শোয়াইব আবদুর রউফ। হাফেজ, মাওলানা, আদিব, দাওয়াহ স্কলার। এগুলো তাঁর একাডেমিক ব্যক্তিত্ব-পরিচয়ের খেতাব। তাঁর বড় পরিচয়, তিনি একজন মাদরাসাপড়ুয়া আলেম, দীনের দাঈ, উম্মাহর খাদেম। একদিকে তিনি দরসের মসনদে বসে তালিবুল ইলমদের উন্মুখ মনে ঢেলে দিচ্ছেন কুরআন-হাদিস-আদবের সঞ্জীবনী, অপরদিকে খেদমতে খালকের ময়দানে একজন আদর্শ সমাজসেবক হয়ে কাজ করে যাচ্ছেন বিপুল কর্মতৎপরতায়।
১৯৭৭ সালে কিশোরগঞ্জ জেলার এক অভিজাত ব্যবসায়ী পরিবারে জন্ম নেওয়া শোয়াইব আবদুর রউফ শিক্ষাজীবনের সিংহভাগ সময় কাটিয়েছেন মুজাহিদে মিল্লাত মাওলানা আতহার আলী রহ. প্রতিষ্ঠিত আল জামিয়াতুল ইমদাদিয়ায়। এখান থেকে দাওরায়ে হাদিস সমাপ্ত করে দাওয়াহ পড়ার উচ্চাশায় তিনি পাড়ি জমান মক্কা মোকাররমায়। তাঁর উসতাদদের তালিকায় যেমন আছেন আযহার আলী আনোয়ার শাহের মতো ইলমি মনীষা এবং আতাউর রহমান খানের মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, তেমনই ডক্টর ইবরাহিম নাসির আল বিশর, ডক্টর মুনকিজ মাহমুদ সাক্কার, ডক্টর আবদুল আজিজ আল হুমাইদি প্রমুখের মতো নামজাদা আরব স্কলারগণও। কর্মজীবনে তিনি আল জামিয়াতুল ইমদাদিয়ার মুহাদ্দিস। সেইসাথে দীনি এবং সমাজসেবামূলক উন্নয়নকাজে নিজেকে আমূল জড়িয়ে নিয়েছেন। বৃহত্তর মোমেনশাহীতে খেদমতে খালকের ময়দানে শোয়াইব আবদুর রউফ একজন উদ্দীপ্ত কর্মবীরের নাম।
ফাতেহ টুয়েন্টি ফোর ডটকমের তরফ থেকে শায়খ শোয়াইব আবদুর রউফ হাফিজাহুল্লাহ’র মুখোমুখি হয়েছিল— মুজিব হাসান এবং খাইরুল ইসলাম। মুখোমুখি আলাপটি আমাদের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
মুজিব হাসান : সালামুন আলাইকা উসতাদ! করোনাকালে ঘরবন্দি দিনে আপনার সময় কীভাবে কাটছে?
শোয়াইব আবদুর রউফ : ঘরবন্দি দিনে আমার সময় কাটছে অনেকটা ঘরবন্দিদের সেবায়। নিজে বন্দি না, নিজে মুক্তই। যেরকমভাবে বাবুর্চিরা রান্না করে অনেকেই খাবার খায়, সেরকম এটা আমাদের ওপর আল্লাহ পাকের একটা বিশেষ রহমত যে, যারা ঘরবন্দি আছে, বিশেষ করে করোনায় বিপর্যস্ত, লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত এবং দুস্থ ও দিনমজুর, এদেরকে কিছুটা সহায়তার সুযোগ আল্লাহ পাক করে দিচ্ছেন। তোমরা হয়তো জানো— আল্লামা আযহার আলী আনোয়ার শাহ ফাউন্ডেশনের কথা। এটা একরকম সরকারকর্তৃক অনুমোদিত। ডিসি সাহেবের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা আছে এখানে। তার স্বাক্ষরিত পরিচয়পত্রও দেওয়া হয়েছে। এদের অধীনে একধরণের ত্রাণকাজের সাথে আমি ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। এই পরিপ্রেক্ষিতে বলা যেতে পারে, ঘরবন্দিদের সেবা দিয়ে আমার দিন কাটছে। আসলে আল্লাহ পাকই সব করাচ্ছেন। ব্যক্তিগতভাবে কারো সেবা করার যোগ্যতা, ক্ষমতা বা সামর্থ্য কোনোটাই আমাদের নেই।
খাইরুল ইসলাম : আপনার মাদরাসাজীবন নিয়ে কিছু হাসি-কান্নার স্মৃতিচারণ শুনতে চাই!
শোয়াইব আবদুর রউফ : মাদরাসাজীবনের স্মৃতি তো সব টক-ঝাল-মিষ্টির মতো স্মৃতি! অনেক স্মৃতিই জমে আছে। হেফজখানায় যখন পড়তাম, আমি একটু ছন্নছাড়া ধরণের ছিলাম। দুষ্টুমিভরা জীবন ছিল সেটা। যখন কিতাবখানায় পড়া শুরু করেছি, তখন আমার একটা আগ্রহ ছিল ‘আউট বই’ পড়ার প্রতি। বিভিন্ন ধরণের গল্প-উপন্যাস আর সাহিত্যের বইয়ের প্রতি একধরণের দুর্দান্ত এডিকশন বা আসক্তি ছিল। এগুলো না পড়ে আমি থাকতে পারতাম না। ক্লাসের মধ্যে আল্লাহ পাক সবসময় আমাকে সম্মানজনক স্থানে রেখেছেন। এটা আমার কাছে খুব ভালো লাগত। যখন আমি কোনো বই পড়তাম, তখন এমন একটা চম্বুক আকর্ষণীয় স্থান, যেটা না পড়লেই না হয়, সেখানে গিয়ে বইটা বন্ধ করে দিতাম। বই বন্ধ করে ক্লাসের সবকটা পড়ে নিতাম। তখন মাথার মধ্যে কাজ করত, ওই অংশটা আমাকে পড়তে হবে, এজন্য তাড়াতাড়ি সবকটা শিখতে হবে। আর এভাবে দেখা যেত, যে সবকে অন্যদের আধাঘণ্টা সময় লাগাত, সেটা আমি পাঁচ মিনিট বা তার চেয়ে কম সময়ের মধ্যে হল করে নিতাম। অনেক সময় রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে সবকটা শিখে নিতাম। কারণ মাথার মধ্যে কাজ করত, বাসায় গিয়ে ওই অংশটা পড়তে হবে। এটা আমার কাছে একধরণের পুলকিত স্মৃতি। আলহামদুলিল্লাহ, এটা আল্লাহ পাকের বিশেষ রহমত। অনেকেই এসবের সাথে থাকার কারণে লাইনহারা হয়ে যায়। আল্লাহ পাক আমাকে এসবের সাথে থাকার পরও লাইনহারা করেননি।
মুজিব হাসান : ছাত্রজীবনে কোন উসতাদ দ্বারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছেন এবং কেন?
