মালেক বেন নাবী : সভ্যতা ও রেনেসাঁর দার্শনিক

হুজাইফা আওয়াদ:

জন্ম

মালেক বেন নাবী। জন্মেছেন যিলকদ ১৩২২ হিজরি, মুতাবেক জানুয়ারি ১৯০৫ ইংরেজি সনে, আলজেরিয়ার পূর্বের রাজ্য কন্সটান্টাইনের তেবেস্বা পল্লীতে। এ সময় আলজেরিয়ায় চলছিলো ফ্রান্সের দখলদারিত্ব। শৈশবে মায়ের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে জ্ঞান বিজ্ঞানের মহাসমুদ্র পাড়ি দেওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন বেন নাবী। মা ছিলেন পেশায় একজন দর্জি, সন্তানের পড়াশোনার জন্য বাড়ির প্রয়োজনীয় আসবাব সামগ্রী পর্যন্ত বিক্রি করে দিয়েছিলেন তিনি।

তেবেস্বা গ্রামটি ছিলো একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলে, ফলে ফরাসিয়ানদের রাজনৈতিক ও চিন্তাগত প্রভাব থেকে অনেকটাই মুক্ত ছিলো। আঞ্চলিকতার রীতি মেনে বেন নাবীও শৈশবে অন্য সবার মতো মসজিদ-কেন্দ্রিক মকতবে দীনি সবক গ্রহণ করেন। এসময় কয়েকজন ধার্মিক ব্যাক্তির সাথে তার উঠাবসা শুরু হয় তার। ফলে কোরআনে কারীম ও ধর্মীয় মূল্যবোধ বেন নাবীর হৃদয়ে বিশাল একটি স্থান করে নেয়।  প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ করে বেন নাবীকে কন্সটান্টাইন শহরে চলে যেতে হয় উচ্চ শিক্ষার জন্য। ফরাসিয়ান কলেজে, মার্টান নামের এক ফরাসি শিক্ষাবিদ বেন নাবীকে মুগ্ধ করে তোলেন, আপন পাণ্ডিত্যের গভীরতায়।  আবার একই সাথে শহরে থাকাকালীন সময়ে ব্যাপক প্রভাবিত হন আব্দুল হামীদ বাদিসের তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত আলজেরিয়ান সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের মুখপত্র ‘আশ শাবাব’ দ্বারাও।

বেন নাবী ও তার চিন্তার নির্মাণ

এ সময় দুটি কিতাব বেন নাবীর হস্তগত হয়। এক. প্রসিদ্ধ আলজেরিয়ান কবি আহমাদ মুহাররম-এর ‘আল ইফলাসুল মা’নাবী’ (পরোক্ষ দেওলিয়াত্ব : প্রাচ্যে পশ্চিমের রাজনীতির হেতু কি?)।  দুই. মুহাম্মদ আবদুহুর ‘কিতাবুত তাওহীদ’। তৎকালীন ইসলামী বিশ্বের সামগ্রিক চিত্র বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে এই দুটি কিতাব তার সহায়ক হয়। আব্দুর রহমান কাওয়াকিবী লিখিত ‘উম্মুল কুরা’ কিতাবটিও বেশ গভীর উপলব্ধি নিয়েই শেষ করেন তিনি। পাশাপাশি বিদগ্ধ আলেম আব্দুল হামিদ বাদিসের শাগরেদদের সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে। এখানে বলে রাখা ভালো যে, শহরে থাকাকালে বেন নাবী বেশ কয়েকজন খৃস্টান শিক্ষকের কাছেও পড়াশোনা করেন, তাদের মিশনারি তৎপরতাও খুব কাছ থেকে উপলব্ধি করেন। বাইবেল পড়ে শেষ করেন সে সময়-ই। এজন্য খ্রিস্টীয় সংস্কৃতির সমালোচনা খুব সুক্ষ্মভাবে করতে পেরেছিলেন তিনি।

