মুসলিম ইতিহাসে আলেম সমাজ: ফাসেক আলেম ও অসৎ শাসকশ্রেণীর মোকাবেলায়

মাহদি হাসান:

মুহাদ্দিস ইয়াযিদ ইবনু যুরাই রহিমাহুল্লাহু(মৃত্যু: ১৮৩ হিজরি) এর পিতা ছিলেন ইরাকের আল-আবেলা শহরের গভর্নর। মৃত্যুকালে তিনি ইয়াযিদ রহিমাহুল্লাহুর জন্য রেখে যান অঢেল সম্পদ। কিন্তু ইয়াযিদ রহিমাহুল্লাহু তা থেকে এক পয়সাও গ্রহণ করেননি। কারণ, তাঁর পিতা ছিলেন সাম্রাজ্যের অধীন কর্মকর্তা। এমনিভাবে আবুল কাসিম আল-বাজি আল-আন্দালুসি (মৃত্যু: ৪৯৩ হিজরি) রহিমাহুল্লাহুরও রয়েছে এমন দৃষ্টান্ত। তাঁর পিতা শাসকের কাছ থেকে উপহার গ্রহণ করার কারণে তিনি পিতার রেখে যাওয়া অঢেল ধন-সম্পদ থেকে কিছুই গ্রহণ করেননি। ইমাম যাহাবি রহিমাহুল্লাহু এ দুটি বিরল ঘটনা বর্ণনা করেছেন। এ থেকে স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, উলামায়ে কেরামগণ শাসকশ্রেণীর সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কতটা কঠোর ছিলেন এবং কত মজবুত শর্ত আরোপ করতেন।

তাদের এই সতর্কতা এবং কঠোর অবস্থানের ফলে ইসলামি ইতিহাসে উলামায়ে কেরামের একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ অবস্থান তৈরী হয়েছে। এর কারণেই তারা শতাব্দীর পর শতাব্দী ইসলামি শরিয়াহ, ফাতওয়া, বিচার এবং শিক্ষাব্যবস্থার হাল ধরে রাখতে পেরেছিলেন। উলামায়ে কেরাম সর্বদাই রাজকীয় এবং সরকারি সংগঠন ইত্যাদির সংস্পর্শ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেছেন। তাঁরা ছিলেন সমাজ এবং জনগণের নিকটবর্তী। মুসলিম ফোকাহা এবং উলামায়ে কেরাম নিয়মতান্ত্রিক এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জনগণকে সম্মান করার এবং শাসকশ্রেণীকে থেকে নিরাপদ দূরত্ব রাখার শিক্ষা দিতেন। যা তাদের বিভিন্ন উক্তি থেকে জানা যায়।

ফোকাহা এবং উলামায়ে কেরাম তাদের মাঝে এবং শাসকশ্রেণীর মাঝে যে প্রান্তরে এসে সীমানা নির্ধারণ করে দিয়েছেন আমরা আলাপ করব সেই প্রান্তর নিয়ে। উলামায়ে কেরাম যে নিজেদেরকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার প্রতি আগ্রহী ছিলেন; যার ফলে তারা উম্মাহর হৃদয়ে সম্মানের আসন অর্জন করেছিলেন, যার ফলে তাদের সুযোগ হয়েছিল সম্ভ্রান্ত এবং প্রশান্ত জ্ঞানের পরিবেশ উৎপন্ন করার। আমাদের মূল ফোকাস থাকবে এ দিকটি নিয়ে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁরা নিজেদের প্রবৃত্তির অনুসরণ এবং শাসকশ্রেণীর অনুরক্ত হওয়া থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছিলেন। তবে ফোকাহায়ে কেরাম থেকে কেউ-ই যে শাসন এবং রাজনীতির জগতে প্রবেশ করেননি তা বলা যাবে না। কেউ কেউ এ জগতে ছিলেন পুরোপুরি সম্পৃক্ত। কেউ যুক্ত হয়েছিলেন কোনো উপকারের জন্য অথবা কেউ কেউ ছিলেন এ জগতের সাময়িক অতিথি।

দূরত্ব বজায় রাখা

ফোকাহা এবং উলামায়ে কেরাম দুই স্তরে তাদের মাঝে এবং শাসকশ্রেণীর মাঝে দূরত্ব বজায় রেখেছেন। প্রথমটি ছিল অভ্যন্তরীণ স্তর। যেখানে ইলম অর্জনকারীদেরকে শাসকশ্রেণী থেকে দূরত্ব বজায় রাখার কথা বলা হতো। দ্বিতীয়টি হচ্ছে বহিরাগত স্তর। যা ছিল সাধারণ জনগণ এবং  উলামায়ে কেরামের মধ্যকার সম্পর্ক এবং দূরত্ব বজায় রাখার এই ধারায় জনসাধারণের অবস্থানের সাথে সম্পৃক্ত।

ইতিহাসের পাতায় পাতায় প্রথম স্তরের অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। উলামায়ে কেরাম শাসকশ্রেণীর সংস্পর্শ এবং তাদের সম্পদ, ভাতা ও উপহার গ্রহণ থেকে সতর্ক করাকে নিজেদের নিয়ম বানিয়ে নিয়েছিলেন। ইমাম সুফিয়ান সাওরি রহিমাহুল্লাহু (মৃত্যু: ১৬১ হিজরি) শাসক বণ্টিত গণিমত তথা যুদ্ধলব্ধ সম্পদ থেকেও নিজের অংশ নিতেন না। এর কারণ দর্শাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি জানি তা আমার জন্য হালাল। তবে আমি আশঙ্কা করি যে, এটি গ্রহণ করার মাধ্যমে আমার অন্তরে তাদের প্রতি (শাসকশ্রেণী) টান সৃষ্টি হবে।’

এমনকি কতক উলামায়ে কেরাম তাদের পিতা সরকারি চাকরীভুক্ত হওয়ার কারণে নিজেদের পৈতৃক উত্তরাধিকারের সম্পদই গ্রহণ করেননি। ইমাম যাহাবি রহিমাহুল্লাহু আমাদেরকে এমনই কিছু ঘটনা জানিয়েছেন। প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইয়াযিদ ইবনু যুরাই রহিমাহুল্লাহুর পিতা ছিলেন ইরাকের আল-আবেলা শহরের গভর্নর। মৃত্যুকালে তিনি রেখে যান পাঁচহাজার দিনার। সেখান থেকে ইয়াযিদ ইবনু যুরাই রহিমাহুল্লাহু একটি পয়সাও গ্রহণ করেননি। এমনিভাবে কাজি ইয়াজ আল-মালিকি আমাদেরকে জানিয়েছেন যে, আবুল কাসিম বাজি আল-আন্দালুসি; যিনি  ছিলেন তৎকালীন মালেকি মাজহাবের ইমাম ওলিদ ইবনুল বাজির পুত্র। কিন্তু আবুল কাসিম বাজি তাঁর পিতার রেখে যাওয়া সম্পদ থেকে নিজেকে স্বেচ্ছা বঞ্চিত করেন। কারণ, তাঁর পিতা শাসকের কাছ থেকে উপহার গ্রহণ করেছিলেন।

পঞ্চম হিজরি শতাব্দীতে এসে শাসকশ্রেণীর সম্পদের উপর আলেমদের নির্ভরতার ব্যাপক প্রচলন ঘটে। এ সময়ে এসে সাম্রাজ্যের নিয়মকানুন এবং সমাজব্যবস্থার শৃঙ্খলা মজবুত হয়। তখন মসজিদ এবং ফিকহি মাজহাবগুলোর পাশাপাশি বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত  ইলমি ক্ষেত্র হিসেবে স্বয়ংসম্পূর্ণ মাদ্রাসাসমূহও সগৌরবে ইসলামি জ্ঞানের প্রসারে অবদান রাখছিল। তাই অনেকের মনেই আশঙ্কা জেগে উঠে যে, এভাবে শাসকশ্রেণীর সম্পদের উপর নির্ভরশীলতার কারণে উলামায়ে কেরামের স্বাতন্ত্র নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাই তারা এ সকল সম্পদের উপর অধিক নির্ভরতা পরিত্যাগ করেন। ইসলামের শুরু থেকে যে ধারা চলে এসেছিল এ সময়ে এসে তা পালটে যায়। যেখানে আগেকার শাসকগণ দানের ক্ষেত্রে কোনো পক্ষপাতিত্ব করতেন না। ‘কিন্তু এ সময়ে শাসকদের মন কেবল তাদের প্রতিই উদার হতো; যারা তাদের সেবায় আগ্রহী হতো এবং নিজেদেরকে আত্মমর্যাদা ভুলে গিয়ে বারংবার নিজেদের প্রয়োজন তুলে ধরে সাহায্য কামনা করত। এ ছাড়াও শাসকদের উপস্থিতিতে অথবা অনুপস্থিতিতে তোষামোদ এবং সীমাতিরিক্ত প্রশংসা করা যাদের বৈশিষ্ট্য ছিল, তারাই পেত শাসকশ্রেণীর সুনজর।’ ইমাম গাজালি রহিমাহুল্লাহু তাঁর অদ্বিতীয় গ্রন্থ ‘ইহইয়াউ উলুমুদ্দীনে’ এমনটিই ব্যক্ত করেছেন।

