রাকিবুল হাসান নাঈম:
৫৯৭ হিজরি সালটি ছিল সীমাহীন বিপর্যয়ের বছর। ইতিহাসবিদ ইবনে কাসির ‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ গ্রন্থে লিখেন, সে বছর একটি ভূমিকম্প আঘাত হানে ইরাকে। সেই ভূমিকম্প ইরাক থেকে ছড়িয়ে পড়েছিল বর্তমান তুরস্ক এবং শামে। তখন লক্ষাধিক প্রাণ ও গবাদিপশুর প্রাণহানি হয়েছিল। ভেঙে পড়েছিল সুউচ্চ প্রাসাদ, রাজধানীর বড় বড় ইমারাত। মানুষ তখন না খেতে পেয়ে একজন আরেকজনকে খাওয়া শুরু করেছিল। তবে সবচে বেশি আঘাত হেনেছিল শামে। বসরার একটি গ্রাম মাটিতে দেবে গিয়েছিল। শামের উপকূলে বয়ে গিয়েছিল ধ্বংসযজ্ঞ। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল ত্রিপোলি, টায়ার, একর এবং নাবলুসের অনেক শহর। নাবলুসে কেবল সামরিয়া পাড়াই রয়ে গিয়েছিল। সেখানে মারা গিয়েছিল ৩০ হাজার লোক।
‘মিরআতুয যামান’ গ্রন্থে লেখা হয়েছে, এই ভূমিকম্পে ১.১ মিলিয়ন মানুষ মারা গিয়েছিল। এর থেকেই প্রতীয়মান হয়, ইতিহাসের ভয়ংকরতম ভূমিকম্পটি আঘাত হেনেছিল সে বছর।
ধর্ম এবং ভূতত্ত্ব: আরবরা কীভাবে ভূমিকম্পের ব্যাখ্যা দেয়?
‘আরব ঐতিহ্যে ভূমিকম্পের কারণ’ শিরোনামে কুয়েতি ডাক্তার এবং গবেষক আবদুল্লাহ ইউসুফ আল-ঘুনাইমের ১১৩ পৃষ্ঠার গবেষণাপত্রটি একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা। ইতিহাস এবং ভূগোলের দৃষ্টিকোণ থেকে ভূমিকম্পের বিষয় যেমন তুলে এনেছেন, তেমনি আরব ঐতিহ্যের উদাহরণও তুলে ধরেছেন। তিনি তার গবেষণায় যা বলেছেন, তা আরবের বিভিন্ন প্রামাণ্য গ্রন্থেও ছড়িয়ে আছে।
ভূমিকম্প বলা হয় প্রবল কম্পন এবং তীব্র ঝাঁকুনিকে। পবিত্র কোরআনে কেয়ামতের চিহ্ন এবং আখেরাতের সতর্কবাণী হিসেবে ভূমিকম্পের প্রসঙ্গ এসেছে। সূরা যিলযালে বলা হয়েছে: ‘যখন পৃথিবী তার কম্পনে প্রকম্পিত হবে, যখন সে তার বোঝা বের করে দেবে। এবং মানুষ বলবে, এর কি হল ? সেদিন সে তার বৃত্তান্ত বর্ণনা করবে।’
শব্দটি উদ্বেগ, আতঙ্ক এবং মনস্তাত্ত্বিক পরাজয় প্রকাশ করার জন্য একটি রূপক হিসাবেও ব্যবহৃত হয়। সূরা আহযাবে বলা হয়েছে: ‘সে সময়ে মুমিনগণ পরীক্ষিত হয়েছিল এবং ভীষণভাবে প্রকম্পিত হচ্ছিল।’ আরবি অভিধানগুলোও শব্দটির মূল অর্থ ‘প্রবল কম্পন’ এবং ‘তীব্র ঝাঁকুনি’ বলে উল্লেখ করেছে।
দশম শতকের আরবের মুসলিম দার্শনিকদের সংগঠন ছিল ইখওয়ানুস সাফা। তাদের ‘রাসাইলু ইখওয়ানুস সাফা’ নামক গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘পাহাড় এবং পৃথিবীর অভ্যন্তরে বিভিন্ন অতল গহবর রয়েছে। সেগুলো থেকে যখন পানি বের হতে পারে না, পানিগুলো দীর্ঘদিন আবদ্ধ থাকে। পৃথিবীর অভ্যন্তরভাগ উত্তপ্ত হয়ে যায়, পানিগুলোও তপ্ত হয়ে যায়, স্ফীত হয়ে যায়। প্রশস্ত জায়গার দাবি করে। তখন সেখানে বাষ্প হয়ে প্রবল চাপ তৈরী হয়। ভূমি ফেটে সেগুলো তখন বাইরে বেরিয়ে আসে। যে জায়গা দিয়ে সেই পানি ও বাতাসের চাপ বেরিয়ে আসে, সে জায়গাটি দেবে যায়। এটাকেই ভূমিকম্প বলে। ‘
