মহানবীর ষাটোর্ধ্ব জীবন

নাসিম ইমরান:

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ষাটোর্ধ্ব জীবন প্রবীণ জীবনের দৃষ্টান্তমূলক নমুনা। `ষাটোর্ধ্ব জীবন’ সংখার পাঠকদের জন্য পেশ করা হল সংক্ষেপে মহানবীর ষাটোর্ধ্ব জীবনের ঘটনাপঞ্জী। প্রতিটি ঘটনায় রয়েছে স্ববিষয়ের বিস্তর শিক্ষা। ষাটোর্ধ্ব জীবনেও যা করা সম্ভব তার একটি চিত্র ফুটে উঠবে এখান থেকে।

অষ্টম হিজরি : ৬২৯ সাল

অষ্টম হিজরির সফর মাসের প্রথম তারিখ। মদিনায় ফিরে এলেন ইবনু আবিল আওজা। ৫০ জনের কাফেলাসহ তাকে পাঠানো হয়েছিল সপ্তম হিজরির জিলহজ মাসে, বনু সুলাইমের কাছে ইসলাম প্রচারের জন্য। তাদেরকে দাওয়াত দেওয়া হয়, অগ্রাহ্য করে তারা। আক্রমণ করে এবং তাবারির মতে, সকলেই শহিদ হয়ে যান। যদিও ওয়াকিদি লিখেন, কাফেলা-প্রধান আহত রক্তাক্ত অবস্থায় ফিরে আসতে পেরেছিলেন।

৮ম হিজরির রবিউল আউয়াল মাস। মুসলিমদের ওপরে হামলা করার জন্য বনু কুজাআহর সেনাসংগঠনের খবর শুনে মহানবি সা. কাব বিন উমায়ের আনসারির নেতৃত্বে ১৫ জনের একটি সেনাদল প্রেরণ করেন। যুদ্ধে সাহাবিদের নির্মমভাবে শহিদ করা হয়। কাফেলার মধ্যে একজন মাত্র জীবিত থাকেন।

৮ম হিজরির রবিউল আউয়াল মাস। বনু হাওয়াজিন গোত্র বারবার শত্রুদের সাহায্য করে যাচ্ছিল। ফলে তাদের দমনের জন্য শুজা বিন ওয়াহাব আল আসাদির নেতৃত্বে ২৫ জনের একটি সেনাদল উক্ত গোত্রের জাতু-ইরক এ প্রেরিত হন। যুদ্ধ হয়নি।

৮ হিজরি জুমাদাল উলা মাসে মুতার যুদ্ধ সংঘঠিত হয়। বসরা বা হাওরানের নিকট নবিজির পত্র বহন করে নিয়ে যাওয়ার সময় উমর ইবনু হারিস রাদিয়াল্লাহু আনহু সিরিয়া সীমান্তে মুতার রোমক শাসনকর্তা শুরাহবিল কর্তৃক শহিদ হন। এজন্য রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজরত যায়েদ রাদিয়াল্লাহু আনহার নেতৃত্বে ৬ হাজার সেনা প্রেরণ করেন। রোম সম্রাটের সাহায্যপুষ্ট শুরাহবিল ১ লাখ সৈন্য নিয়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। যায়েদ, জাফর ও আবদুল্লাহ সৈন্য চালনা করতে গিয়ে শহিদ হন।। অবশেষে হজরত খালিদ বিন ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহুর নেতৃত্বে রোমানরা পরাভূত হয়।

মক্কাবিজয় ও মহামানবতার নবযাত্রা

৮ম হিজরির শাবান মাসে মুসলিমদের মিত্র বনু খুজাআর বিরুদ্ধে কুরাইশদের মিত্র বনু বকর অস্ত্রধারণ করে এবং বহু লোককে হত্যা করে। বনু বকরকে কতিপয় কুরাইশ অস্ত্র ও সৈন্য দিয়ে সাহায্য করেছিল। যার ফলে হুদাইবিয়ার সন্ধি ভেঙে যায়।

(সন্ধিচুক্তি ভেঙে যাওয়ার পর) অত্যাচারের প্রতিশোধকল্পে ৮ম হিজরির ৭ই রমজান মোতাবেক ৬২৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ ডিসেম্বর শুক্রবার ১০,০০০ সাহাবি নিয়ে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনা হতে রওনা হন এবং ১৭ই রমজান মোতাবেক ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দের ৮ই জানুয়ারি সোমবার একপ্রকার বিনা যুদ্ধে মকাবিজয় সম্পন্ন হয়। মুসলিম পক্ষে কাফেলা থেকে আলাদা দুইজন শহিদ ও কাফেরের পক্ষে অতি উৎসাহী হয়ে অগ্রবর্তী ১২ জন নিহত হয়। এ সময় মদিনার দায়িত্বে ছিলেন আবু রুহুম কুলসুম বিন হুসাইন আল-গিফারি।

মক্কা অধিকার সম্পন্ন করে হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সাহাবিগনের প্রতি কুরাইশদের যাবতীয় অত্যাচার উৎপীড়নের প্রতিশোধ না নিয়ে তিনি সবাইকে সাধারণ ক্ষনা প্রদান করেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়, যে ব্যক্তি অস্ত্র ত্যাগ করবে, সে নিরাপদ। যে ব্যক্তি স্বগৃহে অবস্থান করবে, সে নিরাপদ। যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের ঘরে প্রবেশ করবে, সেও নিরাপদ। এটা ছিল পৃথিবীর যুদ্ধের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব এবং অভাবনীয় ঘটনা। নবিজির উদারতা ও ক্ষমার গুণে মুগ্ধ হয়ে ইসলামের অনেক বড় বড় শত্রুসহ মক্কাবাসীর নরনারীগণ ইসলাম গ্রহণ করেন। এরপর মুসলিমরা কাবার ভেতর ও বাইরের মূর্তিগুলোকে বিনষ্ট ও বিদূরিত করে কাবাগৃহের পবিত্রতা ও সম্মাননা নিশ্চিত করেন।

