আবদুল্লাহিল বাকি:
‘জীবন কী? জীবন হলো অনবরত স্মৃতির তরঙ্গাভিঘাত। বিস্মৃতির মহাসাগরে ডুবে যাচ্ছে ক্রমশ। মৃত্যু হল সাগরের ওপারের স্থির শান্ত বন্দর।’
—নাজিব মাহফুজ
শুরুতেই তুলে ধরলাম, জীবন সম্পর্কে নোবেল লরিয়েট উপন্যাসিক নাজিব মাহফুজের একটা উক্তি। তিনি যেমনটা বলেছেন— সেভাবেই হয়তো আমার যত স্মৃতি আছে মাদরাসাতুল মদিনাকে ঘিরে— একে একে সব ডুবে যেত বিস্মৃতির মহাসমুদ্রে। কিন্তু আমার রোজনামচার খাতা কটি স্মৃতিগুলোকে ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষা করেছে, ছোট ছোট নৌকোর মত।
হেফজখানায় থাকতেই আমি প্রথম মাদরাসাতুল মদিনার কথা শুনেছিলাম। আমাদের হিফজখানার হুজুর ছিলেন আদীব হুজুরের দ্বিতীয় ভাই সাঈদ আল মিসবাহ সাহেবের ছাত্র। তিনি আমাদেরকে আদিব হুজুর (মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ) ও তার প্রতিষ্ঠিত মাদরাসাতুল মদিনার কথা বলতেন। হুজুরের কথা শুনে আমার সামনে স্বপ্নময় এক রঙ্গিন জগতের চিত্রকল্প ভেসে উঠতো।
আমার মাঝে তখন মাদরাসাতুল মদীনার প্রতি বিপুল আগ্রহ ও কৌতূহল জন্ম নিয়েছিল। না, হুজুরের স্বপ্নিল বিবরণের কারণে নয়। আগ্রহের মূল হেতু ছিল— আদীব হুজুরের কয়েকটা বইপাঠ। এসো কলম মেরামত করি, বাইতুল্লাহর মুসাফির আর জীবন পথের পাথেয়। আল কলম পুষ্পও পড়েছিলাম, বিভিন্ন স্থান থেকে। বইগুলো পড়ে আমার মনে হয়েছিল— তিনি ছাত্রদেরকে সরাসরি প্রচুর সময় দেন। আমিও ছিলাম সেটার প্রত্যাশী। কিন্তু আমার ভাবনাটা ছিল বাস্তবতার সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে।
১৪৩৩ সালের রমজান মাসে আমি মাদরাসাতুল মদিনার আধা পরিচয় নিয়ে, কামরাঙ্গীরচর যাই আব্বুর সাথে। লোহারপুল থেকে নেমে যেতেই পুরান ঢাকার পথ ‘বায়ান্ন সড়কের তেপ্পান্ন গলি’তে হারিয়ে যায়। জনগণের ভিড়, ধুলো ওড়া সরু সড়ক, ঐতিহ্যবাহী ঘোড়ার গাড়ির টক টক শব্দ, প্লাস্টিক আর স্যান্ডেল কারখানার ভ্যাপসা গন্ধ— আমার সামনে নতুন একটা বলয়ের ছবি চিত্রিত করেছিল সেদিন, যার সাথে আমার আগে কখনো পরিচয় ছিল না।
এদিক সেদিক বিভিন্ন গলি ঘোরাঘুরি করে, রাস্তার ব্যস্ত মানুষদেরকে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে করে— অবশেষে খুজে পেলাম কুমিল্লাপাড়ায় ‘হৃদয় কনফেকশনারী’র বিপরীতে তেতলা একটা পুরনো ভবন। সামনে কোন নেমপ্লেট অথবা সাইনবোর্ড নেই। দেয়ালগুলোতে খসে পড়েছে পলেস্তরা। জায়গায় জায়গায় পুরনো ইট হা করে আছে। মাদরাসার সামনে কারেন্টের তারের জঞ্জাল। তারগুলো খুব ভয়ংকর ও বিপদজনক। এই তারের থাবায়, চতুর্থ বর্ষে থাকাকালীন দেখেছিলাম, মাদরাসার একজন খাদেম মরে যেতে যেতেও বেঁচে গিয়েছিলেন। কারেন্ট তাকে শক্তভাবে ধরে রেখেছিল। আগুনের ধোঁয়া বেরুচ্ছিল তার পায়ের পাতা থেকে। আমাদের কারোর কিছুই করার ছিল না। কারেন্ট তারগুলো