মাকাল ফলের দিন

মুজিব হাসান:

মহল্লার পাঞ্জেগানা মসজিদে জোহরের নামাজে দাঁড়িয়েছেন মাওলানা মুনতাসির। বাইরে চৈত্রের দুপুর। মাথার ওপর জ্বলন্ত উনুনের মতো গনগনে সূর্য আগুনের হলকা ছড়াচ্ছে। খরখরে রোদে জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে চারপাশ। একচালা টিনশেডের মসজিদ। ওপরে কোনো সানশেড নেই। মোটে তিনটি ফ্যান। ইমাম সাহেবের মাথার ওপরে একটি জালি ফ্যান আর দুটো সিলিং ফ্যান মুসল্লিদের কাতার বরাবর। বিদ্যুৎ না থাকলে গুমোট গরমে হাঁসফাঁস করতে হয়। ভেতরের যা আয়তন, সাকুল্যে পনেরোজনের মতো মুসল্লি একসঙ্গে দাঁড়াতে পারেন। মসজিদটির অবস্থান টাউনের বাইরে। মাওলানা এখানের পেশ ইমাম। ফজর ছাড়া প্রতিদিন চার ওয়াক্তের নামাজ পড়ান। তার বাসা এখান থেকে এক কিলো দূরে, টাউনের পশ্চিম কলোনিতে। সেখানে তিনি মেশকাত জামাত পর্যন্ত এক মাদরাসার খেদমতে নিয়োজিত আছেন, পাশাপাশি পালন করছেন এই মসজিদের ইমামতির দায়িত্ব।

নামাজের তাকবিরে উলার সঙ্গে সঙ্গে চলে গেল বিদ্যুৎ। আহা যন্ত্রণা, একেই বলে গজের ওপর বিষফোঁড়া! আজকের দাবদাহে সবার দমবদ্ধ অবস্থা, এর উপর এই লোডশেডিং। করোনাকালীন লকডাউন চালুর পর থেকেই এদিকটায় ঘনঘন লোডশেডিং হচ্ছে। কী ব্যাপার, টাউনের বাইরে বলে এই এলাকা পল্লী বিদ্যুতের আওতায় চলে গেছে নাকি? হতেও পারে। করোনা মহামারির ভয়াল থাবায় বিশ্বজুড়ে যে প্রাণঘাতী জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে, এর ঢেউ আছড়ে পড়েছে বাংলাদেশেও। গোটা দেশে এখন জরুরি অবস্থা জারি হয়ে গেছে। সরকার থেকে করোনা মোকাবেলার নামে আসছে একের পর এক কঠোর নির্দেশনা। লকডাউন-শাটডাউনের কবলে পড়ে জনগণ দাঁড়িয়ে আছে বাঁচামরার দুয়ারে। মহামারির এই প্রাণসংকট সময়েও প্রতিনিয়ত তাদের বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করতে হচ্ছে। কাজের মানুষগুলো কাজ হারিয়ে দিন কাটাচ্ছে অচল যন্ত্রের মতো ঘরবন্দি হয়ে। বেঁচে থাকার রসদ-সামগ্রী ক্রমেই হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। মধ্যবিত্তের বোবাকান্না আর নিম্নবিত্তের হাহাকারে ভারি হয়ে উঠছে চারপাশ।

মাওলানা নিবিষ্ট মনে নামাজ পড়ছেন। নামাজ মুমিনের আত্মার প্রশান্তি। লোডশেডিংয়ের কারণে গরমের তীব্রতা লাই পেয়েছে। মনে হচ্ছে প্রখর রোদে খড়ের গাদার নিচে শুয়ে আছেন সবাই। মাওলানার পেছনে ইক্তেদাকারী মুসল্লিরা গরমে আইঢাই করছেন, কিন্তু তিনি নামাজ পড়ছেন একাগ্রচিত্তে, খুশুখুজুর সঙ্গে। ব্যাপার হলো, পরিবেশের উত্তাপের চেয়ে পরিস্থিতির উত্তাপ মাওলানাকে নিদারুণ অতিষ্ঠ করে তুলেছে। আদতে তিনি একজন শান্তিপ্রিয় মানুষ। দীনের খেদমত আর ঘর-সংসার নিয়ে আছেন। লকডাউনের ভয়াবহ পরিস্থিতির ঝাপটা তাকেও ধাক্কা দিয়ে গেছে। বছরের একেবারে শেষ দিকে এসে পরীক্ষা শুরুর প্রাক্কালে বন্ধ হয়ে গেছে মাদরাসা। বেতন-ভাতা যা ছিল, সবই বকেয়া রয়ে গেছে। মাদরাসা-মসজিদের খেদমত ছাড়া মাওলানার আর কোনো ইনকাম সোর্স নেই। তার একলা উপার্জনে চলে চার সদস্যের সংসার। বেতন মোটামুটি চলার মতো। দুই জায়গা থেকে মিলিয়ে বারো হাজার টাকা পান। তা দিয়ে প্রতিমাসের খাইখরচ, বাসা ভাড়া ও আনুষাঙ্গিক খরচাদি আর স্ত্রী-সন্তানদের টুকটাক শখ-আহ্লাদ পূরণ করে বেশ দিন চলে যায়। এরমধ্যে লকডাউন এসে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে তার জীবন।

সালাম ফিরিয়ে মাওলানা নামাজ শেষ করলেন। এবার তার খেয়াল এলো নিজের দিকে। দুপুরের খরতাপে ঘেমেনেয়ে একাকার। পরনের পাঞ্জাবি ভেজে চপচপে হয়ে পিঠের সঙ্গে লেপ্টে যাচ্ছে। মাথার ঘাম টুপির ফাঁক গলে কপাল বেয়ে লেগে আছে ভ্রুর সঙ্গে। মাওলানা ঘাম মুছে মুসল্লিদের দিকে তাকালেন। তিনজন মুসল্লি বসে আছেন নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে। গরমের তীব্রতায় তাদের অবস্থাও করুণ। পাঞ্জেগানা মসজিদ বলে এম্নিতেই মুসল্লির উপস্থিতি কম। এর উপর লকডাউনের কারণে মসজিদের উপরও জারি হয়েছে সরকারি নির্দেশনা : ওয়াক্তিয়া নামাজে পাঁচজন আর জুমার নামাজে দশজনের বেশি মুসল্লি থাকতে পারবে না। এই নির্দেশনা প্রতিটি মসজিদে কঠোরভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে। মাওলানার পাঞ্জেগানা মসজিদও পড়েছে এর আওতায়। আগে প্রতি ওয়াক্তে দশ-বারোজন মুসল্লি হতো, এখন পাঁচজনের অনুমতি থাকলেও দুতিনজনের বেশি হয় না।

মাওলানা সুন্নতের জন্য উঠে দাঁড়ালেন। তিনজন মুসল্লির দুজনেই ফরজ পড়ে পা বাড়ালেন বাড়ির দিকে। একজন শুধু নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে সুন্নতের নিয়ত বাঁধলেন। নামাজ শেষ করে মাওলানা তার দিকে তাকালেন। তিনি এই মসজিদের মোতাওয়াল্লি মফিজ সাহেব। খুবই আলেমভক্ত মানুষ। গুমোট গরম উপেক্ষা করে মাওলানা তার জন্য বসে রইলেন। নামাজ শেষ করে এগিয়ে এলেন মফিজ সাহেব। তাকে দেখে মাওলানা হাসি হাসি মুখ করে উঠে দাঁড়ালেন। তিনি কিছু বলার আগেই মফিজ সাহেব বলে উঠলেন, ‘ইমাম সাব, আফনের এই মাসের বেতনডা ত এহনও দেওয়া হয় নাই। কষ্ট কইরে একটু বয়েন, আমি হিসাবের খাতাডা লইয়া আই।’

মফিজ সাহেব বাসার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলেন। মসজিদের পাশেই তার বাসা। মাওলানা প্রসন্নমনে অপেক্ষা করতে লাগলেন। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ফিরে এলেন তিনি। মাওলানার হাতে আটটা পাঁচশো টাকার চকচকে নোট দিয়ে বললেন, ‘লকডাউনের দিনকাল, সবারই অবস্থা খারাপ চলতাছে। আফনেরে কিছু বেশি দেওনের নিয়ত আছিন। এইবার বেতনডা দিতাছি, আল্লা রহমত করলে দেহি সামনে কিছু দিতাম পারি কি-না!’

প্রতিমাসে ইমাম সাহেবের বেতন নির্বাহ করেন মফিজ সাহেব। এই মহল্লার অন্যদের তুলনায় তিনি মোটামুটি অবস্থাপন্ন লোক। টাউনের পৌরমার্কেটে তার কাপড়ের ব্যবসা। এজন্য মসজিদের বেতন নিয়ে মাওলানার এত চিন্তা নেই। ঠিক সময়ে হাতে পেয়ে যান।

মফিজ সাহেবের কথায় মাওলানা স্মিতমুখে বললেন, ‘চাচাজি, এইটাতেই আল্লার শোকরিয়া। যে একটা অবস্থা শুরু হইছে, মানুষের জীবন নিয়া টানাটানি। আল্লা রহমত না করলে বাঁইচে থাকাটাই মুশকিল।’

মফিজ সাহেব মাথা নাড়লেন, ‘হুম, যে অবস্থা দেখতাছি, করোনা ভাইরাসের থাবাডা খুব শক্ত কইরেই আইব দেহা যায়।’

মাওলানা অভয়বাণী শুনালেন, ‘চাচাজি, দেইখেন আল্লাই রহমত করবেন। যত কঠিন অবস্থাই আসুক, আমাদের উচিত সবসময় আল্লার ওপরে ভরসা রাখা।’

মফিজ সাহেবকে সালাম জানিয়ে মাওলানা টাউনের দিকে চললেন।

হাইওয়ে ধরে আধা কিলো হাঁটার পর সামনে পড়ে পৌরমার্কেট। এখানেই মাওলানার মাদরাসা। প্রতিদিন এই পথটুকু তিনি পায়ে হেঁটে যাওয়া-আসা করেন। শাটডাউনের কারণে রাস্তাঘাট পুরো ফাঁকা। সবধরনের যান চলাচলের ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। বন্ধ হয়ে আছে ব্যস্তসমস্ত মার্কেট-শপিংমল। ফার্মেসি, কাঁচাবাজার আর কয়েকটা মুদির দোকান খোলা। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া লোকজন বাইরে বেরুতে পারছে না। টাউনজুড়ে সারাক্ষণই লেগে আছে পুলিশি টহল। কিন্তু নিত্য প্রয়োজন আর জীবিকার তাগিদে মাওলানার মতো অনেককেই বাইরে বেরুতে হচ্ছে। এখন বাইরে গেলেই মাস্ক পরিধান অপরিহার্য। করোনা এসে এই জিনিসটির কদর বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। সার্জিকাল মাস্ক একদিন ব্যবহারের পর পাল্টাতে হয়, তাই মাওলানা কাপড়ের মাস্ক কিনে নিয়েছেন। এতে খানিকটা সাশ্রয় হয়েছে বটে। ব্যবহারের পর ধুয়ে পরা যায়। প্রথমদিকে এই মাস্ক নিয়েও শুরু হয়েছিল জুয়াচুরি। এক টাকার সার্জিকাল মাস্ক বিক্রি হচ্ছিল দশ টাকায়। এখন দাম একটু শিথিল হয়েছে, তবে আইন রয়ে গেছে আগের মতোই। এসময়ে মাস্ক ছাড়া বাইরে বেরুলেই মুশকিল। সুশীল লোকদের বাঁকা চাউনি সহ্যের পাশাপাশি সরকারি আইনের জরিমানাও গুনতে হয়।

