মুজিব হাসান:
পরানকথা
সময়টা তখন সংক্ষুব্ধ। খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে উত্তাল গোটা ভারতবর্ষ। ব্রিটিশ-শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্ত হওয়ার সংগ্রাম অবিরাম চলমান। সেসময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর তুরস্কের প্রতি ব্রিটিশ-নীতি একেবারেই মারমুখো হয়ে উঠেছে; সুর উঠছে খেলাফত-ব্যবস্থা ভাঙ্গন নিয়ে। মজলুম খলিফা আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে গেছেন এ নীতির শিকলে। তখন খলিফার প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি দেখিয়ে এবং খেলাফত-ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে বহির্বিশ্বের যেসকল মুসলিম দেশ ও অধিবাসীরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন ভারতবর্ষের মুসলমানরা। তারা তুর্কি জাতি-ভাইদের প্রতি ত্রাণ ও অনুদানের ঢালি পাঠিয়ে যেরকম দেখিয়েছেন মানবিক উদারতা, তেমনই ব্রিটিশ-শাসনের শৃঙ্খলে থেকেও তাদের ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কথায় ও কলমে জানিয়েছেন জোরালো প্রতিবাদ। সেসময়কার ভারতীয় পত্র-পত্রিকায় বড় বড় শিরোনামে ছাপা হতো এ আন্দোলনের খবর। কেউ ব্রিটিশ-নীতিকে সমর্থন করত, কেউবা করত কড়া সমালোচনা। এ ব্যাপারে হিন্দু সম্প্রদায়ের রক্ষণশীল লেখকগোষ্ঠী ছিল একচোখা মনোভাবাপন্ন। অন্যদিকে মুসলমান লেখক-সাংবাদিকরা অসীম সৎসাহসিকতার সঙ্গে এর বিরুদ্ধে জোর কলম চালাতেন। ‘সাপ্তাহিক মোহাম্মদী’ ছিল সেরকমই একটি পত্রিকা। এর সম্পাদক ছিলেন একজন নির্ভীক ও স্বাধীনচেতা সাংবাদিক। তিনি এ অনৈতিক নীতির বিরুদ্ধে বেপরোয়া হয়ে ব্রিটিশ-সরকারকে ‘আক্রমণ’ শুরু করলেন। যেকারণে বুদ্ধিজীবী হিন্দুরা কৌতুক করে তাঁকে ডাকতে লাগল ‘আক্রমণ খাঁ’ বলে।
সম্পাদক সাহেবের এ ব্যাপারটা ব্রিটিশ-সরকারের কানে গেল। তখন ইংরেজ লাট সাহেবের নির্দেশ অনুযায়ী একটি এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল বা শাসন-পরিষদ এ দেশ শাসন করত। এ পরিষদের একজন সদস্য ছিলেন জনৈক নবাব উপাধিধারী বাঙালি মুসলিম। তিনি থাকতেন রাইটার্স বিল্ডিংয়ে বেঙ্গল গভর্নমেন্টের সেক্রেটারিয়েট ভবনে। লাট সাহেবের নির্দেশ পেয়ে সম্পাদক সাহেবকে সেখানে ডেকে পাঠালেন। মোহাম্মদী নামক পত্রিকার সম্পাদক হওয়ায় তিনি তাঁকে মনে করতেন আহলে হাদিসের অনুসারী। জমহুর মুসলমান তথা আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের ইবাদত-পদ্ধতি ও মাজহাব বিষয়ক ব্যাপারে তাদের মতভেদ সম্পর্কে নবাব সাহেব জ্ঞাত ছিলেন। তুরস্কের খলিফা ছিলেন আহলে সুন্নতের নেতা, এ হিসেবে আহলে হাদিসরা তাঁকে নাও মানতে পারেন। এটাকে তিনি ধরে নিলেন সম্পাদক সাহেবকে ঘায়েল করার মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে।
যথাসময়ে সম্পাদক সাহেব এসে হাজির হলেন বেঙ্গল গভর্নমেন্টের সেক্রেটারিয়েট ভবনে। নবাব সাহেব তাঁকে যত্নআত্তি করে বসালেন। মোহাম্মদী পত্রিকায় খলিফার পক্ষ হয়ে ব্রিটিশ-নীতির বিরুদ্ধে তিনি যেভাবে কলম চালনা করছেন, সেটার অযৌক্তিকতা দেখাতে গিয়ে বললেন, ‘মাওলানা সাহেব, আপনি যেভাবে খলিফার পক্ষ হয়ে লেখালেখি করছেন, ভেবে দেখুন তো তিনি আপনার মতাদর্শের লোক কি-না? আমার তো মনে হয়, আপনি নিজস্ব মতাদর্শের বাইরে গিয়ে একজন ভিন্ন মতাবলম্বী নেতার প্রতি মায়াকান্না দেখাচ্ছেন। ব্যাপারটা আদৌ অযৌক্তিক নয়-কি? তাছাড়া এমনটা করতে গিয়ে আপনি মাননীয় গভর্নরের বিরুদ্ধাচারণ করছেন, এটাও অনৈতিক।’
নবাব সাহেবের কথা শুনে সম্পাদক সাহেব মুচকি হাসলেন। ভাবগাম্ভীর্যতা বজায় রেখে সুচিন্তক উত্তর দিলেন, ‘জনাব, আপনি বলছেন মতাদর্শের কথা। মত যা-ই থাক, আমাদের পথ তো এক। আমাকে আহলে হাদিসের অনুসারী মনে করার আগে আপনার উচিত, আমি একজন মুসলিম, এ পরিচয় মনে রাখা। তেমনই তুরস্কের খলিফাও আহলে সুন্নতের নেতা হওয়ার আগে একজন সাচ্চা মুসলিম। আর আপনি যে গভর্নরের কথা বলছেন, তিনি তো আমাদের মতের বাইরে হওয়ার সাথে সাথে পথেরও বাইরে। তাকে সমর্থন করাটা কোনো দাবির মধ্যেই পড়ে না।’
সম্পাদক সাহেবের কাটকাট উত্তরে নবাব সাহেব কেমন চুপসে গেলেন। একটু নড়েচড়ে বসে দ্বিতীয় অস্ত্র হিসেবে তাঁর সামনে মেলে ধরলেন একটি লোভনীয় প্রস্তাবের ফাঁদ, ‘দেখুন মাওলানা সাহেব, আপনার কথাটি যদিও বিবেচনাযোগ্য, তারপরও আপনি যে জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, সেটিকে তো আগে ধরে রাখতে হবে! বলছিলাম আপনার সাপ্তাহিক মোহাম্মদী পত্রিকার কথা। আপনি যদি মাননীয় গভর্নরের নীতির পক্ষে কলম চালনা করেন, তাহলে তিনি আপনার পত্রিকাকে সাপ্তাহিক থেকে দৈনিকে বের করার সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতা এবং অর্থকড়ির জোগান দিতে প্রস্তুত। ভেবে দেখুন মাওলানা সাহেব, আমার প্রস্তাবটা কেমন লাগছে!’
নবাব সাহেবের এ কথায় সম্পাদক সাহেব গম্ভীর হয়ে গেলেন। নানাদিক থেকে ভাবনারা তাঁকে ঘিরে ধরল। তখন তাঁর অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। টাকা-পয়সার অভাবে সাপ্তাহিক মোহাম্মদী নিয়মিত প্রকাশে বাধা পড়ে যাচ্ছে। এর ওপরে দেখা দিয়েছে সাংসারিক টানাপোড়েন। মাঝেমধ্যে ঘরোয়া বাজার-সদাইও আটকা পড়ে যাচ্ছে। এমন সংকটাপন্ন অবস্থায় নবাব সাহেবের প্রস্তাবটা তাঁর কাছে মনঃপূত হওয়ার মতো ছিল। কিন্তু সম্পাদক সাহেব যে জীবনাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন, ব্রিটিশ-দ্রোহী বংশের রক্তে এর সমর্থন মিলেছিল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন নবাব সাহেবের প্রলোভন-কৌশল। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে তেজোদ্দীপ্ত গলায় বললেন, ‘দেখুন জনাব, খলিফার বিরুদ্ধে চিন্তা করার আগেই যেন আমার মস্তিষ্ক বিকল হয়ে যায়। তাঁর বিরুদ্ধে কলম ধরার পূর্বেই যেন আমার হাত অবশ হয়ে পড়ে। তাঁর অনিষ্ট সাধনের চেষ্টার আগেই যেন আমার নশ্বর-দেহের অবসান ঘটে। মহামহিম আল্লাহর দরবারে এটাই আমার অন্তরের প্রার্থনা।’
সম্পাদক সাহেবের এমন নির্ভয় নিঃসংকোচ উত্তরে নবাব সাহেব খুব ক্ষিপ্ত হলেন। তাঁর দিকে রোষ কষায়িত চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনি জানেন, আপনি কার সাথে কথা বলছেন? আমি বেঙ্গল গভর্নমেন্টের একজন এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল। ইচ্ছে করলে আমি এখানেই আপনাকে বন্দুকের গুলিতে হত্যা করার আদেশ দিতে পারি!’
সম্পাদক সাহেব মোটেও বিচলিত হলেন না। ভাবগাম্ভীর্যতা বজায় রেখে অকম্পিত কণ্ঠে বললেন, ‘দেখুন জনাব, আমি জীবনে বহুবার শিকার করেছি। বন্দুকের গুলিতে অনেক পাখি মেরেছি। আমার প্রতি গুলি নিক্ষিপ্ত হলে মারা যেতে পারি, এ কথা আমি ভালোভাবেই জানি। কিন্তু আপনি নিশ্চয় জানবেন, আমাকে বন্দুকের গুলিতে নিহত করা হলে আমার দেহ থেকে যত ফোঁটা রক্ত ঝরবে, বাংলার বুকে ততজন আকরম খাঁ পুনরায় জন্মাবে!’
হ্যাঁ, সেই অকুতোভয় সম্পাদকের নামই মাওলানা আকরম খাঁ। যাঁর অনন্য অভিধা : মুসলিম বাংলার সাংবাদিকতার জনক। বাঙালি মুসলমানদের সামাজিক, রাজনৈতিক, দীনি ও তমদ্দুনিক এক অধঃপতনের যুগে যিনি আবির্ভূত হয়েছেন যুগের দিশারি, কালের নকিব এবং সময়ের বাতিঘর হিসেবে; যাঁর জীবন ও সাধনা ছিল এ উপমহাদেশের লাঞ্ছিত, অপমানিত ও ভাগ্যহত মুসলমানদের সামগ্রিক কল্যাণে নিবেদিত। তাঁর মতো এমন আদর্শবাদী, সংগ্রামী ও সাহসী সাংবাদিক সহস্রাব্দে একজনই জন্মান।
বাংলার কৃতী পুরুষ, সফল রাজনীতিবিদ, সুসাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদ তাঁকে নিয়ে যথার্থই অভিব্যক্তি জানিয়েছেন, ‘মাওলানা আকরম খাঁ একটি ব্যক্তিমাত্র ছিলেন না; অন্যান্য অনেক নেতার মতো শুধুমাত্র একটি প্রতিষ্ঠানও ছিলেন না। তিনি ছিলেন একটা যুগের প্রতিনিধি, যুগের প্রতীক। স্বয়ং একটা যুগ। বাহির হইতে তাঁর ব্যক্তিত্বের বিরাটত্ব, তাঁর সাফল্যের বিপুলতা, তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক জীবনের বিস্তৃতি দেখিলে বলিতেই হইবে, তিনি ছিলেন একটা প্রতিষ্ঠান। মাওলানা সাহেবের বিরাট ব্যক্তিত্বরূপী সে প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, চিন্তানায়ক ও সমাজ সংস্কারকের শ্রেষ্ঠ মহৎ গুণাবলির সমাবেশ ঘটিয়াছিল অপূর্ব সামঞ্জস্যে। তিনি ছিলেন একাধারে সবই। সকল অমৃতফলের তিনি ছিলেন কল্পতরু।’
শতাব্দীর মহিরুহ, সকল অমৃতফলের কল্পতরু মাওলানা আকরম খাঁ-এর মুসলিম সাংবাদিকতার জনক হওয়ার গল্পটি এবার আমরা ধাপে ধাপে শুনব।
বিন্দু থেকে শুরু
মাওলানা আকরম খাঁ-এর কর্মজীবন শুরুর সময়টা ছিল অত্যন্ত ঘটনাবহুল। সেটা ছিল উনিশ শতকের শেষ এবং বিশ শতকের প্রারম্ভকাল। উপমহাদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, দীনি ও তমদ্দুনিক প্রতিটি প্রেক্ষাপট ঘটনার বর্ণিলতায় ভরপুর। তখন ব্রিটিশ-শাসন মজবুত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। প্রতিনিয়ত তাদের জিঘাংসার শিকার হচ্ছে মুসলমানরা। সিপাহি বিপ্লবোত্তর পঞ্চাশ বছরের একটানা নির্যাতনে মুসলিম সমাজ অর্থ-বিত্ত, বিদ্যাবুদ্ধি প্রায় সবকিছু হারাতে বসেছে। বিপ্লবোত্তর গণহত্যার কারণে তারা পরিণত হয়েছে সংখ্যালঘুতে। মাওলানা আকরম খাঁ-এর কর্মস্থল কোলকাতায় মুসলিম জনসংখ্যা নগণ্য। আর্থিক দিক দিয়ে তারা নিম্নবিত্ত শ্রেণির অন্তর্গত, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগও কম। অন্যদিকে সরকারি স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত সবখানে হিন্দুদের একচ্ছত্র আধিপত্য। বাংলার মুসলমানরা চাষাভুষা, শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। নিজেদের উন্নতির দিকে ভালোভাবে দৃষ্টি না দিয়ে তারা ধর্মের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে তর্ক-বিতর্কে মেতে উঠেছে। রাজনীতিতে চলছে কংগ্রেসের জয়জয়কার। মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠালাভ করলেও জাতীয় পর্যায়ে ভূমিকা রাখার মতো সাংগঠনিক শক্তি অর্জনের সক্ষমতা পাচ্ছে না। সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনে সমগ্র বাংলা তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিভায় ভাস্বর। মুসলিম বাংলার সাহিত্য বলতে আছে গুটিকয়েক পুঁথিপুস্তক। এ ছাড়া অন্যকিছু মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছে না। তথাকথিত শরিফ, বিত্তশালী মুসলমানরা বাংলাভাষা চর্চাকে মনে করছে শরাফতির অন্তরায়। আলেমগণ ফার্সি ও উর্দু চর্চার মাধ্যমে জনগণকে ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবার প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
