বোর্ড পরীক্ষায় ধর্মশিক্ষা বাদ : কেন প্রতিবাদে নামছেন আলেমরা?

মুনশী নাঈম:

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও সর্বস্তরে ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক ও বোর্ড পরীক্ষায় ধর্মশিক্ষা বহালের দাবিতে প্রতিবাদে নামছেন প্রায় সব ধারার আলেমগণ। তারা বলছেন, বোর্ড পরীক্ষায় ধর্ম শিক্ষা ৫০ নম্বরের জন্য হলেও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বোর্ড পরীক্ষা থেকে বাদ রেখে শুধু শিখনকালীন মূল্যায়ন দিয়ে ইসলাম শিক্ষার সুফল প্রত্যাশা করা অবাস্তবতার নামান্তর।

ধর্মীয় মহল বলছেন, নতুন শিক্ষাক্রমে মূল্যবোধ ও নৈতিকতা শিরোনামে ধর্মীয় শিক্ষা রাখা হলেও মূলত তা কোনোক্রমে ধর্মশিক্ষা নয়। বরং দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় শিক্ষাক্রম থেকে ইসলাম শিক্ষা বাদ দেয়ার যে পরিকল্পনা চলছিল, এ শিক্ষাক্রম তার সফল বাস্তবায়ন। ২০১০ সালে প্রণীত সর্বশেষ জাতীয় শিক্ষানীতি ধর্ম, বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষাকে বিশেষ প্রাধান্য দিয়ে তৈরী করা হয়েছিল। কিন্তু তারপর আর সেই শিক্ষানীতি কেউ অনুসরণ করেননি। ২০১২-এ একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীতে ইসলামী শিক্ষাকে উপেক্ষা করা হয়েছে। বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শাখা থেকে ইসলামী শিক্ষাকে পুরোপুরি বাদ দেয়া হয়েছে। মানবিক বিভাগে ইসলাম শিক্ষাকে করা হয়েছে ঐচ্ছিক। তারপর জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২০-এ ‘ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা’ বিষয়টিকে দশম শ্রেণীর বোর্ড পরীক্ষা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। আর ২০২২ সালের শিক্ষাক্রমেও একই অবস্থা বহাল রয়েছে।

শনিবার (৩০ জুলাই) বিকেল ৩টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের আবদুস সালাম হলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে ইসলামি শিক্ষা আন্দোলন বাংলাদেশ। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন প্রায় সবধারার আলেমগণ। উপস্থিত ছিলেন চরমোনাই, ছারছিনা, ফুলতলী, নেছারাবাদ ও মোকামিয়া সহ আলিয়া মাদরাসার বিভিন্ন প্রতিনিধিগণ। আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা বলেন, ৯১ শতাংশ মুসলমানের দেশে বোর্ড পরীক্ষা থেকে ইসলাম ধর্ম তুলে দেওয়াটা দুঃখজনক। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সর্বস্তরে ইসলামসহ ধর্মশিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। জাতীয় শিক্ষানীতির দাবি অনুযায়ী প্রাক-প্রাথমিক স্তরের ২টি শিশু শ্রেণি এবং প্রাথমিক স্তরের ১ম ও ২য় শ্রেণিতে ইসলাম তথা ধর্মশিক্ষার নির্ধারিত বই থাকতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীদের ৪র্থ শ্রেণির মতোই যথাযথ মূল্যায়নের আওতায় আনতে হবে।

সম্মেলন থেকে ৪ দফা দাবীও জানানো হয়। দাবিগুলো হলো—১. বোর্ড পরীক্ষায় ইসলামি শিক্ষাসহ সব ধর্মীয় শিক্ষা বিষয় বহাল করতে হবে। ২. প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত কারিগরিসহ সব শ্রেণি ও শাখায় ধর্মশিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। ৩. শিক্ষা-সিলেবাস থেকে প্রত্যাখাত বিবর্তনবাদসহ ধর্মবিরোধী সব পাঠ অপসারণ করতে হবে। ৪. বৈদেশিক শ্রম বাজারে ব্যাপকহারে প্রবেশের জন্য শিক্ষার সব স্তরে আরবি ভাষা-শিক্ষা কোর্স চালু করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক মো. শহীদুল হক বলেন, প্রথমে বিষয়টির নাম ছিল ‘ইসলাম শিক্ষা’। এরপর পরিবর্তন করে নাম রাখা হলো ‘ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা’। এরপর পরিবর্তন করে রাখা হলো, ‘মূল্যবোধ ও নৈতিকতা শিক্ষা’। শুধু নামই পরিবর্তন না, বোর্ড পরীক্ষা থেকেই ধর্মশিক্ষা বাদ দেয়া হলো। অথচ সরকারের নির্দেশ ধর্মকে প্রাধ্যন্য দিয়ে শিক্ষাক্রম তৈরী করা। কিন্তু শিক্ষা কমিটি সে নির্দেশনা মানেননি। এটা মূলত গভীর ষয়যন্ত্রের অংশ।’

