মাদানীনগর মাদরাসা : শব্দরা যেখানে শব্দ করে হাসে

ওমর আলী আশরাফ:

একবার একুশে ফেব্রুয়ারিতে মাদানীনগর মাদরাসায় আচমকা একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকদল এসে উপস্থিত হলেন তাদের যাবতীয় সরঞ্জামাদি নিয়ে, সম্ভবত তারা খবর পেয়েছেন, আজ সরকারি ছুটির দিনেও মাদরাসায় ক্লাস চলছে। মাদরাসা সরকারি আইন অমান্য করে, জাতীয় দিবস ভঙ্গ করে, শহিদদের অবজ্ঞা করে ছুটির বদলে ক্লাস করছে, ব্যাপারটাকে একহাত দেখিয়ে নিতে হবে। এর মিডিয়া কভারেজ করার জন্য তারা ছুটে এসেছেন দলবেঁধে।
আমি তখন সেখানকার ছাত্র। একুশে ফেব্রুয়ারি এলে মাদরাসার গেইটের দেয়ালে আর বকুলতলায় দেয়ালিকা ফেস্টুন টাঙিয়ে ভরে ফেলতাম। গেইটের দেয়াল, হাউজপারের দেয়াল, বিভিন্ন ভবনের দেয়ালে দেয়ালে আমরা লিখে-এঁকে টাঙিয়ে দিতাম বুকের ভেতর থেকে কলমের ডগায় ফুটে ওঠা ভালোবাসা।

সাংবাদিকদল গাড়ি নিয়ে সোজা মাদরাসার ভেতরে মাঠে এসে নামলেন। তারা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন, মাদরাসার আঙিনাজুড়ে ছাত্রদের হৈ-হুল্লোড় কম, শুধু এক জায়গা থেকে মাইকে বক্তৃতা শোনা যাচ্ছে। তুমুল গর্জনে বক্তা দেশ ও ভাষার শত্রুদেরকে তির্যক মন্তব্য ছুঁড়ছেন। বকুলতলায় শহিদদের কীর্তি গেয়ে, ভাষার মর্যাদা বুনন করে ফেস্টুনের সারি সাজিয়ে তোলা হয়েছে। দেয়ালে দেয়ালে সেঁটে আছে সদ্য এঁটে দেওয়া হাতে লেখা দারুণ সব দেয়ালিকা।

সাংবাদিকরা বুঝতে পারলেন, তারা ভুল ইনফরমেশন পেয়েছেন এবং বিষোদ্গার ছড়াবার মানসে তারা ভুল জায়গা নির্বাচন করেছেন। সেদিন মাদরাসায় কিছুক্ষণ থেকেই তারা এই প্রতিষ্ঠান সম্বন্ধে অনেককিছু জানতে পেরেছেন।

মাদানীনগর মাদরাসা সাংস্কৃতিক বান্ধব প্রতিষ্ঠান; ভাষা দিবসে আমরা নানান আয়োজন করতাম। আমাদের একটা সংগঠন আছে, নাম ‘আঞ্জুমানে দারুল মুতাআলা’। মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা সন্দ্বীপের হযরতজি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি নিজে এটা প্রতিষ্ঠা করেছেন। ব্যক্তি উদ্যোগে, যৌথ উদ্যোগে, জামাতের উদ্যোগে এবং দারুল মুতাআলার উদ্যোগে আমাদের দেয়ালিকা বের হতো। লেখালেখি, দেয়ালিকা, আঁকাআঁকি, বক্তৃতা শেখা ইত্যাদির জন্য আমরা মোটেও লেখাপড়ায় ব্যাঘাত ঘটাতাম না। একেকটি দেয়ালিকার জন্য হাতে পর্যাপ্ত সময় নিয়ে আমরা কাজ করতাম। বিকেলের অবসরে, রাতে শোবার আগে, শুক্রবারে ফাঁকা সময়গুলো কাজে লাগিয়ে আমরা দেয়ালিকার কাজ সম্পন্ন করতাম। আরবি বাংলা ইংরেজি—যত দেয়ালিকা বের হতো, সবগুলো হাতে লেখা হতো। পুরো কাগজে থাকত দারুণ সব নকশা।

