মিশরে বাঙালী ছাত্রদের ঈদ : দিন যাপনের গল্প

যুবায়ের হুসাইন :

হাইয়া! বিসুর‌আহ ইয়া আখি! দেরি হয়ে যাবে তো!

আমার রুমমেট আলবানিয়ান ঈসার তাড়া পেয়ে আমি আমার বাঙ্গালী ধীরগতি বাদ দিয়ে আরেকটু দ্রুত প্রস্তুতি নিতে লাগলাম। ততক্ষণে বাসার অন্যান্য সিরিয়ান এবং রাশিয়ান সদস্যরা প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে প্রায়। বাইরে তাকবির শোনা যাচ্ছে। ঈদুল ফিতরের তাকবির। আজকে পরিবার থেকে দূরে মিশরে আমার প্রথম ঈদ। কিন্তু‌ এত তাড়াহুড়ো কীসের! একটু আগেই না ফজরের নামাজ হলো? না থেমে এখনো একনাগাড়ে তাকবির চলছেই। একটু পর পর আওয়াজ পরিবর্তন হচ্ছে অবশ্য। একটু ভালো করে কান পাতলে বিভিন্ন জায়গা থেকে ভেসে আসা তাকবিরের আওয়াজ আলাদা করা যাবে। ঈসার ক্রমাগত তাড়ার কারণে দূর থেকে ভেসে আসা তাকবিরের আওয়াজ আলাদা করার সুযোগ পাওয়া গেল না অবশ্য। গোসল করে, সাদা জুব্বাটা ইস্ত্রি করে, একটু আতর দিয়ে আশপাশের জন্য নিজেকে সুরভিত করে বেরিয়ে পড়লাম। মিষ্টি কিছু কি খেয়েছিলাম? মনে পড়ছে না এখন।

বাসার পাশেই ঈদের নামাজের জন্য নির্ধারিত স্থান। ইমাম শাফেয়ী রহিমাহুল্লার মতে, মসজিদ প্রশস্ত হলে ঈদের নামাজ মসজিদে পড়াই উত্তম। (১) আমাদের বাসার পাশের মসজিদটা বেশ প্রশস্ত‌ই বলা চলে। সামনে বড় আঙ্গিনা, রাস্তা আর মসজিদ মিলিয়ে নামাজের জায়গা। ঈদগাহে পৌঁছুতে‌ই ঈসার প্রকটভাবে তাড়া দেয়ার কারণ জানা গেল। পৌঁছার একটু পরেই ইমাম সাহেব নামাজ শুরু করে দিলেন। পরে অন্যান্য ভাইদের কাছে শুনেছি প্রথমবার সবার‌ এক‌ই অভিজ্ঞতা হয়। দ্রুত পৌঁছাতে না পারলে ঈদের জামাত ধরা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। প্রথমবার ঈদের নামাজ প্রায় সব বাংলাদেশী ভাইদের‌ই কোনো না কোনো মজার কিংবা অনাকাঙ্ক্ষিত কাহিনী আছে। এবং বলতে গেলে সবার‌ই মূল ঘটনা এক‌ই।

আমাদের সময়টা কি খুব দ্রুত ফুরিয়ে হয়ে যাচ্ছে? নবি কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভবিষ্যৎ বাণী ‘তাকারুবুয যামানের’ চাক্ষুষ সাক্ষী কি আমরাই? দেখতে দেখতে মিশরে পাঁচ বছর হতে চলল আমার। কোনো কোনো উলামায়ে হাদীসের মতানুযায়ী আমি চাইলে এখন নিজের নামের সাথে ‘মিশরী’ সম্বোধন যোগ করতে পারি। তাবেয়ী আমের বিন আব্দে কায়সের একটা ঘটনা আছে। তাকে একবার এক লোক দাঁড় করিয়ে কিছু বলতে চাইলো। তখন তিনি লোকটিকে বললেন, ‘আগে সূর্যকে তুমি থামিয়ে দেখাও।’