জাতির এ দৈন্যদশা প্রথম থেকেই ভাবিয়ে তুলল মাওলানা আকরম খাঁকে। তিনি বুঝতে পারলেন, মুসলমানদের প্রতিষ্ঠিত করতে হলে সবার আগে তাদের ঘুমন্ত চেতনাকে জাগিয়ে তুলতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন পরিকল্পিত বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। সেটি হলো, নিজস্ব তাহজিব-তমদ্দুন তুলে ধরে জাতির বোধকে নাড়িয়ে দেওয়া এবং বিজাতীয় অনুকরণ ও সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসনকে রুখে দিতে শক্ত অবস্থান নেওয়া; আর এর একমাত্র মাধ্যম সংবাদপত্র প্রকাশ ও নির্ভীক সাংবাদিকতা। তিনি অনুভব করলেন, সংবাদপত্র না থাকলে মুসলিম সমাজের উন্নতি তরান্বিত হবে না। কারণ, হিন্দু সম্প্রদায়ের তুলনায় মুসলমানরা অনুন্নত। দরিদ্র মুসলিম সমাজের অভাব-অভিযোগ তুলে ধরা, তাদের মধ্যে শিক্ষা-দীক্ষা প্রসার এবং অন্ধ অনুকরণ ও কুসংস্কার দূর করার জন্য চাই হিন্দু সম্প্রদায়ের মতো শক্তিশালী সংবাদপত্র। এটিই তাদের উন্নতির অন্যতম মাধ্যম। এ বোধ থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি মাঠে নামার প্রস্তুতি নিলেন।
শিক্ষাজীবন শেষ করার পর তাঁর প্রয়োজন ছিল একটি চাকরি। জীবনের উন্নতির পথ বেছে নেওয়াই ছিল প্রয়োজন। কিন্তু অর্থনৈতিক পথ অন্বেষণ না করে তিনি দুর্দশাগ্রস্ত জাতির উন্নতি-অগ্রগতির জন্য চিন্তা করতে লাগলেন–কীভাবে সংবাদপত্র প্রকাশ করবেন! এর জন্য কোলকাতা থেকে নিজ গ্রাম হাকিমপুরে চলে এলেন। দিনমান একলা মনে ভাবেন, কিন্তু কোনো উপায় উদ্ভাবন করতে পারছেন না। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের কাছে মনের ভাব প্রকাশ করলেন, সবাই তাঁকে নিদারুণ নিরুৎসাহিত করল। অর্থকড়ি দিয়ে সহায়তা দূরের কথা, অনেকেই উপহাস করে উড়িয়ে দিল তাঁর প্রস্তাব। কারণ, তখনকার পত্রিকা প্রকাশনাগুলো ছিল একচেটিয়া হিন্দুদের দখলে। তাদের পরিচালনায় প্রকাশিত হতো উল্লেখযোগ্য পত্রিকাদি। মুসলামানদের প্রকাশিত পত্রিকার সংখ্যা ছিল নিতান্ত হাতেগোনা। এগুলো চলত জীবন্মৃত হয়ে এবং অর্থসংস্থানের অভাবে বন্ধও হয়ে যেত একসময়। এ অবস্থায় তরুণ আকরম খাঁ চরম আর্থিক দুরাবস্থার মধ্যেও পত্রিকা বের করবেন, এটা ছিল অবিশ্বাস্য। কিন্তু জাতীয় চেতনায় উদ্বেলিত, জিহাদি প্রেরণায় উজ্জীবিত-প্রাণ মাওলানা আকরম খাঁ দমে যাওয়ার লোক ছিলেন না। তিনি তাঁর জনৈকা খালার কাছ থেকে এক টাকা চেয়ে নিলেন আর নিজের কাছে ছিল তেরো পয়সা। এ এক টাকা তেরো পয়সা নিয়ে অসীম সাহসে বুক বেঁধে একাই রওনা হলেন কোলকাতার উদ্দেশ্যে।
সেসময় বাংলাভাষায় যেসব সংবাদপত্র বের হতো, এগুলোর মধ্যে হিতবাদী ও বঙ্গবাসী ছিল প্রধান। মাওলানা আকরম খাঁ খুব মনোযোগ দিয়ে এসব সংবাদপত্র পাঠ করতেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রকাশনা থেকে পরিচালিত হতো পত্রিকাগুলো। ইসলাম ধর্ম এবং মুসলিম সমাজকে নিয়ে নানারকম ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ ও অপমানাত্মক প্রবন্ধাদিতে ভরপুর থাকত এগুলোর কলেবর। এসব পাঠ করে তিনি নিদারুণ ব্যথিত হতেন। তখনই তাঁর মনে সেই পরিকল্পনাটি উদ্দীপ্ত হয়ে উঠল, ইসলামকে নিয়ে এমন বিদ্রুপাত্মক লেখালেখির প্রতিবাদ প্রকাশ এবং মুসলমানদের দুঃখ-দুর্দশা ও অভাব-অভিযোগগুলো তুলে ধরার জন্য একটি জাতীয় সংবাদপত্রের প্রতিষ্ঠা তিনি করবেনই। সাম্রাজ্যবাদের জুলুম ও জবরদখল এবং হিন্দুত্ববাদের অবহেলা ও অগ্রাসনের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিভাত হবেন যুগের ধূমকেতু হয়ে। তাঁর কলম থেকে ছুটবে রেনেসাঁর আবেহায়াত এবং ইনকিলাবের নহর। সেদিনটি খুব কাছেই।
হঠাৎ আলোর ঝলকানি
মাওলানা আকরম খাঁ বাঙালি মুসলমানদের সামাজিক, রাজনৈতিক, দীনি ও তমদ্দুনিক পশ্চাৎপদতা দূর করার জন্য সাংবাদিকতাকেই উপযুক্ত মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করলেন। অসীম সাহসে বুক বেঁধে এ দুর্গম পথ পাড়ি দিতে তিনি রওনা হলেন একাই। পথচলার সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে করে যেতে হলো পথনির্মাণ। যে পথে তাঁর পদরেখা ধরে এগিয়ে আসবে অনেক কাফেলা এবং তিনি বরিত হবেন মুসলিম বাংলার সাংবাদিকতার জনক হিসেবে।
তাঁর সাংবাদিকতা শুরু হলো ‘আহলে হাদীস’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সঙ্গে। এটি ছিল ধর্ম বিষয়ক মাসিক পত্রিকা, পরে সাপ্তাহিকে পরিণত হয়। আঞ্জুমানে আহলে হাদীস-এর মুখপত্র হিসেবে কোলকাতা থেকে প্রকাশিত হতো। কিছুদিন দায়িত্ব পালন করে তিনি এ পত্রিকা ছেড়ে দিলেন। তখন তাঁর মনে ঘুরপাক খেতে থাকল নিজস্ব সংবাদপত্র প্রকাশের পরিকল্পনাটি। এ সময়ই তাঁর সাক্ষাৎ হলো মৌলভি কাজী আবদুল খালেকের সঙ্গে। তিনি চব্বিশ পরগণা জেলার উত্তর শিয়ালদহ পল্লি থেকে ‘মোহাম্মদী আখবার’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন। এটি ছিল বাংলা-উর্দু দ্বিভাষিক পত্রিকা। প্রথমে অর্ধ সাপ্তাহিক, পরে সাপ্তাহিক হিসেবে বের হয়েছিল। মাওলানা আকরম খাঁ এ পত্রিকায় যোগদান করলেন। এর একই পাতায় বাংলা ও উর্দু ভাষায় কলাম থাকত। তিনি এ পত্রিকায় বিভিন্ন প্রবন্ধ ও খবর বাংলা থেকে উর্দু এবং উর্দু থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন। এ পত্রিকায় তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন সহাকারী সম্পাদক হিসেবে।
মাওলানা আকরম খাঁ মাদ্রাসায়ে আলীয়ার ছাত্রাবস্থায় মোহাম্মদী আখবার-এ খৃস্টান মিশনারিদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রবন্ধ লেখতেন। এরপর যখন এ পত্রিকায় কাজ করার সুযোগ হলো, তখন তাঁর পরিকল্পনা ও ধ্যান-ধারণা অনুযায়ী এবং স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের প্রয়োজনে একটি পত্রিকা প্রকাশের কথা গভীরভাবে ভাবতে লাগলেন। কিন্তু তখনও অর্থাভাবের কারণে সাধ্য ছিল তাঁর প্রতিকূলে। ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ একটি পত্রিকা প্রকাশের খরচ বহন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না।
এমন সময় হঠাৎ তাঁর সামনে ভেসে উঠল এক ঝলক আশার আলো। কাজী সাহেব তাঁকে অত্যধিক স্নেহ করতেন। তিনি মাওলানার পত্রিকা প্রকাশের অদম্য আগ্রহের কথা জানতে পারলেন। সেসময় তাঁর মোহাম্মদী আখবারও অর্থাভাবের মধ্যে পড়ে গেছে। তিনি তাঁর হাতে ধরিয়ে দিলেন মোহাম্মদী আখবার-এর ফাইলটা। উৎসাহ দিলেন একে মোহাম্মদী নামে প্রকাশ করতে। পত্রিকা প্রকাশের এরকম একটি পাকাপোক্ত অবকাঠামো পেয়ে মাওলানা অত্যন্ত উৎফুল্ল হলেন। কিন্তু তখনও তাঁর অর্থকড়ির কোনো ব্যবস্থা হয়নি। হাতে আছে সেই এক টাকা তেরো পয়সা। এ অবস্থায় জনৈক ব্যবসায়ী ভদ্রলোক একটি বাংলা ফারায়েজ (উত্তরাধিকার সম্পত্তির ভাগ-তালিকা) তৈরি করার জন্য তাঁকে ৫০ টাকা দিলেন। টাকাটা পেয়ে তিনি যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন। এর পুরোটা দিয়ে করে বসলেন পত্রিকা প্রকাশের যাবতীয় ব্যবস্থা। কোলকাতার একটি প্রেস থেকে ধুমধামের সঙ্গে বের করলেন মোহাম্মদী-র ১ম সংখ্যাটি।
স্বপ্নসাধের পত্রিকার ১ম সংখ্যাটি বের করতে পেরে তিনি যারপরনাই আনন্দিত হলেন। প্রফুল্লচিত্তে উদ্যোগ গ্রহণ করলেন এর ২য় সংখ্যা বের করবেন। কিন্তু প্রেসের মালিক গাফিলতি করায় ২য় সংখ্যা প্রকাশে দেরি হতে লাগল। হতোদ্যম ও নিরুপায় হয়ে তিনি বসুমতী প্রেসের মালিকের নিকট গিয়ে মোহাম্মদী প্রকাশের অনুরোধ জানালেন। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় নামের একজন হিন্দু ভদ্রলোক। বসুমতী প্রেস-কর্তৃপক্ষ প্রথমে সম্মতি দিলেও পরে অজ্ঞাত কারণে তাদের প্রেস থেকে পত্রিকাটি ছাপানোর সুযোগ দেয়নি। সময়মতো পত্রিকা প্রকাশ করতে না পেরে মাওলানা আকরম খাঁ মনের দুঃখে নিজ গ্রামে ফিরে এলেন।
হাজী আবদুল্লাহ নামের এক প্রখ্যাত ও উদার ব্যবসায়ী ছিলেন মাওলানা আকরম খাঁ-এর পিতা মাওলানা আবদুল বারী খাঁ সাহেবের বন্ধু। তিনি ছিলেন ধার্মিক, দাতা, সমাজহিতৈষী ও সাহিত্যরসিক। তাঁর দেশের বাড়ি কুষ্টিয়ায় আর কোলকাতার তাঁতী বাগানে ছিল তেলের ব্যবসা। সেখানকার বেনিয়াপুকুর লেনে আলতাফী প্রেস নামে তাঁর নিজস্ব মালিকানায় একটি প্রেস ছিল। তিনি দীর্ঘদিন ধরে চিন্তা করছিলেন একটি মাসিক পত্রিকা বের করবেন, কিন্তু লোকবল না পেয়ে পত্রিকা পরিচালনার জন্য উপযুক্ত সম্পাদকের অপেক্ষা করছিলেন। এ অবস্থায় মাওলানা আকরম খাঁ-এর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হলো। তিনি মাওলানাকে এ পত্রিকা সম্পাদনার ভার গ্রহণ করতে অনুরোধ জানালেন।
মাওলানা আকরম খাঁ এ আরাধ্য সুযোগ পেয়ে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। হাজী সাহেবের অনুরোধ তিনি গ্রহণ করলেন খুশিমনে। ১৯০৩ সালের ১৮ই আগস্ট আলতাফী প্রেস থেকে শুরু হলো মাসিক মোহাম্মদী-র প্রকাশ। হাজী সাহেব ছিলেন এ পত্রিকার ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তিনি সম্পাদক হিসেবে মাওলানার বেতন ধার্য করলেন ১৫ টাকা। সহকারী সম্পাদক হিসেবে নিয়োজিত হলেন হাবিবুর রহমান সাহিত্যরত্ন। এ পত্রিকায় ধর্ম নিয়ে তর্ক-বিতর্ক বিষয়ক লেখাদি স্থান পেতে লাগল। প্রথম ৫টি সংখ্যা মাসিক, এরপর কয়েক বছর ধরে পত্রিকাটি প্রকাশিত হলো পাক্ষিক হিসেবে। ১৯০৭ মতান্তরে ১৯০৮ সাল থেকে সাপ্তাহিক হিসেবে প্রকাশিত হতে লাগল। মাঝেমধ্যে পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেলেও আবার চালু হতো। তখন ছিল পত্রিকাটির শিশুকাল। হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়ে যাচ্ছে। মাওলানা আকরম খাঁ মনপ্রাণ উজাড় করে যেতে লাগলেন এর পরিচর্যা। হাজী সাহেবও মোহাম্মদী পরিচালনায় যথেষ্ট লোকসান দিলেন।
হাজী আবদুল্লাহ সাহেব ছিলেন নিরীহ প্রকৃতির লোক। একবার একটি লেখা প্রকাশের জন্য প্রেসে পুলিশ এলো। তিনি খুব বিব্রতবোধ করলেন। এর জের ধরে পত্রিকা বন্ধ করে দিতে চাইলেন। কিন্তু মাওলানা আকরম খাঁ-এর কর্মোদ্দমতা তাঁকে দারুণ অভিভূত করল। তা দেখে ১৯১০ সালে পত্রিকার স্বত্ব তিনি মাওলানাকে প্রদান করে দিলেন। সেই সঙ্গে বন্ধুর ছেলে হিসেবে স্নেহের নিদর্শনস্বরূপ তাঁকে দিয়ে দিলেন আলতাফী প্রেসটিও। এখান থেকেই শুরু হলো মাওলানার সাংবাদিক-জীবনের মহাঅধ্যায়।
দীপে দীপে আলোর মিছিল
মাওলানা আকরম খাঁ যখন মুসলিম সাংবাদিকতা শুরু করেছেন, তখন এ ময়দান একেবারেই অকর্ষিত ও অন্ধকার। বাঙালি মুসলিম সমাজ আটকে পড়েছে সাংস্কৃতিক বিপর্যয়ের ঘেরাটোপে। তাদের অধিকারের কথা বলার মতো জোরালো কণ্ঠস্বর নেই; নেই দুঃখ-দুর্দশার চিত্র তুলে ধরার মতো শক্তিশালী গণমাধ্যম। সবকিছুই একচেটিয়া হিন্দু সম্প্রদায়ের দখলে। তারা ময়দান খালি পেয়ে নিজেদের অধিপত্য বিস্তার করে চলেছে। কলমের খোঁচায় রক্তাক্ত করছে ইসলাম ও মুসলমানদের। এরকম এক বিপর্যস্ত সময়ে তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন বিরুদ্ধ স্রোতের বিপরীতে। সেই অকর্ষিত ও অন্ধকার ময়দানে লাঙলের দৃপ্ত ফলা ধরলেন। একটা দশক পর্যন্ত নিজেকে ব্যাপৃত রাখলেন সাংবাদিকতার চর্চায়। তারপর উঠে দাঁড়ালেন আবাদি জমিতে, আলোর মশাল হাতে। একটার পর একটা গাছ লাগিয়ে পথে পথে দীপ জ্বেলে গেলেন। বাঙালি মুসলিম সমাজ তাঁর ছায়ায় খুঁজে পেল আশ্রয়, তাঁর আলোয় পেল পথের দিশা। তিনি হয়ে উঠলেন শতাব্দীর মহিরুহ, মহাকালের বাতিওয়ালা। মাওলানার হাত দিয়ে জ্বলে ওঠা সেই দীপসদৃশ সংবাপত্রগুলোর ধারাবর্ণনা এখানে পেশ করছি :