ভাষা দিবস, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস—জাতীয় ছুটিগুলোতে মাদরাসার স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ থাকতো। আমরা উঠেপড়ে লাগতাম ছুটির এই নিয়ামতকে কাজে লাগাবার জন্যে। বছরের অন্যান্য সময়েও আমাদের দেয়ালিকা কার্যক্রম, বক্তৃতা প্রশিক্ষণ, বইপাঠের আসর ধারাবাহিক চলতে থাকতো।

মাদরাসার সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘আঞ্জুমানে দারুল মুতাআলা’-এর অধীনে তিনটি বিভাগ ছিল—বক্তৃতা, লেখালেখি, বইপাঠ।

১. লেখালেখি মূলত নিজের কাছে। মানুষ সত্তাগতভাবে যদি লেখার প্রতি আগ্রহ বোধ না করে, তাকে খুব শিখিয়ে-পড়িয়ে বানানে নির্ভুল করা যায়, প্রবন্ধ লেখাবার হাত চালু করা যায়; কিন্তু সৃষ্টিশীল গদ্য, রুচিশীল গল্প তার কলমে ফোটে না। এজন্য দেখা যেত, একেক জামাতে মাত্র ৬-৭ জন মনোযোগী হয়ে নিয়মিত সাহিত্য আসর করছে এবং এখন এই কালে সেই আমাদের সহপাঠী সিনিয়র-জুনিয়র মিলে মাত্র কয়েকজন সাহিত্যে ব্রত আছেন। এদের মধ্যে আবার কেউ কেউ লেখালেখি করেন যদি মোটে একটু সময় জোটে। কাউকে কাউকে সৃজনশীলতা বাদ দিয়ে অনুবাদে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে।

২. বইপাঠের দারুণ উদ্যোগ ছিল দারুল মুতাআলার। প্রাথমিক পাঠকদের জন্য মোটামুটি ভালো একটা সংগ্রহশালা ছিল। ছাত্ররা সেখান থেকে নিয়মিত বই নিতে পারতো। সপ্তাহ শেষে পুরোনোটা জমা দিয়ে নিতে পারতো নতুন বই। অনেক ছাত্র ছিল, ছুটির সময়গুলোতে সময় অপচয় না করে তারা ডুব দিত সিলেবাসের বাইরের এই মহাসমুদ্রে।

৩. বক্তৃতার আসরটা জমতো খুব সমারোহে। প্রতি বৃহস্পতিবার মাগরিবের পর থেকে ইশা পর্যন্ত বাধ্যতামূলক চলতো এই আয়োজন। ফার্সি জামাত থেকে মেশকাত পর্যন্ত জামাতগুলো আঞ্জুমানে দারুল মুতাআলার আওতাধীন। শিক্ষাবর্ষের শুরুতেই নিচের জামাতগুলোর জন্য ওপরের জামাতের দুইজন করে ছাত্র নিয়োগ দেওয়া হতো; যারা প্রত্যেকে একইসঙ্গে লেখাপড়ায় সেরা, সিলেবাসের বাইরেও আছে তাদের পাঠের তুলনামূলক ব্যাপ্তি, বক্তৃতায় প্রাণোচ্ছল, লেখালেখিতে প্রাঞ্জল, দিকনির্দেশনা দিতে সক্ষম বড়ভাইদের বাছাই করে উস্তাদরাই তাদের বানিয়ে দিতেন নিচের জামাতগুলোর জিম্মাদার।

মাদানীনগর মাদরাসার নিয়মকানুন এমনিতেই কড়া; রুটিনবদ্ধ। ছুটি ছাড়া কেউ শুক্রবারেও বেশি সময় বাইরে থাকতে পারে না। বৃহস্পতিবারে বাধ্যতামূলকভাবেই সবাইকে মাদরাসায় উপস্থিত থাকতে হতো এবং বক্তৃতার জলসায় বসতে হতো। জলসার শুরু ও শেষে হাজিরা হতো; অনেক সময় মাঝেও হতো। কেউ অনুপস্থিত থাকলে, উপস্থিত থেকেও বক্তৃতা না করলে তাকে বিচারের সম্মুখীন হতে হতো।

