‘ম্যায় তুঝে ভুলতা নেহি’ : দারুল উলুম দেওবন্দে একবছর

হাসান ফরাজি:

স্বপ্নের ফুল

দারুল উলুম দেওবন্দের দ্বিতীয় মুহতামিম মাওলানা রফিউদ্দীন রহ. এর দুটি স্বপ্ন খুবই প্রসিদ্ধ। একটি হলো নওদারায় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক নিজ হাতে মাদরাসার জন্য দাগ দিয়ে যাওয়া। (ঘুম ভাঙার পর সেই দাগ তিনি হুবহু অবশিষ্ট পেয়েছেন, নাকি স্বপ্নটা তার পরিষ্কার মনে ছিলো এবং স্বপ্নে দেখা দাগ মতোই নওদারার ইমারতটি তৈরি করেছেন- এটি একটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। এই প্রসঙ্গে এই মুহূর্তে জড়াতে চাচ্ছি না।)

দ্বিতীয় স্বপ্ন হলো, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুলসারী কূপের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। কূপভর্তি দুধ। দলে দলে লোকজন সেখানে এসে রাসুলের হাতে দুধ পান করছে। কারও হাতের পাত্র অনেক বড়, কারওটা ছোট।

তিনি এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা করেন, দুধ হচ্ছে উলুমে নবুওয়ত। আর যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতে দুধ পান করেছে তারাই সেই সৌভাগ্যবান, যারা এই বাগান থেকে ইলম আহরণের সুযোগ লাভ করবে। কথিত আছে, স্বপ্নে তিনি যাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতে দুধ পান করতে দেখেছেন সবার চেহারা তাঁর মনের পর্দায় গেঁথে যায়। পরবর্তীতে তিনি তাদের দেখামাত্র চিনতে পারেন।

হেফজখানায় যেদিন এই স্বপ্নের কথা শুনি সেদিন কেঁদে কেঁদে আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলাম, আল্লাহ! তুমি আমাকে সেই দুধ পানকারীদের অন্তর্ভুক্ত করো।

আমার সৌভাগ্য, আমি একটি আলেম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার আব্বা যদিও আলিয়া মাদরাসায় পড়েছেন, কিন্তু আপাদমস্তক একজন কওমী ঘরানার মানুষ। আমার ভগ্নিপতি ছয়জনই আলেম। পাঁচজন কওমী পড়ুয়া। এদের মাঝে তিনজন দেওবন্দেও পড়ে এসেছেন। ভাইয়েরাও সবাই কওমীতে পড়েছেন। শৈশব থেকে কতবার কতভাবে যে দেওবন্দের গল্প শুনেছি তার কোনো হিসেব নেই। ফলে দেওবন্দ শৈশব থেকেই আমার চিন্তা এবং কল্পনায় মিশে যায়।

মালিবাগে এসে দেওবন্দের স্বপ্ন আরও পরিপুষ্ট হয়। কাজী সাহেব রহ. থেকে শুরু করে মালিবাগের অন্যান্য উস্তাদগণ দেওবন্দে যাওয়ার ব্যাপারে নিয়মিত প্রেরণা যোগাতেন। আর বেশিরভাগ উস্তাদ যেহেতু দেওবন্দ থেকে পড়ে এসেছেন তাই দরসে নানা প্রসঙ্গে দেওবন্দ নিয়ে আলোচনা করতেন। দেওবন্দের স্মৃতিচারণ করতেন। সব মিলিয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, দেওবন্দে আমাদের যেতেই হবে।

দেওবন্দের ব্যাপারে আমরা কতটা সিরিয়াস ছিলাম এটা বুঝা যাবে আমাদের ভিসা সংগ্রহের প্রক্রিয়া থেকে। আমাদের সাথিরা ভিসা সংগ্রহ করে ২০ হাজার টাকায়। আমিও ২০ হাজারে রাজি হয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু বাগড়া দেয় আমার ভাই। পরে ১২ হাজারি ভিন্ন আরেক দালাল পেয়ে তার মাধ্যমে ভিসা করাই। আমাদের এই ২০ হাজার আর ১২ হাজারের গল্প শুনে অনেকেই চোখ কপালে তুলে। যেখানে ৬০০ টাকায় ভিসার আবেদন করা যায় সেখানে এত টাকা ঢালা কেন? আমাদের কাছে এর সরল উত্তর হচ্ছে, ৬০০ টাকার আবেদনে কোনো নিশ্চয়তা নেই। ভিসা লাগতেও পারে নাও লাগতে পারে। কিন্তু দেওবন্দ তো আমাদের কাছে অপশনাল নয়। আমাদের দেওবন্দে যেতেই হবে। যে কোনো মূল্যে। সুতরাং যে পথে আমাদের দেওবন্দ যাত্রা আপাত নিশ্চিত হবে আমরা সে পথেই এগুবো। টাকা-পয়সা এখানে কোনো ফ্যাক্ট নয়।

দেওবন্দের প্রস্তুতি এবং যাত্রা

আমাদের দেওবন্দের প্রস্তুতির মাঝে ছিলো উস্তাদদের কাছ থেকে দোয়া নেয়া, বড়দের থেকে পরামর্শ নেয়া আর নিকট অতীতে যারা দেওবন্দে পড়ে এসেছে তাদের থেকে ইমিগ্রেশন আর দেওবন্দের ভেতরগত বিষয়াদি সম্পর্কে ভয়াবহ সব সংবাদ-দুঃসংবাদ শোনা। তাদের থেকে জেনেছি, ইমিগ্রেশনে ভুলেও দেওবন্দ বা নিজামুদ্দীনের কথা বলা যাবে না। বলতে হবে, আজমীর শরিফ যাচ্ছি। সাথে অতিরিক্ত জিনিসপ্রত্র খুব বেশি রাখা যাবে না।

ইন্ডিয়ান ছাত্রদের সম্পর্কে তাদের থেকে যে ধারণা পেলাম তা হচ্ছে, এরা খুবই ভয়াবহ ধরণের প্রাণী। সারাক্ষণ বাঙ্গালীদের ব্যাপারে ওঁৎ পেতে থাকে। একবার বাগে পেয়ে গেলে আর রক্ষে নেই। সোজা দফতওে গিয়ে নালিশ করে দেবে। এরপর বহিষ্কার! সুতরাং ইন্ডিয়ানদের থেকে যথা সম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে থাকতে হবে। বিশেষ পশ্চিমবঙ্গ এবং আসামের ছেলেদের ধারে কাছেও যাওয়া যাবে না।

আমি তাদের কথার উপর যথাসাধ্য আমল করেছি। তবুও আমার যে কয়জন ইন্ডিয়ানের সাথে অল্প-বিস্তর পরিচয় হয়েছে তারা সবাই আসাম এবং বিহারের। বিহারের তিনটা ছেলে তো আমাদের (আমি আর আমিন) ছোট ভাইয়ের মত দেখতেন। আসামিদের কামরায় বেশ কিছুদিন খানা খেয়েছি। সেই সুবাদে তাদের সাথেও ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠে। আসলে ব্যতিক্রম তো সব জায়গায়ই থাকে। সবাই যেমন এতটা দরাজ দিল না, তেমনি সবাই অতটা খারাপও না। সব কিসিমের ছাত্রই ওখানে আছে।

উস্তাদদের সাথে দেখা করে দোয়া নিলাম। এনায়েতুল্লাহ সাহেব কিছু টাকা দিয়ে বললেন, ‘রাস্তায় কিছু কিনে খেও।’ এরপর নসিহতের স্বরে বললেন, ‘দেওবন্দের কোনো মুলাযিম বা কারও কোনো ভুল ধরবে না। মনে রেখো, তুমি সেখানে ইসলাহ করার জন্য যাচ্ছো না। নিজের ইসলাহ করাতে যাচ্ছে।’ নায়েবে মুহতামিম সাহেব বলে দিলেন প্রতিদিন দুইবার করে যেন মাকবারায়ে কাসেমীতে যাই। আর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পর হুজুরের জন্য দোয়া করি। অন্যান্য উস্তাদগণও দোয়া এবং দিক-নির্দেশনামূলক নসিহত করলেন। সবার দোয়া পুঁজি করে একদিন বাদ ইশা দেওবন্দের উদ্দেশে রওয়ানা হয়ে গেলাম।

সে বছর আমদের দলটিই দেওবন্দগামী প্রথম কাফেলা ছিলো। তাই আমাদের বিদায় জানাতে স্টেশনে অনেক মানুষের সমাগম হয়। বাগানবাড়ি থেকে আমার ভগ্নিপতি মুফতি হাফিজুদ্দীন সাহেব, আমার বড় দুই ভাই, আব্বা এবং আরও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন এবং ছাত্রদের এক জামাতের সাথে রীতিমত মিছিলের মত পরিস্থিতিতে আমি স্টেশনে পৌঁছি। সেখানে গিয়ে দেখি আরও অনেক ছাত্র দাঁড়িয়ে আছে। আমি জানি, এই সমাগমের পেছনে আমার বা আমার সাথীদের তেমন কোনো কৃতিত্ব নেই। এরা এসেছে মূলত দেওবন্দের মহব্বতে। আমি নিজেও আগে এক/দুইবার এভাবে এসেছি।

সফরসঙ্গীদের পরিচয়

কাফেলায় আমরা পাঁচজন ছিলাম। সদ্য দাওরা পড়া আমরা তিনজন। আমি, জাহিদ ভাই আর মনসুর ভাই। মুরুব্বি এবং পথ নির্দেশক হিশেবে পেয়ে গেলাম আমাদের সিনিয়র মাহফুজ ভাইকে। মাহফুজ ভাই আগেও ইন্ডিয়া ঘুরে এসেছেন। চিল্লা দিয়েছেন ওখানে। ব্যক্তিগতভাবেও অনেক চালু। তাকে পেয়ে আমাদের বোঝা অনেকটা হালকা হয়ে যায়।

তাছাড়া মাহফুজ ভাই অনেক প্রাণবন্ত এবং মজার একজন মানুষ। পুরো সফর আমাদের মাতিয়ে রেখেছেন।

আমাদের পঞ্চম সফরসঙ্গী ছিলেন বি-বাড়িয়ার। তিনি দেওবন্দে যাওয়ার জন্য সঙ্গী খুঁজছিলেন। সেই সুবাদে একদিন মালিবাগে আসেন। জাহিদ ভাই দয়ালু হয়ে তাকে কাফেলায় ভিড়িয়ে নেন। এই সহজ-সরল এবং নির্বোধ ধরণের মানুষটি সফরে আমাদের জন্য ভালো রকম ঝামেলা তৈরি করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি আমাদের রেখে এক পুলিশের সাথে মাঝপথে নেমে যান। গল্পটা জানার লোভ হচ্ছে? থাক আজকে।

ইমিগ্রেশন

ইমিগ্রেশন সম্পর্কে যত ভীতিপ্রদ কথাবার্তা শুনেছিলাম বাস্তবে তেমন কিছুই ঘটেনি। শুধু আমার ব্যাগ দেখে জিজ্ঞেস করেছিলো, এটার ভেতরে কি? বললাম, কাপড়-চোপর। জিজ্ঞেস করলো, ইন্ডিয়ান রুপি আছে? সোজামুখে না বলে দিলাম। অথচ পকেটে ইন্ডিয়ান রুপি ছিলো। সতর্কতামূলক বাড়ি থেকে দিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু প্রশ্নকর্তা আমাকে প্রশ্নটি করেছেন ‘ব্যাগে কী’ প্রশ্নটির পর। সুতরাং আমি এটিকে এর সাথে আত্বফ করে ধরে নিয়েছি, তিনি আমার ব্যাগে ইন্ডিয়ান রুপি আছে কি না সেটা জানতে চেয়েছেন। আর রুপি তো ব্যাগে ছিলো না। ছিলো পকেটে। আমাকে কি মিথ্যাবাদী বলা যায়?

ইমিগ্রেশন পার হয়ে বাড়িতে ফোন করে জানাই, নিরাপদে পার হতে পেরেছি। বর্ডারের অপর পাড়ে বাংলাদেশের নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। ফলে বাংলাদেশের সিম দিয়েই আমরা যোগাযোগ করতে পারি।

দেওবন্দের মাটিতে

দিল্লি থেকে দেওবন্দের দূরত্ব দ্রুতগামী ট্রেনে তিন থেকে সাড়ে তিন ঘন্টা। আর তুলনামূলক কম গতি সম্পন্ন ট্রেনে পাঁচ ঘন্টায় যাওয়া যায়। আমরা দিল্লি থেকে আম্বালা ট্রেনে উঠি ফজরের শুরু-সময়ে। সেই ট্রেন যখন দেওবন্দ স্টেশনে থাকে তখন বেলা সাড়ে বারোটা বা তারচেয়েও বেশি।

দেওবন্দ স্টেশন, কত আকাবির আর বুযুর্গানে দ্বীন ও উলামায়ে কেরাম এই স্টেশনে এসে অবতরণ করেছেন ! এখান থেকে ট্রেনে চড়েছেন ! কত মহান মনীষীর পদচারণে ধন্য এই স্টেশন !

দেওবন্দ স্টেশনে নামাতেই অটোঅলারা ঘিরে ধরলো। এই দারুল উলুম.. দারুল উলুম…! আমরা ভাড়া মিল করে একটা অটোতে চড়ে বসলাম। আমাদের স্বপ্নের দারুল উলুম আর মাত্র মিনিট কয়েকের দূরত্ব!

দারুল উলুমের ভেতরে

অটো আমাদের এনে বাবুল কাসেমের (সদর গেইট) সামনে নামিয়ে দিলো। দেওবন্দে যারা গিয়েছেন তারা জানেন, বাবে কাসেম দিয়ে ঢুকে সামনে ছোট্ট একটা চত্বর। ডানে মসজিদে কদীম এবং বামে কুতুবখানা ও মাতবাখের রাস্তা। আর সোজা বরাবর সামনে দিয়ে ঢুকলে মুলসারী চত্বর। মুলসারী চত্বরে ঢুকার আগ মুহূর্তে ডানদিকে একটি দানবাক্স বানানো আছে। দানবাক্স· দেখে মাথায় আসলো, এখানে কিছু রেখে যাই। হয়ত আল্লাহ তায়ালা এই উসিলায় এখানে আমার দাখেলা করিয়ে দিবেন। বিসমিল্লাহ বলে ভেতরে দশ টাকার একটি নোট রেখে দিলাম। আর সঙ্গে সঙ্গে ঘন্টা বেজে উঠলো, ঢং!

প্রচন্ড ভয় পেয়ে পিছেয়ে গেলাম। ঘটনা কী? এভাবে টাকা রাখার সঙ্গে সঙ্গে ঘন্টা বেজে উঠলো কেন? কোনো ভুলচুক হয়ে যায় নি তো? পরে সেই রহস্য খোলাসা হয়েছে। দেওবন্দে প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টি বাজানো হয়। ঘড়িতে যা সময় হয় ঠিক ততটা বেল বাজানো হবে। আমরা যখন দেওবন্দে পৌঁছি তখন বাজে ঠিক একটা। তারই ঘণ্টির আওয়াজ ছিলো সেটা। দেওবন্দে মোট দুটি ঘণ্টি আছে। দুটিই ইয়া বড়। একটা কুতুবখানায় ঢুকার মুখে বাম দিকে। আরেকটা মুলসারীতে ঢুকার আগে দু’তলায়। একটা দরসের সময়ের জন্য, আরেকটা প্রতি ঘণ্টার সতর্কিকরণ বেল এবং রমজানে সেহরি-ইফতার এসবের ঘোষণার কাজে ব্যবহৃত হয়।

মুলসারী চত্বর সংলগ্ন পশ্চিমের বিল্ডিংটিই হলো নওদারা। নয়টি দরজাবিশিষ্ট একটি ভবনটিই সেই ঐতিহাসিক স্বপ্নের স্মৃতি বহন করে দাঁড়িয়ে আছে। দুপুর একটায়ও নওদারার বারান্দায় ছাত্র ভরপুর। বরকতের আশায় ভর্তিচ্ছুক ছাত্ররা এখানে বসে পড়াশোনা করে। ভর্তির সময় এই জায়গা কখনও খালি থাকে না। রমজানের আগেই ভরে যায়। ভর্তির আগ পর্যন্ত এভাবে জমজমাট থাকে।

নওদারার সাথে লাগোয়া বিল্ডিংটাই দেওবন্দের বিখ্যাত লাল বিল্ডিং। নওদারা পার হয়ে এপারে এসে পেছনে ঘুরে তাকালেই নজরে পড়বে লাল বিল্ডিংয়ের সৌন্দর্য। এরপর মাঠ। লাল বিল্ডিংয়ের ঠিক বরাবর পশ্চিমে মাঠের অপর পাশেই বাবুয যাহের। এটি মূলত গেইট। ভেতরে কয়েকটি কামরা আছে। উলুমুল হাদীসের দরস হয় এখানে। কয়েকটা কামরায় ছাত্ররাও থাকে। সাধারণত বাংলাদেশী ছেলেরাই থাকে এখানে। ভেতরে আপাত দৃষ্টিতে শ্রীহীন এবং ছাড়পোকার আখড়া বলেই হয়ত ইন্ডিয়ানদের নজর আকর্ষণ করতে পারেনি। তবে পরিচিতি এক বাংলাদেশী ভাই বলেছেন, এর ভেতরটা কেমন আপন আপন লাগে। দ্বারে জাদীদের আধুনিক কামরাগুলোতে সেই আপনত্বের অনুভূতি আসবে না। আমরা প্রথমে গিয়ে এখানেই উঠলাম।

আমাদের নুরু ভাই!