৮ম হিজরির শাওয়াল মাস, হুনাইন জনপদের হাওয়াজিন বংশীয় যোদ্ধারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ প্রস্তুতি নিচ্ছে জেনে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সামাম ২ হাজার মক্কাবাসী ও ১০ হাজার মদিনাবাসী বীরযোদ্ধাদের নিয়ে হুনাইনে উপস্থিত হন। এবং যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে শত্রুপক্ষের ৬ হাজার নারী ও শিশু বন্দি হয়। বিপুল পরিমান গবাদিপশু ও ধনসম্পদ মুসলিমদের হস্তগত হয়। পরাজিত হুনাইনিরা তায়েফ দুর্গে আশ্রয় নেয়। মুসলিমরা দুর্গ অবরোধ করে রাখে তিন সপ্তাহ পর তারা আত্মসমর্পণ করতে বাধা হয়। যুদ্ধবন্দিদের প্রতি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অমায়িক ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে হাওয়াজিন দলপতি মালেক স্বীয় দলবলসহ ইসলাম গ্রহণ করেন। এ যুদ্ধে মুসলিমদের ১২ জন শহিদ হন।

আওতাস যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার কারণ হলো, হাওয়াজিন সম্প্রদায় পরাজয় বরণ করার পর তাদের একদল তায়েফে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। তাদের মধ্যে দলপতি মালিক ইবনু আওফ নাসরিও ছিল। তায়েফের দুর্গের অভ্যন্তরে তারা অবস্থান নেয়। আর এক দল লোক আততাস নামক স্থানে গিয়ে সমবেত হয়। বাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু আমির আশআরি রাদিয়াল্লাহু আনহুর নেতৃত্বে একদল সাহাবির একটি বাহিনী তাদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। মুসলিম বাহিনী যুদ্ধ করে তাদের পরাজিত করেন। অন্যদিকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বয়ং তায়েফের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন এবং তায়েফ অবরোধ করেন। ইবনু হিশাম বলেন, এ যুদ্ধে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিনজানিক দ্বারা পাথর নিক্ষেপ করেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বপ্রথম ইসলামে মিনজানিক ব্যবহার করেন। এর দ্বারা তিনি তায়েফবাসীদের প্রতি পাথর বর্ষণ করেছিলেন। কতিপয় সাহাবি একটি দাব্বাবায় (ট্যাংকের ন্যায় সমরাস্ত্র) প্রবেশ করেন। তারপর তা আস্তে আস্তে টেনে নিয়ে যান তায়েফের প্রাচীর বিধ্বস্ত করার জন্য। তখন তাদের ওপর গরম লৌহ শলাকা ফেলে দেওয়া হয়। ফলে তারা দাব্বাবা থেকে বেরিয়ে আসেন। তখন বনু সাকিফ তাঁদের ওপর তির নিক্ষেপ করে। যুদ্ধে মুসলিমদের বিজয় হয়। প্রচুর গনিমত অর্জিত হয়।

যুদ্ধে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দুধ বোন সায়মা বিনতে হারিস ইবনু আবদুল উজ্জা বন্দি হন। নবিজি তাকে চিনতে পেরে সম্মান প্রদর্শন করেন। এক দাসী ও দাস এবং নানা উপহারসহ তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় নিজ গোত্রে, যেখানে তিনি যেতে চেয়েছিলেন। হুনাইনের গনিমত বণ্টন করে জিলকদ মাসে জিরইয়ানা থেকে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাইতুল্লাহয় উমরা আদায় করেন।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তায়েফ থেকে ফিরে এলে বুজাইর ইবনু জুহাইর ইবনু আবি সুলমা তার সহোদর কাব ইবনু জুহায়েরকে পত্র লিখে জানান যে, মক্কার যেসব লোক রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিন্দা করত এবং তাঁকে কষ্ট দিত, তাদের কতিপয়কে তিনি হত্যা করেছেন। কুরাইশদের যেসব কবি এখনও বেঁচে আছে যেমন: ইবনু জুবারি ও হুরায়রা ইবনু আরি ওহাব তারা চারিদিকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তুমি যদি বেঁচে থাকা প্রয়োজন মনে করো; তবে দ্রুত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে চলে এসো। কেননা, যে লোক তওবা করে। তাঁর কাছে আসে তাকে তিনি হত্যা করেন না। তিনি তাঁর সেই বিখ্যাত কাসিদাটি রচনা করল, যাতে তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রশংসা করেছেন, তাঁর আশঙ্কার কথা ও নিন্দাকারী শত্রুদের কেঁপে ওঠারও বর্ণনা দিয়েছেন। এরপর তিনি মদিনার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লেন। নবিজির সমীপে উপস্থিত হয়ে তিনি কবিতা আবৃত্তি করেন, ইসলাম গ্রহণ করেন এবং নবিজি কর্তৃক পুরষ্কৃত হন।

অভিযান থেকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় প্রত্যাবর্তন করেন। তখন জিলহজ মাস শেষ হতে কয়েক দিন বাকি ছিল। বছরের অবশিষ্ট সময় সেখানেই কাটান। এ বছর জিলহজ মাসে মারিয়া কিবতির গর্ভে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পুত্র ইবরাহিমের জন্ম হয়।