আমরা কেন প্রতিবাদ করছি তা ব্যাখ্যা করে এই অধ্যাপক বলেন, ‘আগের প্রজন্ম সবাই মোটামুটি ধার্মিক হতো। শিক্ষাক্রমেই সে ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু এখনকার যে ব্যবস্থাপনা, তাতে আগামী প্রজন্ম ধর্মহীন হয়ে পড়বে। আমাদের ছেলেরা না হয় মাদরাসায় পড়েছে, কিন্তু জেনারেল শিক্ষায় যারা পড়ছে, তারা ধর্মশিক্ষাটা পাবে কোথায়? তারা তো বঞ্চিত হচ্ছে। তাদের কথা ভেবেই প্রতিবাদ জানাতে হবে। জনগণকে জাগ্রত করতে হবে।’

ফরিদপুরের চরবন্দরখোলা ফাজিল মাদ্রাসার প্রভাষক মাওলানা কবি মুহিব্বুল্লাহ জামী বলেন, ২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে ধর্মীয় শিক্ষায় গুরুত্ব দেবার কথা ছিল। কিন্তু তারপর ক্রমান্বয়ে ধর্মীয় শিক্ষাকে গুরুত্বহীন করে তোলা হয়েছে। ধর্মীয় শিক্ষার ক্লাসের সংখ্যা অন্য বিষয়ের ক্লাস থেকে কম। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীতে কোনো ধর্মীয় বই নেই। পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত কোনো ধর্মীয় শিক্ষক নেই। অথচ শিশুদের ভিত তৈরী হয় এ ক্লাসগুলোতেই। পরে বোর্ড পরীক্ষা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে ধর্মশিক্ষা। এখন তো আর কেউ পড়বেই না বিষয়টা। ভবিষ্যত প্রজন্ম অমাদের ভয়াবহ ধর্মীয় পরিচয় সঙ্কটের মধ্যে পড়বে। তাই আমাদেরকে সচেতন হতে হবে। মানুষকে সতর্ক করতে হবে। সরকারকে বলতে হবে। যার যার জায়গা থেকে প্রতিবাদ করতে হবে।

শিক্ষাক্রমে ধর্মীয় শিক্ষা সংকোচনের প্রতিবাদে শুরু থেকে সরব ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলো৷ এসএসসি পরীক্ষায় যখন ধর্মীয় শিক্ষা বাদ দেয়া হয়েছিলো, তখনই প্রায় সব ইসলামি দল প্রতিবাদ জানিয়েছিলো। চলতি বছরের পয়লা এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয়েছিলো ইসলামী আন্দোলনের জাতীয় মহাসমাবেশ। এতে প্রধান পাঁচটি দাবির অন্যতম একটি ছিল—শিক্ষাক্রমে ধর্মীয় শিক্ষা সংকোচন বন্ধের দাবি। দলটির ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি মাওলানা ইমতিয়াজ আলম বলেন, শুরু থেকেই আমরা নতুন এই শিক্ষাক্রমের বিরুদ্ধে কথা বলছি। ইসলামী আন্দোলনের জাতীয় সমাবেশ থেকে শুরু করে প্রতিটি সমাবেশে শিক্ষাক্রমে ধর্মীয় শিক্ষা সংকোচনের প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে। আমাদের জাতীয় শিক্ষক ফোরাওমও এ বিষয়ে সরব। সরকারের উর্ধ্বতন মহলে আমরা মেইল, স্মারকলিপি দিয়েছি। তাতে কাজ হয়নি। তাই মাঠে ময়দানে কথা বলা শুরু করেছি। এখন সবাইকে এক করে প্রতিবাদ শুরু করেছি।

আগের সংবাদআর্সেনিক দূষণে জন্ম নেওয়া শিশুদের ওজন কম হয়
পরবর্তি সংবাদকওমি মাদরাসায় গাইড বইয়ের ছড়াছড়ি !