মাহদি হাসান :
শেষ হয়ে গেছে পবিত্র মাহে রমজান। রমজান এলেই আমাদের মাঝে ছড়িয়ে যায় এক অদ্ভুত আনন্দ। পাড়ায় পাড়ায় ছড়িয়ে যায় এক প্রশান্তিময় পরিবেশ। মাহে রমজানের আগমনে পৃথিবী যেন নিজের গা থেকে মুছতে শুরু করে পাপের কালিমা যত। পশ্চিমাকাশে রমজানের নতুন চাঁদ দেখতেই কচিকাঁচা, যুবক, বৃদ্ধ সবার মনে খেলে যায় এক পবিত্র আনন্দ। সকলেই হৃদয়ের গভীর থেকে অভিবাদন জানায় সেই নতুন চাঁদকে।
রমজানের সন্ধ্যা হতেই সবাই ফিরে আসে নিজ নিজ নীড়ে। সারাদিন রোজা রেখে ইফতারে সবাই লাভ করে সীমাহীন আনন্দ। ইফতারের পর শুরু হয় রমজানের রাত। রমজানের প্রতিটি রাতই যেন এক উৎসব। সেই উৎসবের উপলক্ষ্য তারাবির নামাজ। যেখানে কচিকাঁচা, কিশোর, যুবক, বৃদ্ধ সবাই দাঁড়িয়ে যায় দীর্ঘ নামাজে। আল্লাহকে খুশী করার উদ্দেশ্যে প্রশান্তমনে দাঁড়িয়ে থাকে দীর্ঘ সময়। পবিত্র কুরআনের সুরে মোহাবিষ্ট হয়ে থাকে সবাই। সমগ্র বিশ্বের মুসলিমদের মাঝেই তারাবির নামাজের রয়েছে বিশেষ মাহাত্ম্য। আমাদের বাংলার শহর এবং পল্লী অঞ্চলেও তারাবীর নামাজ আদায় করা হয় ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনার সাথে।
কবি জসিমউদ্দীন কত সুন্দর করে লিখে গেছেন,
তারাবি নামাজ পড়িতে যাইব মোল্লাবাড়িতে আজ,
মেনাজদ্দীন, কলিমদ্দীন, আয় তোরা করি সাজ।
চালের বাতায় গোঁজা ছিল সেই পুরাতন জুতা জোড়া,
ধুলাবালু আর রোদ লেগে তাহা হইয়াছে পাঁচ মোড়া।
তাহারি মধ্যে অবাধ্য এই চরণ দুখানি ঠেলে,
চল দেখি ভাই খলিলদ্দীন, লন্ঠন-বাতি জ্বেলে।
ঢৈলারে ডাক, লস্কর কোথা, কিনুরে খবর দাও।
মোল্লাবাড়িতে একত্র হব মিলি আজ সার গাঁও।
পল্লী কবি জসিমউদ্দিনের এই কবিতা যেন শুধু কবিতা নয়। আমাদের পল্লী অঞ্চলের রমজান মাসের এক বাস্তবিক চিত্র। তিনি চিত্রায়িত করেছেন, রমজান শুধু সিয়াম-সাধনার মাস নয়। রমজান ঐক্যের মাস। পরস্পর ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে ক্ষমা করে দেয়ার মাস। কিন্তু কবিতার শেষাংশে কবি দুঃখ করেই রমজানের এই চিরায়ত ঐতিহ্য ধীরে ধীরে মুছে যাওয়ার আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন। যান্ত্রিকতার এ যুগে এসে মানুষগুলো কেবলই অনুভূতিহীন হতে চলেছে। এখনো রমজান এসে চলে যায়। বন্ধ হয় না মানুষের ঝগড়া-ফ্যাসাদ।
পবিত্র রমজান মাসের অন্যতম আকর্ষণ তারাবির নামাজ। তারাবির দীর্ঘ নামাজের কুরআন তিলাওয়াত এবং শ্রবণ মুমিনের অন্তরকে বিগলিত করে প্রভুর দিকে মনোযোগী করে দেয়। একজন মুমিনের ভালোবাসার এই তারাবি নামাজের ইতিহাস সম্পর্কে আমরা খুব কমই জানি। চলুন আজ জেনে নিই, আমাদের ভালোবাসার এই তারাবি নামাজের বিস্তারিত ইতিহাস সম্পর্কে।
তারাবির নামাজ কখন প্রণীত হয়?