৬৩১ খ্রিষ্টাব্দ, নবম হিজরি

বিশেষত ৯ম হিজরিকে বলা হয় আমুল উফুদ ‘প্রতিনিধি বর্ষ’। যদিও ১০ম হিজরি বর্ষে প্রতিনিধিদল আগমনের ধারা জোরদার ছিল। কিন্তু এর প্রেক্ষাপট তৈরি হয় দীর্ঘ ধারাবাহিকতায়। যাকে অবধারিত করে মক্কা ও হুনাইন বিজয়। এরপর আরবদের ইসলাম গ্রহণে বড় কোনো বাধা রইল না। তারা এতদিন দেখতে চাচ্ছিল মহানবির সাথে স্বগোত্রীয়দের বিরামহীন বিরোধিতার শেষ পরিণতি কী হয়? তা যখন সবাই দেখে নিল এবং ইসলামের মহিমাকে অনুভব করে নিল নিবিড়ভাবে, এরপর আরব উপদ্বীপের বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীর নেতারা ইসলাম গ্রহণ করতে আরম্ভ করল। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনের নাসর সুরায় ইরশাদ করেন,

যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় এলো এবং আপনি মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করতে দেখলেন, তখন আপনি আপনার পালনকর্তার পবিত্রতা বর্ণনা করুন এবং তাঁর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করুন। নিশ্চয় তিনি তওবা কবুলকারী।

ইসলামে আত্মনিবেদনের মাত্রা এমনই ছিল, যার ফলে, মক্কাবিজয়ের মাত্র নয় মাসের মাথায় ৯ম হিজরির রজব মাসে তাবুক অভিযানের সময় ৩০,০০০ সৈন্য নিয়ে অভিযান সম্পন্ন হলো। তার এক বছর পর ১০ম হিজরির জিলহজ মাসে বিদায় হজের সময় নবিজির সাথি হলেন ১ লক্ষ ২৪ হাজার বা ৩০ হাজার মুসলিম।

৯ম ও ১০ম হিজরিতে আগত প্রতিনিধিদলের সংখ্যা ছিল বিস্তর। ইবনু সাদ, দিমইয়াতি, ইবনু সাইয়িদিন নাস, মুগলতায়ি, জায়নুদ্দিন ইরাকি প্রমুখ জীবনীকারগণ ৬০-এর অধিক প্রতিনিধিদলের কথা বর্ণনা করেছেন। জুরকানি বলেন, মোট ৩৬টি প্রতিনিধিদলের বর্ণনা দিয়েছেন। ইবনুল কাইয়িম উল্লেখ করেছেন ৩৫ প্রতিনিধিদলের কথা।

তায়েফের ছাকিফ গোরের প্রতিনিধিদল ১ম হিজরির রমজান মাসে মদিনায় আসে। সেখানে ইতোপূর্বে উরওয়া ইবনু মাসউদ ছাকাফি রাদিয়াল্লাহু আনহু ইসলাম গ্রহণ করে এর আনুকূল্যে দাওয়াতি কাজ করেন এবং সালাতরত অবস্থায় শহিদ হন।

এরপর ইসলামে অনুরক্ত হয়ে যে কাফেলা মদিনায় এলো, তাতে ছিলেন ছয়জন সদস্য। যাদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন প্রথম ভারত অভিযানকারী বিজয়ী সেনাপতি উসমান ইবনু আবুল আছ-সাকাফি। এরা মদিনায় পৌঁছলে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হুকুমে মুগিরা বিন শোবা এদের আপ্যায়ন ও আতিথেয়তার দায়িত্বে নিয়োজিত হন।

তারা মুসলিম হতে চাইলেও সালাত থেকে অব্যাহতি চায়, ব্যভিচার, সুদ ও মদপানের অনুমতি চায়। কোনো চাহিদাই নবিজির কাছে স্বীকৃত হয়নি।

আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লান ছাকিফ প্রতিনিধিদলের জন্য মসজিদে নববির কাছাকাছি তাঁবুর ব্যবস্থা করতে বললেন। যাতে তারা সেখান থেকে মসজিদে সালাতের দৃশ্য দেখতে পায় ও কুরআন শুনতে পায়। ইসলামকে খুব কাছ থেকে তারা দেখল। কয়েক দিনের মধ্যেই তাদের অন্তরে ইসলাম প্রভাব বিস্তার করল।

বিস্তারিত আলোচনা শেষে তারা সবাই ইসলাম কবুল করল। ১৫ দিন পর বিদায় নিলো। নিজেদের জন্য একজন ইমাম কামনা করল। বলল, নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তরুণ কিন্তু বিজ্ঞ সাহাবি উসমান বিন আবুল আস-সাকাফিকে তাদের ইমাম ও নেতা নিযুক্ত করে দেন।

এর কিছুদিন পরে, বীরে মাউনার গণহত্যার অপরাধী আমের বিন তোফায়েল ও আরবান বিন কায়েস মহানবিকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হত্যার লক্ষ্য নিয়ে নজদ থেকে আগত প্রতিনিধিদলের সঙ্গী হয়। তারা ব্যর্থ হয় এবং অচিরেই মৃত্যুবরণ করে।

ইয়ামামার হানিফা গোত্রের ১৭ সদস্যের অস্ত্র প্রতিনিধিদলটি ৯ম হিজরি সনে মদিনার এসে ইসলাম কবুল করেন। তাদের নেতা ছুমামাহ বিন আছাল হানাফি যিনি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হত্যার কুমতলবে ৬ষ্ঠ হিজরির মহররম মাসে মদিনায় যাওয়ার পথে মুহাম্মদ বিন মাসলামার হাতে পাকড়াও হয়ে মদিনায় নীত হন। তিন দিন বন্দি থাকার পর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে মুক্তি দিলে তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইসলাম কবুল করেন। প্রধানত তাঁরই দাওয়াতে উদ্‌বুদ্ধ হয়ে অত্র প্রতিনিধিদলটি ৯ম হিজরি সনে মদিনায় এসে ইসলাম কবুল করেন। উক্ত প্রতিনিধিদলে ইয়ামামার নেতা মুসায়লামা ছিল, সে শর্ত দিলো, যদি মুহাম্মদ তাঁর পরে আমাকে তাঁর শাসন ক্ষমতা অর্পণ করেন, তাহলে আমি তাঁর অনুসারী হব। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর হাতে রাখা খেজুরের শুকনো ডালটির দিকে ইশারা করে বললেন, যদি তুমি এই শুকনা ডালের টুকরাটিও চাও, তাহলেও আমি তোমাকে এটা দেবো না। যদি তুমি ইসলাম প্রত্যাখ্যান করে ফিরে যাও, তবে আল্লাহ তোমাকে ধংস করে দেবেন। কারণ, তোমার পরিণতি আমাকে দেখানো হয়েছে। মুসায়লামা ফিরে গিয়ে মুরতাদ হয় এবং নবি দাবি করে নিজেকে।

