খালিদ মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ:
বন্যার শহর বাগদাদ: ঐতিহ্যগত আলাপ
বাগদাদ শহর আদিম যামানা থেকেই বন্যা-বিপর্যয়ের জন্য মশহুর। নুহ নবী আ. এর যুগে যে বন্যা-প্লাবন ঘটেছিল, অধিকাংশ মুফাসসির ও ইতিহাসবেত্তাদের মতে তা ছিল বাগদাদে। বন্যা শেষে নূহ নবীর নৌকা অবতরণ করেছিল ‘জুদি’ পর্বতে; সেটি ইরাকের বাবেল শহরে। নৃতাত্ত্বিক গবেষণায় জানা গেছে, ইরাকের জুদী পর্বতে নৌকার ধ্বংসাবশেষ রয়ে গেছে। বাইবেলের বরাতে হিফজুর রহমান সিওহারভী লিখেছেন, “জুদী আরারাত পর্বত শ্রেণীর মধ্যে অন্যতম পর্বত। আরারাত আসলে দ্বীপের নাম। অর্থাৎ, এটি সেই অঞ্চলের নাম যা দজলা ও ফোরাত নদীদ্বয়ের মধ্যবর্তী ‘দিয়ারে বিকর’ হতে বাগদাদ পর্যন্ত বিস্তৃত।
প্রাচীনকাল থেকে ফোরাত ছিল দজলার সঙ্গে জড়িত। বাগদাদের পঞ্চিম পাড় ঝূঁকিপূর্ণ ছিল পার্শ্ববর্তী নালার কারণে। ইতিহাসের বিভিন্ন কালপর্বে নতুন নতুন নামে শুহরত লাভ করে নালাটি। বাবেলী যুগে এর নাম ছিল ‘হাদাকেল’। আশুরিরা নাম রেখেছিল ‘আরাহতু’। এরপর রোমানীরা নামকরণ করল মালিকা নদি। আরবদের প্রভাব বিস্তারের পর ঈসা নামে প্রসিদ্ধি পেয়েছিল। শেষদিকে এসে গারমা এবং সাকলাভিয়া নামে পরিচিত হয় ইতিহাসে। বাগদাদে, দজলা-ফোরাতের অববাহিকায় যেসব ভৌগলিক রুপান্তর ঘটেছিল ইতিহাসে, তার পেছনে উভয় নদীর সম্মিলন ও সংযোগের প্রভাব ছিল। বাঁধ খুলে দেওয়া এবং বদ্ধ রাখার ব্যাপারটা বন্যা ইস্যুতে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ছিল। ফলে ইতিহাসে, বিশেষত তাওরাত সহ প্রাচীন কেতাবাদিতে এই নদীর কথা এসেছে।
হালাকু খানের আক্রমনের পর ইসলামি সভ্যতার কেন্দ্র এবং আব্বাসী খেলাফতের রাজধানী বাগদাদের ছন্দপতন ঘটে। এছাড়াও অবিরাম যুদ্ধ ও ক্ষমতার পালাবদলে সর্বশেষ বাগদাদ অধিকার করেন সুলতান মুরাদ, ১৬৩৮ সালে। তখন থেকে ইরাক ছিল উসমানিদের দখলে। সবশেষে ১৯১৭ সালে ইংরেজদের শাসনাধীনে চলে যায়। ইলখানি তাতারিদের শাসনামলে সবচে বড় বন্যা-বিপর্যয় নেমে এসেছিল। ১৩২৫ সালের এই বন্যার ব্যাপারে ঐতিহাসিকগন বলেন, পাঁচ হাজারের বেশি ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়েছিল। ইবনে ওয়ারদি লেখেন, ৪ দিন যাবত ঘরবাড়ি পানির নিচে ছিল। মানুষ ঘর থেকে বের হতে পারতো না। নেতা জনতা, ছোট বড় সবাই বাঁধ নির্মাণের কাজে আত্মনিয়োগ করেছিল। গোটা বাগদাদ হয়েছিল দ্বীপ। জাফরিয়া মাদ্রাসা, উবাইদুল্লাহ মাদ্রাসা এবং মাদ্রাসার পাঠাগার সহ শহরের দোকানপাট, বাগান, মসজিদ পানিতে ডুবে গিয়েছিল। ভবনের ছাদে দাঁড়ালে আসমান ছাড়া কিছুই গোচরীভূত হতো না। একটা রহস্যময় ঘটনা ঘটেছিল তখন, গোটা কবরস্থান নষ্ট হয়ে গেলেও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের কবর ছিল অক্ষত। এই ঘটনা বাগদাদব্যাপী শুহরত লাভ করে। পানিতে বড় একটা কাঠ ভেসে এসেছিল, যাতে প্রচুর লোকের জীবন রক্ষা পেয়েছিল। অনেক মানুষ গাছের আগায় বসে ছিল পানি থেকে জীবন বাঁচানোর জন্য।
জালায়েরি যুগে বন্যা ও নিয়ন্ত্রণ-প্রকল্প