আরব চিকিৎসক এবং ভূগোলবিদদের লিখিত বেশিরভাগ ব্যাখ্যা ইখওয়ানুস সাফার বক্তব্যের কাছাকাছি। স্বল্প কিছু পার্থক্য এবং আপেক্ষিক কিছু সংযোজন রয়েছে। ইবনে সিনা ভূমিকম্পকে বলেছেন ‘বায়ুমণ্ডলীয় চাপ’। আটকে পড়া বাতাসের কারণে এটা ঘটে থাকে। তাই দেখা যায়, যখন ভূমিকম্প ঘটে, তখন কোনো বাতাস থাকে না। আরব ভূগোলবিদ কাজউইনি ভূমিকম্পের গতিবিধিকে জ্বরগ্রস্ত দেহের কাঁপুনির সাথে তুলনা করেছেন। জ্বরের তপ্ততায় মানুষ যেমন অশান্ত হয়ে থাকে, তেমনি অভ্যন্তরের গ্যাসীয় তপ্ততায় ভূমিও অশান্ত হয়ে উঠে।
তাই ইবনে সিনাসহ মুসলিম পণ্ডিতরা ভূমিকম্পের ঝুঁকি কমানোর জন্য অনেক কূপ এবং খাল খনন করার পরামর্শ দিয়েছেন। এতে ভূমিকম্পের ঝুঁকি হ্রাস পাবে।
ভূমিকম্পের কারণ: অন্যান্য ব্যাখ্যা
একদল আলেম ধর্ম ও বিজ্ঞানকে একত্রিত করে ভূমিকম্পের ভূতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ইবনে তাইমিয়া বলেন, ‘ভূমিকম্প আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সাবধান ও সতর্ক করার জন্য পাঠান। সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণের মতো এটিও একটি ভীতিমূলক নিদর্শন। জমিনের অভ্যন্তরে তপ্ত বাষ্প যখন বের হবার জায়গা পায় না, তখন তার চাপে ভূমিকম্প ঘটে।’
এ সম্পর্কে পৌরাণিক কাহিনী আছে। কেউ কেউ বলেন, পৃথিবী একটি ষাঁড়ের শিংয়ের উপরে দাঁড়িয়ে আছে। এটি আল্লাহর একটি কুদরত। ষাঁড় যখন নড়ে, তখন ভূমিকম্প ঘটে। ইবনে তাইমিয়া বলেন, এটা একটা ভূল কথা। ষাঁড় নড়লে তো পুরো পৃথিবীই নড়তো। এমন তো হয় না, পুরো পৃথিবী একসঙ্গে নড়ে।
ইবনুল জাওজির মতে, জমিনের অভ্যন্তরের বাতাস উত্তপ্ত হয়ে যখন বের হবার পথ খুঁজে পায় না, তখন আল্লাহ তায়ালা সেগুলো বের হবার অনুমতি দেন। তখন প্রচণ্ড ভূমিকম্প তৈরী হয়। এতে বান্দাও সতর্ক হয়, ভয় পায়।
আলেমরা বলেন, ভূমিকম্পে যারা মারা যাবে, তারা শহীদ। ইমাম কুরতুবি তার কারণ উল্লেখ করে লিখেন, ‘যারা শহীদ হচ্ছে, তারা তো অবহেলা করে শহীদ হয়নি। তারা পূর্ণ সতর্ক ছিল। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা এই ভূমিকম্প দিয়েছেন।’
আজহারি আলেম ইসাম তালিমাহ বলেন, ‘যারা বলে ভূমিকম্প আসে বান্দার গুনাহের শাস্তি হিসেবে, তাদের কথা ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষঙ্গ শাহাদাতের সঙ্গে বিরোধী হয়ে যায়। অথচ, হাদিসে শাহাদাতকে কেবল যুদ্ধের ময়দানের সঙ্গে সীমাবদ্ধ করেননি। বরং ডুবে মরা, আগুনে পুড়ে মরাকেও শাহাদাত বলেছেন।