সহীহাইনে আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত আছে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের রাতের মধ্যভাগে বের হয়ে মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করলেন। লোকেরাও তাঁর সাথে নামাজ আদায় করল। এভাবেই চলতে লাগল। মুসল্লির সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেল। চতুর্থদিন এসে রাসুল সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে বললেন, আমি তোমাদের আমল প্রত্যক্ষ করেছি। কিন্তু আমার ভয় হয় যে, এ আমল তোমাদের উপর ফরজ হয়ে যাবে এবং তোমরা তা আদায় করা থেকে অক্ষম হয়ে যাবে। [বুখারী, হাদীস নং: ২০১২]
অনেকেই মনে করে থাকেন যে, ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর রা.-এর শাসনামলে তারাবির নামাজের সূত্রপাত হয়। কিন্তু আল্লামা ইবনুল মুবাররাদ হাম্বলি (মৃত্যুঃ ৯০৯ হিজরি) আমাদের কাছে তারাবি নামাজের সূচনার কথা স্পষ্ট করেছেন। বলেছেন, ‘তারাবিকে কেউ যেন ওমর রা.-এর সৃষ্টি মনে না করে। বরং নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সময় থেকেই তারাবির নামাজের প্রচলন শুরু হয়। তবে ওমর রা.-ই চতুর্দশ হিজরিতে তারাবির নামাজের জন্য এক কারীর পিছনে মুসল্লীদের একত্রিত করার পদ্ধতি চালু করেছিলেন। এর আগে সবাই একা একা তারাবির নামাজ পড়ত। প্রতি চার রাকাত পর পর বিশ্রাম নেয়ার কারণে এ নামাজকে তারাবি নামকরণ করা হয়েছে। তারাবি হচ্ছে তারওয়িহ শব্দের বহুবচন। এর অর্থ হচ্ছে বিশ্রাম নেয়া।’
ইমাম শাওকানি বলেন, তারাবির নামাজ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে প্রমাণিত। তিনি রমজানের রাতে নামাজ আদায় করেছেন এবং অনেক সাহাবায়ে কেরাম তাঁর ইক্তেদা করেছেন। নবীজি তা জানতে পেরেছিলেন। কিন্তু তাদের উপর এ আমল ফরজ হয়ে যাওয়ার ভয়ে তিনি তা থেকে নিষেধ করেছিলেন। এ থেকে জানা যায় যে, রমজানের রাতে জামাতের সাথে নফল নামাজ আদায় করা সুন্নাত, বিদয়াত নয়। কারণ, নবীজি ওজরের কারণেই তা থেকে বিরত থেকেছিলেন। [আস-সাইলুল জারার: ১/৩২৯]
আমিরুল মুমিনীন ওমর ইবনুল খাত্তাব রাযিয়াল্লাহু আনহু এক ইমামের পিছনে মুসল্লিকে একত্রিত করে পূর্বেকার সুন্নাতকেই পুনরায় চালু করেছিলেন। কারণ, ফরজ হয়ে যাওয়ার যে আশঙ্কা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম করেছিলেন, তাঁর ইন্তেকালের পর সেই পথ বন্ধ হয়ে গেছে। ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহুর এই পদক্ষেপে সাহাবায়ে কেরাম খুবই আনন্দিত হয়েছিলেন। এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। আলি রাযিয়াল্লাহু আনহুর মুখ দিয়ে এই উচ্ছ্বাস প্রকাশিত হয়েছে। তিনি যখন মসজিদে প্রবেশ করে দেখতে পেলেন মোমের আলো জ্বলছে, লোকেরা দাঁড়িয়েছে তারাবির নামাজে, তখন তিনি ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহুকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠেন, ‘হে ইবনুল খাত্তাব, আপনি যেভাবে আল্লাহর মসজিদকে কুরআনের আলোয় আলোকিত করেছেন, তেমনি করে আল্লাহ আপনার কবরকে আলোকিত করুন।’ [মুখতাসারু কিয়ামিল লাইল, মিরওয়াযি : ২১৮, হাদিস একাডেমী, ফয়সালাবাদ, পাকিস্তান]