এ যুগে ৭৫৭ এবং ৭৭৫ সালে বড় বড় দুটি বন্যা এসেছিল। ১৩৩৮ সালে জালায়েরিরা শাসনক্ষমতা লাভ করে, প্রথম পর্বে তাদের শাসনকাল বিস্তৃত ছিল ৫৭ বছর। ১৩৯২ সালে তৈমুর লং এর আক্রমণে তাদের পতন ঘটে। দু’বছরের মধ্যেই জালায়েরিরা ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করে। ছয় বছর শাসন করার পর তৈমুর আবার দখল করে বাগদাদ। তৈমুরের মৃত্যুর পর জালায়েরিরা ১৪১১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। উয়াইস আল জালায়েরির শাসনামলের প্রথম বছর, ১৩৫৬ সালে দজলার পানি ফুপে বন্যা-প্লাবিত হয় শহর। প্রায় চল্লিশ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল। পারস্যের বিভিন্ন কবিদের কাব্যে এই বন্যার আখ্যান রয়েছে। উয়াইসের আমলেই ৭৭৫ হিজরি সনে আরেকটি বন্যা হয়। দজলা স্ফীত হয়ে প্রায় ৬০ হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছিল। বড় বড় মসজিদ-মাদরাসা প্লাবিত হয়েছিল। পাহাড়ের চূড়া থেকে চূড়া, টিলা থেকে টিলা নৌকা করে লোকজন স্থানান্তরিত করা হতো। বন্যার পর ঘরবাড়ি দূরে থাক নিজেদের মহল্লা পর্যন্ত অপরিচিত হয়ে গিয়েছিল। দজলা এবং ফোরাত দুই নদী মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। ব্রিজ-কালভার্ট ভেঙে যায়। বিশদিন পর পানি নেমে গেলে বাগদাদকে মনে হয়েছিল ভুতের শহর। এই বন্যায় মানুষ সর্দি কাশি এবং কলেরায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে। বন্যা পরবর্তী পূনর্বাসন কল্পে বাদশাহ উয়াইস একটি দূর্দান্ত পরিকল্পনা নিয়েছিলেন; লোক মারফতে জনগণের নিকট প্রস্তাব করলেন যে, তোমরা ঋণ হিসেবে আমার থেকে অর্থকড়ি নিয়ে গৃহনির্মাণ করবে, তাতে মাসিক ভাড়ার বিনিময়ে বসবাস করতে থাকবে, যেদিন ভাড়ার টাকায় সমস্ত ঋণ শোধ হবে সেদিন থেকে বাড়ি তোমাদের নিজস্ব সম্পত্তি হয়ে যাবে। এভাবে বহু মানুষের ঘরের বন্দবস্ত হল। পাশাপাশি উয়াইস বাজারঘাট নির্মাণে মনোযোগী হলেন।
আলুসী রহ. বলেন, দজলার তীরবর্তী এলাকায় একটা ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল ১৮৩৯ সালে। অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল মানুষ। মিষ্টার উইলিয়াম লুফতিস বাগদাদে অবস্থানকালে এখানের বন্যা সম্পর্কে বলেন, ১৮৩৯ সালের মার্চ মাসে বাগদাদে পৌঁছে দেখি শহরের লোকজন ভয়ে তটস্থ। ফোরাতের পানি শহরের অলিগলিতে প্রবাহিত হচ্ছে। এক রাতে সাত হাজার ঘরবাড়ি ঢুবে গেয়েছিল। কিরমালি বন্যার বিবরণ তুলে ধরে লিখেছেন, ১৮৮৪ সালে দজলার পানিতে বাগদাদ প্লাবিত হয়। প্রশাসক প্রাপ্ত-বয়স্ক কর্মঠ জনগণের প্রতি নির্দেশ জারি করেন, সকলেই যেন বাধ নির্মাণে অংশ নেয়। সশরীরে হাজির না হলে যেন একজন শ্রমিকের মূল্য দেয়, যে তার বদলে কাজ করবে। সেসময় ইহুদি-খৃষ্টানরাও দেশাত্মবোধের খাতিরে অর্থকড়ি দিয়েছিল। লোকেরা ডোল-তবলা পিটিয়ে জনসাধারণকে কাজে অংশগ্রহণের ব্যাপারে তাগিদ দিতো। এভাবে বাগদাদ নগরীর হেফাজত হয়। বীজ, শস্য এবং শাকসবজি বিনাশ হয়ে যায় বন্যায়।