তিনি আরও বলেন, বিপদ আসে বান্দাদের পাপ এবং সীমালঙ্ঘনের উপর ভিত্তি করে। সবসময় এটা খাটবে না। কারণ মহাজাগতিক ঘটনা এটি মানুষের ধার্মিকতা বা দুর্নীতির সাথে সম্পর্কিত নয়। বরং মহাবিশ্বের স্রষ্টার সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাই দেখা যায়, ভূমিকম্প এবং আগ্নেয়গিরি মুসলিম এবং অমুসলিম সব দেশেই ঘটে। ভূমিকম্প দিয়ে পূর্ববর্তী উম্মতকে শাস্তি দেয়া হতো। কিন্তু আমাদের নবী আসার সঙ্গে সঙ্গে সেই শাস্তির ধরণের ইতি ঘটেছে এবং উম্মতের শাস্তি আখেরাতের জন্য স্থগিত করা হয়েছে রাসুলের দোয়ার কারণেই।’
ভূমিকম্প বিষয়ক আরবি রচনা
ভূমিকম্প সম্পর্কিত বইয়ে পূর্ণ আরবি ভাষা। বিভিন্ন বইয়ে এই বিষয়টি ইবনে সিনা, কাজউইনি, ইবনে খালদুন এবং ইবনে হাইয়ান অমর করে রেখেছেন। কুয়েতি গবেষক আবদুল্লাহ ইউসুফ আল-ঘুনাইম অনেক বইয়ের নাম উল্লেখ করেছেন।
১. علم حدوث الرياح في باطن الأرض، المحدثة كثير الزلازل: ইবনে নাদিম তার ফিহরিস্তে বলেছেন, এটি দার্শনিক কিনদির লেখা (২০৪হি)।
২. الإنذار بحدوث الزلازل : ইয়াকুত হামাবি লিখেছেন, এটি ঐতিহাসিক ইবনে আসাকিরের লেখা।
৩. كتاب الزلال والأشراط : এটি লিখেছেন আবুল হাসান আলী ইবনে আবি বকর আউশানি (৫৫৭হি)।
৪. عروة التوثيق، في النار والحريق : এটি লিখেছেন কুতুব মুহাম্মদ বিন আলি কাস্তালানি।
৫. تحصين المنازل من هول الزلازل; এটি লিখেছেন আবুল হাসান বিন জাযযার।
৬. كشف الصلصلة عن وصف الزلزلة : এটি লিখেছেন জালালুদ্দিন সুয়ুতি।
আরবের বিখ্যাত কিছু ভূমিকম্প
ইসলামি ইতিহাসে অনেক ভূমিকম্পের ঘটনা আছে। এরমধ্যে অন্যতম হলো দামেশকের ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প যা দামেস্ক শহরকে কাঁপিয়েছিল। সুয়ুতি তার ‘দামেশকের ইতিহাস’ গ্রন্থে ইবনে আসাকিরের উদ্ধৃতি দিয়ে এই ভূমিকম্পের সময় এবং বৃত্ত নির্ণয় করেছেন। তিনি লিখেছেন, ২৩৩ হিজরি রবিউস সানিতে এই ভূমিকম্প হয়েছিল। উমাইয়া মসজিদের এক চতুর্থাংশ ধ্বসে পড়েছিল। মানুষ তখন মাঠে বেরিয়ে এসে নামাজ পড়ে সাহায্য পার্থনা করেছিল।
৪৬০ হিজরিতে মদিনায় আরেকটি মারাত্মক ভূমিকম্প হয়। এটি শাম এবং ফিলিস্তিনে ছড়িয়ে পড়ে। ইবনে কাসির এই ভূমিকম্পে কী ঘটেছিল তা বর্ণনা করতে ইবনুল জাওজির উদ্ধৃতি দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, এটি আঘাত করেছিল জুমাদাল উলা মাসে। এটি ওয়াদি সাফরা ও খায়বারে ছড়িয়ে পড়েছিল। পুরো রামলাকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। সেখানে মারা গিয়েছিল ১৫ হাজার লোক।
দামেস্ক থেকে অনতি দূরে হামা এবং শাইজার শহর একটি ভয়ানক ভূমিকম্প দেখেছিল ৫৪৯ হিজরিতে। এতে মুনকিদ পরিবারের রাজত্বের পতন ঘটে।
কামালিয়া তাজকিরাহের লেখক উল্লেখ করেছেন, ১১৭৩ খৃস্টাব্দে রবিউল আউয়ালের ষষ্ঠ তারিখ, রাত দশটায়, ঝড়ের বাতাসে পৃথিবী প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। দাামেশকের বাড়ি এবং মিনারগুলো তাতে ধ্বসে পড়ে।
সুতরাং বলা যায়, শাম, সিরিয়া এবং ইরাক আবহমান কাল থেকেই ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। ইতিহাসে সেখানে ঘটে গেছে ভয়ংকর সব ভূমিকম্প।
সূত্র : আল জাজিরা