বাড়ছে মুদ্রাস্ফীতির চাপ : বাড়ছে না মাদরাসা শিক্ষকদের বেতন

মুনশী নাঈম:

কয়েক মাস ধরে চাল, ডাল, গম, তেল, ময়দা, লবণসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের পাশাপাশি খাদ্য–বহির্ভূত পণ্যের দাম বাড়ার কারণে কওমি মাদরাসার শিক্ষকদের কষ্ট বেড়েছে। তাদের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বেতন না বাড়ায় বাজারের তালিকা থেকে সদাই কাটছাঁট করতে হচ্ছে। মাসের বাজার-খরচ আঁটসাঁট করছেন অনেকে।

জিনিসপত্রের দাম বাড়লে সরকারি হিসাবে তা মূল্যস্ফীতি দিয়ে প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মূল্যস্ফীতির হিসাব করে। সংস্থাটির সর্বশেষ হিসাবে বাংলাদেশে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক ৯৫ শতাংশ। অবশ্য আগস্ট ও সেপ্টেম্বর দুই মাসেই পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি বা মাসভিত্তিক) মূল্যস্ফীতির পারদ ৯ শতাংশের ওপরে ওঠেছে। তাই জীবনযাত্রায় মূল্যস্ফীতির প্রভাব বেশি টের পাওয়া যাচ্ছে।

মাদরাসার শিক্ষকরা বলছেন, তাদের বেতন বাড়ানো এখন সময়ের দাবি। মাদরাসার মুহতামিম প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো উন্নয়ন, জমি ক্রয়সহ অন্যান্য উন্নয়নের প্রতি যে জোর দেন, শিক্ষকদের বেতনের বেলায় সেটি অনুপস্থিত। সে কারণে অর্থনৈতিকভাবে কোনও কোনও মাদ্রাসা স্বাবলম্বী হলেও বছরের পর বছর ধরে শিক্ষকদের বেতন বাড়ানো হয় না।

বেতন বাড়াতে মুহতামিমদের অনাগ্রহ

বেতন বাড়াতে মুহতামিমদের অনাগ্রহের কথা তুলে ধরেছেন মাদরাসাতুল মুত্তাকিন ঢাকার শিক্ষক মাওলানা ওলিউর রহমান। ফাতেহকে তিনি বলেন, আলাদা করে শিক্ষকদের কথা কী বলব? গোটা বাংলাদেশেই তো শ্রমের মূল্য একদম সস্তা। মাদরাসার শিক্ষকদের কথা বললে বলতে হবে, বিষয়টা জটিল। একজন সাধারণ শিক্ষকের গড়পরতা যে বেতন তা কেবল বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতিতেই নয় বরং সবসময়ের জন্যই অতি নগণ্য। তবে বিনা বেতন কিংবা স্বল্প বেতনে ছাত্র পড়ানো ছোট ছোট অনেক মাদরাসার জন্য নির্ধারিত বেতনই সময়মত পরিশোধ করা কষ্টসাধ্য হয়ে উঠে। এক্ষেত্রে অনেক সময় অবশ্য মোহতামিমদের সদিচ্ছার অভাব থাকে বেশি।

বেতন কাঠামো নির্ধারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আসল কথা হল, বেতন কাঠামো নির্ধারণ, নিয়োগ-বিয়োগের স্বচ্ছ নীতি প্রণয়ন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ দিয়ে—মুদ্রাস্ফীতির এ সঙ্কটকালীন সময়ে শিক্ষকদের বেতন না বাড়া নিয়ে একজন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে আমার আলাদা কোনো আক্ষেপ নেই।

কথা হয় যাত্রবাড়ির জামিয়া আবু বকরের ইফতা বিভাগের মুশরিফ মাওলানা মুঈনুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি ফাতেহকে জানান, কওমি মাদরাসার শিক্ষকরা আগে যদি মধ্যবিত্ত থেকে থাকেন, মূল্যস্ফীতির কারণে তারা এখন নিম্নবিত্তে পরিণত হয়েছেন। তাদের বেতন বাড়ানো এখন সময়ের দাবি। মুহতামিমগণ ইচ্ছে করলে বেতন বাড়াতে পারেন। কিন্তু তারা বেতন বাড়ান না। বেতন বাড়ালে অবকাঠামো এবং মাদরাসার অন্যান্য উন্নয়ন হয়তো কিছুটা ব্যাহত হবে। তবে তাই বলে শিক্ষকদের বেতন না বাড়ানো অযৌক্তিক।