১৮৯৫ সালে দজলা-ফোরাতের পানি উপচে উঠে, পাশাপাশি অবিরাম বারি বর্ষণে ব্যাপক প্লাবিত হয়। চতুর্দিকে বাঁধ ভাঙ্গতে শুরু করে। অল্পদিনেই কয়েক হাজার ঘরবাড়ি ভেঙে যায়। বন্যার স্থায়িত্ব ছিল প্রায় এক বছর। কারমালি লিখেছেন, এই বছরে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। দজলার পানি বৃদ্ধি পায় অস্বাভাবিক হারে। সাধারণত এই সময়ে এতো পানি হতো না। ফলে অগত্যা বন্যা চলে আসায় জনমানুষের প্রস্তুতি এবং পর্যাপ্ত ব্যবস্থাপনার অভাব ছিল। এমন আকস্মিক দূর্ঘটনার ব্যাপারে মানুষ ছিল অসচেতন। প্রতি বছর সংষ্কার হতো যেসব বাঁধ তা ছিল দূর্বল ও শীর্ণকায়। ফলে প্লাবনের সঙ্গে সঙ্গে বাঁধ ভাঙনের কবলে পড়ে গেল। বাদশাহ হুকুম করলেন যেন প্রত্যেক সামর্থ্যবান পুরুষ বন্যা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে, নতুবা শ্রমিককে বদলা দিয়ে হলেও শরীক হয়। শহরের সর্বস্তরের জনগণ এ কাজে তখন অংশ নিয়েছিল। ঠিক দুমাস পরেই পুনরায় বন্যা আসে, সেবার প্রস্তুতি থাকার সুবাদে তেমন ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় নি। ব্রিটিশ পর্যটক বারফিট লেখেন, চতুর্দিকে ৪০০ মাইল ভূমি প্লাবিত হয়েছিল। শহরের প্রায় ১২ শত ঘর পানির নিচে ছিল। প্রচুর মানুষ এবং প্রাণী ডুবে মারা যায়। সহস্রাধিক গাছপালা নষ্ট হয়ে যায়।
বন্যার সালনামা: উসমানিদের ক্যালেন্ডার সংষ্কৃতি
১৮৪০ সাল থেকে ১৯০৫ পর্যন্ত দীর্ঘ ছেষট্টি বছরে যতো বন্যা-বিপর্যয় বাগদাদে ঘটেছিল, সেগুলোর ফিরিস্তি উসমানিরা দেওয়ান আকারে লিপিবদ্ধ করেছিল। সেখানে বন্যার মেয়াদ ও স্থায়িত্ব সহ, খুব অল্প পরিসরে দরকারি তথ্য সরবরাহ করা হয়েছিল। ১২৫৭ হি. (১৮৪০ খৃ.) আলি রেজা পাশার শাসনামলের বন্যা। বাঁধ ভেঙ্গে গিয়েছিল সেবার। ১২৬১ হি. মোতাবেক ১৮৪৫ সালে নাজিব পাশার আমলে বন্যা বিপর্যয় নেমে আসে। ৪০ দিন স্থায়ী ছিল বন্যা। ১২৬৫ হি. মোতাবেক ১৮৪৯ সালে, আবদুল করিম পাশার শাসনকালে ৫০ দিন মেয়াদি বন্যা হয়েছিল। ১২৭০ হি. মোতাবেক ১৮৫০ সালে রশিদ পাশার আমলে ৩০ দিনব্যাপী বন্যা-বিপর্যয় ছিল। এভাবে সংক্ষিপ্ত তথ্যের দীর্ঘ এক ফিরিস্তি রেখে গিয়েছিল উসমানি সালতানাত। মুসলিম শাসনব্যবস্থায় এটা একটা বুদ্ধিবৃত্তিক সংযোজন।
ফোরাত নদীতে মাদহাত পাশার বাঁধ নির্মাণ
উসমানীয় শাসনমালে মাদহাত পাশা (১৮৬৯-১৮৭২ খৃ.) ফোরাত ও দজলার সংযোগ স্থাপক খালের উপর বাঁধ নির্মাণ করেন, যাতে ফোরাতের পানি বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে না পারে। এটা বাগদাদের ইতিহাসে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত ছিল। এটি বিশেষত পশ্চিম অঞ্চলে স্থিতিস্থাপকতা বজায় রেখেছিল। সাকলাভিয়া নালাকে ঘিরে তখন নানামুখী উদ্যোগ নেয়া হচ্ছিল, প্রশাসকরা ভাবলেন ব্যবসা-বানিজ্য এবং যোগাযোগ বৃদ্ধির খাতিরে নৌ-ব্যবস্থা চালু করবেন। পরবর্তীতে মুহাম্মদ রশীদ পাশা এই বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেন। তৎকালে নির্মিত বাঁধগুলো যুগান্তকারী ভূমিকা রাখে বাগদাদ শহরে। বিশেষত সাকলাভিয়া বাঁধ, সারিইয়্যা বাঁধ (১৮৯০ সালে সিররি পাশার সময়ে নির্মিত), বারমা বাঁধ, নাজিমপাশা বাঁধ ইত্যাদি। নাজিমপাশার বাঁধ উপনিবেশিক শাসনে City Bund নামে পরিচিত ছিল। সবশেষে, মোদ্দাকথা হচ্ছে মুসলিম সভ্যতার বন্যা-বিপর্যয়ে বাগদাদের ইতিহাস পুনর্পাঠ এবং পর্যালোচনা জারি রাখতে হবে।