মুনশী নাঈম:
মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী কওমী মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাকের মহাপরিচালক নিযুক্ত হওয়ায় উচ্ছ্বসিত মাদরাসাপড়ুয়া তরুণসমাজ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ভেসে যাচ্ছে শুভেচ্ছার জোয়ারে। এই জোয়ার আগের কোনো মহাপরিচালকের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। ইতোমধ্যেই তরুণরা মাওলানা নদভীর কর্মপরিকল্পনা ঘিরে নতুন আশা বুনতে শুরু করেছে। তারা বলছে, মাওলানা নদভির কাছে তাদের প্রত্যাশা একটু বেশিই। কারণ, তার বিগত দিনের তৎপরতায় দেখা গেছে, তিনি শিক্ষার্থীদের অনুভূতি বুঝেন। ঐতিহ্যবাদী ধারার সঙ্গে তিনি আধুনিক ধারার সমন্বয়ে আগ্রহী। বেফাককে একটি আদর্শ শিক্ষাবোর্ডে পরিণত করার কাজটি তার হাতেই হতে পারে।
সনদ কার্যকরের উদ্যোগ নিতে হবে
এ প্রসঙ্গে কথা হয় জামিয়া মাদানিয়া যাত্রাবাড়ির তাকমিল বিভাগের ছাত্র রহমতুল্লাহর সঙ্গে। তিনি তাকমিল শেষ করে বাইরে কোথাও পড়তে যেতে চান। তার ইচ্ছে, সৌদি কিংবা মিশর। কিন্তু তার প্রধান সমস্যা তার সনদ। সনদ পাবেন ঠিক, কিন্তু এই সনদ কোনো কাজে লাগবে না। ফাতেহকে তিনি বলেন, কওমি সার্টিফিকেটের ইকোসিস্টেম ব্যালেন্সড না থাকা, সার্টিফিকেটের সমমান পরিপূর্ণভাবে নিশ্চিত না করা এবং দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে কোলাবরেশন না থাকার কারণে আমরা বাইরের দেশে অনার্স-মাস্টার্স করতে পারি না। এই সমস্যার মুখোমুখি অনেক ছাত্র। মাওলানা নদভিও নিজেও বাইরের দেশে পড়াশোনা করেছেন। তিনি বুঝবেন শিক্ষার্থীদের কষ্ট এবং জটিলতা। তিনি যদি চেষ্টা করেন, কার্যকরী কোনো উদ্যোগ সামনে আসতে পারে।’
এই শিক্ষার্থী আরও বলেন, শুধু সৌদি-মিশর না, আমরা তো এখন দারুল উলুম দেওবন্দেও যেতে পারি না। আমাদের শিক্ষাবোর্ড উদ্যোগ নিলে এটা সামাধান করা যেতো। মাওলানা নদভি যদি সনদকে বাইরের দেশে পড়ার মতো মানে উন্নত করে দেন, তাহলে আমরা কৃতজ্ঞ থাকবো।
নেগরানি ও অভিযোগ শোনায় তৎপরতা
কথা হয় তরুণ আলেম ও লেখক মাওলানা আহমাদ সাব্বিরের সঙ্গে। মাওলানা নদভীর কাছে তার প্রত্যাশা জানতে চাইলে তিনি বলেন, শিক্ষাবোর্ডকে শিক্ষার্থীদের সুবিধা-অসুবিধা দেখতে হবে। বেফাক অফিসে গিয়ে শিক্ষার্থীরা যে দুর্ভোগের শিকার হন, এই দুর্ভোগ দূর করতে হবে।
গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি প্রসঙ্গে কথা বলেন তরুণ এই আলেম। তিনি ফাতেহকে বলেন, বেফাকের পক্ষ থেকে বিভিন্ন মাদরাসায় নেগরানির জন্য যান কর্মকর্তারা। উদ্দেশ্য, পড়াশোনা কেমন হচ্ছে তা পর্যবেক্ষণ করা। কিন্তু কর্মকর্তারা সেটা ঠিকমতো করেন না। দেখা যায়, মহিলা মাদরাসা পরিদর্শনে গিয়ে অফিসে বসে চা-নাস্তা খেয়ে তারা চলে আসেন। পড়াশোনার খবর নেন না। মহিলা মাদরাসায় এটা বেশি হয়। অনেক পুরুষ মাদরাসাতেও এমন হয়। তদারকি ও নেগরানি না করলে তো পড়ালেখা উন্নত হবে না। তাই বেফাককে এই দিকে মনোযোগ দিতে হবে। নবনিযুক্ত মহাপরিচালককে এ ব্যাপারে কঠোর হতে হবে।
দেওবন্দের সিলেবাস অনুসরণ
