মুফতি শহিদুল ইসলাম: মানবসেবায় উৎসর্গ যার জীবন

মুনশী নাঈম:

মানব সেবামূলক সংগঠন আল মারকাজুল ইসলামীর (এএমআই) চেয়ারম্যান, নড়াইল-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মুফতি শহিদুল ইসলাম ইন্তেকাল করেছেন। বৃহস্পতিবার (২৭ জানুয়ারি) রাত সাড়ে ১২টার দিকে মানিকগঞ্জে তার প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা আবু হুরায়রায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। দীর্ঘদিন ধরে তিনি ডায়াবেটিস, প্রেশারসহ নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন। শুক্রবার (২৭ জানুয়ারি) দুপুর ২টা ৪০ মিনিটে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ চত্বরে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় ইমামতি করেন ফিলিস্তিনের বায়তুল মুকাদ্দাসের ইমাম শায়খ আলী ওমর আল আব্বাসি। পরে কেরানীগঞ্জে তার প্রতিষ্ঠিত জামিআতুল উলুম আল ইসলামিয়া মাদ্রাসার পাশে কবর দেওয়া হয়।

হেফাজতের আমীর আল্লামা শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী ও মহাসচিব আল্লামা শায়েখ সাজিদুর রহমান বলেছেন, আল মারকাজুল ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান বিশিষ্ট সমাজসেবক মুফতি শহীদুল ইসলামের ইন্তেকালে দেশ একজন বিশিষ্ট আলেম সমাজসেবককে হারিয়েছে। তার মৃত্যুতে দেশ ও ইসলামি অঙ্গনের যে ক্ষতি হয়েছে, তা অপূরণীয়। মারকাজুল ইসলামীর মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের সেবায় অসামান্য অবদান রেখেছেন। তিনি তার সেবামূলক কাজের জন্য আজীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

এই মানুষটি তার ভূমিকা, সেবা, অবদানে এদেশে একটি শিরোনামে পরিণত হয়েছিলেন। সেবক-আলেম হিসেবে শত্রু-মিত্র দেশের সব পক্ষের মানুষ তাকে চিনতো। বাংলাদেশের আলেম-সমাজের জন্য প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সেবার অঙ্গনের দরজা দৃশ্যমানভাবে প্রথমে খুলে দিয়েছেন তিনি। এই লেখায় তার সংক্ষিপ্ত জীবন-বিবরণী তুলে ধরছি।

জন্ম, পড়াশোনা, পরিবার

মুফতি শহীদুল ইসলাম হাফি: ১৫ মার্চ ১৯৬০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) ফরিদপুরের ঝিলটুলী এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। পৈত্রিক নিবাস নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলায়। তার পিতা শামসুল হক সরদার।

গোপালগঞ্জের গহরডাঙ্গা মাদ্রাসায় তিনি তার শিক্ষা জীবন শুরু করেন। গওহারডাঙ্গায় হিফজ শেষ করার পর এসে ভর্তি হন জামিয়া মুহাম্মদিয়া যাত্রাবাড়ীতে। সেখানে ডক্টর আসাদুল্লাহ গালিবের কাছে ‘ফিকহে মুহাম্মদী’ অধ্যয়ন করেন। পরবর্তীতে লালবাগ মাদরাসা এবং কামরাঙ্গীরচর মাদরাসায় পড়ে পাকিস্তানের করাচীর বিন্নুরী টাউন মাদ্রাসায় ভর্তি হোন। সেখান থেকে ১৯৮৮ সালে দাওরায়ে হাদিস (মাস্টার্স) শেষ করে ইফতাও (ইসলামি আইনশাস্ত্রের পাণ্ডিত্ত্ব) সম্পন্ন করেন।

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি দুই পুত্র ও চার কন্যার জনক ছিলেন। পুত্র দুইজন হলেন: মুফতি তালহা ইসলাম এবং মাওলানা হামজা ইসলাম। হামজা ইসলাম মারকাজের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।