প্রতিজন ছাত্রের বক্তৃতা শেষে তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হতো। জিম্মাদার বড়ভাইয়েরা খুব যত্নের সঙ্গে এই কাজ করতেন। উপস্থিত ছোটদের থেকেও মন্তব্য নেওয়া হতো। এতে কারও প্রতিভা বিচার করার একটা সূক্ষ্ম যোগ্যতা তৈরি হয়ে যেতো। শেষে শোনা হতো সামগ্রিক অনুভূতি। সময় থাকলে হতো উপস্থিত বক্তৃতা পরিবেশনা। শেষের এই কাজটায় যারা বেশি আগ্রহী ছিল, তারা এখন কেউ কেউ মাশাআল্লাহ চমৎকার বক্তা হিসেবে দ্বিনের খিদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছে।

এই মজলিসগুলোতেই ব্যাপক পরিমাণে পাঠের প্রতি উৎসাহ দেওয়া হতো। আদিব হুযুরের পরিচর্যায় প্রকাশিত ‘পুষ্প’ ছিল আমাদের চলার পথে বিমোহিত সুবাস। আমরা গভীর মনোযোগে আদিব হুযুরের লেখাগুলো নিয়ে বসতাম এবং অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে প্রতিটি লেখা থেকে প্রতিযোগিতা লেগে উপকার গ্রহণ করার চেষ্টা করতাম।

মাদরাসার তরফ থেকে দুটি পত্রিকা পড়ার অনুমোদন ছিল। ইলমি বিষয়ের জন্য ‘মাসিক আলকাউসার’ আর সাহিত্যের জন্য ‘আল-কলম পুষ্প’। বক্তৃতা প্রশিক্ষণের কোনো কোনো জিম্মাদার নিয়মিত দুটি পত্রিকা থেকে হাতে-কলমে ইস্তিফাদা নেবার কৌশল শেখাতেন। শুদ্ধ উচ্চারণে পড়তে পারার প্রতি উৎসাহ দিতেন।

বক্তৃতার এই সাপ্তাহিক জলসাতেই শুদ্ধ ভাষায় কথা বলার প্রতি উৎসাহিত করা হতো। দেয়ালে, রুমের দুয়ারে, সিঁড়ির উপরে, ওযুখানায় কাগজে সাঁটানো থাকত, ‘শুদ্ধ ভাষায় কথা বলা সাহিত্যের অর্ধেক’। নিচে সুন্দর করে নাম লেখা থাকত, ‘মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ’। আমরা জোর করে নয়, অভ্যাসগতভাবেই শুদ্ধ ভাষায় কথা বলার প্রয়াস নিতাম; অর্থাৎ প্রথম প্রথম এমন স্বাভাবিক ভঙ্গিতে শুদ্ধ বলার চেষ্টা করতাম, যেন আমি এভাবেই কথা বলি, এভাবে কথা বলাই আমার অভ্যাস। খুব বেশিদিন লাগেনি, আমাদের বেশ কয়জনের মুখের ভাষায় শুদ্ধ বলা অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। এখনো সেই অনেকে শুদ্ধ ছাড়া অন্য অপ্রমিত তেমন সাবলীল বলতে পারি না। বিশেষ করে এখন আমরা যারা লেখালেখিতে রত আছি, বক্তৃতা আর সাহিত্যের আসরগুলো আমাদের মুখের ভাষা শুদ্ধে সাবলীল করার জন্য বিশেষ অবদান রেখেছে। সেসব মজলিসে উৎসাহের জন্য শুদ্ধ ভাষায় কথা বললে পুরস্কার দেওয়া হতো। জামাতের সবাই সাক্ষী দিত, পুরো সপ্তাহে কে একটি শব্দও অশুদ্ধ বলেনি।