সহিহ বুখারিতে আবদুর রাহমান ইবনু আবদ আল-ক্বারী (রহ.) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, আমি রমযানের এক রাতে ‘উমর ইবনুল খাত্তাব (রাদি)- এর সাথে মসজিদে নাববীতে গিয়ে দেখি যে, লোকেরা এলোমেলোভাবে জামাআতে বিভক্ত। কেউ একাকী সালাত আদায় করছে, আবার কোন ব্যক্তি সালাত আদায় করছে এবং ইকতেদা করে একদল লোক সালাত আদায় করছে। ‘উমর (রাদি) বললেন, আমি মনে করি যে, এই লোকদের যদি আমি একজন কারীর (ইমামের) পিছনে জমা করে দেই, তবে তা উত্তম হবে। এরপর তিনি ‘উবাই ইব্নু ‘কাব (রাঃ)- এর পিছনে সকলকে জমা করে দিলেন। পরে আরেক রাতে আমি তাঁর [উমর (রাদি)] সাথে বের হই। তখন লোকেরা তাদের ইমামের সাথে সালাত আদায় করছিল। ‘উমর (রাদি) বললেন, কতইনা সুন্দর এই নতুন ব্যবস্থা! তোমরা রাতের যে অংশে ঘুমিয়ে থাক, তা রাতের ঐ অংশ অপেক্ষা উত্তম যে অংশে তোমরা সালাত আদায় কর, এর দ্বারা তিনি শেষ রাত বুঝিয়েছেন, কেননা তখন রাতের প্রথমভাগে লোকেরা সালাত আদায় করত। [বুখারি, হাদীস নং: ২০১০]
ইবনুল মুবাররদের ছয় শতাব্দী আগের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ আল্লামা ইবনু জারির তবারি ওমর রা. কর্তৃক তারাবির নামাজের জন্য মানুষকে একত্রিত করার ঘটনা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, ১৪ হিজরিতে ওমর রা. এ নিয়ম চালু করেছিলেন এবং শাসিত প্রতিটি অঞ্চলে এর নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন। তিনি পুরুষদের জন্য এবং মহিলাদের জন্য আলাদা আলাদা কারি নিযুক্ত করেছিলেন। তবে উম্মাহাতুল মুমিনীন তথা নবীজির স্ত্রীগণ হয়তো নিজেদের বিশেষ অবস্থানের দিকে লক্ষ্য করে মহিলাদের তারাবির জামাতে অংশগ্রহণ করতেন না।
ওমর রাযিয়াল্লাহু যে সকল কারিকে তারাবীর জন্য নিযুক্ত করেছিলেন তাদের নাম ইতিহাসের পাতায় সংরক্ষিত আছে। বিভিন্ন সময়ে তাদেরকে এ কাজে নিযুক্ত করা হয়েছিলে। পুরুষদের জন্য নিযুক্ত কারীগণের মধ্যে ছিলেন : উবাই ইবনু কাব রা. (মৃত্য: ২২ হিজরি), তিনি বিশ রাকাত নামাজ পড়াতেন এবং মুয়াজ ইবনুল হারিস আল-আনসারি রাদি. (মৃত্যু: ৬৩ হিজরি)। আর মহিলাদের জন্য নিযুক্ত কারিগণের মধ্যে ছিলেন: তামিম দারি রা. (মৃত্যু: ৪০ হিজরি), তিনি পুরুষদের নিয়েও নামাজ পড়িয়েছেন। আরও ছিলেন, সুলাইমান ইবনি আবি হাসমা আল-কারশি এবং আমর ইবনু হুরাইস আল-মাখযুমী (মৃত্যু: ৮৫ হিজরি)।
তারাবির প্রসিদ্ধ ইমামগণ
যুগের পরিক্রমায় অনেক প্রসিদ্ধ আলিম তারাবির নামাজের ইমামতি করেছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন, শাইখুল মুফাসরিরিন ইমাম তবারি (মৃত্যু: ৩১০ হিজরি), প্রসিদ্ধ কারি আবু বকর ইবনু মুজাহিদ আল-বাগদাদি (মৃত্যু: ৩২৪ হিজরি), ইমাম ইবনুল জাওযী (মৃত্যু: ৫৯৭ হিজরি) প্রমুখগণ। আবু বকর ইবনু মুজাহিদ রহিমাহুল্লাহু একবার বাগদাদের মসজিদে ইমাম তবারি রহিমাহুল্লাহুর তারাবিহর নামাজের তিলাওয়াত শুনেছিলেন। অতঃপর বলেছিলেন, ‘আমার মনে হয় না এর চেয়ে সুন্দর করে আর কেউ তিলাওয়াত করতে পারবে!!’