শোয়াইব আবদুর রউফ : আমাদের সময়টা এত প্রাচীন ছিল না, আবার এখনকার মতো প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতায় এত আধুনিকও ছিল না। এই দুইয়ের মাঝামাঝি ছাত্রজীবনের সময়টা ছিল অন্যরকম। আমাদের সময় সব উসতাদ দ্বারাই নিজেদের প্রভাবিত মনে করতাম। সব উসতাদের ক্ষেত্রেই মনে করতাম, অন্য সব জায়গার উসতাদ থেকে আমাদের উসতাদগণ সেরা। আর যে প্রতিষ্ঠানে থাকতাম, সেটাকেই সবচেয়ে সেরা প্রতিষ্ঠান মনে হত। অন্যগুলো চোখে তেমন ভাসত না। এরকম একটা মন-মানসিকতা কাজ করত। তবে পরবর্তীতে বাস্তবতার আলোকে দেখা গেছে ভিন্ন অবস্থা। আমাদের উসতাদগণ তো আছেনই, তাঁদের মতো এবং আরো ভালো মানের উসতাদও আছেন।
ব্যক্তিগতভাবে আমার ওপর অনেকেরই প্রভাব আছে। নুরানি মাদরাসায় যখন পড়তাম, তখন আমাদের নাজেরা পড়াতেন একজন বৃদ্ধ হুজুর ছিলেন— তাঁর বাড়ি বরিশাল, নামটা মনে আসছে না, আমরা তাঁকে বুড়া হুজুর বলেই ডাকতাম— হুজুরের গলার টোনটা এখনো আমার কানে বাজে। পরে যখন জামিয়া ইমদাদিয়ায় কিতাব বিভাগে ভর্তি হলাম, তখন তো আলহামদুলিল্লাহ সব উসতাদের স্নেহলাভে ধন্য হয়েছি। তবে প্রাথমিকভাবে আমার মধ্যে হিফজুর রহমান সাহেব হুজুরের প্রভাবটা সবচেয়ে বেশি। যেহেতু ছোটবেলা থেকে হুজুরের বাসায় থাকতাম, হুজুরের ছেলে হিসেবে গড়ে উঠেছি, হুজুরের মেজাজের সাথে আমার মেজাজও একটু মিল ছিল। তখন আমরা আরবি শেখার প্রতি একটু ঝুঁকছি। আরবি একটা শব্দ জানতে হলে, লুগাতে না পাওয়া গেলে— ইন্টারনেট ঘেঁটে বের করার সুবিধা তো ছিল না— হুজুরের দ্বারস্থ হতে হত। একটা আরবি পত্রিকা কীভাবে দেখতে হয়, এর জন্য হুজুরের কাছে যেতে হত। সেই হিসেবে আমি হুজুরের দ্বারা অনেক প্রভাবিত।
বিশেষ করে মক্কা মোকাররমায় যখন আল্লাহ পাক নিলেন, তখন সেখানে ডক্টর মুনকিজ মাহমুদ সাক্কার নামে একজন উসতাদ ছিলেন। তিনি তুলনামূলক ধর্মবিজ্ঞান সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখতেন। উম্মুল কোরা ইউনিভার্সিটি থেকে তাঁর ডক্টরেটটা ছিল এই বিষয়ে। তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব ছাড়াও আফকারে হাদ্দামা এবং সমকালীন বিভিন্ন আইডিওলোজির ওপরও তাঁর বুৎপত্তি ছিল অসাধারণ। তাঁর পড়ানোর ধরণ, জীবনধারা, গবেষণাধারা এগুলো আমাকে খুব প্রভাবিত করতো। এ ছাড়া আরেকজন উসতাদ ছিলেন ডক্টর আবদুল আজিজ আল হুমাইদি হাফিজাহুল্লাহ। হারামে তাঁর দরস আছে। তিনি মক্কার সমাজে একটা বৈশ্বিক চিন্তা লালন করতেন। বিশ্বের মুসলমানদের মধ্যে কীভাবে অমিলের মধ্যে থেকেও একটা মিল করা যায়, অনৈক্যের মধ্যেও ঐক্যের একটা পয়েন্ট খুঁজে পাওয়া যায়, এই বিষয়ে তাঁর অনেক ফিকির ছিল। আমাকে তিনি বলেছিলেন, হারামের বর্তমানে যিনি খতিব ডক্টর সালেহ আল হুমাইদ— তিনি সম্ভবত একসময় সউদি আরবের স্পিকার ছিলেন— তিনি নাকি তাঁকে বলেছেন, “আমাদের মনের কথাগুলো আপনি বলেন”। আমরা যা মুখ ফুটে বলতে পারি না, তা আপনি সাহস করে লেখার মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। তিনি আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। একদিন আমাকে বলেছিলেন— ما رأيت مثلك منذ سنوات। তাঁর দ্বারাও আমি অনেক প্রভাবিত। তাঁর চিন্তা-চেতনা, মনের বিশালতাও আমাকে অত্যন্ত আকৃষ্ট করছে। তাঁর একটা বই আছে— الرسائل الشمولية— দীনের বিভিন্ন বিষয়গুলোর যে ব্যাপ্তি-ব্যাপকতা আছে, এগুলো নিয়ে লিখেছেন। এ ছাড়া শাহসাব হুজুর রহ., খানসাব হুজুর রহ.— তাঁদের ব্যাপারটা তো ভিন্ন। ছোটবেলা থেকে তাঁদের সংস্পর্শে থাকার কারণে তাঁদের দ্বারাও যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছি।
খাইরুল ইসলাম : কুতুবে সিহাহ সিত্তাহ কার কার কাছে পড়েছেন? তাঁদের পড়ানোর তরজ (পদ্ধতি) সম্পর্কে কিছু বলুন!
শোয়াইব আবদুর রউফ : কুতুবে সিত্তাহ, আমরা যেটাকে সিহাহ সিত্তাহ বলি, এটা আমরা জামিয়া ইমদাদিয়ায়পড়েছি। আমাদেরকে বুখারি শরিফ জিলদে আওয়াল পড়িয়েছেন শাহ সাহেব হুজুর রহ.। আমাদের সময় তিনি একাই পুরো জিলদে আওয়াল পড়াতেন। শাহ সাহেব হুজুরের পাঠদান ছিল শাহ সাহেবের মতোই। তাঁর চলন-বলন, পোশাক-আশাক সবকিছুতে যেন একটা শাহিয়ানা ভাব ছিল, পড়ানোর সময়ও এটার ছোঁয়া পাওয়া যেতো। অল্পকথায় তিনি খুব চমৎকার মনোজ্ঞ আলোচনা করতেন। হুজুরের দরস সম্পর্কে তোমাদের অভিজ্ঞতা আছে কিছুটা, তাঁর আলোচনা শুনলে ক্লাসের বাইরে আর পড়া লাগত না। মনে আছে, দাওরার বছর বেশি বেশি ইবারত পড়ার জন্য তিনি আমাকে একটা বিশেষ দোয়া দিয়েছিলেন— بارك اللّٰه في فيك। আল্লাহ তায়ালা হুজুরকে জান্নাতের উঁচু মাকাম দান করুন!
বুখারি জিলদে সানি পড়িয়েছেন শফিকুর রহমান জালালাবাদী সাহেব হুজুর। হুজুরের পড়ানোটা ছিল খুব সুন্দর এবং আকর্ষণীয়। হুজুরের পড়ানোর ধরণটা সারাবছর একই ধারায় চলত। কোনো ব্যস্ততা নেই, তাড়াহুড়া নেই। এটা আমাদের জন্য খুব উপকার হতো। প্রায় বিষয়ে হুজুরের একটা নিজস্ব বক্তব্য থাকত। এটা আমাকে খুব আকৃষ্ট করত।
মুসলিম শরিফ জিলদে আওয়াল পড়েছি ইমদাদুল্লাহ সাহেব হুজুরের কাছে। হুজুরও অনেক তাত্ত্বিক আলোচনা করতেন। আধ্যাত্মিক জগতের অনেক কিছু বলতেন। বিশেষ করে মনোরোগ সম্পর্কে। এগুলো আমার কাছে অনেক ভালো লাগতো।
মুসলিম শরিফ জিলদে সানি পড়েছি আবদুল বারি সাহেব রহ.-এর কাছে। উনি অনেক ভালো উসতাদ এবং যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ছিলেন। আমাদেরকে খুব সুন্দরভাবে হাসিঠাট্টা করে পড়াতেন। সবাইকে মৌলবি সাব বলে ডাকতেন। অনেক সময় ছাত্ররা গুনত, এক দরসে কতবার মৌলবি সাব বলেছেন। মৌলবি সাব মৌলবি সাব বলে মূল কাজটা সেরে ফেলতেন আরকি!
তিরমিজি আওয়াল পড়েছি শামসুল ইসলাম (মুফাসসির সাহেব) হুজুরের কাছে। হুজুরের পড়ানোটা ছিল অভিনব। তাঁর দরসগুলো ছিল খুব প্রাণবন্ত। বিশেষ করে ইখতিলাফি মাসআলাগুলোতে যখন তারজিহাত দিতেন, তখন খুব আকর্ষণীয় লাগত।
তিরমিজি সানিও আমাদেরকে পড়িয়েছেন আবদুল বারি সাহেব হুজুর। তাঁর মতো করে।
আবু দাউদ আওয়াল পড়েছি লুৎফুর রহমান সাহেব হুজুরের কাছে। এই বছরই হুজুর আমাদের প্রথম হাদিস পড়িয়েছেন। উনি সবক পেয়ে আমাকে বলেছিলেন, তুমি আমার জন্য দুই রাকাত নামাজ পড়ে দোয়া করবা, যেন সুন্দরভাবে পড়াতে পারি। হুজুর খুব সুন্দর পড়িয়েছেন আলহামদুলিল্লাহ!