আমাদের মেজবান ছিলেন নুরুল করিম ভাই। দেওবন্দ আমাদের দেশের ছাত্রদের কতটা বদলে দেয় তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলেন নুরুল করিম ভাই। নুরু ভাইকে মালিবাগে বেশ কয়েক বছর দেখেছি। কখনও হয়ত সিড়িতে সালাম বিনিময় হয়েছে। ব্যাস, এতটুকুই। সত্যি বলতে, তাকে দেখে সালাম দিতেও ভয় লাগতো। কোনোদিন তাকে বিশেষ হাসতে দেখেছি বলেও মনে পড়ে না। তিনি বক্তৃতা গ্রুপের যে ফরিকের আমির ছিলেন সেই ফরিকের ষান্মাসিক প্রতিযোগিতার দিন গিয়েছিলাম অতিথিদের বক্তব্য শুনতে। মালিবাগের সাবেক সব তারকা বক্তারা উপস্থিত ছিলেন। নুরু ভাই সেদিন অনেক মজার মজার কথা বলেছিলেন। যদিও তার মুখের দিকে তাকিয়ে আমাদের হাসা উচিত কি না বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আর এই মানুষটি এভাবে মজা করে কথা বলতে পারে সেটাও আমাদের বিশ্বাস করতে যথেষ্ট কষ্ট হচ্ছিলো।

কিন্তু দেওবন্দে আমরা যে নুরু ভাইকে দেখেছি তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মানুষ। সদা হাসিখুশি, সদা তৎপর। নতুন আসা ছাত্রদের জন্য এক মহান ত্রাতা! কামরা ঠিক করে দেয়া, প্রয়োজনিয় জিনিসপত্র কিনে দেয়া বা ব্যবস্থা করে দেয়া, নানাভাবে অভয় দিয়ে রাখা এবং সাহস যোগানো, কী করেননি তিনি আমাদের জন্য! দেওবন্দের এই প্রচণ্ড গরমে যে কোনো সময় যে কোনো প্রয়োজনে ছুটে আসতেন। কখনও সামান্যতম বিরক্তিবোধও নেই। আমাদের নিয়ে বার বার বাজারে গিয়েছেন। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে দিয়েছেন। কোনো জিনিসে সমস্যা হলে, ফেরত দেয়ার প্রয়োজন হলে আবার গিয়েছেন। আবার বড় ভাইয়ের মত আগলে রেখেছেন সারাক্ষণ।

তিনি যে শুধু মালিবাগের ছাত্রদের জন্যই করতেন তা নয়। ন্যূনতম পরিচয়ের সূত্রে যে বা যারাই তার কাছে এসেছে, তিনি তার জন্য সর্বাত্মক করেছেন। এই সহযোগিতার মনোভাব অবশ্য পরে আরও অনেকের মাঝেই দেখেছি। দেওবন্দ সবাইকে কেমন বদলে দেয়। আমি অন্যদের নুরুল করিম ভাইয়ের সাথে তুলনা করতে চাই না। তার তুলনা কেবল তিনিই। তবে দেওবন্দের এই বিশেষ প্রভাব সবাইকে কিছু না কিছু প্রভাবিত করেই। যে শাইখুল হিন্দ তার সঙ্গে সাক্ষাত করতে আসা অচেনা মেহমানকে নিজ হাতে বাতাস করেন, তার পা দাবিয়ে দেন তার রেখে যাওয়া বাগানের রুহানী ভ্রমরদের মাঝে এর কিছু প্রভাব পড়বে—এটা তো খুবই স্বাভাবিক।

ঘুরে দেখা দারুল উলুম দেওবন্দ

বিকেলে দেখা হলো মুনশি উবাইদুল্লাহর সাথে। সন্ধার পর তার সাথে বের হয়ে গেলাম দেওবন্দ দেখতে। প্রথমে সিম কিনে বাড়িতে জানালাম, নিরাপদে পৌঁছতে পেরেছি। এরপর গেলাম মাকবারায়ে কাসেমীতে। যেখানে গেলে মনের অজান্তেই ভেতরে অন্যরকম এক অনুভূতি খেলে যায়—কত ইলম এখানে মাটির নিচে দাফন হয়ে আছে!

হুজ্জাতুল ইসলাম কাসেম নানুতুবী রহ. এর কবরের অদূরে বামদিকে তার সুযোগ্য নাতি কারী তৈয়ব রহ. এর কবর। পূবদিকে শাইখুল হিন্দ রহ.। তার পাশে তারই প্রিয় ছাত্র শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানী রহ.। এছাড়া মাকবারার আরও বিভিন্ন প্রান্তে শুয়ে আছেন আল্লামা ইবরাহিম বালিয়াভী রহ., মুফতি আজীজুর রহমান রহ.সহ আরও কত জানা-অজানা মনীষী! একটু সামনে এগিয়ে গেলে আলাদা করে রাখা আছে হাজী আবেদ হুসাইন রহ. এর কবর। যিনি দারুল উলুম দেওবন্দের জন্য প্রথম চাঁদা প্রদান করেন এবং প্রথম চাঁদা সংগ্রহের জন্য মহল্লার ঘরে ঘরে ছুটে যান। তিনি ছিলেন দারুল উলুমের প্রথম মুহতামিম এবং তিন মেয়াদের মুহতামিম। প্রতিষ্ঠাতা অর্থে তাকেই দারুল উলুম দেওবন্দের ‘বানী’ বলা যায়। তিনিই প্রথম এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেন এবং কাসেম নানুতুবী রহ.কে চিঠি দিয়ে দেওবন্দে আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে বলেন, আমি মাদরাসা শুরু করে দিয়েছি। আপনি চলে আসুন। নানুতুবি রহ. তখন মিরাঠে এক মাকতাবার সাথে চুক্তিবদ্ধ ছিলেন। তাই নিজে আসতে না পেরে মোল্লা মাহমুদকে পাঠিয়ে দেন শিক্ষক হিসেবে।

আবেদ হুসাইন রহ. এর কবরের পাশেই রাস্তা। মুনশি জানালো, এটি সেই ঐতিহাসিক গ্র্যান্ড ট্যাংক রোড। কবরের পাশে হাজী সাহেবের স্মৃতিস্বরূপ একটি মসজিদ বানিয়ে রাখা হয়েছে। শুনেছি এই মসজিদটি কুল হুয়াল্লাহ মসজিদ নামে পরিচিত। কারণ এখানে ইমাম সাহেব কুল হুয়াল্লাহ এর গতিতে নামাজ পড়ান।

মাকবারা যেয়ারত শেষে আমরা ভেতরের রাস্তা দিয়ে ফিরে আসলাম। এদিকে পরপর তিনটি বিল্ডিং। দুটি বিশাল আকৃতির, আর একটা সেই তুলনায় একটু ছোট। বিশাল বিল্ডিং দুটির একটির নাম হলো শাইখুল ইসলাম মঞ্জিল। যা আসামি মঞ্জিল নামে পরিচিত। অপরটির নাম হলো শাইখুল হিন্দ মঞ্জিল। এটি পরিচিত আজমী মঞ্জিল নামে। এই দুই মঞ্জিলের মাঝামাঝি পুরনো আকৃতির দুতলা আরও একটি মঞ্জিল আছে। যা আফ্রিকি মঞ্জিল নামে পরিচিত।

এদিকটা শেষ করে গেলাম মাযারে আনওয়ারিতে। এখানে শুয়ে আছে ইমামুল আসর আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী রহ. এবং তার পরিবারবর্গ। কাশ্মীরী রহ. সন্তান, ছেলেমেয়ে, স্ত্রী সবাই শুয়ে আছেন এখানে। সেই রাতে মাযারে আনওয়ারিতে ঢুকতে পেরেছিলাম কি না এখন মনে পড়ছে না। সম্ভবত শুধু সামনে দিয়ে ঘুরে চলে এসেছি। পরে এক সময় ভেতরে যাওয়া হয়। এরপর তো আমার দুঃসময়ের এক বিকেলের সাক্ষীই হয়ে আছে এই মাযারে আনওয়ারি।

মাযারে আনওয়ারি থেকে আরেকটু সামনে গেলে দারুল উলুম ওয়াকফ। সেই রাতের মতো আর ওদিকে যাইনি। ফিরে আসি দারুল উলুমে।

পরিচয় সঙ্কট!

রাস্তার পাশে মাটিতে চাটাই বিছিয়ে কিতাব বিক্রি হচ্ছিলো। কিতাবের দাম শুনে আমার মাথা খারাপ হওয়ার মতো অবস্থা। এত কম দাম! ইচ্ছে করছে সবই কিনে ফেলি। মুনশি আমাকে নিবৃত্ত করলো। বললো, যা কেনার দাখেলার পর। এখন আপাতত নিজেকে দমন করেন। কিন্তু নিজেকে দমন করা কি এত সোজা? আমি বারবার উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ছি। আরে এটা তো বাংলাদেশে.. ।

মুনশি ঈষৎ ধমক দিয়ে আমাকে চুপ করিয়ে দেয়। কড়াভাবে সতর্ক করে দেয়, ভুলেও যাতে দেশের নাম মুখে না নিই। আর বাংলায় এত বেশি উচ্ছ্বাস প্রকাশেরও প্রয়োজন নেই। বিপদ হতে পারে।

দেওবন্দের জীবনে এই এক সমস্যা। কোথাও দেশের নাম উচ্চারণ করতে পারি না। রাহমানিয়ার ছাত্ররা বলতো সোনাপুর। সম্ভবত আসামের একটি জায়গা আছে সোনাপুর নামে। তারা এই নামটিই স্বদেশের জন্য ব্যবহার করতো। তবে মালিবাগের ছেলেরা সোনাপুর বলতো না। তারা বলতো, বি ডি। আমার বেশ কিছুদিন সময় লেগেছে এই কোড ওয়ার্ড আত্মস্ত করতে। বার বার মুখ দিয়ে বাংলাদেশ বের হয়ে যেত আর পুরাতনদের ধমক খেতাম। তখন একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করলাম। যখনই কেউ জিজ্ঞেস করে, ‘আপ কাহাঁ কে হে?’ জবাবে ‘বাংলাদেশ’ বলতে না পারায় এক অজানা কষ্টে ভেতরটা খান খান হয়ে যেত। এটি আমার জন্য সম্পূর্ণ নতুন এক অভিজ্ঞতা। বিদেশের মাটিতে গেলে দেশের জন্য এত আবেগ কোত্থেকে আসে কে জানে?

শুরু হলো নতুন জীবন

পরদিন নুরু ভাই আমাদের জন্য সাত্তা মসজিদের পাশে একটি কামরা ভাড়া করে দেন। এই কামরায় বিগত কয়েক বছর ধরে এখানে মালিবাগের ছাত্ররাই থাকছে।

নুরু ভাই আমাদের সাথে গিয়ে প্রয়োজনীয় সামানা কিনে দিলেন। শুরু হলো আমাদের নতুন জীবন। রোজার পর পরীক্ষা। প্রস্তুতি নিতে হবে। প্রচণ্ড গরমে ঘরে অবস্থান করাই দায়। পড়া তো অনেক দূরের ব্যাপার। মাঝে মাঝে মসজিদে কদীম আর মসজিদে রশিদে যাই পড়তে। কিতাবপত্র নিয়ে অনেক আয়োজন করে যাই। কিন্তু কিছুক্ষণ তামাশা দেখে ফিরে আসি। পড়া আর হয় না।

মেশকাত ছাড়া বাকি সব কিতাবই কিনে ফেলেছি। হেদায়া আখেরাইন, শরহে আকাঈদ, শরহে নুখবা আর সিরাজি। পরীক্ষার পর অবশ্য হেদায়া ফেরত দিয়ে এর পরিবর্তে সমমূল্যের অন্য কিতাব নিয়ে এসেছি। এজন্য কিছুটা মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়। যতদূর মনে পড়ছে, তারীখে দারুল উলুম এই টাকায়ই কিনেছিলাম। সাথে আরও কিছু টাকা যুক্ত করে সাওয়ানেহে কাসেমী।

আমি সারা জীবন পরীক্ষাবিমুখ ছেলে। পরীক্ষা উপলক্ষে পড়া আমার ধাতে নেই। ইসমাঈল ভাই বার বার তাগাদা দেন, এবারের পরীক্ষাটা একটু সিরিয়াসলি দাও! আর দশটা পরীক্ষা আর এই পরীক্ষা তো সমান নয়!

আমি এসব কথায় খুব বেশি কান দিইনি। যার ফল পরে ভুগতে হয়েছে।

আসলে পরীক্ষার চেয়েও আকর্ষণীয় আরও কত ইস্যু আমার সামনে। একটা নতুন বই পেলাম। নাম, বানীয়ে দারুল উলুম আওর তারীখী হাক্বায়েক্ব। লেখক শাইখুল হিন্দ একাডেমীর সাবেক মুহাক্কিক। তিনি এই বইয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন, বানীয়ে দেওবন্দ কাসেম নানুতুবী রহ. নয়, বরং হাজী আবেদ হুসাইন রহ.। তিনি বইটিতে হাজী সাহেবের প্রতি অতিরিক্ত মহব্বত প্রকাশ করতে গিয়ে নানুতুবী রহ. এর পরবর্তী বংশধর, মাদানী পরিবার কাউকেই ছাড়েননি। তবু আমি একটি কারণে লেখকের প্রতি কৃতজ্ঞ। তিনি বইটিতে সংক্ষেপে হলেও হাজী আবেদ হুসাইন রহ. এর জীবনী নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ যুক্ত করেছেন। এটি হাজী সাহেব সম্পর্কে জানতে আমার অনেক কাজে দিয়েছে। দেওবন্দের প্রথম মুহতামিম এবং দেওবন্দের জন্য উৎসর্গীতপ্রাণ এই মানুষটির জীবনী নিয়ে স্বতন্ত্র কাজ প্রায় নেই বললেই চলে। “তাযকিরাতুল আবেদীন” নামে একটি জীবনীগ্রন্থ হযরতের একজন খাদেম লিখেছিলেন। বইটি এখন দুষ্প্রাপ্য। এই বইটিতে লেখক তারই সারাংশ উল্লেখ করেছেন।

ফরম সংগ্রহ এবং পরীক্ষার প্রস্তুতি

ঈদের একদিন আগে ভর্তি পরীক্ষার ফরম বিতরণ শুরু হয়। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিতে ভিজে দৌড়ে যাই নওদারার দ্বিতীয় তলায়। দীর্ঘ সিরিয়াল আর দমবন্ধ করা ভীর এবং ধাক্কাধাক্কি ঠেলে অবশেষে ফরম হাতে পাই। ফরম পূরণ করে নির্ধারিত অংশ কেটে রেখে ছবি যুক্ত করে বাকিটা জমা দিয়ে আসি। আমার সিরিয়াল নম্বর ১২৪৬। দাখেলা হওয়া পর্যন্ত এটাই আমার নম্বর।

আনুষ্ঠানিকতা সব শেষ। এখন পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে হবে। এতদিন নিজেকে বুঝিয়েছি, ঈদের পর থেকে পড়া শুরু করবো। এর মাঝে ঈদও চলে এলো। একে তো বিদেশের মাটি, তার উপর সামনে ভর্তি পরীক্ষা—ঈদ কেমন হবে সেটা বলাই বাহুল্য। দেওবন্দের ঈদগাহ মাঠে ঈদের নামাজ পড়ে নিজেদের তৈরি মিষ্টান্ন দিয়ে ঈদ উদযাপন করা করলাম। দিন পার করে যখন সন্ধায় উপনিত হই তখন হঠাৎ উপলব্ধি করি, নতুন জায়গার উত্তেজনা, উৎসবমুখর পরিবেশ, এডভ্যাঞ্চার সবই হঠাৎ করে শেষ হয়ে গেছে। এখন সামনে একটাই বাস্তবতা! নির্মম বাস্তাবতা—ভর্তি পরীক্ষা!