কেবলমাত্র মাদরাসার নয়। পুরো শহরের। উপরের বর্ষের এক ভাই ঝাড়ু দিয়ে আঘাত করে তাকে বাঁচাতে গিয়েছিলেন। কিন্তু তারও একই পরিণতি হয়। সেও ফেঁসে যায় বৈদ্যুতিক তারের অক্টোপাসীয় কামড়ে। কিন্তু ভাগ্যিস, মুহূর্তেই কারেন্ট চলে যায়। আর কারেন্টের তার থেকে মুক্তি পেয়ে তারা দুজন ছিটকে পড়েন খানিকটা দূরে। অজ্ঞান অবস্থায় তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে।
মাদরাসায় ঢোকার পর দেখেছিলাম, অল্প কজন ছাত্র। সবার পরনে সাদা পাঞ্জাবি পাজামা। অধিকাংশের পাঞ্জাবি কলারহীন। মাথায় নকশা-বিহীন সাদা পাঁচকল্লি টুপি। আদিব হুজুর অবশ্য কখনোই এটার ক্ষেত্রে পাঁচকল্লি নামটি ব্যবহার করতেন না। বলতেন, গোল টুপি। এখানে আসার পূর্বে আমি ভেবেছিলাম, শিক্ষাগত দিক থেকে মাদরাসাটি যেহেতু আধুনিক, সেহেতু ছাত্রদের বাহ্যিক চলাফেরায় হয়তো এর প্রকাশ থাকবে। কিন্তু আমাকে দেখতে হল ভিন্ন এক করুণ চিত্র। যে চিত্রে চিত্রিত হয়ে উঠেছিলাম একদিন আমি নিজেই। যা আমাকে আঁকড়ে থেকেছিল দীর্ঘকাল।
যোহরের ওয়াক্তে সেখানে পৌঁছেছিলাম। নামাজ শেষ করে আমাদেরকে আদীব হুজুরের সাথে দেখা করতে নিয়ে যাওয়া হয়। কারণ, মাদরাসাতুল মদিনায় ভর্তির নিয়ম হল— যাকে দেখে আদিব হুজুর পছন্দ করবেন, তাকেই শুধু পরবর্তী ভর্তি-পরীক্ষার সুযোগ দেওয়া হবে।
এর আগে কখনও তাঁকে দেখিনি। এমনকি তাঁর বয়স সম্পর্কেও জানতাম না। পুষ্প আর এসো কলম মেরামত করি পড়ে ধারণা হয়েছিল, বয়স হয়তো যৌবনে সীমা থেকে বেরিয়ে গেলেও পৌঢ়ত্বে পা দেয়নি। কিন্তু দেখলাম তিনি ঊনষাট বছরের বৃদ্ধ। ফর্সা নূরানী চেহারা। ধূসর-শুভ্র বাবরি চুল মাথায়। চাপ দিয়ে টুপি পড়ার কারণে অন্যরকম একটা ঢেউ সৃষ্টি হয়েছে। মুখে দুই মুষ্টির মত দাড়ি। প্রায় নিঃশব্দে মুখ বন্ধ করে পান চিবুচ্ছেন। মুখের ভেতরের রক্তিমাভা বাইরে প্রকাশ পাবার কোন জো নেই।
অভিভাবক ছাড়া সেদিন আরো দুজন ছাত্র এসেছিল। কিন্তু অভিভাবক না থাকার কারণে আদিব হুজুর তাঁদের সাথে কথাও বলেননি। এক্ষেত্রে পরে শুনেছি, তিনি বলেছিলেন এক মজলিসে— স্কুলে পড়ানোর ক্ষেত্রে মা-বাবার অপরিসীম গুরুত্ব লক্ষ করা যায়। তারা নিজেরা গিয়ে নিজেদের সন্তানদের প্রতিদিন দিয়ে আসেন। সময় শেষ হলে আবার নিয়ে আসেন। অনেক মায়েরা তো স্কুলের পাশে বেঞ্চিতে ছেলের ক্লাস শেষ হবার অপেক্ষায় বসেও থাকেন। সন্তানদেরকে মাদরাসায় পড়ানোর ক্ষেত্রে আমাদের চাওয়া হলো অভিভাবকের ন্যূনতম আগ্রহ ও ভালোবাসা। এজন্য ভর্তির সময় তো অন্তত অভিভাবকের উপস্থিতি আবশ্যক।
আমার সম্পর্কে আদিব হুজুর আব্বুকে জিজ্ঞাসা করলেন, এর আগে কোথায় কী পড়েছে?
আব্বু স্পষ্টভাবে সব বললেন। বললেন আমার স্কুল-জীবন ও সেখান থেকে মাদরাসায় আসার সমস্ত পরিক্রমা।
আদীব হুজুরের পক্ষ থেকে এর পরের প্রশ্ন ছিল— ‘এখন কেন এসেছেন মাদ্রাসায়?’