শাসকশ্রেণীর সাথে উলামায়ে কেরামকে এমন দূরত্ব বজায় রাখতে হবে যেন তা একেবারে বিচ্ছিন্নতার কাছাকাছি হয়। ইমাম গাজালি এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে বলেন, ‘যদি কোনো আলেম প্রথমে শাসকদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে, তারপর বারবার তাদের সেবায় নিয়োজিত হয়, তাদের জন্য প্রশংসা ও দোয়া করে, সাহায্য প্রার্থনায় সুলতানকেও সাহায্য করার আশ্বাস দেয়, শাসকের সভায় অধিক পরিমাণে অংশগ্রহণ করে, তাদের প্রতি আন্তরিকতা প্রকাশ করে আর শত্রুদের বিরুদ্ধে সাহায্য করে এবং শাসকদের অত্যাচার এবং দোষগুলোকে গোপন রাখে; তবে সেই আলেম নিজের প্রতি এক দিরহাম সমপরিমাণ দয়াও দেখায়নি।’ এ সকল কারণে বর্তমান সময়ে এসে শাসকদের হালাল সম্পদ গ্রহণ করাই বৈধ নয়, সেখানে তাদের হারাম এবং সন্দেহযুক্ত সম্পদ গ্রহণের কী হুকুম হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই কেউ যদি শাসকদের সম্পদের লোভে মত্ত হয়ে নিজেকে সাহাবা এবং তাবেয়ীদের মতো মনে করে, সে যেন ফেরেশতাদেরকে কামারদের সাথে তুলনা করল।

ইসলামি বিশ্বের পশ্চিমাঞ্চলের দিকে তাকালে দেখতে পাই যে, আল্লামা আশ-শানতিরিনি আল-আন্দালুসি রহিমাহুল্লাহু (মৃত্যু: ৫৪২ হিজরি) তাঁর রচিত ‘আয-যাখিরাহ ফি মাহাসিনি আহলিল জাযিরাহ’ গ্রন্থে তাঁর সামসময়িক উলামায়ে কেরামকে অন্যায়ভাবে কর এবং ট্যাক্স আরোপকারী শাসকদের উপঢৌকন গ্রহণে নিষেধ করেছেন। যদি আলেমদের মধ্য হতে কেউ তাদের সম্পদ গ্রহণ করে তাহলে পুরো জাতিকেই এর তিক্ততা ভোগ করতে হবে।

সতর্কতা এবং ঘৃণাপোষণ

মুহাদ্দিস আবু শুজা আদ-দাইলামি রহিমাহুল্লাহু (মৃত্যুঃ ৫০৯ হিজরি) বলেন, নিশ্চয়ই উলামায়ে সু তথা নিকৃষ্ট আলেম হচ্ছে তারা, যারা এই ইলমকে ব্যবসা হিসেবে গ্রহণ করে এবং সামসময়িক শাসকদের কাছ থেকে লাভের বিনিময়ে তা বিক্রি করে। আল্লাহ তায়ালা কখনোই তাদের এই ব্যবসায় লাভ দিবেন না।’ আল্লামা জমখশারি তাঁর এক রচনায় নিজেকে প্রশ্ন করে বলেন, ‘ঐ সকল নিকৃষ্ট আলেমদের এ কী হাল! তারা শরীয়তের বিধিবিধান একত্র করে সংকলিত করলেন, তারপর সেখানে নিকৃষ্ট শাসকদের জন্য শিথিলতা করে তা অপমানিত করে দিলেন?!’

কারাফি রহিমাহুল্লাহু (৬২৬-৬৮৪ হিজরি) ফতোয়া জারি করে শাসকশ্রেণীর প্রতি শিথিলতা করা থেকে সতর্ক করেছেন। তিনি ‘আল-ইহকাম ফি তাময়িজিল ফাতাওয়া আনিল আহকাম’ গ্রন্থে বলেন, ‘যখন কোনো মাসআলায় দুইটি রায় থাকে, যার একটি কঠিন আর অপরটি সহজ; এমতাবস্থায় মুফতির জন্য উচিত নয় সাধারণ মানুষের বেলায় এসে কঠিন রায় প্রদান করা আর শাসকশ্রেণীর বেলায় এসে সহজ রায় প্রদান করা। এমনটি ফাসেকি এবং দীনের ব্যাপারে খেয়ানতের নিকটবর্তী। এর মাধ্যমে মুসলিমদের সাথে ছলনা করা হয় এবং অন্তর থেকে আল্লাহ তায়ালার ভয় দূর হয়ে যাওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়।’

এখানে কারাফি রহিমাহুল্লাহু একজন ফকিহের অন্তর্নিহিত তাকওয়ার প্রতি ইঙ্গিত দিচ্ছেন। উলামায়ে কেরাম যার প্রতি দিয়েছেন অত্যাধিক গুরুত্ব। যে সকল আলিম শাসকদের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন তাদের অন্তরে দ্বীন এবং ইলম অবহেলিত এবং নিপীড়নের শিকার। কারণ, তাকওয়াহীন ইলম একজন আলেমকে নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে দূরে সরিয়ে দেয় এবং তার কাছে ইলমের চাহিদার চেয়ে প্রবৃত্তির চাহিদাই বেশি প্রাধান্য লাভ করে।

আল্লামা তাজুদ্দিন সুবকি রহিমাহুল্লাহু (মৃত্যুঃ ৭৭১ হিজরি) তাঁর ‘তবাকাতুশ শাফিইয়্যাহ’ গ্রন্থে শাসকশ্রেণীঘেষা  নিম্নস্তরের আলেমদের কাছে এই সতর্কবার্তা পৌঁছে দিয়েছেন। তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, ‘ফাসেক ফকিহ এবং আলেমরা শাসকদেরকে বিনষ্ট করে। কারণ, ফকিহ এবং আলেম হয়ে থাকে দু ধরণের। সৎ এবং অসৎ। যারা সৎ যথাসম্ভব তারা শাসকের দরজায় কড়া নাড়ে না। আর যারা অসৎ তারা প্রায়ই শাসকদের কাছে ধর্না দেয়। অতঃপর শাসককে বাধ্য করে তাদের চাহিদা এবং প্রবৃত্তি অনুযায়ী চলতে। তারা শাসকদের কাছে গুরুতর বিষয়কেও তুচ্ছ করে উপস্থাপন করে। নিশ্চয়ই তারা মানুষের জন্য হাজার শয়তান থেকেও ক্ষতিকর। যেমনিভাবে সৎ আলিমগণ হাজারো আবেদের চেয়েও উত্তম।

আল্লামা তাকিউদ্দিন আল-হিসনি আশ-শাফেয়ি রহিমাহুল্লাহু (মৃত্যুঃ ৮২৯ হিজরি) তাঁর ‘কিফায়াতুল আখইয়ার ফিল হাল্লি গায়াতিল ইখতিসার’ গ্রন্থে বলেন, ‘মুসলমানদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর হচ্ছে ফাসেক এবং ভ্রষ্ট ফকিহ, আলেম এবং সূফীরা। যারা অত্যাচারী শাসকদের কাছে বারংবার ধর্না দেয়। অথচ এ সকল শাসকরা যে মদ্যপানসহ আরও অনেক অন্যায় ও পাপাচারে লিপ্ত হয় সে ব্যাপারে তারা অবগত আছে। ঐ সকল নিকৃষ্ট শ্রেণীর ফকিহ, আলিম এবং সূফীদেরকে দেখে কেউ যেন প্রবঞ্চিত না হয়।’