ইসলাম ও পশ্চিম—এই দুই বিপরীত চিন্তাজগতের মিশ্রণে তার চিন্তাধারা নির্মিত হয়। এবং এই দ্বৈততা তার লিখিত গ্রন্থাদিতেই স্পষ্ট দেখা যায়; একদিকে ইসলামী সভ্যতার সাথে সম্বন্ধ, অন্যদিকে বর্তমান প্রেক্ষাপটে একে অতি মাত্রায় বিকাশের চিন্তা।

বিশ বছর বয়সে তিনি পাড়ি দেন প্যারিসে, কিন্তু কিছুদিন না যেতেই বেকারত্ব ভোগ করে দেশে ফিরে আসেন। তবে ১৯৯৩-এর দিকে ফের প্যারিস যান। ওরিয়েন্টাল ইনস্টিটিউটে চান্স না পেয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং স্টাডিতে যান। মোটকথা এখানে বেন নাবী রকমফের চিন্তার নানাবিধ জ্ঞান বিজ্ঞানের সাথে পরিচিত হন। মাঝে মাঝে খৃস্টান পণ্ডিতদের সাথে বাইবেল বিতর্কেও অংশ নেন বেন নাবী। বিভিন্ন সেমিনার সিম্পোজিয়ামে উপস্থিত হওয়াতে একটা পর্যায়ে যথেষ্ট পরিচিতি লাভ করেন তিনি। প্যারিসে সাকিব আরসালান ও গান্ধির মত জনপ্রিয়রাও সাক্ষাত করতে যান তার সাথে।  অঘোষিতভাবেই তিনি হয়ে ওঠেন আফ্রিকাসহ পশ্চিম-শাসিত  ইসলামি বিশ্বের কমনওয়েলথের চিন্তানায়ক।

১৯৩৫ সনে ইলেক্ট্রিক ইঞ্জিনিয়ার হয়ে দেশে ফেরেন। ফরাসি দখলদারদের চাপে তখন সাধারণ আলজেরিয়ান মুসলিমরা গম ও আঙুর চাষ করতেন, এগুলো থেকে মদ তৈরী করা হতো ফরাসিদের জন্য। বেন নাবী আলজেরিয়া ফিরে এসে এসব চাষাবাদ শুরু করেন, কিন্তু চঞ্চল জীবনটা কেমন যেন থমকে দাঁড়ায় তার। ফলে সিদ্ধান্ত নেন, আবার ফিরে যাবেন প্যারিস।  ১৯৩৯ এ সেখানে ফিরে গিয়ে এবার বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ শুরু করেন। ‘লোমেন্ড’ পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। এসময় তার বিখ্যাত কিতাব ‘আয যাহিরাতুল কুরআনিয়্যা’ (কুরআনিক ফেনোমেনন)  প্রকাশিত হয়। (১)

এরপর  ১৯৪৯ সনে তার কিছু মূল্যবান গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে ছিল— ‘শুরুতুন নাহযাহ’ (নবজাগরণের শর্ত),  ‘ওয়াজহাতুল আলামিল ইসলামি’ (ইসলামী বিশ্বের গন্তব্য) এবং ‘ফিকরাতুল আফরিকা ওয়া আসিয়া’ (এশিয়া ও আফ্রিকার রাজনৈতিক চিন্তা)।

মিশর যেহেতু সে সময়ে স্বাধীনতা ও আরব মুক্তির প্রশ্নে ছিলো এক অন্যতম প্রেক্ষাগৃহ, তিনি ভাবলেন, ওখানে গিয়ে হয়তো মুসলিম বিশ্বের স্বার্থে বড় কোনো কাজ করা সম্ভব। সেই লক্ষ্যে ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৩ পর্যন্ত তিনি মিশরে অবস্থান করেন। আরবী সাহিত্য, সভ্যতা ও সংস্কৃতি পূর্ণ আয়ত্তে আনেন। বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য ইলমি মারকাযগুলোর কাছে অত্যন্ত আস্থাভাজন ও বড় মাপের বুদ্ধিজীবী হিসেবে স্বীকৃতি পান বেন নাবী।  ‘আস সিরাউল ফিকরী ফিল বিলাদিল মুসতা’মারা’ (পশ্চিম কলোনিয়াল দেশগুলোতে চিন্তার দ্বন্দ্ব) আরবী ভাষায় লেখা তার সর্বপ্রথম গ্রন্থ। ‘আরব সমাজের প্রতিচ্ছবি’, ‘একটি সমাজের জন্ম’ ও ‘নতুন নির্মাণের আখ্যান’— গ্রন্থগুলো মিশরে থাকতেই প্রকাশিত হয়। এরপর তিনি কায়রোতে ইসলামিক সম্মেলনের উপদেষ্টা হিসাবে নির্বাচিত হন।