‘মাদ্রাসা দেখতে।’— আব্বু বললেন।
‘এখন তো মাদ্রাসা বন্ধ। তো এ সময় মাদরাসায় কী দেখতে এসেছেন?’— এমন প্যাঁচালো প্রশ্ন করে আব্বুকে থতমত খাইয়ে দিলেন আদিব হুজুর। আব্বু বেকায়দায় পড়ে গেলেন। কথা এদিক সেদিক নিয়ে মাদ্রাসায় ভর্তির উদ্দেশ্য খোলাসা করে বলে— কোনমতে রেহাই পেলেন আব্বু।
আদিব হুজুরের কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে গেলাম। কোরআন শরীফ থেকে প্রশ্ন করল। পুষ্পের একটা ছোট প্রবন্ধ পড়ে শোনাতে বলল। এরপর দুই লাইন বাংলা হাতের লেখা। ব্যাস এতোটুকুই। ভর্তির জন্য অনুমোদন পত্র দেয়া হল। এখন শুধু ভর্তির দিন এসে ভর্তি হয়ে যাবো। এতদিন শুনে এসেছিলাম— মাদরাসাতুল মদিনায় ভর্তি হওয়া অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। সেই কথাটা আমার কাছে সত্য বলে মনে হলো না ।
২
শাওয়াল মাস। ১০ তারিখ। নতুন ছাত্রদের ভর্তি হওয়ার তারিখ।
সকাল আটটার দিকে গিয়ে হাজির হলাম এক নতুন পৃথিবীতে। অনেক ছাত্র আর অভিভাবকদের ভিড়। পথ দেখিয়ে কয়েকজন ছাত্র নিয়ে যেতে লাগলো আমাদেরকে এক রুম থেকে আরেক রুমে- কক্ষ থেকে কক্ষান্তরে, ভর্তির এক ধাপ থেকে শুরু করে আরেক ধাপে। ফরম পূরণ থেকে শুরু করে আদিব হুজুরের স্বাক্ষর— মাঝখানে চলে গেল প্রায় কয়েকটি ঘণ্টা। বসে থাকতে থাকতে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায়। চাপাচাপি-ভিড় আর ভ্যাপসা গরমে ঘেমে হাঁসফাঁস করতে হয়েছে। তবুও স্বপ্নের বিদ্যাকাননে ভর্তি হতে পেরে সেদিন নিজেকে পরম ধন্য মনে হয়েছিল।
সেদিনকার অনুভূতি কখনোই ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়।
ভর্তি হবার পর বাসায় যাবার আর অবকাশ নেই। একেবারে এক মাস পর। ভর্তির সময়ই নিয়ে যেতে হয়েছিল প্রয়োজনীয় সমস্ত জিনিসপত্র। মাদরাসার পক্ষ থেকে সবাইকে দেয়া হয়েছে লকার (সুন্দুক)। কিনে নিতে হয়েছে বিশেষ তাবলিগি ছোট সাইজের বিছানা। নতুন জায়গায় সাধারণত আমার ঘুম হয়না। তার মধ্যে যদি আবার চাপাচাপি থাকে, তাহলে মানিয়ে নিতে খুব কষ্ট হয়। মাদরাসাতুল মদিনা যাবার পর দিন তিনেকের মত আমি রাতে ঘুমাতে পারিনি। বিছানায় শুয়ে শুধু এদিক সেদিক পাশ ফিরেছি, আর কাত পরিবর্তন করেছি। এক রুমে অনেক মানুষের নিঃশ্বাসের উষ্ণতায় দম বন্ধ হয়ে আসছিল বারবার।
এখানে এসে প্রথম প্রথম কোন হুজুরের নামই জানা যায় না। শুধু এলাকার নাম জানা যায়- অমুক জায়গার হুজুর, তমুক জায়গার হুজুর। প্রথম বর্ষে মোমেনশাহীর হুজুর আর সিরাজী হুজুর। ইয়াদায়ে শেরপুরের হুজুর আর রাজবাড়ির হুজুর। দ্বিতীয় বর্ষে ঢাকার হুজুর, রাজশাহীর হুজুর। তৃতীয় বর্ষে গোপালগঞ্জের হুজুর। চতুর্থ, পঞ্চম বর্ষে সম্মিলিতভাবে দরস দিতেন হাতিয়ার হুজুর, নদভী হুজুর, কাসেমী সাহেব আর নাযেম সাহেব হুজুর। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে আদিব হুজুর সম্ভবত চেয়েছিলেন— ছাত্রদের মুখে ওস্তাদের নাম উচ্চারণ না হোক। তবে ক্ষতি যেটা হয়েছে, সেটা হলো- এখন তাদের মূল নাম মনে করতে কখনো কখনো বেশ বেগ পেতে হয়।