ফকিহ এবং আলেমরা যদি বারংবার ঐ সকল অত্যাচারী শাসকশ্রেণীর কাছে পদচারণা করে তবে তারা নিজেদের অসৎ কাজে আরও বেশি উৎসাহ পাবে। এটিই হচ্ছে সবচেয়ে বড় বিপদ। যে ব্যপারে ঐ সকল নির্বোধ আলেমদের কোনো উপলব্ধিই নেই। তাকিউদ্দিন আল-হিসনি রহিমাহুল্লাহু আরও বলেন, অত্যাচারী শাসকদের কোনো আয়োজনে উলামায়ে কেরামদের অংশগ্রহণ উচিত নয়।

তাই উসূলবিদগণ ফাসেক আলেমদের কাছ থেকে ইলম গ্রহণ করা যাবে কি না এ নিয়ে ইখতিলাফ করেছেন। অধিকাংশ উসূলবিদের মতে মুফতি হওয়ার জন্য  প্রধান শর্ত হচ্ছে খোদাভীরুতা। এই একটি শর্তের রয়েছে বিরাট গুরুত্ব। এর মাধ্যমেই একজন ফকিহ শাসকশ্রেণীর সংস্পর্শে যাওয়ার ক্ষতি এবং প্রয়োজন অনুপাতে তাদেরকে নসীহত করার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন। লক্ষ্যণীয় যে, আল্লামা সুবকি এবং কারাফি রহিমাহুল্লাহু ঐ সকল ফকিহ, আলেম এবং মুফতির ক্ষেত্রে ‘ফাসেক’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। ফিকহের পরিভাষায় এটি অত্যন্ত গুরুতর একটি পরিভাষা, যা কেবল কবিরা গুনাহে লিপ্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়।

তবে এখানে  তাদের ক্ষেত্রে ফাসেক শব্দ ব্যবহারের পিছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ নিহিত রয়েছে। যা উলামায়ে কেরামের স্বাতন্ত্র্য, প্রভাব এবং গ্রহণযোগ্যতার সাথে সম্পৃক্ত। সাধারণ জনগণের উপর উলামায়ে কেরামের যে প্রভাব রয়েছে, তা হচ্ছে তাদের তাকওয়াসমৃদ্ধ ইলমের প্রভাব। এর ফলেই মানুষের মনে উলামায়ে কেরামের প্রতি সম্মান এবং শ্রদ্ধা সৃষ্টি হয়। ফলে তারা উলামায়ে কেরামের অনুসরণে উৎসাহী হয়। তাই যখন আলেমদের এই প্রভাব দূর হয়ে যাবে অথবা এতে কাদার আঁচড় লাগবে, তখন এর ফলে যে ক্ষতি হবে তার প্রভাব শরীয়ত এবং শরয়ী জ্ঞানের উপরেও পড়বে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আলেমদের আচরণের কারণেই নাস্তিক্যবাদ এবং ধর্মবিরোধীতার পালে হাওয়া লাগে।

জনসাধারণ যখন দেখবে যে ঐ সকল আলেম, যারা নিজেদেরকে ধর্মের রক্ষক বলে দাবি করে, তারাই নিয়োজিত হয়েছে ধর্মের ধ্বংসকল্পে, তখন তাদের মনে উলামায়ে কেরাম, সর্বোপরি ধর্মের প্রতি কোনো শ্রদ্ধাবোধ অক্ষত থাকবে না। তাই দ্বীনের সুরক্ষা এবং স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার জন্য উলামায়ে কেরাম নিজেদেরকে আত্মসমালোচনা করে এ ধরণের কঠিন কঠিন হুঁশিয়ারি প্রদান করেছেন। যখন কেউ কোনো অপরাধে লিপ্ত হয় উলামায়ে কেরাম তার বিরোধিতার ব্যাপারে অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করেছেন। এমনকি যদি কোনো আলেমও অপরাধে লিপ্ত হয় তবুও তার বিরোধিতা করতে হবে এবং তাকে বর্জন করতে হবে। কারণ, ‘এই উম্মাহর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে উলামায়ে কেরামের পরস্পরের প্রতি তোষামোদি মনোভাব না থাকা। এর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা এই উম্মাহকে অনেক নেয়ামত দান করেছেন।’ ইবনু হাজর আল-হাইতামি রহিমাহুল্লাহু (মৃত্যুঃ ৯৭৩ হিজরি) ‘আল-ফাতাওয়াল ফিকহিয়্যাতিল কুবরা’ গ্রন্থে এমনটি ব্যক্ত করেছেন।

প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আলি ইবনুল মাদিনি রহিমাহুল্লাহু (মৃত্যুঃ ২৩৪ হিজরি) মুতাজিলি মতাবলম্বী বিচারক আহমাদ ইবনু আবু দাউদের (মৃত্যুঃ ২৪০ হিজরি) কাছে যাওয়ার ফলে আহমাদ ইবনু হাম্বল রহিমাহুল্লাহু আলি ইবনুল মাদিনি রহিমাহুল্লাহুকে বর্জন করেছিলেন। যদিও তাদের দুজনের মাঝে ছিল অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক এবং ইলমি মজলিসসমূহে দীর্ঘদিনের সাহচর্য। এই কাজি আহমাদ ইবনু আবু দাউদ ছিলেন খলকে কুরআন তথা কুরআনকে সৃষ্ট বস্তু বলার প্রবক্তা। আল্লামা যাহাবির বর্ণনা অনুযায়ী, ইবনু আবি দাউদ আলি ইবনুল মাদিনি রহিমাহুল্লাহুকে সম্পদের মাধ্যমে সাহায্য করতেন দুটি কারণে। একটি হচ্ছে তারা দুজন ছিলেন একই শহরের বাসিন্দা। তবে অপর কারণটি আল্লামা যাহাবি উল্লেখ করেননি। এতে ধারণা করা হয় যে, সেই কারণটি ছিল উলামায়ে কেরামের জন্য দোষণীয়।

তাই ঐ সময়ের উলামায়ে কেরামের কাছে সেই নিন্দনীয় ব্যাপার সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইবনু রজব হাম্বলী রহিমাহুল্লাহু (মৃত্যুঃ ৭৯৫ হিজরি) বলেন, ‘আলি ইবনুল মাদিনি রহিমাহুল্লাহুর ব্যাপারে তীব্র সমালোচনা হতে থাকে। এমনকি তাঁকে প্রায় মুরতাদ হিসেবে গণ্য করা হতে থাকে। আহমাদ ইবনু হাম্বল রহিমাহুল্লাহু এবং ইবরাহিম আল-হারবি রহিমাহুল্লাহু (মৃত্যুঃ ২৮৫ হিজরি) প্রমুখগণ তাঁর কাছ থেকে হাদীস বর্ণনা বর্জন করেন।

শাসকশ্রেণীর প্রতি নির্ভরশীল হওয়া থেকে সতর্ক করে উলামায়ে কেরামগণ তাদের কিতাবে পৃথক অধ্যায় লিখেছেন। বরং এ নিয়ে স্বতন্ত্র কিতাবও লিখা হয়েছে। যেমন, ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল রহিমাহুল্লাহুর শাগরিদ ইমাম আবু বকর মাররূযী (মৃত্যুঃ ২৭৫ হিজরি) লিখেছেন ‘আখবারুশ শুয়ুখ ওয়া আখলাকুহুম (‘সালাফের দরবারবিমুখতা’ নামে বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে)। মাহমুদ ইবনু ইসমাইল আল-খাইরবাতি রহিমাহুল্লাহু (মৃত্যুঃ ৮৪৩ হিজরি) লিখেছেন ‘আদ-দুররাতুল গুররা ফি নসিহতিস সালাতিনি ওয়াল কুজাতি ওয়াল উমারা (সুলতান, বিচারক এবং শাসকদের প্রতি উপদেশ)। এমনিভাবে আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতি লিখেছেন ‘মা রওয়াহুল আসাতিন ফি আদমিল মাজিয়ি ইলাস সালাতিন (শাসকদের সংস্পর্শ বর্জনের ব্যাপারে শ্রেষ্ঠ মনীষীদের অবস্থান)।

