আশরাফ উদ্দীন খান
মাহে রমজানের দিনগুলো প্রায় শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছে। সামান্য সময়ের ব্যবধানেই আমাদের থেকে রমজান বিদায় নেবে এক বছরের জন্যে। বিদায়ের এই মুহুর্তে আমাদের উচিত রমজানে আমার আমল ও অবস্থা নিয়ে মুহাসাবাহ বা পর্যালোচনা করে দেখা। এটা সকলের জানা যে, ইসলামের একটি ‘রুকুন’ ইবাদত হচ্ছে মাহে রমজানের রোজা বা সিয়াম। ইসলামি শরিয়াতের প্রতিটি ইবাদতের মূলে কিছু নির্ধারিত উদ্দেশ্য বা মাকাসিদ রয়েছে, যা অর্জন করা একজন ইবাদত আদায়কারীর জন্যে একটি অপরিহার্য বিষয়। সেই হিসাবে সিয়ামের বিধান নিয়ে প্রতিবছর আমাদের মাঝে মাহে রমজান উপস্থিত হয়ে থাকে একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে, সেই উদ্দেশ্য খোদ কুরআনের আয়াতে, যেখানে মাহে রমজানের রোজার আদেশ দেওয়া হয়েছে, স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সেই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন, ‘…তোমাদের উপর রোজা বা সিয়াম ফরজ করা হয়েছে যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’ সুতরাং রোজার একটি বিশেষ উদ্দেশ্য হচ্ছে তাকওয়া অর্জন করা বা তাকওয়ার সবক গ্রহণ করা।
তাকওয়া একটি ইসলামি পরিভাষা, যার সহজ অর্থ হচ্ছে ‘আল্লাহকে ভয় করা’, মনের মধ্যে এই ধারণা, বিশ্বাস রাখা যে আমার প্রতিটি আচরণ ও উচ্চারণ আল্লাহ তায়ালা দেখছেন, শুনছেন। কাজেই এমন কোনো আচরণ ও উচ্চারণ না করা যেটা আল্লাহ তায়ালার কাছে পছন্দনীয় নয়।
রোজার উদ্দেশ্য হিসাবে তাকওয়াকে নির্ধারণ করা পিছনে যে হিকমত ও সম্পর্ক তা আপাত–দৃষ্টিতে অনুধাবন করা যেতে পারে। কারণ রোজা এমন একটি ইবাদত যার হাকিকত বা বাস্তবতা শুধুমাত্র বান্দা আর তাঁর প্রতিপালক মহান আল্লাহর মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে। সিয়াম এমন একটি ইবাদত যেখানে অন্যকে ধোঁকা দেওয়ার যথেষ্ট সুযোগ থাকা স্বত্ত্বেও মানুষ সেই ধোঁকার পথে অগ্রসর হয় না। সিয়াম পালনের সময়, মানুষের মধ্যে এই ধারণা বিরাজমান থাকে যে দুনিয়ার কোন মানুষ তাকে না দেখলেও, আল্লাহ তায়ালা তাকে দেখছেন। শুধুমাত্র এই ধারণা বা বিশ্বাস লালন করার কারণে তিনি সারাদিন পানাহার ও অন্যান্য রোজা–ভঙ্গকারী কাজ থেকে দূরে সরে থাকেন। এইভাবে এক মাস আমলের মাধ্যমে তার মধ্যে মুলত আল্লাহকে ভয় করা বা তাকওয়ার সবক গ্রহণ ও প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়ে থাকে। এই হিসাবে রোজার মাকসাদ হিসাবে তাকওয়া অর্জন করার বিষয়টি একটি সুস্পষ্ট বিষয়।
রমজানকে আমরা–মুসলিম উম্মাহ—যে আগ্রহ–উদ্দীপনার সাথে বরণ করে থাকি সেটা অনেকটা প্রশান্তির বিষয় বলেই মনে হয়। কারণ রমজানের আগেই মুসলিম উম্মার মাঝে এক অভুতপুর্ব অনুভূতি জাগ্রত হয়ে থাকে। অধীর আগ্রহ নিয়ে সকলে রমজানের অপেক্ষায় থাকে। এরপর রমজানের প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় দিন… গভীর আগ্রহের সাথে সিয়াম ও কিয়াম পালন করতে থাকে। মানুষের আচার–আচরণে রমজানের একটি প্রভাব অনুভব করা যায়। সিয়ামের সাথে অন্যান্য ইবাদতের সম্পর্ক, যেমন কুরআন তেলাওত, জিকির–দোয়া, দান–সদকা, মানুষের প্রতি সহানুভূতি দেখানো, মানুষের উপকার করার মানসিকতা পোষণ করা, অধিনস্তদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করা ইত্যাদি বিষয় রমজানের প্রভাবেই সৃষ্টি হয়ে থাকে।
