রাকিবুল হাসান:
হজরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবি রহ. রচিত গ্রন্থ ও পুস্তকের সংখ্যা প্রায় আটশ৷ ছোট ছোট রিসালা, পরিভাষায় যেগুলোকে মাযামিন ও মাকালাত তথা প্রবন্ধ বলা হয়, সেগুলোও এর অন্তর্ভুক্ত। ১৩৫৪ হিজরিতে থানবি রহ.-এর খাদেম মাওলানা আবদুল হক ফাতেহপুরী থানবি রহ.-এর রচনাবলীর একটি তালিকা প্রকাশ করেন। তালিকাটি ছিল ৮৬ পৃষ্ঠাব্যাপী। মুসলমানদের এমন খুব কম বিষয়ই আছে, যে বিষয়ে থানবি রহ. কলম ধরেননি। থানবি রহ.-এর অধিকাংশ বই গদ্যাকারে এবং উর্দু ভাষায় রচিত। তবে ১২-১৩টি কিতাব রচিত আরবিতে।
তাসাউফ সংকলন-পরিমার্জনে থানবি রহ.- এর ভূমিকার কোনো তুলনা হতে পারে না। জালালুদ্দিন রুমি রহ.- এর ওপর তিনি প্রায় সাত-আট হাজার পৃষ্ঠার বিশাল ব্যাখ্যাগ্রন্থ লিখেছেন। কুরআন বিষয়েও থানবি রহ.- এর বিশেষ আগ্রহ ছিল। গত শতকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তাফসীরের একটি বয়ানুল কুরআন। দেওবন্দি ধারায় লিখিত পরের তাফসীরগুলো মূলত বয়ানুল কুরআনের ছায়া অনুবাদ। উলুমুল কুরআন ও তাজবিদ বিষয়েও তার বেশকিছু কিতাব আছে। ফার্সি ও উর্দুতে রচিত আগের অনুবাদে কোথায় কোথায় ত্রুটি আছে, সে বিষয়ে তিনি বেশকিছু রিভিউও লিখেছেন। থানবি রহ. ইলমে কেরাআতের বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। এখন রুকইয়া-চিকিৎসার বহুল প্রচলন ঘটেছে, থানবি রহ. কুরআনি চিকিৎসা নামে আমালিয়াত বিষয়ে একটা নাতিদীর্ঘ বই লিখেছেন।
ইলমে কালামে (তর্কশাস্ত্র) থানবি রহ. -এর অবদান কোনো অংশে কম নয়। আল ইনতিবাহাতুল মুফিদা গত শতকের আলোচিত কালামি কিতাবের একটি। পাশাপাশি সমকালে উত্থাপিত প্রশ্নগুলোও তিনি উত্তর দানের চেষ্টা করেছেন, একাধিক সংকলন বের হয়েছে। যুক্তির আলোকে ধর্মীয় বিধিবিধান তুলে ধরেছেন। ফিকাহে তার দক্ষতা ও প্রভাব তুলনাহীন। উসুলে ফিকাহ ও ইফতা বিষয়ক লেখাজোখা এখন সংকলিত হয়েছে, ফতোয়া প্রকাশিত হয়েছে ছয় খণ্ডে। ই’লাউস সুনান ও আহকামুল কুরআন রচিত হয়েছে তার নির্দেশনায়।
লেখায় বরকতের কারণ
শুরু থেকেই থানবি রহ.-এর রচনার সঙ্গে খোদা প্রদত্ত বরকত, আল্লাহর বিশেষ সাহায্য এবং গায়বী সহযোগিতা ছিল। তিনি যখন আপন মুরশিদ হযরত হাজী ইমাদাদুল্লাহ সাহেব মুহাজিরে মাক্কী রহ.-এর খেদমতে ছিলেন, তখন হাজী সাহেব রহ.-এর নির্দেশে হযরত ইবনে আতা ইসক্বান্দরী রহ.-এর কিতাব ‘তানবীরের’ উর্দু ভাষায় তরজমা করেন। হাজী সাহেব রহ. অল্প সময়ে বেশী কাজ হতে দেখে আনন্দিত হয়ে বলেছিলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা তোমার সময়ে বরকত রেখেছেন।’ আসলেও তাই। থানবি রহ.-এর সময়ের বরকত স্পষ্ট নজরে পড়ে। অতি অল্প সময়ে তিনি যত কাজ করতেন, তা অন্যদের পক্ষে দীর্ঘ সময় ব্যয় করেও সম্ভব হতো না।
তবে থানবি রহ.-এর সময়ে বরকতের বাহ্যিক ছয়টি কারণ উল্লেখ করেছেন তার বিশিষ্ঠ খলিফা এবং তার জীবনীকার হযরত খাজা আযীযুল হাসান মজযুব রহ.।