প্রসিদ্ধ তাই গোত্রের প্রতিনিধিদল তাদের বীর যায়েদ আল খাইলের নেতৃত্বে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খিদমতে হাজির হয়। সবাই মুসলিন হয়ে যায়। দলনেতা যায়েন নবিজির প্রশংসা লাভ করেন। ৯ম হিজরির রবিউল আউয়াল মাসে হাতিম তায়ির পুত্র বিখ্যাত খ্রিষ্টান পণ্ডিত ও পুরোহিত আদি বিন হাতিম স্বীয় বোন সাফফানার দাওয়াতে সাড়া দিয়ে শাম থেকে মদিনায় এসে সরাসরি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে হাজির হন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে মর্যাদা প্রদর্শন করে নিজ বাড়িতে নিয়ে আসেন। তিনি ইসলামকে ঘৃণা করতেন এবং তা থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। মহানবির সাথে আলোচনা ও নববি বৈশিষ্ট্যে মুগ্ধ হয়ে তিনিও ইসলামে দীক্ষিত হন।

কিন্দার নেতা আশআস বিন কায়েস ৬০ অথবা ৮০ জনের একটি দল নিয়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকটে আসেন। অতঃপর তারা মসজিদে প্রবেশ করেন। এমতাবস্থায় তাদের পোশাকে রেশমের কাপর ছিল। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওরা সাল্লাম তাদের বললেন, তোমরা কি ইসলাম কবুল করোনি? তারা বলল, হ্যাঁ। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তাহলে তোমাদের পোশাকে রেশনি কাপর কেন? এগুলো ছিঁড়ে ফেলো। অতঃপর তারা এগুলো ছিঁড়ে দূরে নিক্ষেপ করল।

ইয়েমেনের প্রসিদ্ধ আশআরি গোত্র মুসলিম হয়েই মদিনায় আসে। আনাস বিন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমাদের নিকট একদল লোক আসবে, যারা ইসলামের ব্যাপারে তোমাদের চাইতে নম্র হৃদয়।

অতঃপর আশআরি প্রতিনিধিদল এলো। যাদের মধ্যে আবু মুসা আশআরিও ছিলেন।

তারা মদিনায় প্রবেশ করার সময় খুশিতে কবিতা পাঠ করতে থাকেন,

“কালকে আমরা বন্ধুদের সাথে মিলিত হব। মুহাম্মদ ও তাঁর দলের সাথে।”

অতঃপর তারা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট এলেন এবং পরম্পর মুসাফাহা করলেন। তাদের মাধ্যমেই প্রথম মুসাফাহার রীতি চালু হয়।

বনু তামিম আগে থেকেই মুসলিম হয়েছিল। কিন্তু তাদের কিছু লোক তখনো মুসলিম হয়নি। তারা জিজিয়া দিতে অস্বীকার করে এবং অন্যান্য গোত্রকেও জিজিয়া না দেওয়ার জন্য প্ররোচিত করে। ফলে তাদের বিরুদ্ধে রাজ্য কর্মকর্তা উয়ায়না বিন হিসন ৯ম হিজরির মহররম মাসে ৫০ জনের একটি অশ্বারোহী দল নিয়ে অতর্কিতে হামলা করেন। তাদের অনেকেই বন্দি হয়। এ নিয়ে আলোচনা করতে আসে তাদের নেতারা। মহানবিকে গৃহের বাইরে থেকে অশোভনভাবে ডাকতে থাকে। যার প্রেক্ষিতে মহান আল্লাহ তাআলা নির্দেশ জারি করেন,

যারা তোমাকে কক্ষের বাহির থেকে উঁচু স্বরে আহ্বান করে, তাদের অধিকাংশ জ্ঞান রাখে না। যদি তারা তোমার বের হওয়া পর্যন্ত ধৈর্যধারণ করত, তাহলে সেটাই তাদের জন্য উত্তম হতো।

আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বনু তামিন নেতাদের সাথে বসলেন। কিন্তু তারা তাদের বংশীয় অহমিকা বর্ণনা করে বক্তৃতা ও কবিতা আওড়ানো শুরু করে দিলো। প্রথমে তাদের একজন বড় বক্তা উতারিদ বিন হাজের বংশ গৌরবের উপরে উঁচু মানের বক্তব্য পেশ করলেন। তার জওয়াবে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘খতিবুল ইসলাম’ ছাবিত বিন কায়িস বিন শাম্মাস রাদিয়াল্লাহু আনহুকে পেশ করলেন। অতঃপর তারা তাদের কবি জিবরিকান বিন বদরকে পেশ করল। তিনিও নিজেদের গৌরবগাথা বর্ণনা করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কবিতা পাঠ করলেন। তার জওয়াবে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘শাইরুল ইসলাম’ হজরত হাসসান বিন ছাবিত রাদিয়াল্লাহু আনহুকে পেশ করলেন।

উভয় দলের বক্তা ও কবিদের মোকাবিলা শেষ হলে বনু তামিমের পক্ষ হতে আকবা বিন হাবিস বললেন, তাদের বক্তা আমাদের বক্তার চাইতে উত্তম। তাদের কবি আমাদের কবির চাইতে উত্তম। তাদের আওয়াজ আমাদের আওয়াজের চাইতে উঁচু এবং তাদের বক্তব্যসমূহ আমাদের বক্তব্যসমূহের চাইতে উন্নত। অতঃপর তারা ইসলাম কবুল কালেন। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের উত্তম উপঢৌকনাদি দিয়ে সম্মান প্রদর্শন করলেন। অতঃপর তাদের বন্দিদের ফেরত দিলেন।