মাওলানা কাঁচাবাজারের দিকে এগিয়ে গেলেন। অনেকদিন হলো সংসারের বাজার করা হয় না। করোনার আগে সপ্তাহে দুবার তাকে কাঁচাবাজার আসতে হতো। এবার এসেছেন টানা দুসপ্তাহ পর। কিছু করার ছিল না, হাত একদম খালি। মাদরাসা থেকেও তিনমাসের বেতন আটকা। রমজানের আগে কিছু পাওয়ার আশ্বাস আছে। কিন্তু এই আশ্বাসটিও খুব ক্ষীণ মনে হচ্ছে। মাদরাসার আয়ের মাধ্যম ছাত্রদের বেতন আর দোকান ভাড়া। করোনা পরিস্থিতির কারণে দুটোই বন্ধ। যেকারণে আটকা পড়েছে পুরো স্টাফের বেতন। এ নিয়ে মুহতামিম সাহেবও খুব উদ্বিগ্ন। সেদিন দফতরে ইহতিমামে মাওলানাকে পেয়ে বলেছিলেন, ‘মাওলানা, আপনাদের বেতন-ভাতা কিছু দিতে পারতাছি না। দেখতাছেন তো মাদরাসার অবস্থা। আয়ের সব পথ বন্ধ। কীভাবে কী করমু, আল্লা পাকের রহমত ছাড়া আর কোনো উপায় দেখতাছি না। দেখি, রমজানের আগে আপনাদের কিছু দিতে পারি কি-না।’

রমজানের আর দিনদশেক বাকি। মাওলানা সেই আশ্বাসে বুক বেঁধে আছেন। আজ ভাবছেন, বাসায় যাওয়ার পথে মাদরাসায় মুহতামিম সাহেবের সঙ্গে দেখা করে যাবেন। মসজিদ থেকে যা পেয়েছেন, তা দিয়ে টুকটাক সাংসারিক প্রয়োজনগুলো মিটবে, কিন্তু মাদরাসা থেকে কিছু না পেলে খুব মুশকিলে পড়ে যাবেন।

মাদরাসায় গিয়ে মুহতামিম সাহেবকে পাওয়া গেল না। মাওলানা দফতরে ইহতিমামে কিছুক্ষণ বসে রইলেন। ছাত্রশূন্য মাদরাসা কেমন খাঁ খাঁ করছে। সপ্তাহ দুয়েক আগেও ছাত্রদের পড়াশোনার আওয়াজে মুখরিত ছিল চারপাশ। পরীক্ষার খেয়ার চলছিল। ক্লাসরুমে, বারান্দায় ছাত্ররা বসে বসে পড়ত। দুসপ্তাহের ব্যবধানে বন্ধ হয়ে গেল একটা জমজমাট মাদরাসা। ছাত্রদেরও আর পরীক্ষা দেওয়া হলো না। মাওলানার ইচ্ছে হচ্ছিল নিজের কামরায় গিয়ে বসবেন। কিন্তু বাসায় ফেরার তাড়ায় সেই ইচ্ছে ত্যাগ করলেন। বেরুনোর পথে গেইটম্যান শওকতের কাছ থেকে জানলেন, মুহতামিম সাহেবের এক আত্মীয় গুরুতর অসুস্থ। তাকে দেখতে তিনি গ্রামের বাড়িতে গেছেন। মাওলানা বাসার উদ্দেশ্যে পা বাড়াবেন, তখনই পেছন থেকে শওকতের গলা শোনা গেল, ‘হুজুর, একটা কথা আছিন।’

শওকত কাঁচুমাচু করছে। দোলাচলে পড়ে গেছে, কথাটি বলবে কি-না।

মাওলানা আন্তরিকতা দেখালেন, ‘বলেন শওকত ভাই, কী কথা।’

শওকত হাত কচলানোর ভঙ্গি করে জানাল, ‘আমার কিছু টাকার দরকার আছিন। ঘরে বাজার-সদাই কিছু নাই। মুহতামিম সাবের থেইকা নেওনের নিয়ত আছিন। হুজুররে আয়া পাই নাই।’

মাওলানা তার হাতে পাঁচশো টাকার একটি নোট দিয়ে বললেন, ‘নেন, এইটা রাখেন। আমারও একটু সংকট চলতাছে।’

শওকত লজ্জিত ভঙ্গিতে টাকাটা নিল। মাওলানা বাজারের ব্যাগ হাতে বাসার দিকে পা বাড়ালেন।

কলিংবেল চেপে মাওলানা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন। তার এক হাতে বাজারের ব্যাগ, আরেক হাতে মুখের মাস্কটি ধরা। বেশিক্ষণ দাঁড়াতে হলো না, আধা মিনিটের মধ্যে দরজা খুলে দিল মুনা। স্বামীর ঘামে ভেজা মুখটির দিকে তাকিয়ে তার খুব মায়া লাগল। মিষ্টি হেসে সালাম দিয়ে তাকে অভ্যর্থনা জানাল ঘরে। হাত থেকে বাজারের ব্যাগটি নিয়ে ছুটল পাকঘরের দিকে। স্ত্রীর এই গুণটির প্রতি মাওলানা সবসময় ফিদা। তার হাসি আর অভ্যর্থনার সামনে এসে নিমিষেই দূর হয়ে যায় সমস্ত ক্লান্তি ও অবসাদ। মাওলানা প্রফুল্লমনে ঘরে ঢুকলেন। গায়ের পাঞ্জাবি ছেড়ে ফ্যানের নিচে বসলেন। মুনা এসে পাঞ্জাবিটা ঝুলিয়ে রাখল হ্যাঙ্গারে। ঠোঁটের কোণে এক টুকরো মিষ্টি হাসির আভা ধরে বলল, ‘ঘামে তো ভিইজা গেছেন। একটা গোসল দিয়া আসেন, নালে গা কুটকুট করব।’

স্ত্রীর কথায় মাওলানা মাথা নাড়লেন, ‘হুম, যাই। আয়াত আর সিজদা কই?’

‘দুজনেই ঘুমাইতাছে।’

মাওলানা শোবার ঘরে ঢুকে একপলক দেখে নিলেন কলিজার টুকরো দুটোকে। আয়াত আর সিজদা পাশাপাশি ঘুমাচ্ছে। ঘুমন্ত শিশুর মুখের সামনে পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য ম্লান। তার কাছে মনে হচ্ছে যেন ভরা পূর্ণিমার চাঁদ দুটুকরো হয়ে পড়ে আছে বিছানায়। ওদের মুখ থেকে ঠিকরে পড়ছে সৌন্দর্যের বিমল আলো। মাওলানার খুব ইচ্ছে হচ্ছে সন্তান দুটোকে একটু আদর করবেন। কিন্তু এই শরীরে ওদের ছোঁয়া ঠিক হবে না মনে করে গোসল করতে চললেন।

স্বামীকে গোসলে পাঠিয়ে মুনা খাবারের বন্দোবস্ত শুরু করল। আয়োজন সামান্য, আলুভর্তা, ডিমভুনা আর ডাল। আজ দুসপ্তাহ ধরে ভাতের সঙ্গে ব্যঞ্জন হিসেবে এগুলো চালাতে হচ্ছে। প্রায়দিনই আলু আর ডাল, মাঝেমধ্যে ডিম। ছেলেমেয়ে দুটো বেশ শান্তশিষ্ট হয়েছে। ওদের যা-ই দেওয়া হয়, তা-ই খেয়ে নেয়। কখনও বাইরের জিনিস খাওয়ার আবদার করলে মুনা ওদের আলু আর ডিম সিদ্ধ করে চটপটির মতো বানিয়ে দেয়। এতে করে কিছুটা বাড়ন্ত হয়ে গেছে। ঘরে আজ দুটোই ডিম ছিল। ভুনা করে একটি ছেলেমেয়েকে খাইয়েছে, আরেকটি রেখে দিয়েছে স্বামীর জন্য। রাতের রান্নাবান্না নিয়ে একটু দুশ্চিন্তার মধ্যে ছিল। কিন্তু স্বামীকে বাজারের ব্যাগ হাতে বাসায় আসতে দেখে মন খুশিতে ভরে উঠল। সাংসারিক কোনো ব্যাপারেই তাকে কিছু বলতে হয় না। মুনা মনে করে, তার স্বামীর মতো এমন সংসার-অনুরাগী মানুষ আর হয় না। ঘর-সংসারের প্রতি তার ভালোবাসা ও মনোযোগ খুবই অবাক করার মতো।

গোসল শেষে ফুরফুরে মন নিয়ে মাওলানা খেতে বসলেন। মুনা হাতপাখা দিয়ে স্বামীকে বাতাস করতে লাগল। মাওলানা হাত ধুয়ে ভাত মাখতে মাখতে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আয়াত আর সিজদা ভাত খাইছে?’

মুনা মুচকি হেসে জবাব দিল, ‘জি, ওরা খাইয়াই ঘুমাইছে। আপনি খান।’

মাওলানা সুধামাখা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি খাইছ?’

মুনা মিষ্টি হাসিতে মুখ রাঙিয়ে উত্তর দিল, ‘আপনি খান, আমি পরে খামু।’

‘পরে কখন খাইবা? আসো, একসাথে খাই। নেও, হাঁ করো!’

মুনা ভালো করেই জানে, তার স্বামী তাকে রেখে খাওয়ার লোক না। তিনি যতদিন বাসায় থাকেন, প্রতিবেলার খাবার দুজনে একসঙ্গে একথালায় ভাগ করে খান। স্বামীর এই ব্যাপারটা মুনাকে দারুণ চমৎকৃত করে। তার প্রতি লোকটার যে ভালোবাসা, তা বিয়ের আট বছরেও এতটুকু কমেনি।

‘বিসমিল্লাহি ওয়াবারকাতিল্লাহ’ বলে মুনা স্বামীর মেখে দেওয়া লুকমাটি মুখে তুলল। মাওলানাও দোয়া পড়ে মুখে পুরলেন দ্বিতীয় লুকমাটি। খেতে খেতে তিনি বাজার করার প্রসঙ্গ তুললেন, ‘লকডাউনের কারণে কাঁচাবাজারের দামও ম্যালা বাইড়া গেছে।’

স্বামীর কথায় মুনা জিজ্ঞেস করল, ‘আনাজপাতির দাম কেমন নিছে?’

মাওলানা স্ত্রীর মুখে খানিকটা ডিমের কুসুম তুলে দিয়ে বললেন, ‘সবকিছুতেই ডবল দাম। পাটনাই আলুর কেজি আগে ছিল ২০ টাকা, এখন হইছে ৪০ টাকা। টমেটো ছিল ৩০ টাকা, এখন ৬০ টাকা। এইযে হাইব্রিট ডাঁটার আঁটি, এইটার দাম নিছে ৪০ টাকা।’

মুনা চোখ কপালে তুলে বলল, ‘কী কন, এই চার-পাঁচটা ডাঁটার এত দাম!’