ইমাম ইবনুল আসাকির (মৃত্যু: ৫৭১ হিজরি) উল্লেখ করেছেন, তাঁর উস্তাদ আবুল ফাতাহ আল-আনসারি আল-মাকদিসি (মৃত্যু: ৫৩৯ হিজরি) দামেস্কের মসজিদে আলি ইবনুল হাসানে তারাবির নামাজ পড়াতেন। তাঁর পিছনে তারাবির নামাজ পড়ার জন্য মানুষের ভীড় লেগে যেত। তাঁর তিলাওয়াত জড় হৃদয়কেও করে দিত বিগলিত।
শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া রহিমাহুল্লাহু (মৃত্যু: ৭২৮ হিজরি)ও ছিলেন তারাবির নামাজের ইমাম। তাঁর শাগরিদ ঐতিহাসিক ইবনুল ওয়ারদি (মৃত্যু: ৭৪৯ হিজরি) ইবনু তাইমিয়ার জীবনীতে বলেন, আমি রমজানে তাঁর পিছনে তারাবিহর নামাজ আদায় করেছি। তাঁর তিলাওয়াতে পেয়েছি একনিষ্ঠতা এবং তাঁর নামাজের সকল মুসল্লীদের মাঝে দেখেছি এক আশ্চর্য কোমলতা।
ইমামগণের মধ্য হতে অনেকেই পর্যটক এবং ব্যবসায়ীও ছিলেন। ঐতিহাসিক সালাহুদ্দিন সাফাদির (মৃত্যু: ৭৬৪ হিজরি) বর্ণনা অনুযায়ী মুসা ইবনু মাইমুন আল-কুরতুবী নামক এক ব্যক্তিকে মুওয়াহহিদিনদের শাসনামলে ইহুদি ধর্ম থেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করানো হয়। অতঃপর সে কুরআন হিফজ সম্পন্ন করে। সমুদ্রপথে মিসরে ফিরে আসার পথে সে জাহাজের যাত্রীদেরকে নিয়ে রমজান মাসে তারাবির নামাজ আদায় করে। কিন্তু মিসরের এসে সে পুনরায় আগের ধর্মে ফিরে যায় এবং সে সময়কার ইহুদিদের সর্দার বনে যায়। এটি ছিল সুলতান সালাহুদ্দিনের সময়কার ঘটনা।
ইমামগণের মধ্য হতে অনেকেই ছিলেন কুরআন তিলাওয়াতে অত্যন্ত পারদর্শী। তারা প্রতিরাতে এক খতম কুরআন তিলাওয়াতে অভ্যস্ত ছিলেন। দামেস্কের কাজি আবুল হাসান ইমাদুদ্দিন আত-তারসুসি (মৃত্যু:৭৪৮ হিজরি) যিনি অল্প সময়ে কুরআন হিফজ করেছিলেন। তিনি তিন ঘন্টা বিশ মিনিটেই জামাতের সাথে কুরআন খতম সম্পন্ন করেছিলেন।
কারি আবুল হাসান কামালুদ্দিন আল-হিমইয়ারি আল-ইস্কান্দারি (মৃত্যু: ৬৯৪ হিজরি) রমজান মাসে প্রতি রাতে এক খতম করে কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে তারাবির নামাজ পড়াতেন। আবু মুহাম্মাদ আল-হারবি (মৃত্যু: ৫৮৭ হিজরি) পড়তেন অর্ধেক খতম করে। তাদের মধ্যে হতে অনেকেই সাত কেরাত এমনকি দশ কেরাতেও কুরআন তিলাওয়াতে পারদর্শী ছিলেন।
তারাবি যুগে যুগে
চতুর্দশ হিজরীতে জামাতের সাথে তারাবির প্রচলনের পর থেকে তা আজও পর্যন্ত একইভাবে অব্যাহত আছে। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের নিকট জামাতের সাথে তারাবির নামাজ আদায় করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা হিসেবে গণ্য। যুগে যুগে অনেক প্রসিদ্ধ এবং অভিজ্ঞ আলিম তারাবির নামাজের ইমামতি করেছেন। মসজিদে মসজিদে সাধারণ জামাতের পাশাপাশি যুগে যুগে অনেক বিশেষ তারাবির নামাজও হয়েছে। সুলতান, আমির-উমারা এবং বিশেষ ব্যক্তিগণ এই বিশেষ জামাতের আয়োজন করতেন।