প্রতিদিন সকালে কিতাবপত্র নিয়ে মসজিদে ক্বদীমের দুতলায় চলে যাই। যতটা পড়ি তারচেয়ে বেশি অন্যদের পড়া দেখি। কত ভাষার, কত জাতের ছেলেরা বসে আছে এখানে। মসজিদের উপর-নিচ সব ভর্তি। ইন্ডিয়ান মাদরাসাগুলোর নিয়ম হচ্ছে, দেওবন্দে যতদিন ভর্তি পরীক্ষা চলে ততদিন অন্য কোনো মাদরাসা খুলে না। সারা ইন্ডিয়া থেকে দলে দলে ছাত্ররা দেওবন্দে আসে ভাগ্য পরীক্ষা করাতে। দেওবন্দের বিশাল আকৃতির ছাত্রাবাসগুলোতেও ছাত্র সংকুলান হয় না। আশাপাশের সব মেসবাড়ি ভরাট হয়ে যায়। ভর্তি পরীক্ষার পর এক/দুই দিনে পুরো দেওবন্দ খালি। এরপর নামের তালিকা আসলে কৃতকার্যরা ফেরত আসে। অন্যরা আগের মাদরাসায় ফিরে যায়।

এদিকে পড়াশোনার পাশাপাশি আধ্যাত্মিক প্রস্তুতিও চলছে সমান গতিতে। শেষ রাতে মসজিদে ক্বদিমে কান্নাকাটি হচ্ছে, সকাল-বিকাল মাকবারায়ে কাসেমীতে হাজিরা চলছে, আর নওদারা তো রমজানের আগে থেকেই ভরে আছে। এদিকে লাল বিল্ডিং সংলগ্ন বিল্ডিংয়ে একজন সন্ধার পর সিরাজি শিখায়। সেখানেও উপচে পড়া ভীর। দিনরাত পড়াশোনা আর আমল-তদবিরে সর্বত্র এক নূরানী পরিবেশ।

দেওবন্দের মাকতাবাগুলোতে এবতেদায়ী থেকে দাওরা পর্যন্ত সব কিতাবের আলাদা গাইড পাওয়া যায়। সেগুলো বেচাবিক্রি হচ্ছে প্রচুর পরিমাণে। আমি নিজেও শরহে আকাঈদ আর মেশকতের গাইড কিনেছিলাম। শরহে আকাঈদের গাইড পড়ার সুযোগই হয়নি। ভেবেছিলাম পরীক্ষার আগের রাতে পড়বো। আপাতত মূল কিতাব একটু দেখে নেয়া যাক। এরই মাঝে এক ইন্ডিয়ান ভাই এসে পড়ার জন্য নিয়ে গেলেন। পরীক্ষার আগের সন্ধায় সেই ভাই এবং গাইড দুটোই গায়েব!

মেশকাত গাইড কিছুটা পড়া হয়েছিলো। কিন্তু যা পড়েছি তার কিছুই পরীক্ষায় কাজে লাগেনি। মেশকাত পরীক্ষার প্রশ্ন অনেক কঠিন হয়েছিলো। এছাড়া বাকিগুলো বলতে গেলে পান্তাভাত।

ভর্তি পরীক্ষা

পরীক্ষা ছিলো তিনদিন। প্রতি পরীক্ষার মাঝে একদিন করে বিরতি। হেদায়া-সিরাজি এক দিন, শরহে নুখবা আর শরহে আকাঈদ এক দিন। শেষদিন মেশকাত দুই খণ্ড একত্রে। মেশকাত ছাড়া বাকি প্রশ্নগুলো অনেক সহজ হয়েছে। হেদায়াতে ইখতেলাফ এবং দলিল সবই প্রশ্নে উল্লেখ থাকে। শুধু বুঝিয়ে দিতে বলা হয়।

বিষয়বস্তুর চেয়ে আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছিলো ভাষা। উর্দুতে উত্তর দেয়ার কথা আমরা কল্পনাও করতাম না। আরবিতে যথাসাধ্য দেয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু অনুবাদ তো উর্দুতেই করতে হবে। অবশ্য এক/দুইজন এই কাজও আরবিতেই সেরেছে। আসলে আরবিটা আমাদের জন্য উর্দু থেকে তুলনামূলক নিরাপদ। কারণ উর্দু তাদের মাতৃভাষা। কিন্তু আরবি আমাদের এবং তাদের কারওই মাতৃভাষা নয়। এতটুকুই ছিলো সান্ত্বনা।

আমাদের ভর্তি পরীক্ষা হয় নতুন দারুল ইমতিহানে। বাবুয যাহেরের অদূরে পশ্চিমে ভারতের পার্লামেন্টের আদলে যে বিল্ডিংটা তৈরি হচ্ছে এরই আন্ডারগ্রাউন্ডে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। আমাদের মাধ্যমেই উদ্ভোধন হয় বিল্ডিংটির। কথা ছিলো দরসও এখানেই শুরু হবে। কিন্তু আমাদের বছর আর তা হয়নি। সম্ভবত আমাদের পরের বছর থেকে সেখানে দরস শুরু হয়েছে।

রেজাল্টের অপেক্ষা এবং পরীক্ষা পরবর্তী দিনগুলো

ভর্তি পরীক্ষার পর হাতে প্রায় এক সপ্তাহের মতো সময়। এই সময়ে সবাই মাওয়াজেয়ে খমসা বা পাঁচটি জায়গায় ঘুরতে যায়। নানুতা, থানাভবন, গঙ্গুহ, সাহারানপুর এবং জালালাবাদ। আমাদের সঙ্গীরা সাহারানপুরের পরিবর্তে অন্য একটি জায়গা বাছাই করে- ঝাঞ্জানা! হাজি ইমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কি রহ. এর শায়েখ নূর মুহাম্মদ ঝাঞ্জানবী রহ. এর স্মৃতি বিজড়িত এলাকা। সাহারানপুরকে বাদ দেয়ার কারণ হচ্ছে, এটি হাতের কাছেই আছে। যে কোনো সময় যাওয়া যাবে। তাছাড়া কারণে-অকারণে বিভিন্ন সময়ই সাহারানপুরে যাওয়া হবে। সুতরাং এখন না গেলেও ক্ষতি নেই। কিন্তু অন্যদের ক্ষতি না হলেও আমার হয়েছে। দেওবন্দের পুরো এক বছর আমার সাহারানপুরে আর যাওয়া হয়নি। কয়েকবার প্রোগ্রাম করেও শেষ পর্যন্ত অলসতার কাছে হার মেনেছি।

মাওয়াজেয়ে খমসার গল্প আমি বিস্তারিত বলতে চাচ্ছি না। এই লেখাটি দেওবন্দেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাই।

মাওয়াজেয়ে খসমা ঘুরতে লেগেছে মাত্র একদিন। বাকি দিনগুলো কি করবো? কেউ বললো, তাবলীগে চলে যাই। কেউ প্রস্তাব দিলো, ফুলাতে কালীম সিদ্দিকী সাহেবের খানকায় চলে গেলে কেমন হয়? এই সময়টা যত বেশি রুজু ইলাল্লাহ থাকা যায় ততই ভালো। মসজিদ বা হযরতের খানকাই হবে এর জন্য উত্তম জায়গা। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলো, ফুলাত যাবো। এরই মাঝে সংবাদ চলে এলো, কাল-পরশু রেজাল্ট দিয়ে দিবে। ফলে আমরা সফর মুলতবি করে দিলাম। সংবাদটা অবশ্য ভুল ছিলো। ফলাফল প্রকাশ পেতে আরও বেশ কিছুদিন সময় লেগেছে। সেই দিনগুলো যে কিভাবে কেটেছে! প্রতিদিনই মনে হতো, আর রেজাল্ট দিয়ে দিবে। আজ রাত বারোটার পর রেজাল্ট দিবে! রাত জেগে নওদারায় বসে থাকি। রাত এগারোটার পর বাবে কাসেম বন্ধ হয়ে যায়। এরপর কামরায় ফিরতে হলে শাইখুল হিন্দ গেইট দিয়ে বের হয়ে বাজার ঘুরে আসতে হবে। তবু অপেক্ষা করি। অপেক্ষা করতে ভালো লাগে।

ফলপ্রকাশ

এরপর একদিন রেজাল্ট বের হলো। গভীর রাতে নয়, ইশার কিছুক্ষণ আগে। সেই রেজাল্ট আমার মাথায় বজ্রের মতো পতিত হলো। তালিকায় আমার নাম আসেনি!

জীবনে এত বড় ধাক্কা এর আগে কখনও খেয়েছি বলে মনে পড়ে না। বাড়িতে সংবাদ পৌঁছতে সময় লাগেনি। আমি দেওবন্দে বসে কাঁদি, আর আমার মা-বোনেরা দেশে জায়নামাজে বসে কেঁদে বুক ভাসায়। আমার মা-বোনদের সেই বুকফাটা কান্নার কারণেই হয়ত আল্লাহ অবশেষে রহমতের দৃষ্টি দেন। দারুল উলুম দ্বিতীয়বারের মত নাম প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেয়। যারা ভর্তির নম্বর পেয়েও তাকাবুলে বাদ পড়ে যায় তাদের গাইরে ইমদাদী ছাত্র হিশেবে নিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

এবার নাম আসে আমার। আমাদের পারিবারিক পত্রিকা “পুষ্পিতা”য় এ নিয়ে বিস্তারিত আকারে লিখেছিলাম। এখানে লেখাটি হুবহু তুলে দিচ্ছি।

রুল নাম্বর ১২৪৬

১২৪৬ এর কিছু আগে এসে তালিকাটা শেষ হয়ে গেছে। এরপরের সংখ্যাটা আরও বড়। মাঝখানে ১২৪৬ ও এর আশেপাশের কয়েকটা সংখ্যা নেই। নেই তো নেই-ই। আমার বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেলো। দুরু দুরু বুকে আরেকটু খোঁজার চেষ্টা করলাম। প্রচণ্ড ভীড়। প্রচুর ধাক্কাধাক্কি হচ্ছে। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ছে। এরমধ্যেই ইতিউতি একটু খোঁজার চেষ্টা করলাম। নাহ, নেই।

বেরিয়ে আসলাম। কি করবো ভেবে পাচ্ছি না। শুনেছি নাম না আসলে কেউ কেউ তালিমাতের উপর থেকে লাফ দিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে। এরকম কিছু একটা করে ফেলার চিন্তাও মাথায় আসলো। আশেপাশে তাকালাম। কেউ দেখে ফেলার আগেই সটকে পড়তে হবে। এই চেহারা কাউকে দেখানোর উপযুক্ত না। চুপিসারে সরে পড়া সম্ভব হলো না। সিঁড়ির গোড়ায় আজম ভাই দাঁড়িয়ে আছেন। চোখে পানি। ওরও বোধয় আমার দশা হয়েছে।

কাছে যেতেই জড়িয়ে ধরলেন। ‘ভাই,আমার নাম এসেছে!’

সে কি ভুল বলছে? নাকি আমি কি ভুল শুনছি?

নিশ্চিত হওয়ার জন্য আবার জিজ্ঞেস করলাম, আপনার নাম আসে নাই?

‘এসেছে ভাই, এসেছে।’

কান্নার গমক আরও বাড়লো। মনে মনে বললাম, ব্যাটা তোর নাম এসেছে! তোর তো এখন খুশিতে নাচা দরকার। কাঁদতেছস কেন?

চলন্ত কোনো ট্রাকের নিচে যদি ঝাঁপ দিই, খুব কি বেশি কষ্ট হবে? মরতে ঠিক কতোটা সময় লাগবে? যদি না মরি? হাত-পা ভেঙে পঙ্গু হয়ে যাই? কোনো জিনের বাদশা যদি এখন আমাকে এসে উঠিয়ে নিয়ে যায়? কেউ কোনো দিন জানতেও পারবে না আমি কোথায় হারিয়ে গেছি! ঈদগাহ মাঠের মাঝখানে বসে আছি অনেকক্ষণ ধরে। মাথায় উল্টাপাল্টা চিন্তা আসছে। একটু পরপর কয়েকজন করে ছাত্র আসা-যাওয়া করছে মাঠের মাঝখান দিয়ে। মাঝে মাঝে দুই-একটা কুত্তাও আসছে ঘেউ ঘেউ করতে করতে। আমি বসে আছি। কতক্ষণ বসে থাকবো বুঝে উঠতে পারছি না। ফিরে যাবো কোথায়? এই চেহারা নিয়ে কিভাবে দাঁড়াবো সবার সামনে?

দারুল উলুম দেওবন্দে পড়ার স্বপ্ন দেখছি শৈশব থেকে। হেফজখানায় থাকতে রফিউদ্দীন সাহেবের দুধের স্বপ্নের কথা শুনে কেঁদে কেঁদে দোয়া করেছিলাম, আল্লাহ যেন আমাকেও সেই সৌভাগ্যবানদের কাতারে শামিল করে নেন। এরপর মালিবাগে এসে সেই স্বপ্ন আরও পরিপুষ্ট হয়েছে। ডালপালা ছড়িয়ে প্রকাণ্ড মহিরুহে পরিণত হয়েছে। অবশেষে আল্লাহ দেওবন্দে এনেছেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। আজকে ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে। ভর্তিযোগ্য ছাত্রদের নামের তালিকা টানিয়ে দেয়া হয়েছে। সেই তালিকায় আমার নাম নেই।

ঘণ্টার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ঢং ঢং করে বারোবার বাজলো। অর্থাৎ, রাত বারোটা বেজে গেছে। আচ্ছা, সাথীভাইরা কি আমাকে খুঁজছে? খুঁজলে কোথায় খুঁজতে পারে। মাকবারায়? এখানে আসার সম্ভাবনা কি আছে? সাথে মোবাইল আনিনি। কেউ চাইলেও যোগাযোগ করতে পারবে না।রাত বাড়ছে। চারপাশ ক্রমশ শূন্য হয়ে আসছে। আরও কিছুক্ষণ বসে থেকে শেষতক মনে হলো, এবার ফিরে যাওয়া দরকার। যতো কষ্টই হোক, সারারাত এখানে বসে থাকার মতো সাহসী এখনও হয়ে উঠিনি।

ফিরে এসে আরও একবার তালিকাটা দেখলাম। যদি কাকতালীয় কিছু ঘটে! কিছুই ঘটলো না। তালিমাত থেকে নামতে যাবো, তখনই দেখি আমাদের কয়েকজন সাথী চিন্তিত মুখে হাঁটাহাঁটি করছে। বুঝতে কষ্ট হলো না, আমাকে খুঁজছে। পিলারের আড়ালে লুকিয়ে পড়লাম। এই মুখ নিয়ে নিয়ে কারও সামনে দাঁড়ানোর হিম্মত নেই। ওরা একটু সরে গেলে দ্রুত নেমে আসলাম। কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা চলে গেলাম কামরায়। মোবাইল নিয়ে দেখি বিভিন্ন নম্বর থেকে প্রায় তিরিশটি মিসড কল। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে দ্রুত ফেইসবুক অন করলাম। আইডি লগ আউট করলাম। এরপর মোবাইল বন্ধ করে ফেললাম।