আল-মারকাজুল ইসলামী প্রতিষ্ঠা

তার কর্মজীবনের বড় একটি অধ্যায়জুড়ে রয়েছে সেবাসংস্থা আল-মারকাজুল ইসলামী। বেসরকারি এই সেবা সংস্থা দেশ-বিদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের সাহায্য-সহযোগিতায় বিভিন্ন সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। বিন্নুরী টাউন মাদ্রাসায় অধ্যয়নকালে ১৯৮৮ সালে তিনি আল মারকাজুল ইসলামী প্রতিষ্ঠা করেন। বিভিন্ন দেশের বন্ধুদের পরামর্শে এই সংস্থার প্রথম নামকরণ করেন ‘মুসলিম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন’। পরে বিন্নুরী টাউনের এক উস্তাযের পরামর্শে ‘আল মারকাযুল ইসলামী বাংলাদেশ’ নাম রাখেন। পাকিস্তানে এ সংস্থার অর্থ জমা রাখতেন শায়খ আব্দুল মালেক হাফি.-এর কাছে।

দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তির অর্থ-সহযোগিতা বিশেষ করে সৌদি আরব, কাতার, দুবাই, আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের সহযোগিতায় মারকাযের বিভিন্ন সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। নব্বই দশকের শুরুতে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে মারকাজের কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। বাবর রোড ও শ্যামলীতে সংস্থাটির নিজস্ব সম্পত্তি রয়েছে। বর্তমানে কেরানীগঞ্জ উপজেলার সিরাজনগর ইউনিয়নে ১৬০ বিঘা জমির ওপর আল মারকাযুল ইসলামীর বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

এ সংস্থার অধীনে বেশ কয়েকটি কওমি ও মহিলা মাদ্রাসা পরিচালিত হয়। এ ছাড়া মারকাজুল ইসলামী অসংখ্য মসজিদ-মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখেছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নলকূপ স্থাপন করে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করেছে, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের ফ্রি চিকিৎসার পাশাপাশি ঠোঁট কাটা, তালু কাটা রোগীদের ফ্রি চিকিৎসা করেছে। মারকাজুল ইসলামীর অধীনে মানবসেবামূলক নানা কাজ চালু রয়েছে। হাসপাতাল, অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস, লাশ বহন, লাশের গোসল করানো থেকে শুরু করে বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের সংক্রমণের সময় মৃতদের দাফন ও সৎকার কার্যক্রম নিয়ে সর্বমহলের ব্যাপক প্রশংসা পায় সংস্থাটি। ১৯৮৮ সালের বন্যার সময় বাংলাদেশের প্রায় সব মাদ্রাসায় চাউল বিতরণ করেছিলেন তিনি।

তিনি মানবসেবার উদ্দেশ্যে বহু এম্বুলেন্স ক্রয় করেছেন। রাজধানী ঢাকায় যে কোনো শীর্ষ আলেমের ইন্তিকাল হলেই আল মারকাযুল ইসলামীর এম্বুলেন্স এসে হাজির হয়ে যায়। এম্বুলেন্সের প্রথম টাকা দিয়েছিলেন তার মা। বিভিন্ন ঘরোয়া আলোচনায় তিনি এ কথা জানিয়েছেন।

শিক্ষা বিস্তারে অবদান

বাংলাদেশে আরবী ভাষা-সাহিত্যের জোয়ার তৈরীর পেছনের তার অবদান খাটো করে দেখা যাবে না। তিনি মারকাযুল ইসলামীর অধীনে আরবী সাহিত্য বিভাগ খুলে এর দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন শায়খ শহীদুল্লাহ ফজলুল বারী রহ: এর হাতে। তিনি তার নিপুণ কারিশমায় দেশে আরবি চর্চার জোয়ার তৈরী করেন।

মুফতী শহীদুল ইসলাম আল মারকাযুল ইসলামীর পক্ষ থেকে প্রতি মাসে আরবী ম্যাগাজিন প্রকাশ করতেন। বিভিন্ন ইসলামী রাষ্ট্র থেকে আরবী ভাষার বিভিন্ন কিতাব এনে বাংলাদেশের উলামা-তালাবার মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ করতেন। তার ভাষ্যমতে, বিভিন্ন দেশ থেকে আগত কিতাব অনেক সময় মুফতী আবদুর রহমান বসুন্ধরা রহ: এর পরিচালনাধীন আল মারকাযুল ইসলামীতে চলে যেতো।