সময়ের পরিক্রমায় হুট করে আরেকটি রোজার মাস এসে শেষ হয়ে যাচ্ছে। কদিন পর আবার ঈদের চাঁদ উঠবে আকাশে। ঈদুল ফিতরের হিসেবে অবশ্য মিশরে এটি আমার চতুর্থ ঈদ। মাঝখানে এক বছর ঈদুল ফিতরের সময়টা দেশে কাটানোর সুযোগ হয়েছিল। তবে এবারের ঈদটা বোধ করি খুব দ্রুত চলে এল। গত ঈদের স্মৃতি এখনো একটু‌ও হলদেটে হয়নি। মনে হচ্ছে, এইতো সেদিন ‘সূক সাইয়ারত’ এর বিশাল প্রান্তরে ঈদের নামাজ পড়লাম। মিশরীদের পাশাপাশি আশপাশের প্রচুর বিদেশী ছাত্র/পরিবার এখানে নামাজ পড়তে আসেন। দেখে মনে হবে কোনো আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক সম্মেলন বসেছে এখানে‌। বিভিন্ন রং-গোত্রের মানুষেরা তাদের ঐতিহ্যবাহী সব পোষাকে এক জায়গায় উপস্থিত। অদ্ভুত সুন্দর এক দৃশ্য! এদিক সেদিক তাকালে পরিচিত অনেককেই দেখতে পাওয়া যাবে। ছবি তোলার জন্য এগিয়ে আসবে অনেক ভিনদেশীরা। আশপাশে আরো অনেককেই বিভিন্ন ভঙ্গিতে ছবি তুলতে দেখা যাবে। কেউ কেউ হয়তো দূর দেশে তাদের পরিবারের সাথে কথা বলা শুরু করে দিয়েছে। তাদের চোখেমুখে তৃপ্তির আভা দেখে মনের মধ্যে বেশ ভালো লাগা চলে আসবে আপনার। ‘ঈদ মুবারক ওয়া সায়ীদ, তাকাব্বালাল্লু মিন্না ওয়া মিনকুম সালিহাল আ’মাল, কুল্লু আম ওয়া আনতুম বিখাইর’ এ জাতীয় ঈদ সম্ভাষণের মৃদু গুঞ্জনে ভরে উঠবে চারিদিক। কী মোহনীয় এক পরিবেশ!

রোজার মাসে কায়রোর রাতগুলো আগের চেয়ে অনেক বেশি রঙ্গিন হয়ে ওঠে। মহল্লার রাস্তাগুলো ছেলে-পেলেরা ফানুস এবং বিভিন্ন বাহারী কাগজ দিয়ে সাজায়। গৃহিণীরা বাসায় আলাদা সজ্জা যোগ করেন। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় কোনো কোনো বাসার ব্যালকনিতে চোখ পড়লে, ঝলঝলে আলোর ঝাড়বাতি দেখতে পাওয়া যাবে। কিংবা অন্ততপক্ষে কয়েকটা ‘রামাদান কারীম’ লেখা ফানুস। দোকানপাটগুলো‌ দেখলে মনে হবে যেন সেগুলোর গায়েও রোজার রং লেগেছে। মসজিদগুলোতে রাতে লম্বা তারাবী হয়। শেষ দশ রাতে কিয়ামুল লাইলের‌ও আলাদা জামাত হয়।

চাঁদ রাতে সেই কোলাহল কিছুটা স্তিমিত হয়ে আসে। তখন রাস্তায় বেরোলে দেখা যাবে মানুষজন ঈদের দিনের জন্য শেষ মূহুর্তের খাবার দাবারের কেনাকাটা সেরে নিচ্ছেন। গৃহিণীদের কিছুটা অস্থির ভঙ্গিতে কেনাকাটা করতে দেখা যাবে। আরো কত কিছু কেনা কে জানে! মসজিদগুলো থেকে আর তারাবীর কুর‌আনের শব্দ ভেসে আসছে না দেখে আপনার একটু খারাপ হতে পারে অবশ্য। তবে একটু হাঁটলে কায়রোতে যে অল্পকিছু লাল ফুলের গাছ রয়েছে, সেগুলোতে লাল ফুলে ছেয়ে যাওয়া দেখে আপনার ভালো লাগতে শুরু করবে। রাস্তায় বাচ্চাদের অবাধ কিচিরমিচির আর তরুণদের ঝাঁক দেখে আপনি ঈদের আমেজ পেতে শুরু করবেন। এরপর একটু ঘুমিয়ে যখন সকাল হবে, ফজরের একটু পর থেকেই ভিন্ন সুরে আবার সেই পরিচিত তাকবিরের আওয়াজ শোনা যেতে থাকবে সব জায়গায়।

আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্! আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ!