জনসাধারণের কথা বলার ব্যাপারে উলামায়ে কেরামের অবস্থান

তবে শাসকদের সাথে দূরত্ব বজায় রাখার মানে এই নয় যে, উলামায়ে কেরাম তাদের কাছে জনসাধারণের কথা বলা এবং তাদের দাবি তুলে ধরা থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন। ইসলামি ইতিহাসের পুরো অধ্যায়জুড়েই উলামায়ে কেরাম ছিলেন অসহায় এবং নিপীড়িত জনগণের দোভাষী। এখানে এসে আরেকটি ভিন্ন প্রসঙ্গের অবতারণা হলো। তা হচ্ছে, জনসাধারণের সাথে উলামায়ে কেরামের সম্পর্ক এবং শাসকশ্রেণী ও উলামায়ে কেরামের দূরত্ব বজায় রাখার ক্ষেত্রে জনসাধারণের ভূমিকা।

জনসাধারণ প্রত্যেক বিপদে-আপদে উলামায়ে কেরামের কাছে ছুটে যেতেন। উলামায়ে কেরামগণ ছিলেন সামাজিক এবং জ্ঞানভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের মতো। যারা সমাজের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে, তাদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে এর সমাধানের পথ বাতলে দিতেন। এ ক্ষেত্রে কারও আগ্রহ অথবা কোনো প্রতিক্রিয়ার পরোয়া তারা করতেন না। এজন্যই নিজামুদ্দিন আলকামি আন-নাইসাবুরি রহিমাহুল্লাহু (মৃত্যুঃ ৮৫০ হিজরি) তাঁর তাফসির গ্রন্থে সতর্ক করে বলেন, ‘নিকৃষ্ট আলেম হচ্ছে তারা যারা জনসাধারণকে আশা দেখিয়ে প্রবঞ্চিত করে এবং তাদের অনুসন্ধান ও পরিশ্রমের যোগ্যতাকে অকেজো করে দেয়।’

ফোকাহায়ে কেরামের স্বয়ংসম্পূর্ণতা এবং স্বাতন্ত্র্যের ফলেই শহিদ কাজি আবু আবদুল্লাহ ইবনুল ফাররা আল-আন্দালুসি (মৃত্যুঃ ৫১৪ হিজরি) মোরাবেতীন সাম্রাজ্যের শাসক ইউসুফ বিন তাশফিনের (মৃত্যুঃ ৫৩৭ হিজরি) কাছে সুস্পষ্ট চিঠি লিখেছিলেন। ইউসুফ বিন তাশফিন যখন সামরিক অভিযানের জন্য কর আরোপের নির্দেশ দেন তখন কাজি আবু আবদুল্লাহ তাঁর কাছে চিঠি লিখে জানান, ‘যে সম্পদকে আপনারা ‘সাহায্য’ নাম দিয়েছেন তা জোরপূর্বক ইয়াতিম এবং অসহায়দের সম্পদ থেকে কেটে নেয়া হচ্ছে। আপনাকে এর জবাবদিহিতা করতে হবে। সবকিছু আপনার তদারকিতেই হচ্ছে। হয়তো কোনো নিকৃষ্ট লোভী আলেম আপনাকে এমনটি করার পরামর্শ দিয়েছে।’ সুলতান ইউসুফ বিন তাশফিন এ চিঠির মাধ্যমে প্রভাবিত হন এবং আদায়কৃত সম্পদের এক তৃতীয়াংশ অধিকারীদের কাছে ফিরিয়ে দেন। আল্লামা যাহাবি তাঁর ‘তারিখুল ইসলাম ‘ গ্রন্থে এমনটি বর্ণনা করেছেন।

আরও অনেক উলামায়ে কেরামের কাছ থেকে এমনই অবস্থানের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ইজ্জ বিন আবদুস সালাম রহিমাহুল্লাহু (মৃত্যুঃ ৬৬০ হিজরি)।  যিনি ছিলেন উম্মাহর কল্যাণের লক্ষ্যে নিবেদিত একজন আলেম এবং ফকিহ হিসেবে সর্বজনবিদিত। শাসকশ্রেণীর কর্তৃত্বের বিপরীতে তিনি সারাজীবন জনসাধারণের অধিকারের পক্ষে সোচ্চার থেকেছেন। এর ফলে তিনি পেয়েছিলেন ‘সুলতানুল উলামা’ তথা আলেমদের সুলতান এবং ‘বায়িউল উমারা’ তথা শাসকদের বিক্রেতা উপাধি।

মামলুক সুলতান যাহির বাইবারস (মৃত্যুঃ ৬৭৬ হিজরি) যখন ৬৬৬ হিজরিতে তাতারিদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের প্রস্তুতির জন্য শাম তথা বৃহত্তর সিরীয় অঞ্চলের অধিবাসীদের উপর কর আরোপ করেন এবং এ ব্যাপারে ফকিহগণের মাধ্যমে ফতোয়া জারি করেন তখন ইমাম নববী রহিমাহুল্লাহু (মৃত্যুঃ ৬৭৬ হিজরি) সুলতানের মুখোমুখি হয়ে সেই ফতোয়া প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁকে প্রত্যাখ্যানের কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি যে উত্তর প্রদান করেন, তা শুনে আশ্চর্য হতে হয়। তিনি বাইবারসকে বলেন, ‘আমি জানি, আপনি ছিলেন সুলতান আলাউদ্দিনের দেহরক্ষী। আপনার কোনো সম্পদ ছিল না। তারপর আল্লাহ তায়ালা আপনার জন্য মুসলমানদের উপর নিয়ন্ত্রণ লাভ সহজ করেছেন, ফলে আপনি এই সাম্রাজ্যের শাসকে পরিণত হয়েছেন। শুনেছি এখন আপনার কাছে হাজার দাস রয়েছে। তাদের প্রত্যেকের আছে হাজার দিনার মূল্যের ঘোড়া এবং সামানা। আরও আছে দুইশত দাসী। যাদের প্রত্যেকের সিন্দুকে রয়েছে দশহাজার দিনার অধিক মূল্যের অলংকার। আপনি যদি এ সকল সম্পদ খরচ করেন, তখন আমি আপনার জন্য প্রজাদের কাছ থেকে সম্পদ গ্রহণের বৈধতার ব্যাপারে ফতোয়া প্রদান করব।’

শাসকশ্রেণীর প্রতি কঠোর অবস্থানের আরও কিছু ঘটনা

কঠোর অবস্থানের এই নীতি শুধু অত্যাচারী শাসকদের সাথেই সীমাবদ্ধ ছিল না।  বরং অত্যাচারী ও ন্যায়পরায়ণ সকলের সাথেই তাদের একই অবস্থান ছিল। উলামায়ে কেরামের প্রভাব এবং গ্রহণযোগ্যতা বজায় রাখার জন্য এই অবস্থান ছিল তাদের চারিত্রিক এবং আদর্শিক প্রয়োজনীয়তা। ফোকাহায়ে কেরামের এ সকল ঘটনা শুধু তাদের জীবনীগ্রন্থগুলোতেই বর্ণিত হয়নি, বরং ফিকহ এবং শাস্ত্রীয় কিতাবগুলোতেও এর বর্ণনা দেয়া হয়েছে। যাতে করে পরবর্তী আলেম প্রজন্ম এর উত্তরাধিকার লাভ করতে পারে। হানাফি মাজহাবের অধিকাংশ উলামায়ে কেরামের মতে অত্যাচারী শাসকদের কাছে জাকাত প্রদান বৈধ নয়। কারণ, স্পষ্টতই তারা জাকাতের সম্পদকে শরয়ী ক্ষেত্রগুলোতে ব্যয় করবে না। বরং উপকারের স্থলে তাদের মাধ্যমে আরও ক্ষতিসাধণ হবে।