সপ্তাহে সপ্তাহে বক্তৃতা শিখনেঅলাদের উৎসব লেগে যেত মাদরাসার আয়োজিত সিজনগুলোতে। সাধারণত জাতীয় দিবসগুলোতে আঞ্জুমানে দারুল মুতাআলার প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান আয়োজিত হতো। পুরো মাদরাসা থেকে বাছাই করে পঁচিশ-ত্রিশ জন নির্বাচিত হতো এই প্রতিযোগিতায় লড়াই করার জন্য। চলত মধ্য রাত পর্যন্ত। শুধু বক্তৃতা নয়, হামদ-নাত-তিলাওয়াত হতো। নাটক মঞ্চায়ন করত বিভিন্ন গ্রুপ। হাসতে হাসতে পেটে খিল পড়ে যাবার দশা হতো। সব শেষে মুহতামিম সাহেব হুযুর দরাজ কণ্ঠে নসিহত করতেন। তার কণ্ঠ আজও বাজে আমার কানে। শব্দের ভাঁজে ভাঁজে স্নেহরা ঝরে পড়ত কলকলিয়ে। উৎসাহ দিতেন, নিজের হাতে পুরস্কার দিতেন। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতেন। যে বাংলাদেশে একসময় আলিমরা সাহিত্য-সংস্কৃতিকে চর্চার বিষয় হিসেবে গ্রহণ করতে চাইতেন না; এমনকি বাংলায় দরস দেওয়ার প্রচলন ছিল না, সেই দেশের মূলধারার এই জামিআ তার প্রতিজন ছাত্রকে আগ্রহভরে শুধু নির্দেশনাই দিচ্ছে না, হাতে-কলমে শিখিয়ে-পড়িয়ে গড়ে তুলছে। রাত জেগে জেগে উস্তাদরা আমাদের সঙ্গে লেগে থাকতেন, কত স্নেহ আর মায়ারা ঝরে পড়ত তাদের তত্ত্বাবধানগুলোতে।

তবে এজন্য মূল লেখাপড়ায় সামান্য হেরফের হতে পারতো না। মাদানীনগর মাদরাসা সম্বন্ধে যারা ওয়াকিবহাল, তারা জানেন, দুর্বল ছাত্রদেরকে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ রাখতে ইচ্ছুক থাকেন না। যারা লেখাপড়ায় মনোযোগী কিন্তু মেধায় দুর্বল, তাদের ব্যাপারে হয়তো উস্তাদরা বিশেষ সুপারিশ করতেন; কিন্তু যারা একইসঙ্গে দুষ্টু ও দুর্বল, তাদের নামে অভিযোগ গঠন হতো এবং শেষমেশ তারা প্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে যেতে হতো। পরীক্ষার ফলাফল মাকবুল বিভাগে এলে সে অটোমেটিক দুর্বল সাব্যস্ত হতো, রাসিব হলে তো কথাই নেই। সেই কড়াকড়ির নিয়মানুবর্তিতায় সংস্কৃতি চর্চা মোটেও মন্দ প্রভাব ফেলতে পারত না; বরং দেখা যেত লেখালেখি ও বক্তৃতায় যারা অগ্রসর, দরসের বিষয়াদিতে তারাই তুলনামূলক বেশি কৃতকার্য হতো। দরসি পড়ায় অনেক দুর্বলকে বরং আমরা দেখেছি, বক্তৃতায় এগিয়ে গিয়ে লেখাপড়ায়ও সে আগের তুলনায় ভালো করছে। সম্ভবত আত্মবিশ্বাস তাদের পথের সঙ্গী হতো। এটা আমার ধারণা।

