বিদেশে উচ্চশিক্ষা : কওমি ছাত্রদের ভোগান্তি কাটছে না

রাকিবুল হাসান নাঈম:

কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের জন্য বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ একেবারেই সীমিত। তবুও ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় যারাই বিদেশে পড়তে যাচ্ছেন, তাদেরকেই পোহাতে হচ্ছে ভোগান্তি। সার্টিফিকেটের ইকোসিস্টেম ব্যালেন্সড না থাকা, সার্টিফিকেটের সমমান পরিপূর্ণভাবে নিশ্চিত না করা এবং দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে কোলাবরেশন না থাকার কারণেই এমনটি ঘটছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিদেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে কওমি শিক্ষার্থীদের প্রথম পছন্দ ভারতের প্রাচীন ও সুবিদিত ইসলামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘দারুল উলুম দেওবন্দ’, লখনৌতে অবস্থিত ‘দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামা’, আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়, পাকিস্তানের ‘দারুল উলুম করাচি’, ‘জামেয়া ইসলামিয়া বিনৌরি টাউন’, সৌদি আরবের মদিনা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, মক্কার উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়, মিসরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কাতারের কাতার বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরবের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু কওমি শিক্ষাবোর্ডের উদ্যোগ এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন যেন স্বপ্নই রয়ে যাচ্ছে কওমি শিক্ষার্থীদের মনে।

কাজে আসছে না কওমি সার্টিফিকেট

বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তাকমীল সনদের স্বীকৃতি প্রদানের পর কয়েক বছর চলে গেলেও এখন পর্যন্ত নিচের তিনটি স্তরের সমমান নির্ধারিত না হওয়ায় আলিম/এইচএসসি পরীক্ষা ব্যতীত কোন কওমি ছাত্র বিদেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে না। ফলে এখান থেকে যারা উচ্চশিক্ষায় যেতে চান, তাদেরকে ভীষণ পরিশ্রম করতে হয়। কাউকে হয়তো অন্য কোথাও পরীক্ষা দিয়ে সার্টিফিকেট কুড়াতে হয়, অথবা নানাভাবে বিভিন্ন জটিলতায় তাকে পড়তে হয়। তাছাড়া তাকমিল তথা মাস্টার্স সমমানের পড়াশোনা শেষ করার পর আবারও তাদেরকে নতুন করে অনার্সে চার-পাঁচ বছর পড়াশোনা করতে হয়। এতে শিক্ষাজীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ নষ্ট হয়।

এ প্রসঙ্গে মদিনা ইসলামিক ইউনিভার্সিটির গ্রাজুয়েট ও মারকাযুল লুগাতিল আরাবিয়্যাহ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক মাওলানা মহিউদ্দিন ফারুকী ফাতেহকে বলেন, এই জটিলতার পেছনে প্রথম কারণ শিক্ষার্থীরা। তারা আগে থেকে কোনো পরিকল্পনা সাজায় না। হঠাৎ করে যখন বাইরে পড়তে যাবার ইচ্ছে করে, তখন জটিলতায় পড়ে সার্টিফিকেট নিয়ে। দ্বিতীয়ত, সরকার কওমি সনদকে স্বীকৃতি দিয়েছে ঠিক, কিন্তু বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কোলাবরেশনে আগ্রহী নয় হাইয়াতুল উলয়ার মুরুব্বীগণ। ফলে বাইরের দেশে কোথাও এই সার্টিফিকেট শো করেও লাভ হয় না। আমার তাজকিয়া নিয়ে অনেকে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় মদীনাতে যাচ্ছে। তারা যাচ্ছে আলিমের সার্টিফিকেট দিয়ে। হাইয়া কর্তৃপক্ষকে বলেছিলাম, একটা কমিটি গঠন করে মদীনা ইউনিভার্সিটিতে আমাদের কাগজগুলো সাবমিট করি। আমি সহযোগিতা করব। কিন্তু তারা আগ্রহ দেখাননি। তৃতীয়ত, শিক্ষার্থীরা নিজেদের শিক্ষাবোর্ড থেকে তো সহযোগিতা পায়-ই না, এমনকি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সহযোগিতাও পায় না।’

