ম্যাটার’ আছে এমন অনুষ্ঠান আয়োজন করতে পুলিশের অনুমতি লাগছে। তবে ইসলামি আচার চিহ্ন নিয়ে আগে যে পরিমাণ হয়রানি আর ভয়ভীতির মধ্যে মানুষ ছিল, হেফাজতের সাথে সরকারের বোঝাপড়ার পর এটা কিছুটা কমেছে।
সাংস্কৃতিক পরিবর্তন আসলেও ধর্মীয় রাজনীতি তেমন একটা সুবিধে করতে পারেনি। একে কি নিছক নির্বাচনী ব্যবস্থার সংকট হিসেবে আখ্যা দেবেন নাকি এর সাথে দলগুলোর ব্যর্থতাও সমানভাবে জড়িত?
ধর্মীয় রাজনীতি সুবিধা করতে পেরেছে কি পারেনি সেটা আসলে নির্ভর করে কোনো একটা দলের রাজনৈতিক তৎপরতা এবং রাজনৈতিক ভিশনের উপর। খেয়াল করলে দেখবেন, ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনকালের বড় সময়ে এখানকার মানুষ রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে না–ই হয়ে ছিল, কিন্তু এর মানে এই না যে তাদের রাজনীতি বা রাজনৈতিক তৎপরতা বন্ধ হয়ে ছিল। আমি তো বলব, ঐ সময়ের রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলো মানুষের দাবি–দাওয়া নিয়ে সবসময় লেগে থাকার দরুণ সমাজে প্রবল রাজনৈতিকভাবে হাজির ছিল। ক্ষমতার অংশ আকারে না থাকা সত্ত্বেও সমাজে তাদের প্রভাব ছিল ব্যাপকভাবে। ফলে ফরায়েজী থেকে শুরু করে এমন অনেক জনপ্রিয় আন্দোলন ছিল, যার রাজনৈতিক চরিত্র আর ধর্মীয় চরিত্র খুব একটা আলাদা ছিল না।
উপনিবেশ শাসনের পর দুনিয়াজুড়ে–ই মুসলমান সমাজগুলোতে মুসলিম জাতীয়াতাবাদ–ই ছিল সবচাইতে জনপ্রিয় আদর্শ। ধর্মীয় দলগুলো তখন থেকেই মূলধারার রাজনীতির বাইরে সরে যায়। জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সংকীর্ণতার দিকগুলো মানুষের সামনে হাজির হতে হতে মানুষ এই বিষয়ে এখন অনেক সতর্কও হয়েছে। ফলে এখন সে অর্থে মুসলিম জাতীয়াতাবাদী রাজনীতির আবেদনও আর নেই। আর ধর্মীয় রাজনীতি যে সাইড লাইনে পড়েছে সে আর মূলধারায় বের হয়ে আসতে পারেনি। তবে এ সময়ে বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক অবস্থা এবং রাজনীতি নিয়ে সাধারণ মানুষের যে বোঝাপড়া, সে ব্যাপারে ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলো যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না। বিশেষত রাষ্ট্র প্রশ্নে, ক্ষমতা প্রশ্নে, কার্যকরীভাবে রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ প্রশ্নে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় প্রশ্নে ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলোর চিন্তা–তৎপরতা পুরোপুরি পষ্ট না। এসব প্রশ্নের সুস্পষ্ট মীমাংসা না থাকার কারণে ধর্মীয় সার্কেলের বাইরে ধর্মীয় রাজনীতির খুব একটা আবেদন দেখা যায় নাই গত কয়েক দশকে।
আপনি আলিয়া মাদরাসা থেকে উঠে এসেছেন। অনেকে আলিয়া মাদরাসার ভবিষ্যত নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তবে আপনার মুখে বরাবর আশাবাদ দেখেছি। আলিয়া মাদরাসায় কওমি মাদরাসার গুরুত্বপূর্ণ কিতাবগুলো আছে এবং পাশাপাশি আছে সাধারণ মাধ্যমের সব, একজন শিক্ষার্থীর পক্ষে কতটা চাপ নেওয়া সম্ভব? আলিয়া মাদরাসার ছাত্রদের মধ্যে আত্মপরিচয়ের একটা সংকট তৈরি হচ্ছে বলে অনেকে মনে করেন। একে কীভাবে দেখবেন?