৯ম হিজবির শেষদিকে ইয়েমেনের অন্তর্গত হামদান গোত্রের প্রতি একটি পরসহ আলি রাদিয়াল্লাহু আনহুকে প্রেরণ করেন নবিজি। আগে প্রেরণ করা হয়েছিল খালিদ বিন ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহুকে। কিন্তু তারা সাড়া দেয়নি। হজরত আলি রাদিয়াল্লাহু আনহ তাদের নিকটে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পত্রটি পড়ে শোনান এবং তাদেরকে ইসলামের প্রতি দাওয়াত দেন। ফলে তাঁর দাওয়াতে এক দিনেই গোত্রের সমস্ত লোক ইসলাম কবুল করে। এই সুসংবাদ জানিয়ে আলি বাদিয়াল্লাহু আনহুর প্রেরিত পত্র পাঠ করে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খুশিতে ‘সিজদায়ে শোকর’ আদায় করেন।

নাজরান ছিল ৭৩টি পল্লিসমৃদ্ধ খ্রিষ্টানদের বৃহৎ কেন্দ্র। সে সময় একটি দ্রুতগামী ঘোড়ার পক্ষে উক্ত নগরী এক দিনে পরিভ্রমণ করা সম্ভবপর ছিল না। উষ্ণ নগরীতে ছিলেন গুণী ও দক্ষ ব্যক্তিবর্গ, রাজনীতিক, ধর্মনেতা এবং এক লাখ দক্ষ যোদ্ধা।

সেখান থেকে দুবার এই প্রতিনিধিদলের আগমন ঘটেছিল। প্রথমবার তিনজনের এবং পরেরবার ৬০ জনের। দুটি দলই সম্ভবত অল্পদিনের ব্যবধানে ৯ম হিজরিতে মদিনায় এসেছিল, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে সন্ধিচুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিল এবং সেখানকার অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করেছিল।

বনু সাদ বিন বকরের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে আসেন গোত্রনেতা জিমাম বিন সালাবাহ। বাইরে উট বেঁধে রেখে তিনি মসজিদে প্রবেশ করেন। নবিজিকে কিছু প্রশ্ন করতে চাইলে তিনি বলেন, যা খুশি প্রশ্ন করো। জিমাম আল্লাহর কসম দিয়ে তাঁকে বাপ দাদাদের উপাস্য দেব-দেবী সম্পর্কে প্রশ্ন করেন। জবাবে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সান্নাম বলেন, এ সবই শিরক। আল্লাহ ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই। অতঃপর তিনি ইসলামের ফরজসমূহের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেন। জবাবে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কালিমা, সালাত, সিয়াম, জাকাত ও হজ-সহ ইসলামের পাঁচটি বুনিয়াদি ফরজ ব্যাখ্যা করেন। তখন তিনি কালিমা শাহাদাত পাঠ করে ইসলাম কবুল করে নেন। তিনি তার কওমের নিকট ফিরে যান এবং তাদের নিকটে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইতি ওয়া সাল্লামের আদেশ ও নিষেধসমূহ বর্ণনা করেন। অতঃপর তার উপস্থিতিতে সন্ধ্যার মধ্যেই সকল নারী-পুরুষ ইসলাম কবুল করে।

ইয়েমেনের কিন্দা গোত্রের তুজিব শাখার লোকেরা আগেই মুসলিম হয়েছিল। তাদের ১৩ জনের এই প্রতিনিধিদল নিজ গোত্রের মাল-সম্পদ ও গবাদিপশুর জাকাতসমূহ সাথে করে এনেছিল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমরা এগুলো ফেরত নিয়ে যাও এবং নিজ কওমের ফকির-মিসকিনদের মধ্যে বিতরণ করে দাও। তারা বলল, হে আল্লাহর রাসুল! তাদেরকে বন্টন করার পর উদ্বৃত্তগুলোই কেবল এখানে এনেছি। তারা দ্বীনের বিধিবিধান শেখার জন্য খুবই উদগ্রীব ছিল। সে কারণ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের তালিমের জন্য বেলাল রাদিয়াল্লাহু আনহুকে নিযুক্ত করেন। অতঃপর তারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কয়েকটি বিষয়ে প্রশ্ন করে। তিনি সেগুলোর জওয়াব তাদের লিখিয়ে দেন। তারা ফিরে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হলে সাহাবিরা তাদের বললেন, এত তাড়া কীসের? তারা বলল, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবার থেকে আমরা যেসব কল্যাণ লাভ করেছি, দ্রুত ফিরে গিয়ে আমরা সেগুলো আমাদের সম্প্রদায়কে জানাতে চাই।

বনু সাদ হুজায়েম প্রতিনিধিদল আবু নুমানের নেতৃত্বে রাসুল সা.-এর দরবারে আসেনা তারা নবিজির আতিথ্য লাভ করেন।

৯ম হিজরিতে সুরা তাওবায় মুশরিকদের সাথে সর্বপ্রকার বারাআত বা সম্পর্ক ছিন্ন করে আয়াত নাজিল করা হয়। হজরত আলি রাদিয়াল্লাহু আনহু সেই আয়াতগুলোর বিধান হজের উদ্দেশ্যে আগত সবাইকে শুনিয়ে দেন। তিনি বলেন, অতঃপর কোনো পৌত্তলিক কাবায় হজ করার জন্য আগমন করতে এবং কাবাগৃহে প্রবেশ করতে পারবে না। শত যুগ যুগান্তর পরে হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম প্রতিষ্ঠিত কাবাগৃহ পৌত্তলিকতা হতে মুক্ত হয়। আলোকের আবির্ভাবে অন্ধকার বিদূরিত হয়।