আবু দাউদ সানি পড়েছি সালাহউদ্দিন লাহোরি সাহেব রহ.-এর কাছে। হুজুর আসতেন খুব প্রাণবন্ততার সাথে। তাঁকে দেখেই আমরা চাঙা হয়ে উঠতাম। আমাদেরকে তিনি খুব হাসিখুশি মেজাজে টক-ঝাল-মিষ্টির মতো পড়াতেন। আর বইল্লের (কিশোরগঞ্জ বয়লা এলাকার আঞ্চলিক উচ্চারণ, মাওলানা সালাহউদ্দিন লাহোরি রহ.-এর জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে এই এলাকার ইতিহাস। তাঁর সবকিছুতে ‘বইল্লে’ শব্দটি থাকত— খাইরুল) উদাহরণ তো তখন থেকে চালু আছে মাশাল্লাহ, আশা করি জান্নাতেও চালু থাকবে ইনশাল্লাহ!
এরপর ইবনে মাজাহ, নাসায়ি এবং তহাবি, এই তিনটা আমরা ইমদাদুল্লাহ সাহেব হুজুরের কাছেই পড়েছি। কোনোটি নিয়মিত, কোনোটি খারেজি ঘণ্টায় হুজুর অত্যন্ত অমায়িকতার সাথে আমাদের পড়াতেন।
আর মুয়াত্তাইন আমরা পড়েছি আতাউর রহমান খান সাহেব রহ.-এর কাছে। হুজুরের দরস ছিল আক্ষরিক অর্থেই একটা হাদিসের দরস। যদিও তাঁর দরসের সংখ্যা খুব অল্প ছিল, কারণ দাওরার বছর হাদিসের অন্যান্য কিতাবের ভিড়ে এই কিতাবে বেশি একটা সময় দেওয়া হয়ে উঠতো না। তারপরও আমরা হুজুরের কাছ থেকে একটা সমৃদ্ধশীল, তাত্ত্বিক, দার্শনিকতাপূর্ণ এবং ব্যুৎপত্তিমূলক জ্ঞানের দরস পেয়েছি। এভাবেই আমরা দাওরায়ে হাদিসের বছরটা শেষ করেছি, আলহামদুলিল্লাহ!
মুজিব হাসান : আল্লামা আযহার আলী আনোয়ার শাহ রহ.-এর সাথে আপনার সম্পর্কটা শুনতে চাই! কোন গুণগুলো তাঁকে অন্যদের থেকে আলাদা ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে?
শোয়াইব আবদুর রউফ : শাহ সাহেব হুজুরের সাথে আমার সম্পর্কটা ছাত্রজীবনের শুরু থেকেই। ইমাম শাফেয়ি রহ.-এর যেমন দুইটা মাজহাব আছে— একটা তাঁর কাদিম মাজহাব, আরেকটা জাদিদ মাজহাব— শাহ সাহেব হুজুরের ব্যক্তিত্বকেও আমার কাছে দুই ধরণের লাগে। উনি যখন বাইরে থাকতেন, তখন উনার মোড— ওকার-রজানা-গাম্ভীর্যতায় পূর্ণ, আবার উনি যখন ঘরোয়া পরিবেশে একান্ত কাছে থাকতেন, তখন উনার যে ব্যবহারিক কোমলতা— এটার স্বাদই ভিন্নরকম।
আমাকে এই নেশা পেয়েছিল। প্রায় রাতেই আমি হুজুরের বাসায় যেতাম। ছাত্রজীবন থেকেই আমি একটু বেয়াড়া ধরণের, একটু মুখ-আগলা ছিলাম। মুখে যা আসত, তা-ই বলে ফেলতাম। হুজুর এগুলোকে ঘরোয়া কথাবার্তা হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই নিতেন। কোনো ধরণের বেয়াদবি বা অন্যকিছু মনে করতেন না। তখন থেকেই হুজুর আমাকে অপত্য স্নেহ এবং খুব আদর-সোহাগ করতেন। আবার পড়ালেখার ব্যাপারে কোনো প্রকার ছাড় দিতেন না।
একবার কোনো কারণে জালালাইন জামাত ডিঙানোর উদ্যোগ নিলাম। জালালাইন শরীফের যে বাংলা হবে, তখন এটা আমাদের কল্পনার মধ্যেও ছিল না। আমি প্রথম শাহ সাহেব হুজুরের কাছে গেলাম, হুজুর জালালাইন ডিঙায়া ফেলতে চাই! হুজুর বললেন, তুমি পারবা? আমি বললাম, পারবো ইনশাআল্লাহ! হুজুর আমাকে একটা স্লিপ দিলেন। এটা নিয়ে জামিয়ার কুতুবখানা থেকে পুরান দুইটা নুসখা উঠালাম। এক হুজুরকে ধরলাম, আমাকে জালালাইন পড়ায়া দেন। কিন্তু হুজুর রাজি হননি। এ নিয়ে হুজুরের কাছে বেশ কয়েকবার গেলাম, অনেক অনুরোধ করলাম, কিন্তু হুজুর হয়তো বাস্তবতার কারণে পড়াতে পারেননি। তখন ভাবলাম, আমার তো একজন রিজার্ভ শিক্ষক আছেন, হিফজুর রহমান সাহেব হুজুর। তাঁর কাছে পড়ে নিবো। কিন্তু সেই রমজানে কাঞ্চন ভূঁইয়া সাহেব হুজুরকে তাশকিল করে পাঠিয়ে দিলেন চিল্লায়। তখন আমি আর হুজুর একসাথে তারাবি পড়াতাম। আমার কোনো অংশ কঠিন লাগলে হুজুরকে দিয়ে দিতাম। মানে হুজুরের ওপর দিয়ে পার পেয়ে যেতাম। সেই রমজানে হুজুরের চিল্লায় যাওয়াতে আমি পড়ে গেলাম মস্ত পেরেশানিতে। একদিকে একা একা তারাবি পড়াতে হবে, আবার জালালাইনের প্রস্তুতিও নিতে হবে। কিন্তু নিজের জেদ আর হিম্মত দিয়ে এই গ্যাঁড়াকল পরিস্থিতি থেকে আল্লাহর রহমতে উদ্ধার পেয়ে গেলাম। তারাবির জন্য কুরআন শরিফ পড়তাম, আবার জালালাইন-হেদায়া কিতাবও মুতালাআ করতাম।
এভাবে রমজান অতিবাহিত হলো। তখন ভাবলাম, শাহ সাহেব হুজুরকে তো ‘ঘায়েল’ করতে হবে। আমি তখন পাঁচশো টাকা জমিয়ে দোকান থেকে একটা মেকাপ কিনে আমাদের আম্মা হুজুরকে হাদিয়া দিলাম। এই কৌশলে হুজুরের কাছে দরখাস্ত নিয়ে গেলাম। কিন্তু হুজুর আমার ভর্তি-পরীক্ষায় ইন্টারভিউয়ের জন্য লিখে দিলেন এক নম্বর বোর্ড। এই বোর্ডের দায়িত্বে ছিলেন জালালাবাদী সাহেব হুজুর। হুজুরের নাম দেখেই সারা রমজানে কষ্ট করে যা শিখেছিলাম, সব যেন নিমিষেই ভুলে গেলাম। হুজুর উনার মাথায় হাত রেখে বললেন, বেটায় কি তাড়াতাড়ি মৌলানা হয়া যায়তা চাও নাকি! হুজুর পরীক্ষা নিলেন। তিনি প্রশ্ন করলেন, আমি আমার মতো উত্তর দিলাম। আল্লাহর রহমতে সে যাত্রায় পার পেয়ে গেলাম।
যাহোক, নস্টালজিয়ায় চলে গিয়েছিলাম। শাহ সাহেব হুজুরের সাথে আমার মুহাব্বতের এই শ্রদ্ধান্বিত বন্ধনটা আরো দৃঢ় হয়েছে জামিয়া ইমদাদিয়ায় আসার পর থেকে। পাশাপাশি আত্মীয়তার বন্ধনটিও এখানে বড় নেয়ামত হিসেবে কাজ করেছে। (হুজুরের তৃতীয় ভাই জনাব আশরাফ আলী সাহেব আমার শ্রদ্ধেয় শ্বশুর।)
শাহ সাহেব হুজুরের যে ব্যক্তিত্ব, এটা একটা ব্যতিক্রমধর্মী আলাদা ব্যক্তিত্ব। তাঁর সবকিছুতেই একটা একসেপশনালিটি, একটা ইসতিসনাইয়া, একটা স্বাতন্ত্র্যভাব ছিল। আমাকে যদি বলা হয় শাহ সাহেবের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে বাছাই করতে, তাহলে আমি বলব, শাহ সাহেব হুজুরের ব্যক্তিত্ব ছিল অবিসংবাদিত। কোনো ঘরানার সাথে সংশ্লিষ্ট না হয়ে, দলীয় সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ না হয়ে ঈমানি দাবি পূরণ করে সবাইকে সন্তুষ্ট রাখা এবং সবার অনুরক্ত হওয়া— কাউকে ছাড় না দিয়ে ঈমানি দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে, সময়ের চ্যালেঞ্জের সাথে মোকাবিলা করে সবাইকে ভালোবাসা এবং সবার ভালোবাসায় সিক্ত হওয়া, এটা একধরণের কঠিন ও দুঃসাধ্য ব্যাপার।
অনেকেই আছে, অন্যের কাছে ভালো থাকার জন্য ছাড় দেয়— ঝোপ বুঝে কোপ মারে, রং পাল্টায়, বর্ণচোরামি করে, বহুমুখী রূপ নেয়— কিন্তু তিনি কোনো সময় এসবের কোনোটাই করেননি। যা বলতেন, সব স্পষ্ট ভাষায়। দেখা যাচ্ছে কালোকে কালো বলছেন, এই কালোঅলা তাঁকে ভালোবাসছে। আল্লাহ পাক অলৌকিকভাবে শাহ সাহেব হুজুরকে এমন একটা বৈশিষ্ট্য দিয়েছিলেন, উনি কাউকে বকা দিলেও দেখা গেছে বকা খাওয়া ব্যক্তি খুশি হচ্ছে। আর কারো পিঠে হাত বুলিয়ে দিলে তো সে মহাখুশি হচ্ছে। আবার দীনের জন্য কোনো ছাড় না দিয়ে, ধর্মীয় বিষয়ে কোনোধরণের তানাজুল (শিথিলতা) না করে তিনি যতই কঠোর হয়ে উঠেছেন, তাঁর পারিপার্শ্বিক প্রতিকূলতা কেটে গিয়ে ততই দূরে সরে গেছে। শাহ সাহেব হুজুরের এই একটা কঠিন এবং বিরল বৈশিষ্ট্য। আমার কাছে তাঁর এই বৈশিষ্ট্যকে মনে হয় সূর্যের মতো আলোকোজ্জ্বল আর বাকিগুলোকে তারার মতো মিটমিটে।
আসলে শাহসাব হুজুর যে কী জিনিস ছিলেন, তাঁর মূল্যায়নটা আমরা জীবিতকালে বুঝতে পারিনি। মৃত্যুর পর এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি!