মাওলানা ভাতের লুকমা মুখে পুরে মাথা নাড়লেন, ‘হুম!’

মুখের রেখায় বিস্ময়চিহ্ন ফুটিয়ে মুনা জিজ্ঞেস করল, ‘মিষ্টি কুমড়ার ফালিটা কত নিছে?

‘৩০ টাকা।’

‘সবরি কলার হালি?’

‘৫০ টাকা।’

‘আর পাঙ্গাশ মাছ?’

‘১৩০ টাকা কেজি। এইটা দুই কেজি ওজনের। দাম নিছে ২৫০ টাকা।’

‘ডিম কত হালি আনছেন?’

‘হাঁসের ডিম, ৫০ টাকা হালি।’

‘লেবু দুইটা কত নিছে?’

‘২০ টাকা।’

‘কী কন, এই ফুলঝরা লেবুর দাম ২০ টাকা?’

‘হুম।’

‘এত দামে আনলেন কেরে?’

‘শরবত কইরে খাওয়াইবা। তোমার হাতের শরবত তো চিনি ছাড়াই মাশাল্লা!’

স্বামীর মশকরা বুঝতে পেরে মুনা কপট রাগ দেখাল,

‘হইছে হইছে, আর কওয়া লাগব না।’

মাওলানা অবাক হওয়ার ভান করে বললেন, ‘গুণবতীর প্রশংসা করতেও মানা?’

মুনা মিষ্টি হেসে বলল, ‘এই প্রশংসায় নুন নাই। গুণের প্রশংসা গাইলে নুন-চিনি দেওয়া লাগে।’

স্ত্রীর মজাক ধরতে পেরে মাওলানা একটু দরাজ গলায় বলে উঠলেন, ‘সুবহানাল্লাহ, কিয়া বাত!’

তখনই শোবার ঘর থেকে ভেসে এলো সিজদার ঘুমভাঙা কান্নার আওয়াজ। মুনা আবারও মুখজুড়ে কপট রাগের চিহ্ন ফুটিয়ে বলল, ‘হইছে এইবার, মেয়েটা উইঠা গেছে। আমি যাই, আপনি খাওয়া শেষ করেন।’

মাওলানা আহূত গলায় বললেন, ‘আরে, আরেকটা লুকমা খাইয়া যাও!’

শোবার ঘর থেকে ভেসে এলো মুনার তাড়া, ‘আপনি খাওয়া শেষ কইরে ঘুমাইতে আসেন। আমার ম্যালা কাজ পইড়ে রইছে।’

মাওলানা হাসিমুখে খাওয়া শেষ করায় মন দিলেন।

মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে মুনা পাকঘরে এলো। রাতের রান্নার বন্দোবস্ত করতে হবে। ছেলেমেয়ের সংসার, রান্নাবান্না বেলাবেলি শেষ করতে পারলেই ভালো। ঝুড়িতে আনাজপাতি রেখে দা নিয়ে সবজি কুটতে বসল। ডাঁটাগুলো হাইব্রিট হলেও লকলকে। দুটো দিয়ে এক পদের তরকারি হয়ে যাবে। এগুলো কুটে একটি পাত্রে রাখল। চারটে পাটনাই আলু আর তিনটে টমেটো কুটে রাখল আরেকটি পাত্রে। এবার মাছে হাত দিল। পাঙ্গাশ মাছ, এসময়ের মেছো বাঙালি মধ্যবিত্তদের প্রিয় আমিষ। মুনার ইচ্ছে আজ মাছ দিয়ে দুপদের তরকারি করবে। একটি ডাঁটার, আরেকটি আলু-টমেটোর। পাঙ্গাশের সঙ্গে দুটোই ব্যঞ্জন হিসেবে চমৎকার। মাছটা ভেজে নিতে হবে। পাঙ্গাশ মাছ ভেজে রান্না করলে তরকারি বেড়ে হয়। ভাজা মাছের কয়েকটা টুকরো রাখতে হবে আয়াত আর সিজদার জন্য। ছেলেমেয়ে দুটো মাছভাজা দিয়ে ভাত খেতে ভালোবাসে।

স্ত্রীকে পাকঘরে দেখে মাওলানা শোবার ঘর থেকে উঠে এলেন। দুপুরে খেয়ে শুয়েছিলেন। প্রতিদিন এই সময়টায় তিনি কিছুক্ষণ ঘুমান। আজও শুয়েছিলেন, কিন্তু ঘুম আসছিল না। অগত্যা স্ত্রীর সঙ্গে খোশগল্প করতে এলেন। লকডাউন চালুর পর থেকেই তাকে অনেকটা সময় বাসায় থাকতে হচ্ছে। আগে যেটুকু সময় মাদরাসার জন্য ব্যয় হতো, সেটা এখন স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে কাটাচ্ছেন। তবে বেশিক্ষণ বাসায় থাকলে নিজেকে কেমন নিষ্কর্মা লাগে। এজন্যই ইমামতিটা ধরে রেখেছেন। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বাসায় থাকেন। ছেলেমেয়ে দুটোকে পড়ান। জোহরের ওয়াক্তে মসজিদে যান ইমামতি করতে। ফিরে এসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেন। তারপর আসরের ওয়াক্তে বেরিয়ে ঘরে ফেরেন ইশার নামাজ পড়িয়ে। আসর আর মাগরিবের পরের সময়টা মাদরাসায় তার কামরায় কিতাব মুতালায়া করেন। এতে করে নিজেকে প্রাণবন্ত লাগে, সময়টাকে কাজের মনে হয়।

মুনা মাছ কুটছে। মাওলানা একটি পিঁড়ি পেতে বসে পড়লেন স্ত্রীর পাশে। স্বামীর দিকে এক পলক তাকিয়ে মাছের ঘাড়ে পোঁচ দিয়ে মুনা বলল, ‘আপনি না ঘুমাইতে গেছিলেন? ঘুমাইবেন না?’

মাওলানা স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে স্মিতমুখে বললেন, ‘ঘুম আসতাছে না। শুধু শুধু শুইয়া থাকার চাইতে তোমার মাছ কাটা দেখলে ভালো লাগব।’

মুনা এক পোঁচে আলাদা করে ফেলল মাছের মুড়োটা। ওটা পাতিলে রেখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে একগাল মিষ্টি হেসে বলল, ‘এইটা কাতলা মাছ হইলে মাথাটা দিয়া মুড়িঘণ্ট রান্ধা যাইত। আপনার মনে আছে, আমাদের বাড়ির গাঙ থেইকা আট কেজি ওজনের একটা কাতলা মাছ মারছিলেন?’

স্ত্রীর স্মৃতিজাগানিয়া জিজ্ঞাসায় মাওলানা উদ্দীপ্ত হয়ে উঠলেন।

‘মনে থাকব না! ওই মাছ দেখার জন্য তোমাদের বাড়িতে পাড়ার লোক ভাইঙ্গা পড়ছিল। লোকজন বলাবলি করতাছিল, এইটা নাকি জামাইয়ের মাছ। তোমার ছোট ভাই বন্ধুবান্ধব নিয়া আসল আমার সাথে ফটো তুলব। এইটা নাকি এক পত্রিকায় ছাপা হইব। এরপরে মাছের মাথাটা দিয়া তুমি যে মুড়িঘণ্ট রান্না করছিলা, ওইটার স্বাদে এখনও আমার জিহ্বা জ্বলে!’

স্বামীর ইশারার মারজা ধরতে পেরে মুনা খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে খিন্ন গলায় সহানুভূতি জানাল, ‘আপনার যে অত ঝাল লাগব এইটা কিন্তু আমি জানতাম না। আমাদের ঘরের সবাই মোটামুটি ঝাল খায়। নতুন জামাইয়ের সাথে ঘরের সবাই খাইতে বসছে, তখনই আপনি ঝালের চোটে হুসহাস শুরু করলেন। চোখের পানি আর নাকের পানি এক হইয়া যাইতাছে। ব্যাপারটা খেয়াল কইরে আমার কিন্তু খুব মায়া লাগছিল!’

মাওলানা মুগ্ধতার সুরমা মাখা চোখে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। স্বামীর এমন করে তাকানো ছুঁয়ে গেল মুনাকেও। মুখজুড়ে আয়নাআদল ফুটিয়ে অপলক তাকিয়ে রইল স্বামীর দিকে। স্ত্রীর আয়নামুখে জান্নাতি ভালোবাসার প্রতিফলন দেখতে পেয়ে মাওলানা মুচকি হেসে উঠলেন। স্বামীর হাসির মর্ম বুঝতে পেরে মুনা ডালিমদানার মতো লাল হয়ে উঠল লজ্জায়। মাওলানা এই লজ্জাবতীর ডালটিকে আলতোভাবে ছুঁয়ে দিতে চাইলেন, তখনই পেছন থেকে পাখির মতো কণ্ঠ করে ডেকে উঠল আয়াত, ‘আব্বু, আমি হিসু করমু!’

এবার স্বামী-স্ত্রী দুজনেই শরমিন্দা হয়ে উঠলেন। মুনা মুখের হাসি চেপে মন দিল মাছ কুটায়। মাওলানা আয়াতকে কোলে নিয়ে উঠতে উঠতে বললেন, ‘চলো আব্বু, চলো!’

পেশাবের ঝামেলা চুকিয়ে আয়াত আবারও শুয়ে পড়ল। ওর বয়স সাতে পড়েছে। এই বছর নাজেরায় ভর্তি হবে। ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে মাওলানা কুরআন শরিফ নিয়ে বসলেন। আজ আর ঘুমাবেন না। আসরের আজানের পৌনে এক ঘণ্টা বাকি। এসময়ের মধ্যে এক পারা তেলাওয়াত করা যাবে। তার প্রতিদিনের রুটিন তিন পারা কুরআন তেলাওয়াত করা। আজ এক পারা পড়েছেন। এখনের এক পারা হলে দুপারা পড়া হবে। বাকি এক পারা মাগরিবের পর পড়ে নিবেন। শোবার ঘরের জানালার পাশে বসে মাওলানা কুরআন তেলাওয়াত করছেন–

‘ওয়াল্লাযিনা ইয়াকুলুনা রাব্বানা হাবলানা মিন আযওয়াজিনা ওয়া যুররিইয়্যাতিনা কুররাতা আইউনিউ ওয়াজআলনা লিলমুত্তাকিনা ইমামা!’