বর্ষ ভাগ করে বললাম, কারণ তারা ছিলেন সেসব বর্ষের জন্য নির্ধারিত। এর বাইরে তাদের কোন দরস ছিল না। এভাবেই আদিব হুজুর মাদ্রাসাকে সাজিয়েছেন। প্রথম বর্ষে আমাদেরকে পড়িয়েছেন সিরাজী সাহেব হুজুর। আর দায়িত্বে ছিলেন মোমেনশাহী হুজুর। তিনি একটু কঠিন হৃদয়ের মানুষ ছিলেন। কোনদিন আমার দিকে হাসিমুখে তাকিয়েছেন, এমনটা মনে করতে পারছি না। পরে শুনেছি, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তিনি কঠোর হলেও ব্যক্তিগতভাবে মিশুক। আর দ্বিতীয় বর্ষ থেকে আমাদের হাল তুলে দেয়া হলো ঢাকার হুজুরের হাতে। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, মাদরাসাতুল মদিনা থেকে বের হয়ে আসা অবধি তার নেগরান থেকে আমরা আর নিস্তার পাইনি।
আমি চলে আসার কিছুদিন পর, ভাগ্যদোষে— তাঁকেও বের হয়ে আসতে হয়েছে মাদরাসাতুল মদিনা থেকে। মাদরাসাতুল মদিনার হুজুরদের মধ্যকার বোঝাপড়াগুলো আমাদের কাছে চিরকালই অধরা ছিল। এখনো এসব বিষয়ে অনেক অস্পষ্টতা আছে।
যেদিন ভর্তি হলাম, এর পরের দিন মোমেনশাহী হুজুর আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন— ‘তোমরা কেউ যদি বাসা থেকে ‘যন্ত্র’ এনে থাকো, তাহলে আমার কাছে এখনই জমা দিয়ে দাও। মাসিক বিরতিতে বাসায় নিয়ে যাবে। কারো কাছে যদি পাওয়া যায়, তাহলে এর কয়েক মুহূর্ত পরে সে আর মাদরাসাতুল মদিনা আলো-বাতাস পাবেনা। এছাড়া আরেকটি কথা। আদিব হুজুরের বই ছাড়া অন্য কারো বই তোমাদের জন্য পড়া যাবে না এখন। পড়তে হলে তৃতীয় বর্ষের পরে চতুর্থ বর্ষে উঠে পড়ার অনুমতি আছে। একমাত্র শুধু বাংলা অভিধান রাখা যেতে পারে। আরবি অভিধানও এখন ব্যবহার করা যাবে না। অন্য বইয়ের তো প্রশ্নই আসেনা…’
আমার সমগ্র জগতজুড়ে ভীষণ ক্লান্তি নেমে এসেছিলো। ভেবেছিলাম— আদিব হুজুরের লেখায় সাহিত্যের যে উন্মুক্ততা দেখতে পাই, মাদরাসার আবহে তার বাস্তবায়ন কই? এত নিয়মাবদ্ধতার মধ্যে আবার সাহিত্য হয় কিভাবে? বাসা থেকে তখন নিয়ে গিয়েছিলাম যাইনুল আবেদীন সাহেবের ‘সাহিত্যের ক্লাস’, শফীউদ্দীন সরদারের ‘সূর্যাস্ত’ আর আশরাফ আলী থানভির ‘মুনাজাতে মকবুল’। লকারের ভেতর কাপড়ের স্তূপের নিচে ফেলে রাখলাম বইগুলো। কয়েকদিন যেতেই দেখি— ছাত্ররা গোপনে কিছু বই-টই পড়ছে। দেখাদেখি আমিও পড়তে লাগলাম। ‘সূর্যাস্ত’ উপন্যাসটা নবাব সিরাজউদ্দৌলার জীবনের উপর ভিত্তি করে লেখা। অর্ধেক আগেই পড়া ছিল। বাকিটুকু পড়তাম রাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলে, বাতি জ্বালিয়ে। রেখে দিতাম বালিশের তলায়। এক মাস যেতে না যেতেই ধরা খেয়েছিলাম। এরপর অনেকদিন যাবত ‘তওবা তওবা’ বলে শান্ত রেখেছিলাম আমার পিপাসু মনকে।
