মাদরাসাশিক্ষার্থীদের অনুভবে কাজী নজরুল ইসলাম

হামমাদ রাগিব:

(জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৩ তম জন্মবার্ষিকী আজ। প্রেম ও দ্রোহের কবির জীবনটা ছিল অদ্ভূত বৈচিত্রমণ্ডিত। কখনও তুমুল কমিউনিস্ট, কখনও নবিপ্রেমে দেওয়ানা এক পাগল কবি। একসঙ্গে অনেকগুলো চরিত্রের বসবাস ছিল চিরদুঃখী এই মানুষটার ভেতর। কিন্তু বিশ্বাসের জায়গায় কখনও কারও সঙ্গে আপোস করেননি তিনি। তাঁর প্রতি আজকের ইসলামি ঘরানার ঐতিহ্যবাদীদের মুগ্ধতা ঠিক এ কারণেই। শৈশবের সোনালি সময় থেকে ঐতিহ্যবাদী ইসলামিস্টদের অনুভবে কাজী নজরুল ইসলাম কীভাবে জায়গা করে নেন, বেড়ে ওঠার সঙ্গে কীভাবে জড়িয়ে পড়েন তাঁদের চেতনায় এবং প্রাসঙ্গিক ও বরণীয় হয়ে ওঠেন পরবর্তী-জীবনে, তারই সংক্ষিপ্ত চিত্র এঁকেছেন ফাতেহের সহযোগী সম্পাদক হামমাদ রাগিব। জাতীয় কবির জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে লেখাটি আজ প্রকাশিত হলো ফাতেহের পাঠকদের জন্য।)

নদীর ছলাৎ ছলাৎ ঢেউয়ের মতো একটা সময় আমরা পার করে আসি তুমুল দুরন্তপনায়। নজরুলের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে অবুঝ আনন্দে মোড়ানো সেই জল-শৈশবেই। ঠিক নজরুলের সঙ্গে বললে ভুল হবে, পরিচয় ঘটে মূলত নজরুলের কবিতার সাথে। পিচ্চি একটা বইয়ের ব্যাগ পিঠে ঝুলিয়ে সকালের মিষ্টিরোদ গায়ে মাখতে মাখতে যখন আমরা গ্রামের ইবতেদায়ি মাদরাসায় মকতবের সবক পড়তে যাই দল বেঁধে, শরীরের সবটুকু শক্তি গলায় এনে আমরা আবৃত্তি করি সদ্য মুখস্ত করা লাইনগুলো—
ভোর হোলো
দোর খোলো
খুকুমণি ওঠো রে!
ঐ ডাকে
জুঁই-শাখে
ফুলখুকী ছোটো রে…!

চৌধুরীবাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে আমরা মাদরাসায় যাই, কখনো যাই রমিজ চাচার ক্ষেতের আল ধরে। আমাদের ‘ভোর হোলো’র আওয়াজ মাঝে মাঝে এতোটা উচ্চ হয় যে, চৌধুরীবাড়ির বৌ-ঝিরা ঘরের দাওয়ায় মুখ বাড়িয়ে দেখে আমাদের মকতবগমন। ক্ষেতের কাজে মগ্ন রমিজ চাচা কখনো সখনো মুখ খিঁচুনী দিয়ে হুমকি দেয়— বেত্তমিজ পোলাপান! কী চিল্লাফাল্লা শুরু করছে দ্যাখো! খাড়া, তোগো মিয়াসাবরে আইজকা পায়া লই…!

আমাদের জল-শৈশবে এভাবেই থৈ থৈ করে নজরুল, নজরুলের প্রভাতী, ভোর হোলো দোর খোলো। আমরা আরেকটু বড়ো হই। মকতব আউয়ালের পাঠ শেষ করিয়ে আমাদের সবক দেয়া হয় মকতব দুওমে। তুমুল আনন্দ নিয়ে আমরা ঝপি আলিফ বে পে তে…।

‘মাত ডার, চুপ রাহ’ পড়ে আমরা না-ডরানোর সবক নিই ঠিক, তবে চুপ থাকতে পারি না। সন্ধ্যে হলেই ঘরের দাওয়ায় মুরতা বেতের চাটাই বিছিয়ে লণ্ঠনের আবছা আলোয় আমরা চিল্লাতে থাকি—

খোকার সাধ
কাজী নজরুল ইসলাম

আমি হবো সকালবেলার পাখি
সবার আগে কুসুমবাগে উঠবো আমি ডাকি।
সূয্যিমামা জাগার আগে উঠবো আমি জেগে
‘হয়নি সকাল, ঘুমো এখন’— মা বলবেন রেগে।
বলবো আমি— ‘আলসে মেয়ে, ঘুমিয়ে তুমি থাকো
হয়নি সকাল তাই বলে কি সকাল হবে না কো?