বাস্তবতা হচ্ছে, এ ধরণের ফতওয়ার মাধ্যমে শাসকশ্রেণীর সাথে শুধু উলামায়ে কেরামের নয়, বরং জনসাধারণেরও দূরত্ব সৃষ্টি হবে। এমনকি এ ধরণের ফতওয়ার মাধ্যমে শাসকশ্রেণী এক ধরণের শাস্তির মুখোমুখি হবে। তারা যে জনসাধারণের কাছে প্রত্যাখ্যাত, এই পীড়া তাদেরকে ভোগাতে থাকবে। অনেক প্রসিদ্ধ ফোকাহায়ে কেরাম শাসকশ্রেণীর প্রতি এমন কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছেন, যখন দেখেছেন তারা যে কল্যাণের বুলি আওড়ে যায় তাদের মাধ্যমে তা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইমাম মালিক রহিমাহুল্লাহু দীর্ঘ সময় গৃহে অবস্থান করেছেন। মসজিদে নববীতে নামাজ অথবা দরস প্রদানের জন্য যাননি। কারণ, তখন ফিতনা বেড়ে গিয়েছিল এবং খেলাফত তাঁকে নিযুক্ত করে তাঁর মাধ্যমে জনসাধারণের মনোতুষ্টি অর্জন করতে চেয়েছিল। ইমাম কুরতুবি রহিমহুল্লাহু (মৃত্যুঃ ৬৭২ হিজরি) তাঁর ‘আত-তাজকিরা’ গ্রন্থে ইমাম মালিক রহিমাহুল্লাহুর এ কাজের কারণ দর্শাতে গিয়ে বলেন, ‘যেন তাঁকে শাসকের কাছে যেতে না হয়।’ এ থেকেই বুঝা যায় যে ইমাম মালিক রহিমাহুল্লাহু শাসক কর্তৃক কোনো পদে নিযুক্ত হওয়া থেকে বেঁচে থাকতে চাইতেন এবং এ কারণেই তিনি দীর্ঘদিন পর্যন্ত মসজিদ গমন থেকে বিরত থাকেন।

এই স্বাতন্ত্র্য কেবল ফোকাহায়ে কেরাম এবং উলামায়ে শরীয়তের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং বিভিন্ন মতাদর্শের আলেমের মাঝেও এমনটিও লক্ষ্য করা গেছে। প্রথমদিকে মুতাজিলিদের মধ্যে ওয়াসিল ইবনু আতা (মৃতুঃ ১৩১ হিজরি) এবং আমর ইবনু উবায়েদ (যাকে জাহাবি রহিমাহুল্লাহু দুনিয়াবিমুখ এবং আবেদ বলেছেন) প্রমুখগণ শাসকদের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছেন এবং তাদের কাছে যাওয়া থেকে নিষেধ করেছেন। এমনকি আবদুল কাহির আল-বাগদাদি রহিমাহুল্লাহু (মৃত্যুঃ ৪২৯ হিজরি) তাঁর ‘আল-ফারকু বাইনাল ফিরাক’ গ্রন্থে বলেন, ‘বাগদাদের মুতাজিলি নেতা আবু মুসা মুরদার (মৃত্যুঃ ২২৬ হিজরি) শাসকশ্রেণীর সংস্পর্শ গ্রহণকারী ব্যক্তিকে কাফির আখ্যা দিতেন। এমনিভাবে তার পূর্ববর্তী মুতাজিলিরাও শাসকদের সংস্পর্শ গ্রহণকারী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে বলত, ‘তারা ফাসিক, মুমিনও নয়, কাফিরও নয়।’

শুরু থেকেই চলে আসা প্রকারভেদ

ঐতিহাসিকভাবেই শাসকদের হাদিয়া-ভাতা গ্রহণের ব্যাপারে উলামা এবং ফোকাহায়ে কেরাম দুই ভাগে বিভক্ত ছিলেন। একদল তা গ্রহণে নিষেধ করেছেন, চাই তা যেভাবেই আসুক না কেন। অধিকাংশ আলেম এবং ফকিহ এ মতের পক্ষেই ছিলেন। তাঁরা একে উলামায়ে কেরামের স্বয়ংসম্পূর্ণতা, স্বাধীনতা এবং স্বতন্ত্রতার প্রতীক মনে করতেন।

তাদের শীর্ষ অবস্থানে আছেন ইমামে আজম আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহু (মৃত্যুঃ ১৫০ হিজরি)। আব্বাসীয় খলিফা মানসুর (মৃত্যুঃ ১৫৮ হিজরি) যখন তাঁকে বিচারকের দায়িত্ব গ্রহণের প্রস্তাব করেন, তিনি তা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ, তিনি শাসকদের সম্পদ থেকে দূরে থাকতে চেয়েছিলেন। নিজের স্বাধীন মত এবং মর্যাদার স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার জন্য তিনি রেশমী কাপড়ের ব্যবসা করতেন। এমনিভাবে সুফিয়ান সাওরি রহিমাহুল্লাহু বিক্রি করতেন যাইতুন তেল। বুখারায় (বর্তমানে উজবেকিস্তানের অন্তর্গত শহর) অবস্থানকারী তাঁর এক চাচার কাছ থেকে প্রাপ্ত উত্তরাধিকার সম্পদ তিনি এ ব্যবসা দাঁড় করিয়েছিলেন। খতিব আল-বাগদাদির জগদ্বিখ্যাত গ্রন্থ ‘তারিখে বাগদাদ’ এর বিবরণ পাওয়া যায়।

ইমাম আবু নুয়াইম আল-ইস্পাহানি রহিমাহুল্লাহু (মৃত্যুঃ ৪৩০ হিজরি) তাঁর ‘হিলইয়াতুল আউলিয়া’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, একবার সুফিয়ান সাওরি রহিমাহুল্লাহুর এক ছাত্র ব্যবসায় জড়িত হওয়ার ব্যাপারে অস্বীকৃতি জানালে তিনি তাকে ধমক দিয়ে বলেন, ‘চুপ করো। এই দিনার-দিরহাম না থাকলে রাজা-বাদশাহরা আমাদেরকে হাতের রুমালের মতো ব্যবহার শুরু করে দিত।’ অর্থাৎ, প্রয়োজনে ব্যবহার করে তারপর ছুঁড়ে ফেলে দিত। এমনিভাবে ইমাম বায়হাকি রহিমাহুল্লাহুও (মৃত্যুঃ ৪৫৮ হিজরি)  সুফিয়ান সাওরি রহিমাহুল্লাহু থেকে বর্ণনা করেন, ‘যখন তুমি কোনো আলেমকে শাসকের কাছ হাত পাততে দেখবে, তবে জেনে রাখো সে হচ্ছে চোর। যদি দেখো সে ধনীদের কাছে হাত পাতছে, তবে জেনো সে প্রয়োজনগ্রস্ততার ভান করছে। তুমি হয়তো প্রবঞ্চিত হতে পারো, যদি তোমাকে বলা হয় যে, এ সম্পদের মাধ্যমে তুমি অন্যায়কে প্রতিরোধ করবে এবং মজলুমের সাহায্য করবে। নিশ্চয়ই এটি শয়তানের কুমন্ত্রণা। আলেমরা একে সিঁড়ি বানিয়ে নিয়েছে।’

ফুজাইল ইবনু ইয়াজ রহিমাহুল্লাহও (মৃত্যুঃ ১৮৭ হিজরি) এই শ্রেণীর একজন। নিজের অস্বচ্ছলতা এবং প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও তিনি শাসকদের সম্পদ গ্রহণ থেকে বেঁচে থাকতেন। খতিব বাগদাদী এমনটিই বর্ণনা করেছেন। ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল রহিমাহুল্লাহুও শাসকের পক্ষ থেকে যে কোনো উপহার অথবা ভাতা গ্রহণে স্পষ্ট অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। এমনকি শাসকরা যদি তাঁর কোনো নিকটাত্মীয় অথবা অন্য কারো ঘরে প্রবেশ করত, তবে তিনি সে ঘরে প্রবেশ করতেন না। শাসকদের অবদান আছে এমন কোনো বিষয়ের মাধ্যমে তিনি উপকার লাভ করতেন না। ইমাম ইবনু কাসির ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ গ্রন্থে এমনটি উল্লেখ করেছেন।