মোমেনশাহী হুজুরের কথা শেষ হয়নি। বললেন—‘অন্য বর্ষের ছাত্রদের সাথে কোনরকম প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলা যাবে না। দস্তরখানের দাওয়াত দেয়া হলে কামরায় বসে থাকা যাবে না। সাথে সাথে দস্তরখানে শরিক হতে হবে…’
ইত্যাদি আরো অনেক নিয়ম-কানুন বলেছিলেন। যেগুলো পালন করা কিছুটা কষ্টকর ছিল।
পুরো প্রথম বর্ষে আমাদেরকে কেবল চারটি কিতাব পড়ানো হয়েছিল। এসো আরবী শিখি পরিপূর্ণ, আত তামরীনুল কিতাবীয়্যু, কাসাসুন নাবিয়্যিনের প্রথম খণ্ড আর এসো ছরফ শিখি। সিরাজী হুজুর আমাদেরকে পড়িয়েছিলেন অত্যন্ত সুন্দরভাবে। শব্দার্থ ছাড়া অন্য কোন কিছুই তিনি আমাদের মুখস্থ করাতেন না। প্রচুর অনুশীলন করাতেন। ব্যাপক অনুশীলনের ফলে আমার মত অমনোযোগী ছাত্ররাও খুব দ্রুত, ভালোভাবে আরবি শিখে ফেলেছিল।
সেখানে বছরে পরীক্ষা ছিল দু’টি। প্রথম ফাতরায় শুধুমাত্র এসো আরবী শিখি আর আত তামরীনুল কিতাবীয়্যু পড়ানো হয়েছিল। দ্বিতীয় ফাতরায় এর সাথে যুক্ত হয়েছে কাসাসুন নাবিয়্যিন ও এসো সরফ শিখি। কাসাসুন নাবিয়্যিনের শুরুতে প্রায় দুই সপ্তাহর মতো আমাদেরকে দরস দিয়েছেন আদিব হুজুর নিজেই। প্রতিদিন মাগরিবের পর আসতেন।
তার দরসের কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল। ছোট কিতাব হলে হুজুর দরসের পুরো সময়টা দাঁড়িয়ে থেকে অথবা ছাত্রদের মাঝে হেঁটে হেঁটে পড়াতেন। ক্ষণিকের জন্যেও বসতেন না। প্রথমে কোন একজনকে মূল অংশটি পড়ে শোনাতে বলতেন। আরবি পড়ার স্বরে কোনো ঘাটতি থাকলে উচ্চারণ করে শোনাতেন। এরপর সেই অংশটির টিকায় যদিও অপরিচিত শব্দের বাংলা অর্থ দেয়া রয়েছে, তবুও মাতৃভাষার আশ্রয় ছাড়া বিভিন্নভাবে—হোক সমর্থক আরবি শব্দ ব্যবহার করে, অথবা ইশারা ইঙ্গিতে, অঙ্গভঙ্গি- হাতের ইশারা ব্যবহার করে—উদ্ধৃত অংশটির মর্ম আমাদের সামনে স্পষ্ট করে তুলে ধরতেন। কঠিন কঠিন তারকীবগুলো বিশ্লেষণ করে দেখাতেন। এরপর অংশটি আমাদের নিজেদের ভাষার আরবিতে তৈরি করে শুনাতে বলতেন। এরপর শেখাতেন উদ্ধৃত অংশটির অনুবাদের কলাকৌশল। প্রথমে তারকীবানুগ ও মূলানুগ তরজমা। এটা করতেন অংশটি ভালভাবে বোঝার জন্য। এরপর সেই মূলানুগ তরজমাকে কিভাবে ভাবানুবাদ করে বাংলা ভাষার সাথে একাত্ম করতে হয়— সেটাও শেখাতেন। এতে করে অনুবাদের প্রাথমিক অনুশীলনটাও হয়ে যেত দরস থেকেই।
দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষায় যারা গড়ে ষাট নম্বরের কম পেয়েছিল, তাদেরকে আরেকবার প্রথম বর্ষ পড়ার জন্য ইয়াদায় পাঠানো হয়। বছরের শুরু থেকে যতটুকুই মনোযোগ ছিল পড়ালেখায় আমার, তা শুধুমাত্র ইয়াদার যন্ত্রণা থেকে বাঁচার জন্য। সেখান থেকে মুক্তি পেয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। দ্বিতীয় বর্ষে আমি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে পুরো বছরটা নষ্ট করেছি। পড়ালেখায় মনোযোগ কমে গিয়েছিল। তবে সেটাও নেতিবাচক ছিল না।
সময়ের বড় একটা অংশ লেখার চর্চা করার পেছনে ব্যয় করেছিলাম।
৩