মুজিব হাসান : আরবি সাহিত্যের সাথে আপনার যে হৃদয়ের মুনাসাবাত, এটা কীভাবে তৈরি হলো?
শোয়াইব আবদুর রউফ : আসলে আমরা যারা কওমি মাদরাসায় পড়ি, আরবির প্রতি এমনিতেই একটা ঝোঁক থাকে। তারপরও আমি যখন হিফজুর রহমান সাহেব হুজুরের বাসায় থাকতাম, তখন উনার এবং উনার বাসার পরিবেশ অনেকটাই আরবিময় ছিল। এটা একটা কারণ। আর আমাদের সময় পারিপার্শ্বিকতায় উর্দু এবং বাংলার চেয়ে আরবির মূল্যায়নটা অন্যরকম ছিল। পাশাপাশি আরবির প্রতি একটা ঝোঁক সবসময় ছিল। তারপর বিশেষভাবে আরবির প্রতি দুর্বলতা আসে— যখন বাংলাদেশে দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন হিফজুর রহমান সাহেব হুজুর, সাথে আরেকজন গিয়েছিলেন সেখানে ভর্তি হতে। আমিও তাদের সাথে গিয়েছিলাম ঢাকা দেখব বলে। তখন ঢাকা দেখাও একটা স্বপ্নের বিষয় ছিল।
সেখানে যাওয়ার পর সাইয়েদ সাফতি— আল্লাহ মালুম তিনি এখন হাফিজাহুল্লাহ নাকি রাহিমাহুল্লাহ— উনি সবাইকে পরীক্ষার হলে ঢোকার জন্য তাড়া দিচ্ছিলেন, পরীক্ষার সময় হয়ে গেছে, সবাই ভিতরে যান। উনি খুব মোটাসোটা লোক ছিলেন। হিফজুর রহমান সাহেব হুজুর ভিতরে ঢুকছেন। উনি মনে করলেন, আমিও বুঝি পরীক্ষা দিতে এসেছি। উনি আমাকে জড়িয়ে ধরে বলছেন, তাফাদ্দল! তাফাদ্দল! আমি উনার জড়ানোর মধ্যে থেকে, যাকে বলে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধন, এই তাফাদ্দলের অর্থ খুঁজে পাচ্ছি না। তাফাদ্দলের অর্থে ফজিলতের গন্ধ পাচ্ছি, কিন্তু আসল মানেটা খুঁজে পাচ্ছি না। এই অবস্থায় কোনোমতে তাঁর বন্ধন থেকে বের হয়ে দৌড়ে গেলাম দুতলায়— তখন তাদের প্রথম ক্যাম্পাস ছিল মহাখালীতে, দুতলায় ছিল লাইব্রেরি— সেখানে গিয়ে লুগাতে খুঁজতে লাগলাম তাফাদ্দলের অর্থ কী! কিন্তু লুগাত শেষ করেও তাফাদ্দলের অর্থ আর পেলাম না। এই ঘটনা থেকে আমার মনে আরবি শেখার প্রতি একটা আগ্রহ জন্মেছে যে, আরবি ভাষা আমাকে শিখতেই হবে! তখন থেকে আমি রাতদিন— এককথায় শয়নে-স্বপনে বলা যেতে পারে— আরবি শেখার প্রতি জান-প্রাণ দিয়ে লেগে গেলাম। এমনকি বাথরুমে গেলেও দুই-তিনটা শব্দ মাথায় নিয়ে মনে মনে পড়তাম। আর বাইরে যত জায়গা আছে, খেলাধুলা বা দুষ্টুমি করার সময়ও আরবি শব্দ জপতাম। এরপরও অনেক কিছু শিখতে পারিনি। এখনো কতকিছু যে শেখার বাকি রয়ে গেছে! তারপরও যতটুকু হয়েছে, ওই ঘটনা থেকেই হয়েছে। ওই ঘটনাই আমার জীবনে আরবি শেখার প্রভাব ফেলেছে।
খাইরুল ইসলাম : উম্মুল কোরা মক্কায় আপনার শিক্ষাজীবন নিয়ে কিছু বলুন!