এইবার আমরা কবিতার সঙ্গে নতুন আরেকটা জিনিস আবিষ্কার করি। আমরা জেনে ফেলি, এই যে চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে আমরা কবিতা পড়ছি, এই কবিতা এমনি এমনি তৈয়ার হয়নি। এর একজন রচয়িতা আছেন। তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। আমাদের শিশুমন আপনার অজান্তেই এই নামের মানুষটাকে ভালোবেসে ফেলে। এতো সুন্দর করে যিনি কবিতা লিখতে পারেন, তাকে ভালো না বেসে পারা যায়?

ইশকুলের মতো আমাদের বইগুলোতে কোনো জানদারের ছবি নেই। তাই নজরুলকে আমরা মনের ক্যানভাসে নিজের মতো করে আঁকি। তারপর প্রাইমারিতে পড়া কোনো সমবয়েসী খেলার সাথির বাংলা বইয়ে হঠাৎ একদিন দেখে ফেলি নজরুলকে। নাদুসনুদুস চেহারার ঝাঁকড়াচুলো নজরুল। সকালবেলার পাখি হবার প্রেরণা জাগানো নজরুল। আমাদের মানসপটে নজরুলের সেই ছবি অঙ্কিত হয়ে যায়। নজরুল নাম শুনলেই চোখের তারায় জ্বলজ্বল করে গভীর কালো চোখের ঝাঁকড়াচুলো নাদুসনুদুস একটা মুখের প্রতিচ্ছবি।

সময়ের পিঠে চড়ে আমরা লকলকিয়ে বাড়তে থাকি। আমরা আরেকটু বড় হই। নজরুল এবার আমাদের সামনে হাজির হন প্রত্যাশার পাঠ নিয়ে। নজরুলকে আমরা আবৃত্তি করি আরেকটু নতুন করে—
মোরা ফোটা ফুল তোমরা মুকুল এসো গুল-মজলিসে
ঝরিবার আগে হেসে চলে যাবো তোমাদের সাথে মিশে।

নজরুল আমাদের কাছে তাঁর হৃদয়ের হাহাকার ব্যক্ত করেন—
মোরা কীটে-খাওয়া ফুলদল, তবু সাধ ছিলো মনে কতো
সাজাইতে এই মাটির দুনিয়া ফিরদৌসের মতো।

তারপর আমাদের কিশোর-কাঁধে তিনি তুলে দেন স্বপ্নালু এক মহান দায়িত্ব। দায়িত্ব তো না, আমাদের মূলত তিনি বাতলে দেন জীবনের অভীষ্ট লক্ষ্যের ঠিকানা—
আমাদের সেই অপূর্ণ সাধ কিশোর-কিশোরী মিলে
পূর্ণ করিয়ো, বেহেশ্ত এনো দুনিয়ার মাহফিলে।

মকতবের দুয়ার পার হয়ে আমরা দাখেলা পাই মিজানে। ফাআলা ফাআলা ফাআলু জপতে জপতে আমাদের মুখে ফেনা আসার উপক্রম—এরই ফাঁকে নজরুল আমাদের কাছে জাগরণের বাণী নিয়ে হাজির হন—ইসলাম জাগো! মুসলিম জাগো! আল্লাহ তোমার একমাত্র উপাস্য, কোরআন তোমার সেই ধর্মের, সেই উপাসনার মহাবাণী, সত্য তোমার ভূষণ, সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতা তোমার লক্ষ্য, তুমি জাগো! মুক্ত বিশ্বের বন্য শিশু তুমি, তোমায় পোষ মানায় কে? দুরন্ত চঞ্চলতা, দুর্দমনীয় বেগ, ছায়ানটের নৃত্য-রাগ তোমার রক্তে, তোমাকে থামায় কে? উষ্ণ তোমার খুন, মস্ত তোমার জিগর, দারাজ তোমার দিল, তোমাকে রুখে কে? পাষাণ কবাট তোমার বক্ষ, লৌহ তোমার পঞ্জর, অজেয় তোমার বাহু— তোমায় মারে কে?…

নজরুলের দৃপ্ত উচ্চারণ আমাদের তন্দ্রালু কিশোর-হৃদয়কে আন্দোলিত করে তোলে। আমাদের রক্তে ছড়িয়ে পড়ে নতুন এক উষ্ণতা। আমরা পৃথিবী নিয়ে একটু একটু ভাবতে শিখি। তারপর আসে নাহবেমির-এর বছর। একশো’ আমেলের সাথে আমাদের ঠোঁটস্থ হয়ে যায় ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতাখানি—
দুর্গম গিরি কান্তার-মরু দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশিতে যাত্রীরা হুঁশিয়ার!
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ
কে আছো জোয়ান, হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিষ্যত…

নজরুলের আহুত সেই ‘জোয়ান’ হিসেবে নিজেকে কল্পনা করতে আমাদের তখন বড্ড ভালো লাগে। ‘কাণ্ডারী’ হবার একটা প্রতিজ্ঞা ভেতরে ভেতরে আমরা করে ফেলি আপনার অজান্তেই।