প্রথম বর্ষ শেষ করার কিছুদিন আগে অন্য কোন মাদ্রাসায় চলে যেতে মনস্থ করেছিলাম। চাপের মধ্যে জীবনের সুন্দরতম সময় আর দিনগুলি- কৈশোর কাটাতে মোটেও ভাল লাগছিল না। জীবনকে তখন আমি নতুনভাবে দেখতে শিখেছিলাম। মানুষের মধ্যে নিজস্বতা বলতে যে কিছু আছে— মাদরাসাতুল মদীনার পরিবেশে তার অভাব মানসিকভাবে আমাকে বিপর্যস্ত করে তুলছিল। এমন অনুভূতি খুলে বলার মতো কাউকে পাইনি। আমার ভেতর থেকে উচ্চারিত হয়ে উঠতো, আমি তো মাদরাসাতুল মদিনায় পড়তে আসিনি। সত্যি কথা বলতে— আমার ইচ্ছে ছিল আদিব হুজুরের সংস্পর্শ লাভ। সেটাও তো হয়ে উঠছে না।
চলে যাবার জন্য ফন্দি-ফিকির করতে লাগলাম। রমজানের কিছুদিন আগে আদিব হুজুরকে গিয়ে একদিন বললাম, ‘এসো সরফ শিখি আমি ভালোভাবে বুঝিনি।’ বোকার মত মনে করেছিলাম, হয়তো সরফ বোঝার জন্য আমাকে অন্য মাদরাসায় যেতে অনুমতি দিবেন। তাছাড়া অনুমতি ব্যতীত যাওয়ার সাহসও ছিল না। কিন্তু আদিব হুজুর বললেন, ‘যতটুকু বুঝেছো ততটুকুই যথেষ্ট। এর বেশি এখন প্রয়োজন নেই। উপরের বর্ষে উঠলে ধীরে ধীরে বিস্তারিত জানতে পারবে। এখন ওসব নিয়ে একদম ভাববে না। বিরতিতে বাসায় গিয়ে আরেকবার পড়ে নিবে। পুষ্প পড়বে আর নিয়মিত রোজনামচা লিখবে। যাও। ফি আমানিল্লাহ।’
হুজুরের কথার আর্দ্রতা আমার হৃদয়কে ছুঁয়ে গেল। এরপর আমি আর অন্য কোন কিছু ভাবতে পারিনি।
ভালো ছাত্ররা দ্বিতীয়বর্ষে চলে আসলো। তুলনামূলক কম মেধাবীরা চলে গেল ইয়াদায়। নতুন বর্ষে উঠে সবাই খুব আগ্রহের সাথে পড়তে লাগলো। কিন্তু আমার অবস্থা দাঁড়ালো বিপরীত। কেমন যেন একটা উদাস উদাস ভাব। লাস্ট বেঞ্চের আগের বেঞ্চের গাফেল তালেবে এলেম বনে গিয়েছিলাম। হুজুর আমাকে প্রায় সময় পড়া ধরতেন। পড়া না পারতে পারতে, হুজুরের মনের মধ্যে গাফিল হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেছিলাম। তবে হ্যাঁ, এসো উর্দু শিখি বইটা তখন নতুন বেরিয়েছিল। প্রেসের গরম গরম পৃষ্ঠা তখনো, উষ্ণ খাবারের সুস্বাদ নিয়ে পড়েছিলাম। দেড় মাসে আমাদেরকে পুরো বইটা পড়িয়ে শেষ করে দেয়া হয়। এটা পড়ার পর সহজ উর্দুগুলো পড়তে পারতাম।
এ সময় আসরের পর বুড়িগঙ্গার সামনে গিয়ে একটু দাঁড়াতাম। বর্ষা এলে দুকূল ভরে যেত। গন্ধ চাপা পড়ে যেত তলানিতে। বেড়িবাঁধ দিয়ে বাতাসে হাটাহাটি করতে ভালোই লাগতো। মাদরাসাতুল মদিনায় তখন একজন ছাত্র পড়তো। কবিতা লিখতো। বর্ষাকালে সে বুড়িগঙ্গার সৌন্দর্যে এতটা বিমোহিত হয়ে যেত যে, একদিন বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত তীরে দাঁড়িয়েছিল। আদিব হুজুর এটা জানতে পেরে তাকে মাদরাসা থেকে বের করে দিয়েছিলেন। পরে একদিন রাস্তায় দেখা হওয়ায় তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘শুধু শুধু এভাবে রাতে সেদিকে ঘোরাঘুরি করেছিলেন কেন?’
‘উনবিংশ শতকের কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের অনুভূতিটা স্পর্শ করার জন্য।’
‘কিভাবে?’