শোয়াইব আবদুর রউফ : আমরা যে প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করেছি, এটা মূলত উম্মুল কোরা না। এটা হচ্ছে মাহাদ খাদিমুল হারামাইন, যা মক্কা মোকাররমায় অবস্থিত। এখানে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা হলো বাকালোরিয়া তথা অনার্স লাগবে। আমার তো দাওরায়ে হাদিস ছাড়া এরকম কোনো সার্টিফিকেট নেই। এই অবস্থায় ডক্টর ইবরাহিম নাসির আল বিশর— তিনি মক্কার একজন প্রবীণ ব্যক্তিত্ব, হারামাইনের অনেক ইমাম তাঁর ছাত্র— তিনি আমার দায়িত্ব নেন। তাঁর সাথে আমার পরিচয় হলো, তিনি একবার বাংলাদেশে এসেছিলেন। আমি তাঁর খেদমতে ছিলাম। তিনি আমাকে সেখানে দেখার পর বললেন, আমার তো ইচ্ছা ছিল তুমি এখানে লেখাপড়া করো। তিনি আমার কাগজপত্র নিয়ে জমা দিলেন। ভর্তিকমিটিতে যাঁরা যাচাই করে, তাঁরা আমার কাগজপত্র দেখেই রেখে দিলেন যে, তার তো এখানে ভর্তি হওয়ার মতো কোনো যোগ্যতাই নেই। এই কথাটা ওই কমিটিতে যিনি ছিলেন, তিনি নিজে আমাকে বলেছেন। তখন ডক্টর ইবরাহিম নাসির আল বিশর তাঁদের কাছে যান এবং তাঁদেরকে বলেন, আমি তার দায়িত্ব নিলাম, তোমরা তাকে ভর্তি করো। আলহামদুলিল্লাহ, ভর্তিপরীক্ষার রেজাল্ট ভালোই এলো এবং ছাব্বিশটা রাষ্ট্রের ছাত্র সেখানে আমরা দাওয়াহ এবং মুকারানাতু আদইয়ান বিষয়ে পড়াশোনা করেছি। রেজাল্টপ্রকাশের রাতে ওই লোক আমাকে এসে বলেন, তুমি ডক্টর ইবরাহিম নাসির আল বিশরের নিকটা একটা রিসালাতুশ শোকর লেখো। তোমার ব্যাপারে আমরা এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, তিনিই তোমাকে ভর্তির ব্যাপরে সব দায়িত্ব নিয়েছেন।
মক্কাজীবনের স্মৃতিগুলো খুবই মধুময় এবং আনন্দদায়ক স্মৃতি। সেখানের শায়খদের সাথে আগে থেকেই পরিচয় ছিল এবং উসতাদগণও আমাকে নিজের সন্তানের মতো দেখতেন, মুহাব্বত করতেন। ছুটির দিনগুলোতে আমাকে নিয়ে নানান জায়গায় ঘুরতে বেরোতেন, যেন আমার দেশের কথা মনে না হয় বা একাকিত্ব অনুভব না করি। আল্লাহর রহমতে ওই সময়গুলোতে আমার জন্য নির্ধারিত আবাসিক সিট ছাড়াও একটা বিশেষ সাকানের ব্যবস্থা হয়েছিল হারাম শরিফের একদম নিকটবর্তী ছয়তলা ভবনের একটি রুমে। মক্কার এক প্রসিদ্ধ ধনী লোক হজ-ওমরার যাত্রীদের জন্য এটা ওয়াকফ করে দিয়েছিলেন। এসব মিলিয়ে আমার মক্কার জীবনটা ছিল অনেক আনন্দময় স্মৃতির জীবন। যেটা স্মরণ হলে মনের মধ্যে একটা অন্যরকম পুলক অনুভূত হয়, যার কোনো তুলনা হয় না।
মুজিব হাসান : বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আরবি সাহিত্যের তালিমি মানহাজ কেমন হওয়া উচিত?
শোয়াইব আবদুর রউফ : বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আরবি সাহিত্যের বর্তমান যে ধারাটা চলছে— স্বাভাবিকভাবে কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মীতা ছাড়া মৌলিক যে ধারাটি আছে কওমি ও আলিয়া মাদরাসায়— আমার কাছে মনে হয় এটাকে আরো সমৃদ্ধশালী করা দরকার। বিশেষ করে কওমি মাদরাসার মধ্যে আরবি বিষয়ে যে ধারাটা আছে, এটা কুরআন-হাদিসের ব্যুৎপত্তিমূলক জ্ঞানের জন্য অনেকটা সহায়ক হলেও আমার কাছে মনে হয় অত্যন্ত অপ্রতুল। যুগের চাহিদা পূরণ বা বর্তমানে ভাষাশিক্ষা দেওয়ার জন্য প্রযুক্তিগত এবং গবেষণাগতভাবে যতটুকু অগ্রসর হওয়া দরকার, আমরা বোধহয় এর থেকে অনেকটাই ছিটকে পড়েছি বা দূরে সরে রয়েছি।
আল্লাহই জানেন, এই কথাটি একধরণের বেয়াদবিমূলক কথা হয় কি-না: হজরত কাসেম নানুতবি রহ. যখন দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন— একটা চেতনা, একটা আন্দোলন বা দীন রক্ষার জন্য— আমার কাছে মনে হয়, ওই সময়ের সামাজিক পরিস্থিতিতে তিনি আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে একধরণের ইলহামি তাজদিদি কাজ করেছেন। তিনি এই উদ্যোগটা না নিলে আজকে আমরা দীন থেকে কোথায় যে ছিটকে পড়তাম, সেটা আমরা কল্পনাই করতে পারতাম না। এটা আমার মৌলিক বিশ্বাস যে, আল্লাহ পাক কুদরতিভাবে, গায়েবিভাবে এবং দীনকে রক্ষা করার জন্য তাঁকে মুজাদ্দিদ হিসেবে পাঠিয়েছিলেন। তৎকালীন সময়ের পুরো চাহিদাকে পূরণ করে এটা আরো অনেক বছর পর্যন্ত সচল থাকার মতো। হাদিসের মধ্যে আছে, আল্লাহ পাক প্রতি একশো বছর পর পর এই উম্মতের দীনকে তাজদিদ করার জন্য, সংস্কার করার জন্য— যে সমস্ত দাখায়িল বা পরগাছা আছে, তা থেকে রক্ষা করার জন্য— একজন মুজাদ্দিদ প্রেরণ করেন। দীনের একটা চাহিদা হচ্ছে কালের গতির সাথে চলা। এজন্য ইসলাম ওসায়েল বা মাধ্যমগুলোর ব্যাপারে এত কঠোরতা আরোপ করে না। সাহাবায়ে কেরাম উট দিয়ে, ঘোড়া দিয়ে হজ করেছেন, আমরা এখন বিমান দিয়ে হজ করছি। ইসলাম এখানে আমাদের বাধ্যবাধকতা করেনি যে, তাঁরা যে রংয়ের উট দিয়ে হজে যেত, তোমরাও সে রংয়ের উট দিয়ে হজে যাও। এটা ইসলামের চিরন্তনতার একটা বড় প্রমাণ। যে সমস্ত বিষয়ে ছাড় দেওয়ার কথা, সেখানে পূর্ণ ছাড় দিয়েছে আর যেসমস্ত বিষয়ে কঠোরতা করার কথা, সেখানে পূর্ণ কঠোরতা আরোপ করেছে।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে আমার বক্তব্য— কওমি, আলিয়া অথবা প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় আরবিভাষা শিক্ষা দেওয়ার যে উদ্যোগ, মানহাজ বা শিক্ষা কারিকুলাম, এগুলোকে বর্তমান যুগের চাহিদা পূরণে তেমন ফলপ্রসূ মনে হয় না। আমি এগুলোর সমালোচনা করছি না, বরং আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানের অভিমত এবং অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, এ বিষয়ে কাঙ্খিত ফলাফল পাওয়ার জন্য আমাদের শিক্ষা কারিকুলাম আরো উন্নত করা দরকার। বিশেষ করে আরববিশ্বে এখন ভাষাশিক্ষা দেওয়ার জন্য যে সমস্ত বিষয়ের কিতাব এবং যেসব সিরিজ তাঁরা লিখছেন এবং পাঠ্য করছেন, সেগুলো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় আরো জোরালোভাবে আনা দরকার। বিশেষ করে নাহু সম্পর্কে আমরা যে সনাতনী কিতাবগুলো পড়ছি— এগুলো তো আছেই, আলহামদুলিল্লাহ এগুলো থেকেই মানুষ গড়ে উঠছে— তবে নাহুকে সহজতর করে শিক্ষা দেওয়ার জন্য আরো যে প্রচুর কিতাব আছে, সেগুলো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠদানের জন্য অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এই জাতীয় আরো যে সমস্ত ফন ও বিষয়ের ওপর কিতাব লেখা হয়েছে, সেগুলোকেও অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
এটাই আমার একান্ত কামনা— বর্তমানে যে মানহাজটা আছে, এটাকে আরেকটু উন্নত করা এবং এতে আরেকটু চিন্তাভাবনা করা দরকার— যুগের চাহিদার সাথে ঢেলে সাজালে মনে হয় আরো সুন্দর হবে। আলহামদুলিল্লাহ, যেটা আছে সেটা যে যুগের চাহিদা পূরণে অক্ষম, তা না; বরং এই পরিবর্তনটা করলে মানহাজটা আরো সুন্দর এবং ফলপ্রসূ হত। এটা অনেকটা এরকম— আমি সাইকেল দিয়ে অমুক জায়গায় যাব, এর পরিবর্তে মোটরসাইকেলে করে গেলাম।
মুজিব হাসান : দেশের তাখাসসুস ফিল আদব মারকাজগুলো, মাদানি নেসাব এবং প্রচলিত ভাষা-সাহিত্যের কোর্স-প্রোগ্রামগুলো যে শিক্ষাসিলেবাস অনুকরণে পড়া-পড়ানোর কাজ করছে—কোনো স্বপ্নবান তরুণের আদবি চাহিদা পূরণে এগুলোই যথেষ্ট, নাকি তাকে স্বপ্ন ও চাহিদা পূরণে উম্মুল কোরা, মদিনা ইউনিভার্সিটি বা আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ভাষা-সাহিত্যের নামকরা প্রতিষ্ঠানগুলোর দাখেলা নিতে হবে? এ নিয়ে আপনার একান্ত অভিব্যক্তি শুনতে চাই!