বেন নাবী ও  বৌদ্ধিক কার্যকলাপ

আলজেরিয়া স্বাধীন হয় ১৯৬১ সনে। এর দু’বছর পর দেশে ফিরে আসেন তিনি। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন পদে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা হলো— শিক্ষা সংস্কার। এ বিষয়ে তাঁর লিখিত গ্রন্থাদি  ইসলামী দেশগুলিতে শিক্ষার সংস্কার,  পরিবর্তন ও সামাজিক পুনর্গঠনের প্রক্রিয়াগুলোয় বেশ ভূমিকা রাখে। ‘ইসলামি বিশ্বে চিন্তাগত প্রশ্ন’,অর্থনীতির বিশ্বে মুসলিম’, ও ‘শতাব্দী কালের সাক্ষীর ডায়েরী’ গ্রন্থগুলো বের হয় এই সময়ে। বেন নাবী অঞ্চলভিত্তিক বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কার্যক্রম শুরু করেন, এর অংশ হিসেবে তার বাড়িতেও সাপ্তাহিক সেমিনার অনুষ্ঠিত হতো, অগ্রসর চিন্তার বহু যুবক ও বয়স্ক লোকেরা উপস্থিত হতেন সেখানে। এসকল সেমিনারগুলোর ধারাবাহিকতা ও সাফল্য দেখে রাষ্ট্রীয়ভাবে মালেক বেন নাবীকে সাংস্কৃতিক ফোরামের দায়িত্বশীল নির্বাচন করা হয়, যার অধীনে প্রতি বছরই আন্তর্জাতিক ইসলামী সম্মেলনের আয়োজন করা হতো।

১৯৬৭ সনে মালেক রাষ্ট্রীয় ও অরাজনৈতিক—সর্বপ্রকার দায়িত্ব ও সংস্থা থেকে অব্যাহতি গ্রহণ করেন। ১৯৭১ সনে সিরিয়ান সংকট নিয়ে ‘কুড়ি শতকে মুসলিমদের ভূমিকা ও বিশ্ব দরবারে তাদের বার্তা’ শীর্ষক সুদীর্ঘ ভাষণ দেন। মনে করা হয়, এটিই তার জীবনের শেষ ‘নসিহাহ’।

ইলমি ও চিন্তাগত বোঝাপড়া

বেন নাবী ছিলেন একজন সৃজনশীল চিন্তাবিদ, সভ্যতা নির্মাণে ছিলো তার গভীর পর্যবেক্ষণ। তার চিন্তা ছুঁয়েছিলো ‘শক্তির’ উপাদানগুলোকে, ইসলামি বিশ্বের মৌলিক ও কেন্দ্রীয় সংকটগুলোর প্রতি অব্যাহত আলোকপাত করে গেছেন তিনি। সভ্যতা, নবজাগরণ, উপনিবেশবাদ ও অধীনতা সমস্যার দিকে গভীর মনোযোগী ছিলেন বেন নাবী। ফলে এসবের প্রত্যেকটি দিকের ব্যাখ্যা প্রতিফলিত হয়েছে তার লেখনীতে। যেহেতু তার চিন্তার ভিত্তি ছিলো ‘চিন্তা’র ডেমোলেশানের উপর, সেহেতু প্রাচ্যের সভ্যতার অনেক কিছুতেই তিনি নমনীয় ছিলেন। ফলতঃ (তারা ভাষায়) ‘উম্মাহর উপযোগী’ করে পশ্চিম সভ্যতার রেশ ফলিত হয়েছে তার চিন্তায়।