মাহে রমজানের পবিত্র দিনগুলোতে যে ইমানি–আমলি পরিবেশ ও রুহানিয়াতের বহির্প্রকাশ ঘটে, মাহে রমজান শেষ হওয়ার সাথে সাথে সেই পরিবেশ ও রুহানিয়াত কোথায় অদৃশ্য হয়ে যায়–এই প্রশ্ন আমাদের অনেকেই মনেই জাগ্রত হয়ে থাকে। এর একটি কারণ সম্ভাবত এমন হতে পারে যে—
১.মাহে রমজানের একটি নিজস্ব প্রভাব ও রুহানিয়াত রয়েছে, যার প্রভাব মানুষের মধ্যে প্রকাশ পেয়ে থাকে, যেমন মসজিদে বা কোনো দীনি পরিবেশে থাকার কারণে আমাদের মধ্যে যে প্রভাবের সৃষ্টি হয় সেটা সেই পরিবেশের পরিবর্তন ঘটার মাধ্যমে অবস্থার মধ্যেও পরিবর্তন হয়ে থাকে, যেমন সাহাবায়ে কেরাম যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের মজলিসে থাকতেন তখন তাঁদের মধ্যে যে রুহানিয়াতের সৃষ্টি হতো সেই রুহানিয়াত তাঁদের মধ্যে বিরাজ করত না যখন তাঁরা সেখান থেকে বের হয়ে নিজেদের সাধারণ পরিবেশে যুক্ত হতেন। মাহে রমজানের দিনগুলোতে মুমিন বান্দাদেরকে ইবাদতে নিয়োজিত করার জন্যে আল্লাহর পক্ষ থেকে যে সুরক্ষা ও সহজতা দান করা হয়ে থাকে, তার মাধ্যমেই মানুষের মধ্যে ইমান ও আমলের এই নুরানি পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে থাকে।
২. সেই সাথে, অন্যদিকে মাহে রমজানকে বরণ ও গ্রহণ করার মানসিকতার মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। যেমন কেউ কেউ মাহে রমজানকে বরণ করে থাকেন এই চিন্তা থেকে যে, সারা বছর ইবাদত–বন্দেগিতে যে অবহেলা ও ত্রুটি হয়েছে, রমজানের এই পবিত্র দিনগুলোতে কিছু ইবাদত করার মাধ্যমে সেই অবহেলা ও ত্রুতি দূর করে, নিজের আখেরাতকে সুন্দর করা উচিত। এই মানসিকতা নিয়ে কেউ কেউ এই মাসে ইবাদতের প্রতি উদ্বুদ্ধ হয়ে থাকে।
৩. আবার কিছু মানুষ আছেন যাঁরা মাহে রমজানকে গ্রহণ করে থাকেন এই দৃষ্টিকোণ থেকে যে, এই পবিত্র মাস ইবাদত–বন্দেগির মৌসুম, সেই সাথে সারা বছর আল্লাহর আদেশ–নিষেধ অনুযায়ী অতিবাহিত করার একটি প্রশিক্ষণ এখান থেকে গ্রহণ করা যায়।
অর্থাৎ মাহে রমজান যেমন একদিকে ইবাদত–বন্দেগির বিশাল সুযোগ আমাদের সামনে পেশ করে, তেমনি এই মাস থেকে আমরা সারা বছর সঠিকভাবে চলার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে থাকি। বিষয়টি সহজভাবে উপলব্ধি করার জন্যে আমাদের জীবনের সাধারণ কিছু উদাহরণ পেশ করা যেতে পারে। যেমন আমাদের সমাজে বিভিন্ন বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্য বিভিন্ন সাপ্তাহ বা কর্মসুচি পালন করা হয়ে থাকে। সড়ক আইন অনুসরণ করার সপ্তাহের কথা উল্লেখ করি। এখানে এই এক সাপ্তাহের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র সেই নির্ধারিত সময়ে সড়ক আইন মেনে চলা নয়, বরং সড়ক আইনের ব্যাপারে সাধারণ জনমত সৃষ্টি করা ও জনগণের মধ্যে সাধারণ সচেতনতা সৃষ্টি করা, যার মাধ্যমে সাধারণভাবে মানুষের মধ্যে সড়ক আইনের প্রতি বাধ্যবাধকতা তৈরি হতে পারে। এই উদাহরণটি সামনে রেখে রমজানের দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক। রমজান মাসে বিভিন্ন আমলের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে, কুরআন তেলাওত, তাহাজ্জুদ, নফল নামাজ, জিকির, দোয়া, দান–সদকা, মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করা ইত্যাদি। এক মাস মানুষকে এই সকল আমলের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করার মাধ্যমে তাদের মধ্যে এই সকল আমলের প্রতি এক ধরনের অভ্যাস ও আগ্রহ সৃষ্টি হয়ে থাকে, যাতে বছরের বাকি সময়ে এই সকল আমলের সাথে আমাদের বেশী বেশী সম্পর্ক সৃষ্টি হতে পারে।