কমিটিকে দোষ দেন মুহতামিমরা

কথা হয় রামপুরা আইউববাগ ইয়ারুননেছা তাহফিজুল কুরআন মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা মাহদি হাসানের সঙ্গে। তিনি ফাতেহকে জানান, কমিটি পরিচালিত যেসব মাদরাসা রয়েছে, সেখানে কমিটিরা ইচ্ছে করেই বেতন বাড়ান না। বছর শেষে দেখা যায় মাত্র ৫০০ টাকা করে বেতন বাড়াচ্ছেন। তিনি চাইলেই বেতনটা দেড় থেকে দুই হাজার টাকা বাড়াতে পারেন, কিন্তু বাড়ান না।’

মাদরাসার আয়ের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের মাদরাসায় ছাত্রদের বেতন এবং অনুদান মিলিয়ে আয় তো খারাপ না। বেতন চাইলেই বাড়াতে পারেন। কিন্তু তারা বাড়ান না ইচ্ছে করেই।’

অন্য আয় খোঁজা উচিত

কথা হয় মেরুল বাড্ডার এক কওমি মাদরাসার শিক্ষক মুফতি আবু সাঈদের সঙ্গে। তিনি ফাতেহকে জানান, মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। তাই মাদরাসা শিক্ষকদেরও বেতন বাড়ানো উচিৎ। এটা কর্তৃপক্ষ বিবেচনা করবেন। তবে মাদরাসা শিক্ষকদেরও এক্ষেত্রে সচেতন হওয়া উচিৎ। নিজেদের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি অন্য কোনো উপায়ে উপার্জন সম্ভব হলে সেদিকেও অগ্রসর হওয়া উচিৎ। এতে মাদরাসার উপর চাপ কমবে। পাশাপাশি শিক্ষকেরও জীবন যাপনে সমস্যা থাকবে না।

তার মতে, মাদরাসারও আয়ের পথ বের করা উচিত। তিনি বলেন, কর্তৃপক্ষের উচিৎ, কেবলই গণমুখী না হয়ে মাদরাসার আয়ের কোনো স্থায়ী উপায় বের করা। এতে উস্তাদদের মূল্যায়নে সমস্যা লাঘব হবে। বেতন বাকি রাখতে হবে না।

‘বেতন বাড়ানো উচিত’

মাদরাসা কর্তৃপক্ষের সামর্থ্য থাকলে বর্তমান প্রেক্ষিতে বেতন বাড়ানো উচিত বলে মনে করেন হাটহাজারী মাদরাসার মুহাদ্দিস মাওলানা আশরাফ আলী নিজামপুরী। ফাতেহকে তিনি বলেন, যাদের সামর্থ্য আছে বেতন বাড়ানোর, তাদের বেতন বাড়ানো উচিত। বর্তমান যে বাজারের অবস্থা, তা কঠিন। মুহতামিমদের তা লক্ষ্য করা দরকার। তবে যাদের সামর্থ্য নেই, বলেও তো লাভ নেই। মাদরাসার সামর্থ্য না থাকলে শিক্ষকদের ধৈর্য্য ধরতে হবে।

বেতন না বাড়ার কারণে সাংসারিক জীবনে বেশ হিমশিম খেতে হচ্ছে বলে মনে করেন জামিয়া কাশিফুল উলুম মাধবদি মাদরাসার শিক্ষক মাওলানা জুনায়েদ আহমদ। তিনি বলেন, বেতন বাড়ানো এখন সময়ের দাবি। বেতন না বাড়ানোর কারণে শিক্ষকদের এখন অন্যদের কাছে হাত পাততে হয়। সন্তান অসুস্থ হলে ঠিকমতো চিকিৎসা করানো যায় না, মেহমানদের মেহমানদারি করা যায় না । এছাড়াও সাংসারিক আরও অনেক দায়িত্ব থাকে, সেগুলোও পালন করা হয় না। মুহতামিমদের এ দিকে দৃষ্টি দেয়া উচিত। এমন সংকট থাকলে মেধাবীরা কওমি মাদরাসার শিক্ষকতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে।’

আগের সংবাদমুসলিম সভ্যতায় সাহিত্য সম্মাননা
পরবর্তি সংবাদদেশে প্রতি ৪ জনের একজন স্ট্রোকের ঝুঁকিতে