তবে তা সত্ত্বেও আহমাদ ইবনু হাম্বল রহিমাহুল্লাহু শাসকের বিরুদ্ধে কোনো রাজনৈতিক বিদ্রোহে সহায়তা করেননি। এতে করে জোরালোভাবে প্রমাণিত হয় যে, রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ এবং ধর্মীয় নিয়ন্ত্রণের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করা এক বিষয় আর শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ অথবা অন্যকোনোভাবে সংঘর্ষে জড়ানো ভিন্ন বিষয়। দুটি বিষয় কোনোভাবেই এক নয়।

তবে অপর একদল আলেম শাসকদের হাদিয়া এবং ভাতা গ্রহণের পক্ষে ছিলেন। তবে নিজেদের স্বপক্ষে তারা এই দলিল পেশ করেন যে, তাদের সামসময়িক সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পরিবেশে তা প্রত্যাখ্যান করার সুযোগ ছিল না। ইমাম মালিক ইবনু আনাস রহিমাহুল্লাহু (মৃত্যুঃ ১৭৯ হিজরি) ছিলেন এই দলের। কাজি ইয়াজ ইমাম মালিক রহিমাহুল্লাহুর শাগরিদ আবু ইমরান আস-সাদাফি থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, ‘একবার আমি ইমাম মালিকের কাছে শাসকদের উপহার-উপঢৌকন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি তা অপছন্দ করলেন। আমি বললাম, আপনি নিজেই তো তা গ্রহণ করে থাকেন। তখন তিনি বললেন, তুমি কি চাও আমার গুনাহ এবং তোমার নিজের গুনাহ নিয়ে প্রত্যাবর্তন করতে?

ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল রহিমাহুল্লাহুর কয়েকজন আলেম সন্তানও শাসকদের ভাতা গ্রহণ করতেন। আব্বাসীয় খলিফা মুতাওয়াক্কিল বিল্লাহ (মৃত্যুঃ ২৪৭ হিজরি) তাদের জন্য মাসিক চারহাজার দিরহাম করে ভাতা নির্ধারণ করেছিলেন। পিতা আহমাদ ইবনু হাম্বল রহিমাহুল্লাহু তাদের এ বিষয়টিকে অপছন্দ করেন। বলেন, ‘তোমরা কেন তা গ্রহণ করছ? অথচ সীমান্ত অঞ্চলগুলো এখনো অরক্ষিত অবস্থায় আছে আর মালে ফাইকে সঠিক হকদারদের মাঝে বন্টন করা হচ্ছে না!’ তাঁর এই অস্বীকৃতি এবং অপছন্দকে তিনি সংযুক্ত করেছেন বণ্টনের ক্ষেত্রে শাসকদের অবিচারের সাথে। অতঃপর তিনি আরও সংযুক্ত করে বলেন, ‘ যদি আমি জানি যে এই সম্পদ সঠিকভাবে গ্রহণ করা হয়েছে এবং এতে কোনো অন্যায় ও অবিচার নেই, তবে এ ক্ষেত্রে তোমরা তা গ্রহণ করলে আমি তা নিয়ে কিছু বলব না।’

স্বয়ংসম্পূর্ণতা এবং স্বতন্ত্রতার প্রয়োজনীয় উপাদানসমূহ

শাসকদের কাছ থেকে হাদিয়া-ভাতা গ্রহণ করা যাবে কি যাবে না? এ নিয়ে শিয়াদের মাঝেও বেশ কয়েক শতাব্দী ধরে তর্ক-বিতর্কের ঝড় চলে আসছে। তাদের শাইখ আল-কিরাকি আল-আমিলি (মৃত্যুঃ ৯৪০ হিজরি) সাফাবি শাসকদের ভাতা গ্রহণ বৈধ হওয়ার ফতওয়া দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন সাফাবি সাম্রাজ্যের শাসকদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় দিক-নির্দেশক পদে নিযুক্ত। তবে তার এই ফতওয়া ছিল শিয়াদের ফিকহের ধারাবাহিক উত্তরাধিকার বিরোধী। কিরাকির সামসময়িক এবং তার বন্ধু ইবরাহিম আল-কাতিফি (মৃত্যুঃ ৯৫০ হিজরি) এই ফতওয়ার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন।

শিয়াদের ইলমি জগতে এই মতানৈক্যের ফলে বিরাট প্রভাব সৃষ্টি হয়েছিল। যা বর্তমান সময়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও বহাল আছে। তাদের মধ্য হতে একদল এখনও শাসকদের সাথে মেলামেশা এবং তাদের সম্পদ বর্জনের কথা বলে থাকেন। অপর একদল শাসকদের সাথে উঠাবসার আহ্বান করে। তবে আসল কথা হচ্ছে, উলামা এবং ফোকাহায়ে কেরামের রিজকের উৎস নিয়ে আমাদেরকে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। একজন আলিম এবং ফকিহের জন্য তাঁর ইলমি যোগ্যতা এবং গবেষণা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ শর্ত রয়েছে। সে পর্যন্ত পৌঁছতে তাঁকে সকল কাজ থেকে মুক্ত হয়ে শুধু অধ্যয়ন এবং পাঠদান নিয়েই থাকতে হবে। এজন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আলেমদের জন্য উপার্জনের অন্য কোনো পন্থা থাকে না।

ইমাম ইবনুল জাওজি রহিমাহুল্লাহু (মৃত্যুঃ ৫৯৭ হিজরি) তাঁর ‘সাইদুল খাতির’ গ্রন্থে এদিকে আলোকপাত করেছেন। তিনি আলেমদের জন্য এমন কিছু নসীহত পেশ করেছেন যা তাদেরকে শাসকশ্রেণীর উপহার এবং ভাতা থেকে অমুখাপেক্ষী রাখবে। যাতে করে তাদের ফতওয়াসমূহ গাইরে ইলমি তথা ইলম বর্জিত প্রভাব থেকে মুক্ত থাকে। তিনি বলেন,’কতক উলামায়ে কেরামের শাসকের দরজায় পদচারণার প্রতি আপনি লক্ষ্য করবেন না। নিশ্চয়ই তাদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা একজন আলিম এবং ইলমের জন্য অধিক নিরাপদ। আলেমরা তাদের কাছ থেকে যা আশা করে, এরচেয়ে কয়েকগুন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফোকাহায়ে কেরামের সর্দার সাইদ ইবনুল মুসাইয়িব (মৃত্যুঃ ৯৩ হিজরি) কখনোই শাসকদের মুখোমুখি হননি। তাই হে আলেম, আপনি এমন উপার্জনের চেষ্টা করুন, যা আপনাকে উচ্চাভিলাষ থেকে অমুখাপেক্ষী রাখবে।’

ফোকাহায়ে কেরাম মুফতি এবং বিচারক আলিমগণের জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং স্বতন্ত্র পেশাগত অবস্থান তৈরীর চেষ্টা করেছেন। মালেকি মাজহাবে মুফতির জন্য ফতওয়ার বিনিময় গ্রহণ জায়েজ রয়েছে। এমনিভাবে ফোকাহায়ে কেরাম সাম্রাজ্যের আনুষ্ঠানিক মুফতি নির্বাচনের ভার ন্যাস্ত করেছিলেন উলামায়ে কেরামের কাঁধে। তাদের যোগ্যতার মানদণ্ড অনুযায়ী যারা উত্তীর্ণ হতো, তাদেরকেই নির্বাচিত করা হতো। এ ক্ষেত্রে শাসকদের আগ্রহের কোনো পরোয়া করা হতো না।

আর বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে আন্দালুস তথা স্পেনে এই নিয়ম প্রচলিত ছিল যে, ফিকাহ শাস্ত্র অনুযায়ী কাজি তথা বিচারক নির্বাচনের জন্য অন্যতম শর্ত হচ্ছে তাকে নিযুক্ত করার আগে এই পরিমাণ সম্পদ প্রদান করা; যার মাধ্যমে সে ধনী হয়ে যায়। আবুল ওয়ালদি আল-বাজি আল-আন্দালুসি রহিমাহুল্লাহু তাঁর ‘আল-মুনতাকা’ গ্রন্থে বলেন, ‘সকল ঋণ পরিশোধ করা এবং ধনাঢ্যতা লাভের আগ পর্যন্ত বিচারকের আসনে বসা উচিত নয়। কারণ, এতে বিচারের ক্ষেত্রে বিঘ্নতা এবং পক্ষপাতিত্বের অবকাশ থাকে। তাই ঘুষ এবং বিভিন্ন উপহারের প্রলোভন থেকে নিরাপদে থাকার জন্য ধনাঢ্যতা অর্জন জরুরী।’