একটু আলো ফুটতেই একে একে সবাই বেরিয়ে আসতে শুরু করবেন ঈদগাহের উদ্দেশ্যে। বড়-ছোট, ছেলে-মেয়ে সবাই। ছোট্ট বাবুগুলোও তাদের বাবা-মার কোলে পিঠে করে চলে আসবে। মায়া মায়া দৃষ্টি নিয়ে আপনার দিকে তাকিয়ে থাকবে। ভাগ্য ভালো হলে আপনি তাদের থেকে হৃদয়কাড়া এক টুকরো শিশু হাসিও উপহার পেতে পারেন। এত সবকিছু উপভোগ করতে চাইলে ঈদগাহে যেতে দেরি করা যাবে না একদম। একটু দেরি হলেই জায়গা পেতে কষ্ট হয়ে যাবে। ফজরের একটু পর থেকে নিয়ে একেবারে নামাজ শুরু হ‌ওয়ার আগ পর্যন্ত অনবরত মাইকে তাকবির চলতেই থাকবে। চতুর্দিক থেকে ছুটে আসা মানব স্রোতের সাথে আপনিও একসময় ঈদগাহে পৌঁছে যাবেন। আমরা একবার কয়েকজন মিলে আযহার মসজিদে ঈদের নামাজ পড়লাম। সেই এক‌ই পরিবেশ। এক‌ই স্নিগ্ধতা। তবে এর সাথে মিশে ছিল কিছুটা ইতিহাসের আচড়।

নামাজের পরে সাধারণত আমার মত পরিবারহীন মানুষদের, বিভিন্ন বাসায় দাওয়াত থাকে। বড় ভাইদের স্ত্রীরা বাসায় মোটামুটি একটা ভুড়িভোজের আয়োজন করেন। ঈদের দিন সন্ধ্যায় অথবা পরদিন বাংলাদেশী বিভিন্ন কমিউনিটি আলাদা আলাদাভাবে ঈদের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।সেখানেও আরো খাবার দাবারের ব্যবস্থা থাকে। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে সাধারণত একটা খাবারময় ঈদ উদযাপন ঘটে বলা যায়। তবে ঈদের দিন সকালবেলার চা এবং ঘুম কাব্য রচনা হতে পারে বলে আমার ধারণা। ভিডিও কলের কল্যাণে পরিবার থেকে দূরে ঈদ কাটানোর যে আবেগী পরিবেশ এবং আবহ, এখন সেটা বলবৎ নেই বললেই চলে। মনেই হয় না যে, আপনি দেশ থেকে হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে আছেন। আল্লাহ্ তায়ালা আমাদেরকে অসংখ্য তার নেয়ামতরাজিতে ডুবিয়ে রেখেছেন। নেয়ামতের মধু আমাদের শরীর থেকে চুইয়ে পড়ছে অবিরত!

কিন্তু এবার রোজায় আমরা এসবের কিছুই দেখিনি। ফানুস দিয়ে কায়রোর গলিগুলো ভরে ওঠেনি আগের মতো। ব্যালকনিতে ঝুলে থাকা রমজানের ঝাড়বাতিগুলো পূর্বের মত ঝলমল করছে না তেমন। কেউ কেউ এরপরও চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাদের ঝোলানো ফানুসগুলো, ঝাড়বাতিগুলো কেমন যেন নিস্প্রভ দেখাচ্ছিল। ধর্ম মন্ত্রণালয় আগে থেকেই মসজিদে নামাজ নিষিদ্ধ করে রেখেছিল। সে কারণে এবার সব রাতগুলোই চাঁদ রাতের মতো কিছুটা নিস্তব্ধ। কোথাও তারাবির তেলাওয়াতের আওয়াজ নেই। ঈদের নামাজ‌ও অনুষ্ঠিত হবে না এবার মিশরে। জমজমাট ঈদগাহগুলো এবার বিরাণ পড়ে র‌ইবে। মসজিদগুলোতে বাচ্চাদের ছুটোছুটির কারণে নামাজ বিঘ্নিত হবে না কারো। তবে এতকিছুর পরেও সেই লাল ফুলগুলো কিন্তু ফুটেছে। রাস্তার ধারে, গলির মুখে লালচে আভা ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে চোখ পড়তেই আমার ঈদের কথা মনে পড়ে ওঠে আবার। এবারের ঈদের আমেজ তো এই ওইটুকুই!

পাদটিকা: 

১. বিস্তারিত জানতে ইমাম নববী রহিমাহুল্লার শারহুল মুহাযযাব দেখুন।

 

আগের সংবাদগৌর বাংলায় মুসলিম পর্যটক 
পরবর্তি সংবাদআমাদের মিডিয়া, কয়েকটি খুচরো আলাপ