আবু তাহের ভাই মালিবাগে আমাদের আমির ছিলেন। এখনও আমরা তাকে আমিরের মতোই মানি। খুবই দায়িত্বশীল একজন মানুষ। তিনি ছুটে আসলেন। ‘হুজুর (মুফতি হাফিজুদ্দীন সাহেব) আপনাকে ফোন করতে বলেছেন। একবার শুধু ফোন করে জানান আপনি এসেছেন। সবাই অনেক টেনশন করছে।’দুই/একজন এসে তাকদিরের কথা বলে সান্ত্বনা দেয়ারও চেষ্টা করলো। আমি কিছু না বলে মূর্তির মতো বসে রইলাম। আমার সামনে তখন একটাই বাস্তবতা; ‘দারুল উলুম আমাকে কবুল করেনি।’

আবু তাহের ভাই হুজুরকে ফোন দিয়ে মোবাইল আমার কানে দিলেন। ওপাশ থেকে হুজুরের সালাম শোনা গেলো। আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। হাউমাউ করে কেঁদে ফেললাম। এতক্ষণ পর্যন্ত এক ফোটাও কাঁদিনি। সাক্ষাত মূর্তি বনে গিয়েছিলাম। কিন্তু হুজুরের কণ্ঠ শুনে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। হুজুর বিভিন্নভাবে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু আমি তখন সব সান্ত্বনার উর্ধ্বে অবস্থান করছি।

গুঁজু হয়ে বসে কাঁদছি। আব্বা এসে পাশে দাঁড়ালেন। কে কাঁদছে এখানে বসে? আমি মাথা আরও গুঁজে ফেললাম। যাতে চিনতে না পারেন। ঘুম ভাঙলো কাঁদতে কাঁদতে।

সেই দুঃসময়ের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ঈদগাহ মাঠ, মুলসারি চত্বরের বকুল গাছের গুড়ি আর মাযারে আনওয়ারির বেঞ্চ  আমার সেই দুঃসহ সময়ের সাক্ষী। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতাম এসব জায়গায় নিশ্চল হয়ে।

দুপুর থেকে একটা গুজব শোনা যাচ্ছে। সময় যত গড়াচ্ছে গুজবটা ততো শক্তিশালী হয়ে উঠছে। এতক্ষণে প্রায় তাওয়াতুরের পর্যায়ে চলে গেছে। গুজবের ভাষ্য হলো, নতুন করে আরও কিছু নাম প্রকাশ করা হবে। যারা ভর্তির নম্বর পেয়েও তাকাবুলে বাদ পড়ে গেছে তাদের ভর্তি করিয়ে নেয়া হবে। কিছুক্ষণ আগে এক ভাই এসে জানালেন, তিনি সরাসরি মাদরাসি সাহেবের মুখে শুনে এসেছেন।

আমি নিস্পৃহ মুখে সব শুনে যাচ্ছি। এই কয়দিনে জীবন কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। কলরবের নতুন কিছু গান ডাউনলোড করেছি। কানে ইয়ারফোন গুঁজে সেগুলিই শুনছি। হঠাৎ মনে হলো, ব্যাপারটা তো সত্যও হতে পারে। যদি সত্য হয়ে যায় তাহলে এই তালিকায় আমার নামও আসতে হবে। আল্লাহর কাছ থেকে চেয়ে নিতে হবে। ইয়ারফোন ফেলে ওজু করে আসলাম। দোয়া পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে গেলাম। ঘুম ভাঙলো শেষ রাতে। নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে খুব কাঁদলাম। এইসব অবস্থায় পাষাণ মনেও কান্নার জোয়ার আসে। আল্লাহ তওফিক দেন।

ফজর পড়ে হানিফ ভাইয়ের সাথে মাকবারা যিয়ারত করে আসলাম। সুরা ইয়াসিন পড়ে আবার কানে ইয়ারফোন গুঁজলাম। সেখানে বাজছে বদরুজ্জামান আর এক পিচ্চির যৌথ কণ্ঠ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ..

তখনই সংবাদটা আসলো। নতুন নামের তালিকা টানানো হয়েছে!

সিঁড়ির বিশটা ধাপ। মনে হলো যেন বিশ শ! কোনোমতে ধাপগুলো পার হওয়া গেলো। আশঙ্কা হচ্ছিলো, উত্তেজনায় না আবার পা পিছলে পড়ে যাই। ভীড়ের ফাক দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে দিলাম। ১২৪৬ আজীজুর রহমান, অরুনাচল প্রদেশ!

আবার দেখলাম। আবার। চোখ ভিজে এলো। বুক-হাত কাঁপতে লাগলো থর থর করে। কোনোমতে বেরিয়ে এলাম। আশেপাশে তাকালাম কাউকে দেখা যায় কি না। পরিচিত কাউকে পেলাম না। একজন ছিলেন। ফয়সাল ভাই। আমি তাকে দেখিনি। তবে তিনি আমাকে দেখেছেন। আমার কান্না দেখে ভেবেছেন এবারও বুঝি আমার নাম আসেনি। তাই আর কাছে আসার সাহস করেননি।

আমার অবস্থা তখন বর্ণনাতীত। সারা শরীর কাঁপছে থরথর করে। হাউমাউ কান্না বুক ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। ইচ্ছে করছিলো  সমগ্র বিশ্বকে চিৎকার করে বলি, আমি দারুল উলুমে দাখেলা পেয়ে গেছি!

এক ঝটকায় বুঝে গেলাম আজম ভাইয়ের সেদিনের কান্নার মহাত্ম। কোনোমতে কামরায় আসতে পারলাম। ইসমাঈল ভাই জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম এসেছে?

আমি কাঁপতে কাঁপতে বললাম, এসেছে, এসেছে!

দৃশ্যটা দেখার মতো ছিলো। কপাল ভালো মাহফুজ ভাই তখন ছিলেন না। না হলে কপালে দুঃখ ছিলো। সারা জীবন এর জন্য আমাকে ক্ষেপিয়ে মারতেন।

ওজু করে দৌড়ে চলে গেলাম সাত্তা মসজিদে। চোখের পানিতে আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করলাম!

(পুষ্পিতা থেকে ঈষৎ পরিবর্তিত)

আমাদের দাখেলা ছিলো গাইরে ইমদাদী। অর্থাৎ, আমরা দরস করতে পারবো, কুতুবখানা থেকে কিতাব পাবো, মাদরাসার পরিচয়পত্র পাবো, পরীক্ষায় অংশগ্রহণও করতে পারবো। তবে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা নিজের করে নিতে হবে। এই সিদ্ধান্তের অল্প কিছুদিন পরই মজলিসে শূরার মিটিং হয়। সেখানে গাইরে ইমদাদী ছাত্রদের প্রসঙ্গ উঠে। শূরা সদস্যগণ বলেন, দাওরায় তো দিনব্যাপী দরস হবে। তাহলে ছাত্ররা নিজেদের থাকা-খাওয়ার ইন্তেজাম করবে কখন? তাদের জন্য থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও করা হোক।

এরপর দ্রুততম সময়ে মাতবাখে আরও কিছু নতুন চুলা বানানো হলো। নতুন বাবুর্চি নিয়োগ দেয়া হলো। আফ্রিকি মঞ্জিলের পেছনে নতুন মাতবাখের নির্মান কাজ চলছিলো। সেখানে দ্রুত বেশ কিছু কামরা তৈরি করা হয়। এছাড়া অন্যান্য কামরাগুলোতেও ইযাফী সিট হিসেবে আরও একজন করে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। সব মিলিয়ে ইমদাদী ছাত্রদের সাথে আমাদের আর খুব বেশি পার্থক্য রইলো না। লাভের মধ্যে যা হলো তা হচ্ছে, আমাদের ‘মন জয়ের জন্য’ কুতুবখানা থেকে কিতাব বণ্টনের সময় আমাদের প্রাধান্য দেয়া হয়। এভাবে প্রাধান্য দিতে গিয়ে দেখা গেলো কিতাব টান পড়ে গেছে। তখন ইমদাদী ছাত্রদের জন্য আবার নতুন করে কিতাব কেনার প্রয়োজন পড়ে। এভাবে তাদের অনেকের কিতাব পেতে কুরবানিও পার হয়ে গেছে।

অবশ্য কিছুটা পার্থক্য তবু রয়ে গেছে। ইমদাদী ছাত্রদের প্রতি মাসে মাদরাসা থেকে ২০০ করে টাকা দেয়া হয়। শীতকালে তারা মাদরাসা থেকে লেপ পায়। আমাদের জন্য এসব ছিলো না। আজব ব্যাপার হলো, দেশে ইমদাদী বা ফ্রি খাওয়া লজ্জাজনক হিসেবে বিবেচিত হয়। যারা টাকা দিয়ে খায় তারা বুক উচিয়ে চলে। এখানে ঠিক উল্টো দৃশ্য। “আমার দাখেলা গাইরে ইমদাদী” এটা কেমন যেন লজ্জাজনক ব্যাপার! ইমদাদী দাখেলা হলে গর্বভরে বলা যায়।

ভর্তি

দাখেলায় নাম আসা চূড়ান্ত কিছু নয়। এ তো কেবল সংগ্রামের শুরু। আসল সংগ্রাম শুরু হয় এরপর। প্রথমে কেরাত পরীক্ষা। সেখানে শুরু হয় প্রাথমিক হয়রানি। কেরাত পরীক্ষকগণ নানাভাবে বাংলাদেশী ছাত্রদের মনোবল দুর্বল করার চেষ্টা করেন। হয়ত হুট করে কাউকে বাংলায় বলে বসবেন, বাড়ি কোথায়? অমনোযোগী হলে সে বাংলায় কিছু একটা বলে ফেলবে। আর তখনই পরীক্ষকের মুখে খেলে যাবে বিজয়ের হাসি। কারণ ছাত্রের ফরমে যে ঠিকানা দেয়া আছে সেই অঞ্চলের ভাষা বাংলা নয়।

কেরাতের পরীক্ষকগণ এই কাজগুলো কেন করেন আল্লাহ জানেন। এই কাজের জন্য পরবর্তী ধাপ তো রয়েছেই। কঠিন ধাপ। সেই ধাপ হচ্ছে ভর্তির ফরম সংগ্রহ। এই ধাপে প্রতি বছরই প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশীদের ফিরিয়ে দেয়া হয়। তারা দ্বারে দ্বারে ঘুরতে থাকে। এরপর এক পর্যায়ে ভর্তি নিয়ে নেয়া হয়।

অনেকেই এর হুসনে তাবীল করেন। তাদের বক্তব্য হলো, প্রশাসন সারাক্ষণ মাদরাসার প্রতি কড়া নজর রাখছে।  ইন্ডিয়ান ছাত্ররাও সতর্ক দৃষ্টি রাখে। দারুল উলুমে বিভিন্ন প্রদেশ ভিত্তিক ছাত্র আঞ্জুমানগুলো অনেক শক্তিশালী। এদের মাঝে আবার সবচেয়ে শক্তিশালী নাকি আসামের আঞ্জুমান। যার ফলে আশঙ্কাটাও বেশি। এসব কারণেই নাকি বাংলাদেশীদের প্রাথমিকভাবে ফিরিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভর্তি নিয়ে নেয়া হয়। সুতরাং মনোবল হারানোর কিছু নেই।

কথাটা পুরোপুরি অস্বীকারও করা যায় না। কারণ যে কোনো উস্তাদের সাথে সাক্ষাত করলেই তারা অত্যন্ত আন্তরিক ব্যবহার করেন। আশার বাণী শোনান। নানাভাবে বাংলাদেশী ছাত্রদের প্রতি নিজেদের ভালোবাসা প্রকাশ করেন। সুতরাং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাপারগুলোতে তাদের আচরণ তাদের মজবুরী হিসেবে ধরাই যায়।

আমাদের নাম যখন আসে তখনও পর্যন্ত ইমদাদী ছাত্রদের দাখেলাই সম্পন্ন হয়নি। তারাও ঘুরছে দ্বারে দ্বারে। মুহাতামিম থেকে নায়েবে মুহতামিম। কোথাও কোনো আশার বাণী নেই। এরই মাঝে আমরা কেরাত পরীক্ষা দিয়ে দিলাম।

আমার পরীক্ষক আলহামদুলিল্লাহ কোনো ঝামেলা করেননি। নির্বিঘ্নে পরীক্ষা দিয়ে চলে আসলাম। এখন ফরম নেয়ার পালা। একদিন মাগরিবের পর দুরু দুরু বুকে গিয়ে উপস্থিত হলাম সেই পরীক্ষার হল আন্ডারগ্রাউন্ডে। আমাদের বেলায়ও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। বাংলাদেশীদের আটকে দেয়া হচ্ছে। সবাইকে একটি নির্দিষ্ট তারিখে আসতে বলা হলো। সেই তারিখ আসার পর আবার নতুন তারিখ। এভাবে কয়েকটা তারিখ ঘুরিয়ে এরপর একদিন বাদ মাগরিব সবাইকে ফরম দিয়ে দেয়। অবশ্য ততদিনে দরস শুরু হয়ে গেছে। ভর্তির ফরমের পেছনে দৌড়াতে গিয়ে আমরা পালনপুরী সাহেবের প্রথম দিনের দরস এবং ফরম প্রদানের দিন মুহতামিম সাহেবের দরসের আংশিক মিস করেছি।

কয়েকজন উস্তাদের সঙ্গে সাক্ষাত

মাওয়াজেয়ে খমসা সফরে একটা ছেলের সাথে পরিচয় হয়। ওর নাম মুহাম্মদ আমিন। সেই পরিচয় পরবর্তীতে আমার অনেক কাজে দিয়েছে। আমার দুঃসহ দিনগুলোতে সে আমাকে ভিন্নভাবে সঙ্গ দিয়েছিলো। অন্যদের মতো আমাকে সান্ত্বনা দেয়নি। কিছু উৎপটাং আচরণ করেছে। যা অন্যান্য হাজারো সান্ত্বনার বানীর চেয়ে সে সময়ে আমার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার ক্ষেত্রে অনেক বেশি কার্যকর ছিলো। দাখেলায় নাম চলে আসার পর তাই ওর সাথে পুরোপুরিভাবে জুটে যাই। দেশ থেকে যাওয়ার সময় মুফতি হাফিজুদ্দীন সাহেব হুজুর দুই আজমি সাহেবের জন্য (নেয়ামতুল্লাহ আজমি এবং হাবিবুর রহমান আজমি) লুঙ্গি এবং গেঞ্জি দিয়ে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশি গেঞ্জি দেওবন্দের উস্তাদগণ খুবই পছন্দ করেন। রমজানে উস্তাদগণ কেউ ছিলেন না। রমজানের পর এতদিন ছিলো ভর্তির টেনশন। এখন আপাতত তেমন কিছু নেই। তাই একদিন ইশার পর আমিনের সাথে নেয়ামতুল্লাহ আজমি সাহেবের বাসায় চলে গেলাম। হুজুরের মজলিসে তখন কয়েকজন আরব মেহমান ছিলো। আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করি। কিছুক্ষণ পর আরব মেহমানগণ বের হয়ে যান। আমরা গিয়ে হাদিয়া পেশ করতেই হুজুর চঞ্চল হয়ে উঠেন। দ্রুত দুটি গেঞ্জি নিয়ে বললেন, দেখো তো তারা চলে গেছে কি না? এই গেঞ্জি দুটি তাদের দিয়ে আসো।

ঘটনা হলো, তারা হুজুরের কাছে হাদিয়া নিয়ে এসেছিলো। হাদিয়ার বিনিময়ে হাদিয়া প্রদানের জন্য হুজুরের কাছে সে সময় কিছু ছিলো না। আমাদের গেঞ্জি পেয়ে তাই হুজুর অনেক খুশি হন। সেখান থেকে দুটি গেঞ্জি দিয়ে সুন্নতের উপর আমল করেন।

হাবিবুর রহমান আজমির সাক্ষাত

পরদিন বিকেলে গেলাম হাবিবুর রহমান আজমি সাহেবের কাছে। এ এক আজব মানুষ। দেওবন্দে তাকে ‘ইবনে হাজার’ নামে ডাকা হয়। এই নামকরণের সঠিক কারণ আমার জানা নেই। কেউ বলেন, দরসে তিনি বেশি বেশি ইবনে হাজারের হাওয়ালা দেন বলে তাকে এই নামে ডাকা হয়। কেউ বলেন, ইলমে হাদীসে, বিশেষ করে রিজাল শাস্ত্রে তার বিশেষ আগ্রহের কারণেই এই উপাধি লাভ করেছেন। কারণ যাই হোক, মানুষটির ইলম এবং ব্যাপক পড়াশোনার কথা সর্বজন বিদিত। শুনেছি প্রতিদিন প্রায় ১৪/১৫ ঘন্টা মুতালায়া করেন। এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে একটা ঘটনা বলে রাখি। আমরা যখন দেওবন্দে যাই সে সময় মাহনামা দারুল উলুমের সম্পাদক ছিলেন হাবিবুর রহমান আজমি সাহেব। শশমাহীর পর হুজুরের দাওরায় ঘণ্টা ছিলো আবু দাউদ সানী। সে বছর নেয়ামতুল্লাহ সাহেবের অসুস্থতার কারণে তার অংশের মুসলিম সানীও হাবিবুর রহমান সাহেবকে দেয়া হয়। অতিরিক্ত একটা দরস বেড়ে যাওয়ার কারণে তিনি মাহনামার দায়িত্ব ছেড়ে দেন। কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, ‘দরসি মাসরূফিয়্যত’ বেড়ে যাওয়া।

এই ঘটনায় আমি বড়সড় একটা ধাক্কা খাই। কারণ আমি যে দেশে বড় হয়েছি সেখানে একই ব্যক্তি চার-পাঁচটি দায়িত্ব আগলে রেখেও সম্ভব হলে আরও দায়িত্ব নিতে চান। সেখানে এই ঘটনা আমি কিভাবে হজম করবো?