তিনি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিদের শিক্ষা-দীক্ষার লক্ষ্যে আফ্রিকা থেকে শিক্ষক এনে অন্ধ বিভাগ চালু করেন। যার মাধ্যমে শত শত অন্ধ মানুষ কুরআন এবং দ্বীনী জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হচ্ছে।

রাজনৈতিক জীবন

তিনি ইসলামী ঐক্যজোট করতেন এবং মজলিসে শূরার সদস্য ছিলেন। পরে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস (২০০১-২০০৯) করেছেন। মজলিসের জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির ছিলেন। ২০১১ সালের ২১ জুলাই দলটির নায়েবে আমিরের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ গণসেবা আন্দোলন নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। তিনি এ দলের চেয়ারম্যান।

চারদলীয় ঐক্যজোটের অধীনে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের পক্ষ থেকে ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নড়াইল-২ আসনে সাংসদ পদে নির্বাচনে করেন। এ নির্বাচনে শেখ হাসিনা ৪ হাজার ২৩৩ ভোটে জয়ী হয়েছিলেন। পরে শেখ হাসিনা আসনটি ছেড়ে দিলে ২০০২ সালের উপনির্বাচনে তিনি বিজয়ী হন। ২০০৮ সালের নির্বাচনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। এরপর ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকেন। ২০১৮ সালে নড়াইল-২ আসনে একাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দাখিল করেছিলেন। কিন্তু তাকে মনোনয়ন দেয়া হয়নি।

মুফতি আজিজুল হক কাসেমী স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘মুফতি শহিদুল ইসলাম শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ.-এর অত্যন্ত প্রিয়ভাজন ছিলেন। চারদলীয় ঐক্যজোটের পক্ষ থেকে ইসলামী ঐক্যজোটকে একটি মন্ত্রীত্বের পদ দিতে চাইলে শায়খুল হাদীস রহ. সে পদটি মুফতী শহীদুল ইসলামকে দেওয়ার আবেদন করেছিলেন। মুফতী সাহেব সে মন্ত্রীত্বের পদ নিতে রাজি হননি। যখন শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. ঢাকা পল্টনের মুক্তাঙ্গনে স্বীকৃতির জন্য ডাক দিয়েছিলেন, তখন তিনি শাইখুল হাদীস রহ.-এর ডান হাত ছিলেন। তখনকার সময়ে উলামা-তালাবার খানার ব্যবস্থা তিনিই করতেন। তিনি আমাদেরকে বলেছেন, সে আন্দোলনে প্রথম দিনের প্রথম খাবার ব্যবস্থা করেছিল আমার এক হিন্দু ভক্ত।’

শেষ বিদায়

২৪ জানুয়ারি এএমআই সিটি কেরাণীগঞ্জে অবস্থিত জামিআতুল উলূম আল ইসলামিয়া মাদ্রাসার ২০২৩-এর বার্ষিক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন এএমআই -এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মুফতী শহিদুল ইসলাম । মোট ৪টি অধিবেশনে মোট ৯টি বিষয়ে শিক্ষার্থীরা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। চতুর্থ অধিবেশনে পুরস্কার বিতরণ ও গুণীজনদের মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয় এ অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে তিনি ছাত্রদের বলেন, ‘তোমারা আমার জন্য দোয়া করবে, আমি শহিদুল ইসলাম যেন শহিদ হয়ে মারা যাই।’

তিনি চলে গেলেন জুমার পবিত্র এক রাতে। রেখে গেলেন তার কর্মবহুল জীবন। যে মানুষের সেবায় জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছেন এই আলেম, সে মানুষের দোয়ায় তার কবর হয়ে উঠুক জান্নাত। তার কবরে ঝরে পড়ুক রহমতের শবনম।

আগের সংবাদঅর্থনীতির তিন ঝুঁকিতে বাংলাদেশ: আইএমএফ
পরবর্তি সংবাদসংবিধান বহির্ভূত সরকার যেন ক্ষমতায় না আসে সেই চেষ্টা করেছি: প্রধানমন্ত্রী