রাষ্ট্রীয় সহযোগিতার ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, কেউ যদি বাইরের দেশ থেকে সনদ নিয়ে আসে, বিদেশের সনদ কিন্তু এমনিতেই কার্যকর হয় না। বরং ইউজিসির অনুমোদন বা সত্যায়ন লাগে। কওমি শিক্ষার্থী যারা ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় বাইরে থেকে সনদ নিয়ে আসেন, তারা এদেশে কিছু করতে পারেন না ইউজিসির অনুমোদন না পাওয়ার কারণে। আমাদের মুরুব্বীরাও কখনো এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেননি। ইউজিসির সঙ্গে বসেননি। সরকারি মহলে কথা বলেননি। মুরুব্বীরা উদ্যোগ নিলে সহজ হয়ে যেতো।

চলতি বছর মিশরে উচ্চশিক্ষার জন্য গিয়েছে ইবনে আলী। জামিয়া আজহারে সানুবিয়াতে ভর্তিও সম্পন্ন করেছে। ফাতেহকে তিনি বলেন, আল-আজহারে কওমি সার্টিফিকেট দিয়ে অনার্সে সরাসরি ভর্তি হওয়া যায় না। মুআদালা নেই বলে এই ঝামেলা। তাই কওমি ছাত্রদের যোগ্যতা যাচাইয়ের বিভিন্ন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। অর্থাৎ, ইদাদি বা মাধ্যমিক লেভেল ও সানুবি বা ইন্টার লেভেলে স্তর যাচাইয়ের পরীক্ষা দিয়ে তারপর অনার্সে ভর্তি হওয়া যায়। অথচ আজহারের সঙ্গে যাদের মুআদালা আছে ইন্টার সমমানের, তারা সরাসরি অনার্সে ভর্তির সুযোগ পায়। কওমি মাদ্রাসার সানুবিয়ার সার্টিফিকেটকে ইন্টার সমমানের করলে এই ঝামেলা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।’

শিক্ষাবিদরা কী ভাবছেন

ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের মুহাদ্দিস, মুফতি ওয়ালীয়ুর রহমান খান এই জটিলতার পেছনে দায়ী করছেন মুরুব্বীদের রক্ষণশীল ধ্যান-ধারণাকে। তিনি বলেন, আলিম পরীক্ষা ব্যতীত কোন কওমি ছাত্র বিদেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে না। ভিন্নমত থাকা সত্যেও কওমি সনদের স্বীকৃতি নেয়ার উদ্দেশ্যের মধ্যে বহির্বিশ্বে পড়ার সুযোগ সৃষ্টির বিষয়টিও ছিল। তাহলে হাইআতুল উলয়া ও বেফাকের এ সংক্রান্তে ভূমিকা কী? আমি হাইয়াতুল উলয়ার কো চেয়ারম্যান শায়খ সাজিদুর রহমান সাহেবের সাথে একান্তভাবে কথা বলেছিলাম। তিনি আগ্রহী; কিন্তু কিছু মুরব্বী মনে করেন, নীচের স্তরগুলোকে স্বীকৃতির আওতায় আনার পর সব স্তরের সমমান হলে আলিয়ার মতো কওমি ছাত্ররাও দলে দলে দ্বাদশ শ্রেণী পাশ করে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাবে। এক সময় কওমি ধারার মূল উদ্দেশ্যই ব্যহত হয়ে যাবে! এজন্য তারা আর অগ্রসর হতে রাজি নন। অন্যরা মনে করেন, কওমি ছাত্র ও তাদের অভিভাবকদের ধ্যানধারণা আলিয়ার মতো নয়, তারা কওমিতেই থাকবেন।

জটিলতা নিরসনে তার প্রস্তাবের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, উচ্চ শিক্ষার সুযোগ লাভের জন্য অনেক ছাত্র ও শিক্ষক বেফাক ও হাইআতুল উলয়ার সহযোগিতার আশায় আছে। আমি পরামর্শ দিয়েছিলাম, সবাই তো যেতে চায় না বা নাম্বারের কারণে যেতে পারবে না। যারা পারবে তাদের জন্য বোর্ডের অফিসে একটি সেল গঠন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের সাথে চিঠি চালাচালির মাধ্যমে অধিকার আদায় করা। কিন্তু কিছু মুরব্বী ‘আকীদা’ ও ‘দেওবন্দিয়ত’ ক্ষুন্ন হওয়ার আশঙ্কায় এদেরকে আরব দেশে পাঠাতে রাজি নন।