ইমাম জাহাবি (মৃত্যু: ৭৪৯ হিজরি) উল্লেখ করেছেন, আব্বাসীয় খলিফা ‘আল-মুস্তাজহির বিল্লাহ (মৃত্যু: ৫১২ হিজরি) তার তারাবির নামাজের সঙ্গী নির্বাচিত করলেন কাজি ইবনুদ দাওয়াসকে। আশ্চর্য ঘটনা হচ্ছে, রমজানে তাঁরা যখন প্রথম তারাবী শুরু করেন তখন কাজি ইবনুদ দাওয়াস প্রথম দুই রাকাতে এক আয়াত করে পড়েন। সালাম ফিরানোর পর আল-মুস্তাজহির আরও বাড়িয়ে পড়তে বললে ইবনুদ দাওয়াস দুই আয়াত করে পড়েন। আল-মুস্তাজহির আবার বাড়াতে বলেন। এভাবে বাড়াতে বাড়াতে তারা প্রতিরাতে এক পারা করে পড়তে শুরু করেন। আব্বাসীয় খলিফাদের শাসনামলে এভাবেই তারাবিহর বিশেষ জামাত অনুষ্ঠিত হয়ে এসেছে।
তৎকালীন আন্দালুসে ইবনু মুকাতিল আল-কাইসি আল-গারনাতি (মৃত্যু: ৫৭৪ হিজরি) ছিলেন কুরআনের হাফেজ এবং বিভিন্ন কেরাতে দক্ষ। তাঁকে গ্রানাডার গ্র্যান্ড মসজিদের তারাবির ইমাম নিযুক্ত করা হয়েছিল। মুওয়াহহিদিন আমলের সুলতান আল-মানসুর কারি আবুল হাসান আল-ফাহমি আল-কুরতুবির (মৃত্যু:৬১৭ হিজরি) কেরাত শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাই তাঁকে সুলতানের সন্তানদের কুরআন শিক্ষা দান এবং তারাবীর নামাজে কিছু অংশ পাঠের জন্য নিয়োগ করা হয়েছিল। আন্দালুসের প্রসিদ্ধ আল-হামরা প্রাসাদের মসজিদে তারাবির নামাজ পড়িয়েছেন মুহাম্মাদ ইবনু কাসিম আল-আনসারি।
ইবনু খাল্লিকান (মৃত্যু: ৬৮১ হিজরি) উল্লেখ করেছেন, আইয়ুবি সাম্রাজ্যের উজির সফিউদ্দিন বিন শুকর আদ-দুমাইরি (মৃত্যু: ৬৩০ হিজরি) কায়রোতে তাঁর প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসার জন্য একজন কারি খুঁজছিলেন। যিনি সেখানে তারাবির নামাজ পড়াবেন। তখন যিয়াদাহ এবং মুরতাজা নামক দুজন আলিমকে নির্বাচিত করা হয়।
এমনকি বড় বড় উলামায়ে কেরামগণও বিশেষ তারাবিহর নামাজের আয়োজন করতেন। আবু হাফস আল-মুয়াদ্দাব বলেন, আমি ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বলের সাথে রমজান মাসের তারাবী নামাজ পড়েছি। ইবনু উমাইর তাঁর জামাতের ইমামতি করতেন। ইমাম সাখাওয়ী কারি বদরুদ্দিন ইবনু তাকি আল-কুব্বানির (মৃত্যু: ৮৪৪ হিজরি) জীবনীতে উল্লেখ করেছেন, তিনি মাদ্রাসায়ে মানকুতামারিয়ায় আল্লামা ইবনু হাজর আসকালানি রহিমাহুল্লাহু (মৃত্যু: ৮৫২ হিজরি) এর তারাবির নামাজের ইমামতি করতেন।
ইমাম শাফেয়ী রহিমাহুল্লাহু (মৃত্যু: ২০৪ হিজরি) মসজিদে লোকদের সাথে তারাবিহর নামাজ আদায় করতেন না। তিনি নিজ গৃহেই তারাবী পড়তেন এবং এক রমজানে ষাট খতম দিতেন। সুবহানাল্লাহ!
