‘বিরাট ওয়াজ মাহফিল’: গ্রাম বাংলার মাহফিল সংস্কৃতি

মাহবুব জামিল:

গ্রামে গ্রামে ওয়াজ-মাহফিলের আয়োজন বাংলাদেশের হাজার বছরের সংস্কৃতি। বাংলাদেশে ইসলামের প্রসার ঘটেছে বিভিন্ন পীর-আউলিয়া, দরবেশ-মাওলানা আর হুজুরদের বয়ানের মাধ্যমে। যেসব মুসলিম সেনাপতি বঙ্গদেশের বিভিন্ন অঞ্চল জয় করেন, তারা ধর্মপ্রচারের জন্য আসেননি। তারা এসেছিলেন রাজ্য জয়ের জন্য। তারা কেবল স্থানে স্থানে সিপাহী দিয়ে কিছু রাজ্যই জয় করেছেন, কিন্তু ইসলামের বিচ্ছুরিত আলোকবিভা দিয়ে বঙ্গের মানুষের মন জয় করেছেন দরবেশ-ফকির, পীর-আউলিয়া, মাওলানা আর হুজুররা। এই মাওলানারাই নিরাপদ আর সুরক্ষিত রেখেছে বাংলাদেশের ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল। বাংলার প্রতিটি জনপদে নিভৃতে জ্বলতে থাকা মাদরাসাশিক্ষা, মসজিদের মিম্বার থেকে ধ্বনিত হওয়া ইমাম সাহেবের বয়ান, ওয়াজ-মাহফিলের মাইকে বেজে ওঠা মাওলানা আর মুফতিদের দরদি বয়ান আলোর পথ দেখিয়েছে এ অঞ্চলের মানুষদের।এ মাহফিল সংস্কৃতি তাদেরই হাজার বছরের অবদান।

যাত্রা ও পালাগানের অবসান

শীত মৌসুম আসার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে শুরু হয় ওয়াজ-মাহফিলের উৎসব। এই উৎসব আগেও ছিল, তবে এখনকার মতো এত ব্যাপক পরিসরে ছিল না। বড় বড় মাদরাসাকেন্দ্রিক কিছু মাহফিল হতো। এখন এসব মাহফিলের আয়োজন করা হয় বিভিন্ন মাদরাসা, মসজিদ পরিচালনা কমিটি, গ্রামে-গঞ্জে গড়ে ওঠা বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও এলাকাবাসীর উদ্যোগে। এমনকি ব্যক্তি উদ্যোগেও আয়োজিত হয় কিছু মাহফিল। আর মাহফিলের যাবতীয় কাজ আঞ্জাম দেয় এলাকার যুবকরা। মাহফিল প্রচারণা, পোস্টারিং, ডেকোরেশন থেকে শুরু করে মাহফিল চলাকালীন স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পর্যন্ত।

আজ থেকে ৩০-৪০ বছর আগেও গ্রামে-গঞ্জে ব্যাপকহারে আয়োজন করা হতো যাত্রা ও অশ্লীল নৃত্যের। তখন মাহফিল হতো হাতেগোণা। কিন্তু দিনদিন মাহফিলের সংখ্যা যত বেড়েছে, কমেছে যাত্রপালার সংখ্যা। যেখানে আলো আসে, অন্ধকার সেখানে খুব বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারে না। এটা প্রকৃতির নীতি। হয়েছেও তাই। এখন যাত্রপালা খুঁজেই পাওয়া যায় না। কিন্তু কান পাতলে দৈনিক কোনো না কোনো গ্রামে মাহফিলের সুর শোনা যাবেই। মাহফিল সংস্কৃতির কারণেই আজ বাংলাদেশে যাত্রা ও অশ্লীল নৃত্যের সংস্কৃতি সমূলে উৎপাটিত প্রায়। এ অবদানকে অস্বীকার করার উপায় নেই।

যাত্রাপালার পর কিছু কিছু অঞ্চলে এখনো টিকে আছে পালাগানের আসর। তবে মাহফিলের সংখ্যা যেভাবে ক্রমশ বাড়ছে, তাতে খুব বেশিদিন টিকে থাকবে বলে মনে হয় না। ইতোমধ্যে গ্রামের সাধারণ আয়োজন থেকে পালাগান বিদায় নিয়েছে। টিকে আছে কেবল ওরস ও মাজারকে কেন্দ্র করে। মাহফিলের ক্রমবর্ধমান আগ্রহের কারণে বিভিন্ন মাজারেও গানের বদলে এখন মাহফিল হয়।