‘তিনি লিখে গিয়েছেন রাতের বিমল আলোয় বুড়িগঙ্গাকে দেখে—
‘‘সমালয় সন্নিহিত
বুড়িগঙ্গা প্রবাহিত
বান্দাঘাট শোভিত যাহাতে
সেখানে বসিয়ে গিয়া
জুড়ায়া সন্তপ্ত হিয়া
সলিল শিকরসিক্ত রাতে’”
ডাইরিতে টুকে রেখেছিলাম, যেভাবে মনে ছিল সেভাবে। আজ দেখে নিলাম।
তৃতীয় বর্ষে ওঠার পর, হুজুরের নেগরানি একটু শিথিল হয়ে পড়ে। সে সময় আবার লুকিয়ে লুকিয়ে বই পড়ার ভূত চাপল ঘাড়ে। আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘ফররুখ আহমদ জীবন ও সাহিত্য’ পড়ার পর ফররুখের প্রতি আগ্রহ আসলো প্রবল। সাত সাগরের মাঝি আর হাতিম তাঈটা পড়ে ফেলেছিলাম। ইকবালের ‘আসরারে খুদি’ বাংলা অনুবাদটা পড়েছিলাম। এছাড়াও হাসান হাফিজুর রহমানের ‘বিমুখ প্রান্তর’ পড়েছিলাম। তার গাম্ভীর্যপূর্ণ, নৈঃশব্দে ভরা কবিতাগুলো আমার বেশ ভালো লাগত। পড়েছিলাম সৈয়দ আলী আহসানের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘জীবনের শিলান্যাস’। তখন আমার ভাষা তার গদ্যে বেশ প্রভাবিত হয়ে পড়ে। পরবর্তীতেও অবশ্য তেমন তৎসম শব্দবহুল ভাষা থেকে বেরিয়ে আসতে পারি।
আর আরবি পড়েছিলাম আলী তানতাবীর ‘মাআন্নাস’, ‘নুরুন ওয়া হিদায়াতুন’। দ্বিতীয় বইটিতে আহমদ আমিনের প্রশংসা ছিল। এটা পড়ার পূর্বে আহমদ আমিন সম্পর্কে আমার বিরূপ ধারণা ছিল।
বিস্তৃতভাবে বাইরের বই পড়তে থাকলেও, এ সময় দরসি কিতাবেও মনোযোগী হয়ে উঠি। জীবনের মূল্য বুঝতে শিখি। প্রথম পরীক্ষায় টার্গেট নিয়ে পড়ার কারণে শেষ দিকের সিরিয়াল থেকে উঠে এসে পঞ্চম হয়েছিলাম। বার্ষিক পরীক্ষায় হয়েছিলাম তৃতীয়। তাছাড়া বার্ষিক হাফলায় আরবি সাহিত্যের কৃত্তিম ও অকৃত্রিম ধারার পর্যালোচনামূলক একটি প্রবন্ধ লিখে পুরস্কার পেয়েছিলাম।
চতুর্থ বর্ষে উঠে আরবি সাহিত্যের বইগুলোর ব্যাপক অনুমতি পাওয়া যায়। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের নয়। তখন আহমদ আমিনের ‘হায়াতি’, ‘ইলা ওলাদি’, ‘কিতাবুল আখলাক’ পড়ে তার প্রতি শ্রদ্ধা চলে আসে। অন্যরা পড়ত মানফালুতির ‘আন-নাযারাত’, ‘আল-আবারাত’। হাবুডুবু খেত প্রেম আর বিচ্ছেদের গল্পে, কারুকার্যময় বাক্যালংকারে। কিন্তু আমার কাছে প্রিয় হয়ে ওঠেছিল আহমদ আমিনের চিন্তামূলক লেখা। আমি আহমদ আমিনের ১০ খন্ডের প্রবন্ধ-সংকলন ‘ফাইজুল খাতির’ কিনে বিভিন্ন প্রবন্ধ পড়া শুরু করি।
এছাড়া মাদরাসাতুল মদিনার ছাত্র পাঠাগারে বাংলা ভাষায় বেশ কিছু চিন্তামূলক গ্রন্থ ছিল। সেগুলো বেছে বেছে পড়তে লাগলাম। শিবলী নোমানীর ‘আল মামুন’, আবুল হাসান আলী নাদাবির জামিয়া মিল্লিয়ায় প্রদত্ত ভাষণ ‘ধর্ম ও কৃষ্টি’, সুলাইমান নাদাবির ‘পয়গামে মুহাম্মদী’, আব্দুল মান্নান তালিব অনূদিত, ইমাম গাজ্জালীর ‘তাহাফাতুল ফালাসিফা’, বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত, আব্দুল মওদুদের ‘মুসলিম মনীষা’ প্রভৃতি।
আমি চতুর্থ বর্ষে থাকাকালীন আদিব হুজুর মেশকাত ও দাওরা খোলার ঘোষণা দিলেন। ভীষণ ব্যথিত হয়েছিলাম খুশি হওয়ার বদলে। ভেবেছিলাম কিছুদিন পরই মুক্তি মিলবে। এখন সেটা আর হয়ে উঠলো না।
আমাদের নিচে যত বর্ষ ছিল, সবাইকে একে একে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল হযরতপুরে। মাদরাসাতুল মদীনার নতুন আঙ্গিনায়। সেখানে চাপ ছিল আরো বেশি। ছাত্রদের ভোগান্তিরও কম ছিল না। তবুও সেখানকার ছাত্রদের মুখে সর্বদা হাসি দেখেছি। সেখানের প্রাকৃতিক সান্নিধ্য তাদের মনকে সজীব রাখতে হয়তো সহায়তা করে থাকবে।