আজমি সাহেবের স্বভাব হলো, তিনি কাউকে সহজে কাছে ঘেঁষতে দেন না। সাক্ষাৎ করতে গেলে যত দ্রুত তাড়িয়ে দেয়া যায় সেই ফিকিরে থাকেন। প্রত্যেক কথার পর একবার করে ‘আচ্ছা যাও’ বলবেন। সারা দেওবন্দে দুইজন মানুষের সাথেই তার বিশেষ খাতির লক্ষ্য করেছি। একজনের সাথে বন্ধুত্ব আর অপরজনের সাথে শ্রদ্ধাপূর্ণ সম্পর্ক। বন্ধুত্বের সম্পর্ক হলো নেয়ামতুল্লাহ আজমি সাহেবের সাথে। আসরের পর নেয়মতুল্লাহ সাহেব লাঠি ঠক ঠক করে আজমি মঞ্জিলে চলে আসতেন। মাগরিব পর্যন্ত দুই বন্ধু বসে গল্প-গুজব করতেন।

আর শ্রদ্ধার সম্পর্ক ছিলো সাইয়্যেদ আরশাদ মাদানী হাফিজাহুল্লাহর সাথে। মাদানী সাহেব যখনই কোনো কারণে দেওবন্দের বাইরে যেতেন, ফিরে আসার পর হাবিবুর রহমান সাহেব অনিবার্যভাবেই তার সঙ্গে সাক্ষাত করবেন। দূর থেকে লক্ষ করলে দেখা যেত তার চেহারা থেকে ভক্তি-শ্রদ্ধা কিভাবে ঝড়ে ঝড়ে পড়ছে। নিজে কখনও দেওবন্দের বাইরে গেলেও এসে মাদানী সাহেবের সাথে সাক্ষাত করতেন।

হাবিবুর রহমান সাহেবের সাথে প্রথম সাক্ষাতের পর আমার আহমদ ছফার ‘যদ্যপি আমার গুরু’র কথা মনে পড়ে গিয়েছিলো। অধ্যাপক আব্দুর রাযযাক সাহেব যেমন প্রথম সাক্ষাতে ছফাকে তাড়িয়ে দেয়ার তালে ছিলেন, আজমি সাহেব ঠিক এই কাজটিই করেছেন। শুধু হাফিজুদ্দীন সাহেবের স্বাস্থ্যের খোঁজ নিয়েছেন। ব্যস, এরপর প্রত্যেক কথার পর ‘ঠিক হ্যাঁ, যাও।’

দুঃখজনক ব্যাপার হলো, ছফা পরবর্তীতে আব্দুর রাযযাক সাহেবের কাছ থেকে অনেক কিছুই বের করে নিতে পেরেছিলেন। কিন্তু আমি পারিনি কিছুই। খুব বেশি কাছে যেতে সাহসই হতো না। তবু এক/দুইবার আমিনের সাথে গিয়েছি। হুজুরের লেখা হাদীস ও সুন্নাহর পার্থক্য বিষয়ক রিসালা এনেছিলাম। দুই আজমি সাহেবই হাদিস এবং সুন্নাহর পার্থক্যের বিরুদ্ধে। নেয়ামতুল্লাহ সাহেবের পরামর্শে হাবিবুর রহমান আজমি সাহেব এই বিষয়ে তিনটি রিসালা লিখেন। সেখানে পালনপুরী সাহেবকে ইলমিভাবে রদ করেন।

কথায় কথা আসে। হাদিস এবং সুন্নাহ বিষয়ক আলোচনা দারুল উলুমে ছাত্রদের কাছে একটি উপভোগ্য টপিক। ছাত্ররা বিভিন্ন উস্তাদের দরসে এই বিষয়ে প্রশ্ন করে। পালনপুরী সাহেব তো নিজ থেকেই আলোচনা করেন। অবশ্য আমাদের বছর কিছুটা অভিমান ভরা কণ্ঠে বলেছিলেন, এক সময় আমি এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতাম। এখন করি না। কারণ আমার এই আলোচনায় দারুল উলুমেরই কিছু কিছু উস্তাদ কষ্ট পান। তবে একদম আলোচনা না করেও পারছি না। কারণ বুখারী শরিফের নামের অংশে আছে ‘ওয়া সুনানিহী’। সুতরাং সুন্নত কি এটা আমাকে বলতেই হবে।

একদিন হাবিবুর রহমান আজমি সাহেবের ঘণ্টায় এক ছাত্র পর্চা পাঠিয়ে হাদিস এবং সুন্নত বিষয়ক আলোচনার জন্য অনুরোধ করে। আজমি সাহেব সেই চিরকুট পেয়ে প্রচণ্ড ক্ষেপে যান। হুজুরের বাক্যটা ছিলো অনেকটা এরকম, ‘কিয়্যা লড়াই ঝগড়াওয়ালি বাত লে কে আয়া..।’ বলতে বলতে চিরকুটটি ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলেন। হুজুরের সেই রাগভরা কণ্ঠ এবং চেহারা এখনও আমার চোখে ভাসে। আমি হুজুরের সেই রাগত: কণ্ঠ এখনও শুনতে পাই।

এরপর হুজুর বলে দিলেন, এ বিষয়ে আমার তিনটি রিসালা আছে। আগ্রহ থাকলে সেগুলো পড়ে নিও। দরসে এসব বিতর্কিত প্রসঙ্গ তুলবে না।

হুজুরের সাথে যতবার দেখা করেছি প্রত্যেকবার হুজুর জিজ্ঞেস করতেন, কাহাঁ কে হো? প্রত্যেকবার আমি হাফিজুদ্দীন সাহেবের পরিচয় দিতাম। কিন্তু পরেরবার আবার ভুলে যেতেন। আবারও একই প্রশ্ন করতেন। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হলো, হুজুরের কাছ থেকে আমরা যখন কিতাব কিনি তখন তাঁর কাছে ভাংতি টাকা ছিলো না। বলেছিলেন পরে নিয়ে যেতে। পরেরবার যখন দেখা করতে যাই তখন আমাদের ঠিকই চিনে ফেলেন। বললেন, তোমরা তো আমার কাছে টাকা পাবে। নিয়ে যাও।

হুজুর মুত্তাহিদা কওমিয়্যতের উপর একটি কিতাব সংকলন করেছেন। হুজুরের কাছে কিতাবটির সন্ধানে গেলে জানালেন, এটি দিল্লি জমিয়তের প্রকাশনী থেকে ছেপেছে। ওখানেই পাওয়া যাবে। আর মাদানী রহ. এর মুত্তাহিদা কওমিয়্যত আওর ইসলাম সম্পর্কে বলেছিলেন, এটি এখন আর পাওয়া যায় না। কিন্তু আলহামদুল্লিাহ, দিল্লি জমিয়তের মাকতাবায় আমি উভয়টি পেয়ে যাই। মাদানী রহ. এর রিসালার সাথে হিফজুর রহমান সিহারবি রহ. এর একটি ছোট্ট মাকালাও ছেপে দেয়া আছে।

জামিল সাহেবের সাক্ষাত

আজমি সাহেব যেহেতু আমাদের অল্প সময়ে বিদেয় করে দিয়েছেন তাই বাকি সময়ে আরও কয়েকজনের কাছ থেকে ঘুরে আসা যায়। এরপর আমরা গেলাম মাওলানা জামিল আহমদ সাহেবের কাছে। (আল্লাহ মরহুমকে জান্নাতের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় দান করুন।) দারুল উলুম ওয়াকফের কাছেই হুজুরের মাকতাবা। আসরের পর হুজুর সেখানে বসেন। আমরা কয়েকজন গেলাম হুজুরের সাক্ষাৎে। এমনিতেই বাংলাদেশী ছাত্রদের অনেক মহব্বত করতেন। এর মাঝে আবার মালিবাগের ছাত্রদের প্রতি আলাদা দুর্বলতা ছিলো। হুজুর আমাদের ভর্তির খবর নিলেন। আমরা জানালাম, এখনও দ্বারে দ্বারে ঘুরে মরছি। হুজুর অভয় দিলেন- ‘হু জায়েগা ইনশাআল্লাহ!’ হুজুরের উচ্চারিত এই বাক্যটি এখনও আমার কানে বাজে। কয়েকবার বলেছেন এই কথাটি। মাঝে জিজ্ঞেস করলেন, মুহতামিম সাহেব কি বলেন?

আমরা জানালাম, মুহতামিম সাহেব কিছু বলতে চান না। বলেন, এটা তালিমাতের কাজ। আমার এখানে কিছু করার নেই।

হুজুর হেসে বললেন, ‘তালিমাত তো ইহতেমামেরই অধীনে।’ এরপর আবার বললেন, ‘আসলে মুহতামিম সাহেবও তো দায়বদ্ধ। তারও মজলিসে শূরার কাছে জবাবদিহিতা করতে হয়।’ তারপর আবারও সেই অভয়বানী, ‘হু জায়েগা ইনশাআল্লাহ!’

ভর্তি সংক্রান্ত সেই অনিশ্চয়তার দিনগুলোতে হুজুরই ছিলেন আমাদের সবচেয়ে বেশি সান্ত্বনার জায়গা। হুজুর আমাদের অভয় দিয়ে দিয়ে রেখেছেন। দুশ্চিন্তা করতে নিষেধ করতেন।

দুঃখজনক ব্যাপার হলো, হুজুরের সাথে খুব বেশি সুসম্পর্ক রাখতে পারিনি। সুযোগ ছিলো। কিন্তু অলসতার কারণে যাওয়া হত না। সারা বছর সর্ব সাকুল্যে তিন/চারবার যাওয়া হয়েছে হুজুরের কাছে। একবার যে কোনো কারণে মন অত্যন্ত খারাপ ছিলো। সেদিন আমার মন খারাপের পুরো নিরাময় ছিলো হুজুরের মজলিসে। আমি মালিবাগে পড়েছি জেনে অনেক খুশি হলেন। মালিবাগের ব্যাপারে নিজের মুগ্ধতার কথা প্রকাশ করলেন। কিছুদিনের মধ্যে হুজুরের বাংলাদেশ সফরের কথা ছিলো। সেটা নিয়েই কথা হচ্ছিলো একজনের সাথে। হুজুর বললেন, বাংলাদেশের আবহাওয়া আমার জন্য খুবই মোয়াফিক। মাত্রাতিরিক্ত গরম নেই, আবার অতিরিক্ত ঠাণ্ডাও নেই। এরপর বললেন, আমি যতদিন বাংলাদেশে থাকি সাধারণত ভাতই খেয়ে থাকি। ওখানকার তরকারি অনেক সুস্বাদু।

চলে আসার সময় বলে দিলেন, আমি আসরের পর এখানেই বসি। এসো মাঝে মাঝে।

এরপর শুধু একবার যাওয়া হয়েছে। তাও অনেক দিন পর। ততদিনে হুজুর এই সাক্ষাতের কথা ভুলেই গেছেন।

জামিল সাহেবের কাছ থেকে যখন বিদায় নিই তখনও মাগরিবের আজানের আরও কিছু সময় বাকি আছে। আমিন বললো, চলেন পালনপুরী সাহেবের কাছ থেকে ঘুরে আসি। আমি বললাম, হুজুরের নাম শুনলেই ভয় লাগে।

আমিন বললো, কিসের ভয়? আমার তো উনার সাথে তর্ক করতে মন চায়!

পালনপুরী সাহেবের সাথে সেদিন আর সাক্ষাৎ করা সম্ভব হয়নি।

ইফতেতাহী মাহফিল

আমাদের ভর্তি তখনও ঝুলন্ত। এরই মাঝে ইফতেতাহি মাহফিল হয়ে গেলো। আল্লামা রিয়াসত আলি বিজনূরী রহ. এর নাতি যাকওয়ান ভাই তারানায়ে দেওবন্দ পরিবেশন করে। এরপর নাযেমে দারুল ইক্বামা মাওলানা মুনীর সাহেব দারুল ইক্বামার নিয়ম-কানুন সম্বলিত আলোচনা পেশ করেন। তিনি বিশেষভাবে ‘মাল্টিমিডিয়া মোবাইল সেট’ ব্যবহারের উপর বিশেষ পাবন্দি আরোপ করেন এবং ধরা পড়লে কঠিন শাস্তির কথা উল্লেখ করেন। সহকারী নাযেমে তালিমাত মাওলানা আফজাল সাহেব বলেন, তোমাদের দাখেলা কিন্তু শর্তযুক্ত দাখেলা। শর্ত হলো, তোমরা দারুল উলুমের সকল নিয়ম-কানুন মেনে চলবে।

বিশেষ আলোচক হিসেবে বয়ান করেছেন আওলাদে রাসুল সাইয়্যেদ আরশাদ মাদানী এবং শাইখুল হাদীস মুফতি সাঈদ আহমদ পালনপুরী রহ.। পালনপুরী সাহেব দেওবন্দিয়ত নিয়ে আলোচনা করেন। মাদানী সাহেবের আলোচনার বিষয়বস্তু মনে নেই। তিনি সাম্প্রতিক কোনো একটি বিষয় নিয়ে কথা বলেছিলেন।

অনুষ্ঠান চলাকালীন একটি দৃশ্য আমাকে বিশেষভাবে নাড়া দেয়। আবুল কাসেম নুমানি সাহেব যখন অনুষ্ঠানস্থলে আসেন বাইরে তখন প্রচণ্ড রোদ। হুজুরের হাতে ছাতা ছিলো। মসজিদের দরজায় এসে তিনি ছাতা বন্ধ করলেন। এরপর জুতা খুলে এক হাতে ছাতা আর অপর হাতে জুতা নিয়ে আস্তে আস্তে মজলিসের সামনের দিকে চলে আসলেন। সাথে ছাতা ধরার জন্যও কোনো খাদেম নেই, জুতা রাখার জন্য কোন লোকও নেই।

হয়ত খুবই সাধারণ একটি দৃশ্য। কিন্তু এই দৃশ্যটিই অস্বাভাবিক হয়ে যায় যখন কোনো মক্তবের মুহতামিমকেও আগে-পিছনে কয়েকজন খাদেম নিয়ে চলাফেরা করেন। একজন ছাতা ধরে রাখেন। জুতা ধরার জন্য থাকে আলাদা খাদেম।

পালনপুরী সাহেব দরসে শুনিয়েছেন, অফিসে যখন তারা বসেন, কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে মুহতামিম সাহেব নিজে উঠে গিয়ে সেটা নিয়ে আসেন। কাউকে অর্ডার দেন না। যিনি বলেছেন তিনি যথার্থই বলেছেন, দারুল উলুমের মুহতামিম সাহেবের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি যে দেওবন্দের মুহতামিম সেই অনুভূতিই তার নেই।

এখানে অনুভূতি নেই বলতে গর্ব-অহঙ্কারের ব্যাপার বুঝানো হয়েছে। অন্যথায় দায়িত্বের ক্ষেত্রে তিনি পূর্ণ সচেতন। কিন্তু আচার-আচরণে সম্পূর্ণ মাটির মানুষ।

শুরু হলো দরস

ইফতেতাহি মাহফিলের এক/দুইদিন পরই দরস শুরু হয়ে যায়। সে এক নতুন অভিজ্ঞতা। আগের দিন বিকেলে মসজিদে রশিদের আন্ডারগ্রাউন্ড খুলে দেয়া হয়। শুরু হয় জায়গা রাখার প্রতিযোগিতা। আমিও গেলাম জায়গা রাখতে। কিন্তু জায়গা রাখার পরিবর্তে তামাশা দেখতে দেখতেই শেষ। আসামের একটা ছেলে কি পরিমাণ মস্তানি করছিলো! ছেলেটাকে পরে যতবার দেখেছি তার প্রথম দিনের সেই মস্তানির কথা মনে পড়েছে। অবশ্য পরে একদিন সে আমাদের একটা উপকারও করেছিলো। আসলে পরবর্তীতে তার কোনো আচরণে তেমন উগ্রতার প্রকাশ পাইনি। কিন্তু সেদিন জায়গা রাখা নিয়ে সে এমন করছিলো কেন কে জানে?