এক—উৎসাহ ও উদ্বীপনা। কোন কাজ আরম্ভ করলে তা সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত তিনি অস্থির ও ব্যাকুল হয়ে থাকতেন। একান্ত প্রয়োজনীয় কাজ ব্যতীত কোনো বিরতি নিতেন না। এক নাগাড়ে লিখে যেতেন। ‘কলিদে মুসনবীর’ ব্যাখ্যা লেখা যখন শেষ করেন, শেষদিকে টানা একদিন একরাত লিখেছেন। এক মিনিটের জন্যও বিশ্রাম নেননি। ফলে অভ্যাসের বিপরীত অস্বাভাবিক ক্লান্তির কারণে জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলেন।
দুই— উপস্থিত জ্ঞান। তিনি কোন বিষয়ে লিখতে বসলে অতিরিক্ত চিন্তা-ফিকির করতে হতো না। সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম বিষয়গুলো তিনি অতি সহজে লিখে যেতেন। যদিও লেখা অবস্থায় বা পরে তাতে সংযোজন-বিয়োজন করতেন।
তিন — প্রতিবন্ধকতা মুক্ত সময় পাওয়া। তার খোদ ভাষ্য হলো, তাফসীরে বয়ানুল কুরআন লেখার সময় প্রায় আড়াই বছর পর্যন্ত আমার কান গরম হয়নি। অথচ তখন প্লেগ বা মহামারীর প্রদুর্ভাব খুব বেশী ছিল। আমি আল্লাহর দরবারে দুআ করলাম, হে আল্লাহ! তাফসীর পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত আমাকে জীবিত রাখুন। আল্লাহ তা‘য়ালা আপন দয়ায় আমার কানও গরম করেননি। আলহামদুলিল্লাহ, কোন ধরণের অসুবিধা ছাড়া, সুস্থ-স্বজ্ঞানে তাফসীর লিখার কাজ সমাপ্ত হল।
চার— রচনায় অতিরঞ্জন না করা। হযরত মাওলানা হাবীবুর রহমান সাহেব [সাবেক মুহতামিম, দারুল উলুম দেওবন্দ] এর মতও তাই ছিল। হযরত থানবি রহ. মাওলানা হাবীবুর রহমান সাহেবের এই মতটি উল্লেখ করে বলেছেন, তিনি বিলকুল সত্য বলেছেন। অতিরিক্ত আলোচনা সমৃদ্ধ রচনা দ্বারা কাজ হয় না। আমার দৃষ্টি কেবল প্রয়োজনের প্রতি নিবদ্ধ। দীর্ঘ আলোচনা মানুষের অন্তরে বিরক্তি সৃষ্টি করে। তাই আমার ‘ইবারত’ (মূল রচনা) অনেক ছোট হয়ে থাকে। কিন্তু দাবী প্রকাশ করার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অর্থবোধক ও যথেষ্ট মর্ম বাহক এবং স্পষ্ট হয়ে থাকে।
তিনি যখন লিখতেন, তখন সবসময় নিজের কাছে পেন্সিল ও কাগজ রাখতেন। যখনই ঐ বিষয়ে কোনকিছু মাথায় আসতো, তৎক্ষণাত লিখে নিতেন। অনেক সময় রাত্রি বেলা ঘুমানোর সময় বালিশের নীচে কাগজ এবং পেন্সিল রাখতেন। যেন কোনকিছু মনে হলে লিখে নিতে পারেন।
পাঁচ— সময়ানুবর্তিতা। থানবি রহ. অত্যন্ত সময়ানুবর্তী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি বলতেন, যদি আমি সময়ানুবর্তী না হতাম তা হলে দ্বীনের অল্প-সল্প যা কিছু খিদমত হচ্ছে তা কখনো হতো না।
ছয়— ইখলাছ বা নিষ্ঠা। থানবি রহ. নিজের রচনা সম্ভারকে জীবিকার মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করেননি।
থানবি রহ.-এর রচনাস্বত্ব
থানবি রহ. একমাত্র দ্বীনের খেদমতের জন্য লিখেছেন। আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া তার আর কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। এ জন্য তার পক্ষ থেকে ব্যাপকভাবে অনুমতি রয়েছে , যে কেউ যত কপি ছাপাতে আগ্রহী ছাপাতে পারবে। বিভিন্ন প্রকাশনা তার কিতাবাদী ছেপে লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন করছে।
এক ইংরেজ থানবি রহ.-কে জিজ্ঞাসা করল, আপনি তাফসীর গ্রন্থ লিখে কত টাকা রুজি করেছেন? তিনি বলেন, এক টাকাও না। ইংরেজ বিস্মৃত হয়ে বলল, এত বড় কিতাব লেখার এই কষ্ট কেন স্বীকার করলেন? তিনি বললেন, আমাদের বিশ্বাস, এই জীবনের পর অন্য একটি জীবন রয়েছে, যাকে আখেরাত বলা হয়। আমার প্রত্যাশা, সেই আখেরাতে আল্লাহ তা‘য়ালা আমাকে তার প্রতিদান দিবেন। এবং দুনিয়াতেও আমি উপকৃত হব। কারণ, যখন আমি দেখব আমার মুসলমান ভাইরা তা অধ্যয়ন করে উপকৃত হচ্ছে তখন আমি আনন্দিত হব।