মাহে রমজানের বিদায় মুহূর্তে এই মাসে আমাদের সামগ্রিক আমল ও অবস্থার পর্যালোচনা করে দেখা অতি জরুরি। একটি হাদিসে এরশাদ করা হয়েছে–‘ধ্বংস হোক সেই ব্যক্তি যে রমজান মাস পেল কিন্তু নিজে গুনাহ মাফ করিয়ে নিতে পারল না।’ রমজানের বিদায়ের মুহূর্তে এই বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে দেখা জরুরি যে, আমরা কি রমজানের এই পবিত্র মুহূর্তে নিজেদের গুনাহ মাফ করিয়ে নিতে পারছি? আরেকটি হাদিসে এরশাদ করা হয়েছে যে, ‘যে রমজান মাসে মিথ্যা কথা ও অন্যায় আচরণ থেকে বিরত থাকতে পারল না তার পানাহার বর্জন করার কোনো দরকার নেই।’ অর্থাৎ সিয়ামের অর্থ শুধুমাত্র পানাহার বর্জন করা নয়, বরং আল্লাহ তায়ালার নিষিদ্ধ বিষয় থেকে নিজেকে বিরত রাখা হচ্ছে রোজার মূল উদ্দেশ্য।
ইসলামের ইবাদতসমূহ যতটুকু না পালনের তার চেয়ে বেশি উপলব্ধির, অর্থাৎ ইবাদত আদায় ও পালন করার সাথে সাথে সেই ইবাদতের হাকিকত ও বাস্তবতা উপলব্ধি করা একটি গুরুত্বপুর্ণ বিষয়। ইবাদতের ব্যাপারে একটি হাদিসে সাধারণভাবে বলা হয়েছে, ‘ইহসান হচ্ছে এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত করা যেন তুমি আল্লাহকে প্রত্যক্ষ করছ, যদি এই উপলব্ধিতে আসতে না পারো তাহলে অন্ততপক্ষে এই উপলব্ধি করা যে আল্লাহ আমাকে দেখছেন।’ নামাজের ব্যাপারে পবিত্র কুরআনের আয়াতে বলা হয়েছে, ‘নামাজ কায়েম করো, আমার স্বরণে।’ আল্লাহর জিকিরের অর্থ শুধু মুখে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা নয়, বরং অন্তর থেকে আল্লাহর স্বরণ করা, আল্লাহর সিফাত ও গুণাবলি নিয়ে চিন্তা–ফিকির করা। সিয়ামের ব্যাপারে একটি হাদিসে বলা হয়েছে, ‘সিয়াম আমার জন্যে, আমিই এর প্রতিদান দেবো।’ ‘রোজাদারের জন্যে দুটি খুশি : একটি ইফতারের মুহূর্তে আরেকটি আল্লাহর সাথে মিলিত হওয়ার মুহুর্তে।’ এই হাদিসটি আমাদেরকে দুনিয়ার সাধারণ পার্থিব খুশির ধারণা থেকে আখেরাতের অপার্থিব ধারণা উপলব্ধির জগতে নিয়ে যায়। সারাদিনের ক্ষুধা–পিপাসার কষ্ট যেমন ইফতারের সময় দূর হয়ে একটি তৃপ্তি অনুভূত হয়, সেই তৃপ্তিকে অনুভব করে স্বরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, মহান প্রতিপালকের সাথে মিলিত হওয়ার সময় রোজাদারের জন্যে আরেকটি খুশি অপেক্ষা করছে।
কাজেই রমজানের বিদায়ের সময়ে প্রতিটি রোজাদারের মধ্যে এই পর্যালোচনা আসা দরকার যে, রমজানের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে কতটুকু সফলতা অর্জন করতে পারলাম, আর সেই সাথে রমজানের প্রভাব থেকে কতটুকু প্রভাব গ্রহণ করতে পারলাম, এবং সেই প্রভাব রমজানের বাইরে আমাকে কতটুকু পরিচালিত করতে পারবে। এই উপলব্ধি, পর্যালোচনা ও প্রত্যয়ের মাধ্যমেই রমজানকে বিদায় জানানো উচিত। রমজানের ব্যাপারে আকাবেরদের অবস্থান উল্লেখ করার ব্যাপারে বলা হয়ে থাকে যে তারা রমজানের আগ থেকেই রমজানের জন্যে অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতেন, আর রমজানের বিদায়ের পরে তারা রমজানে কৃত আমল যেন আল্লাহর নিকট কবুল হয় সেই জন্যে দীর্ঘ দোয়া করতে থাকতেন। রমজানের প্রতি আমাদের মানসিকতাও ঠিক এমন হওয়া উচিত। ইসলামের প্রতিটি ইবাদতের প্রভাব ইবাদতের মুহূর্তকে অতিক্রম করে ইবাদত আদায়কারীর সমগ্র জীবন ও চিন্তাকে আচ্ছাদিত করে থাকে।
লেখক : আলেম ও গবেষক