আমি তখন অনেকাংশেই আমিনের উপর নির্ভরশীল। সে যেখানে জায়গা নিবে সেখানেই বসবো। তার চেহারায় পেরেশানীর ছাপ। কয়েক জায়গা ঠিক করেও শেষ রক্ষা হলো না। আসলে সেদিন বিকেলে এত মারামারি-দাপাদাপি করে যারা জায়গা রেখেছিলো তাদের সব শ্রম বেকার হয়ে যায়। পরদিন সকালে আবার নতুন করে জায়গা রাখা হয়। আর সেটিই ছিলো চূড়ান্ত। আমরা উত্তর দিকে মসনদ থেকে কিছুটা দূরে একটা জায়গায় আসন নেই। বছরের শেষ পর্যন্ত ওটাই ছিলো আমার আসন। মাঝে মধ্যে এক দুই ঘন্টার জন্য এদিক-ওদিক হয়েছি। কিন্তু সার্বিকভাবে এটিই ছিলো আমার জায়গা।

দরস শুরু হওয়ার কথা সাতটায়। সেদিন ফজরের পর আর কামরায় যাইনি। জায়গা টায়গা রেখে আমিনের পকেট মেরে সকালের নাস্তা সেরেছি। প্রথম ঘন্টা মুসলিম আওয়াল। দরস দিবেন আল্লামা কমরুদ্দীন সাহেব। কিন্তু সাতটা পনেরোর দিকে দরসে আসলেন সাইয়্যেদ আরশাদ মাদানী। তখনও মাইক ঠিকঠাক হয়নি। কিন্তু হুজুরের জন্য তো মাইকের প্রয়োজন হয় না। খালি গলাই যথেষ্ট। হুজুর সবাইকে রব্বি যিদনি ইলমা পড়ালেন। এরপর বললেন, মাওলানা (কমরুদ্দীন সাহেব) আমাকে ফোন করে বলেছেন, আপনি শুরু করে দিয়ে আসুন। এরপর আমি যাবো। তাই আমি এসেছি।

আল্লামা কমরুদ্দীন সাহেবের দরস

পরের দরসে আল্লামা কমরুদ্দীন সাহেব আসলেন। হুজুরের অংশে ছিলো মুসলিম প্রথম খণ্ড। দেওবন্দে দাওরায় শুধু দুটি কিতাবই পূর্ণাঙ্গ পড়ানো হয়। বুখারী এবং তিরমিযি। বাকিগুলো শুধু নির্দিষ্ট নেসাব পড়ানো হয়। পুরো কিতাবের ইবারতও পড়া হয় না। মুসলিম প্রথম খণ্ডের জন্য নির্ধারিত সময় ছিলো শশমাহী পরীক্ষা পর্যন্ত। প্রতিদিন সাতটা থেকে আটটা। এক ঘন্টা দরস। নেসাব মুকাদ্দিমা এবং কিতাবুল ঈমান। নিয়মতান্ত্রিক পড়ালে শেষ সময়ে এসে চলো চলো করার প্রয়োজন হয় না। স্বাভাবিকভাবে তাকরির করেই পড়ানো যায়। অবশ্য কমরুদ্দীন সাহেব তাকরির খুব কমই করেন। শুধু দরকারি জায়গাগুলোতে সামান্য আলোচনা করেন। কথা বলেন ধীর গতিতে এবং নিচ দিকে তাকিয়ে। বুযুর্গ মানুষ, তবে অত্যন্ত কড়া। কোনো ধরণের অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা সহ্য করতে পারেন না। ভয়াবহ ক্ষেপে যান। হুজুর মাঝে মাঝে দরসে হাজিরা ডাকতেন। হুট করে মাঝখানে এক জায়গা থেকে খুলে ডাকা শুরু করতেন। হাজিরা শুরু হলে অনুপস্থিত ছাত্ররা হুড়মুড় করে দরসে ছুটে আসতো। এরপর তিনি খাতা বন্ধ করে ফেলতেন।

আমরা কমরুদ্দীন সাহেবের কাছে দুই কিতাব পড়েছি। শশমাহী পর্যন্ত মুসলিম প্রথম খণ্ড। শশমাহীর ছুটিতে শাইখে সানী আব্দুল হক আজমী রহ. এর ইন্তেকাল হয়ে গেলে বুখারী ছানীও তার যিম্মায় দেয়া হয়। এছাড়া বছর শেষে তিনি আমাদের মুসালসালাতের দরসও দিয়েছেন। সে সম্পর্কে সামনে বিস্তারিত বলার ইচ্ছে আছে।

সাইয়্যেদ আরশাদ মাদানী সাহেবের দরস

দ্বিতীয় ঘণ্টা ছিলো আওলাদে রসুল সাইয়্যেদ আরশাদ মাদানী হাফিজাহুল্লাহর। তার অংশে ছিলো তিরমিযি ছানী পূর্ণাঙ্গ। আমার কাছে হুজুরের দরসের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ ছিলো কিতাবুল আতঈমাহ। ব্যক্তিগত মুতলায়া এবং অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে চমৎকার তাকরির করতেন। আমার আফসোস, সেই তাকরিরগুলো লিখে রাখতে পারিনি।

হুজুর আরও একটি অংশ খুবই মজা করে পড়িয়েছেন। সেটি হলো আলামতে কেয়ামত। বিশেষ করে দাজ্জালের অংশটুকু। স্বীকার করতে বাধা নেই, সারা বছর হুজুরের প্রতিটি দরসে মনযোগ সহকারে শরিক থাকার সুযোগ হয়নি। এই সময়টায় চোখে প্রচণ্ড ঘুম থাকতো। জোর করে সজাগ থাকতেও কষ্ট হতো।

এ তো হলো আমাদের অবস্থা। এবার হুজুরের ঘটনা শুনেন। হুজুর প্রায়ই বিভিন্ন কাজে দিল্লি যেতেন। কখনও বা দেশে বা দেশের বাইরে সফরে চলে যেতেন। বেশিরভাগই দেওবন্দে ফিরতেন শেষ রাতে। অবাক করা ব্যাপার হলো, আটটার দরসে যখন হুজুর উপস্থিত হতেন মনে হতো শরীর একদম ফুরফুরে এবং ঝরঝরে। সফরের ক্লান্তির লেশমাত্রও সেখানে নেই। পূর্ণ নাশাত নিয়ে দরস করাতেন। এটি একদিন দুইদিনের ঘটনা নয়। দেওবন্দের এক বছরে বার বার এই দৃশ্য দেখেছি আর মাদানী রহ. এর অসম্ভব কষ্ট সহিষ্ণুতার কথা স্মরণ করেছি। একেই তো বলে বাপ কা বেটা!

হুজুর শেষ দিনের দরসে এক আজব কথা শুনালেন। বললেন, এই কিতাব তো মূলত মেরাজুল হক সাহেবের। হুজুর আমাকে পড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন। তাই হুজুরের পক্ষ থেকে আমি পড়াচ্ছি।

ঘটনা হলো, মেরাজুল হক সাহেব যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন তখন তিনি তার অংশের কিতাবটি আরশাদ মাদানী সাহেবকে পড়াতে দেন। এরপর থেকে এই কিতাব মাদানী সাহেবই পড়াচ্ছেন। মেরাজুল হক সাহেবের ইন্তেকাল হয়ে গেছে সেই কবে! কিন্তু এখনও তিনি এটি উস্তাদের কিতাব হিশেবেই পড়িয়ে যাচ্ছেন।

তিরমিযি ছানীর মাঝের কিছু অংশ (আদাবের অধ্যায়গুলো) মাওলানা ইউসুফ তাওলাবী সাহেব পড়িয়েছেন। সেই গল্প তাওলাবী সাহেবের আলোচনায় বলবো ইনশাআল্লাহ।

মাওলানা রিয়াসত আলি বিজনুরীর দরস

দারুল উলম দেওবন্দ নিকট অতীতে যে কয়জন অসম্ভব মেধাবী এবং প্রতিভাবান মানুষের জন্ম দিয়েছে তার মাঝে অন্যতম একজন হলেন মাওলানা রিয়াসত আলি বিজনুরী। দেশে থাকতে তাঁর নাম শুনেছি তারানায়ে দারুল উলুমের রচয়িতা হিসেবে। আমাদের উস্তাদ মাওলানা আহমদ মায়মুন সাহেব উনার খুব প্রশংসা করতেন। দারুল উলুমে যখন নিয়মতান্ত্রিক দরস শুরু হয়ে যায় সে সময় তিনি অত্যন্ত অসুস্থ ছিলেন। ফলে বছরের শুরুর দিকে বেশ কিছুদিন দরস করাতে পারেননি। প্রতিদিন দ্বিতীয় ঘণ্টা শেষ হওয়ার পর তর্জুমান ঘোষণা করতো, ঘণ্টা খালি হ্যায়। অন্যান্য উস্তাদগণ তাদের দরসে হুজুরের জন্য বিশেষ দোয়ার আবেদন জানাতেন।

হুজুরের ভাগে ছিলো তিরমিযি প্রথম খণ্ড কিতাবুল জানায়েয শেষ পর্যন্ত। নয়টা থেকে দশটা পর্যন্ত দরস। হুজুর ছিলেন অসম্ভব মজার একজন মানুষ। চমৎকার পড়াতেন। ফাঁকে ফাঁকে সুরসিকতা করতেন। ছাত্ররা হেসে লুটিয়ে পড়তো। কথা বলতেন কিছুটা দ্রুত। তবে বুঝা যেত। তাছাড়া হুজুর যে সময় থেকে দরসে নিয়মিত হতে শুরু করেছেন ততদিনে ছাত্রদের মাঝে বছরের শুরুর সেই জোশ শেষ হয়ে গেছে। ফলে চাইলে প্রথম বেঞ্চেও বসা যেত। আমি বসেছি কয়েকদিন। হুজুরের হাদীসের তাশরীহ, মাসআলা ব্যাখ্যা করা, ইখতিলাফি মাসআলার হল সব কিছুতেই অসাধারণ মেধার ছাপ ছিলো। পরের বছর যারা দেওবন্দে পড়তে গিয়েছে তাদের আমি বলতাম, আপনারা যে কি মিস করবেন সেটা অনুভবও করতে পারবেন না। আপনারা রিয়াসত আলি সাহেবের অসাধারণ দরস মিস করবেন!

হুজুর সর্বশেষ কিতাবুল জানায়েয পড়ালেন। এরপর নিজেই জানাযা হয়ে গেলেন। শুনেছি হুজুরের তত্বাবধানে দারুল উলুমের দুইজন উস্তাদ ‘কাশশাফু ইসতিলাহাতিল ফুনুন’ এর কাজ করেছেন। সেই কাজ কতদূর আছে, কবে বের হবে কিছুই জানা নেই। আল্লাহ এই অসম্ভব প্রতিভাবান মানুষটিকে জান্নাতে শান্তিতে রাখুন।

মুফতি সাঈদ আহমদ পালনপুরী সাহেবের দরস

পালনপুরী সাহেবের দরস শুরু হতো সাড়ে দশটা থেকে। দশটা থেকে সাড়ে দশটা পর্যন্ত বিরতি। যার যার অজু-ইস্তিঞ্জার প্রয়োজন এই সময়ের মধ্যে সেরে নিতে হবে। হুজুরের দরসে বের হওয়ার বা দেরি করে ঢুকার কোনো সুযোগ ছিলো না। প্রচণ্ড রেগে যেতেন দরস শুরু হওয়ার পর কেউ ঢুকলে। এছাড়া মাঝখানে জায়গা রাখাও হুজুরের ভীষণ অপছন্দ ছিলো। মাঝে খালি থাকার কারণে রাগ করে দরস না করে চলেও গিয়েছেন একবার। এজন্যই হুজুর আসার আগে তর্জুমান বিশেষ করে সবাইকে সতর্ক করে দিত যেন সবাই খালি জায়গা পুরণ করে বসে।

হুজুর এসে দরসগাহর একটু আগে গাড়ি থেকে নামতেন। কুলি করে পান খাওয়া মুখ পরিষ্কার করতেন। এরপর হেঁটে হেঁটে দরসে আসতেন। ততক্ষণে তর্জুমান ঘোষণা করতো- ‘হযরত মুফতি সাহাব বাহার তাশরীফ লা চুকে হে। ইসি লিয়ে সভি সাথি বরায়ে মেহেরবানী আগে বড়হ যায়ে। আওর খালি জাগাহ পূর কার লে।’

দেওবন্দে পালনপুরী সাহেবের পরিচয় ‘মুফতি সাহেব’ নামে।

দারুল উলুমে সবচেয়ে বেশি ছাত্র সমাগম হত দুটি দরসে। পালনপুরী সাহেবের দরস আর মুহতামিম সাহেবের দরস। নিয়মিত ছাত্রের বাইরে দাখেলাহীন ছাত্র, মেহমান এবং আরও অনেকেই অংশগ্রহণ করত। হুজুর লম্বা সময় নিয়ে দরস করাতেন। তবে পুরোটা সময় ছাত্রদের মাতিয়ে রাখতেন। যার ফলে সময় দীর্ঘ হলেও বিরক্তি লাগত না।

আগেই বলেছি, ভর্তির ঝামেলায় হুজুরের প্রথম দিনের দরসে হাজির থাকতে পারিনি। সেদিন নাকি হুজুর আসমাউল হুসনার ফজিলত এবং বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করেছেন। এরপর থেকে প্রতিদিন দরসের শুরুতে কিছুক্ষণ সবাইকে আসমাউল হুসনা পড়াতেন। প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ। এভাবে একটু একটু করে সবাইকে পুরো ৯৯ টি নাম মুখস্ত করান। সবাইকে বলে যান যেন আসরের পর হুজুরের মজলিসে গিয়ে শুনিয়ে আসে। যারা অসম্ভব সাহসী তারা শুনিয়েছে। কেউ কেউ সক্ষম হয়েছে, কেউ মাঝপথে ধমক খেয়ে ফিরে এসেছে।

হুজুর দরসে বলে গিয়েছিলেন, যারা ইবারত পড়তে ইচ্ছুক তারা যেন আসরের পর গিয়ে হুজুরকে ইবারত শুনিয়ে আসে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে কেউ হুজুরের পরীক্ষায় পাশ হতে পারেনি। তাই সারা বছর ইবারত নিজেই পড়েছেন। অবশ্য বছরের শেষে এক দুইজনের পড়া শুনে বলেছিলেন, তোমাদের মাঝে এতো ভালো ইবারত পড়ার লোক আছে জানলে তো আমি সারা বছর এত কষ্ট করতাম না।

হুজুর বুখারীর প্রতটি তরজমাতুল বাব ব্যাখ্যা করে পড়াতেন। হাদীস তাকরার হলে সেই হাদীসের ব্যাখ্যা দ্বিতীয়বার করার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু সেই হাদীস দ্বিতীয়বার যে বাবের অধীনে এসেছে সেটা তো নতুন। আর প্রসিদ্ধ আছে- ‘ফিকহুল বুখারী ফী তরজুমাতিহী’। তাই তরজমাতুল বাব ভালো করে বুঝতে হবে।

হুজুর চেষ্টা করতেন ছাত্ররা যে ভাষায় বা যে ভঙ্গিতে বললে কথাটা বুঝতে পারবে ঠিক সেভাবেই বলার। ভাষার সাবলিলতা এবং উপস্থাপনের ভিন্নতা তো আছেই, পাশাপাশি কোথাও যদি অঙ্গভঙ্গি করে বুঝানোর প্রয়োজন হতো তাহলে তাও করতেন। এই বৈশিষ্ট্য দারুল উলুমের দুইজন উস্তাদের মাঝে দেখেছি। মুফতি সাঈদ আহমদ পালনপুরী এবং হাবিবুর রহমান আজমি। তবে অঙ্গভঙ্গি করতে গিয়ে আবার নিজের ব্যক্তিত্ব কখনও নষ্ট হতে দেননি। বরং দারুল উলুমের বা-রু’ব উস্তাদদের তালিকা করা হলে এই দুইজনের নাম শুরুর দিকেই থাকবে। এ এক অপূর্ব সমন্বয়!