দিনভর-রাতভর অতি মনোযোগে লেখাপড়ায় ব্যস্ত ছাত্ররা আসরের পরের অবসরে, রাতে পড়া শেষ করে শোবার আগে, শুক্রবারে হাউজপারে গিয়ে নিজে নিজে গলা ছেড়ে বক্তৃতা করতে থাকতো। বেশির ভাগই হতো মুখস্থ বক্তৃতা। ঠেকে গেলে সঙ্গে সঙ্গে কাগজ থেকে দেখে নিত। এভাবে মুখস্থ দিতে দিতে একসময় তাদের মুখের জড়তা কেটে যেত এবং ভরা মজলিসে অনর্গল বক্তৃতা করতে বেগ পোহাতে হতো না। তাদের সেসব বক্তৃতা প্রশিক্ষণ, অনুশীলন আর প্রতিযোগিতায় উচ্চারিত শব্দরা খলবলিয়ে আছড়ে পড়ত মাদরাসার দেয়ালগুলিতে। শব্দে শব্দে টক্কর খেয়ে ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হতো সারা মাদরাসায়। শব্দরা ছড়িয়ে পড়ত এবং শব্দের পেছনের কণ্ঠটিকে ছড়িয়ে দিত সবার মাঝে।

তবে, আঞ্জুমানে দারুল মুতাআলার উদ্যোগে বক্তৃতা নিয়ে যত আয়োজন ছিল, লেখালেখির বেলায় এই উচ্ছ্বাস আমরা দেখিনি। যেমন, সাপ্তাহিক বক্তৃতার মজলিসে বসা, সবার সামনে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেওয়া ইত্যাদি বাধ্যতামূলক ছিল। বক্তৃতা নিয়ে মাদরাসাজুড়ে বছরে কয়েকটা বড় প্রতিযোগিতার আয়োজন হতো। উস্তাদরা হতেন বিচারক। মুহতামিম সাহেব হুযুর নিজ হাতে পুরস্কার দিতেন ও দুআ করতেন।

কিন্তু লেখালেখির বেলায় এসব ছিল না। নিজের উদ্যোগেই একেকজন নিজেকে গড়ে তুলতে হতো। অবশ্য বড় ভাইয়েরা তত্ত্বাবধান করতেন, দিকনির্দেশনা দিতেন, যথাসাধ্য সঙ্গ দিতেন। তাও এটা ব্যাপক না, শুধু যারা নিজ উদ্যোগে আগ্রহী, তাদের একত্র করে সপ্তাহান্তে মজলিস বসতেন। লেখালেখি; অন্তত রোযনামচার জন্য মাদরাসা থেকে বাধ্যকতা ছিল না। সপ্তাহে সপ্তাহে মজলিসে না বসলে জবাবদিহিতার প্রসঙ্গ ছিল না। ছোট-বড় কোনো প্রতিযোগিতাই হতো না। পুরস্কারের তো প্রশ্নই আসে না। আমরা যারা নিজ উদ্যোগে দেয়ালিকা টাঙাতাম, প্রায়ই নানান নিয়ম আর বিধি-নিষিধের কবলে পড়ার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। তবু আমরা দমে যাইনি। নিয়মিত অনুশীলন করতাম, দেয়ালিকা লিখতাম, নিজেরা পাঠচক্রের আয়োজন করতাম; এবং আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করতাম, পুরো মাদরাসার সবচাইতে মেধাবী ছাত্ররাই আনন্দ নিয়ে লেখালেখি করছে।

বিভিন্ন দিবস আর উপলক্ষ্য ছাড়াও আমরা নিয়মিত দেয়ালিকা করতাম। নতুন নতুন লেখায় ভরে ফেলতাম মাদরাসার দেয়াল। আরবি, বাংলা, মাঝেমাঝে ইংরেজি—লিখতাম আমরা অনবরত। আমাদের লেখা অজস্র শব্দ যখন দেয়ালে দেয়ালে শব্দ করে হাসত, এক ধরনের গভীর তৃপ্তি আমাদেরকে বিশেষ উৎসাহ যোগাতো। আমরা আরও লিখতাম, আরও লিখতাম, আরও। সেরা সেরা লেখাগুলো দিয়ে করতাম দেয়ালিকা। রোযনামচা লিখতাম, ভ্রমণকাহিনি লিখে ভরে ফেলতাম খাতা। নিজের কাছে যত্ন করে পুষে রাখতাম সেসব। অনেকদিন পর আজকের লেখার সঙ্গে পুরোনো এক মাস অথবা এক বছর আগের এই দিনে লেখা রোযনামচা তুলনা করে দেখতাম। মানুষের চেহারার মতো লেখায় সৌষ্ঠব পরিবর্তন আমাদের ভীষণ উদ্দীপিত করে তুলতো। আমরা একটা মুহূর্তও নষ্ট করতে রাজি ছিলাম না; এমনকি সাপ্তাহিক বক্তৃতার জলসায় বসেও লুকিয়ে লুকিয়ে লিখতে থাকতাম; পুরোনো কোনো লেখা ইচ্ছেমতো কাটাচেরা করে যেতাম। কনকনে শীতে শিশুকে পরম মমতায় পরিচর্যা করার মতো রাত-দিন আমরা অবিশ্রান্ত সুখ খুঁজে নিতাম একেকটা লেখার সৌষ্ঠব সৌম্য রচনায়।