থানবি রহ. তার খানকায়ে এমদাদিয়ার প্রকাশনা বিষয়ক এক ওসিয়তে লিখে গেছেন, ‘যেহেতু এখানের রচনাবলির বিনিময়ে কারো থেকে কিছু নেয়া হয় না, তাই রচনাগুলো নিজেদের নামে রেজিস্টার করার অধিকার কারো নেই। পয়লা জমাদিউল আউয়াল, ১৩৩৫ হিজরি।’
রচনায় ভুল এবং প্রতিক্রিয়া
থানবি রহ.-এর অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হল, তিনি তার কিতাবাদীর অনাকাঙ্খিত ভুল অবগত হওয়ার পর তা র্নিদ্বিধায় সংশোধন করে নিতেন। এই বিষয়ে তিনি একটি বিশেষ গন্থও লিখেছেন। নাম ‘তারজীহুর রাজিহ’ । কোনো মাসআলায় তিনি নিজের কোন সামান্য ভুলও যদি ধরতে পারতেন, তৎক্ষণাত সেই মাসআলা থেকে তিনি ফিরে আসতেন। এবং তা সংশোধন করে দিতেন। আর যেখানে দ্বিধাগ্রস্থ হতেন, উত্তর লিখার পর লিখতেন, অন্যান্য ওলামায়ে কেরাম থেকেও তাহকীক করে এর সমাধান জেনে নিন।
থানবি রহ. অনেক ফাযেল ওলামায়ে কেরাম দ্বারা নিজের কিতাব ‘বেহেশতী জেওর’ ‘এমদাদুল ফতোয়া’ ‘তাফসীরে বয়ানুল কুরআন’ পুনরায় ‘তাসহীহ’ করিয়েছেন। যৎ-সামন্য ক্রটি-বিচ্যুতির উপর অবগত হয়েছেন, তা মূল কপি থেকে সংশোধন করে তারপর প্রকাশ করেছেন।
থানবি রহ. বলেন, কখনো কখনো একটি লাইন লেখার জন্য অনেক দূর থেকে টাকা খরচ করে কিতাব আনিয়ে কিতাব দেখে লাইনটি লিখতাম। তারপর আবার বইটি ফেরত পাঠাতাম। পাঠক তো ছোট একটি বাক্য পড়ে চলে যাবে। কিন্তু সে জানবেও না, এই ছোট লাইনটি লিখতে আমাকে কত কষ্ট করতে হয়েছে।
লেখার সূচি প্রকাশ
থানবি রহ. নিজের লেখার ব্যাপারে সতর্ক এবং যত্নশীল ছিলেন। কোনো লেখা হারিয়ে যেতে দিতেন না। বরং প্রতিটি লেখা কিংবা বইয়ের শিরোনাম সূচি আকারে সাজিয়ে রাখতেন। কখনো কখনো সেসব সূচি প্রকাশও করতেন। সূচি সংরক্ষণ করার সবচে বড় উপকার হলো, কেউ যে কোনো কিতাব শুধু এমনিতেই থানবি রহ.-এর দিকে সম্পৃক্ত করে দিতে পারবে না।
তিনি একবার আম ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘যে বইয়ে আমার স্বাক্ষর না থাকবে, অথবা যে বইয়ে আমার সম্পাদনা না থাকবে, সেটা কখনো আমার হিসেবে গণ্য করবে না।’
উপসংহার
এই উপমহাদেশে থানবি রহ.-এর রচনার প্রভাব বেশ গভীর। তার রচনার ছোঁয়ায় বদলে গেছে কত মানুষ, আলোর দেখা পেয়েছে কত হৃদয়! তিনি বেঁচে থাকতেই তার রচনা বিপুল পাঠকপ্রিয়তা এবং গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। খাজা আযীযুল হাসান মজযুব রহ. লিখেন, একবার থানবি রহ. তার বিরোধিতাকারী লোকদের নিয়ে কথা বলছিলেন। তখন তিনি বললেন, বিরোধীরা যত চেষ্টা করারই করুক। তোমরা দেখবে ইনশাআল্লাহ, একদিন আমার কিতাব এত ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পাবে, কেউ আটকাতে পারবে না। তার এই প্রত্যয় বাস্তবে পারিণত হয়েছিল তার জীবদ্দশাতেই।
সূত্র:
১. আশরাফুস সাওয়ানেখ, খাজা আযীযুল হাসান মজযুব
২. হায়াতে থানবি, ড. গোলাম মুহাম্মদ হায়দারাবাদী
৩. সীরাতে আশরাফ, মুনশী আবদুর রহমান খান
৪. আশরাফ আলী থানবি রহ. : ব্যক্তি ও প্রভাব, ইফতেখার জামিল