সাপ্তাহিক মোহাম্মদী
মাওলানা আকরম খাঁ-এর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন, বাঙালি মুসলমানদের মুখপত্র সাপ্তাহিক মোহাম্মদী সম্পূর্ণ নিজের অধীনে, স্বাধীন মতপ্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ১৯১০ সাল থেকে শুরু করল দ্বিতীয় পর্যায়ের যাত্রা। স্বাধীনভাবে বাংলার মুসলিম সাংবাদিকতায় মাওলানার আত্মপ্রকাশ তখন থেকেই। মুসলমানদের সামাজিক, রাজনৈতিক, দীনি ও তমদ্দুনিক সচেতনতার বাহন হিসেবে পত্রিকাটি সুধী সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ভারতীয় মুসলিম জনসাধারণের মধ্যে ঘটল বিরাট বিপ্লবী চেতনার উন্মেষ। অল্পসময়ের মধ্যে এ পত্রিকা বাংলা, আসাম, বার্মার বাংলাভাষী মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠল। দুর্বার গতিতে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল এর খবর। হতাশাগ্রস্ত মুসলিম সমাজে নতুন আশার সঞ্চার হলো। ব্রিটিশ শাসকদের বৈরী দৃষ্টি, অর্থসংকট, বহুবিধ বাধা-বিপত্তির মধ্য দিয়ে মাওলানা আকরম খাঁ এ পত্রিকায় মুসলমানদের জাগরণমূলক প্রবন্ধ, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত রচনা এবং মুসলিম বিশ্বের খবরাখবর প্রকাশ করতে থাকলেন। এ পত্রিকার মাধ্যমেই বাংলাভাষী মুসলিম জনগণ নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো তখনকার ব্রিটিশ শাসকবর্গ এবং বিশ্ব দরবারে তুলে ধরতে সক্ষম হলেন। এভাবে একটি জাতি বুকে পেল আশা, মুখে পেল ভাষা।
সাপ্তাহিক মোহাম্মদীকে কেন্দ্র করে একদল মুসলমান লেখক-সাংবাদিক বাংলায় একটা সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুললেন। মুসলমানদের ধর্ম ও ঐতিহ্যকে প্রাধান্য দেওয়াই ছিল এ আন্দোলনের প্রধান বৈশিষ্ট্য। মূলত সাপ্তাহিক মোহাম্মদী ছিল তখনকার মুসলিম সমাজের ধ্যান-ধারণা ও সুখ-দঃখের বহিঃপ্রকাশ। মুসলমানদের জাতীয় মুখপত্র হিসেবেও পত্রিকাটি অল্পদিনের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠল। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ক্রমাগত বাড়তে লাগল এর গ্রাহক সংখ্যা। গ্রাহকদের পক্ষ থেকে প্রায়ই অভিযোগ আসত, তারা টাকা দিয়েও সময়মতো পত্রিকা পাচ্ছেন না। এ ব্যাপারে মাওলানা সাহেব তদন্ত করে দেখতে পেলেন, হিন্দু পিয়নরা মুসলমানদের বাড়িতে গিয়ে পত্রিকা বিলি করতে অনাগ্রহী, এ কারণে গ্রাহকদের পত্রিকা পেতে অসুবিধা হচ্ছে। হিন্দু পিয়নদের অভিযোগ : মুসলমানরা যা-তা খায়। তাদের বাড়িতে মোরগের পালক থেকে শুরু করে গরুর হাড় পর্যন্ত পড়ে থাকে। হিন্দুদের সেখানে গেলে জাতভ্রষ্ট হতে হয়। এ ব্যাপারে পোস্টাল কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে একটা স্থায়ী সমাধান হলো। তখন পোস্টাল কর্তৃপক্ষ ছিলেন একজন ইউরোপীয়ান।
তখনকার পরিস্থিতি এত উন্নত ছিল না। মুসলমান ও হিন্দু সম্প্রদায় সামান্য তুচ্ছ ব্যাপার নিয়েও একে অপরের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করত। হিন্দুদের গরু-কুরবানি বন্ধ আন্দোলন, মুসলমানদের মসজিদের সামনে বাদ্য বাজানোর নিষেধাজ্ঞা এবং হকি খেলা নিয়ে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের জের ধরে পরিবেশ হয়ে উঠত অশান্তিকর। মুসলিম স্বার্থ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে তখন একটি সাপ্তাহিক কাগজ যে কত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, তা আজকের পরিস্থিতিতে বুঝা দুষ্কর। সেসময় বাংলার বিশাল মুসলিম সমাজের মধ্যে মুন্সী আবদুর রহীম সম্পাদিত মোসলেম হিতৈষী ও মিহির ছিল একমাত্র সংবাদপত্র। হিন্দু সম্প্রদায়-কর্তৃক প্রকাশিত বহু সংখ্যক সংবাদপত্রের তুলনায় এগুলো ছিল খুবই নগণ্য। গ্রাহক সংখ্যাও ছিল অত্যন্ত সীমিত। অন্যদিকে আনন্দবাজার পত্রিকা, বসুমতী, প্রবাসী প্রভৃতির কোনো কোনো ভূমিকা, মতামত এমনকি ভাষাও মুসলমানরা পছন্দ করতে পারেনি। রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, নানাবিধ প্রশ্নে হিন্দু-মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল পৃথক পৃথক। হিন্দু সম্প্রদায়-কর্তৃক পরিচালিত এ পত্রিকাগুলোর বিভিন্ন বক্তব্যের জবাব দেওয়ার দায়িত্ব পালন করে যেত সাপ্তাহিক মোহাম্মদী। কারণ, তখন মুসলিম জনগণ ছিল অবহেলিত। তাদের মত ও মানস প্রকাশের ক্ষেত্র ছিল সীমাবদ্ধ। সেসময় বাংলার মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণ এবং অধিকারের কথা বলার মতো একমাত্র সংবাদপত্র ছিল এ পত্রিকা।
১৯০৩ থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত সময়টা ছিল সাপ্তাহিক মোহাম্মদী-র শৈশবকাল। সেসময় বিশ্ব রাজনীতিতে প্রচণ্ড আলোড়নের সূচনা হলো। এর উদ্দেশ্য ছিল, তুরস্ক থেকে ইসলামি খেলাফতকে বিলুপ্ত করে মুসলিম জাতিকে অধঃপতিত করে দেওয়া। সেই লক্ষ্যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে মিলে পাশ্চাত্যবাদীরা ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা ও কর্মসূচি নিয়ে এগুচ্ছিল। তখন তাদের এ ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ঘোর বিরোধিতা করে জেগে উঠলেন ভারতবর্ষের মুসলমানরা। কথায় ও কলমে শুরু করলেন জোরালো প্রতিবাদ। ১৯১১ সালে মাওলানা মোহাম্মদ আলী জওহর প্রতিষ্ঠা করলেন সাপ্তাহিক কমরেড, ইংরেজি শিক্ষিতদের মুখপত্র হিসেবে। ১৯১২ সালে মাওলানা আবুল কালাম আজাদ প্রতিষ্ঠা করলেন সাপ্তাহিক আল-হেলাল, উর্দুভাষীদের মুখপত্র হিসেবে। মাওলানা আকরম খাঁ-এর পরিচালিত সাপ্তাহিক মোহাম্মদী হয়ে উঠল বাংলাভাষী মুসলমানদের মুখপত্র। এ সময়ই এ পত্রিকা শৈশব, কৈশোর পেরিয়ে পৌঁছে গেল যৌবনে। মাওলানা মোহাম্মদ আলী জওহর এবং মাওলানা আবুল কালাম আজাদ তাঁদের পত্রিকার মাধ্যমে সাপ্তাহিক মোহাম্মদী-র প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন করলেন। এ দুটি পত্রিকার সহযোগিতা পেয়ে মাওলানা দ্বিগুণ উৎসাহে পত্রিকার মান বৃদ্ধির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা শুরু করলেন। অল্পদিনের মধ্যেই পত্রিকাটি প্রসিদ্ধি অর্জন করল প্রথম শ্রেণির সাহিত্য ও ইসলাম বিষয়ক সাময়িকী হিসেবে। একে কেন্দ্র করে আরম্ভ হলো মুসলিম সমাজের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রা। তরুণ সমাজ পেল সোনালি স্বপ্নের সন্ধান।
সাপ্তাহিক মোহাম্মদী প্রকাশের পর থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত নিঃসঙ্গ যাত্রীরূপে পথ চলেছে। এ পথচলাটিও নিষ্কণ্টক ছিল না। যাত্রাপথে নানা ধরনের বাধা এসেছে। তখনকার প্রেক্ষাপটে সংবাদপত্র প্রকাশ ও পরিচালনা ছিল খুবই দুরূহ ব্যাপার। অনেকেই এ কাজ শুরু করলেও ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারেননি। কিন্তু মাওলানা আকরম খাঁ সাপ্তাহিক মোহাম্মদী নিয়মিত প্রকাশ করে গেছেন, এটা খুবই বিস্ময়কর। এটা করতে গিয়ে তাঁকে অনেক রূঢ় বাস্তবতা এবং কঠিন চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হয়েছে। একদিকে ব্রিটিশ শাসকদের অনুদার মনোভাব, অন্যদিকে মুসলমানদের পত্রিকা পাঠের অমনোযোগিতা, বিজ্ঞাপনের অভাব ইত্যাদি কারণে সৃষ্টি হয়েছে সম্পূর্ণ প্রতিকূল পরিবেশ। এরকম বিপর্যস্ত পরিবেশেও তিনি সমস্ত বাধা-বিঘ্নতাকে উপেক্ষা করে এগিয়ে গেছেন অসীম সাহস ও উদ্দীপ্ত মনোবল নিয়ে। পত্রিকা সম্পাদনা করতে গিয়ে মাওলানা কঠোর পরিশ্রম করতেন। সম্পাদকীয় লেখতে বসলে অনেক সময় আহার-নিদ্রা ভুলে যেতেন। তখনও তাঁর লেখালেখির হাত এতটা শক্তশালী হয়ে ওঠেনি। মূলত সাপ্তাহিক মোহাম্মদীতে লেখতে লেখতেই তাঁর কলম সচল ও গতিশীল হয়ে উঠেছে। পত্রিকা পরিচালনার জন্য তাঁর পুঁজি ছিল যৎসামান্য। কোনো প্রকারে কাগজ কেনা ও মুদ্রণের কাজ চালাতেন। চীনা বাজার থেকে ট্রাক ও কুলির খরচ দিয়ে কাগজ আনা ছিল কষ্টসাধ্য। তাই তিনি কাগজ কেনে নিজেই মাথায় করে পত্রিকা অফিসে নিয়ে আসতেন। এতে বিন্দুমাত্রও সংকোচ করতেন না। সেসময় মৌলভি আব্বাস আলী নামের এক দয়াবান দাতার কাছ থেকে তিনি যথেষ্ট সহায়তা লাভ করেছেন।
খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে সাপ্তাহিক মোহাম্মদী-র প্রচার অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেল। তখন তুরস্কের প্রতি ব্রিটিশদের মারমুখো-নীতির সমালোচনা করে মাওলানা আকরম খাঁ জোরদার কলম চালালেন। ব্যাপারটা ব্রিটিশ সরকারের কানে গেলে তাঁর ডাক পড়ল বেঙ্গল গভর্নমেন্টের রাইটার্স বিল্ডিংয়ে। সেখানে এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্য জনৈক নবাব উপাধিধারী বাঙালি মুসলমান তাঁকে প্রস্তাব দিলেন ব্রিটিশ সরকারের নীতির পক্ষে কলম চালনার জন্য। এর বিনিময়ে সরকারি অর্থায়নে সাপ্তাহিক মোহাম্মদীকে দৈনিকে প্রকাশের ব্যবস্থা করে দিবেন। মাওলানার তখন চরম অর্থসংকট থাকার পরও নাকচ করে দিলেন এ প্রস্তাব। এতে নবাব সাহেব ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁকে প্রাণের ভয় দেখালেন। মাওলানা আকরম খাঁ তবুও নতি স্বীকার করলেন না। পরবর্তীতে সাপ্তাহিক মোহাম্মদী-র প্রিন্টার হিসেবে তাঁকে এক বছর জেল খাটতে হয়েছে এবং ব্রিটিশ সরকার-কর্তৃক বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে তাঁর পত্রিকার জামানত।
১৯২৬ সালে কোলকাতায় এবং ভারতের বিভিন্ন স্থানে শুরু হলো হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। তখন সাপ্তাহিক মোহাম্মদী অনন্য ভূমিকা পালন করেছে। মাওলানা আকরম খাঁ মুসলমানদের সংগঠিত করে দাঙ্গার বিরুদ্ধে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানালেন। এতে করে তাদের প্রাণে আশার সঞ্চার হলো। মাওলানা ক্ষুরধার লিখনির মাধ্যমে দাঙ্গার বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন আরম্ভ করলেন। তীব্রতর আঘাত হানলেন সমাজের দুষ্ট লোকদের দমন করতে। তাঁর এ বলিষ্ঠ ভূমিকা কারও কারও কাছে সাম্প্রদায়িক বলে বিবেচিত হলেও সেসময়ে মুসলমানদের অস্তিত্বের জন্য এ সাম্প্রদায়িকতার প্রয়োজন ছিল। এভাবেই মাওলানার সাপ্তাহিক মোহাম্মদী বিশ শতকের তৃতীয় দশক পর্যন্ত বাঙালি মুসলমানদের জীবনকাঠির কাজ করেছে। অবিরাম শুনিয়েছে জাগরণের বাণী।