শোয়াইব আবদুর রউফ : তাখাসসুসের যে মারকাজগুলো আছে, এগুলোর মধ্যে তারা তাখাসসুসের ক্লাসের চেয়ে পিছিয়ে আছে ছাত্রদের সীমাবদ্ধতার কারণে। ব্যাপারটা এমন— আমার পেটের মধ্যে জায়গা আছে দুইশোগ্রাম চালের ভাত ধারণ করার, এখন আমাকে যদি এককেজি চালের ভাত দেওয়া হয়, তাহলে আমি কিন্তু তা ধারণ করতে পারব না। আমাদের বাংলাদেশে তাখাসসুসের যে ধারাটা আছে, এখানে ছাত্রদের মৌলিক বেসিকটা দুর্বল থাকে— যেটা আমার অভিজ্ঞতার আলোকে দেখেছি। এখানে যেটাকে আক্ষরিক অর্থে আরবি সাহিত্য বা অ্যারাবিক লিটারেচার বলা হয়, এটা যদি তাদেরকে দেওয়া হয়, বেসিক্যালি দুর্বলতার কারণে তারা সেটা হজম করতে পারবে না। এজন্য আরো আগে থেকেই শিক্ষাসিলেবাস আরো উন্নত করা দরকার। এটা আমার ব্যক্তিগত অভিমত। যাঁরা এগুলো পরিচালনা করছেন, তাঁরা ময়দানে থেকে কাজ করছেন। তাঁদের অভিজ্ঞতা আমার থেকে অনেক বেশি। বাহির থেকে অনেক কথাই বলে ফেলতে পারবো। রোদের মধ্যে যে কৃষক কাজ করছেন, তাকে যদি বলি, ক্ষেতটা এভাবে না কেটে এভাবে কাটলে ভালো হত। আমি যদি রোজা রেখে গিয়ে ক্ষেত কাটায় নামি, তাহলে বুঝতে পারবো কত ধান কত চাল!
এই ব্যাপারটাও এরকম— যাঁরা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ওই মারকাজগুলো পরিচালনা করছেন, তাঁরা স্রোতের বিপরীতে নৌকা বেয়ে যাচ্ছেন বা কোনোরকম হাতিয়ার ছাড়া যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। কারণ এই কাজে তাঁরা সরকারি কোনো অনুদান এবং সামাজিক সাপোর্টও এত পাচ্ছেন না। এজন্য তাঁদের প্রতি প্রথমত আমাদের সবার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা দরকার। দ্বিতীয়ত, ইসলাম সবসময় সৌন্দর্য ও নিপুণতাকে কদর করে—
إنّ اللّٰه يحب عبداً، إذا عمل عملا أتقنه.
(বান্দা যখন কোনো কাজ সুন্দর, সুচারু, সুনিপুণভাবে করে, তখন আল্লাহ তায়ালা তাঁকে পছন্দ করেন।)
এজন্য আমার অভিমত হলো— তাখাসসুসের যে মারকাজগুলো আছে, সেখানে الحكمة ضالّة المؤمن হিসেবে, আরববিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয় যে শিক্ষাসিলেবাস অনুযায়ী তাদের পড়া-পড়ানোর কাজ করছে, আমরাও যদি ছাত্রদের জন্য সেগুলো নিতে পারি, তাহলে এটা তাদের জন্য অনেক উপকারী হবে এবং তাদের মেধা বিকাশেও বিশাল সহায়ক হবে।
আমি সবসময় এই সমস্ত বিষয়ে উদারনীতি অবলম্বন করি। এটা আমার ব্যক্তিগত আদত। বললে অতিরঞ্জন হবে কি-না, এসমস্ত বিষয়ে ধর্মকে মুখ্য না করলেই ভালো হবে। আমরা যদি দেওয়ানে মুতানাব্বি পড়তে পারি, তাহলে বর্তমান সময়ে আধুনিক সাহিত্যের যাঁরা পথিকৃৎ আছেন— আহমাদ আমিন প্রমুখ, তাঁদের সীমালঙ্ঘন যেটা আছে, সেগুলোকে তাম্বি করে যদি তাঁদের কিতাবগুলো নেসাবভুক্ত করা যায়— এর দ্বারা আমি তাঁদের তাজকিয়া করছি না, বরং তাঁদের যেসব অপকারিতা, সলবিয়াত, নেগেটিভিটি আছে, সেগুলোকে তো অগ্রাহ্য করতেই হবে, তারপর তাঁদের যে ভালোটা আছে, সেটাকে আমাদের গ্রহণ হবে। আমরা রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্য পড়ছি, বিভূতিভূষণের উপনাস্যও পড়ছি, সেগুলো কিন্তু মেধা বিকাশের জন্যই পড়া হচ্ছে। তেমনিভাবে ওই বইগুলোতেও ছাত্রদের মুখ্য উদ্দশ্যে হচ্ছে আরবি সাহিত্য; আধুনিক আরবির সাথে পরিচিত হওয়া। এটাকে শ্রদ্ধা করে যদি তাঁদের বইগুলো আমাদের ছাত্রদেরকে পড়ানো হয়, আমার মনে হয় অনেক ভালো হবে, ইনশাল্লাহ!
আরেকটা কথা হলো, বাংলাদেশের মধ্যে সাধারণভাবে যে সমস্ত তাখাসসুস পড়ানো হয়— ফিকাহ বলো, হাদিস বলো, আরবি সাহিত্য বলো— সবগুলোর মধ্যে আমাকে যেটা মৌলিকভাবে ভাবিয়ে তুলে, সেটা হলো— আমি আরবি সাহিত্যিক হলাম। এজন্য এটা উদ্দেশ্য না, আমি আরবদেশে গিয়ে চাকরি করব; বরং আমার মূল উদ্দেশ্য হলো দীন বোঝা। যুগের চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করা, দীনের আলোকে যুগ সমস্যার সমাধান দেওয়া। ইসলামের শ্রেষ্ঠত্বের কথা, সৌন্দর্যের কথা, কর্মক্ষমতার কথা, সচলতার কথা— এগুলো সমাজের মধ্যে ফুটিয়ে তোলা। এজন্য আমি দেখি যে, চিন্তাকেন্দ্রিক বিষয়গুলো আমাদের কওমি ঘরানার পাঠ্যতালিকার কোনো জায়গায় নেই। যেমন: حاضر العالم الإسلامي মুসলিমবিশ্বের বর্তমান পরিক্রমা, الغزو الفكري বুদ্ধিবৃত্তিক আগ্রাসন, مقارنة الأديان তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব, المذاهب المعاصرة সমকালীন বিভিন্ন মতবাদ— এগুলো নিয়ে খুব একটা পর্যাপ্ত আইডিয়া আমাদের তাখাসসুসগুলোর মধ্যে দেখি না। এটা আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানের অভিজ্ঞতা, হয়তো অন্যান্য জায়গায় থাকতে পারে, কিন্তু যে সমস্ত তাখাসসুসের সাথে আমার উঠাবসা, জানাশোনা আছে, এসবের প্রতিফলন ছাত্রদের মাঝে খুব একটা হয় না। বৌদ্ধধর্মের জনক কে, কীভাবে হয়েছে বৌদ্ধধর্ম, ইসলামের সাথে তাদের মিল কতটুকু, অমিল কতটুকু; হিন্দুধর্ম কোত্থেকে আসছে; জিউনিজম কোন জিনিস, ইরগোলজাইলিউজম বলতে কী বুঝায়, ফ্রিমেশন আন্দোলন কাদের বলা হয়, প্রটেস্টান্ট কারা, ক্যাথলিক কারা— এগুলো সম্পর্কে আমাদের আইডিয়া খুব কম এবং ক্ষুদ্র। এজন্য আমার মনে হয়, এই চিন্তাগত বিষয়গুলো আরবি ভাষায় শিক্ষা দেওয়ার জন্য নেসাবভুক্ত করতে হবে। আর এই বিষয়গুলোর ওপর যে সমস্ত কিতাব লেখা আছে, সেগুলোতে সাহিত্যের অনেক মাল-মশলা আছে। এর দ্বারা আমরা এক ঢিলে অনেক পাখি শিকার করতে পারব। চিন্তাগতভাবে অগ্রসর হতে পারব, আবার সাহিত্যের দিক দিয়েও অনেক সমৃদ্ধশালী হতে পারব। কিন্তু আমাদের তাখাসসুসগুলোতে এই বিষয়গুলোর অনুপস্থিতি দেখে আমি অনেকটাই দুঃখ অনুভব করি!