নবগঠিত মাদানি রাষ্ট্রের আর্থিক ভিত মজবুত করার জন্য এবং ফরজ জাকাত ও অন্যান্য সাদাকাসমূহ সুশৃঙ্খলভাবে আদায় ও বন্টনের জন্য আল্লাহর রাসুল সাম্রাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেন্দ্রীয়ভাবে রাজস্ব কর্মকর্তাদের নিয়োগ দান করেন। ৯ম হিজরি সনের মহররম মাস থেকে এই সকল নিয়োগ কার্যকর হয়। এতদুদ্দেশ্যে তিনি রাষ্ট্রের অধীন ১৬টি অঞ্চল ও গোত্রের জন্য ১৬ জন রাজস্ব কর্মকর্তা নিয়োগ করেন।

এ সালে আবিসিনিয়ার ইসলাম ধর্মাবলম্বী নাজাশি বাদশাহ আসহানা ইনতিকাল করেন। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার মৃত্যুর সংবাদ অবগত হয়ে সাহাবিদের সঙ্গে নিয়ে মদিনা নগরে নাজাশির উদ্দেশে গায়েবানা জানাজা আদায় করেন।

এ বছর তাবুক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। রোমক সম্রাট হিরাক্লিয়াস মদিনা আক্রমণ উদ্দেশ্যে ৪০ হাজার সৈন্য নিয়ে সিরিয়া সীমান্তে উপনীত হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সংবাদ শুনে ৩০ হাজার সৈন্য নিয়ে সিরিয়া সীমান্তবর্তী তাবুক নামক স্থানে শিবির স্থাপন করেন। এবং সেখানে ২০ দিন পর্যন্ত শত্রুর আগমন অপেক্ষায় অবস্থান। করেন। মুসলিমদের মনোবল, প্রতিরোধক্ষমতা ও কষ্ট সহিষ্ণুতার পরিচয় পেয়ে রোমক সম্রাট পশ্চাৎপসরণ করে।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কন্যা উম্মু কুলসুম মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গভীরভাবে শোকাভিভূত হন। তিনি উসমানকে বলেন আমার তৃতীয় কন্যা থাকলে তার বিবাহও তোমার সঙ্গে দিতাম।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তাবুক হতে প্রত্যাবর্তনের পর মুনাফিক নেতা আবদুল্লাহ বিন উবাই মৃত্যুবরণ করে। রাসুলুল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লান তার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করেন এবং উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর বাধা দান সত্ত্বেও তার সালাতে জানাজা আদায় করেন। পরে কুরআন কারিনের আয়াত অবতীর্ণ হয়ে তাতে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর মত সমর্থন করে মুনাফিকদের জানাজা আদায় করতে নিষেধ করা হয়।

ওয়াকিনি রাদিয়াল্লাহু আনহুর মতে এ বছরের রজব মাসেই আবিসিনিয়ার রাজা (বর্তমান ইথিওপিয়া) নাজাশি রাদিয়াল্লাহু আনহুর মৃত্যু হয় এবং সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবিগণের কাছে তার মৃত্যুর সংবাদ পরিবেশন করেন।

৬৩২ খ্রি. ১০ হিজরি

দশম হিজরির শাবান মাসে ইয়েমেন থেকে ১০ সদস্যের প্রতিনিধিদল নবিজির সমীপে আসেন। তারা ঈমান আনয়ন করেন। নবিজি তাদেরকে ইসলামের ফরজ ও আবশ্যক দায়িত্বসমূহ বুঝিয়ে দেন এবং আদেশ করেন-

ক. অবশ্যই অঙ্গীকার পূরণ করবে।
খ. আমানতের সুরক্ষা দেবে।
গ. প্রতিবেশীর প্রতি সুদৃষ্টি রাখবে।
ঘ. কারও ওপর জুলুম করবে না।

উদ্ধত স্বভাবের মুহারিব গোত্র অতীতে অনেক দুর্ব্যবহার করেছে। এবার তারা ১০ জনের প্রতিনিধিদল পাঠায়। তারা বলল, কর্কশ ও রুক্ষ ব্যবহার এবং ইসলামের সাথে দুশমনিতে আমাদের অগ্রবর্তী কেউ ছিল না। কিন্তু এবার আমরা ঈমান আনছি। আমাদের ক্ষমার জন্য দুআ করুন।

রমজান মাসে সালমান গোত্রের সাত নেতা মদিনায় আগমন করে ইসলামে দীক্ষিত হন। নিজেদের এলাকায় অনাবৃষ্টি ও দুর্ভিক্ষ নিয়ে দুআপ্রার্থনা করেন। নবিজি দুআ করেন, তাদের উপহারসামগ্রী প্রদান করেন এবং সেদিনই সেই এলাকায় মুষলধারে বৃষ্টিপাত হয় ।

বনি আবস গোত্রের তিন প্রতিনিধি নবিজির দরবারে আসেন এবং হিজরতের আগ্রহ ব্যক্ত করেন। নবিজি তাদেরকে হিজরত না করে আপন আলয়ে থাকার অনুমতি দেন।

বনি মুনতাফিক গোত্রের প্রতিনিধির আসেন এক ভোরবেলায়। নবিজি সেদিন সাহাবাদের দীর্ঘ খুতবা দেন। তাদের থেকে বাইআত গ্রহণ করেন।

এ বছর রমজানে ২০ দিন এতেকাফ করেন মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। অন্যান্য বছর জিবরাইল আলাইহিস সালাম রমজানে একবার সমস্ত কুরআন পেশ করলেও এ বছর সেটা দুবার করেন। এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি প্রিয় কন্যা ফাতিমা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে বলেন, আমার মৃত্যু খুব নিকটে মনে হচ্ছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুআজ বিন জাবাল রাদিয়াল্লাহু আনহুকে ইয়েমেনের গভর্নর নিযুক্ত করে প্রেরণ করেন দশম হিজরি সনে। তখন তাঁর বিদায় কালে অন্য উপদেশাবলির সঙ্গে এ কথাও বললেন,