স্মর্তব্য, সেসময়কার উপমহাদেশের রাজনীতির অঙ্গন ছিল খুবই উত্তপ্ত। তাই মাওলানা আকরম খাঁ সাংবাদিকতার পাশাপাশি দেশসেবার বৃহত্তর ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছিলেন। এজন্য তিনি পত্রিকা সম্পাদনায় যথেষ্ট সময় দিতে পারতেন না। প্রথমে নাজির আহমদ চৌধুরী, এরপর মাওলানার জেষ্ঠ্যপুত্র খায়রুল আনাম খাঁ এবং ফজলুল হক সেলবর্ষী যথাক্রমে সাপ্তাহিক মোহাম্মদী-র সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন, তারপর সম্পাদনায় সহায়তা করেছেন প্রখ্যাত সাংবাদিক, সুসাহিত্যিক আবুল কালাম শামসুদ্দীন। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পরও এর প্রকাশনা অব্যাহত ছিল। তখন খায়রুল আনাম খাঁ কোলকাতা থেকে এ পত্রিকা প্রকাশের ব্যবস্থা করেছেন। মাওলানা আকরম খাঁ সাপ্তাহিক মোহাম্মদী-র মাধ্যমে অনেক মুসলমান তরুণকে উদ্বদ্ধ করেছেন সাংবাদিকতা পেশায়। অনেক তরুণ তাঁর মাধ্যমে সাংবাদিকতা পেশায় প্রবেশের সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন।
মাসিক আল-ইসলাম
মাওলানা আকরম খাঁ তাঁর ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক চিন্তাধারাগুলো স্বাধীনভাবে প্রকাশের সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছিলেন যে পত্রিকায়, সেটি হলো মাসিক আল-ইসলাম। ১৯১৩ সালে তিনি ইসলাম প্রচারের খেদমতকে বেগবান ও মহিমান্বিত করার উদ্দেশ্যে দেশের আলেম-সমাজকে সংঘবদ্ধ করে আঞ্জুমানে ওলামায়ে বাঙ্গালা নামে একটি সংগঠন করলেন। মাওলানা আবদুল্লাহিল বাকী হলেন এর সভাপতি আর মাওলানা আকরম খাঁ সাধারণ সম্পাদক। ১৯১৪ মতান্তরে ১৯১৫ খিষ্টাব্দ মোতাবেক ১৩২২-২৩ বঙ্গাব্দ বোশেখ মাসে এর মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত হলো ধর্ম ও সাহিত্য বিষয়ক পত্রিকা মাসিক আল-ইসলাম। প্রথম বছর এবং দ্বিতীয় বছরের ১ম সংখ্যা পর্যন্ত এ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করলেন মাওলানা আকরম খাঁ। দ্বিতীয় বছরের ৩য় সংখ্যা থেকে এর সম্পাদনার ভার ন্যস্ত হলো মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী-এর ওপর। মাওলানা ইসলামাবাদী আল-ইসলাম-এর সম্পাদক নিযুক্ত হয়ে একে নিয়ে গেলেন অনন্য উচ্চতায়। অনেক প্রবন্ধের নিচে তিনি ফুটনোটে সম্পাদকীয় মন্তব্য প্রকাশ করতেন। এখানে তাঁর জ্ঞানবত্তা ও চিন্তাশীলতা প্রকাশ পেয়েছে। তখন মাওলানা আকরম খাঁ হলেন এ পত্রিকার প্রকাশক ও যুগ্ম সম্পাদক। সহকারী সম্পাদক হিসেবে নিয়োজিত হলেন ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মাওলানা ফখরুদ্দীন আহমদ নিযামপুরী এবং ফজলুল হক সেলবর্ষী। পত্রিকাটি ছয় বছর চালু ছিল। ইসলামের শিক্ষা ও সৌন্দর্য বিষয়ক প্রবন্ধ, মুসলিম ইতিহাস ও জীবনী এবং প্রতিথযশা কবি-সাহিত্যিকদের লেখা গল্প-কবিতায় প্রতিটি সংখ্যা পূর্ণ থাকত।
সেসময়, বিশ শতকের প্রথম দশকে, উপমহাদেশের রাজনীতিতে মুসলমানরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে আরম্ভ করেছেন। মাওলানা আকরম খাঁ সাপ্তাহিক মোহাম্মদী-র মাধ্যমে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক চর্চার পরিবর্তে রাজনীতির দিকে অধিকতর মনোযোগ দিতে থাকলেন। কিন্তু ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক চর্চারও প্রয়োজন ছিল অনিবার্য। তাঁর এ বোধ থেকেই জন্ম নিল মাসিক আল-ইসলাম। এখান থেকেই পাওয়া গেল মাওলানার বহুমুখী দূরদৃষ্টিতার পরিচয়। তিনি এ পত্রিকার মাধ্যমে মুসলিম জনগণকে ইসলামের মূলধারায় উজ্জীবিত করার আপ্রাণ চেষ্টা শুরু করলেন। আল-ইসলাম প্রকাশের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল : ইসলামের ধর্মতত্ত্বের আলোচনা ও মাহাত্ম্য প্রচার, ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের দ্বারা উপস্থাপিত সংশয়বাদীদের যুক্তি খণ্ডন, সমাজ সংস্কার, অন্ধবিশ্বাসীদের মূলোৎপাটন এবং ধর্ম সম্বন্ধে অনুশীলন ও গবেষণা, মুসলিম ইতিহাস ও ঐতিহ্য, সমাজ, রাজনীতি, দর্শন, বিজ্ঞান, শিল্প-বাণিজ্য, শিক্ষা-সংস্কৃতি, বাংলাভাষা ও সাহিত্য ইত্যাদি সব বিষয়ের ওপর মননশীল প্রবন্ধাদি প্রকাশ করা। মাওলানা আকরম খাঁ এ পত্রিকায় একই আদর্শে উদ্বুদ্ধ খ্যাতনামা লেখকদের সংঘবদ্ধ করেছেন। বাঙালি মুসলিম সমাজে আল-ইসলাম লাভ করেছে বিশেষ জনপ্রিয়তা এবং মুসলিম জনমত গঠনে পালন করেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তখনকার ইসলাম ধর্মীয় সাময়িকীগুলোর মধ্যে আল-ইসলাম ছিল শীর্ষস্থানীয়। জানা যায়, ১৯১৭ সালে এর প্রচার সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫০০।
মাসিক আল-ইসলাম-এ বাংলাভাষার খ্যাতনামা অনেক লেখক-সাহিত্যিকের রচনা প্রকাশিত হয়েছে। মাওলানা আকরম খাঁ-ও ধর্ম ও সংস্কৃতি বিষয়ে বহু প্রবন্ধ লেখেছেন। এগুলো পাঠ করে বাংলার মুসলমান সমাজে এক অপূর্ব জাগরণের সৃষ্টি হয়েছে। ১৩২২ বঙ্গাব্দ সালের বৈশাখ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর মূল বাইবেল কোথায় প্রবন্ধটি। ১৯১৫ সালে খ্রিস্টান মিশনারিদের সঙ্গে বিতর্কে প্রবৃত্ত হয়ে ‘যীশু কি নিষ্পাপ’ প্রবন্ধটি রচনা করলেন। সেসময় এ পত্রিকায় যাঁরা লেখতেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন : মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মাওলানা আবদুল্লাহিল বাকী, মাওলানা আবদুল্লাহিল কাফী, নাজির আহমদ চৌধুরী, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কাজী মোতাহার হোসেন, কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কবি গোলাম মোস্তফা, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, আবদুল মালিক চৌধুরী, কাজী ইমদাদুল হক, শাহাদাত হোসেন, মোজাম্মেল হক, আকবর উদ্দীন, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, আবুল মনসুর আহমদ, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, হাবিবুর রহমান সাহিত্যরত্ন, শেখ ফজলুল করীম, কবি কায়কোবাদ, এয়াকুব আলী চৌধুরী, সৈয়দ এমদাদ আলী, আবুল কালাম শামসুদ্দীন প্রমুখ। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে মাওলানা আকরম খাঁ-এর ব্যাপক তৎপরতা সমগ্র বাংলায় বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি করল। দিকে দিকে পড়ে গেল তাঁর ব্যক্তিত্বের সাড়া।
দৈনিক জামানা
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পর আরম্ভ হলো খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন। এ আন্দোলন মাওলানা আকরম খাঁ-এর জীবনে বয়ে আনল নব প্রেরণার জোয়ার। এতে তিনি সক্রিয় ও সংগ্রামী ভূমিকা পালন করলেন। আন্দোলনকে জোরদার করার উদ্দেশ্যে মাওলানা মোহাম্মদ আলী জওহর ও মাওলানা শওকত আলী-এর সহকর্মীরূপে সফর করলেন সারা ভারত। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ খেলাফত কমিটি-র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। খেলাফত আন্দোলনকে জোরদার করার লক্ষ্যে এর মুখপত্র হিসেবে ১৯২০ সালের ১৪ই মে মতান্তরে ২১শে মে দৈনিক জামানা নামে একটি উর্দু পত্রিকা প্রকাশ করলেন। তিনি হলেন এর সম্পাদক। পরবর্তীতে মাওলানা ব্রিটিশ-সরকারের রোষানলে পড়ে কারাগারে চলে গেলে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হলেন তাঁরই জামাতা আবদুর রাজ্জাক খাঁ। তাঁর সঙ্গে দায়িত্ব পালন করলেন মাওলানার জ্যেষ্ঠপুত্র খায়রুল আনাম খাঁ এবং মাওলানা আবদুল্লাহিল কাফী। খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের বাণী উর্দুভাষীদের কাছে পৌঁছানোই ছিল দৈনিক জামানা-র মুখ্য উদ্দেশ্য। এর মাধ্যমে তিনি উর্দুভাষী মুসলমানদের কাছে রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচার করার সুযোগ পেয়েছেন।
বিশ্ব মুসলিম সম্পর্ক স্থাপনে দৈনিক জামানা-র অবদার অনেক। মাওলানা আকরম খাঁ এ পত্রিকার ১ম সংখ্যার প্রথম সম্পাদকীয়তে ধর্মীয় ভ্রাতৃত্ববোধ সম্পর্কে চমৎকার বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা করেছেন। আমরা ও আমাদের নীতি-নির্ধারণ শিরোনামে দৈনিক জামানা-র উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেছেন, ‘আমরা একদিকে মুসলমান, অন্যদিকে হিন্দুস্থানিও বটে। তাই আমাদের পবিত্র ধর্মের খেদমত এবং প্রিয় দেশের কল্যাণ সাধনের প্রচেষ্টা ‘জামানা’-র নীতিগত দায়িত্ব। কিন্তু এ ক্ষেত্রে এটা স্পষ্ট করে দেওয়া প্রয়োজন যে, আমরা ইসলামি ভ্রাতৃত্ব ও ধর্মীয় সম্পর্কের বন্ধনকে সবসময় দেশের সীমারেখা থেকে মুক্ত মনে করি।…গোটা বিশ্বের প্রতিটি এলাকা, হোক তা নিউজিল্যান্ডের অন্ধকারময় বরফের দেশ কিংবা উত্তপ্ত মরুভূমি, যেখানেই একটিমাত্র কালেমার ধ্বনি উচ্চারিত হবে, এ এলাকার প্রত্যেক লোক আমাদের ভাই। এটা অকাট্য সত্য এবং আল্লাহ তায়ালা ও রাসুল সা.-এর পক্ষ থেকে নির্ধারিত অঙ্গীকার ও আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব।’ এ বোধ থেকেই মাওলানা খেলাফত রক্ষার আন্দোলনে সক্রিয় ও সংগ্রামী ভূমিকায় অংশগ্রহণ করেছেন এবং তুর্কি জাতি-ভাইদের প্রতি বাড়িয়ে দিয়েছেন সহযোগিতার হাত। ত্রিপলি ও বলকান যুদ্ধের সময় ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে একলক্ষ টাকা সংগ্রহ করে তুর্কি-ফান্ডে জমা করেছেন মুমূর্ষু-পীড়িত ও নির্যাতিতদের সেবায়। তুরস্কের মুসলমানদের বিপদের সময়ও তাঁর পত্রিকার মাধ্যমে প্রায় ৪০ হাজার টাকা সংগ্রহ করে পাঠিয়েছেন।
দৈনিক জামানা-এ যাঁরা লেখতেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন প্রখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ ও বিশিষ্ট রাজনৈতিক আলেম। মাওলানা মোহাম্মদ আলী জওহর, মাওলানা শওকত আলী, মাওলানা যফর আলী খাঁ, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, মাওলানা হাসরত আলী মুহানী, মাওলানা আযাদ সুবহানী, মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মাওলানা আবদুল্লাহিল বাকী প্রমুখ আলেম ও নেতৃবৃন্দের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। এ পত্রিকাটি প্রায় চার বছর চালু ছিল। ১৯২৩ সালের দিকে আন্দোলন প্রত্যাহার করায় মাওলানা আকরম খাঁ দৈনিক জামানা-র প্রকাশনা বন্ধ করে দিলেন।
দৈনিক সেবক
মাওলানা আকরম খাঁ রাজনৈতিক মতবাদ প্রচারের উদ্দেশ্যে ১৯২১ সালে সেবক নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ ও সম্পাদনা করেছেন। উর্দু দৈনিক জামানা-র পরপরই শুরু করেছেন এর কার্যক্রম। এ পত্রিকার মাধ্যমে তিনি খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনকে বাংলাভাষী জনগণের সামনে তুলে ধরেছেন। পত্রিকাটি প্রথমে সাপ্তাহিক হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯২১ সালে ১লা ডিসেম্বর থেকে মাওলানা একে রূপান্তরিত করলেন দৈনিকে। এ সময় তিনি একাধারে সাপ্তাহিক মোহাম্মদী, দৈনিক জামানা ও দৈনিক সেবক–এ তিনটি পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন এবং সাংবাদিকতার মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রচারণা ও স্বাধীনতা সংগ্রামে পুরোপুরি আত্মনিযোগ করলেন।