দরসে প্রচুর মজা করতেন। অনেক সময় আবার হাসির কথা বলে পরীক্ষা করতেন ছাত্ররা দরসে মনযোগী আছে কি না। একবার হাদীসের ইবারতে উতবা-শাইবার নাম আসলে হুজুর পড়তে লাগলেন, উতবাতুবনু রাবীআতা ওয়া শাইবাতুবনু পাজামাতা..। পরে আসরের পরের মজলিসে এক মেহমানের সাথে আলাপকালে বলেছিলেন, এখানে তিনি ইচ্ছে করে ‘পাজামাতা’ পড়েছেন ছাত্রদের পরীক্ষা করার জন্য। যদি ছাত্ররা এই ইবারত শুনে হেসে ফেলে তাহলে এর অর্থ হলো, দরসে তাদের মনযোগ আছে। আর যদি না হাসে তাহলে তারা অমনযোগী।

দরসে শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহ. এর প্রচুর হাওয়ালা দিতেন। মূলত হুজুরের দরসে বসেই অনুভব করেছি, শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহ. এমন এক ব্যক্তিত্ব যাকে আলাদাভাবে পড়তে হয়। পড়া দরকার। দেওবন্দি ধারার মাদরাসায় পড়াশোনার কারণে সব সময় নিজেদের শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহ. এর আদর্শের উত্তরসূরী বলে জেনে এসেছি। কিন্তু শাহ ওয়ালিউল্লাহকে পালনপুরি সাহেব যেভাবে উপস্থাপন করেন এমন করে আগে কেউ আমাদের কাছে উপস্থাপন করেননি। আমাদের সামনে শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহ. এর ভিন্ন এক ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠে। তাকে পড়ার আগ্রহ জাগে।

বেদআতের ব্যাপারে হুজুর অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন। যেসব কাজে সামান্য বিদআতের সম্ভাবনা থাকতো, বা ভবিষ্যতে বেদআত সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতো সেসব কাজের তিনি দৃঢ়ভাবে বিরোধিতা করতেন। দরসে কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করার মাসআলায় উলামায়ে দেওবন্দের মাসলাক উল্লেখ করার পর বলেছিলেন, এ তো আমি মাসআলা বললাম। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এভাবে খোলা ছেড়ে দিলে এর থেকেই আস্তে আস্তে বেদআতের জন্ম হয়। এরপর একটি ঘটনা শুনালেন। একবার তিনি আসআদ মাদানী সাহেবের সাথে আজমীর গিয়েছিলেন। সেখানে মাযারকে কেন্দ্র করে যে বেদআত এবং শিরকি কর্মকান্ড চলে সেসব দেখার পর হুজুর মাদানী রহ.কে বলেছিলেন, ইবনে তাইমিয়া সম্ভবত এ ধরণের দৃশ্য দেখেই কবর যিয়ারতের মাসআলায় এত কঠোরতা করেছেন।

কবর যিয়ারতের উদ্দেশে সফরকে হুজুর নাজায়েয মনে না করলেও পছন্দনীয় মনে করতেন না।

কবর যিয়ারতের ব্যাপারে হুজুরের এক আজব ব্যাখ্যা ছিলো। হুজুর বলতেন, অনেকে বলে বুযুর্গদের কবর থেকে রুহানী ফয়েজ পাওয়া যায়। আমি রুহানী ফয়েজের কথা স্বীকার করি। তবে এর উদ্দেশ্য এটা নয় যা মানুষ বুঝে। বরং উদ্দেশ্য হলো সেই হাদীস, যেখানে বলা হয়েছে- কবর যিয়ারতে আখেরাতের কথা স্মরণ হয়। এগুলোই কবরের ফয়েজ। আর এটা বুযুর্গদের কবর যিয়ারত করলে হয় না। হয় সাধারণ মানুষের কবর যিয়ারতে। কারণ বুযুর্গদের কবরে গেলে কারও মৃত্যুর কথা মনে পড়ে না। ওখানে তো সবাই নিজেদের দুনিয়াবী স্বার্থ নিয়ে যায়।

বেদআত এবং রুসুমাতের ব্যাপারে হুজুরের অপছন্দের আরও একটি ঘটনা উল্লেখ করি। এই ঘটনায় খেদমতে খলকের শিক্ষাও রয়েছে। একবার দাওরার একজন বা কয়েকজন ধনী ছাত্র মিলে উস্তাদদের আনা-নেয়ার জন্য একটি গাড়ির ব্যবস্থা করলো। পালনপুরি সাহেব পরদিন দরসে এই বিষয়টি তুললেন। বললেন, দেখো! এখন তোমাদের সামর্থ আছে। তোমরা গাড়ির ব্যবস্থা করছো। হয়ত আগামী বছর যারা আসবে তাদেরও সামর্থ থাকবে। কিন্তু একটা সময় এমন আসতে পারে যাদের বাস্তবিক অর্থেই সামর্থ নেই। কিন্তু যখন ব্যাপারটির প্রচলন হয়ে যাবে তখন তারা সামর্থ না থাকা সত্ত্বেও নিজেদের ইজ্জত রক্ষার্থে গাড়ির ব্যবস্থা করবে। যা তাদের জন্য অনেক কষ্টকর হয়ে যাবে। একটা গলদ কাজ যখন ধারাবাহিকভাবে চালু হয়ে যায় তখন তা থামানো অনেক কষ্টকর হয়ে উঠে। তাছাড়া গাড়ির আমার কোনো প্রয়োজনও নেই। আমি রিকশায় করে আসি। রিকশাঅলাকে ইচ্ছে করে দশ/বিশ টাকা বেশি দেই। অনেক আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন রিকশাচালক আছে, যারা পরিশ্রম করে খাবে, কিন্তু কারও দান গ্রহণ করবে না। তাদের দান করার এটি একটি উত্তম তরিকা। এমনিতে আল্লাহ তায়ালা আমাকে যে সম্পদ দান করেছেন তাতে আমি নিজের টাকায় প্রতিদিন গাড়ি করে আসতে পারি। কিন্তু আমি ইচ্ছে করে রিকশায় আসি। রিকশাঅলাকে দশ/বিশ টাকা বেশি দেয়ার চেষ্টা করি।

দরসে চিরকুট দেয়া হুজুর পছন্দ করতেন না। নিয়ম ছিলো, কারও কোনো প্রশ্ন থাকলে আসরের পর মজলিসে করবে। তবে বৃহস্পতিবার দোয়ার চিরকুট দেয়ার অনুমতি ছিলো। হুজুর প্রতি বৃহস্পতিবার দরস শুরু করার আগে বিশেষ দোয়া করতেন। মজা করে বলতেন, আমার দোয়ার দরজা বৃহস্পতিবারে খুলে। সুতরাং বৃহস্পতিবার ছাড়া অন্য দিন কেউ চিরকুট দিও না।

আমাদের বছর দুইবার নাম ঘোষণা করায় দাওরায় সর্বমোট ছাত্রসংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ১৭ শ। সবার একসাথে দরস হতো। এটা হুজুরের ভীষণ অপছন্দ ছিলো। হুজুরের কথা হলো, ছাত্র বেশি নেয়া হলে তাদের ভাগ ভাগ করে ক্লাস নেয়া হোক। তাহলে হবে দরস দরসের মতো। সব ছাত্র হুজুরের সামনে থাকবে। সবার অবস্থা হুজুরের জানা থাকবে। এখন এই সাড়ে ১৭ এর মধ্যে কে কাকে চিনবে? ব্যাস, এসে শুধু ওয়াজ মাহফিলের মতো কিছুক্ষণ তাকরির করে চলে যাই।

হুজুরের মতে এই সমস্যার মূল কারণ হলো, সারা ভারতে এখন দারুল উলুমে দাওরার কিতাব পড়ানোর মতো কোনো উস্তাদ নেই। অল্প কয়েকজন যারা আছেন তারা নিজ নিজ জায়গায় ব্যস্ত হয়ে গেছেন। এ কারণেই এখানে একসাথে সাড়ে ১৭ কে সামলাতে হচ্ছে।

হুজুর বলতেন, দাওরায় ছাত্র বেশি নেয়ার চল শুরু হয়েছে শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানী রহ. এর সময় থেকে। কাশ্মীরী রহ. সময়ে দাওরায় ছাত্র হতো ত্রিশ থেকে সর্বোচ্চ পয়ত্রিশজন। সবাই কাশ্মীরী রহ. এর চোখের সামনে থাকতেন। তিনি দরসে এসে প্রথমে সবার দিকে এক নজর তাকাতেন। এরপর হঠাৎ একজনকে ইবারত পড়তে বলতেন। কারও ইবারতে সমস্যা মনে হলে তাকে নিচের দিকে উপযুক্ত কোনো জামাতে (তার দুর্বলতা অনুযায়ী) পাঠিয়ে দিতেন।

(হুজুরের এই বর্ণনার সাথে মাওলানা গিলানীর বিবরণের মিল পাওয়া যায় না। মাওলানা গিলানী লিখেছেন, তাদের সাথে দাওরায় প্রায় ৭০/৮০ জন ছাত্র ছিলো।)

আব্দুল হক আজমি রহ. এর দরস

দারুল উলুমে জোহরের নামাজ হয় হানাফী মাযহাব মুতাবেক তাবরীদ করে। গরমকালে জামাত হয় পৌনে তিনটা থেকে তিনটায়। অবশ্য ইন্ডিয়াতে যে গরম তাতে দেড়টায় জামাত পড়তে নিজের সাথে রীতিমত যুদ্ধ করতে হবে।

খাবারের সময় হচ্ছে পালনপুরী সাহেবের দরসের পর। দারুল উলুমের নিয়ম অনুযায়ী সাড়ে দশটায়/এগারোটায় খানা দিয়ে দেয়। কিন্তু আমরা দরস শেষ করে যেতে যেতে বারোটা বা তারচেয়ে বেশি বেজে যেত। খাওয়ার পর ঘুম। জোহর পড়ে সাথে সাথে বুখারী ছানীর দরস।

জোহরের পরের দরস ছিলো শাইখে ছানী আব্দুল হক আজমি রহ. এর। হুজুরকে হুইল চেয়ারে করে দরসে আনা হতো। আমরা হুজুরকে পেয়েছি একদম শেষ সময়ে। যখন তিনি শারীরিক এবং মানসিক দুইভাবেই দুর্বল হয়ে পড়েছেন। কথায় কথায় রেগে যেতেন। ছাত্রদের বকাঝকা করতেন। হাতও চালাতেন। কিল-ঘুষি চলতেই থাকতো। খাদেমদের উপর দিয়ে প্রচুর ঝড়ঝাপ্টা যেত। তবে ছাত্ররা ব্যাপারটায় মজা পেত। হুজুর যত ধমক দিতেন ছাত্ররা তত হেসে উঠতো। আমরা বেশিদিন হুজুরকে পাইনি। শশমাহী পরীক্ষার ছুটিতে হুজুর ইন্তেকাল করেন।

আমাদের যেসব উস্তাদ আজমী সাহেবের কাছে তার যৌবনে পড়েছেন তাদের কাছে শুনেছি, তিনি প্রতিদিন সন্ধার পর গোসল করে দরসে আসতেন। লম্বা সময় নিয়ে পড়াতেন। হুজুরের ক্ষেত্রে প্রসিদ্ধ ছিলো, তিনি উমদাতুল কারীর হাফেজ। দরসে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা মুখস্ত বলে যেতেন। আমাদেরও সময়ও দরসে হুজুর যে কিতাব নিয়ে আসতে সেটি ভর্তি ছিলো হুজুরের নিজের কলমে লেখা হাশিয়া।

হুজুরের ইন্তেকাল পরবর্তী দোয়া অনুষ্ঠানে হাবিবুর রহমান আজমি সাহেব বলেছিলেন, হুজুর তো শেষ জীবনে অনেক সফর-প্রোগ্রাম করতেন। কিন্তু এটি তার আসল রূপ ছিলো না। তিনি ছিলেন সম্পূর্ণরূপে কিতাবের মানুষ। কখনও রাত আড়াইটার আগে ঘুমুতেন না। প্রচুর মুতালায়া করতেন। তোমরা তাকে চিনো না। চিনবেও না। কারণ তাঁর সেই জীবন তোমরা দেখোনি। বলতে বলতে তিনি কেঁদে ফেলেন। হাবিবুর রহমান আজমি সাহেবের মাদরাসায় আসা আব্দুল হক আজমি সাহেবের হাত ধরে। তাই তার সম্পর্কে হাবিবুর রহমান সাহেব সবচেয়ে ভালো জানেন।

আজমি সাহেবের ব্যাপারে প্রসিদ্ধ ছিলো, তিনি মুস্তাজাবুদ দাওয়াত। মাদানী রহ. এর পূর্ণাঙ্গ ছাত্রদের মধ্যে তিনিই ছিলেন সর্বশেষ। এখন আছেন আল্লামা কমরুদ্দীন সাহেব। তিনি মাদানী রহ. এর শেষ বছরের শাগরিদ। মাত্র তিন মাস পড়ছেন মাদানী রহ. এর কাছে। এরপর তিনি পড়ানো বন্ধ করে দেন।

নেয়ামতুল্লাহ আজমি সাহেবের দরস

জোহরের পরের সর্বশেষ দরস ছিলো আবু দাউদ শরীফের দরস। শশমাহী পর্যন্ত আবু দাউদ প্রথম খণ্ড (কিতাবুত তহারত) আর শশমাহীর পর দ্বিতীয় খণ্ড কিতাবুল জিহাদ। প্রথম খণ্ড ছিলো বাহরুল উলুম নেয়মতুল্লাহ আজমি সাহেবের ভাগে। দেশে থাকতে দেওবন্দের যে দুইজন উস্তাদের কথা বেশি বেশি শুনেছি তাদের একজন হলেন পালনপুরী রহ. আর অপরজন বাহরুল উলুম। তাঁর ইলমি বিশালতার পাশাপাশি সবাই একথাও বলতেন, তাঁর কথা বুঝা যায় না। এত এত ইলম, কিন্তু সেখান থেকে উপকৃত হওয়া যায় খুবই কমই। হুজুরের মুখে সমস্যা ছিলো। কথা স্পষ্ট বুঝা যেত না। তাছাড়া বছরের শুরুর দিকে আমরা যে জায়গায় বসি সেখান থেকে হুজুরের কথা বুঝা ছিলো প্রায় অসম্ভব। গভীরভাবে কান পাতলে অল্পবিস্তর বুঝা যেত।

হুজুরের দরস সম্পর্কে একজন বলেছিলেন, তিনি ক্রমাগত হাওয়ালা নকল করে যান। ইবনে হাজার এরকম বলেছেন, আইনি এর এর এমন জবাব দিয়েছেন..।

কিন্তু আমি যে কয়দিন হুজুরের দরসে বসেছি তাতে এই বিবরণের তেমন মিল পাইনি। ক্রমাগত হাওয়ালা নকল করার কোনো প্রবণতাই হুজুরের মাঝে দেখিনি। তিনি একেকটি হাদীস হল করার জন্য প্রথমে হাদীসের সবগুলো আতরাফ জমা করতেন। এরপর মুহাদ্দাসানা শান নিয়ে হাদীসগুলোর পারস্পরিক তাত্ববীক প্রদান করতেন। হ্যা, তার উচ্চাঙ্গের দরস এবং আওয়াজের জড়তা- এসব কারণে সর্বস্তরের ছাত্ররা তার থেকে উপকৃত হতে পারে না।

আমরা হুজুরকে খুব কম পেয়েছি। কুরবানির আগেই তিনি দরস বন্ধ করে দেন। সে বছর তিনি হজ করেছিলেন। হজে যাওয়ার আগের দিন গলার সমস্যার কারণে দরস করাতে পারেননি। হজের পর এসে গলার অপারেশন করান। তবু গলা ঠিক হতে হতে প্রায় বছর শেষ হয়ে যায়।

হজে যাওয়ার আগের দিনের দরসের দৃশ্য এখনও আমার চোখে জ্বলজ্বল করছে। হুজুর কখনও দরস মিস করেন না। যতো যাই হোক, তিনি লাঠি ঠক ঠক করে ঠিকই চলে আসবেন। সেদিনও আসলেন। কয়েকবার চেষ্টা করলেন কথা বলতে। কিন্তু গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না। অতিরিক্ত চেষ্টা করলে যে আওয়াজ আসছে তা ছাত্রদের কেবল হাসির খোরাক যুগাচ্ছে। বিশাল দরসগাহে নানান কিসিমের ছাত্র। আর আন্ডারগ্রাউন্ড হওয়ায় এবং সংখ্যা বেশি হওয়ায় এখানে অল্প আওয়াজও অনেক বড় করে শোনা যায়। ফলে হাসিগুলোও খুবই বিশ্রিভাবে শোনা যাচ্ছিলো। হুজুর বার কয়েক চেষ্টা করে এরপর মাইক্রোফোন খুলে ফেলেন। আস্তে করে নেমে হেঁটে চলে যান। আমি অনেকক্ষণ হুজুরের গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কেমন কষ্টে ভরে উঠলো ভেতরটা। যে মানুষটি এই বয়সেও ঝড়, বৃষ্টি-বাদল সব উপেক্ষা করে নিয়মিত দরসে হাজির হয়ে যান, কখনও কোনো অজুহাতে দরস মিস করেন না, আজ তিনি ফিরে যাচ্ছেন দরস না করেই। কে জানত এই ফাতরায় এটিই ছিলো হুজুরের শেষ দরস। এরপর আবার হুজুরকে ফিরে পেতে চলে যাবে এতগুলি মাস!