ইতিহাসের অধ্যায়গুলোতে প্রায় ক্ষেত্রেই আলেম শ্রেণী, বিশেষ করে ফোকাহায়ে কেরামগণ আর্থিক উন্নতির লক্ষ্যে নিজেদের শিক্ষা এবং আদর্শ অনুযায়ী বেশ কিছু মাধ্যম অবলম্বন করেছেন। এগুলোর মাধ্যমে তারা শাসকশ্রেণীর কবল থেকে নিজেদের স্বতন্ত্রতা রক্ষার লড়াইয়ে সহায়তা লাভের চেষ্টা করেছেন। তন্মধ্য হতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু মাধ্যম হচ্ছে:

এক.কাজের মাধ্যমে উপার্জন

ইসলামি ইতিহাসের ঊষালগ্ন থেকেই উলামায়ে কেরাম ইলম তথা জ্ঞানের স্বতন্ত্রতা অর্জনের ক্ষেত্রে আর্থিক স্বয়ংসম্পূর্ণতাকে প্রধান দরজা হিসেবে গণ্য করেছেন এবং এক্ষেত্রে সফল হওয়ার চেষ্টা করেছেন। তাই তারা শিক্ষার পাশাপাশি বিভিন্ন পেশা এবং ব্যবসায় নিয়োজিত হয়েছিলেন। এমনকি বিভিন্ন জীবনী ইত্যাদি গ্রন্থে তারা নিজেদের পেশাগত পরিচয়ে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। তারা কামার, কাঠমিস্ত্রী, দর্জি, তাঁতি, সুগন্ধি প্রস্তুতকারী এবং লিপিকার ইত্যাদি নানা পেশায় নিয়োজিত হয়েছিলেন।

এ ব্যাপারে বিস্তারিত অধ্যয়ন করতে চাইলে ইমাম আবু সাদ আস-সামআনি আল-মিরওয়াজি রচিত ‘আল-আনসাব’ গ্রন্থটি পাঠ করা উচিত। এতে কয়েকশত উলামায়ে কেরামের পেশাগত পরিচিত তুলে ধরা হয়েছে। এমনিভাবে আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনু ইসহাক আস-সাদি আল-হিরাওয়ি রচিত ‘আস-সুন্নাউ মিনাল ফোকাহায়ি ওয়াল মুহাদ্দিসীন’ গ্রন্থটিও পেশাজীবী আলেমগণের পরিচয় জানার জন্য অত্যন্ত উপকারী প্রাচীন একটি গ্রন্থ।

সাম্প্রতিক কালে আবদুল বাসিত ইবনু ইউসুফ আল-গারিব এ ব্যাপারে বিস্তৃত গ্রন্থ রচনা করেছেন এবং ‘আত-তারফা ফী মান নুসিবা মিনাল উলামায়ি ইলা মিহনাতিন ওয়া হিরফা’ শিরোনামে প্রকাশ করেছেন। এতে তিনি প্রায় পনেরশ উলামায়ে কেরামের চারশর মতো পেশা উল্লেখ করেছেন। এ সকল পেশার মাধ্যমেই তারা জীবিকা নির্বাহ করতেন এবং সরকারি কোষাগারের অথবা শাসকের উপহার থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে পারতেন। পাশাপাশি নির্বিঘ্নে মনোযোগী হতে পারতেন জ্ঞানচর্চার অঙ্গনে। এমনকি অনেক ছাত্রকে তারা নিজেদের পেশায় নিয়োগ দিয়েছিলেন।

দুই. যোগ্যতার স্বীকৃতি

শিক্ষাদান, ফতওয়া প্রদান এবং গবেষণার জন্য নিজেকে যোগ্য ঘোষণা করার পূর্বে একজন আলেমকে তার যোগ্যতা প্রমাণের জন্য বেশ কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করতে হতো। এ কয়েকটি ধাপে তার শিক্ষা-দীক্ষা এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য গুরুত্বের সাথে যাচাই করা হতো। উস্তাদদের সাক্ষ্য এবং স্বীকৃতি ছাড়া কাউকে যোগ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হতো না। এ ছিল সকল মাজহাবেরই নিয়ম। যদি উস্তাদগণ কারও সম্পর্কে এই সাক্ষ্য দিতেন যে, সে ঐ সকল ইলমি ধাপগুলোতে উত্তীর্ণ হয়েছে, যা তাকে তার পছন্দনীয় বিষয় চর্চা করার যোগ্য করে তুলেছে; তবেই তাকে যোগ্য হিসেবে মেনে নেয়া হতো। খতিব আল-বাগদাদি রহিমাহুল্লাহু তাঁর ‘আল-ফকিহ ওয়াল মুতাফাক্কিহ’ গ্রন্থে ইমাম মালিক রহিমাহুল্লাহুর একটি উক্তি উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘সত্তর জন উস্তাদ আমার যোগ্যতার সাক্ষ্য এবং স্বীকৃতি দেয়ার পরেই আমি ফতওয়া প্রদান করেছি। কারো উচিত নয় অধিক জ্ঞানী কাউকে জিজ্ঞাসা না করে নিজেকে কোনো বিষয়ে যোগ্য মনে করা।’

যোগ্যতার স্বীকৃতি না পেলে কাউকে গ্রহণ করা হতো না। আর এই যোগ্যতার স্বীকৃতির জন্য আবশ্যকীয় শর্ত ছিল শাসকশ্রেণীর সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকা এবং তাদের প্রভাব মুক্ত হওয়া। পূর্বেই ইবনু রজব হাম্বলি রহিমাহুল্লাহুর বরাতে উল্লেখ করেছি, খেলাফতের বিচারক ইবনু আবি দাউদের সাথে সম্পর্ক থাকার কারণে মুহাদ্দিস এবং উলামায়ে কেরামগণ আলি ইবনুল মাদিনি রহিমাহুল্লাহুর সাথে কীরূপ আচরণ করেছিলেন! এমনকি তাদের আচরণ দেখে মনে হতো যে আলি ইবনুল মাদিনি যেন ইসলাম থেকেই বের হয়ে গেছেন।

এমনকি যারা শাসকদের আগ্রহকে পাত্তা দেয় এমন সামসময়িক আলেমদেরকে বর্জনের ক্ষেত্রে ফোকাহায়ে কেরাম হাস্যকর পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন। তাকিউদ্দিন হিসনি আশ-শাফেয়ি রহিমাহুল্লাহু তাঁর ‘কিফায়াতুল আখইয়ার ফিল হাল্লি গায়াতিল ইখতিসার’ গ্রন্থে স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন, ‘যদি কোনো ব্যক্তি মুসলমানদের মধ্য হতে সবচেয়ে মূর্খ ব্যক্তিকে সম্পদ ওসিয়ত করতে চায়, তবে এ ক্ষেত্রে প্রথমেই থাকবে ঐ সকল আলেমদের নাম যারা অত্যাচারী শাসকদের সাথে উঠাবসা করা। কারণ, তারা শাসকদের অজ্ঞতামূলক কাজগুলোর ব্যাপারে নীরব থেকে এগুলোর বৈধতার স্বীকৃতি প্রদান করে। আর এমন নীরবতার ফলে পবিত্র শরিয়তের বিলুপ্তি আবশ্যক হয়ে যাবে।’

তিন. ওয়াকফ ব্যবস্থাপনা

সেই প্রাচীন সময় থেকেই ওয়াকফ ব্যবস্থাপনা ছিল উলামায়ে কেরামের স্বতন্ত্রতা রক্ষার প্রধানতম সহায়ক। ওয়াকফের ছিল বিভিন্ন ধরণ এবং বৈশিষ্ট্য। ইসলামি ইতিহাসে অনেক ধরণের ওয়াকফের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। মাদরাসা, শিক্ষক, ছাত্র এবং অন্যান্য সেবামূলক খাতে ওয়াকফ করা হতো। কখনো কখনো চিকিৎসাবিদ্যা এবং জ্যোতির্বিদ্যা ইত্যাদি শিক্ষা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্যও ওয়াকফ করা হয়েছে।