কথা হয় কুুমিল্লার জামিয়া আরাবিয়া রামপুর মাদরাসার তাকমিল বিভাগের ছাত্র মাওলানা হাবিবুল্লাহর সঙ্গে। সদ্যনিযুক্ত বেফাক মহাপরিচালকের কাছে প্রত্যাশা কি জানতে চাইলে তিনি ফাতেহকে বলেন, আমি গ্রামের মাদরাসার ছাত্র। আমি আর কি বলব। তবে একটি কথা বলতে চাই। ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদরাসা শিক্ষার্থীদেরকে এসএসসি লেভেল পর্যন্ত জেনারেল সিলেবাস পাঠদান এবং এসএসসি লেভেলের পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সার্টিফিকেট নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে । দেওবন্দের অনুসরণে বাংলাদেশের কওমি মাদরাসাতেও এ সিস্টেম চালু করা যেতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, জেনারেল শিক্ষিত পরিবারের লোকেরা চান, তার সন্তানও আরবির বাংলা-ইংরেজি পড়ুক। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে দেওবন্দ তার সিলেবাসে পরিবর্তন করে। যেহেতু আমরা দেওবন্দের অনুসরণ করি, আমাদেরও তো পরিবর্তন করা দরকার। আমি চাই সিলেবাসে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন হোক।
জনগোষ্ঠীর চিন্তা ও মতামত গুরুত্বপূর্ণ
মাওলানা নদভীকে নিয়ে কেমন প্রত্যাশা করছেন জানতে চাইলাম তরুণ আলেম মুফতি খালিদ মুহাম্মাদ সাইফুল্লাহর কাছে। নির্মোহ দৃষ্টিতে তিনি ফাতেহকে বলেন, একটি শিক্ষাবোর্ডের পরিচালনায় কেবল শিক্ষাবিদ এবং বুদ্ধিজীবী যথেষ্ট না, বরং পরিচালনা দক্ষতাও গুরুত্বপূর্ণ। নদভী সাহেবের পরিচালনার অভিজ্ঞতা কতটুকু এবং কেমন সেটা ভাববার বিষয়। একটা সিস্টেমে অনেক কিছু থাকে, নির্দিষ্ট একক ব্যক্তিত্ব পুরো সিস্টেমে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে না। বাংলাদেশ সহ মুসলিম রাষ্ট্রের সেকুলার শিক্ষা-সিস্টেমকে বদলানোর জন্য বহু নীতিবান মানুষের আগমন হয়েছিল, কিন্তু দেখা গেছে তাদের অনেকেই সিস্টেমের অংশ হয়ে গেছে। আদতে একটা সিস্টেমের সাথে বিরাট একটা জনগোষ্ঠীর অনুভূতি, চিন্তা ও মতামতের সংযোগ থাকে। চাইলেই তা বদলে ফেলা যায় না। জনগোষ্ঠী মধ্যে হাজির থাকা বয়ানকেও প্রভাবিত করতে হয়। মাওলানা নদভিকে তা করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, বেফাকের সাথে সংযুক্ত জনগোষ্ঠী অবশ্যই কওমী-সমাজ, সিস্টেম বদলানো বা প্রয়োজনীয় সংষ্কার চাইবার আগে দেখতে হবে তাদের মনস্তত্ব কি, সেখানে কোন রদবদলের দরকার আছে কি না। তবেই নেযাম নিয়ে আমাদের যেকোন আলাপ ও প্রচেষ্টা স্বার্থক হবে। তবে বেফাকের সাথে উবাইদুর রহমান খান নদভী সাহেবের সম্পর্ক বেশ পুরোনো। তার পিতা আতাউর রহমান খান সাহেব ছিলেন এখানের গুরুত্ত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, স্বভাবতই অন্যদের চেয়ে এই প্রতিষ্ঠানের উত্থান-পতনের হালহাকিকত খুব কাছ থেকে তিনি অনুভব করেছেন। তাছাড়া শিক্ষা ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরেও তার একধরনের সক্রিয়তা ছিল, সুতরাং তার থেকে বিশেষ কিছু আশা আমরা করতেই পারি।’
উল্লেখ্য, দেশের সর্ববৃহৎ কওমী মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের মহাপরিচালক নিযুক্ত হয়েছেন মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী। রবিবার (১৬ অক্টোবর) রাজধানী ঢাকার যাত্রাবাড়ী ভাঙ্গাপ্রেসস্থ বেফাকের কার্যালয়ে বেফাকের খাস কমিটির বৈঠকে মহাপরিচালক হিসেবে তার নিয়োগের ব্যাপারটি চূড়ান্ত হয়। তিনি ২৭ অক্টোবর থেকে অফিস শুরু করবেন। এর আগে ২০২০ সালের ২৩ নভেম্বর স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন বেফাকের মহাপরিচালক অধ্যাপক মাওলানা জোবায়ের আহমদ চৌধুরী। তার পদত্যাগের পর বেফাকের সহকারী মহাপরিচালক মাওলানা মুহাম্মদ জোবায়ের অদ্যবধি ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।