আশাবাদ দেখেছি বলতে আসলে এই অর্থে যে সমাজে এখনো বিপুল সংখ্যক মানুষের কাছে এর আবেদন রয়েছে। বাংলাদেশেরবর্তমানে ৯ হাজার তিনশো তিনটি আলিয়া মাদরাসায় সাড়ে ৩৮ লাখ শিক্ষার্থী রয়েছে। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে, আলিয়া মাদরাসায় নারীশিক্ষার্থীর হার এখন ৫৫%। এ ছাড়া মাধ্যমিক পর্যায়ে দেশের প্রতি তিনজন শিক্ষার্থীর একজন মাদরাসাশিক্ষার্থী। আর রাষ্ট্রীয় স্কুল–কলেজের কারিকুলামের পাশাপাশি দেওবন্দ ধারার মাদরাসার মতই বাংলাদেশের আলিয়া মাদরাসাগুলো দরসে নিজামি কারিকুলাম অনুসরণ করে। কিন্তু আশংকার বিষয় হচ্ছে, গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের মাদরাসা শিক্ষার যে উপায়ে সংস্কার হয়েছে তা যথাযথ গবেষণা এবং পঠন–পাঠনের মধ্য দিয়ে হয়নি। ফলে মাদরাসার স্বকীয়তাটা বিলুপ্ত হচ্ছে।
একটা ভালো দিক হচ্ছে সরকার মাদরাসাগুলো কো–অর্ডিনেট করতে ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু আমি দেখেছি দেশের মাদরাসা, মাদরাসা–শিক্ষার্থী এবং এর স্টকহোল্ডারদের নিয়ে এই প্রতিষ্ঠানের খুব ভালো কোনো ভিশন নাই। এটার আকার–আয়তন বৃদ্ধি করে মাদরাসাশিক্ষার্থীদের জন্য গবেষণামূলক উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আকারে হাজির হতে পারে এটি। অন্যান্য দেশে এর ভালো উদাহরণও আছে। এ ছাড়া মাধ্যমিক–উচ্চমাধ্যমিকের পর যেহেতু বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী ঝরে যায়, তাদের জন্যে বিভিন্ন ভাষা দক্ষতা–কারিগরি বিষয়ে ছয় মাস ভিত্তিক নানান ডিপ্লোমা কোর্স চালু করলে এর কার্যকরিতা আরও বাড়বে। তবে রাষ্ট্রকাঠামোটা এমনভাবে হাজির যেখানে কাঠামোগতভাবে মাদরাসাশিক্ষার্থীরা আলাদা হয়ে আছে, এসব নিয়ে আরও বিস্তারিত আলাপ করা যাবে।
তবে আলিয়া মাদরাসার ভবিষ্যত নিয়ে অনেকেই আশংকা প্রকাশ যে করেন এর যথেষ্ট কারণ আছে। যেমন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা মাক্সুদা বানু বলছিলেন, বাংলাদেশের ইসলাম–ধর্মীয় অথরিটি এখন দেওবন্দ–ধারার মাদরাসাগুলোই করে, আলিয়া মাদরাসা না। আলিয়া মাদরাসাগুলো একালে মডার্ন শিক্ষাব্যবস্থার সাথে প্রতিযোগিতা করে, ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থার সাথে না। তবে বানুর গবেষণাটা মূলত ঢাকা আর চট্টগ্রাম শহর–কেন্দ্রিক ছিল বলে বানু কিছুটা সরলীকরণ করে ফেলেছেন মনে হয়। কেননা আলিয়ার একটা বড় অংশ মডার্ন শিক্ষার সাথে প্রতিযোগিতা করলেও, আরেকটা অংশ এখনো ধর্মীয় ইস্যুতে প্রতিনিধিত্ব করে যাচ্ছে। ছারছিনা, চরমোনাই রশিদিয়া, তামিরুল মিল্লাত, জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়াসহ নানান ধারার বড়সড় কিছু মাদরাসা রয়েছে, যারা এখনো সমাজে যথেষ্টভাবে প্রভাব জারি রেখেছে। তবে মানের দিক থেকে বললে এসব মাদরাসার শিক্ষার মান নিয়ে যথেষ্ট শংকার অবকাশ রয়েছে। এসব নিয়ে ভালো স্টাডি হওয়া দরকার। কীভাবে কী করা যায় আরও।
এই সময়ে আপনি ঠিক কোন কোন ইস্যুকে গুরুত্বপূর্ণ আকারে দেখেন?