সেই পূর্বকাল থেকেই ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গ এবং শাসক ও মন্ত্রীগণ এ সকল প্রতিষ্ঠানগুলোতে সম্পদ ওয়াকফ করার প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন। আল্লমা তাজুদ্দিন সুবকি ‘তবাকাতুশ শাফিয়িয়্যাহ’ গ্রন্থে সালজুক সাম্রাজ্যের উজির নিজামুল মুলক (মৃত্যঃ ৪৮৫ হিজরি) সম্পর্কে বলেন, ‘জানা যায়, ইরাক এবং খোরাসানের প্রতিটি শহরেই তাঁর প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা রয়েছে।’ ইবনুল জাওজি রহিমাহুল্লাহু উল্লেখ করেন, উজির নিজামুল মুলক ৪৫৯ হিজরিতে বাগদাদে তাঁর প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসায়ে নিজামিয়্যাহর জন্য অনেক ফসল, জমি-জমা এবং মাদ্রাসার কাছেই প্রতিষ্ঠিত বাজারকে ওয়াকফ করেছিলেন। প্রত্যেক শিক্ষক এবং কর্মীর জন্য ওয়াকফ থেকে নির্দিষ্ট অংশ বরাদ্দ ছিল।

ডক্টর মুস্তফা আস-সিবাই (মৃত্যুঃ ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দ) তাঁর ‘রাওয়াইউ হাজারাতিনা’ গ্রন্থে শাম তথা বৃহত্তর সিরিয়ার আলেম সমাজে নাগরিক ওয়াকফের অবদানের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি নুয়াইমি আদ-দিমাশকি (মৃত্যুঃ ৯২৭ হিজরি) রচিত ‘আদ-দারিস ফি তারিখিল মাদারিস’ থেকে বর্ণনা করে বলেন, ‘এক দামেস্কেই কুরআনুল কারিম শিক্ষা দেয়ার জন্য সাতটি মাদ্রাসা ছিল। হাদিস শিক্ষার জন্য ছিল ষোলটি। কুরআন এবং হাদীসের জ্ঞানের সমন্বয়ে মাদ্রাসা ছিল তিনটি। শাফেয়ি মাজহাবের ফিকহ শিখার জন্য ছিল ৬৩ টি মাদ্রাসা। হানাফি মাজহাবের জন্য ছিল ৫২টি। মালেকি মাজহাবের চারটি এবং হাম্বলি মাজহাবের জন্য ছিল এগারোটি। এছাড়া চিকিৎসাবিদ্যা ইত্যাদি অন্যান্য শাস্ত্রের মাদ্রাসাগুলোও ছিল। এর প্রত্যেকটিতেই ছাত্রদের কোনো কমতি ছিল না।’

মামলুক সুলতান আশরাফ কাইতাবাইয়ের (মৃত্যুঃ ৯০১ হিজরি) শাসনামলে একজন বিরাট ব্যবসায়ী মিসরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি মনোনিবেশ করেন। তিনি এর সংস্কার করেন এবং সুলতান কাইতাবাইয়ের নামে মিনার নির্মাণ করেন। এমনিভাবে ছাত্রদের থাকার জন্য হোস্টেল নির্মাণ করেন এবং সেখানকার শিক্ষক ছাত্রদের জন্য অনেক সম্পদ ওয়াকফ করেন। এমনিভাবে উসমানি সুলতান সুলাইমান আল-কানুনিরও আল-আজহারের প্রতি সুনজর ছিল। সাম্রাজ্যের পক্ষ থেকে তিনি সেখানকার আলেম এবং সংশ্লিষ্টদের জন্য অনেক সম্পদ ওয়াকফ করেছিলেন।

উলামায়ে কেরামের সেই স্বাতন্ত্র্য কি আজ ম্লান হয়ে গেছে?

আধুনিক সময়ে এসে বেশ কয়েকটি কারণ উলামায়ে কেরামের ধরে রাখা সেই স্বাতন্ত্রকে দূরে ঠেলে দেয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করেছে। প্রথম কারণটি হচ্ছে, উপনিবেশ শক্তি কর্তৃক ওয়াকফ ব্যবস্থাপনাকে বাতিল করা। ১২৫৯ হিজরি মোতাবেক ১৮৪৩ খ্রিষ্টাব্দে সর্বপ্রথম ফ্রান্স আলজেরিয়া দখল করে সেখানকার ওয়াকফ ব্যবস্থাপনাকে বাতিল করে। অতঃপর অন্যান্য ইসলামি রাষ্ট্রের ওয়াকফ ব্যবস্থাপনাগুলোর উপরেও উপনিবেশবাদীরা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে নেয়। এর ফলে উলামায়ে কেরামের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা হয়ে পড়ে খুবই কঠিন এবং নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি। তবে এমন কঠিন পরিস্থিতিতেও অনেক আলেম নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছিলেন।

বর্তমান সময়ে এসে আলেমদের স্বতন্ত্রতা বিনষ্ট হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে, আধুনিক শাসনব্যবস্থার সাথে আলেমদের মিশে যাওয়া। বর্তমান সময়ের অনেক আলেম সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে জড়িত এবং মাস শেষে সরকারি ভাতা গ্রহণ করেন। এর পাশাপাশি এ সময়ে শিক্ষাপ্রদানের পাশাপাশি অন্যান্য ব্যবসার সাথে জড়িত হওয়াও খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়াও বর্তমান সময়ের শাসন ব্যবস্থায় প্রতিটি সেক্টরে এমন কিছু নিয়ম ও রীতি-নীতি প্রয়োগ করা হয় যার ফলে আলেমদের সেই সুপ্রাচীন স্বাতন্ত্র্য রক্ষা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

তারপরও, উলামায়ে কেরামের জন্য উচিত নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার জন্য পৃথক নীতিমালা প্রণয়ন করা। মুসলিম বিশ্বের প্রাচ্যে ও পশ্চিমের উলামায়ে কেরাম নিজেদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় কি কি পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন, কীভাবে তারা শাসকশ্রেণীর নিয়ন্ত্রণ এবং প্রভাব থেকে দূরে থেকে সম্মানজনক এবং নিরাপদ জ্ঞানচর্চার পরিবেশ তৈরী করেছিলেন, তা অধ্যয়ন করা এ ক্ষেত্রে খুবই উপকারী হবে। এভাবেই উলামায়ে কেরামের স্বাতন্ত্র্য বজায় থাকবে। তাই মাদ্রাসাগুলোর জন্যও উচিত এ ব্যাপারে কার্যকরী পন্থা গ্রহণ করে উলামায়ে কেরামের স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণে ব্রতী হওয়া। নিজেদের স্বাতন্ত্র্য ভুলে গিয়ে শাসকদের পূজা করা এবং তাদের দ্বারস্থ হওয়া কোনো খাঁটি আলেমের বৈশিষ্ট্য নয়।

এই শ্রেণীর আলেমদের ক্ষেত্রেই ফাসিক এবং উলামায়ে সু শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। দ্বীন রক্ষার ক্ষেত্রে উলামায়ে কেরামের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা উক্ত প্রবন্ধে আলোচিত হয়েছে। এজন্যই আবু সাইদ খুদরি রা. নির্ভীক চিত্তে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন বনু উমাইয়া শাসক মারওয়ানের সম্মুখে। দ্বীনে ইলাহির প্রবর্তক বাদশাহ আকবরের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে কোনো ভয় করেননি মুজাদ্দিদে আলফে সানি আহমাদ সিরহিন্দি রহিমাহুল্লাহু। যারা আজ নিজেদের স্বাতন্ত্র্য ভুলে গিয়ে শাসকপূজায় লিপ্ত হয়েছে তাদের উচিত উলামা এবং ফোকাহায়ে কেরামের সেই উজ্জ্বল ইতিহাস অধ্যয়ন করে কল্যাণের পথে ফিরে আসা।

আগের সংবাদমুসলিম সভ্যতায় গোয়েন্দা ব্যবস্থা
পরবর্তি সংবাদসাইয়েদাতুত তাবিইয়াত হাফসা বিনতে সীরীন