হৃদয়ের দরদ ঢেলে কণ্ঠের শহদ মেখে এই আয়াতটি তিনি বারবার পড়তে লাগলেন। হাতের কাজ শেষ করে মুনা শোবার ঘরে এলো। বিছানায় বসে নিবিষ্ট মনে শুনতে লাগল স্বামীর কুরআন তেলাওয়াত। সুরা ফুরকানের এই আয়াতটি তিনি বারবার তেলাওয়াত করছেন। মাদরাসাশিক্ষিতা হওয়ায় মুনা এই আয়াতের অর্থ ও মর্ম পরিষ্কার বুঝতে পারছে। এটি কুরআনিক দোয়া। সুখময় দাম্পত্যজীবনের মূলমন্ত্র।

শাটডাউন চলছে। রাস্তাঘাট পুরো ফাঁকা। আসরের নামাজ পড়াতে মাওলানা মসজিদে যাচ্ছেন। হাইওয়ের ফুটপাত ধরে হাঁটছেন চিন্তিত মনে। মুখজুড়ে দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। রমজানের আর দুদিন বাকি। মাদরাসা থেকে এখনও কোনো টাকা-পয়সা পাননি। টানাটানির সংসারে বেতন বকেয়ার ব্যাপারটা মরার ওপর খাড়ার ঘায়ের মতো। মাওলানা এই ঘায়ে প্রতিনিয়ত ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছেন। মসজিদ থেকে যা পেয়েছেন, তা দিয়ে সাংসারিক প্রয়োজনগুলো মিটেছে। এখনও বাকি রয়ে গেছে বাসা ভাড়া। একসঙ্গে দুমাসের ভাড়া বাকি। বাসার মালিক মাহতাব সাহেব। অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার। মোটামুটি ধার্মিক মানুষ। তাকে কোনোদিন বাসা ভাড়া চাইতে হয়নি, মাস শেষ হতেই মাওলানা নিজ থেকে পরিশোধ করে দেন। তার এই মুয়ামালায় মাহতাব সাহেব দারুণ অভিভূত। এজন্য প্রথম মাসের ভাড়া ঠিক সময়ে দিতে না পেরে মাওলানা দুঃখ প্রকাশ করলেন, ‘চাচা, একটু সংকটের মধ্যে পইড়ে গেছি। এই মাসের ভাড়াটা কয়েকটা দিন পরে দেওয়া লাগব।’

মাহতাব সাহেব হেসে বললেন, ‘সমস্যা নাই মাওলানা সাব, আপনি ভাড়া সামনের মাসেই দিয়েন।’

লকডাউনের ভেতরে চলে গেছে এক মাস। আজ বাসা থেকে বেরুনোর পথে মাহতাব সাহেবে সঙ্গে দেখা। মাওলানা তাকে সালাম দিলেন। তিনি হাসি হাসি মুখ করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মাওলানা সাব, মসজিদে যাইতাছেন নাকি?’

মাওলানা স্মিতমুখে জবাব দিলেন, ‘জি চাচা, আসরের ওয়াক্ত হইয়া যাইতাছে।’

মাহতাব সাহেব কৈফিয়ত দেওয়ার মতো করে বললেন, ‘পাশের বাসার লোকেরা বলতাছে, তারা নাকি সামনের মাসে বাসা ছাইড়ে দিব। আপনারা দুই বাসা আছেন, আরেকটা বাসা আনাম খালি পইড়ে থাকব। এহন করোনার সময়, নতুন ভাড়াটিয়া পাওয়াও মুশকিল।’

মাওলানা বুঝে নিলেন, মাহতাব সাহেব বাসা ভাড়া বাড়ানোর কথা বলছেন। করোনার কারণে ভাড়াটিয়াদের আয়-রোজগারের পথ বন্ধ, এই অবস্থায় মালিকপক্ষের উচিত তাদের প্রতি সদয়ী হওয়া। মাওলানা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। মাহতাব সাহেব আর কিছু না বলে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলেন দুতলায়।

ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাটঁতে মাওলানা বিষয়টি নিয়ে ভাবতে লাগলেন। এখন যদি বাসা ভাড়া বাড়ানো হয়, তাহলে তিনি বড় মুসিবতে পড়ে যাবেন। আল্লাহ না করুন, না খেয়েও দিন কাটানো লাগতে পারে। স্ত্রী-সন্তানদের অনাহারক্লিষ্ট মুখ তিনি দেখতে পারবেন না। ব্যাপারটা মনে আসতেই মাওলানার বুক চিনচিন করে উঠল। আনমনে পকেটে হাত দিতেই বেরিয়ে এলো মোবাইল। মুহতামিম সাহেবের সঙ্গে বেতনের বিষয়টি নিয়ে কথা বলবেন। তিনি এখনও গ্রামের বাড়ি থেকে ফিরেননি। মাওলানা তার নম্বরে কল দিলেন। দুবার রিং হওয়ার পর মুহতামিম সাহেব রিসিভ করলেন, ‘মাওলানা, কী অবস্থা আপনার?’

কুশল বিনিময়ের পর মাওলানা জানান দিলেন, ‘লকডাউনের দিনকাল, একটু সংকটের মধ্যে আছি হুজুর। কিছু টাকা-পয়সার দরকার ছিল।’

মুহতামিম সাহেবের গলায় অপারগতার সুর, ‘মাওলানা, বলছিলাম রমজানের আগে আপনার হাতে কিছু টাকা দেম, কিন্তু আপনি তো জানেনই মাদরাসার অবস্থা। ছাত্রদের বেতন আর দোকান ভাড়া না হইলে আমাদের চলা মুশকিল।’

শুনে মাওলানা পড়ে গেলেন দুশ্চিন্তার অকূল পাথারে। ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে মুহতামিম সাহেব একটা আশ্বাসের খবর শুনালেন, ‘শুনতাছি বেফাকের পক্ষ থেইকা উদ্যোগ নেওয়া হইছে মাদরাসাগুলার মধ্যে অনুদান দেওয়া হইব। প্রত্যেক শিক্ষকই মোটামুটি টাকা-পয়সা পাইব। এইটা হইলে আমাদের জন্য একটু আসান হইব।’

এই কথায় মাওলানা ধাতস্থ হতে পারলেন না। বেফাকের অনুদানের ব্যাপারে তিনিও শুনেছেন। কিন্তু এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হতে অনেক সময়ের প্রয়োজন। ততদিন পর্যন্ত তার মতো একজন মফস্বলে মাদরাসার শিক্ষককে বসে বসে আশার জাল বুনে যেতে হবে।

চিন্তিত মনে হাঁটতে হাঁটতে মাওলানা মসজিদের মহল্লার কাছাকাছি চলে এসেছেন। এই গলির শেষ মাথায় তার মসজিদ। ওদিকে পা বাড়াবেন, দেখেন গলির মুখে পুলিশি ব্যারিকেড। তিনি একটু ভড়কে গেলেন। এসময়ে পুলিশের উপস্থিতি মানেই বিপজ্জনক কিছু। দূরে দাঁড়িয়ে অবস্থা বুঝতে চেষ্টা করলেন। তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে যুবক বয়সী এক পুলিশ এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘হুজুর, আপনি এইদিকে কেন?’

মাওলানা স্বাভাবিক গলায় উত্তর দিলেন, ‘আমি এই মহল্লার পাঞ্জেগানা মসজিদের ইমাম। নামাজ পড়াইতে আসছি।’

পুলিশটি সার্কুলার দেওয়ার মতো জানাল, ‘শুনেন হুজুর, এই মহল্লায় একজন করোনার রোগী পাওয়া গেছে। এইজন্য লকডাউন দেওয়া হইছে। এই মহল্লার সবাই ১৪ দিন পর্যন্ত হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকবে। কেউ এর ভেতরে যাইতে পারবে না আর এখানের কেউও বাইরে আসতে পারবে না। উপর থেইকা আমাদের ওপর এই নির্দেশ দেওয়া হইছে।’

মাওলানা মাথা নেড়ে ফেরার পথ ধরলেন। যেতে যেতে ভাবলেন, মফিজ সাহেবকে একবার ফোন করে এই ব্যাপারে পরিষ্কার হবেন। ফোন দিলেন তার নম্বরে। রিং হতেই রিসিভ করলেন মফিজ সাহেবের বড় ছেলে মুজাম্মেল সাহেব। মাওলানা সালাম দিলেন। প্রতিউত্তর দিয়ে তিনি শুনালেন এই দুঃসংবাদটা, ‘ইমাম সাব হুজুর, আপনি শুনছেন কি-না, আব্বার তো করোনা ধরা পড়ছে।’

মাওলানা দারুণ আঁতকে উঠে বললেন, ‘ইন্নালিল্লাহ, কী বলতাছেন!’

মুজাম্মেল সাহেব সত্যায়ন দেওয়ার মতো বললেন, ‘জি হুজুর, আজকেই ধরা পড়ছে। আব্বারে হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা হইছে আর মহল্লাজুড়ে লকডাউন দেওয়া হইছে। সবাই খুব দুশ্চিন্তার মধ্যে আছি। হুজুর, আব্বার জন্য বিশেষভাবে দোয়া করবেন। আল্লাহ যেন আমাদের এই বিপদ থেইকা মুক্তি দেন!’

মাওলানা তাকে অভয় দিয়ে বললেন, ‘মুজাম্মেল ভাই, ভয়ের কিছু নাই। ইনশাল্লাহ, আপনার আব্বা সুস্থ হইয়া উঠবেন। আপনারা একটু সতর্ক হইয়া চইলেন। কোয়ারেন্টাইনের নিয়মকানুন মাইনে চললে আশা করতাছি বিপজ্জনক কিছু হইব না। আমি আপনাদের জন্য দোয়া করতাছি, ফি-আমানিল্লাহ!’

ফোন রেখে ফেলে আসা পায়ের রেখা ধরে মাওলানা টাউনের দিকে চললেন। সংসার চালানোর মতো অর্থোপার্জনের যে সুযোগগুলো ছিল, একে একে সবই তার হাতছাড়া হয়ে গেল। দুদিন পর থেকে শুরু হবে রমজান। কিছু বাজার-সদাইয়ের দরকার। কিন্তু হাত একদম খালি। আজকালের মধ্যে বাসা ভাড়াও দিতে হবে। কোথায় থেকে দেবেন, এই দুর্দিনে লোকজন তো ধারকর্জও দেবে না। এসব দুশ্চিন্তায় মাওলানা অস্থিরপ্রায়। মাথার উপর দুশ্চিন্তার পাহাড় নিয়ে তিনি হাঁটছেন হাইওয়ের ফুটপাত ধরে। হঠাৎ এক দমকা আউলা বাতাস তাকে দোলা দিয়ে গেল। ফুসফুস ভরে দম নিয়ে মাওলানা একটু থামলেন। আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার করলেন, তার হৃদয়বীণায় রব তুলছে কুরআনিক ইসমে আজমের এই জিকির, ‘ইয়া আইয়্যুহাল্লাযিনা আমানু-সতায়িনু বিস-সাবরি ওয়াস-সালাতি; ইন্নাল্লাহা মাআস-সাবিরীন!’

