
রাগিব রব্বানি :
বাংলাদেশের ইসলামি ধারায় সাহিত্য ও লেখালেখির চর্চায় সাম্প্রতিক কালে যে বিপ্লব সাধিত হয়েছে, এর মূলে বেশ কয়েকজন মনীষী আলেমের অবদান অনস্বীকার্য। মাওলানা মুহিউদ্দীন খান ও মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ তাঁদের অন্যতম। কিন্তু বিপ্লব শুরু করতে গিয়ে এই মনীষী আলেমরাও যাঁর কাছ থেকে প্রেরণা পেয়েছিলেন তিনি বিশ্বনন্দিত ইসলামিক স্কলার সাইয়েদ আবুল হাসান আলি নাদাবি রহমতুল্লাহ আলায়হি।
সাইয়েদ আবুল হাসান আলি নাদাবি ভারতের বাসিন্দা হলেও একই সঙ্গে ছিলেন উর্দু-আরবি ভাষাবিদ, সমাদৃত সাহিত্যিক, ইতিহাবেত্তা এবং সিরাতগবেষক। ছিলেন যুগসচেতন একজন কিংবদন্তি আলেম। পৃথিবীর বহু দেশ ঘুরেছেন। মুসলিম অধ্যুষিত জনপদগুলোতে ভ্রমণের সময় স্থানীয় মুসলমানদেরকে তাদের হারানো শৌর্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। শাসকের স্থান থেকে ছিটকে পড়ে কীভাবে এই জাতি শোষিত শ্রেণিতে পরিণত হয়েছে, সেই মর্মান্তিক দাস্তান শুনিয়ে পুনরায় উজ্জীবিত হবার আহ্বান জানিয়েছেন। শিল্প ও সাহিত্যের বাগডোর নিজেদের আয়ত্বে নিয়ে আসবার কৌশল শিখিয়েছেন।
এরই ধারাবাহিকতায় মনীষী এ আলেম দুইবার বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। প্রথমবারের সফর ছিল ১৯৮৪ সালের মার্চ মাসে। ১০ দিনের সংক্ষিপ্ত এ সফরে তিনি ঢাকা, সোনারগাঁ, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও রাজশাহী ভ্রমণ করেন। প্রতিটা এলাকায়ই ওলামায়ে কেরাম ও সুধীজনদের উদ্দেশে হৃদয়স্পর্শী বক্তব্য রাখেন। আর এসব বক্তব্যের বড় একটি অংশজুড়ে ছিল বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির নেতৃত্ব কেন এ দেশের ইসলামপন্থীদের হাতে নেই, সেই আফসোস। প্রতিটা বক্তব্যে তিনি এ দেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতির নেতৃত্বগ্রহণের জোরদার আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশি ওলামায়ে কেরামের প্রতি।
দ্বিতীয়বারের সফরটা ছিল আরও সংক্ষিপ্ত, ১৯৯৪ সালে। চট্টগ্রামের দারুল মাআরিফের মহাপরিচালক মাওলানা সুলতান যওক নদভীর আমন্ত্রণে ছিল এ সফর। এ সফরেও তিনি একই আহ্বান জানিয়ে গিয়েছিলেন বাংলাদেশি ওলামায়ে কেরামের প্রতি—বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের নেতৃত্ব গ্রহণ করতে হবে।
দুইবারের বাংলাদেশ সফরে বিভিন্ন জায়গায় আলেম-ওলামা ও ধর্মীয় বুদ্ধিজীবী মহলের উদ্দেশে যে বক্তব্যগুলো প্রদান করেছিলেন সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলি নাদাবি, তার সারনির্যাস ছিল এ রকম—
১. আপনাদেরকে বাংলাভাষা ও সাহিত্যের নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করতে হবে।
২. উলামা ও বুদ্ধিজীবী সমাজকে সজাগ ও হুঁশিয়ার থাকতে হবে।
৩. আপনাদের নিজস্ব কৃষ্টি-কালচার, নিজেদের কবি-সাহিত্যিক এবং বুদ্ধিজীবীদেরকে জনগণের সামনে, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে হবে। অন্যথায় এ জাতি সভ্যতা ও সংস্কৃতির দিক থেকে দেউলিয়া হয়ে পড়বে। (আল্লামা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. : জীবন ও কর্ম, পৃষ্ঠা : ১৮২)
১৯৮৪ সালে প্রথমবারের সফরে ১৪ মার্চ তারিখে জামিয়া ইমদাদিয়া কিশোরগঞ্জে আলেম-ওলামা ও মাদরাসা-ছাত্রদের উদ্দেশে তিনি যে বক্তব্য প্রদান করেছিলেন, সেটা এ দেশের ওলামায়ে কেরামকে ব্যাপকভাবে বাংলাভাষা চর্চার প্রতি প্রবুদ্ধ করেছিল। বক্তব্যটির অনুবাদ ও লিখিতরূপ লাভের কারণে আজও সেই বক্তব্য থেকে প্রেরণা গ্রহণ করেন লিখতে আসা আলেম ও মাদরাসাছাত্ররা।
মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী, মাওলানা আকরম খাঁ, মাওলানা মুহিউদ্দীন খান বাংলা ভাষায় লেখালেখির ময়দানে যে নীরব আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন, আলি মিয়া নাদাবির কিশোরগঞ্জের ভাষণ সেই আন্দোলনের নিয়ামক হিসেবে কাজে লাগে। নব্বইয়ের দশকে বা তারও পরে আলেমদের মধ্য থেকে যাঁরা লিখতে এসেছেন, এই বক্তব্য ছিল তাঁদের প্রত্যেকেরই অনুপ্রেরণার উৎস।
মাদরাসার পরিমণ্ডলে বাংলাভাষাকে একসময় অস্পৃশ্য মনে করার একটা রেওয়াজ ছিল, সে রেওয়াজের বিরুদ্ধে যে গুটিকয়েক সাহিত্যসমঝদার আলেম কথা বলছিলেন, আলি মিয়া নাদাবির এই বক্তব্য তাদের কাছে একটি দলিল হিসেবে পরিগণিত হয়।
এ ছাড়া বিগত কয়েক বছর ধরে মাদরাসা পরিমণ্ডলসহ ইসলামি অঙ্গনে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চার যে একটা বিপ্লব সাধিত হয়েছে, আলি মিয়া নাদাবির সেই ভাষণ ছিল এই বিপ্লবেরই একটা বীজ।
মাওলানা মুহাম্মদ সালমান রচিত ‘আল্লামা সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী : জীবন ও কর্ম’ গ্রন্থে মাওলানা আবু তাহের মেসবাহের অনুবাদে কিশোরগঞ্জে প্রদত্ত সেই বক্তব্যটি পরবর্তীতে গ্রন্থিত হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন মাধ্যমে এই বক্তব্যটি বিপুলভাবে পঠিত হয়ে আসছে।
বক্তব্যটির চুম্বকাংশ থেকে আংশিক—
…এ দেশের ভাষাকে (বাংলা ভাষা) আপনারা অস্পৃশ্য মনে করবেন না। ‘বাংলা ভাষা ও তার সাহিত্য চর্চায় কোনো পূণ্য নেই, যত পূণ্য সব আরবী আর উর্দুতে’—এ ধারণা বর্জন করুন। এটা নিছক মূর্খতা। নিজেদেরকে বরং বাংলা ভাষার বিরল প্রতিভারূপে গড়ে তুলুন। আপনাদের প্রত্যেককে হতে হবে আলোড়ন সৃষ্টিকারী লেখক, সাহিত্যিক, সুবক্তা। সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় আপনাদের থাকতে হবে দৃপ্ত পদচারণা, লেখনী হতে হবে রসসিক্ত ও সম্মোহনী শক্তির অধিকারী। যেন আজকের ধর্মবিমুখ শিক্ষিত তরুণ সমাজও অমুসলিম লেখক-সাহিত্যিকদের লেখনী ছেড়ে আপনাদের সাহিত্যকর্ম নিয়েই বিভোর থাকে।… (আল্লামা সাইয়েদ আবুল হাসান আলি নদভী : জীবন ও কর্ম। পৃষ্ঠা : ৪২৬)
বন্ধুগণ! উর্দু ভাষার পরিবেশে যে চোখ মেলেছে, আরবী সাহিত্যের খেদমতে যে তার যৌবন নিঃশেষ করেছে সে আজ আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে পূর্ণ দায়িত্বসচেতনতার সাথে বলছে—বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে ইসলামবিরোধী শক্তির রহম-করমের ওপর ছেড়ে দেবেন না। ‘ওরা লিখবে আর আপনারা পড়বেন’—এ অবস্থা কিছুতেই বরদাশত করা উচিত নয়।… (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা : ৪২৭)
…এ দেশের মুসলিম সাহিত্যিকদের বিশ্বদরবারে আপনারা তুলে ধরুন, নজরুল ও ফররুখকে তুলে ধরুন, তাদের অনবদ্য সাহিত্যকর্মের কথা বিশ্বকে অবহিত করুন। নিবিষ্ট মন ও গবেষকের দৃষ্টি নিয়ে তাদের সাহিত্য পাঠ করুন, অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ করুন এবং আল্লাহ তওফিক দিলে আরবি ভাষায়ও তাদের সাহিত্য পেশ করুন। কত শত আলোড়ন সৃষ্টিকারী সাহিত্যপ্রতিভার জন্ম হয়েছে এদেশে, তাদের কথা লিখুন, বিশ্বের কাছে তাদেরকে তুলে ধরুন। আল্লাহর রহমতে এমন কোনো যোগ্যতা বাকি নেই যা আপনাদেরও দেওয়া হয়নি।…
…আমার কথা মনে রাখবেন, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের নেতৃত্ব নিজেদের হাতে নিতে হবে। দুটি শক্তির হাত থেকে নেতৃত্ব ছিনিয়ে আনতে হবে। অমুসলিম শক্তির হাত থেকে এবং অনৈসলামী শক্তির হাত থেকে। অনৈসলামী শক্তি বলতে সেইসব নামধারী মুসলিম লেখক-সাহিত্যিকের কথাই আমি বোঝাতে চাচ্ছি, যাদের মন-মগজ এবং চিন্তা ও কর্ম ইসলামী নয়।… এমন অনবদ্য সাহিত্য গড়ে তুলুন যেন অন্যদিকে কেউ আর ফিরেও না তাকায়।… (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা : ৪২৮)