বেন নাবীর চিন্তার যাত্রা শুরু হয়েছিলো, একটি কেন্দ্রীয় বিন্দু থেকে। তা হলো, যে কোনো সমাজের জাগরণ পূর্ণতা পায়, তার জন্মলগ্নের মৌলিক উপাদানগুলোর পুনঃউপস্থিতির মাধ্যমেই। অতএব মুসলিম সমাজের জাগরণ, ধার্মিকতার পুনর্পাঠ ব্যতিরেকে তা সম্ভব নয়। আল্লাহ তায়ালা কোরআন কারীমে বলেন, ‘ নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা কোন সম্প্রদায়ের পরিবর্তন ঘটান না, যাবৎ না তারা খোদ নিজেদের পরিবর্তন করে।’ [সুরা রা’দ, আয়াত -১১] এটি মালেক বেন নাবীর চিন্তাকাঠামো গঠনের মৌলিক প্রকল্প।

সভ্যতার ব্যাখ্যা

বেন নাবী মনে করেন, সভ্যতা এক প্রকার  মানবিক উৎপাদন‌। সুতরাং মুসলিম সম্প্রদায়ের উন্নত হওয়া অথবা না হওয়া— নিছকই তাদের ভেতর থেকে উদ্ভূত, যা তাদের মানসিকতা ও ব্যক্তিত্ব গঠন-প্রকৃতির ফল, যেখানে নেতিবাচক সংস্কৃতিচর্চা যেমন স্থান পায়, এর ভিন্ন কিছুও সমানভাবে স্থান পাওয়ার সুযোগ আছে। একটি কার্যকর ও অকার্যকর সমাজের মাঝে তিনি পার্থক্যের জায়গা নির্ণয় করে দেখিয়েছেন যে, কার্যকর সমাজ মূলত কার্যকর মানুষ দ্বারা সৃষ্টি হয়। এ কারণে বলা হয়ে থাকে – ‘ব্যক্তির চাঞ্চল্যে সমাজ ও ইতিহাস সচল থাকে, আর ব্যক্তির নীরবতায় এ দুটি থমকে দাড়ায়।’

আর কার্যকারিতার মৌলিক শর্ত বেন নাবীর কাছে— ব্যক্তি নিজেকে ইতিহাসের নির্মাতা এবং চালক হিসেবে দেখবেন। ইতিহাস কোন তাত্ত্বিক বক্তব্য নয়, বাস্তব ফলাফল। তিনি মনে করেন, এক্ষেত্রে একটা বড় সমস্যা হলো, মানুষ বলার জন্য ও বক্তব্য রাখার জন্যই কেবল চিন্তা করে, এজন্য চিন্তা করে না যে- আমাকে কাজ করতে হবে। ফলে, সম্পদ, সময়, ও জ্ঞান থেকে বাস্তব প্রতিফল আসে না।’

প্রতিটি জাতির সংকট মূলত সভ্যতার সংকট, কোনো জাতির জন্য তাদের সংকট উপলব্ধি করে উত্তরণের পথ বের করা সম্ভব নয়, যতক্ষণ না তারা মানবিক যাপিত জীবন থেকে তাদের চিন্তার খোরাক না বের করছে এবং অনুধাবন করছে সভ্যতার উত্থান ও পতনের কারণগুলো। সভ্যতার গুরুত্ব, সভ্যতার বিকাশ থেকে ক্ষয় পর্যন্ত এর সচলতা বোঝাপড়ার প্রয়োজনীয়তার ক্ষেত্রে তার এই সুদৃঢ় বিশ্বাস থেকে তিনি সভ্যতাকে বিস্তৃত  সংজ্ঞায় হাজির করবার চেষ্টা করেছেন।