এই জিকিরে মাওলানার মনের দুশ্চিন্তার পাহাড় তুলোর মতো উড়ে যাচ্ছে। নিজেকে লাগছে প্রাণবন্ত। তার ভেতর থেকে কেবলই তাড়না আসছে, একটা মসজিদে ঢুকে আসরের নামাজটা জামাতের সঙ্গে আদায় করতে হবে।

বাসায় ঢুকে মাওলানা ভীষণ অবাক হলেন। চারদিকে কেমন আমেজমুখর পরিবেশ। ঘরভর্তি আনন্দের হিল্লোল। কলিংবেল চাপতেই আয়াত এসে দরজা খুলে দিল। ওর যেন আগে থেকেই জানা ছিল আব্বু এসেছেন। অথচ আজ তিনি চলে এসেছেন অন্যদিনের তুলনায় অসময়ে। আব্বুকে দেখে আয়াত খুশির জুসে গলা ভিজিয়ে বলল, ‘আব্বু আব্বু, হুজুররা আসছিল। আমাদের ইফতারি আর মজা দিয়া গেছেন।’

ছেলের আনন্দ ঝলমল মুখের দিকে তাকিয়ে মাওলানা মুচকি হাসলেন। খানিকটা খুশির সঙ্গে তার চেহারাজুড়ে ফুটে উঠল বিস্ময় ও কৌতূহলের চিহ্ন। তখনই শোবার ঘর থেকে সিজাদাকে কোলে নিয়ে এগিয়ে এলো মুনা। মাওলানা প্রশ্নবোধক চোখে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। স্বামীর চোখের ভাষা বুঝতে পেরে মুনা সবিস্তারে খুলে বলল ঘটনা।

আসরের নামাজ পড়ানোর জন্য মাওলানা মসজিদে চলে গেলেন। শোবার ঘরে আয়াত আর সিজদাকে খেলায় বসিয়ে মুনা পাকঘরে এলো রাতের রান্নার বন্দোবস্ত করতে। কুলোয় করে চাল পাছড়াচ্ছিল, তখনই শুনল কলিংবেলের শব্দ। পাকঘর থেকে আয়াতকে ডাক পাড়ল, ‘আয়াত, আব্বু দেখো তো কে আসছে।’

মায়ের কথায় আয়াত দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলল। মুনার কানে ভেসে এলো কথোপকথনের শব্দ। আয়াত কারও সঙ্গে কথা বলছে। চাল পাছড়ানো থামিয়ে মুনা উৎকর্ণ হলো। আয়াতকে বলতে শুনল, ‘আব্বু তো বাসায় নাই, মসজিদে গেছেন। আম্মু আছেন বাসায়।’

একটি পুরুষালি কণ্ঠের আওয়াজ ভেসে এলো, ‘তাইলে তোমার আম্মুরে গিয়া বলো, কয়েকজন হুজুর আসছেন। আপনার সাথে একটা দরকারে একটু কথা বলবেন।’

আয়াত ‘জি আচ্ছা’ বলে ছুটে এলো পাকঘরে। কিছু বলার আগেই মুনা ওকে থামিয়ে আব্রুঢাকা হয়ে গেল। দরজার পর্দার পাশে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় বলল, ‘ওনি তো মাত্রই বের হইছেন। ফিরবেন ইশার নামাজ পড়ায়া। কীসের দরকারে আসছিলেন আপনারা?’

পর্দার ওপাশ থেকে লোকটি বিনয়ী গলায় বলে উঠলেন, ‘জি মুহতারামা, আমরা আসছিলাম ‘নুসরাতুল উলামা ফাউন্ডেশন’ থেইকা। এইটা একটা সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। করোনাকালের এই দুর্দিনে আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল আলেমদের সেবা দেওয়াই আমাদের মূল লক্ষ্য। এই ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেইকা রমজান উপলক্ষে এরকম প্রত্যেক আলেমের বাড়িতে একটি করে ‘ইফতার-সাহরি ফ্যামেলি প্যাকেজ’ হাদিয়া দিতাছি। মাওলানা সাহেবের কাছেও এই উদ্দেশ্যে আসছিলাম।’

শুনে মুনা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। স্বামীর অনুপস্থিতিতে এরকম কিছু গ্রহণ করবে কি-না, ব্যাপারটা নিয়ে দোলাচলে পড়ে গেল। পর্দার ওপাশের লোকটি হয়তো এটা আঁচ করতে পেরেছেন, স্মিমুখে বলে উঠলেন, ‘সমস্যা নাই মুহতারামা, আপনি এইটা গ্রহণ করতে পারেন। মাওলানা সাহেবকে আমাদের কথা বললেই ওনি আমাদের চিনবেন।’

বলে একটি মুখবদ্ধ বস্তা ভেতরে ঠেলে দিলেন। মুনা দুপা পিছিয়ে দাঁড়াল। আয়াত এগিয়ে এসে বস্তার মুখে হাত দিয়ে বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে রইল আম্মুর দিকে। পর্দার ওপাশ থেকে লোকটি ওকে ডাক পাড়লেন, ‘ছোট হুজুর, এইদিকে আসেন।’

আয়াত পর্দার ফাঁক গলে দরজার সামনে দাঁড়াল। ওর আব্বুর মতো দেখতে হুজুর লোকটি হাতে একটি খাম ধরিয়ে বললেন, ‘এইটা আপনার আম্মার হাতে দিয়া আসেন।’

আয়াত ছুটে গিয়ে আম্মুর হাতে খামটি দিয়ে এলো। এবার হুজুর লোকটি মিষ্টি হাসিতে মুখ রাঙিয়ে ওর হাতে ধরিয়ে দিল একগাদা চকলেট। আয়াত চমকিত হয়ে তার মুখের দিয়ে তাকাল। হুজুর লোকটি ওর মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে মোলায়েম গলায় বললেন, ‘আমরা আসি ছোট হুজুর। আপনার আব্বারে আমাদের সালাম জানাইবেন। আল্লাহ হাফেজ!’

আয়াত দুহাতভর্তি চকলেট নিয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল লোকগুলোর দিকে।

স্ত্রীর মুখে ঘটনা শুনে মাওলানা চুপচাপ বসে রইলেন। মুনা একটু ভয় পেয়ে গেল, তার স্বামী প্রচণ্ড আত্মমর্যাদাশীল লোক। শত অভাবেও সহজে কারও কাছে হাত পাতেন না। কারও কাছ থেকে কিছু নেওয়ার ব্যাপারেও তিনি খুব সাবধান। আজকের ব্যাপারটা তার আত্মমর্যাদায় কোনো আঘাত করেছে কি-না, এটাই মুনার ভয়ের কারণ। ভয় কাটল স্বামীর প্রসন্ন গলার ডাক শুনে, ‘মুনা, এইটা আমাদের ওপর আল্লা পাকের একটা রহমত। ক্যামনে? শোনো কী হইছে…’

মাওলানা সবিস্তারে বললেন বেরুনোর পর থেকে নিয়ে বাসায় ফেরার আগ পর্যন্ত ঘটনাগুলো। তারপর উপসংহার টেনে বললেন, ‘বুঝলা, এইজন্যই বলতাছি, এইটা আল্লা পাকের রহমত আমাদের উপর। আলহামদুলিল্লাহ!’

বস্তাটা এতক্ষণ দরজার কাছেই পড়েছিল। মাওলানা উঠে গিয়ে এটা তুলতে তুলতে বললেন, ‘হাদিয়া দেখা যায় এখনও খুলে দেখো নাই।’

মুনা স্বামীর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলল, ‘আপনার অপেক্ষায় ছিলাম। এই বরকত তো আপনি ছাড়া খুলতে পারি না।’

স্ত্রীর কথায় মাওলানা প্রাণবন্ত হেসে উঠলেন। আয়াত আর সিজদা আব্বুকে ঘিরে বসল। মুনাও বসে পড়ল ওদের পাশে। বস্তা খুলতেই মাওলানার চোখ খুশিতে চিকমিক করে উঠল। ইফতার ও সাহরি প্যাকেজ মিলিয়ে দশ কেজি জিনিস তারা দিয়ে গেছেন। মাওলানা মন খুলে তাদের জন্য দোয়া করলেন। তখনই মুনা স্বামীর দিকে বাড়িয়ে দিল ওই খামটি। মাওলানা এটার ব্যাপারেও শুনলেন। মুখবদ্ধ খাম খুলতেই দেখা গেল ছয়টা পাঁচশো টাকার চকচকে নোট। দেখে মাওলানা দারুণ আনন্দিত হলেন। আবারও তাদের জন্য হৃদয়ের গভীর থেকে দোয়া করলেন। সেইসঙ্গে নগদ অর্থের ব্যবস্থা দেখে স্ত্রীর সঙ্গে শেয়ার করলেন পরিকল্পিত বিষয়টি।

‘মুনা, এখন তো আমার মসজিদ-মাদরাসা দুইটারই খেদমত বন্ধ। ভাবছিলাম আয়-রোজগারের জন্য অন্য কোনো পথ দেখা যায় কি-না।’

স্বামীর কথায় মুনা একটু কৌতূহলী হয়ে বলল, ‘কী ভাবতাছেন? কী করবেন?’

মাওলানা বোদ্ধার মতো মাথা নেড়ে বললেন, ‘ভাবতাছি, কাঁচাবাজারের একটা ব্যবসা দিলে কেমন হয়? কিছু টাকা-পয়সাও পাওয়া গেল আর সংসারের বাজার-সদাইয়েরও চিন্তা থাকল না। দেখতাছ না, কাঁচাবাজারেও এখন দামের আগুন লাইগা গেছে।’

মুনা একটু নিশ্চুপ থেকে বলল, ‘আপনি পারবেন এই কাজ? কষ্ট হইব তো! সামনে আবার রোজা আসতাছে।’

মাওলানা মুচকি হেসে বললেন, ‘কষ্ট ছাড়া কোনো কিছুতেই সফলতা নাই। যারা রোজা রাইখা দিনমজুরের কাজ করবে, তাদের তুলনায় আমার কষ্ট তো কিছুই না। এর উপর এই রমজান পড়ছে বৈশাখ মাসে। গ্রামের অনেক মানুষ রোজা রাইখা বৈশাখের ধানকাম করব। তাদের কষ্ট তো আরও বেশি।’

মুনা মাথা নেড়ে স্বামীর কথায় সমর্থন জানাল, ‘আইচ্ছা, তাইলে দেখেন। কিন্তু আপনি তো এই লাইনে নতুন। কীভাবে কী করবেন?’

মাওলানা স্মিতমুখে বললেন, ‘এই চিন্তা তোমার করতে হইব না। কাঁচাবাজারের হায়দার চাচা আছেন। তিনি আমার পরিচিত মানুষ। তার সাথে আলাপ করলে একটা গতি হইব।’

মুনা স্বামীর কথায় অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়ে বলল, ‘আইচ্ছা, আল্লাহ আপনার নিয়তরে কবুল করুক। পরিকল্পনারে বাস্তবায়নের তৌফিক দেউক।’

স্ত্রীর চাঁদপানা মুখের দিকে তাকিয়ে মাওলানা উদ্দীপ্ত কণ্ঠে বললেন,‘আল্লাহুম্মা আমিন!’

আব্বুর কথায় আয়াত আর সিজদাও মুখ চাওয়াচাওয়ি করে বলে উঠল, ‘আল্লাহুম্মা আমিন!’