কোন ইস্যু গুরুত্বপূর্ণ এটা আসলে নির্ভর করে আর্থ–সামাজিক–রাজনৈতিক অবস্থা ভেদ করে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যদি বলি, তবে এখনকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হচ্ছে বাংলাদেশকে একটা নাগরিকবান্ধব মানবিক রাষ্ট্র আকারে রূপান্তরের লড়াইটা। এইটা একটা লম্বা লড়াই। মোটামুটি সকল ইস্যুই এই লড়াইয়ের মধ্যে রয়েছে বলে আমি মনে করি।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক চর্চার পথ সংকুচিত হবার পর অ্যাকটিভিজমের পরিসর বাড়ছে। অ্যাকটিভিজমের ক্ষেত্রে এই সময়ে আপনি প্রধান কী কী বৈশিষ্ট্য ও প্রবণতা দেখেন?
অ্যাকটিভিজিমও এক ধরনের রাজনৈতিক চর্চা। বাংলাদেশের জনপরিসরে ভয়ের সংস্কৃতিটা এত প্রবল হয়েছে যার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক চর্চার পথগুলো সংকুচিত হয়ে গেছে। তবে যে অ্যাকটিভিজম আমরা দেখি এটাও একটা সীমার মধ্য দিয়ে চলে। যাঁদের অ্যাক্টিভিস্ট আকারে দেখা হয়, সবাই নিজেরা নিজেরা নিজেদের সার্কেলের বাইরে খুব একটা তৎপর না, আবার অন্যদের স্পেইসও দিতে চান না, অনেকের পক্ষে আবার স্পেইসও দেয়া সম্ভব না। ফলে সামাজিক মিডিয়া এবং মানববন্ধন–কেন্দ্রিক যেসব
অ্যাকটিভিজম দেখি, এগুলোর একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এসব আলাদা আলাদাভাবে স্ব স্ব সার্কেলের মধ্য স্ব স্ব সার্কেলের ইস্যু–কেন্দ্রিক হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ইসলামপন্থার একটা নীরব সংঘাত চলছে। সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক নানা পরিসরে। তবে কোটা ও সড়ক আন্দোলনে দেখা যাচ্ছে, তরুণরা এর বাইরেও ভাবতে শিখছে। আগামী দিনের বাংলাদেশের রাজনীতি ও সংস্কৃতিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
আমি তো মনে করি সেক্যুলার আর ইসলামপন্থার মধ্যে একটা ব্রিজ নির্মাণ করতে পারলে একটা সুন্দর বাংলাদেশ গড়া সম্ভব। এজন্যে উচিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অমীমাংসিত ইস্যুগুলোতে এবং যেসব বিষয়ে বলছেন নীরব সংঘাত চলছে, সেসব বিষয়ে পরস্পরবিরোধী গ্রুপগুলোর সংকীর্ণ চিন্তা চেতনাগুলো ক্রিটিক করার পাশাপাশি সবাইকে এনলাইটেন করা। আগামী দিনের রাজনীতি–সংস্কৃতি আসলে এর ওপরই নির্ভর করছে যে, এই গ্রুপগুলো কীভাবে নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব নিরসন করবে।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
আপনাকেও। ফাতেহ টোয়েন্টি ফোরের জন্য অনেক শুভ কামনা।