হে মুআজা! এ বছরের পর তোমার সঙ্গে আমার হয়তো আর সাক্ষাৎ নাও হতে পারে, তখন হয়তো-বা আমার এ মসজিদ এবং আমার কবরের পাশ দিয়ে তোমরা যাতায়াত করবে।

বিদায় হজ

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লান হজের জন্য তাঁর ইচ্ছা এবং কর্মসূচি ঘোষণা করলেন। আরবের মুসলিমগণ দলে দলে সমবেত হতে আরম্ভ করলেন। প্রত্যেকেরই ঐকান্তিক ইচ্ছা ছিল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পদচিহ্নকে নিজ নিজ চলার পথে একমাত্র আকাঙ্ক্ষিত ও অনুসরণযোগ্য বা পাথের হিসেবে গ্রহণ করে নেবেন।

জিলকদ মাসের চার দিন অবশিষ্ট থাকতে শনিবার দিবস রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা অভিমুখে যাত্রার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন।

তিনি চুলে চিরুনি ব্যবহার করলেন, তেল মালিশ করলেন, পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান করলেন, কুরবানির পশুগুলোকে মালা বা হার পরালেন এবং জোহর নামাজের পর রওনা হয়ে গেলেন। আসরের পূর্বে জুল হুলাইফা নামক স্থানে পৌঁছলেন। সেখানে আসরের দুই রাকাত নামাজ আদায় করলেন এবং শিবির স্থাপন করে সারা রাত সেখানে অবস্থান করলেন।

অতঃপর জোহরের নামাজের পূর্বে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইহরামের জন্য গোসল করলেন। এরপর আয়েশ রাদিয়াল্লাহ আনহা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শরীর এবং পবিত্র মাথায় নিজ হাতে জাবিরা এবং দেশক মিশ্রিত একপ্রকার সুগন্ধি দ্রব্য মালিশ করে দিলেন। সুগন্ধির বেশ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরা মাথার সিঁথি এবং দাড়িতে পরিলক্ষিত হলো, কিন্তু তিনি সেই সুগন্ধি না ধুয়ে তা স্থায়ীভাবে রেখে দিয়েছিলেন। অতঃপর তিনি লুঙ্গি পরিধান করেন, চাদর গায়ে দেন এবং জোহরের দুই রাকাত নামাজ আদায় করেন।

অতঃপর মক্কা অভিমুখে ভ্রমণ অব্যাহত রাখেন। সপ্তাহব্যাপী পথ চলার পর সন্ধ্যার নিকটবর্তী সময়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মক্কার উপকণ্ঠে জি-তাওয়া নামক স্থানে পৌঁছলেন, যাত্রা বিরতি করে সেখানে রাত্রিযাপন করলেন এবং কছরের নামাজ আদায়ের পর গোসল করলেন। অতঃপর সকাল নাগাদ মক্কায় প্রবেশ করলেন। দিবসটি ছিল ১০ম হিজরির ৪ঠা জিলগজ রবিবার। পথে তিনি আট রাত কটান, মধ্যমভাবে এ দূরত্ব অতিক্রম করার জন্য এ সময়েরই প্রয়োজন হয়ে থাকে।

মাসজিদুল হারামে পৌঁছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রথমে কাবাগৃহের তাওয়াফ সম্পন্ন করলেন। অতঃপর সাফা ও মারওয়ার মধ্যে সাঈ করলেন। কিন্তু ইহরাম ভঙ্গ করলেন না।

জিলহজ মাসের ৮ তারিখে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিনায় গমন করেন এবং সেখানে ৯ই জিলহজের সকাল পর্যন্ত অবস্থান করেন। সেখানে জোহর, আসর, মাগরিব,ইশা এবং ফজর এ পাঁচ ওয়াক্তের নামাজ আদায় করেন। অতঃপর সূর্যোদয় পর্যন্ত অপেক্ষ্যা করলেন। অতঃপর আরাফার দিকে রওনা হলেন এবং সেখানে যখন পৗঁছলেন তখন ওয়াদিয়ে নামেরায় তাঁবু প্রস্তুত হয়েছিল। সেখানে তিনি অবতরণ করলেন। সূর্য যখন পশ্চিম দিকে চলে গেল তখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশে কাসওয়া নামক উটের পিঠে হাওদা চাপানো হলো। এরপর তিন বাতনে ওয়াদিতে গমন করলেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন ১ লাখ ৪০ হাজার কিংবা ১ লাখ ৪৪ হাজারের এক বিশাল জনতার ঢল। এ বিশাল জনতার উদ্দেশে তিনি প্রদান করেন ঐতিহাসিক বিদায় হজের ভাষণ।

মদিনায় প্রত্যাবর্তন

হজের সকল বিধিবিধান পালন করার পর ১৪ জিলহজ বুধবার হারামে ফজরের সালাত আদায়ের পর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবিগণকে নিয়ে মদিনা অভিমুখে রওনা হয়ে যান।