নজরুলের দেয়া সাহস ও স্বপ্ন নিয়ে আমরা বিস্তৃতির পথে হাঁটতে থাকি। আমরা আরেকটু বড় হই। শৈশব-কৈশোরের উচ্ছলতা পেছনে ফেলে আমাদের শিরায় এখন টলমল তারুণ্যের উষ্ণতা। আমাদের চিন্তায়-দেমাগে অঙ্কুর গজিয়েছে পরিপক্কতার বীজ। কবির জীবন নিয়ে এবার আমাদের কৌতূহল জাগে। আমরা জীবনীর পাতা উল্টাই। কবির জীবন-কাহিনি পড়তে বসে আমাদের চোখ ভারী হয়ে ওঠে। চুরুলিয়ার শিশু দুখু মিয়াকে আমরা কখনো যাত্রাদলের সঙ্গে ঘুরতে দেখি। কখনো রুটির দোকানে দেখি দু’মুঠো হালাল খাবারের জন্য খাটুনি খাটছেন।

কৈশোরের একটা পর্বে এসে মোয়াজ্জিনের মিনারেও দেখি কবিকে। অনাদর আর অবহেলায় বেড়ে ওঠা কবির ভেতর বিদ্রোহের অগ্নিলাভা দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। দ্রোহের ভেতরই কবি প্রেম খুঁজে পান। প্রেম খুঁজে পান যুদ্ধের দামামায়। মুসলমানদের দুরবস্থা কবিকে কষ্ট দেয়। গান ও কবিতায় কবি মুসলমানদের হারানো শৌর্যবীর্য স্মরণ করিয়ে তাদের জাগাবার চেষ্টা করেন। কবি হাহাকার করেন মুসলমানদের হারানো ঐতিহ্য নিয়ে।

জীবনীর এ পর্যন্ত সব ঠিকঠাক। কবিকে নিয়ে গর্বে আমাদের বুক ফুলে ওঠে। কিন্তু আমরা হোচট খাই, যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠি, যখন দেখি কবির আশপাশ বরং কবির চতুর্দিক বেষ্টন করে আছে ইসলামের শাশ্বত চিন্তা-চেতনার বিপরীত মেরুর লোকজন। ধুরন্ধর এই লোকগুলো ইসলাম ও মুসলমানের হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনার স্বপ্নে বিভোর কবির চিন্তা-চেতনাকে সাম্যবাদের মুলো দেখিয়ে রূপান্তরিত করে মেতে ওঠে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের ধান্ধায়। একাডেমিক পড়াশোনা থেকে দূরে থাকা আবেগী নজরুলকে কাজে লাগায় নিজেদের মতো করে। সবচে’ বড় ধাক্কাটা খাই কবির বৈবাহিক জীবন দেখে। তারপরও আমরা কবিকে দিল থেকে মুছতে পারি না। আমাদের হৃদয়ের তারে বেজে ওঠে কবির বিশ্বাসের সুর—
কোন নামে হায় ডাকবো তোমায়
নাম না জানা অ-নামিকা
জলে স্থলে গগণ-তলে
তোমার মধুর নাম যে লিখা!

আমরা কবিকে ঘৃণা করতে গিয়ে আরো নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরি। তন্ময় হয়ে শোনি কবির রসুল-প্রেমের আহাজারি—
আমি যদি আরব হতাম—মদিনারই পথ,
সে পথে মোর চলে যেতেন নুরনবি হজরত।
চরণ তাঁর লাগতো এসে আমার কঠিন বুকে,
আমি ঝর্ণা হয়ে গলে যেতাম অম্নি পরম সুখে;
সেই চিহ্ন বুকে পুরে
পালিয়ে যেতাম কোহ-ই-তুরে
দিবা-নিশি করতাম তার কদম জিয়ারত…

মূর্তিপূজা, কমিউনিজম আর অবিশ্বাসের আস্তানায় জীবন কাটালেও কবি তাঁর বিশ্বাসের জায়গা থেকে নড়েননি একচুলও। এই বিস্ময়টাই কবির প্রতি আমাদের ভালোবাসাকে ক্রমশ গভীর করে তোলে। তার জন্যে ইসতেগফার পড়তে উদ্বুদ্ধ করে তাহাজ্জুদের নিবিড় মোনাজাতে।

ভালোবাসার কবি ভালো থাকুন ‘মসজিদেরই পাশে’। ভালো থাকুক কবির প্রেরণা-জাগানো গান ও কবিতাগুলো।

আগের সংবাদকাজী নজরুল ইসলাম : একুশ শতকে কেন অনিবার্য?
পরবর্তি সংবাদফররুখের নজরুল ভাবনা: তুলনা এবং প্রতিতুলনা