তার কাছে সভ্যতার সংজ্ঞা হলো— নৈতিক ও বৈষয়িক সব ধরণের ‘সমন্বয়-প্রয়োজনীয়তা’, যা একটি নির্দিষ্ট সমাজকে তার অস্তিত্বের প্রতিটি পর্যায়ে- শৈশব থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত প্রতিটি সদস্যের জন্য বিকাশের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সহায়তা নিশ্চিত করে, যা তাদের জন্য অতীব দরকার। অতএব, সমাজ তার সন্তানদের কাছে যে শিক্ষামাধ্যম, সুরক্ষার নিশ্চয়তা ও আবশ্যিক অধিকারগুলো সরবরাহ করে থাকে, এর সবটাই সামাজিক সহায়তার বিভিন্ন রূপ। সভ্য সমাজের উচিত এগুলো সামাজিক সদস্যদের কাছে উপস্থাপন করা।

ইবনে খালদুন ও বেন নাবী

আধুনিক ইসলামি চিন্তা-গবেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, মালেক বেন নাবী এ সময়ের ইবনে খালদুনের ভূমিকা পালন করেছেন অনেকাংশে। এবং খালদুনের পর থেকে সম্ভবত তিনি-ই সবচে’ বেশী সভ্যতা চিন্তায় নিজেকে নিমগ্ন রেখেছেন, যদিও পশ্চিমা সভ্যতার দ্বারাও কিছুটা প্রভাবিত ছিলেন বেন নাবী।  তিনি ‘শত বছরের সাক্ষীর ডায়েরি’–তে লিখেন, ‘ইবনে খালদুন তার প্রথম উস্তাদ ও জীবনের সব চেয়ে বড় অনুপ্রেরণা।’ ইবনে খালদুন তার দৃষ্টিতে ‘মানব নগরায়ণ’ বা urbanization (২) এর যে ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন, বেন নাবীও একই ব্যাখ্যা গ্রহণ করেছেন। (দেখুন, ‘মুযাক্কিরাতু শাহিদিল কারন’)

প্রফেসর ড. সারজানী বেন নাবীকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখেন, ‘..এভাবেই মালেক বেন নাবী আমাদের মাঝে উপস্থিত হন, এবং বিংশ শতকের ভাষায় জাতির সচেতনতায় ফিসফিস করে ইবনে খালদুনের জ্ঞানকে প্রতিধ্বনিত করে তোলেন। সমাজের অসুস্থ জায়গাগুলো চিহ্নিত করেন, সাথে সাথে দেখান সামাজিক উত্থানের যাবতীয়  কারণ। উপনিবেশিক চিন্তাকে পরিত্যক্ত ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলেন। উপনিবেশিকদের দুর্গন্ধযুক্ত মানসিকতাকে বিশ্লেষণ করেন। দুর্বল দেশগুলো, বিশেষত, মুসলিমদেরকে পশ্চিমকর্তৃক নিয়ন্ত্রণ করবার ‘কলাকৌশল’ গভীরতর করে পর্যবেক্ষণ করেন তিনি..।’

মৃত্যু

৪ ই শাওয়াল ১৩৯৩ হিজরি, মুতাবেক  ৩১ অক্টোবর ১৯৭৩ ইংরেজি সনে ইতিহাসের এই মহান জ্ঞানতাপস আল্লার দরবারে হাজিরির জন্য বিদায় জানান। আল্লাহ তায়ালা তার ভুল ত্রুটি ক্ষমা করুন, নিজ রহমতের ছায়ায় আবৃত করে নিন। রাহিমাহুল্লাহু তায়ালা রাহমাতান ওয়াসিয়াহ। (৩)

পাদটিকা:—

(১) এই কিতাবটি সামগ্রিক বিচারে অত্যন্ত উঁচু মাপের, এটি তিনি ফরাসী ভাষায় লিখেছিলেন। কোরান উপলব্ধির জন্য যথেষ্ট প্রভাবক বলা যায় একে।

বেন নাবীর জীবদ্দশাতেই একাধিক ফ্রেঞ্চ ব্যক্তির মুসলিম হওয়ার নেপথ্যে এই কিতাব ব্যাপক ভূমিকা রাখে, ফলে এক সময় পশ্চিমে তার এই গ্রন্থ নিষিদ্ধ হয়। তবে, খেয়াল রাখতে হবে, সংখ্যাগুরু আলেমদের ব্যাখ্যার বাইরে গিয়ে কিছু আয়াতের অস্বাভাবিক ব্যাখ্যা এখানে আশ্রয় পেয়েছে, ড. ইউসুফ কারজাবিও কিছু ব্যাপারে সতর্ক করেছেন একটি আর্টিকেলে। এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।