আখিরি হজের সময়কাল : ২৪ জিলকদ শনিবার বাদ জোহর মদিনা থেকে রওনা হন ও জুল-হুলাইফাতে গিয়ে কসরের সাথে আছর পড়েন এবং সেখানে রাত্রিযাপন করেন। ও জিলহজ শনিবার সন্ধ্যার প্রাকালে মক্কার নিকটবর্তী ‘জু-তুওয়া’-তে অবতরণ করেন ও সেখানে রাত্রিযাপন করেন। পরদিন ৪ জিলহজ রবিবার ৯ দিনের মাথায় মক্কায় পৌঁছেন। অতঃপর ৯ জিলহজ শুক্রবার পবিত্র হজ অনুষ্ঠিত হয়। তিনি মক্কায় মোট ১০ দিন অবস্থান করেন। ১৪ জিলহজ বুধবার ফজর সালাত শেষে মদিনার উদ্দেশে রওনা হন। অতঃপর সপ্তাহকাল সফর শেষে জুল-হুলাইফাতে পৌঁছে রাত্রিযাপন করেন ও পরদিন মদিনায় পৌঁছেন। এভাবে গড়ে ৯+১০+৯=২৭ দিন সফরে অতিবাহিত হয়।

কুরআন অবতরণের সমাপ্তি : ২২ জিলহজ থেকে ফিরে ১১ হিজরির মহররম ও সফর পুরো দুমাস রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় অবস্থান করেন। ওফাতের ৮১ দিন আগে আরাফাতের ময়দানে নাজিল হয়েছিল ইসলামের পূর্ণতার আয়াত, আইয়ামে তাশরিকের মধ্যবর্তী দিনে ১২ জিলহজে মিনায়, দুপুরে নাজিল হয় সুরা নসর। আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, এটিই ছিল কুরআনের সর্বশেষ পূর্ণাঙ্গ সুরা।

সাধারণ ভাষণ

মুসলিমদের ডাকলেন মসজিদে নববিতে। প্রচুর লোক সমাগত হলেন। উপস্থিত জনতার উদ্দেশে বললেন,

মুসলিমগণ, মারহাবা! তোমাদের প্রতি আমার অভিনন্দন। আল্লাহ তাআলা তোমাদের সবাইকে তাঁর সমূহ নিয়ামত দিয়ে ধন্য করুন। তোমাদের ব্যথা ও দৈনা মোচন করুন! সর্বতোভাবে তিনি তোমাদের সাহায্য করুন! তোমাদের রিজিক ও বরকত দান করুনা সম্মান ও মর্যাদায় তোমাদের ভূষিত করুন! তোমাদের রাখুন সুখে-শান্তিতে ও নিরাপদে এখন তোমাদের প্রতি আমার একটি মাত্র উপদেশ, আল্লাহর ভর অন্তরে পোষণ করবে, তাকওয়ার পথ অবলম্বন করবে। একমাত্র আল্লাহই এখন তোমাদের রক্ষক ও পরিচালক। তোমরা তাঁকেই ভয় করবে, এই আমার একান্ত উপদেশ। কেননা, ‘নাজিরুম মুবিন’ তথা প্রকাশ্য সতর্ককারীর ভূমিকা পালন করাই আমার দায়িত্ব। সাবধান! সাবধান! আল্লাহর রাজ্যে আর তাঁর বান্দাদের মধ্যে গর্বিত উদ্ধত হয়ে চলো না! স্মরণ রাখবে আল্লাহর হুকুম,

“এ হচ্ছে পরকালের বাসস্থান। আমার সেই সব বান্দাদের জন্যই আমি তা রেখেছি যাবা দুনিযায় অহংকারী ও কলহপ্রয়াসী না হয়। আর পরকালের সাফল্য তো কেবল মুত্তাকি পরহেজগারদেরই জন্য।”

সাবধান করে বললেন,

“মদমত্ত অহংকারীদের বাসস্থান জাহান্নাম নয় কি?”

সর্বশেষে বললেন,

সালাম ও আশীর্বাদ তোমাদের প্রতি আর আমার ওই সব অনাগত উম্মতের প্রতি যারা তোমাদের মাধ্যমে আমার আনুগত্যের বন্ধনে আবদ্ধ হবে।

রোগের নতুন মাত্রা

২৯ সফর সোমবার। জনৈক মৃতের জানাজা শেষে আল্লাহর নবি ঘরে ফিরছিলেন। পথিমধ্যে মাথাব্যথার দ্বারা রোগের সূচনা হলো। কঠিন অসুখের সময়কাল ছিল ১৩ অথবা ১৪ দিন। যার মধ্যে অধিকাংশ দিন তিনি মসজিদে এসে জামাআতে ইমামতি করেন। শেষের দিকে বৃহস্পতিবার এশা থেকে সোমবার ফজর পর্যন্ত ১৭ ওয়াজ নামাজে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু ইমামতি করেন।
হিজরী একাদশ সন। দিনটি ছিল সোমবার সূর্য অধিক গরম হওয়ার সময় অর্থাৎ ১০/১১টার সময়। তিনি সর্বোচ্চ বন্ধুর সাথে মিলিত হলেন। এ দিন তাঁর বয়স হয়েছিল চান্দ্রবর্ষ হিসাবে ৬৩ বছর চার দিন।

(মুসা আল হাফিজ রচিত ‘মহানবির জীবনপঞ্জী’ মূলত প্রিয় নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পবিত্র জীবনভিত্তিক একটি কোষগ্রন্থ। এককথায় অনন্য শ্রমনিষ্ঠ সুচয়িত সুলিখিত একটি বই। বাংলা ভাষায় সিরাতচর্চার ইতিহাসে এক ব্যতিক্রমী, অনবদ্য সংযোজন এটি। সেখান থেকে “ষাটোর্ধ্ব জীবন” সংখ্যার পাঠকদের জন্য রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ষাটোর্ধ্ব জীবনপঞ্জী সংক্ষেপ ও সম্পাদনা করে পেশ করা হল।)

সহায়ক গ্রন্থ:
মহানবির জীবনপঞ্জী, মুসা আল হাফিজ, মুহাম্মদ পাবলিকেশন, জুন ২০২২।

আগের সংবাদছাগল চুরির অভিযোগে আওয়ামী লীগ নেতা কারাগারে
পরবর্তি সংবাদমাইক্রোবাসের ১১ যাত্রী নিহত: গেটম্যানের বিরুদ্ধে মামলা