বিশিষ্ট আলেম ও আর্থনীতিবিদ মুফতি ইউসুফ সুলতান মনে করে এই জটিলতা নানাভাবে সমাধান করা সম্ভব। এখন যেহেতু হাইআতুল উলয়ার মাধ্যমে সরকার একটি মান দিয়েছে, এর পরিপূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করা দরকার। দেশে তো বটেই, বিদেশেও যেন আমাদের সার্টিফিকেট গ্রহণযোগ্য হয় সেই উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। তিনি ফাতেহকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, আমাদের কওমিপড়ুয়া অনেক আলেম এখন বহির্বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে অবস্থান করছেন, তাদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা যেতে পারে। তাদের মাধ্যমে সেসব দেশের অন্তত একটি-দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্পর্কস্থাপন করা যেতে পারে। তখন দেখা যাবে, যারা উচ্চশিক্ষার জন্য যেতে চাচ্ছেন, তাদের জন্য ‘শিক্ষাসফর’টা সহজ হবে। নাহয় অনেক চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে কাঙ্ক্ষিত স্থানে পৌঁছতে হয়। দেখা যায়, মাস্টার্স সমমানের পড়াশোনা শেষ করার পর আবারও তাদেরকে নতুন করে ব্যাচেলরসে/অনার্সে চার-পাঁচ বছর পড়াশোনা করতে হচ্ছে। এতে শিক্ষাজীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বোর্ড থেকে কোনও পদক্ষেপ নিলে এই জটিলতা এড়ানো সম্ভব, অথবা কমপক্ষে এটি করতে হবে, যারা এসব বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নিতে আগ্রহী হবেন, তাদেরকে বোর্ড থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে হবে। তাহলেই ধর্মীয় ধারায় উচ্চশিক্ষার সুযোগ তৈরি হবে।

উদ্যোগ নেই হাইয়াতুল উলয়ার

২০১৯ সালের ১৭ মার্চ রাজধানীর ফরিদাবাদ মাদরাসায় অনুষ্ঠিত হাইয়াতুল উলয়ার তৎকালীন চেয়ারম্যান আল্লামা আহমদ শফীর সভাপতিত্বে একটি বৈঠক হয়। সেখানে কওমি মাদরাসা-শিক্ষার্থীদের বিদেশে উচ্চশিক্ষাগ্রহণের প্রক্রিয়া সুগম করার লক্ষ্যে ৬ সদস্য বিশিষ্ট বিশেষ একটি সাব-কমিটি গঠন করা হয়। বলা হয়, এই কমিটির অধীনে কওমি শিক্ষার্থীদের ‘স্টুডেন্ট ভিসা’ সহজিকরণের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। পাশাপাশি বহির্বিশ্বের শিক্ষার্থীরাও যাতে বাংলাদেশের কওমি মাদরাসাগুলোতে পড়াশোনার সুযোগ পেতে পারে সে-ব্যাপারেও কাজ করবে এ কমিটি। বেফাকের তৎকালীন মহাসচিব মাওলানা আবদুল কুদ্দুসকে আহ্বায়ক করে গঠিত উচ্চতর কমিটিতে ছিলেন মুফতি রুহুল আমীন, মাওলানা মাহফুজুল হক, মুফতি নুরুল আমিন, মাওলানা বাহাউদ্দীন যাকারিয়া, মুফতি মোহাম্মদ আলী।

এই কমিটি এখনও বলবৎ আছে। তবে বিদেশে উচ্চশিক্ষা বিষয়ক কোনো উদ্যোগ নিয়ে তাদের আলোচনা নেই। জটিলতা নিরসন করে বিদেশে উচ্চশিক্ষা সুগম করতে কমিটি কী করছে জানতে চাইলে কমিটির সদস্য মুফতি মোহাম্মদ আলী ফাতেহকে বলেন, ‘কমিটি বলবৎ থাকলেই হয় না। কার্যক্রম থাকতে হয়। পরবর্তীতে বিদেশে উচ্চশিক্ষা সুগম করার লক্ষ্যে কমিটিতে তেমন কোনো আলোচনা হয়নি।’

হাইয়াতুল উলয়ার দিকে অনেক শিক্ষার্থী তাকিয়ে আছে। বিষয়টি নিয়ে মুরুব্বীরা কথা না বললে কে বলবে। এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা নিয়ে আর আলোচনা হয় না। আবার আলাপ তুলব। দেখি।’

আগের সংবাদবিয়ে ও তালাকে শীর্ষে রাজশাহী, তালাক কম বরিশালে
পরবর্তি সংবাদমালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগের অনুমতি দেওয়া শুরু, গ্রিসের সঙ্গে চুক্তি