তখন অহিংস অসহযোগ আন্দোলন জোরেশোরে চলছে। সেই বিক্ষুব্ধ সময়ে মাওলানা আকরম খাঁ দৈনিক সেবক-এ ‘অগ্রসর! অগ্রসর!’ শিরোনামে একটি উত্তেজনাপূর্ণ সম্পাদকীয় লেখলেন। এটি প্রকাশিত হলো ১০ই ডিসেম্বর, দৈনিক সেবক-এর প্রকাশনার মাত্র দশদিন পর। লেখাটি ব্রিটিশ-সরকারের দৃষ্টিগোচর হলে সরকাবিরোধী তকমা লাগিয়ে পত্রিকার জামানত তলব করা হলো এবং বন্ধ করে দেওয়া হলো এর প্রকাশনা। রাজদ্রোহের অপরাধে গ্রেফতার করা হলো মাওলানা আকরম খাঁকে। সেসময় সারা ভারতজুড়ে গ্রেফতারের হিড়িক চলছিল। গ্রেফতার করা হয়েছিল মহাত্মা গান্ধী থেকে শুরু করে সব উল্লেখযোগ্য কংগ্রেস নেতাদের। অহিংস অসহযোগের নীতি অনুসরণ করে এ কংগ্রেসী নেতারা কেউই আত্মপক্ষ সমর্থন করলেন না। মাওলানাও আত্মপক্ষ সমর্থন না করে কারাবরণ করলেন। কোলকাতার তখনকার প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট মিস্টার সুইনহোর বিচারে তাঁকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হলো। প্রেরণ করা হলো আলিপুরের সেন্ট্রাল কারাগারে। তখন আলিপুরের কারাগারে ছয়শো হিন্দু-মুসলমান রাজবন্দী আটক ছিলেন। তাঁদের মধ্যে মাওলানা আকরম খাঁ, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, পীর বাদশাহ মিয়া, মুজিবুর রহমান, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহন সেন গুপ্ত, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, অধ্যাপক জীতেন্দ্রলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, ডা. বিধানচন্দ্র রায় প্রমুখ ছিলেন দেশ বিখ্যাত নেতা। এ সময় মাওলানার দৈনিক সেবক কিছুকাল বন্ধ রইল। সরকার তাঁকে শরীরী সংগ্রাম থেকে নিষ্ক্রিয় করার জন্য বন্দী করেছে, কিন্তু সংগ্রামী বীর মাওলানা আকরম খাঁ কারাগারে বসেই কলম সৈনিকের ভূমিকা গ্রহণ করলেন।
কারাগারে যেসকল বন্দী মনীষী ছিলেন, তাঁরা রাজনীতি ও ধর্মতত্ত্বের চর্চায় নিয়োজিত হলেন। এ সময়ই মাওলানা আকরম খাঁ-এর মনে কুরআন শরিফে বাংলা-অনুবাদ করার ইচ্ছে জাগল। বন্দীগণ এ ইচ্ছের কথা জানতে পেরে তাঁকে অনুবাদ কাজে প্রবৃত্ত হতে উৎসাহিত করলেন। তাঁদের উৎসাহ পেয়ে মাওলানা কুরআনের ত্রিশতম পারার অনুবাদে প্রবৃত্ত হলেন। কারাগারের বন্দীশিবিরে বসেই সমাপ্ত করলেন এ অনুবাদ। নাম দিলেন–‘কারাগারের সওগাত’। দেশের সুধীসমাজ এ অনুবাদ পাঠ করে দরাজ কণ্ঠে তাঁর প্রশংসা করতে লাগলেন।
ইতোমধ্যে সেবক-এর ওপর থেকে সরকারি নিষেধাজ্ঞা উঠে গেল। মাওলানার জ্যেষ্ঠপুত্র খায়রুল আনাম খাঁ পত্রিকা পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। তাঁর কারাবাস থাকায় এর গ্রাহক সংখ্যা কিছুটা কমে গেল। এতে তিনি কারাগারের থেকেই এর সম্পাদনার ভার গ্রহণের জন্য কবি কাজী নজরুল ইসলামকে আহ্বান করলেন। তিনি তখন কুমিল্লায়। মাওলানার পত্র পেয়ে কবি নজরুল ১৯২২ সালের জুন মাসে কোলকাতায় এসে দৈনিক সেবক-এর সম্পাদকীয় বিভাগে যোগদান করলেন। কিছুদিনের মধ্যেই পত্রিকাটি কবি নজরুলের সরস তেজোময়ী প্রবন্ধ ও জ্বালাময়ী কবিতায় সমৃদ্ধ হয়ে জনসাধারণের কাছে আকর্ষণীয় উঠল। বিশেষ করে সংবাদগুলোর শিরোনামের কবিতাময় রূপটা পাঠকদের আকর্ষণ করল বেশি। কিন্তু কবি নজরুল এ পত্রিকায় বেশিদিন থাকেননি। এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী-এর সঙ্গে একটি রচনা নিয়ে তাঁর মতদ্বৈধতা প্রকাশ পেল। এতে তিনি অসন্তুষ্ট হয়ে পত্রিকার কার্যালয় ত্যাগ করলেন। খায়রুল আনাম খাঁ তাঁকে অনেক চেষ্টা করেও পুনরায় আসতে রাজি করাতে পারেননি। সেসময় দৈনিক সেবক-এর সম্পাদকীয় বিভাগে কর্মরত ছিলেন আবুল কালাম শামসুদ্দীন, মোহাম্মদ মোদাব্বের, নৃপেন্দ্র কৃষ্ণ চট্যোপাধ্যায়, অদ্বৈতমল্ল বর্মণ-এর মতো সুসাহিত্যিক ও সাংবাদিকগণ। সঠিক পরিচালনার অভাবে পত্রিকাটির জনপ্রিয়তা কমে যেতে লাগল। এ অবস্থায় মাওলানা আকরম খাঁ একদিন কারাগার থেকে লেখিত নির্দেশের মাধ্যমে পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ করে দিলেন।
দৈনিক মোহাম্মদী
অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের কারণে মাওলানা আকরম খাঁ তখন কারাবন্দী। বাংলাভাষী জনগণের নিকট রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচারের জন্য তিনি দৈনিক সেবক-এর প্রকাশনা শুরু করেছিলেন, কিন্তু ব্রিটিশ-সরকার রাজদ্রোহিতার অপরাধে সেই পত্রিকার জামানত বাজেয়াপ্ত করে নিল। বন্ধ হয়ে গেল এর কার্যক্রম। সংগ্রামী সাংবাদিক মাওলানা আকরম খাঁ তবুও দমলেন না। তাঁর স্থলাভিষিক্ত যাঁরা ছিলেন, কারাগারের বন্দীশিবিরে বসেই তাঁদের নির্দেশ দিলেন আরেকটি দৈনিক পত্রিকা চালু করতে। মাওলানার নির্দেশকে সময়োচিত মনে করে সাপ্তাহিক মোহাম্মদী-র কর্মীগণ একে দৈনিকে বের করার উদ্যোগ নিলেন। কারণ ব্রিটিশবিরোধী পত্রিকার ডিক্লারেশন পাওয়া ছিল দুষ্কর। এর পরিবর্তে সাপ্তাহিক মোহাম্মদী-র দৈনিক সংস্করণ বের করতে আইনগত কোনো বাধা ছিল না। সেজন্য দৈনিক সেবক-এর স্থলে চালু হলো দৈনিক মোহাম্মদী।
১৯২২ সাল থেকে আরম্ভ হলো দৈনিক মোহাম্মদী-র প্রকাশনা-যাত্রা। এর কার্যালয় ছিল কোলকাতার ২৯ নং আপার সার্কুলার রোডে, সাপ্তাহিক মোহাম্মদী-র অফিসে। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে নিয়োজিত হলেন মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী। কিন্তু তাঁর নাম পত্রিকার কোথাও উল্লেখ থাকত না। সম্পাদক হিসেবে মাওলানা আকরম খাঁ (কারাগারে) উল্লেখ থাকত। এ পত্রিকায় সম্পাদনার মাধ্যমেই শুরু হলো প্রখ্যাত সাংবাদিক, সুসাহিত্যিক আবুল কালাম শামসুদ্দীন-এর সাংবাদিক-জীবন। তিনি দৈনিক মোহাম্মদী-তে যোগদান করে ‘হরেক রকম’ নামে একটি রসাত্মক কলাম চালু করলেন। এতে অন্য পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিত মতামত ও সংবাদের ওপর ব্যঙ্গবাণ বর্ষণ করা হতো। বিশেষ করে পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি ছিলেন নায়ক পত্রিকার সম্পাদক এবং নলিনী কিশোর গুহ, যিনি ছিলেন স্বরাজ পত্রিকার সম্পাদক, তারা দুজনেই ভালো লেখক ছিলেন। তবুও মাঝে মাঝে তাদের লেখায় স্ববিরোধী বক্তব্য ফুটে উঠত। এরই সুযোগ গ্রহণ করত দৈনিক মোহাম্মদী।
দৈনিক মোহাম্মদীকে লক্ষ্য করে নায়ক পত্রিকার সম্পাদকীয়তে একদিন একটি লেখা বের হলো। লেখাটি ছিল এরকম : ‘একটা মাথাকাটা সহযোগী আমাদের বড় পিছনে লাগিয়াছে। মনে হইতেছে, ঘুঘু দেখিয়াছে কিন্তু ফাঁদ দেখে নাই। বদরং চালাইও না , ভালো হইবে না।’ লেখাটি আবুল কালাম শামসুদ্দীন-এর দৃষ্টিগোচর হলো। তিনি নায়ক-এর এ কুৎসিত ইঙ্গিতের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিলেন। অবশ্য ভাষাটা একটু শালীনতা-বিবর্জিত হয়ে গিয়েছিল। মাওলানা আকরম খাঁ তখন কারাগারে থেকেই নিয়মিত পত্রিকার পরিচালনা-নির্দেশিকা দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি মোহাম্মদী-র কলমযুদ্ধের এতটা সীমাতিক্রম মোটেও পছন্দ করলেন না। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীকে কারাগার থেকে চিঠি পাঠালেন: ‘তোমাদের কাগুজে লড়াই ভদ্রতার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এতটা বাড়াবাড়ি ভালো নয়। আমার কাগজকে মেছোহাটা করলে চলবে না।’ স্বয়ং সম্পাদকের পক্ষ থেকে এমন শাসানি পেয়ে মোহাম্মদী-র আক্রমণাত্মক ভঙ্গি অনেকটা শিথিল করা হলো।
সেসময় দৈনিক মোহাম্মদীতে আরেকটা রসাত্মক কলাম লেখা শুরু করেছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনিও তখন এ পত্রিকার সম্পাদনা বিভাগে যোগদান করেছেন। তাঁর কলামটির নাম ছিল ‘কাতুকুতু’। এর শিরোনামগুলো ছিল এরকম : ‘নেহারি নেহরু মতিলাল, বানর-আঁখি অতিলাল!’ ‘ফিরিজ হিজিবিজি’ ‘জাপানের চা-পান’। কবি নজরুলের এ রসাত্মক কলামগুলো সর্বস্তরের মানুষরা সোৎসাহে ও সানন্দে পাঠ করতেন। এসব কলাম লেখে তিনি দৈনিক মোহাম্মদীকে সাধারণ মানুষের হৃদয়গ্রাহী পত্রিকা করে তুললেন। একসময় দৈনিক সেবক-এর ওপর থেকে সরকারি নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে দৈনিক মোহাম্মদী-র কার্যক্রম স্থগিত করা হলো।
সাপ্তাহিক কমরেড
মাওলানা আকরম খাঁ উর্দু ও বাংলার পাশাপাশি একটি ইংরেজি পত্রিকা প্রকাশের কথা দীর্ঘদিন ধরে চিন্তা-ভাবনা করছিলেন। এতে তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, উপমহাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত দিকগুলো ইউরোপীয়ানদের সামনে তুলে ধরবেন, যাতে এ ব্যাপারে তাদের মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি জানতে পারেন এবং ইংরেজি শিক্ষিতদের করে তুলতে পারেন ইসলামমুখী। এ ভাবনা থেকে ১৯৪৩ সালে প্রকাশ করলেন সাপ্তাহিক কমরেড।
সাপ্তাহিক কমরেড-এর মূল প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন উপমহাদেশের খেলাফত ও আজাদি আন্দোলনের প্রখ্যাত নেতা, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, আলেম মনীষী, সুসাহিত্যিক মাওলানা মোহাম্মদ আলী জওহর। ১৯১১ সালের জানুয়ারি মাসে কোলকাতা থেকে তিনি শুরু করেছেন এর প্রকাশনা। ১৯১২ সালে ভারতের রাজধানী কোলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত হলো। মাওলানা তখন কমরেড-এর অফিসও সেখানে নিয়ে গেলেন। কোলকাতায় এর সর্বশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে ১৪ই সেপ্টেম্বর ১৯১২ সালে, এরপর ১২ই অক্টোবর ১৯১২ সালে দিল্লি থেকে বের হলো ১ম সংখ্যা। এ পত্রিকার সঙ্গে তাঁর সাংবাদিক ও রাজনৈতিক জীবনের সূত্রপাত হয়েছে। সাহিত্য ও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে পত্রিকাটি ছিল তখনকার অন্যতম প্রধান ও প্রখ্যাত ইংরেজি সাপ্তাহিক। এর মাধ্যমে তিনি ইংরেজি শিক্ষিত মুসলিম সুধীদের চাহিদা পূরণ করতে থাকলেন। অল্প সময়ের মধ্যে পত্রিকাটি আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করতে সক্ষম হলো। সাপ্তাহিক কমরেড শুধু ভারতের হিন্দু-মুসলমানরা পড়তেন না, ইউরোপের শ্বেতাঙ্গদের কাছেও ছিল জনপ্রিয়। বড়লাট হার্ডিঞ্জ-এর স্ত্রীও কমরেড-এর নিয়মিত পাঠক ছিলেন। এ পত্রিকার মাধ্যমে মোহাম্মদ আলী জওহর-এর জ্ঞানের নিপুণতা এবং বুদ্ধিভিত্তিক আন্দোলনের কুশলতা প্রকাশ পেয়েছে। মুসলিম ভারতের রাজনীতি এবং বিশ্ব মুসলিম ভ্রাতৃত্ব স্থাপনে পালন করেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। মুসলিম জাতীয় জাগরণে এ পত্রিকার অবদান অপরিসীম।