মাহফিল সজ্জা

আগে মাহফিলে সাধারণ আয়োজন হলেও এখন বদলে গেছে দৃশ্যপট। মাহফিলের দুদিন আগ থেকেই শুরু হয় মাহফিলের ডেকোরেশন, প্রচারণা মাইকিং। বিরাট বিরাট পোস্টারিং করা হয় ১০-১৫ দিন আগেই। লক্ষ্য থাকে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ জমায়েত করার। যেহেতু পাড়ায় পাড়ায় মাহফিল হয়, মৌন একটা প্রতিযোগিতাও থাকে আয়োজকদের মনে। সবাই চেষ্টা করে তার আয়োজনটা যেন অন্যদের চেয়ে উন্নত হয়।

মাহফিলে এখন ব্যবহার করা হয় উন্নতমানের সাউন্ড সিস্টেম। মাইকের পাশাপাশি ব্যবহার করা হয় বড় বড় সাউন্ডবক্স। যেহেহতু অধিকাংশ বক্তা এখন সুর ‍দিয়ে ওয়াজ করেন, ভালো সাউন্ড সিস্টেমের শর্ত দিয়ে দেন বক্তারাই। পাশাপাশি মহিলারা যেন পর্দার আড়াল থেকে মাহফিলের পুরো দৃশ্য দেখতে পায়, তাই মহিলাদের প্যান্ডেলে বসানো হয় প্রজেক্টর। প্রজেক্টর ছাড়া গ্রামের কোনো মাহফিল এখন চলে না।

তবে খেয়াল রাখতে হবে, ব্যবস্থাপনা, শৃঙ্খলা ও সৌন্দর্যসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় খরচে মধ্যপন্থা কাম্য। অপব্যয় থেকে মুক্ত হওয়া জরুরি। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমাদের অর্থ-সম্পদ অপ্রয়োজনীয় কাজে খরচ করবে না। জেনে রেখো, যারা অপব্যয় করে তারা শয়তানের ভাই, আর শয়তান নিজ প্রতিপালকের ঘোর অকৃতজ্ঞ।’ (সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত : ২৬-২৭)

বার্ষিক ওয়াজ: পারিবারিক মিলনমেলা

কর্মব্যস্ত এই জীবনে আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগও কমে আসছে। টাকার পেছনে ছুটতে গিয়ে হারিয়েছে পারিবারিক সম্মিলনের জৌলুস। তবে বর্তমানে গ্রামে-গঞ্জে পারিবারিক কিংবা ব্যক্তি উদ্যোগেও আয়োজিত হয় কিছু মাহফিল। মাহফিলগুলো মূলত আয়োজিত হয় বিশেষ একটি দিনে। যেমন বাবার মৃৃত্যুদিবস, কিংবা মায়ের মৃত্যুদিবস। কারো পরিবারে অনেক বছর ধরে চলে আসছে বার্ষিক মাহফিল। তাই ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতেও অনেকে আয়োজন করে মাহফিলের।

মাহফিল কেন্দ্র করে সব আত্মীয়স্বজন একসাথে হয়। কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফেরে পুরুষরা। শ্বশুর বাড়ি থেকে বাবার বাড়ি নায়র আসে মেয়েরা। ঈদেও এতটা আনন্দ হয় না, যতটা আনন্দ হয় মাহফিলে। বলতে গেলে মাহফিল হয়ে উঠে পরিবার এবং আত্মীয়স্বজনদের বার্ষিক মিলনমেলা। মাহফিল শেষে সব আত্মীয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে নির্ধারণ করে ফেলা হয় পরবর্তী মাহফিলের তারিখ। তারপর শুরু হয় আবার অপেক্ষা।

কয়েকটি অনুচিত দিক

ক. গ্রামে সাধারণত গভীর রাত পর্যন্ত ওয়াজ চালানো হয়। সাধারণত এমন কাউকে গভীর রাতে ওয়াজের মঞ্চে নিয়ে আসা হয়, যার কথা শ্রোতাদের আকৃষ্ট করে। যারা বছরে এক-দুইবার রাত জেগে ওয়াজ শোনেন, তারা তো আর রাত জাগতে অভ্যস্ত নন। এতে তাদের পরের দিনের নিয়মিত কাজে বিঘ্ন ঘটে, থাকে ফজরের জামাত ছুটে যাওয়ার, এমনকি কাজা হওয়ার সমূহ আশঙ্কা। ওয়াজের আকর্ষণে গভীর রাত পর্যন্ত জাগার পর যদি পরের দিনের ফজরের নামাজই ছুটে যায়, তাহলে এ ওয়াজের সার্থকতা কোথায়? তাই যতটুকু রাত জাগলে পরের দিনের ফজরের নামাজ আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে না, মাহফিল ততটুকু পর্যন্তই দীর্ঘায়িত করা উচিত।