তারাবির নামাজের উপর নিষেধাজ্ঞা
বর্তমান সময়ে কোভিড-১৯ করোনা ভাইরাসের কারণে বিশ্বব্যাপী তারাবীর নামাজে মুসল্লী সীমাবদ্ধকরণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু ইতিপূর্বে ফাতেমীয়রা ইসলামি সভ্যতার অন্যতম ভালোবাসার নিদর্শন তারাবীর নামাজকে বন্ধ করে রেখেছিল। কট্টর শিয়া ইসমাইলিয়্যাহ মতাদর্শীরা তাদের অনুগত অঞ্চলগুলোতে ঘোষণা দিয়েছিল যে, আমাদের মাজহাবে তারাবির নামাজ নেই। এটি নবীজির সুন্নাত নয়। বরং ওমর এটির প্রচলন ঘটিয়েছেন। ফলে মিসর, বৃহত্তর সিরিয়া এবং হেজাজের কিছু অংশে অনেক বছর পর্যন্ত তারাবির নামাজ বন্ধ ছিল।
সাবত ইবনুল জাওযী (মৃত্যু: ৬৫৪ হিজরি) উল্লেখ করেছেন, ফাতেমীয় শাসক আল-মানসুর ইসমাইল ইবনুল কায়িম বি-আমরিল্লাহ (মৃত্যু:৩৩৪ হিজরি) তার পূর্বপুরুষদের নিয়মভেঙ্গে তিউনিসিয়ায় তারাবির নামাজ চালু করেছিলেন। ঐতিহাসিক ইবনু সাইদ আল-ইন্তাকি (মৃত্যু: ৪৫৮ হিজরি) উল্লেখ করেন, ৩৭০ হিজরিতে ফাতেমীয় শাসক আল-আজিজ বিল্লাহ (মৃত্যু: ৩৮৬ হিজরি) মিসরে তারাবির নামাজ বন্ধ করে দিয়েছিল। মিসরের আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত অনুসারী এতে খুবই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন।
পরবর্তীতে আল-হাকিম বি-আমরিল্লাহ (মৃত্যু: ৪১১ হিজরি) এসে তারাবির নামাজের উপর সাময়িক শিথিলতা জারি করে পরে দশ বছরের জন্য বন্ধ করে দেয়। এমনকি যারা এ নামাজ আদায় করতো তাদেরকে নির্বাসিত করা হতো। ইমাম মাকরিজি উল্লেখ করেন, ৩৯৯ হিজরিতে হাকিম বি-আমরিল্লাহ রজা ইবনু আবুল হুসাইন নামক এক আলিমকে হত্যার নির্দেশ দেয়। তাঁর অপরাধ ছিল রমজান মাসে তারাবির নামাজ পড়া। জেরুজালেমের বাইতুল মুকাদ্দাসে শাইখ আস-সালিহ আবুল কাসিম আল-ওয়াসেতিকে প্রহার করা হয়েছিল। এমনকি তিনি প্রায় মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে গিয়েছিলেন। ফাতেমীয় শাসকের তারাবী নামাজ সংক্রান্ত আদেশ লঙ্ঘনের কারণে তাঁকে এই শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়েছিল।
৪০৮ হিজরিতে এসে হাকিম বি-আমরিল্লাহ পুনরায় শিথিলতা জারি করেন এবং এ ব্যাপারে অফিসিয়াল নির্দেশনা জারি করেন। মিসর এবং অন্যান্য অঞ্চলের মসজিদে নিয়মিত তারাবি আদায় করা হয়। যা হাকিমের মৃত্যু পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকে।