মাওলানা মোহাম্মদ আলী জওহর ১৯১৪ সালে সাপ্তাহিক কমরেড-এ ‘তুর্কিদের স্বাধিকার’ (Choice of the Turks) শীর্ষক একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করলেন। এটি ছিল, প্রথম বিশ্বযদ্ধে তুরস্ক কোন পক্ষ সমর্থন করবে, এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত না হওয়ার আগেই তিনি ব্রিটিশ-নীতির সমালোচনা করে তুরস্ককে মিত্রশক্তির পক্ষে যোগদানের জন্য অনুরোধ করলেন। বিষয়টা ব্রিটিশ-সরকারের দৃষ্টিগোচর হলে একে রাষ্ট্রীয় স্বার্থবিরোধী বলে বাজেয়াপ্ত করা হলো পত্রিকার জামানত। উপরন্তু ১৯১৫ সালের মে মাসে ‘ভারত প্রতিরক্ষা আইন’ বলে নজরবন্দী করা হলো মাওলানা মোহাম্মদ আলী জওহর এবং তাঁর বড় ভাই মাওলানা শওকত আলীকে। এরপর দীর্ঘদিন পর্যন্ত পত্রিকাটি বন্ধ ছিল। ১৯২৪ সালের অক্টোবরে তাঁর সম্পাদনায় আবারও শুরু হলো সাপ্তাহিক কমরেড। কিন্তু ১৯২৬ সালে নানা কারণে তিনি নিজেও বন্ধ করে দিলেন এর প্রকাশনা। সেইসঙ্গে পত্রিকাটির স্বত্বও বিক্রি করে দিলেন খাজা নূরুদ্দীন নামের জনৈক ব্যক্তির নিকট। তার কাছ থেকেই মাওলানা আকরম খাঁ-এর দ্বিতীয় ছেলে সদরুল আনাম খাঁ পত্রিকার স্বত্ব কিনে নিলেন।
১৯৪৩ সালে, যখন উপমহাদেশের রাজনীতি স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকে রূপান্তরিত হলো, সেসময় মাওলানা আকরম খাঁ-এর সম্পাদনায় কোলকাতার আজাদ অফিস থেকে আরম্ভ হলো ইংরেজি সাপ্তাহিক কমরেড-এর প্রকাশনা। পরবর্তীকালে এটি বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও সাংবাদিক মুজিবুর রহমান খাঁ-এর সম্পাদনায় বের হয়েছে। ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন কমরেড-এর সম্পাদনায় ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশি মুসলমানদের মধ্যে ইংরেজি সাহিত্যের ওপর প্রথম পিএইচডি ডিগ্রিধারী। মক্কার উম্মুল কোরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি প্রফেসরও ছিলেন। মাওলানা আকরম খাঁ ‘মুসলিম ভারতের সাংস্কৃতিক ইতিহাস’ সম্পর্কীয় অনেক প্রবন্ধ লেখেছেন। সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন ইংরেজি অনুবাদ করে লেখাগুলো কমরেড-এ ছাপাতেন। সেসময় কোলকাতা থেকে স্টার অব ইন্ডিয়া, মর্নিং নিউজ ইত্যাদি ইংরেজি পত্রিকা বের হতো।
মাওলানা আকরম খাঁ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ইংরেজি শিক্ষার সুযোগ না পেলেও ব্যক্তিগত অধ্যাবসায় ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে ইংরেজির ওপর যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করেছেন। তাঁর ইংরেজি জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যেত কমরেড-এর সম্পাদনাকালে। এ সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করে ড. সাজ্জাদ হোসায়েন বলেছেন, ‘কমরেড-এ ছাপাবার আগে প্রতিটি প্রবন্ধ মাওলানাকে পড়ে শোনাতে হতো। এ সময় দেখেছি শব্দ প্রয়োগ সম্পর্কে তাঁর সূক্ষ্ন সচেতনতা। ভুল বা অসার্থক প্রতিশব্দ ব্যবহারের ত্রুটি তিনি সহজেই ধরে ফেলতেন।…মাওলানা আকরম খাঁ-এর পাণ্ডিত্য কত গভীর, এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তাঁর ‘মোস্তফা চরিত’ গ্রন্থটি। এ গ্রন্থে মাওলানা অনেক উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন বহু ইংরেজি গ্রন্থ থেকে। ইংরেজি ভাষায় দখল না থাকলে এটা সম্ভব হতো না।’
মাসিক মোহাম্মদী
মাওলানা আকরম খাঁ মুসলমান সমাজের সংবাদপত্রের দীনতা দেখে মুসলিম জাগরণের কণ্ঠস্বর হিসেবে ১৯২৭ সালের ৬ই নভেম্বর মুসলিম বাংলার বিখ্যাত সাহিত্য পত্রিকা মাসিক মোহাম্মদী-র দ্বিতীয় পর্যায় প্রকাশনা আরম্ভ করলেন। প্রথম পর্যায়ে মাসিক মোহাম্মদী প্রকাশিত হয়েছিল ১৯০৩ সালের ১৮ই আগস্ট এবং ৫ম সংখ্যা বের হওয়ার পর ১৯০৪ সালের ১৯শে জানুয়ারি তা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তারপর দুই যুগ পর মুসলিম জাগরণের বাণী ছড়াতে আবারও শুরু হলো এর প্রকাশনা। অবশ্য এর আগেই মুন্সী রিয়াজ উদ্দীন আহমদ-এর সুধাকর, মুন্সী আবদুর রহীম-এর মোসলেম হিতৈষী ও মিহির, সৈয়দ এমদাদ আলী-এর নবনূর, মীর মশাররফ হোসেন-এর হিতকরী, এ সমস্ত সাময়িকী প্রকাশিত হয়েছে। এগুলোর বেশির ভাগই প্রকাশিত হয়েছে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও সমাজ সংস্কারমূলক প্রবন্ধ এবং কিছু সাহিত্য বিষয়ক রচনা নিয়ে। রাজনৈতিক ও জাতীয় জাগরণমূলক কোনো সংবাদপত্র তখনও পর্যন্ত প্রকাশ পেয়েছিল কি-না, জানা যায়নি।
মাসিক মোহাম্মদী-ই সম্ভবত প্রথম রাজনৈতিক ও জাতীয় জাগরণের বাণী নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। ১৯২৬ সালে কোলকাতা এবং অন্যান্য স্থানে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলো। তখন মাওলানা আকরম খাঁ এ হানাহানির অন্ধকারে তুলে ধরলেন তাঁর মোহাম্মদী-র রওশন মশাল। বজ্রকলমে সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তীব্রভাবে আঘাত হানলেন। দাঙ্গার জন্য দায়ী করলেন বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে। তখন তাঁর লিখনির শাণিত আঘাতে ক্ষিপ্ত হয়ে সাম্প্রদায়িক ভাবাপন্ন কুচক্রী মহল আকরম খাঁ থেকে তাঁকে ব্যঙ্গ করে ডাকতে লাগল ‘আক্রমণ খাঁ’ বলে। কিন্তু মাওলানা এসবের কোনো কেয়ারই করলেন না।
মাওলানা আকরম খাঁ-এর মাসিক মোহাম্মদী প্রগতির ঝাণ্ডা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। এর ১ম সংখ্যাটি বের হয়েছে ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসে। এ সংখ্যায় ‘আত্মনিবেদন’ শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রবন্ধে তিনি যে নীতি নির্ধারণী ভাষ্য প্রদান করেছেন, এতে তাঁর প্রগতিবাদ ও যুক্তিনির্ভর বাস্তবমুখী চিন্তার ছাপ পরিস্ফুটিত হয়ে উঠেছে। অতীতের অন্ধ অনুকরণ বা পাশ্চাত্যের অনুসরণের তিনি ছিলেন ঘোর বিরোধী। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল প্রাচীনপন্থি এবং আধুনিকপন্থিদের গোঁড়া মতবাদকে পরিবর্তন করে সঠিক পথনির্দেশনা দেওয়া। অতীতের সূত্র ধরে আধুনিকতাকে কাজে লাগিয়ে জাতির মুক্তির পথকে অন্বেষণ করা। এ জন্য মাসিক মোহাম্মদী প্রধানত সাহিত্য পত্রিকা হলেও মুসলিম জাগরণের বিশেষ বাহন হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। মাওলানা ‘আত্মনিবেদন’ শীর্ষক প্রবন্ধে লেখেছেন, ‘বিভিন্ন ভাবধারার সমবায়ে এবং পারিপার্শ্বিকতার প্রভাবে মোছলেম বঙ্গের স্তরে স্তরে আজ এক অভিনব জীবন সাধনা জাগিয়া উঠিয়াছে। একদিকে পুরাতনের মায়া, অন্যদিকে আধুনিকতার মোহ।…পুরাতনের সকল সঞ্চয়কে এক্ষেত্রে আঁকড়াইয়া ধরিয়া কেবল প্রবণতার অভিব্যক্তি বা রূঢ় ভাষার স্মরণ গ্রহণ দ্বারা আধুনিকতার প্রবাহকে যাহারা প্রতিহত করিতে চাহিতেছে, এছলামকে যথাযথরূপে বড় করিয়া দেখিবার ও দেখাইবার মতো বড় নজর ও বড় দেমাগ হইতে তাহাদিগের অনেকেই আজ বঞ্চিত! এছলামকে ভাঙ্গিয়া-চুরিয়া দলিয়া-মথিয়া নিজেদের সংকীর্ণ চিন্তা দৃষ্টির সহিত সামঞ্জস্য করিয়া রাখিতে আজ তাহারা ব্যতিব্যস্ত।…সেই কালের সুখস্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত দেখার উদ্দেশ্যে জীবন সায়াহ্নে মাসিক মোহাম্মদী-র এই নতুন সাধনা; এ সাধনা সিদ্ধিলাভ করুক। এ স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হউক।’
সাপ্তাহিক মোহাম্মদী ও মাসিক মোহাম্মদী মুসলিম জাগরণে যে অনন্য ভূমিকা পালন করেছে, তা ইতিহাসের পাতার সোনার হরফে লেখা রয়েছে। মাসিক মোহাম্মদী ছিল ব্রাহ্মধর্মের মুখপত্র উচাঙ্গের সাময়িকী মাসিক প্রবাসী-র প্রতিদ্বন্দ্বী। মাসিক প্রবাসীতে দীর্ঘদিন ধরে মুসলমানদের ইমান-ধর্ম ও সাংস্কৃতিক পরিপন্থি বক্তব্য ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হচ্ছিল। কিন্তু এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বা জবাব দেওয়ার মতো মুসলমানদের তেমন কোনো পত্রিকা ছিল না। বিশেষ করে বন্দে মাতরম সঙ্গীত ও শ্রী-পদ্ম প্রতীক নিয়ে যেসমস্ত প্রবন্ধ সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় প্রবাসীতে প্রকাশ করেছেন, মাওলানা আকরম খাঁ যুক্তির কষ্টিপাথরে তেজস্বী লিখনির মাধ্যমে সেসবের অসারতা প্রমাণিত করে মোহাম্মদীতে সম্পাদকীয় প্রবন্ধ লেখেছেন। তখন কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়-মনোগ্রামে শ্রী-পদ্ম সংযুক্ত করলেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন মুসলমান ছাত্ররা। তারা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এ সিদ্ধান্তের তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ জানালেন। মোহাম্মদী এ আন্দোলনকে সমর্থন করে ছাত্রদের পক্ষে জোরালো লেখা প্রকাশ করে বিশেষ ভূমিকা পালন করল। মাওলানা আকরম খাঁ নিজে মোহাম্মদীতে কয়েকটি প্রবন্ধ লেখে এর জন্য দায়ী করলেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে। প্রবাসী পত্রিকা শ্রী-পদ্মের সমর্থনে অনেক প্রবন্ধ প্রকাশ করতে লাগল। মাওলানা প্রবাসী-র প্রত্যেকটি প্রবন্ধের অত্যন্ত জোরালো ও যুক্তিনির্ভর জবাব দিলেন মোহাম্মদীতে। এতে প্রবাসী-র সম্পাদক লা-জবাব হয়ে গেলেন। মাসিক মোহাম্মদী-র জোরদার প্রতিবাদ এবং ছাত্রদের তীব্র আন্দোলনের মুখে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের সিদ্ধান্ত পাল্টাতে বাধ্য হলেন। বিশ্ববিদ্যালয় মনোগ্রাম থেকে বাদ দেওয়া হলো শ্রী-পদ্ম।
সেসময় কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসে মুসলিমবিরোধী ভাবধারা বাংলা ও ভারতীয় সংস্কৃতি এবং জাতীয়তার নামে হিন্দু সংস্কৃতিকে মুসলমান ছেলেদের কিশোর মনে গেঁথে দেওয়ার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। রবীন্দ্রনাথের মতো কবিও এ প্রকার উক্তি করতে দ্বিধা করলেন না : ‘মুসলমানরা ধর্মে ইসলামানুসারী হলেও জাতিতে তারা হিন্দু। কাজেই তারা হিন্দু মুসলমান’ বাংলার শিক্ষাক্ষেত্রে এ মুসলমান হিন্দু সৃষ্টির চেষ্টাই অব্যাহত গতিতে শুরু হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে। মুসলমান তরুণদের একদল এ প্ররোচনায় এতই প্রভাবিত হয়েছিলেন যে, এদের অগ্রজ মুসলমান অধ্যাপক কাজী আবদুল ওয়াদুদ তাঁর এক প্রবন্ধে নিঃসংকোচে লেখেই ফেলেছেন : ‘এদেশীয় মুসলমানরা হচ্ছে হিন্দু মুসলমান।’ তখন মুসলমান ছাত্রদের সঙ্গে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিমাতাসুলভ আচরণের স্বরূপ উদ্ঘাটন এবং মুসলিম সমাজের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও আপত্তিকর কার্যকলাপের প্রতিবাদে মাসিক মোহাম্মদী-র একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হলো। এ বিশেষ সংখ্যাটির নাম দেওয়া হলো বিশ্ববিদ্যালয় সংখ্যা। শতাধিক পৃষ্ঠাসম্বলিত এ সংখ্যায় প্রকাশিত হলো অনেক সারগর্ভ প্রবন্ধ ও রচনা। এ সংখ্যা প্রকাশিত হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ উঠানো হলো। দীনেশচন্দ্র সেনও প্রতিবাদ লেখে পাঠালেন। মাসিক মোহাম্মদীতে তা প্রকাশ করে উত্তর দেওয়া হলো। কিন্তু তিনি আর পাল্টা উত্তর দেননি। মাওলানা আকরম খাঁ ও মাসিক মোহাম্মদী মুসলমানদের পক্ষে অনেক বৈপ্লবিক ভূমিকা পালন করেছে। কোলকাতার প্রবাসী গোষ্ঠীই শুধু নয়, ঢাকার প্রগতিশীল নামধারী শিখ গোষ্ঠীর বিরুদ্ধেও মাওলানা মোহাম্মদীতে তীব্র ভাষায় লেখা প্রকাশ করেছেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাই ছিল মাসিক মোহাম্মদী-র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