অজস্র লিখে আমরা অনুশীলন করতাম। সেরা লেখাগুলো কেটেকুটে আরও সেরা করে দেয়ালিকার জন্য সিলেক্ট করতাম। রাতে দেয়ালিকা টাঙানোর পর প্রায়ই দূর থেকে লুকিয়ে দেখতাম, কে কে পড়ছে আমার লেখা? কোনো উস্তাদকে বেশিক্ষণ আমার দেয়ালিকার সামনে দাঁড়ানো দেখলে সেটা হয়ে যেত আমার জন্য মুহতামিম সাহেব হুযুরের হাতে দেওয়া বক্তৃতার পুরস্কারের চেয়েও আনন্দদায়ক ঘটনা। আমরা তখন অনুভব করতাম, তিলে তিলে গড়ে তোলা আমার শব্দরা দেয়ালজুড়ে শব্দ করে হাসছে। তার সেই উচ্ছল হাসি আছড়ে পড়ছে আমার হৃৎপিণ্ডে। আমরা ভীষণ উদ্দীপনা অনুভব করতাম। আমাদের কানে বাজতো সাপ্তাহিক বক্তৃতার শব্দরাজি, কুরবানির ঈদে আয়োজন হওয়া বিতর্ক অনুষ্ঠানের শব্দগুলো আমাদের উদ্দীপিত করে তুলতো, বক্তৃতা প্রতিযোগিতার একেকটা শব্দ আমাদের কানে শব্দ করে বাজত; কিন্তু আমরা যা লিখে রেখে দিতাম খাতায়, টাঙাতাম দেয়ালে, পাঠ করতাম আসরে, সেসব শব্দ, শব্দের তরঙ্গ, তরঙ্গের আনন্দ আমাদের বুকের ভেতরটা আঁকড়ে থাকত। আমরা অনুভব করতাম—আমরা যত শব্দ বুনছি, এগুলো জীবিত থাকবে অনন্তকাল। শুধু মাদানীনগরের দেয়ালে নয়, এই শব্দরা শব্দ করে হাসতে হাসতে ছড়িয়ে পড়বে সারা দুনিয়ায়। কলমের কালি এমন এক শক্তি, অনন্তকাল যে উৎস হয়ে উৎসারণ ঘটায়।

আমি অত্যন্ত আনন্দিত, আলহামদুলিল্লাহ, আমার তারুণ্য কেটেছে এই সংস্কৃতি বান্ধব মাদরাসায়। এখানে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের আমিও একজন সদস্য। আমাদের অনেক দূর এগুতে হবে। মাদরাসাগুলো নামে ‘আল-জামিআ’ না হয়ে বাস্তবেই বিভিন্ন বিভাগ ও পাঠদান, সনদ প্রদান ইত্যাদি কার্যক্রমের মাধ্যমে একেকটি জামিআ হয়ে উঠবে পৃথিবীর সেরা ইলমিস্থান, ইনশাআল্লাহ।

ওমর আলী আশরাফ
Omaraliashraf508@gmail.com

 

আগের সংবাদএদিকটায় যেন খুব রোদ ফুটেছে আজ
পরবর্তি সংবাদএকূল ওকূল