
তাসফিন জাকি:
মধ্যাহ্ন। বাগদাদ শহর। আব্বাসিদের স্বপ্নভূমি। প্রাসাদ অভ্যন্তরে আবহাওয়াটা বেশ চমৎকার। কথোপকথনের মৃদু আওয়াজ ভেসে আসছে।
মৃদু ধাক্কাতেই রুদ্ধ দরজা খুলে গেলো। প্রবেশ করলো পাঁচ তুর্কি সিপাহী। মস্ত হলরুম জনশূন্য। এক কোনে খলিফা মুতাওক্কিল আর উজির ফাতেহ আল খাকান আলাপে নিমগ্ন। স্বভাবতই অনাধিকার অনুপ্রবেশে তারা বিরক্ত হলেন। শাহজাদা আল মুনতাসির সাথে থাকায় নিরব রইলেন উভয়েই।
সিপাহীরা দ্বিধাহীন চিত্তে এগিয়ে এলো। হত্যা করলো খলীফাকে। উজির আল খাকানও ভোগ করলেন একই পরিণাম। নিষ্কম্প চোখে শাহজাদা দেখলেন, সমর্থন করলেন ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ড।
গ্রীক মিথলজির ট্র্যাজিক চরিত্র ওডিপাস হত্যা করেছিলেন নিজ পিতাকে। দখল করেছিলেন রাজত্ব। যার সমস্তটাই ঘটেছিলো আচমকা, অজান্তে। আব্বাসী শাহজাদা ছিলেন ব্যতিক্রম। গুনে গুনে ফেলেছেন প্রতিটি কদম। নিখুঁত পরিকল্পনায় আরোহণ করেছেন কাঙ্ক্ষিত সিংহাসনে। ওডিপাস প্রায়শ্চিত্ত করছিলেন নিজের চোখ তুলে। নির্বাসন গ্রহণ করে। ইতিহাস ক্ষমা করেনি আব্বাসী শাহজাদা মুনতাসিরকেও!
৭ম হিজরী। ১০ ই জামাদাল উলা। বুধবার। হেজাজের মদিনা নগরী। রাসূল সা.-এর দরবার। পারস্য সাম্রাজ্যের প্রদেশ বাহরাইনের গভর্নর ‘বাজান’ দুজন দূত পাঠিয়েছেন। সম্রাটের আদেশ আরবের মোহাম্মদ সা.-কে হাজির করো আমার সামনে। গতকালই তারা পৌঁছেছিল। রাসূল সা. আদেশ করেছেন আজ আসতে।
দূত দুজন কিছুটা বিস্মিত। একটু বিরক্তও। আরবের মদিনা আর পারস্যের রাজধানীর মাঝে যোজন যোজন দূরত্ব। সেখানের কোন খবর এখানে আসতে কম করেও সপ্তাহ খানেক লাগে। মোহাম্মদ নামক লোকটি বলছে, গতরাতে সম্রাট খসরু পারভেজ আপন সন্তান শেরওয়াহ কর্তৃক নিহত হয়েছে! তারা বেশ দ্বন্দ্বে পড়ে গেলো।
ইতিহাসের সবটা জুড়েই নিরন্তর ক্ষমতার লড়াই। ক্ষমতার প্রশ্নে কেউ ছাড় দিতে রাজি নয় বিন্দুমাত্র। পিতা জলহস্তী পুত্র সন্তানের জন্মের কিছুটা পরেই তাকে হত্যা করে। ভবিষ্যতে পুত্রই যে তার ক্ষমতার বড় হুমকি। ইতিহাসের এক পাশের মলাটকে পিতা পুত্রের ভালোবাসার অনবদ্য উপাখ্যানগুলো যেমন রঙিন করেছে, অন্যপাশকে তেমনি কিছু নৃশংস কাহিনী করেছে কলঙ্কিত।
মুসলিম খেলাফতের বয়সটা তখন ২৪৭। খেলাফতে রাশেদার পর উমাইয়া রাজবংশ। তারপর আব্বাসীদের শাসনকাল। দীর্ঘ এতটা সময়ে এ ধরণের নৃশংসতা এবারই প্রথম। বাগদাদ সমীপবর্তী খরস্রোতা দজলার উত্তাল জলরাশিও হয়তো কিছুটা কালের জন্য থমকে গিয়েছিল এ ঘটনায়।
২৩৫ হিজরীতে খলিফা মুতাওক্কিল স্থলাভিষিক্ত ঘোষণা করেছিলেন বড় ছেলে মুনতাসিরকে। তারপর অন্য দু ছেলে। কিন্তু সন্তানের ধর্মীয় দর্শন ভ্রান্তিপূর্ণ মনে হতেই সে ঘোষণা বাতিল করেন। পূর্ব থেকেই বাবার ধর্মীয় চেতনার বিরোধী মুনতাসির। মুতাজিলি চিন্তাপ্রিয় দাদার অনুসারী ছিলো সে। বাবার এ কাজ তাকে আরো বিদ্বেষী করে তোলে। যার প্রকাশ ঘটে অচিন্তনীয় বিদ্রোহে।
বুগা কবির এবং ওসিফ তুর্কি। মুনতাসিররের বিদ্রোহ-কাণ্ডের প্রধান দুই মদদদাতা। দুজনই তুর্কি অফিসার। পিতৃহত্যার পর হতেই ধীরে ধীরে তুর্কিদের প্রতি আস্থা হারাতে থাকে মুনতাসির। দরবারে বেশ ক্ষমতাশালী তুর্কিরা শঙ্কিত হতে থাকে ভবিষ্যত নিয়ে।
গালিচাটা নয়ন জুড়ায়। পারস্যের তৈরি। রাজকোষের শোভাবর্ধক। মুগ্ধদৃষ্টিতে সবাই দেখছে। তাকিয়ে আছে মুনতাসিরও। তার দৃষ্টি কেড়েছে গালিচার একটা প্রান্ত। শিরদাঁড়া বয়ে শীতল শিহরণ বয়ে গেলো!
‘আমি কিসরা শেরওয়াহ বিন কিসরা পারভেজ। আমি নিজ পিতার হন্তারক। তবে এর পর আমি ৬ মাসও বাঁচতে পারিনি!’ কথাটা লেখা ছিলো গালিচার একটা প্রান্তে।
রাজ্য লাভের ঠিক ৬ মাস পর মৃত্যু বরণ করেন মুনতাসির। তুর্কি অফিসারদের প্ররোচনায় ডাক্তাররা বিষ খাওয়ায় তাকে। আব্বাসিদের বেখেয়ালি রাজপুত্রকে ইতিহাস ক্ষমা করেনি।
তথ্যসূত্র:
১. আল বিদায় ওয়ান নিহায়া। ২৪৭ হিজরীর অধীনে।
২. তারিখুল খুলাফা। নজর সংস্করণ। পৃষ্ঠা ২৬০।
৩. তারিখে ইবনে খলদুন, ৩/৩৫০।
৪. তারিখে উম্মাতে মুসলিমা। মাকতাবাতুল আজহার। পৃষ্ঠা ৩১২।
৫. আর রাহিকুল মাখতুম। তাওহীদ পাবলিকেশন্স। পৃষ্ঠা ৪০৮।