ছেলেমেয়ের এই দোয়ায় স্বামী-স্ত্রী দুজনেই প্রসন্ন মনে দারুণ হেসে উঠলেন।

পয়লা রমজান থেকে মাওলানা শুরু করলেন সবজির ব্যবসা। ‘নুসরাতুল উলামা ফাউন্ডেশন’ থেকে হাদিয়া হিসেবে যে নগদ অর্থ পেয়েছিলেন, ওটাকে পুঁজি করে এই ব্যবসা শুরু করলেন। এই কাজে সার্বিক তদারক ও রাহবার হিসেবে পেয়েছেন হায়দার চাচাকে। তিনি অত্যন্ত সরল-সহজ ও ভালো মানুষ। তার অসিলায় মাওলানার আয়-রোজগারের একটা পথ খুলেছে। আজ দশদিন চলছে তিনি এই ময়দানে নেমেছেন। শুরুর কয়েকদিন কাজটাকে খুব কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু দিনদুয়েক যেতেই পরিস্থিতির মুখে পড়ে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন। যেকোনো পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে দীনের কাজ চালিয়ে যাওয়া একজন আলেমের কর্তব্য। এজন্য মাওলানা দৈনন্দিন রুটিনে পরিবর্তন এনেছেন। এখন রমজান মাস। অধিকহারে কুরআন তেলাওয়াতের সময়। দিনের বেলায় তিনি তেলাওয়াতের সুযোগ খুব কম পান। আধাদিন তাকে ব্যবসার কাছে ব্যস্ত থাকতে হয়। সকাল আটটায় বেরিয়ে ঘরে ফেরেন বিকেল চারটায়। রাতের প্রথম ভাগ চলে যায় তারাবির নামাজ পড়া আর পরিবারের সঙ্গে সময় দিয়ে। এই বছর তিনি নিজের বাসায় সপরিবারে তারাবি পড়ছেন। ইবাদতের জন্য বিস্তর সময় পাওয়া যায় শেষরাতে। শেষরাতের নিষুপ্ত পরিবেশে ইবাদত করলে দারুণ প্রশান্তি পাওয়া যায়। এসময় মুনাও সাহরির জন্য জাগে। মাওলানা নিবিষ্ট মনে তাহাজ্জুদ ও তেলাওয়াতে মশগুল হয়ে পড়েন। তারপর ফরজ পড়ে সকাল সাতটা পর্যন্ত ঘুমিয়ে শুরু করেন কর্মদিবস।

কাঁচাবাজারের মাঠে মাওলানা সবজির পসরা সাজিয়ে বসেছেন। আগে বাজার বসত মলে। করোনার কারণে লোক সমাগম কমাতে একে স্থানান্তর করা হয়েছে সামনের মাঠে। এখানে প্রশাসনকর্তৃক প্রত্যেক দোকানিকে সীমানা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেকেই নিজের সীমানা রশি দিয়ে ঘেরাও করে নিয়েছেন। ক্রেতারা এই ঘেরাওয়ের বাইরে থেকে জিনিস কিনবে। বেশি ভিড়াভিড়ি করা যাবে না। দুজন পুলিশ থাকে গাইড হিসেবে। নিজের স্থানে পসরা সাজিয়ে মাওলানাও বসেছেন। ক্রেতা ধরতে বসে বসে অপেক্ষার কড়ি গুনছেন। এই কয়েকদিনে ব্যবসা সম্পর্কে তার অনেক অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, একজন আলেম যদি মাদরাসা পড়ানো ছেড়ে অন্য কোনো পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করেন, তাহলে সমাজের কথিত সুশীলশ্রেণি তাকে নিয়ে খুব কটাক্ষ করে। গতকাল মাওলানা এমন একজন সুশীলের কটাক্ষের শিকার হয়েছেন।

লোকটার সঙ্গে মাওলানার কোনোদিন কথাবার্তা হয়নি। তিনি যে মাদরাসায় পড়ান, এর পাশেই তার বাসা। জেনারেল লাইনে ভালো লেখাপড়া করেছেন। বর্তমানে এক ব্যাংকে উচ্চপদস্থ চাকুরে হিসেবে আছেন। আলেমদের প্রতি তার বিদ্রুপী মনোভাবের ব্যাপারটা মোটামুটি সবারই জানা। বাজারের ব্যাগ হাতে ওই লোক মাওলানা দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালেন। মাওলানা প্রথমে তাকে চিনতে পারেননি। পিপিই, মাস্ক পরে পুরোদস্তুর আজনবি হয়ে তার সঙ্গে সবজির দর কষাকষি শুরু করলেন, ‘আলু কত কেজি?’

‘৪০ টাকা?’

‘এখানে এত দাম ক্যান?’

‘সব জায়গাতেই এক দাম স্যার।’

‘পাবদাটা কত রাখা যাইব?’

‘আগে একটা বিক্রি করছি ৪৫ টাকা দিয়া। এইটা একটু ছোট। ৪০ টাকা রাখতে পারমু।’

৩০ টাকা দিলে চলবে না?’

‘না স্যার, লস হইব। ৩৫ টাকা আমার কেনা পড়ছে।’

‘কী বলেন, এই পাবদা ৪০ টাকা। ২০ টাকা দিলেই বেশি। এইটা দেখা যায় ডাকাতি।’

মাওলানা কথাটিকে আমলে নিলেন না। স্মিতমুখে বললেন, ‘স্যার, আমি সত্যটা আপনারে বললাম। আমার যত কেনা পড়ছে, এর থেইকা ৫ টাকা লাভ দিয়া বেচতাছি। লস দিয়া বেচলে তো আমার পুষবে না।’

লোকটা এবার আসল রূপ জাহির করলেন, ‘আরে মিয়া রাখেন আপনার লাভ-লস। থাকছেন তো খালি মাদরাসা আর মসজিদ নিয়া। আপনি বিজনেসের লাভ-লস কী বুঝবেন! আমারে লাভ-লস চিনাইতে আসছেন মিয়া!’

লোকটার কটাক্ষগুলো মাওলানার মনে তীরের মতো বিঁধল। তিনি কিছু না বলে ধৈর্য ধরে চুপ করে থাকলেন। আশপাশের দোকানিরা ফ্যালফ্যালে চোখে তাকিয়ে দেখল এই ঘটনা।

আজ সকালের দিকে ক্রেতাদের ভিড় একটু বেশি ছিল। মাওলানা একা হাতে সবজি মেপে দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না। তিনি খুব সততা ও আমানতদারিতার সঙ্গে ব্যবসা করছেন। আড়তে গিয়ে সবজি কেনেন টাটকা দেখে। সব একদিনের উপযোগী করে আনেন। আল্লাহর রহমতে প্রতিদিনই তার টার্গেট পূরণ হয়। টাটকা জিনিস পাওয়া যায় বলে মাওলানার দোকানে ক্রেতাদের ভিড়টা একটু বেশি পড়ে যায়। এটাই বিষের কাঁটা হয়ে দাঁড়াল দুয়েকজন দোকানির চোখে। সকালের এই ভিড়াভিড় সময়ই তার দোকানে এক টিভি সাংবাদিক এসে হাজির। মাওলানার দিকে ক্যামেরা তাক করে মাইক্রোফোনে উপস্থাপনা শুরু করলেন, ‘সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষা করে বল্গাহীনভাবে চলছে কাঁচাবাজার। ক্রেতা এবং বিক্রেতারা কেউই মানছেন না স্বাস্থ্যবিধি। কারও মধ্যেই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কোনো বালাই নেই। এ নিয়ে আমরা একজন দোকানির সঙ্গে কথা বলছি।’

সাংবাদিক মাইক্রোফোন বাড়িয়ে ধরলেন মাওলানার মুখের সামনে। ঝটপট প্রশ্ন ছুঁড়ে বসলেন, ‘আপনি যে এত ভিড়াভিড়ির মধ্যে সবজি বিক্রি করছেন, আপনার কি মনে হয়, এতে করে সরকারি নির্দেশনা এবং স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘিত হচ্ছে না?’

অবস্থা বেগতিক দেখে মাওলানাকে বলতে হলো, ‘আমি প্রাণপণে চেষ্টা করছি সরকারি নির্দেশনা এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য। কিন্তু ক্রেতারা যখন নিজের থেকে আমার দোকানের সামনে এসে ভিড় করেন, তখন আমি তাদের কয়জনকে আটকাব? এক্ষেত্রে আমি তো অপারগ! আমি আমার পক্ষ থেকে পরিষ্কার আছি, আলহামদুলিল্লাহ!’

মাওলানা এত গুছিয়ে কথা বলবেন, এটা টিভি সাংবাদিক আশা করেননি। তিনি খুব অবাক হয়ে আর কথা না বাড়িয়ে স্থান ত্যাগ করলেন। ব্যাপার হলো, এই ভিড়টা টিভি সাংবাদিক আসার কারণেই লেগেছিল। ক্রেতারা এবং অন্য দোকানিরা কিছুক্ষণের জন্য বেচাকেনা থামিয়ে জড়ো হয়েছিল মাওলানার মাওলানার দোকানের ‘তামাশা’ দেখতে। সাংবাদিকের ক্যামেরাঅলা এই ভিড়-দৃশ্যের ভিডিও করে তাদের টিভি চ্যানেলের মার্কেটিং করছিল।

দোকানের পসরা গুটিয়ে মাওলানা বাসার পথ ধরলেন। তার হাতে টাটকা সবজিভর্তি বাজারের ব্যাগ। আল্লাহর রহমতে এখন প্রতিদিনই টাটকা সবজি খেতে পারছেন। অনেক দোকানদার নিজের ঘরের লোকদের জন্য বাসি এবং লাস্ট পিস জিনিস নিয়ে যায়। এক্ষেত্রে মাওলানা খুবই সতর্ক ও রুচিশীল। তিনি আড়তে গিয়ে তরতাজা ও ভালো দেখে সবজি, ফলমূল কেনেন। বাজার-সদাইয়ের ব্যাপারে মাওলানার যেমন আগ্রহ, রান্নাবান্নার প্রতি তার স্ত্রীর আগ্রহ তত বেশি। এই ব্যাপারে মুনার আনন্দটা দেখার মতো। ঘরনি নারীরা মনের মতো রান্না করে ঘরের লোকদের খাইয়ে যে সুখ পায়, এই সুখের কোনো বাজারমূল্য হয় না। মাওলানা প্রতিনিয়ত তার স্ত্রীকে এমন সুখী মুখে দেখতে চান।

বাসায় ঢোকার মুখে মাওলানার দেখা হয়ে গেল বাড়িওয়ালার সঙ্গে। মাহতাব সাহেব পায়চারি করছিলেন। মাওলানাকে বাজারের ব্যাগ হাতে আসতে দেখে স্মিতমুখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মাওলানা সাব, আজ কী বাজার নিতাছেন?’