অপরদিকে আব্বাসীয় খেলাফতের পূর্বাঞ্চলে হাশাশিনরা; যারা শিয়া ইসমাইলিয়্যাহদের সবচেয়ে কট্টরপন্থী ইউনিট ছিল, তারা নিজেদের অধিকৃত পারস্য ও খোরাসানে তারাবীর নামাজ বন্ধ করে দেয়। অতঃপর নিজেদের অন্তিমলগ্নে এসে তারা এতে শিথিলতা করে। ঐতহাসিক ইবনু তাগরি বারদি (মৃত্যু: ৮৭৪ হিজরি) উল্লেখ করেন, ৬০৮ হিজরিতে হাশাশিনদের দখলকৃত আল-মউত কেল্লার দুর্গাধিপতি জালালুদ্দিন বিন হাসান বাগদাদে প্রতিনিধি পাঠিয়ে আব্বাসীয় খলিফা আন-নাসির বিল্লাহকে (মৃত্যু: ৬২২ হিজরি) জানায় যে, তারা বাতেনিয়্যাহ মতবাদ থেকে মুক্ত হয়ে গেছে, মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ করেছে এবং রমজান মাসে তারাবির নামাজের আয়োজন করেছে। এ সংবাদে খলিফা এবং জনগণ খুবই আনন্দিত হন।
সাবত ইবনুল জাওজি ৪৩৯ হিজরির ঘটনা উল্লেখ করেতে গিয়ে বলেন, সে বছর রমজানে বাগদাদে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। মসুল থেকে চিঠি এসে পৌঁছায় যে, সেখানে দুর্ভিক্ষ চরম আকার ধারণ করেছে, এমনকি লোকেরা মৃতদেহ ভক্ষণ শুরু করেছে। তখন জুমার নামাজের জন্যও সমবেত হওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
মাগরিব তথা মরক্কো এবং উত্তর আফ্রিকান অঞ্চলের ঐতিহাসিক আবুল আব্বাস আন-নাসিরি (মৃত্যু: ১৩১৫ হিজরি) তার গ্রন্থ ‘আল-ইস্তিকসা লি-আখবারি দুওয়ালিল মাগরিবিল আকসা’ এর মধ্যে লিখেন, সেখানে রাস্ট্রীয় নিরাপত্তার স্বার্থে তারাবির নামাজ বন্ধ রাখা হয়েছিল।
সুলতান আবদুল মালিক ইবনু যায়দান আস-সাদিকে (মৃত্যু:১০৪০ হিজরি) হত্যা করার পর তার ভাই ওলিদ ইবনু যায়দানের (মৃত্যু: ১০৪৫ হিজরি) জন্য বাইয়াত নেয়া হয়। এ সময় ফেজ শহরে বিশৃংখলা চরম আকার ধারণ করে। ফলে জামে কারাউইনে এক বছর পর্যন্ত জুমা এবং তারাবির নামাজ বন্ধ করে দেয়া হয়। ভয় এবং আতঙ্কের ফলে সে বছর জামে কারাউইনে মাত্র একজনকে লাইলাতুল কদরে নামাজ পড়তে দেখা গিয়েছিল।
তারাবির নামাজে ছোটদের ইমামতি ইসলামি ঐতিহ্য
তারাবীর নামাজে ছোটদের ইমামতি অনেক আগে থেকেই চালু হয়েছে। এমনকি মক্কাসহ আরো অনেক বড় বড় শহরে ছোটদের ইমামতিতে তারাবির নামাজ অনুষ্ঠিত হয়েছে। যদিও এর বিশুদ্ধতা নিয়ে আলিমগণের মাঝে মতভেদ ছিল।
বিখ্যাত পর্যটক আল-মাকদিসি উল্লেখ করেছেন, পারস্যের সিরাজের অধিবাসীরা তারাবির নামাজে ছোটদেরকে ইমামতির জন্য পাঠাত। আল্লামা ইবনুল জাওযী (মৃত্যু: ৫৯৫ হিজরি) উল্লেখ করেন, ৩৯৫ হিজরিতে বাগদাদের বুওয়াইহিয়্যাহ সম্রাট তিন জনকে তারাবির নামাজের জন্য নিযুক্ত করে। তাদের তিলাওয়াত ছিল খুবই সুন্দর। তারা কেউই প্রাপ্তবয়স্ক ছিল না। এমনকি মিসর এবং হেজাজে ছোটদের ইমামতি প্রচলিত অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। বারো-তের বছর বয়সে তারা যখন হিফজ সম্পন্ন করত তাদেরকে তারাবীর ইমামতির জন্য পাঠানো হতো।