পঞ্চম বর্ষে উঠার পর আমার একটা নতুন ঝোঁক আসলো। বাছবিচারহীন বই পাঠ। অখাদ্য কুখাদ্য সব গেলা, ভালো বইয়ের পাশাপাশি। প্রত্যেক মাসিক বিরতিতে বাসা থেকে ফেরার সময় নীলক্ষেতের পুরনো বইয়ের দোকান থেকে সাতশ এক হাজার টাকার বই কেনা প্রায় আমার নেশার পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। টার্গেট থাকতো এক মাসের মধ্যে সব পড়ে শেষ করে ফেলব। দুই-তিনবার সেটা সম্ভব হলেও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব হতো না। অধিকাংশ বই অবশ্য পড়া হতো। অর্ধেক মাদ্রাসা হযরতপুর চলে যাওয়ায় ফাঁকা জায়গার প্রাচুর্য ছিল। কোনা কানিতে বসে বইপত্র পড়ার সুযোগও কম ছিল না।
কিন্তু আমার এই জীবনে ছেদ পড়ে যায়। একদিন শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর নীলক্ষেত থেকে প্রায় তেরোশো টাকার বই কিনে ফিরছিলাম। কামরায় ঢোকা মাত্র দেখে ফেললেন ঢাকার হুজুর। সবকটি বই ‘দারুল কলম’-এর জন্য নির্ধারিত একটি বাক্সে চালান করে দিলেন। বসিয়ে অনেক কথা শোনালেন। বাসায় নালিশ পর্যন্ত করলেন। বাসা থেকে অনেক কথা শুনতে হলো আমাকে। বন্ধ হয়ে গেল উন্মুক্ত গ্রন্থপাঠ। অবশ্য ঢাকার হুজুরের একটি ভাল গুণ ছিল, এসব ছোটখাটো বিষয়ে তিনি আদিব হুজুরের কাছে বিচার দিতেন না। কয়েকজন হুজুরের মাঝে সে অভ্যাসটা দেখেছি।
পঞ্চম বর্ষ শেষ করার পর আমাদেরকে বলা হল— মিশকাত ও দাওরার ব্যাপারে তোমাদের মাঝে তিনটি ভাগ করা হয়েছে। ১. আদিব হুজুর এর পক্ষ থেকে কয়েকজনকে দাওয়াত করা হয়েছে। ২. কয়েকজনকে এখতিয়ার দেয়া হয়েছে। ৩. কয়েকজনকে মাদরাসায় রাখার ব্যাপারে অপারগতার ওজর আছে। আমাকে ফেলা হলো প্রথম দলে। শুরু হলো আরেক যন্ত্রণা। বুকে পাথর চেপে পড়ে থাকলাম আরো একবছর।
মিশকাত শরীফ আমাদেরকে পড়ানো হয়েছিল ‘সারদ’ পদ্ধতিতে। হাদিস শুধু পড়ে যাওয়া হতো। হুজুর আমাদেরকে হাদিসের মাফহুম বুঝিয়ে দিতেন। হাদিস সংক্রান্ত কোন মাসালা থাকলে সেটা বর্ণনা করতেন। না হলে আগে বাড়তেন। বেশি কথা বলা হতো না। যেসব হাদিসের ব্যাখ্যা সুস্পষ্ট— সেসব ক্ষেত্রে পাঁচ সাতটা অর্থগত দিক বর্ণনা করা থেকে এড়িয়ে যাওয়া হতো। এটা অবশ্য ভালো দিক ছিল।
আদিব হুজুরের একটা উপদেশ আমার সবসময় মনে থাকবে। সবার সামনে দাঁড়িয়ে একদিন আদিব হুজুর বলেছিলেন, ‘পঁচিশ বছর আগের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে আমি এসো আরবি শিখির মাদরাসা খুলেছিলাম। এখন যদি তোমরা এখান থেকে বের হবার পর আবার আমার মত ‘হাযা—হাযিহি’র মাদরাসা খুলে বসো, তাহলে সময়ের প্রতি মোটেও সুবিচার হবে না। তোমাদেরকে খুলতে হবে নতুন প্রজন্মের জন্য ইসলামিক স্কুল।’
একদিন যখন নিঃশব্দে মাদরাসাতুল মদিনার সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠেছিলাম, হাজার স্বপ্নে চোখ ছিল সেদিন আচ্ছন্ন। একে একে সব স্বপ্ন মনের দেয়াল থেকে খসে পড়েছে। কিন্তু মানুষ কি স্বপ্ন ছাড়া থাকতে পারে? এক দুইটিকে সম্বল করে— আজো পরম প্রত্যয়ে বেঁচে আছি, এখনো এগিয়ে যাচ্ছি জীবনের পথে।
‘এখনো জোনাকি জ্বলে’ লেখাটিতে আদীব হুজুর একটি জ্বলন্ত সত্যের কথা বলেছিলেন—‘জীবনের চলমান চাকার নিচে গুড়িয়ে যায় জীবনের অনেক আশা প্রত্যাশা। যারা ভাগ্যবান তাদের দু-একটি স্বপ্ন বেঁচে থাকে এবং অবয়ব লাভ করে।’