(২) নগরায়ন বা শহরায়ন বলতে গ্রামাঞ্চল থেকে শহুরে অঞ্চলে জনসংখ্যার স্থানান্তর, গ্রামের তুলনায় নগর অঞ্চলে বসবাসরত মানুষের অনুপাত ক্রমশ বৃদ্ধি এবং কোনো সমাজ যেভাবে এই পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নেয় তা বোঝায়। এটি মূলত এমন একটি প্রক্রিয়া— যার মাধ্যমে শহর এবং নগরগুলো গঠিত হয় এবং আরও বেশি লোকের বসবাস এবং কাজ শুরু করায় তা বৃহত্তর মাধ্যম হয়ে ওঠে।

(৩) [মালেক বেন নাবীর ক্ষেত্রে, পক্ষে বিপক্ষের বহু আলাপ আছে। সারকথা হলো, ব্যক্তি মালেক ও তার চিন্তার মূল্যায়ন যারা করেছেন, তারা সামগ্রিক চিত্র সামনে রেখে করেছেন। যারা সমালোচনা করেছেন, তারাও ভুলগুলোকে চিহ্নিত করে দিয়েছেন।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মালেক বেন নাবী কিছু ক্ষেত্রে পশ্চিমা জ্ঞান বিজ্ঞানের ও সভ্যতা দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। লুই ম্যাসিগনন, নিৎশে, অনরে দ্যা বালজাক, বারুখ স্পিনোজাসহ আরো বহু পশ্চিমা দার্শনিকের প্রতি মুগ্ধতার কথা তিনি নিজেই বিভিন্ন গ্রন্থাদিতে স্বীকার করেছেন। এই কাতারে রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরও আছেন। ঠিক একইভাবে, ইবনে তাইমিয়া, ইবনে খালদুন, মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহহাব নজদী ও আল্লামা ইকবাল দ্বারাও প্রভাবিত ছিলেন। কারো পাণ্ডিত্য ও অগাধ জ্ঞানের প্রতি মুগ্ধতা কাজ করা অস্বাভাবিক নয়, তবে সমস্যাটা তখন হয়, যখন মুগ্ধতার জায়গাটা তার চিন্তায় প্রতিফলন ঘটে। ফ্রান্সের প্রতি মুগ্ধ হয়ে তিনি এক জায়গায় লিখেছিলেন- ‘স্বাধীনতা ও আলোকায়নের এ শহর আমায় মুগ্ধ করে’। এটাকে অনেকেই তার দ্বৈত ‘চিন্তা-নির্মাণ’ প্রকল্পের উৎস মনে করেন।

মালেক বেন নাবী, একজন বড় মাপের দার্শনিক ও চিন্তাবিদ ছিলেন নিঃসন্দেহে। বিশ শতকের ইসলামী বিশ্ব তার কাছে অনেক দিক থেকে-ই ঋণী। তবে একথাও ধ্রুব সত্য যে— তার চিন্তারাজ্য ও নির্মাণ প্রকল্প নিয়ে তার সমসাময়িক ও পরবর্তী বহু চিন্তাবিদের যৌক্তিক আপত্তি রয়েছে। আমরা এখানে তাকে উপস্থাপন করেছি, এজন্য নয় যে তার সকল চিন্তাই গ্রহণ করার মত, কিংবা আমাদের কাছে আপত্তির উর্ধ্বে। বরং উদ্দেশ্য হলো, তার মত একজন বিদ্যানের সাথে শুধুমাত্র পরিচয় করিয়ে দেওয়া। আশা করি সার্বিক মূল্যায়ন সামনে রেখেই পাঠক তাকে গ্রহণ করবেন । —হুজাইফা আওয়াদ]

আগের সংবাদধর্মীয় চরম ও শিথিলপন্থা : প্রয়োগ ও অপ্রয়োগ
পরবর্তি সংবাদদেওবন্দের পরিচয়, আদর্শ ও দর্শন