মাসিক মোহাম্মদীতে মাওলানা আকরম খাঁ নিয়মিতভাবে বিবিধ প্রসঙ্গ শিরোনামে সম্পাদকীয় লেখতেন। তাঁর লেখায় স্বদেশ, সমাজ ও আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলির আলোচনা থাকত। মাসিক মোহাম্মদীর আলোচনা শীর্ষক বিভাগে মাওলানা তখনকার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় জটিল বিষয়াদি ও সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহের ওপর প্রামাণ্য দলিলসহ যুক্তিপূর্ণ আলোচনা পেশ করতেন। নানা প্রতিকূলকার মধ্যেও মাওলনা তাঁর লিখনি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে মোহাম্মদী-র মাধ্যমে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছেন। মাসিক মোহাম্মদীতে মাওলানা আকরম খাঁ-এর গবেষণাধর্মী ও জাতীয় জাগরণমূলক অনেক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে, যা মুসলিম বাংলার সামাজিক, সাহিত্যিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস রচনায় গবেষকদের জন্য তথ্যভাণ্ডার হয়ে রয়েছে। মোহাম্মদীতে প্রকাশিত মাওলানার কিছু লেখার শিরোনাম : ১. এছলামের আদর্শ, ২. এছলামে নারীর মর্যাদা ও অধিকার, ৩. নব-পর্য্যয় না নব-পর্য্যায়, ৪. রমজানের সাধনা, ৫. সমস্যা ও সমাধান, ৬. জয় মোহাম্মদ, জয় মোস্তফা, ৭. মোহছেন স্মরণে, ৮. জ্বওয়াত ছাবাত, ৯. ব্যাক্ টু-দি কোরআন, ১০. বর্তমান হেজাজ, ১১. মাওলানা ওবায়দুল্লাহ, ১২. মোস্তফা চরিতের বৈশিষ্ট্য, ১৩. বারোয়ারী ইত্যাদি।
মাওলানা আকরম খাঁ মাসিক মোহাম্মদী-র মাধ্যমে একদল আত্মসচেতন লেখক তৈরি করতে চেয়েছিলেন। তখন মুসলমান লেখকদের উৎসাহ-উদ্দীপনার এবং সাহিত্যচর্চার তেমন কোনো ক্ষেত্র ছিল না। মাসিক মোহাম্মদী প্রকাশের ফলে মুসলমানদের সাহিত্যচর্চার সুবর্ণ সুযোগের দ্বার উন্মোচিত হলো। ইসলামি তাহজিব-তমদ্দুন, ইতিহাস, ধর্ম-দর্শন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে মাতৃভাষায় নিজস্ব চিন্তাধারা ও ধ্যান-ধারণা প্রকাশের সুযোগ দিয়ে মুসলিম সাহিত্যসেবীদের অগ্রযাত্রা প্রশস্ত করেছে মোহাম্মদী। মাসিক মোহাম্মদী-র ১ম সংখ্যার সূচিপত্র : সম্পাদকীয়–আত্মনিবেদন, আল্লাহর কালাম, রসুলের বাণী, স্বাগত কবিতা–কাজী কাদের নওয়াজ, এছলামের আদর্শ : ওমর খৈয়াম–কাজী নওয়াজ খোদা, ভারতবর্ষ–এস ওয়াজেদ আলী, এছলাম ও শাসন অধিকার–মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মহাপয়গাম (কবিতা–শাহাদাত হোসেন, খ্রিস্টান লেখকগণের ভ্রান্তি, ক্রন্দসী (কবিতা–গোলাম মোস্তফা, আহমদ ছাদ পাশা… কাটাফুল (উপন্যাস) ইত্যাদি। প্রতি সংখ্যাতেই এরকম বৈচিত্র্যময় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত লেখাদি প্রকাশিত হয়েছে।
প্রবাসীতে সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় যে ধরনের আলোচনা করতেন, মোহাম্মদী-র ধরনও ছিল ঠিক তেমনই উঁচুশ্রেণির ও সুসামঞ্জস্যপূর্ণ। সাহিত্য প্রসঙ্গ, চিন্তাধারা, পুস্তক সমালোচনা, সংকলন শীর্ষক কয়েকটি বিভাগ এতে নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে। এগুলোতে ছিল প্রচুর চিন্তাভাবনার খোরাক। এছাড়া তিনরঙা একরঙা ছবি প্রকাশের দিক দিয়েও মাসিক মোহাম্মদী পিছিয়ে ছিল না। সচিত্র প্রবন্ধ প্রায় প্রতিমাসেই দুএকটা বের হয়েছে। এ অপূর্ব উন্নতি সাধনের পেছনে রয়েছে প্রখ্যাত সাংবাদিক, সুসাহিত্যিক আবুল কালাম শামসুদ্দীন-এর নিরলস শ্রম ও আন্তরিক প্রচেষ্টা। তিনি এ পত্রিকার সম্পাদনা বিভাগে যোগদান করে এর আঙ্গিক-বিন্যাস ও লেখার বিষয়ে আমূল পরিবর্তন করলেন। তখনই মাসিক মোহাম্মদী বাস্তবিক অর্থেই একটি সাহিত্য মানোত্তীর্ণ পত্রিকা হয়ে উঠল। বাংলার নামজাদা মুসলমান লেখক, কবি, গল্প-উপন্যাকারের লেখা তিনি এ পত্রিকায় প্রকাশিত করেছেন। কাজী নজরুল ইসলাম, ফররুখ আহমদ, মোস্তাফিজুর রহমান, আহসান হাবীব, সুফিয়া কামাল প্রমুখের লেখা মোহাম্মদীতে প্রকাশিত হয়েছে তাঁরই মাধ্যমে। ফলে মাসিক মোহাম্মদী তখনকার প্রথম শ্রেণির মাসিকগুলোর অন্যতম হয়ে উঠতে পেরেছিল। তখনই মাওলানার চাওয়া মতো এ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল মুসলমানদের একদল লেখক। এর ক্রমধারা ফলে-ফুলে বিকশিত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে। বাংলার সিংহভাগ খ্যাতিমান কবি-সাহিত্যিকই মাওলানা আকরম খাঁ-এর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ শিষ্য। এ জন্যই তাঁকে বলা হয় মুসলিম সাংবাদিকতার জনক।
দৈনিক আজাদ
মাওলানা আকরম খাঁ-এর সাংবাদিক-জীবনের অমর কীর্তি দৈনিক আজাদ। মুসলিম বাংলার প্রাচীনতম, দীর্ঘস্থায়ী দৈনিক সংবাপত্র হিসেবে দৈনিক আজাদ প্রকাশিত হয়েছে এমন এক ঐতিহাসিক সময়-সন্ধিক্ষণে, যখন উপমহাদেশের রাজনৈতিক পটভূমিতে শুরু হয়েছে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুসলিম নবজাগরণের জোয়ার। সেসময়কার প্রেক্ষাপটে দৈনিক আজাদ-এর ঐতিহাসিক ভূমিকা ও অবদানের মূল্যায়ন একটি সাধারণ দৈনিক সংবাদপত্র হিসেবে বিচার করলে চলবে না, বরং এ পত্রিকার আদর্শ ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের কথা বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে। বস্তুতপক্ষে, দৈনিক আজাদ ছিল তৎকালীন উপমহাদেশের বিশেষ করে তদানীন্তন আসাম ও বাংলার মুসলমানদের মুখপত্র এবং তাদের নবজাগরণ ও আত্মপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনে স্বাধীনতা সংগ্রামের বার্তাবাহক ও হাতিয়ার। মুসলিম বাংলার সাংবাদিকতার ইতিহাসে দৈনিক আজাদ একটি অনন্য মাইলফলক।
মাওলানা আকরম খাঁ যখন দৈনিক আজাদ নিয়ে সাংবাদিকতার ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছেন, তখন এক্ষেত্রে মুসলমানদের ভূমিকা ছিল শূন্যের কোঠায়। ১৯২৬ সালে কোলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছে বাংলার মুসলমানদের সর্বপ্রথম রাজনৈতিক দৈনিক মুখপত্র ‘দৈনিক সোলতান’। মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। মুসলিম রাজনীতির দুঃসময়ে দৈনিক সোলতান ভারতীয় মুসলমানদের বিশেষ করে বাংলার মুসলমানদের জাতীয় স্বার্থকে উঁচু করে তুলে ধরেছে–দৃঢ়কণ্ঠে বুলন্দ আওয়াজ তুলেছে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। পত্রিকাটির বিপুল চাহিদা ছিল, কিন্তু চাহিদা ব্যবহার করার মতো শক্তি ছিল না। মাওলানা ইসলামাবাদী একটা মতানৈক্যের কারণে পত্রিকার সম্পাদনা পদ ছেড়ে দিলেন। দিন দিন এর ম্যানেজমেন্টের অবস্থা শোচনীয় হতে লাগল। তারপর সুদক্ষ পরিচালনার অভাবে প্রকাশনার পাঁচ বছর পরই ১৯৩১ সালে বন্ধ হয়ে গেল সাড়াজাগানো দৈনিক সোলতান। সেসময় সারা দেশে মুসলিম সমাজের পত্রিকা বলতে ছিল স্টার অব ইন্ডিয়া এবং আসরে জাদীদ। এ ছাড়া অন্য কোনো দৈনিক পত্রিকা ছিল না। দু’চারটি থাকলেও সেগুলো ছিল কম উল্লেখযোগ্য। অন্যদিকে কংগ্রেসপন্থি তথা হিন্দুদের জন্য ছিল ইংরেজি দৈনিক অমৃতবাজার, বাংলা আনন্দবাজার, যুগান্তর, দৈনিক বসুমতী, সত্যযুগ, সেবক প্রভৃতি পত্রিকা। এছাড়াও তাদের অনেকগুলো মাসিক ও পাক্ষিক পত্রিকা ছিল। এদিক দিয়ে তখনও মুসলমানরা একটু পিছিয়ে ছিলেন।
প্রায় অর্ধশত বছরেরও বেশি সময়ের মধ্যে মুসলিম সম্পাদিত ও পরিচালিত মাসিক, সাপ্তাহিক এমনকি দৈনিক পত্রিকাও অনেক প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু সেগুলো নানা কারণে দীর্ঘস্থায়িত্ব অর্জন করতে সক্ষম হয়নি। অবশ্য মাওলানা আকরম খাঁ-এর সম্পাদিত সাপ্তাহিক মোহাম্মদী, মাসিক মোহাম্মদী এবং মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন-এর সম্পাদিত মাসিক সওগাত এসবের ব্যতিক্রম। দৈনিক আজাদ-এর পটভূমি আলোচনা করতে গিয়ে আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন বলেছেন : ‘বাংলার মুসলিম সাংবাদিকতার পরিচয় দিতে বসে এ কথা না বললে সম্ভবত বক্তব্য অসম্পূর্ণ থেকে যাবে যে, আজাদ থেকেই বাংলায় মুসলিম দৈনিকের স্থায়ী প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছে। ১৯৪০ সাল থেকেই এর সম্পাদনার ভার পড়ে এই প্রবন্ধ লেখকের ওপর এবং তা অব্যাহত থাকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত। এর আগেও অবশ্য দৈনিক প্রকাশের চেষ্টা হয়েছে। ‘হাবলুল মতীন’-ই সম্ভবত প্রথম মুসলিম বাংলা দৈনিক। আগা মঈদুল ইসলাম এর পরিচালক এবং আবদুল গফুর সিদ্দিকী সম্পাদক ছিলেন। সম্ভবত এই স্বল্পায়ু কাগজখানি ১৯০৯ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। তারপর ১৯১৯ সালে মুজফফর আহমদ, (কাজী) নজরুল ইসলাম ও ফজলুল হক সেলবর্ষী-এর সম্পাদনায় ‘দৈনিক নবযুগ’ প্রকাশিত হয়। তবে এরও ছিল তীব্রোজ্জ্বল কিন্তু স্বল্পায়ু জীবন। এরপর দৈনিক সেবক, দৈনিক মোহাম্মদী, দৈনিক সোলতান, দৈনিক তরককী, দৈনিক নবযুগ, দৈনিক কৃষক, দৈনিক ইত্তেহাদ প্রকাশিত হয়েছে বটে, কিন্তু তাদেরও দীর্ঘস্থায়িত্ব সম্ভব হয়নি।’
১৯২৬ সালে মাওলানা আকরম খাঁ নিখিল ভারত কংগ্রেস-এর (বাংলা শাখার) সভাপতি নির্বাচিত হলেন। মহাত্মা গান্ধী, পণ্ডিত নেহেরু, সুভাচন্দ্র বোস, শরৎচন্দ্র বোস, ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ প্রমুখের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ-এর ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে তিনি কংগ্রেসের সঙ্গে জড়িতে হয়েছেন। কংগ্রেসকে তিনি সত্যিকারের একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবেই গণ্য করেছেন। কিন্তু পদে পদে তাঁকে বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী ও মোতিলাল নেহেরু-এর আচরণ তাঁকে ক্ষুব্ধ করে তুলল। কংগ্রেস-কর্তৃক নেহেরুর রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি দেখলেন, এতে ভবিষ্যতের স্বাধীন ভারতে মুসলমানদের ওপর অবিচারের ইংগিত রয়েছে। তাই তিনি ১৯২৯ সালে কংগ্রেস ত্যাগ করলেন। সেসময় মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য সাপ্তাহিক পত্রিকার যথেষ্ট ছিল না। কংগ্রেস ও হিন্দু প্রভাবিত দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা শুধু বাংলাভাষাতেই ছিল দু’ডজনের ওপরে। মুসলমানদের একটিও দৈনিক পত্রিকা নেই। এ দুঃখজনক অবস্থার আশু প্রয়োজন। এ প্রেরণা থেকেই তৈরি হলো দৈনিক আজাদ-এর প্রকাশনা-পটভূমি।