মুজিব হাসান : বাঙালি মননে আরবি আদবের মুনাসাবাতকে কীভাবে আরবদের মতো ধারণ এবং মজ্জাগত করা যাবে, বাংলাভাষী তরুণদের উদ্দশ্যে এর কিছু তরিকা ও হেদায়াত বয়ান করুন!
শোয়াইব আবদুর রউফ : মজ্জাগতভাবে আরবির প্রতি যে ভালোবাসা, এটা এখন বিচ্ছিন্নভাবে এবং অনেকটাই ব্যক্তিগত উদ্যোগে করা হচ্ছে। এই ব্যাপারে আমার দৃষ্টিভঙ্গি হলো— মৌলিকভাবে আমরা যদি আরবিকে হাইলাইট করি সবসময়— আরবি হচ্ছে কুরআন-হাদিসের ভাষা, ইসলামকে বোঝার জন্য আরবি হচ্ছে সেতুর মতো— যদি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আরবির প্রতি আরো গুরুত্ব দেওয়া হয়— অন্যান্য ভাষার ওপরও গুরুত্ব থাকবে, তবে প্রাধান্য দেওয়া হবে আরবিকে— তাহলে আমার মনে হয় ছাত্রদের মন-মগজে এর গুরুত্বটা উপলব্ধি হবে। এজন্য প্রথমেই অন্যান্য ভাষার ওপর এত চাপ না দিয়ে শুধু আরবির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া। এটা আমি কোনো ভাষার ওপর খাতির করছি না, সব ভাষাই আল্লাহ পাকের দান এবং ইসলামে সব ভাষারই মূল্যায়ন আছে। বিশেষভাবে কওমি ঘরানার জন্য পরামর্শ হলো— প্রাতিষ্ঠানিক এবং বোর্ডগতভাবে শিক্ষকদের দিয়ে ছাত্রদেরকে এই বিষয়ে উৎসাহিত করা। যেমন আরবির জন্য আলাদা নম্বরের ব্যবস্থা করা, আরবি বিষয়ে বেশি বেশি কিতাব নেসাবভুক্ত করা, আরবির জন্য বিশেষ কর্মসূচি মাদরাসার পক্ষ থেকে নেওয়া এবং এগুলোর প্রতি আন্তরিক গুরুত্ব দেওয়া— সময় কাটানোর জন্য বা এডিশনাল সাবজেক্ট হিসেবে না— মৌলিকত্বের সাথে এমনটা যদি করা হয়, তাহলে মনে হয় ছাত্রদের মধ্যে এই বিষয়ে অনেকটা মজ্জাগত বোধ এবং আগ্রহ ও ভালোবাসা কাজ করবে।
আর এই কাজটা করতে হবে সার্বিকভাবে। একজন, দুইজন, পাঁচজন এরকম না, বরং যদি দশহাজার বা চারহাজার ছাত্র দাওরা পাশ করে বের হয়, তাহলে এদের মধ্যে অন্তত আড়াইহাজার ছাত্র যেন থাকে যাদের আরবির প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ থাকে এবং আরবিভাষা সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা থাকে। তাদেরকে আরবদের মতো করে পড়তে হবে বা আরবি সাহিত্য অনুশীলন করতে হবে, এরকম না; বরং আরবদের ফিচার-কলামগুলো এবং তাঁদের পত্রপত্রিকা আর আধুনিক আরবির যে কিতাবাদি আছে, এগুলো যেন পড়তে পারে। পাশাপাশি আমি মনে করি, শুধু এগুলোর মধ্যে বুঁদ হয়ে থাকলে চলবে না— কুরআন-হাদিসের যে মৌলিক আরবি আছে, এই সনাতনী আরবিকে তাদের আঁকড়ে ধরে রাখতে হবে। মাকামাকে হারিরিকে বাদ দিয়ে আমি আহমাদ আমিনের ফায়দুল খাতির, আব্বাস মাহমুদের আবকারিয়াত, মানফুলুতির আবারাত-নাজারাত ইত্যাদি নিয়ে শুধু বুঁদ হয়ে থাকব, এমন যেন না হয়। আমাকে মাকামাতে হারিরি পড়তে হবে, আবার আধুনিক লেখকদের বইগুলোও পড়তে হবে। এককথায়, সাহিত্যপাঠের ক্ষেত্রে একমুখী না হয়ে বহুমুখী হতে হবে, তবেই একটা সুন্দর ফলাফল আসবে ইনশাল্লাহ!
খাইরুল ইসলাম : খেদমতে খালকের ময়দানে আপনি একজন প্রভাবক ব্যক্তিত্ব। সৌদি-বাংলাদেশের বিভিন্ন বেসরকারি অনুদান গ্রহণ এবং তা অনেক দীনি কাজ ও গরিব-দুস্থদের মাঝে বিতরণে আপনার অগ্রণী ভূমিকা খুব প্রশংসনীয়। এই মহতি কাজের অনুপ্রেরণার গল্পটি শুনতে চাই!
শোয়াইব আবদুর রউফ : মানুষের উপকার করতে পারা, এটাকে আমি মনে করি মানুষের মজ্জাগত স্বভাব। আল্লাহ পাক সকল মানুষের মাঝেই এই বিবেচনাটি রেখেছেন। বিশেষ করে আমি ছোটবেলা থেকেই এই বোধটুকু পেয়ে আসছি। একজনের উপকার করতে পারলে আমি গর্ববোধ করি। ছোটবেলা থেকে আমি ব্যক্তিগতভাবে টাকা জমাতাম। মানুষকে সহায়তা করতাম। এখনো মনে আছে, বললে ঠিক হবে কি-না, একবার আমি পাঁচ টাকা দশ টাকা করে বেশ কিছু টাকা জমিয়েছিলাম। একলোকের চাকরির জন্য টাকার দরকার ছিল। তার মায়ের একটি বকরি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। চাকরির টাকার জন্য তাদের এই বকরিটা বেচে দিতে হচ্ছিল। তখন কষ্টে জমানো টাকাগুলো নিয়ে আমি সাইকেলে করে তার বাড়িতে গেলাম। তার হাতে যখন এই টাকাগুলো দিলাম, সেগুলো পেয়ে আনন্দে লোকটার চোখে পানি চলে এলো।
আলহামদুলিল্লাহ, ছোটকাল থেকেই এই গুণটি আমার মাঝে ছিল। পরে যখন বড় হয়ে হাদিসের কিতাবাদিতে পড়লাম—
أثقل شيء في ميزان العبد يوم القيامة الخلق الحسن و يدخل السرور في قلوب الناس.
(মানুষের মনকে পুলকিত করা, কেয়ামতের দিন সবচেয়ে ভারি আমল হিসেবে আল্লাহ তায়ালার কাছে বিবেচিত হবে।)
এবং এই বিষয়ে যখন আরো হাদিস পড়লাম—
واللّٰه في عون العبد ما كان العبد في عون أخيه.
من نفّس عن مسلم كربة نفّس اللّٰه عن كربة يوم القيامة.
হজরত খাদিজা রাদি.-এর বয়ানটি যখন পড়লাম—
كلا، واللّٰه ما يخزيك اللّٰه أبداً، إنك لتصل الرحم، وتحمل الكلّ، وتتكسب المعدوم، وتقري الضيف، وتعين على نوائب الحق،
এখানে যতগুলো কথা বলছেন, একটাও কিন্তু ধর্মীয় আচার-আনুষ্ঠানিকতামূলক কথা না, সব সামাজিকতা, খেদমতে খালকের কথা। এই বিষয়গুলো আমাকে ভীষণ অনুপ্রাণিত করেছে।
এখানে তোমার প্রশ্নের একটা সংশোধনী দিয়ে দিচ্ছি, প্রভাবক ব্যক্তিত্ব বলে তুমি একটু বাড়িয়েই বলেছো। এভাবে না বলে কৌতূহলী ব্যক্তিত্ব বলা যেতে পারে। আমি কৌতূহলী, মনের মধ্যে কাজ করার কৌতূহল আছে। অন্যরা বড় বড় সাগর পাড়ি দিচ্ছে আর আমরা একটা ছোটখাটো নালার মধ্যে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছি। প্রভাবক ব্যক্তিত্ব, উদ্দীপক ব্যক্তিত্ব এগুলো কেমন ভয়ংকর শোনায়। এগুলো একধরনের ‘শব্দসন্ত্রাস’! (হা হা হা… আফওয়ান!)