মাওলানা তার দিকে এগিয়ে গেলেন। হাসিমুখে জানালেন, ‘চাচা, আল্লার রহমতে এখন প্রতিদিনই টাটকা সবজি খাইতে পারি।’

ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে একটি গাছপাকা পেঁপে বের করে বললেন, ‘নেন চাচা, এই পাবদাটা দিয়া আপনি আজ ইফতার কইরেন।’

মাহতাব সাহেব আনন্দ গদগদ কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘আরে মাওলানা করেন কি, এইটা আপনার পোলাপানে খাইব নে।’

‘পোলাপান চাচা প্রতিনিয়ই খায়। আজ তারা অন্যকিছু খাইব। আপনি এইটা রাইখে দেন।’

মাহতাব সাহেব খুশি মনে পেঁপেটা নিলেন। মাওলানা ‘যাই চাচা’ বলে এগিয়ে গেলেন বাসার দরজার দিকে।

কলিংবেলে চাপ দিতেই মুনা এসে দরজা খুলে দিল। মিষ্টি হেসে অভ্যর্থনা জানাল ঘরে। কিন্তু আজকের হাসিটা অন্যদিনের তুলনায় প্রাণবন্ত মনে হলো না। স্ত্রীকে ব্যাপারটা বুঝতে না দিয়ে মাওলানা বাসায় ঢুকলেন। একটু অবাক হলেন সুনসান পরিবেশ দেখে। প্রতিদিন এসময়ে বাসাজুড়ে আনন্দের হিল্লোল বয়ে যায়। তাকে ভেতরে ঢুকতে দেখেই আয়াত আর সিজদা আব্বু আব্বু বলে খুশিতে ডগোমগো হয়ে কোলে উঠতে চায়। মাওলানা ওদের থামিয়ে আগে বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেন। হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে দুহাত ভালোভাবে ধুয়ে অজু করেন। তারপর আয়াত আর সিজদাকে কোলে নিয়ে শোবার ঘরে ঢুকে মেতে ওঠেন খেলায়। আব্বুকে নিজেদের তুলনায় বড় শিশু মনে করে আয়াত আর সিজদা শিশুসুলভ দুষ্টমিতে মেতে ওঠে। আজ ওসবের কিছুই হলো না। আয়াত বা সিজদা কারওর সাড়া পাওয়া গেল না। মাওলানা বাথরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে নিলেন। স্বামীর হাত থেকে ব্যাগটি নিয়ে মুনা চলে গেল পাকঘরে।

শোবার ঘরে আয়াত ঘুমাচ্ছিল। ওর পাশে বসে খেলছিল সিজদা। মাওলানা ফ্রেশ হয়ে ছেলেমেয়ের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে ওই ঘরে ঢুকলেন। আব্বুর কণ্ঠ শুনে সিজদা খুশিতে ডগমগিয়ে উঠল। আব্বু আব্বু বলে হাত বাড়িয়ে দিল কোলে নেওয়ার জন্য। মাওলানা ওকে হাসিমুখে কোলে নিয়ে বসলেন আয়াতের পাশে। ছেলেটি কেমন নিসাড় হয়ে ঘুমাচ্ছে। পাকঘর থেকে মুনা এসে বসল স্বামীর পাশে। মাওলানা আয়াতকে একনজর দেখে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আয়াত এখনও ঘুমাইতাছে নাকি?’

মুনা ফাঁৎ করে নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘দুপুর থেইকাই ওর শরীরে একটু জ্বর জ্বর ভাব। গোসল করায়া ঘুম পাড়াইছিলাম। হঠাৎ শুনি জোরে জোরে দম ফেলতাছে। আমি হাতপাখা দিয়া বাতাস কইরেও পারতাছি না। জ্বরও বাড়তাছে। একটু আগে মাথায় পানি ঢালছি। এখন একটু ঘুমাইছে।’

স্ত্রীর কথায় মাওলানার মুখজুড়ে উৎকণ্ঠা দানা বেঁধে উঠল। তিনি খানিকটা ক্ষুব্ধ গলায় বললেন, ‘ছেলের এই অবস্থা, তুমি আমারে ফোন দিয়া জানাইবা না?’

মুনা আধোআধো গলায় বলল, ‘আপনার তো ওই সময় অনেক ঝামেলা থাকে, তাই ফোন দেই নাই।’

ক্ষুব্ধতার স্বরে মাওলানা বললেন, ‘এইরকম অবস্থায় অতশত ভাবলে চলব? মনে রাইখো, ব্যবসা আমার কাছে কিছুই না। আগে আমার পরিবার, পরে অন্যকিছু।’

মুনা মাথা নুইয়ে স্বামীর কথা শুনল। মাওলানা ছেলের কপালে হাত রাখলেন। আব্বুর হাতের পরশ পেয়ে আয়াত জেগে উঠল। ঘোলাটে চোখে আব্বু-আম্মুর মুখের দিকে একপলক তাকিয়ে দম ফেলতে লাগল জোরে জোরে। মুনা ব্যস্তসমস্ত হয়ে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতে লাগল। মাওলানা অস্থির হয়ে ওর মাথার কাছে মুখ এনে বললেন, ‘আব্বু, কী হইছে তোমার? কষ্ট হইতাছে?’

আয়াত পানির কথা বলল। মুনা চটজলদি নিয়ে এলো এক গ্লাস পানি। এক ঢোক খেয়ে আয়াত আবারও জোরে জোরে দম ফেলতে লাগল। মাওলানা বুঝতে পারলেন অবস্থা বেগতিক। আর দেরি করলেন না, ছেলেকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। একটা রিকশা ডেকে ছুটলেন হাসপাতালের দিকে। মেয়েকে কোলে নিয়ে অজানা আশঙ্কায় জমে গিয়ে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইল মুনা। স্বামী ও ছেলের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে তার চোখদুটো ছলছল করে উঠল। সিজদা অপার বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল আম্মুর অশ্রুসজল মুখটি।

ডাক্তারের চেম্বারে বসে আছেন মাওলানা। তার কোলে আয়াত। এখানে ঢোকার আগে দুটো পিপিই কিনতে হয়েছে, সেইসঙ্গে ডাক্তারের ভিজিট গুনতে হয়েছে ৮০০ টাকা। এসময়ে পিপিই ছাড়া কোনো ডাক্তারই রোগীদের সাক্ষাৎ দেন না। এটাই নাকি স্বাস্থ্যবিধি। দুটো পিপিই মাওলানার উপযোগী। দাম নিয়েছে ১,০০০ টাকা। আয়াতের পিপিই কোনোভাবেই শরীরের সঙ্গে আঁটছে না। কীভাবে আঁটবে, একজন পূর্ণবয়সী মানুষের পিপিই পরানো হয়েছে একটি বাচ্চা ছেলেকে। এটা তো সাক্ষাৎ ডাকাতি। করোনাকালে চেম্বার-হাসপাতালগুলোতে স্বাস্থ্যবিধির দোহাই দিয়ে এভাবেই ডাকাতি চালানো হচ্ছে।

আয়াতকে কোলে নিয়ে মাওলানা ডাক্তারের মুখোমুখি বসলেন। ডাক্তার ওকে হাঁ করতে বললেন। জিহ্বায় থার্মোমিটার সেঁটে পরীক্ষা করলেন জ্বর। একটু ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘জ্বর কবে থেকে?

মাওলানা উত্তর দিলেন, ‘আজ দুপুর থেইকা।’

ডাক্তার রিপোর্ট দেওয়ার মতো করে বললেন, ‘জ্বর তো ১০৩ ডিগ্রিতে ওঠানামা করছে।’

তারপর স্টেথোস্কোপ লাগিয়ে বুক পরীক্ষা করলেন।

‘কফ আছে? শ্বাস নিতে কষ্ট হয়?’

মাওলানা মাথা নেড়ে জানালেন, ‘জি, কফ একটু আছে। আর দম ফেলতে খুব কষ্ট হয়। দুপুর থেইকাই এই সমস্যায় ভুগতাছে।’

এবার ডাক্তার প্রেসক্রিপশন লেখতে লেখতে বললেন, ‘হুজুর, আপনার ছেলের করোনা টেস্ট করতে হবে। ওর শরীরের করোনার উপসর্গ দেখা গেছে।’

শুনে মাওলানা একেবারে আকাশ থেকে পড়লেন। থতমত খেয়ে বললেন, ‘স্যার, কী বলতাছেন আপনি। ওর শরীরের করোনার উপসর্গ দেখা দিছে!’

ডাক্তার মাথা নাড়লেন, ‘ইয়েস, ওর জ্বর ১৩০ ডিগ্রিতে ওঠানামা করছে। ভেতরে কফ জমে শুরু হয়েছে শ্বাসকষ্ট। এগুলোকেই এখন করোনার উপসর্গ হিসেবে ধরা হয়। আপনি এত ঘাবড়াবেন না। আমরা শুধু নমুনাটা টেস্ট করব।’

মাওলানা ছেলেকে জড়িয়ে ধরে চুপচাপ বসে রইলেন।

ডাক্তার তাড়া দিলেন, ‘আপনি আমাদের ল্যাবে গিয়ে টেস্টটা করিয়ে নিন। আর আপনাদের ফ্যামেলির সবাইকেই ১৪ দিন পর্যন্ত হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে। আশা করছি এই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবেন। আসুন, থ্যাংক ইউ।’

আয়াতকে কোলে নিয়ে মাওলানা ল্যাবের দিকে গেলেন। কাউন্টারে টেস্টবিল দিতে গেলেন, বিল এলো ৫,০০০ টাকা। ডাক্তাররা কীভাবে ঠান্ডা মাথায় ডাকাতি করে, মাওলানা আজ প্রত্যক্ষ করলেন। তার হাতে টেস্ট রিপোর্ট দিয়ে বলা হলো, এই পরীক্ষা ছিল সতর্কতামূলক। তেমন সমস্যা নেই, শুধু হোম কোয়ারেন্টাইনের নিয়মটা মেনে চলতে হবে। মাওলানা দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে ছেলেকে কোলে নিয়ে ল্যাব থেকে বের হলেন। ডাক্তারের কসাইখানায় গিয়ে তার পকেট কাটা গেছে। ব্যবসার যা পুঁজি ছিল, সবই গচ্ছা দিতে হয়েছে এখানে। খালি হাতে বাসায় ফিরে এবার তাকে ঘরবন্দি দিন কাটাতে হবে। বিষয়টি ভাবতেই তার মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। বর্তমান সমাজব্যবস্থা হয়ে গেছে মাকাল ফলের মতো, যার বাইরের দিকটা খুব চকমকে আর আকর্ষণীয়, কিন্তু ভেতরের দিকটা বিষের বাষ্পে নীল হয়ে আছে। করোনা মহামারির দুঃসময়ে এদিকটা প্রকটভাবে ধরা পড়েছে। মাওলানার মতো এরকম ভুক্তভোগীরা যারা, সব হারিয়ে তাদের জীবন হয়ে উঠছে দুর্বিষহ।

ইফতারের আর সামান্য সময় বাকি। মাওলানা ছেলেকে কোলে নিয়ে বাসার দিকে হাঁটা দিলেন। পকেট একদম খালি, রিকশা নেওয়ার মতো ভাড়াও নেই। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ নিতে গিয়ে শেষ সিকিটুকুও খরচ করতে হয়েছে। ছেলেকে কোলে নিয়ে তিনি দ্রুত হাঁটছেন। আব্বুর কোলে মাথা দিয়ে আয়াত নিশ্চেন্তে চোখ বন্ধ করে আছে। মাওলানার নিয়ত বাসায় গিয়ে ইফতার করবেন। তার স্ত্রী নিশ্চয় অপেক্ষায় অস্থির হয়ে আছে। কিন্তু পৌরসভার মোড় পর্যন্ত আসতেই বেজে উঠল ইফতারের সাইরেন। মাওলানার ভেতর থেকে আক্ষেপ বেরিয়ে এলো, আহ, ঠিক সময়ে পৌঁছতে পারলেন না।

মাওলানা মোড় পেরিয়ে যাবেন, হঠাৎ শুনেন কেউ একজন তাকে ডাকছেন, ‘মাওলানা সাব, আজগো আমার সাথে ইস্তারি কইরে যাইন।’

মাওলানা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন। দেখলেন ফুটপাতে এক বৃদ্ধ ভিক্ষুক ইফতার সাজিয়ে বসে আছেন, তাকে দাওয়াত দিয়ে ডাকছেন। দুশ্চিন্তা আর অস্থিরতা ঝেড়ে ফেলে মাওলানা তার দাওয়াতে সাড়া দিলেন। ছেলেকে সাথে নিয়ে বসে পড়লেন রাস্তার ধুলোতে। বৃদ্ধ আনন্দিত মনে তাদের নিজের কাছে বসালেন। মাওলানার দিকে বাড়িয়ে দিলেন পানির বোতল। আয়াতকে একটি খেজুর সেধে বললেন, ‘নেও বাবা, খাও এইটা!’