খ. অনেক মাহফিলে দূর-দূরান্তে মাইক ব্যবহার করা হয়। এটা ঠিক নয়। সভাস্থলে প্রয়োজনীয় মাইক ব্যবহার কাম্য। দূর-দূরান্তে এবং বাজার-ঘাটে অপ্রয়োজনীয় মাইক ব্যবহারে উপকারের চেয়ে ক্ষতিই বেশি। আয়োজনের কথা যখন নানানভাবে জানিয়ে দেওয়া হলো, মাইকিং পোস্টার তোরণ ইত্যাদি সম্ভাব্য সব পদ্ধতিতে, তখন যার মনে ওয়াজ শোনার আগ্রহ সৃষ্টি হবে তিনি মাহফিলে শরিক হবেন। আগত শ্রোতাদের উপস্থিতি যতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত, মাইকের সংযোগও ততদূর পর্যন্ত দেওয়া যেতে পারে।

আলেমরা মানুষের ঘুমে ব্যাঘাত হয়—এমন জোরে কোরআন তিলাওয়াতও অবৈধ বলেছেন। (ফাতহুল কদির : ১/২৯৮, ফাতাওয়ায়ে মাহমুদিয়া : ৩/৫৫২, জিকর ও ফিকির, পৃষ্ঠা ২৬)। হজরত ওমর রাদি.-এর যুগে জনৈক ব্যক্তি মসজিদ-ই-নববীতে এসে প্রতিদিন বিকট আওয়াজে ওয়াজ শুরু করেন। এতে পাশেই হুজরায় অবস্থানরত আয়েশা রাদি.-এর কাজে ব্যাঘাত হতো। তাই তিনি হজরত ওমর রাদি.-কে বিষয়টি অবহিত করলে ওমর রাদি. ওই লোককে নিষেধ করে দেন। লোকটি কিছুদিন পর আবার ওয়াজ শুরু করলে ওমর রাদি. এসে তাকে শাস্তি দেন। (আখবারু মাদিনা, ওমর ইবনে শাব্বাহ : ১/১৫)।

গ. মাহফিলের জন্য তহবিল সংগ্রহের কৌশলেও পরিবর্তন আনতে হবে। এসব মাহফিলে ব্যক্তিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে কাউকে চাপে ফেলে যেমন টাকা আদায় করা হয়, তেমনি সুযোগমতো সম্পূর্ণ অপরিচিত ব্যক্তির কাছ থেকে নেওয়া হয় চাঁদা। সিএনজি-অটোরিকশার মতো যানবাহন যেসব রাস্তায় চলে, এর আশপাশে যদি কোনো মাহফিল হয়, তখন দেখা যায়, রাস্তার পাশে মাইক বাজছে, টাকা নেওয়ার জন্য কয়েকজন বসে আছে। ওই রাস্তা দিয়ে চলাচলকারী প্রতিটি যানবাহন আটকে মাহফিলের জন্য টাকা চাওয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রে যাত্রীদের কেউ টাকা না দেওয়া পর্যন্ত গাড়ি ছাড়া হয় না। কথা হলো, কেউ যদি স্বেচ্ছায় টাকা দিয়ে অংশগ্রহণ না করেন, তার কাছ থেকে যদি চাপাচাপি করে টাকা আদায় করা হয়, এ টাকা ব্যবহার করা কি বৈধ হবে?

শেষকথা

ইসলাহি মাহফিল, তাফসির মাহফিল, জিকিরের মাহফিল, বার্ষিক সম্মেলন ও ইসলামি সভাসহ নানা নামে ওয়াজ মাহফিল হয়। যে নামেই হোক না কেন, তাতে বিপুল সংখ্যক মানুষ অংশগ্রহণ করেন। এসব মাহফিল সাধারণ মুসলমানদের দ্বীনি খোরাকও বটে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক নানা বিষয়ে ইসলামের নির্দেশনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয় এসব মজলিসে। মাহফিলে আসা প্রাজ্ঞ ও বিজ্ঞ আলেমদের মুখনিঃসৃত কথায় অনেকের জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। ওয়াজ শোনার পর অনেকে জীবনে আর কখনো নামাজ না ছাড়ার পাকাপোক্ত প্রতিজ্ঞা করেন। এভাবেই ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের জীবনে অনেক পরিবর্তন ঘটছে। আয়োজক এবং ওয়ায়েজগণ যদি আরেকটু সতর্ক হন, আরেকটু কৌশলী হন, তাহলে এই ইতিবাচক পরিবর্তনের ধারা ক্রমশ বিস্তৃত হবে।

আগের সংবাদধর্মপ্রচার, অপপ্রচার ও অর্থলিপ্সা : মুসলিম সভ্যতায় ওয়াজের ইতিহাস
পরবর্তি সংবাদ১৪ নারী কয়েদিকে মুক্তি দিল তালেবান