এভাবেই শুরু। পরে যখন আরবদের সাথে পরিচিত হলাম, আল্লাহ পাকও আমার প্রতি কেমন জানি খুব বেশি সদয় হলেন। সেখানে থাকাবস্থায় দেখতাম, শায়খদের কাছে অনেক বড় বড় প্রজেক্টের প্রপোজ আসত। একবার ইন্ডিয়া থেকে একটা বড় প্রপোজ এলো কাজটা করে দেওয়ার জন্য। এটা দেখে আমার মনের মধ্যে এমন একটা আকুলতা তৈরি হলো যে, টাকা থাকলে নিজেই সবটা করে দিতাম। কিন্তু আমি তো এসবের নাড়িনক্ষত্র কিছুই জানি না। তারপরও শায়খরা এসবের প্রতি লক্ষ্য না করে বলে গেলেন, এভাবে এভাবে কাজ করো। ভুল হলেও নিজেরা দেখিয়ে দেন এবং কাজ করতে উৎসাহ ও প্রণোদনা দেন। এভাবে বিভিন্ন দেশ থেকে তাদের চাহিদাগুলো পেশ করা হয়। শায়খদের হাত হয়ে সেগুলো আমাদের কাছে আসে। এটা আল্লাহ পাকের একটা বিশেষ রহমত, আমি কিছু পারি না, তারপরও জোর করে শায়খরা আমাকে একাজে ধরে রেখেছেন। আর ছোটবেলা থেকে যেহেতু আমারও এরকম একটা চাহিদা ছিল এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থাও আমার অনুকূলে ছিল। আমার আব্বারও একটা সাপোর্ট আছে একাজে। আমি উদাসীন, সাংসারিক খবরাখবর রাখতে পারি না, এটা আব্বা মেনে নিয়েছেন এবং আমাকে সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছেন।
এসবকিছু মিলিয়ে আল্লাহ পাক এই কাজটায় কিছু নাড়াচাড়া করা, উঠাবসা করা— প্রভাবক হিসেবে না, কেবল সামান্য একটু ঘ্রাণ নেওয়ার— সুযোগ করে দিয়েছেন।
খাইরুল ইসলাম : আপনার কয়েকজন প্রিয় ব্যক্তিত্ব, যাঁদের দ্বারা নিজেকে প্রভাবিত মনে করেন, তাঁদের সম্পর্কে কিছু বলুন!
শোয়াইব আবদুর রউফ : অনেককেই ভালো লাগে, অনেকের দ্বারাই নিজেকে প্রভাবিত বোধ করি। তবে আমি এককভাবে কারো প্রতি ঝুঁকতে পারি না। আমি একটু অস্থিরচিত্ত এবং ইনফিতাহি মেজাজের মানুষ হওয়ার কারণে এক ঘরানায় আটকে থাকতে পারি না। মৌলিকভাবে বেশি প্রভাবিত বোধ করি মাওলানা আতহার আলী রহ.-এর দ্বারা। মাওলানা আতহার আলী রহ.-এর জীবনী আমাকে বেশি নাড়া দেয়। বিশেষ করে আতাউর রহমান খান সাহেব হুজুর “মাওলানা আতহার আলী রহ.’র স্মৃতি” নামে যে বইটি লিখেছেন— আমার আগে এমন হত, ঘুমানোর আগে পাঁচ-ছয় মিনিট এই বইটি না পড়লে অস্বস্তি লাগত, ঘুম আসত না— এই বইটি আমার অনুভূতিকে প্রবলভাবে নাড়া দেয়। মাওলানা আতহার আলী রহ.-এর যে বহুমুখী কর্মধারা, এটা আমাকে খুব বেশি প্রভাবান্বিত করে।
এরপর হজরত হাকিম আখতার সাহেব রহ.। তাঁর আধ্যাত্মিক যে বয়ানগুলো আছে, এগুলোও আমার কাছে খুব ভালো লাগে। হৃদয়ে আলোড়ন তুলে।
আর এককভাবে বললে, বর্তমান সমসাময়িকদের মাঝে মুফতি তকি উসমানি সাহেব দা. বা.-এর যে মানহাজটা আছে, তাঁর বক্তব্য, চালচলন— এককথায় তাঁর যে লাইফস্টাইল বা জীবনধারাটা আছে, এটা আমার কাছে অত্যন্ত ভালো লাগে। আর বাংলাদেশের মধ্যে মুফতি আবদুল মালেক সাহেব দা. বা.-এর যে ইলমি ধারাটা আছে, এটাও আমাকে খুব প্রভাবিত করে এবং কাছে টানে।
মুজিব হাসান : ব্যক্তিজীবনে আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী? তরুণপ্রজন্মকে নিয়ে আপনার স্বপ্ন এবং আশাবাদের কথা জানতে চাই!
শোয়াইব আবদুর রউফ : ব্যক্তিজীবনে মনের মধ্যে অনেক স্বপ্ন, অনেক পরিকল্পনাই উঁকি দেয়, বাসা বাঁধে। অনেক কিছুই করার পরিকল্পনা করি, কিন্তু এগুলো তো সবসময় বাস্তবের মুখ দেখে না।
তবে তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে আমি সবসময় যে একটা স্বপ্ন দেখি, সেটা হলো— যদি সব তরুণ এমন হত, যারা আরবিতে যেমন পারদর্শী, ইংরেজিতেও সমান দক্ষতা রয়েছে, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যেও যাদের রয়েছে পর্যাপ্ত দখল। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে যারা ওয়াকিবহাল। কুরআন-হাদিস দিয়ে যেকোনো যুগসমস্যার সমাধানে অভিজ্ঞ এবং পারদর্শী। আমাদের কওমি ছেলেরা যদি এমন হত, যাকে বলে ‘ওয়েল ইন ওয়ান’— আমি এমন একটা স্বপ্ন দেখি!
আমি স্বপ্ন দেখি— আমাদের ছেলেরা যুগের চাহিদা অনুযায়ী অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি এবং ছাড়াছাড়ি ছাড়া সব সমস্যার সমাধান করবে। বর্তমানে নাস্তিক্যবাদের যে একটা ছড়াছড়ি, তাদের যে দৌরাত্ম্য, এই ব্যাপারে তারা সজাগ-সতর্ক থাকবে সবসময় এবং তাদের অভিযোগগুলোর ব্যাপারে লেখালেখি করে এর দাঁতভাঙা জবাব দিবে। বিশেষ করে তারা ইসলামের সৌন্দর্যের কথা, কার্যকারিতার কথা, শ্রেষ্ঠত্বের কথা— বিশেষত ইসলামের অনন্যতার কথা— ইসলামই একমাত্র ধর্ম, যা ব্যক্তিকেন্দ্রিক চর্চার জন্য না এবং আংশিকভাবে দীন পালন করার নাম ইসলাম না; বরং ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা, যেটা আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে একটি কম্প্লিটলি গাইড লাইন— এই বিষয়গুলোকে যৌক্তিকভাবে, বৈজ্ঞানিকভাবে এবং সবকিছু থেকে উন্নত ও অভিনবভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারবে। তারা ইসলামের সৌন্দর্য এবং মাহাত্ম্য বর্ণনা করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিবে; আবার সেই ছেলেগুলো হবে কওমি মাদরাসার সন্তান, যারা কওমি মাদ্রাসার ডাল খেয়ে পড়েছে, কওমি মাদরাসার আলো-বাতাসে বড় হয়েছে।
যখন এই কথাগুলো চিন্তা করি এবং ভাবি, তখন আমার চোখ দিয়ে পানি এসে যায়! আমি যে এমন একটা সর্ব জাগরূক-স্বপ্ন দেখি, আল্লাহ তায়ালা যেন এর বাস্তবায়ন দেখিয়ে দুনিয়া থেকে নেন!
খাইরুল ইসলাম : আমাদেরকে এতক্ষণ সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য শোকরিয়া এবং জাযাকাল্লাহ!
শোয়াইব আবদুর রউফ : তোমাদেরকেও আন্তরিক জাযাকাল্লাহ, সাথে ফাতেহ টুয়েন্টি ফোর ডটকমেরর প্রতিকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি— ইসলামের হয়ে, উম্মাহর হয়ে, হকের পক্ষে থেকে সবসময় কাজ করার জন্য তাদের পথচলা সুন্দর হোক, আলোকিত হোক! জাযাকাল্লাহু খায়রান ফিদদারাইন!