পর্যটক ইবনু জুবাইরের সফরনামায় মসজিদুল হারামে ছোটদের ইমামতির ব্যাপারে বিশদ তথ্য দেয়া হয়েছে। ইবনু জুবাইর উল্লেখ করেন, রমজানের একাদশতম রাত্রিতে মক্কার এক বালক কুরআন খতম সম্পন্ন করে ফেলে। অতঃপর সে মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়ে কিছু কথা বলে। এরপর সেই বালকটির পিতা তার বাসায় ওলিমার আয়োজন করে। অতঃপর ত্রয়োদশ রাত্রিতে এসে মক্কার স্বচ্ছল পরিবারের আরেকটি বালক তারাবীতে এক খতম সম্পন্ন করে।
বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা ( মৃত্যু: ৭৭৯ হিজরি) পরবর্তী সময় পর্যন্তও মক্কায় ছোটদের ইমামতি অব্যাহত ছিল। ইবনে বতুতা তার সফরনামায় আমাদেরকে জানাচ্ছেন যে, মসজিদুল হারামে প্রতিটি মাজহাবের অনুসারীগণ একেক মিহরাবে তারাবির নামাজ পড়তেন। প্রতি রমজানের শেষ দশদিনের কোনো এক বেজোড় রাতে তারা কুরআন খতম সম্পন্ন করতেন। কুরআন খতমকারীদের মক্কার কোনো এক স্বচ্ছল পরিবারের বালক থাকতো। কুরআন খতম সম্পন্ন হলে তাঁর জন্য সুসজ্জিত মিম্বার প্রস্তুত করা হতো। সেখানে বসে সে খুতবা প্রদান করত। খুতবা শেষ হলে বালকটির পিতা সবাইকে দাওয়াত দিয়ে খাবারের আয়োজন করত।
ইমাম ইবনু হাজর আসকালানি ৭৮৫ হিজরিতে বারো বছর বয়সেই মক্কার মসজিদুল হারামে তারাবির নামাজে ইমামতি করেছেন। এমন আরও অনেক নজির রয়েছে।
উপমহাদেশে তারাবি
উপমহাদেশে ইসলাম আগমনের পর থেকেই এখানে ইসলামি সকল আয়োজন উৎসাহ ও উদ্দীপনার সাথে পালিত হয়। উপমহাদেশের মধ্যে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে ইসলামি আয়োজনগুলো কোনো বাঁধা-বিঘ্নতা ব্যতিরেকেই পালিত হয়। কিন্তু বহু বাধা বিঘ্নতা সত্ত্বেও ভারতের মুসলমানদের মাঝেও এ সকল আয়োজনে কোনো ভাটা পড়ে না। রমজান এলেই ভারতের মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে সাজ সাজ রব পড়ে যায়। কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠে মসজিদ।পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলেই ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনার সাথে পালিত হয় রমজানের সিয়াম এবং তারাবি।
মোটকথা, তারাবির নামাজ ইসলামি সভ্যতায় সম্প্রীতি ও ভালোবাসার অনন্য নিদর্শন। প্রভুর কালাম তিলাওয়াত এবং শ্রবণের এক অনন্য মাধ্যম। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে রমজানের রোজা রাখা এবং সুস্থভাবে তারাবীর নামাজে অংশগ্রহণের তাওফিক দান করুন।