আয়াত খেজুরটি নিয়ে চুপচাপ খেতে লাগল। বৃদ্ধ মাওলানার দিকে মুড়ির বাটি বাড়িয়ে প্রসন্ন গলায় বললেন, ‘নেইন মাওলানা সাব, খই খাইন।’

মাওলানা তার দিকে তাকিয়ে হৃদয় থেকে কৃতজ্ঞতার হাসি উপহার দিলেন। দোয়া পড়ে মুখে পুরলেন মুঠোভর্তি মুড়ি। খেতে খেতে বৃদ্ধ তাকে বললেন, ‘মাওলানা সাব, হুনছি রোজাদাররে ইস্তারি করাইলে নাহি তার হমান সওব পাওন যা। আইচ্ছা, আমিও কি এই সওবডা পাইয়াম?’

মাওলানা মুঠোভর্তি মুড়ি নিয়ে মুগ্ধচোখে বৃদ্ধের দিকে তাকালেন। দৃষ্টির দিব্যতা দিয়ে দেখতে লাগলেন তার দরিদ্রক্লিষ্ট মুখটি। অভাবের অথই সাগরে পড়েও তিনি সওয়াবের অন্বেষণ করছেন। মাওলানা মাথা নেড়ে উত্তর দিলেন, ‘জি চাচা, অবশ্যই পাইবেন। আল্লার আদালতে সব বান্দাই সমান।’

বৃদ্ধ মুঠোভর্ভি মুড়ি মুখে পুরতে পুরতে বলল ‘শুক্কুর আলহামদুলিল্লাহ!’

বৃদ্ধের অমায়িক ব্যবহার মাওলানার মন ছুঁয়ে গেল। সমাজের গৌরব এভাবেই ধুলোয় পড়ে থাকে।

১০

২৭ শে রমজান। আজই শেষ হলো মাওলানার ১৪ দিনের হোম কোয়ারেইন্টাইন। এক অবর্ণনীয় যাতনার মধ্য দিয়ে পার করতে হয়েছে দিনগুলো। প্রশাসনকর্তৃক বাসার সামনে লাল পতাকা টানিয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ ডাক্তার দেখানোর দুদিন পরেই আয়াত দিব্যি সুস্থ হয়ে হেসেখেলে ঘরময় বেড়াতে লাগল। আটকা পড়লেন মাওলানা। তিনি কোথাও যেতে পারছেন না, সবজির ব্যবসা তো পুরোই লাটে উঠে গেছে। সরকারি আইনের যাঁতাকলে পড়ে দিনরাত পৃষ্ট হয়েছেন। কিন্তু এই দুঃসহ দিনগুলোতেও তিনি কারও মুখাপেক্ষী হননি। তার যা চাওয়ার, সবই আল্লাহ তায়ালার কাছে চেয়েছেন। বিনিময়ে পেয়েছেন এক আমলি জিন্দেগি এবং নেয়ামতের অনন্য ঢালি।

১৪ দিনের হোম কোয়ারেইন্টানে মাওলানা কুরআন খতম করেছেন সাতবার। দুদিনে এক খতম করে পড়েছেন। স্ত্রী-সন্তানদেরও শরিক করেছেন এই খতমে। তাদের নিয়ে ঘরের মধ্যে কায়েম করেছেন কুরআন শিক্ষার দরস এবং দীনিয়াতের মজমা। রমজান মাসের পবিত্রতায় তার ঘর ভরিয়ে তুলেছেন। সবচেয়ে সুখের কথা হলো, এই হোম কোয়ারেন্টাইনের ভেতরেই মহান আল্লাহর অপার কুদরতে পূরণ হয়ে গেছে মাওলানার সকল অভাব ও প্রয়োজন। মুহতামিম সাহেব তিনমাসের বেতন ঈদবোনাসসহ পাঠিয়ে দিয়েছেন। মফিজ সাহেবও সুস্থ্য হয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন মসজিদের বেতন ও ঈদবোনাস। হায়দার চাচা খবর পাঠিয়েছেন, তিনি চাইলে আবারও সবজির ব্যবসা শুরু করতে পারবেন। আর বাড়িওয়ালা মাহতাব সাহেব তার প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে মওকুফ করে দিয়েছেন দুমাসের বাসা ভাড়া। এই সমস্ত নেয়ামতে শোকরগুজারি করতে মাওলানা নিয়ত করেছেন, রমজানের এই তিনদিনে আরও তিন খতম কুরআন তেলাওয়াত করে দশ খতম পূর্ণ করবেন।

মাওলানা শোবার ঘরে বসে কুরআন তেলাওয়াত করছেন। অনেকক্ষণ হলো ঘরে বিদ্যুৎ নেই। গুমোট গরমে তেলাওয়াত করতে করতে ঘেমেনেয়ে যাচ্ছেন তিনি। আয়াত আর সিজদা বসার ঘরের ফ্লোরে শুয়ে খেলছে। ওদের গরম-ঠান্ডার কোনো বালাই নেই। পাকঘরে রান্নার বন্দোবস্ত করছে মুনা। কিছুক্ষণ আগে বাড়িওয়ালী চাচি কতখানি গরুর গোশত দিয়ে গেছেন। মুনা ডিম ভুনার জন্য পেঁয়াজ-রসুন কাটতে বসল। তখনই চাচি এসে হাজির।

‘বউ, আজ শবে কদর। শুনছি এইদিনে ভালো কিছু রান্না করা লাগে। নেও একটু গোশত আনছিলাম তোমরার লাগিন। পোলাপানরে রাইন্ধা খাওয়াইয়ো।’

মুনা হাসিমুখে বলে উঠল, ‘না চাচি, আমাদের ঘরে ডিম আছে। আজ ডিম ভুনা করমু। এইটা চাচাজিরে রাইন্ধা দিয়েন।’

চাচি জোর গলায় বললেন, ‘আরে বউ রাইখা দেও। আমরাও আজ রানতাছি। এইটা তুমি পোলাপানরে রাইন্ধা দিয়ো।’

মুনা আর না করার সুযোগ পেল না। গোশতটা একটা পাতিলে রেখে দুটো কাগজি লেবু চাচির হাতে দিয়ে বলল, ‘নেন চাচি, লেবুটা চাচাজির পাতে দিয়েন।’

বাড়িওয়ালী চাচি লেবু নিয়ে হাসিমুখে চলে গেলেন। মুনা পাকঘরে গিয়ে গোশত রান্নার উপযোগী পেঁয়াজ-রসুন নিয়ে বসল।

নির্দিষ্ট পরিমাণ তেলাওয়াত করে মাওলানা কুরআন শরিফ উঠিয়ে রাখলেন। স্ত্রীর সঙ্গে খোশগল্প করতে চলে এলেন পাকঘরে। হাসি হাসি মুখ করে স্ত্রীর পাশে বসে রসুনের কোয়া ছাড়াতে লাগলেন। স্বামীর দিকে তাকিয়ে মুনা একগাল মিষ্টি হাসল। তার মুখ ঘামে ভেজা। স্বামীর ঘামে ভেজা মুখটির দিকে মুনা যতবার তাকায়, ততবার তার মনে অসম্ভব মায়া কাজ করে। তখনই মনে মনে গেয়ে ওঠে সেই অমিয় পংক্তিটি। আজ মনের অজান্তে একটু গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠল। মাওলানার কানে বাজতেই তিনি হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী গাও? মাশাল্লাহ, সুরটা খুব শ্রুতিমধুর!’

স্বামীর কথায় মুনা একটু শরম পেয়ে গেল। পরক্ষণেই লাজ ভেঙে বলে উঠল, ‘আপনার মনে আছে, আমারে যেদিন প্রথম দেখতে গেছিলেন, তখন আমাদের আলাদাভাবে কথা কওয়ার সময় কারেন্ট চইলা গেছিল আর আপনি ঘামে ভিইজা যাইতাছিলেন। ওই সময় আমি আপনারে একটা হাতরুমাল দিছিলাম। আপনার মনে আছে ওইখানে কী লেখা ছিল?’

স্ত্রীর স্মৃতিজাগানিয়া জিজ্ঞাসায় প্রাণবন্ত হেসে উঠলেন। রসুন ছাড়ানো থামিয়ে শোবার ঘরে গেলেন। ফিরে এলেন মুঠোবদ্ধ হাত নিয়ে। ওটা স্ত্রীর সামনে মেলে ধরে বললেন, ‘এই যে ওই রুমাল, এখনও রাখছি যতন কইরে।’

মুনা বিস্ময়ে আনন্দে হতবাক হয়ে রুমালটি হাতে নিল। আট বছর আগে এই রুমাল তার স্বামীর হাতে দিয়েছিল। এতদিন তার মনে হয়েছিল, তিনি হয়তো রুমালটা দুয়েকদিন ব্যবহার করে ফেলে রেখেছেন। কিন্তু মুনা বিপুল বিস্ময়ে দেখল, তার স্বামী প্রথম দেখার স্মৃতিচিহ্নটি আজও হৃদয় দিয়ে আগলে রেখেছেন। দেখে স্বামীর প্রতি ভালোবাসায় ছলছল করে উঠল মুনার চোখদুটো। মাওলানা স্ত্রীর আবেগ বুঝতে পেরে সুধামাখা গলায় বললেন, ‘এইটা একটু গাও শুনি। তোমার গলার সুর তো পাখির গানের চাইতেও মাশাল্লা!’

মুনার স্বামীর দিকে তাকিয়ে কপট রাগ দেখিয়ে বলল, ‘হইছে হইছে, আর কওয়া লাগব না।’

মাওলানা আবেগ দেখালেন, ‘আরে গাও না একটু। কতদিন তোমার সুর শুনি না।’

ভালোবাসার আবেহায়াতে গলা ভিজিয়ে মুনা গেয়ে উঠল,

‘আদর করে দিলাম রুমাল
যতন করে রাখিয়েন,
আমার কথা মনে হলে
রুমাল খুলে দেখিয়েন।’

আগের সংবাদআজ আগামী
পরবর্তি সংবাদকবিতা