১৯৩৬ সালে কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলিম লীগ পুনর্গঠন উপলক্ষে কোলকাতায় এলেন। বাংলায় মুসলিম লীগ পুনর্গঠন সম্পর্কে মাওলানা আকরম খাঁ-এর সঙ্গে তিনিও বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা করলেন। তখন কায়েদে আজম মাওলানাকে উদ্বুদ্ধ করলেন, বাংলার ঘরে ঘরে মুসলিম লীগ-এর বাণী পৌঁছে দিতে একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করার জন্য। তাছাড়া দীর্ঘ ৩৫ বছর সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত থাকায় এবং বাংলার মুসলমানদের আস্থা অর্জন করায় বিভিন্ন স্থান থেকে একটি বাংলা দৈনিক প্রকাশ করার জন্য অনেকদিন থেকে তাঁকে অনুরোধ জানানো হচ্ছিল। সাংবাদিক হিসেবে পত্রিকা বের করার প্রবল ইচ্ছে থাকলেও তাঁর তখন সামর্থ্য ছিল না। ১৯২২-২৩ সালে দৈনিক সেবক ও দৈনিক মোহাম্মদী প্রকাশ করে মাওলানা আর্থিক দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন বিধায় শঙ্কিত ছিলেন। এছাড়া দৈনিক পত্রিকা বের করার জন্য উন্নতমানের যে প্রেস দরকার, তাও মোহাম্মদী-র ছিল না। এমনকি নতুন প্রেস কেনার মতো আর্থিক সামর্থ্যও ছিল না। সম্ভবত এ জন্যই মাওলানা দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। ঠিক এ সময়ই অমৃতবাজার পত্রিকা কর্তৃপক্ষ তাদের পুরোনো রোটারী মেশিন বিক্রির সিদ্ধান্ত নিলে মাওলানা অল্প দামে মেশিনটি কিনে নিলেন। এতে আজাদ বের করার পথ অনেকটা সুগম হলো। পত্রিকার বের করার উদ্দেশ্যে মাওলানা আকরম খাঁ ‘হিন্দুস্তান কো-অপারেটিভ ব্যাংক’-এ তাঁর বাড়ি বন্ধক দিয়ে ১৮ হাজার টাকা সংগ্রহ করলেন। এদিকে ১৯৩৫ সালের নির্বাচনের পর বাংলায় কোয়ালিশন সরকার গঠিত হলো। প্রধানমন্ত্রী হলেন শেরে বাংলা এ. কে ফজলুল হক। তিনিও একটি বাংলা দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করার কথা ভাবছিলেন। তিনি অবগত হলেন, মাওলানা আকরম খাঁ পত্রিকা বের করবেন। তাই তিনি গভর্নমেন্ট থেকে ৩০ হাজার টাকা আজাদ-এর জন্য বরাদ্দ করলেন। মুসলিম জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার দৃঢ় শপথ নিয়ে ১৯৩৬ সালের ৩১ শে অক্টোবর পবিত্র শবে বরাতের দিনে আত্মপ্রকাশ করল এদতঞ্চলের মুসলিম মিল্লাতের দীর্ঘদিনের কাঙিক্ষত সাড়াজাগানো বিখ্যাত দৈনিক আজাদ।
দৈনিক আজাদ প্রকাশকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক পটভূমি বিশ্লেষণ করে আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন লেখেছেন : ‘সেসময়ে মুসলিম লীগের নবজন্ম লাভের ফলে ভারতের মুসলিম রাজনীতিতে যে উৎসাহ-উদ্দীপনার জোয়ার এসেছিল, তাতে দেশের বিভিন্ন স্থান ও মহল থেকে মাওলানা আকরম খাঁ-এর কাছে অবিলম্বে একখানা দৈনিক সংবাদপত্র প্রকাশ করার তাগিদ অনবরত আসছিল।…মাওলানার সম্পাদনার দৈনিক আজাদ প্রকাশিত হলো নির্দিষ্ট দিনে। সম্পাদনা বিভাগে মাওলানা ছাড়া রইলেন নাজির আহমদ চৌধুরী, সাপ্তাহিকের ভার রইল নাজির আহমদ চৌধুরীর ওপরে। মাসিকের ভার ছিল আমার ওপর। তা তো রইলই, এর ওপর আমাকেও আজাদ-এর সম্পাদনা বিভাগের কাজে টেনে নেওয়া হলো।…আমরা নতুন কাগজে নব-উৎসাহ নিয়েই কাজে আত্মনিয়োগ করলাম। কী করে আজাদ বাংলার মুসলিম সমাজের কর্ম-প্রবাহে নব-উদ্দীপনা নিয়ে আসতে পারে, এই ছিল আমাদের ধ্যান-জ্ঞান।…সত্যিই আজাদ বাংলার মুসলিম সমাজে উৎসাহ-উদ্দীপনার যে জোয়ার এনেছিল, তা ছিল অভূতপূর্ব। অল্পদিনের মধ্যেই আজাদ মুসলিম বাংলার জাতীয় দৈনিক মুখপত্র হয়ে উঠল। বাংলা-আসামের সুদূরপ্রান্ত থেকে এ কাগজের চাহিদার খবর আসতে লাগল। আজাদকে প্রথম শ্রেণির কাগজে পরিণত করার জন্য মাওলানার এবং আমাদের উৎসাহ ও কর্মতৎপরতার অন্ত ছিল না। এ কাগজের নিউজ অডিটর করা হয়েছিল মোহাম্মদ মোদাব্বেরকে। তিনি এ কাগজকে সংবাদ প্রকাশের দিক দিয়ে সমৃদ্ধ এবং গেটআপকে মনোরম করে তুলতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন।’
দৈনিক আজাদ যে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও অঙ্গীকার সামনে নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে, আজাদ-এর প্রথম সম্পাদকীয় নিবন্ধে সেটা লক্ষণীয় : ‘বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে মোছলেম বঙ্গের জাতীয় জীবনের একমাত্র অবলম্বন হইতেছে কয়েকখানা সাপ্তাহিক সংবাদপত্র। এই শোচনীয় দৈন্যের অনুভূতি মোছলেম বঙ্গের জাতীয় অন্তরকে যাতনা দিয়া আসিতেছে বহুদিন হইতে। তিন কোটি মোসলমানের সত্যকার সেবক ও নিরপেক্ষ প্রতিনিধিরূপে দৈনিক আজাদ হাতে করিয়া সমাজের খেদমতে উপস্থিত হইতে পারিলাম। তাই মোছলেম বঙ্গের জাতীয় জীবনের এই শুভ প্রভাতে সর্বপ্রথমে আল্লার হুজুরে অবনত মস্তকে অন্তরের কৃতজ্ঞতা নিবেদন করিতেছি।…দৈনিক আজাদ সত্যিকার আজাদীর নির্বিঘ্ন ও নির্ভীক অগ্রদূত হিসেবে, বাঙ্গালী মুসলমানের ভিতর বাহিরের সব অশুভ বন্ধন-পাশকে ছিন্ন করিয়া তাহাকে মুক্তির মঙ্গল কার্যে পরিচালিত করিতে সমর্থ হউক।…আমাদের একমাত্র আদর্শ ইসলাম এবং একমাত্র নীতি কোরআনের শাশ্বত ও স্বর্গীয় বিধান। এই নীতি ও এই আদর্শের অনুসরণ করাই হইবে আজাদ-এর সমস্ত জীবনের সর্বপ্রধান সাধনা। এই আদর্শের অনুপ্রেরণায় আমরা স্বদেশের মুক্তিকামী, তাহার পূর্ণ স্বাতন্ত্র্যের একান্ত অভিলাষী। এই আদর্শের আলোকে বুঝিয়াছি যে, পরাধীনতা অপেক্ষা ঘৃণিত অভিশাপ মানব জীবনের পক্ষে আর কিছুই হইতে পারে না।…স্বদেশ বলিতে আমরা দেশের ধূলামাটি, বন-জঙ্গল, নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত অথবা তাহার মুষ্টিমেয় অভিজাত শ্রেণীকে বুঝি না। আমাদের মতে, দেশ মানে দেশের মানুষ। সুতরাং দেশের মুক্তি বলিতে আমরা বুঝি দেশবাসী, মানুষ সাধারণের সার্বত্রিক ও সার্বজনীন মুক্তি। আমাদের মতে, বিদেশী শাসন-শোষণের পরিবর্তে স্বদেশী শাসন-শোষণের প্রতিষ্ঠায় আর সত্যকার স্বাধীনতায় আকাশ-পাতাল প্রভেদ।’
ইতিহাসের এক যুগ-সন্ধিক্ষণে দৈনিক আজাদ-এর আবির্ভাব। তবুও বলতে হবে, দীর্ঘ অর্ধ-শতাব্দীর অধিককাল ধরে দৈনিক আজাদ তার প্রতিষ্ঠাকালীন অঙ্গীকার সমুন্নত রেখে জাতির সামনে ভাস্বর। মুসলমান প্রতিষ্ঠিত বাংলা দৈনিকের মধ্যে এটাই সম্ভবত প্রাচীনতম দৈনিক। বাংলার মুসলমানদের স্বতন্ত্র ভাষা ছিল, ছিল আশা-আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু ব্যক্ত করার মতো কোনো মাধ্যম ছিল না। বাংলার মানুষের সুপ্ত মনের আকুতি প্রকাশ এবং ভাষা দেওয়ার জন্য, বিশ্ব দরবারে তাকে তুলে ধরবার প্রত্যয় নিয়ে জাতীয় সচেতনতার প্রতিভূ ও পরিপূরক হিসেবেই আজাদ-এর আত্মপ্রকাশ।
দৈনিক আজাদ প্রকাশিত হওয়ার পর বাংলার মুসলমানদের মূক-মৌন মুখ যেন ভাষা পেয়েছিল এবং পেয়েছিল বলেই উদ্দাম উচ্ছল গতিতে তারা ছুটে চলেছিল। এখানেই মাওলানা আকরম খাঁ ও দৈনিক আজাদ-এর ঐতিহাসিক ভূমিকা। ইতিহাসের যেকোনো একটা গৌরবোজ্জ্বল স্বর্ণ লেখা আকস্মিক কোনো একটা মুহূর্তে বা দিনে হয় না। সে লেখা হয় বহুদিনের, বহু যুগের অক্লান্ত নিরলস সাধনার ফলে। বিংশতি শতাব্দীর গোড়ায় মাওলানা আকরম খাঁ-এর এ সাধনার আরম্ভ, যার পরিণতি হয়েছে ১৯৩৬ সালে দৈনিক আজাদ প্রকাশে।
তারপর উপমহাদেশের ইতিহাসের যৌবন জল-তরঙ্গ প্রবাহিত হয়েছে দুকূল ছাপিয়ে। গঙ্গার সেই কূল ছাপানো প্লাবন বাংলার সীমান্তে এসে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে একদিকে চলে গেল ভাগিরথী, আরেক দিকে পদ্মা। একদিকে হলো ভারতীয় বাংলা, আরেক দিকে হলো স্বাধীন বাংলাদেশ। মাত্র ২২-২৩ বছর যে বাংলাদেশ সংযুক্ত ছিল পাকিস্তানের সঙ্গে। ১৯৩৬ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত দৈনিক আজাদ-এর ভূমিকা এ উপমহাদেশের বিশেষ করে বাংলাদেশের ইতিহাসে অবিস্মরণীয়। ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে একে মুছে দেওয়া কোনো প্রকারেই সম্ভব নয়। এ সময়ে দৈনিক আজাদ বাংলার মুসলমানকে দিয়েছে আত্মপ্রত্যয়, জাগ্রত করেছে তাদের সুপ্ত চেতনাকে; সৃষ্টি করেছে উদ্দাম গতি, নির্দেশ দিয়েছে তাদের স্বকীয়তাকে। দৈনিক আজাদ-ই ছিল মাওলানা আকরম খাঁ-এর মানস সন্তান।
দেশ বিভাগ হয়ে পাকিস্তান-হিন্দুস্তান কায়েম হয়ে গেলে দৈনিক আজাদ এক বছরেরও বেশি সময় কোলকাতায় রয়ে গিয়েছিল। ১৯৪৮ সালে ১২ই অক্টোবর পর্যন্ত আজাদ কোলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এরপর এক সপ্তাহ বন্ধ থাকার পর ১৯ শে অক্টোবর তারিখে ঢাকা থেকে শুরু হয়েছে এর প্রকাশনা কার্যক্রম। দৈনিক আজাদ ছিল ঢাকার সর্বপ্রথম দৈনিক পত্রিকা। ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলন এবং আইয়ুব-বিরোধী আন্দোলনে এ পত্রিকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। দৈনিক আজাদ-এর প্রকাশনা ধারাবাহিকতা ১৯৯০ সাল পর্যন্ত চালু ছিল।
জনক, আপনাকে সালাম!
বাঙালি মুসলিম সমাজের এক অনিবার্য প্রাকপতনের মুহূর্তে বিশ্বাসের ধ্রুব বতারার মতো মাওলানা আকরম খাঁ-এর অবির্ভাব। তাঁর আবির্ভাব মুসলমানদের রাজনৈতিক, সামাজিক, দীনি ও তমদ্দুনিক পটভূমিগুলোকে অনন্য আলোকরশ্মিতে উদ্ভাসিত করে তুলেছে। সেসময়কার রাজনীতিতে মুসলমানরা ছিল অপাঙক্তেয়, সামাজিকভাবে নিগৃহীত এবং সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে অনুন্নত ও পিছিয়ে পড়া এক জাতি। তিনি বুঝতে পারলেন, তাদের মানসিক অবসাদের এ অচলায়ন ভাঙতে না পারলে কিছুতেই মুক্তি সম্ভব নয়। যেজন্য তীব্র শ্লেষে সুতীক্ষ্ন খোঁচায় ক্ষয়িত সমাজের মর্মমূল বিদ্ধ করার প্রয়োজন তিনি বোধ করলেন। এ জন্য কলমকে বানালেন তাঁর অস্ত্র এবং সাংবাদিকতাকে গ্রহণ করলেন বিশ্বাস ও সংকল্পের বাঙ্ময় প্রকাশ-মাধ্যম হিসেবে। তারপর অসীম সাহসে বুক বেঁধে, অমিত তেজে জ্বলে ওঠে দুর্বার বেগে পাড়ি দিয়ে গেলেন একটার পর একটা দুর্যোগের অগ্নিসেতু। তাঁর চলার পথের বাঁকে বাঁকে ছিল জমাট অন্ধকার। কিন্তু তিনি দৃঢ় পায়ে একে মাড়িয়ে সামনে এগিয়ে গেছেন এবং সেই অন্ধকারে জ্বেলে গেছেন একটি করে দীপ। এ জন্য মুসলিম বাংলার সাংবাদিকতার জনক যদি কাউকে বলতে হয়, তবে নিঃসন্দেহে তিনি মাওলানা আকরম খাঁ। কারণ সাংবাদিকতার জন্য এত দুঃখ-বরণ, সংবাদপত্রের কণ্ঠকে অকম্পিত রাখার জন্য এমন একাগ্র সাধনা আর নিরবিচ্ছিন্ন সংগ্রামের দৃষ্টান্ত কেবল এ উপমহাদেশে নয়, বোধ হয় সারা পৃথিবীতে বিরল। তাই এ মহামনীষীর উদ্দেশ্যে সুরা ফাতেহা ও সুরা ইখলাসের ইসালে সওয়াব পাঠিয়ে শতকণ্ঠে বলতে হয়–হে মহান জনক, আপনাকে সালাম!
সহায়ক গ্রন্থ :
১. মওলানা আকরম খাঁ
আবু জাফর সংকলিত ও সম্পাদিত, ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রকাশিত
২. বাঙালি মুসলিম ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনে মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ’ অবদান
আবুল কালাম মুহাম্মদ যাকারিয়া, বাংলা একাডেমী প্রকাশিত
৩. মুসলিম জাগরণে কয়েকজন কবি ও সাহিত্যিক
মুহাম্মদ আবদুল্লাহ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রকাশিত
৪. অতীত দিনের স্মৃতি
আবুল কালাম শামসুদ্দীন, নওরোজ কিতাবিস্তান প্রকাশিত
৫. মুসলিম বাংলার সাংবাদিকতা ও আবুল কালাম শামসুদ্দীন
মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রকাশিত