হাবিবুর রহমান আজমি সাহেবের দরস

পালনপুরী এবং বাহরুল উলুমের নাম তো দেশেই অসংখ্যবার উস্তাদদের মুখে শুনেছি। দারুল উলুম যাওয়ার পর আরও যে দুইজন ব্যক্তির মাধ্যমে আমি বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছি তাদের একজন মাওলানা হাবিবুর রহমান আজমি আর অপরজন মাওলানা ইউসুফ তাওলাভি। আমরা যে বছর মেশকাত পড়ি সে বছর প্রথমবার তিনি বাংলাদেশে আসেন। হুজুরের নাম তখনই প্রথম শুনি।

কুরবানির পরও যখন নেয়ামতুল্লাহ সাহেবের গলার কোনো উন্নতি হলো না তখন তার পরিবর্তে আবু দাউদ প্রথম খণ্ডের যিম্মদারী দেয়া হয় হাবিবুর রহমান আজমি সাহেবকে। আমি তো বছরের শুরু থেকেই হুজুরের দরসে বসার জন্য উন্মুখ হয়ে আছি। জানতাম শশমাহীর আগে আর সে সুযোগ হবে না। শশমাহীর পর আল্লাহ তাওফীক দিলে আবু দাউদ ছানীর দরসে বসা হবে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা অপ্রত্যাশিতভাবে শশমাহীর আগেই সেই সুযোগ করে দিলেন।

ফার্সিতে একটা প্রবাদ আছে- ‘হার গুলে রা রঙ্গ ও বুঁযে দীগারস্ত!’ অর্থাৎ, প্রত্যেক ফুলেরই আলাদা খুশবু থাকে। এখানেও সেই একই দৃশ্যের অবতারণা হলো। নেয়ামতুল্লাহ সাহেবের মতো মুহাদ্দিসকে আমরা হারিয়েছি, (যাকে পারিভাষিক অর্থেই মুহাদ্দিস বলা যায়) এর পরিবর্তে আল্লাহ আমাদের দিয়েছেন হাবিবুর রহমান আজমিকে।

আবু দাউদের দরসে হুজুর প্রথমে রাবীদের নিয়ে আলোচনা করতেন। সনদ নিয়েদীর্ঘ আলোচনা করতেন। এরপর মতন ব্যাখ্যা করতেন। হুজুরের দরসের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হলো, এখানে অনেক কিতাবের তাআ’রূফ লাভ করা যায়। দরসে তিনি প্রচুর কিতাবের হাওয়ালা দেন। কিতাবগুলোর সাথে ছাত্রদের পরিচয়ও ঘটিয়ে দেন। কোন কিতাবের কি বৈশিষ্ট্য, কোনো আলোচনার জন্য কোন কিতাবটি বেশি উপযোগী হবে এসব বিস্তারিত আকারে আলোচনা করেন। এছাড়া হাদীসের সাথে জড়িত ব্যক্তি, স্থান, পশু-পাখি সবার পরিচয় দেন বিস্তৃত আকারে।

পালনপুরী সাহেবের মতো হুজুরও অনেক সময় অঙ্গভঙ্গি করে মাসআলা বুঝিয়ে থাকেন। ছাত্ররা হাসে। তিনি নিজেও হাসেন। অবশ্য পুরো দরসেই হুজুরের মুখে হাসি লেগে থাকে। এমনভাবে পড়ান, মনে হয় যেন কোনো মজার গল্প করছেন। অথচ তিনি রাবীদের জটিল ব্যাপার স্যাপার নিয়ে কথা বলছেন। হুজুর হয়ত ভাবেন, তিনি যতটা মজা পাচ্ছেন ছাত্ররাও তেমনই মজা পাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। হুজুরের দরসে ছাত্র সমাগম থাকতো সবচেয়ে কম। এমনিতেও আসরের আগ মুহূর্তটা খুবই অলস একটি সময়। তার উপরে এইসব শাস্ত্রীয় আলোচনা ছাত্ররা খুব বেশি উপভোগ করতে পারতো না। অবশ্য ব্যতিক্রমও আছে। একজনকে এমনও বলতে শোনা গেছে, সে হুজুরের দরসে যতটা আগ্রহ নিয়ে বসে পালনপুরী সাহেবের দরসেও অত আগ্রহ নিয়ে বসে না।

আসলে হুজুরের দরস হজম করার মতো অতটা মজবুত ইলমি ভিত সবার থাকে না। ফলে তারা বিরক্তিবোধ করে। তাছাড়া বেওবন্দে পড়তে যায় কয়জন? বেশিরভাগই তো যায় ‘বরকত’ এর জন্য। বরকত লাভের জন্য তো আর এই দুর্বোধ্য শাস্ত্রিয় আলোচনা শোনার প্রয়োজন নেই। হাবিবুর রহমান আজমি সাহেবের মূল দরস হলো শশমাহী পরীক্ষার পর। একই সময়ে। আবু দাউদ ছানী কিতাবুল জিহাদ। এখানে অবশ্য তিনি সনদ নিয়ে আর তেমন আলোচনা করেন না। একই অবস্থা মুসলিম ছানীর ক্ষেত্রেও। শশমাহীর পরও নেয়ামতুল্লাহ সাহেব সুস্থ না হওয়ায় তারই অনুরোধে এই ঘন্টাও হাবিবুর রহমান সাহেকে দেয়া হয়। ফলে আমরা হুজুরের কাছে সবচেয়ে বেশি কিতাব পড়ার সুযোগ লাভ করি।

মুহতামিম সাহেবের দরস

মুহতামিম মাওলানা আবুল কাসেম নুমানী সাহেবের অংশে ছিলো তিরমিযি প্রথম খণ্ড, কিতাবুল বুয়ু থেকে শেষ পর্যন্ত। মাগরিবের পর সপ্তাহে চার দিন হুজুরের দরস। বাকি দুই দিন মুজিবুল্লাহ সাহেবের। মুহতামিম সাহেবের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, তাঁর আওয়াজ একদম পরিষ্কার। প্রতিটি শব্দ স্পষ্ট বুঝা যায়। ফলে ছাত্ররা দরসে বসে মজা পায়। এছাড়া হুজুরের ব্যক্তিত্বও তার দরসে ছাত্রদের টেনে নিয়ে আসে। এত চমৎকার একজন মানুষ! পালনপুরি সাহেবের পর হুজুরের দরসে সবচেয়ে বেশি ছাত্র সমাগম হতো।

দাওরায় প্রত্যেক কিতাব শেষ হওয়ার পর ছাত্ররা সেই দরস এবং উস্তাদ সম্পর্কে স্বরচিত কাসিদা গায়। কিন্তু মুহতামিম সাহেবের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হয়। ছাত্ররা উল্টো তার থেকে শুনতে চায়। ফকিহুল মিল্লত মুফতি মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহী রহ. এর একটি কাসিদা আছে। যেখানে সৃষ্টির সবকিছুতে তিনি আল্লাহকে দেখতে পাওয়ার কথা বলেছেন। মুহতামিম সাহেব এটি গেয়ে শোনান। ছাত্ররা বারবার তার থেকে এটি শুনতে চায়। হুজুরের কণ্ঠে ভিন্নরকম মাধুর্য আছে। যা তার তেলাওয়াত এবং তারানার মাধ্যম প্রকাশ পায়।

মাওলানা মুজিবুল্লাহ সাহেবের দরস

মাগরিবের পরের অপর দরস ছিলো শরহু মাআ’নিল আছার। মাওলানা মুজিবুল্লাহ সাহেবের অংশে ছিলো এই কিতাবটি। যারা হুজুরের লেখা শরহে আকাঈদের শরাহ ‘বয়ানুল ফাওয়ায়িদ’ পড়েছেন তারা সম্ভবত এই নামের সাথে পরিচিত থাকবেন। শরহে আকাঈদের মতো কিতাবের যিনি সহজবোধ্য শরাহ লিখেন, অন্তত জটিল বিষয় সহজ করে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে তার বিশেষ যোগ্যতার কথা আলাদা করে বলার প্রয়োজন হয় না।

দাওরার কিতাবগুলোর মাঝে মুকাদ্দিমাতুল মুসলিম এবং তহাবি শরিফের ইবারতকে জটিল হিসেবে গণ্য করা হয়। ইমাম তহাবি ‘ক্বলা আবু জাফর’’ বলে নিজের যে কথাগুলো বলেছেন সেগুলো উদ্ধার করা একটি জটিল কাজ। সেই কাজটি তিনি করে দিতেন অত্যন্ত নিপুণভাবে। হুজুরের উচ্চারণে সব সময় এমন একটা ভাব থাকতো, যাতে কখনওই মনে হবে না তিনি জটিল কোনো বিষয় পড়াচ্ছেন। খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে পড়িয়ে যান। ফাঁকে ফাঁকে প্রচুর রসিকতা করেন।

ব্যক্তিগত জীবনে এই মানুষটি খুবই সাধাসিধে জীবন যাপন করেন। রাস্তা দিয়ে যখন হেঁটে যান অপরিচিত কারও পক্ষে ধারণা করাও অসম্ভব যে, তিনি দারুল উলুম দেওবন্দের মুহাদ্দিস। নিজের বাজার নিজেই করেন। বাজার হাতে নিয়ে আনমনে রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে চলে যান। চলাফেরায় কোনো কৃত্তিমতা নেই। কোনো আলাদা শান নেই। যেন শানহীনতাই তার শান। মানুষটিকে আমার ভালো লাগত। এতটা সরল চাল-চলন এবং এমন মজার মানুষ- তাকে ভালো না লাগার কোনো কারণ নেই।

মাওলানা আব্দুল খালেক সাম্ভলি সাহেবের দরস

দারুল উলুমে দুইজন নায়েবে মুহতামিম। আব্দুল খালেক মাদরাসি এবং আব্দুল খালেক সাম্ভলি। দুইজনের দরসই ইশার পর। ইশার পর সারা বছর মিলিয়ে মোট তিনজন দরস করেন। শুরুতে সাম্ভলি সাহেব। এরপর মাস দুয়েক আমিন পালনপুরি সাহেব। আর এর পর থেকে বছরের শেষ পর্যন্ত মাদরাসি সাহেব। সাম্ভলি সাহেবের ভাগে ছিলো ইবনে মাজাহ। নেসাব মুকাদ্দিমা। হুজুর খুবই মজার মানুষ। তাছাড়া তার উচ্চারণে এক ভিন্নরকম তান আছে। শুনতে মজা লাগে। এমনিতে তিনি খুবই বিশুদ্ধভাষী। উর্দু এবং আরবি দুই ভাষায়ই তার বিশেষ দক্ষতা রয়েছে। অনুবাদে চমৎকার শব্দ প্রয়োগ করেন। শব্দের তাহকিক করেন খুলে খুলে। আর ফেরাকে বাতেলা তার বিশেষ আগ্রহের বস্তু। মুনাযারাও করেন শুনেছি। ইবনে মাজাহর মুকাদ্দিমা তাই তার জন্য খুবই উপযোগী একটি অধ্যায়। সুন্নত ও বিদআতের আলোচনা এবং বিভিন্ন ফিরাকে বাতেলা সম্পর্কে মনখুলে আলাপ করার সুযোগ পান। বিভিন্ন মজার মজার ঘটনা বলে দরসকে প্রাণবন্ত করে রাখেন। পাশাপাশি ঘটনার আড়ালে হাদীসের মূল বার্তাটি ছাত্রদের মনে গেঁথে দেন। তাকে দেখলে আমাদের মালিবাগের লালবাগ হুজুরের কথা মনে পড়ত।

আমিন পালনপুরি সাহেবের দরস

আমিন পালনপুরী সাহেবের নেসাব ছিলো নাসাঈ কিতাবুত তহারাত। হুজুর শুরুর কয়েক দিন কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। পরে সেই আলোচনাগুলো রিসালা আকারে প্রকাশও হয়। হুজুর শুরুতেই যে বিষয়টিতে সবাইকে বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন সেটি হলো, ‘পড়হো কম, সূচো যিয়াদাহ!’ অর্থাৎ, পড়ো কম, চিন্তা করো বেশি বেশি। তিনি সবাইকে দেওবন্দিয়তের সংজ্ঞা মুখস্ত করিয়েছেন- ‘দেওবন্দিয়ত নাম হে ফিকরি আওর আমলি ই’তিদাল আওর কিতাব ও সুন্নত কা সহীহ ফাহম হাসেল করনা।’

তিনি দেওবন্দকে ‘মাকতাবে ফিকর’ বলতে নিষেধ করতেন। বলতেন, এতে ফের্কা তৈরি হয়। দেওবন্দ কোনো ফের্কা নয়। কোনো আলাদা মাকতাবে ফিকিরের নাম নয়। আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতের মত ও পথই দেওবন্দিয়ত। এটাকে মাকতাবে ফিকির বলে আলাদা ফের্কা হিশেবে উপস্থাপন করবে না।

তিনি নিজে ‘পড়হো কম আওর সূচো যিয়াদাহ’ এর উপর আমল করেন। এর উপর আমল করে তিনি তরজমায়ে শাইখুল হিন্দের অনেকগুলো অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য বের করেছেন। দরসে সেগুলো খুলে খুলে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলতেন, বেশি বেশি তরজমায়ে শাইখুল হিন্দ পড়বে। তাহলে দেওবন্দিয়ত শিখতে পারবে। তরজমায়ে শাইখুল হিন্দের ব্যাপারে তার উৎসহামূলক আলোচনা শুনে ছাত্ররা তর্জমাটি সংগ্রহ করতে চাইলো। কিন্তু পাবে কোথায়? হুজুর তখন নিজের মাকতাবা থেকে সেটি ছাপানোর ব্যবস্থা করলেন।

হুজুর যদিও হাদীসের ইবরত নিজে পড়েন না, কিন্তু ভাইয়ের মতোই তিনিও দ্রুত ইবারত পড়া পছন্দ করেন না। আর সুর করে ইবারত পড়তে শুনলে তো রীতিমত ক্ষেপে যান। তার দরসে ইবারত পড়তে হতো ধীরগতিতে, রষকষহীন স্বরে। রষহীন স্বরেই তিনি ভিন্নরকম রস খুঁজে পেতেন। হাদীসে নববীর রস।

তিনি লম্বচৌরা তাকরির করতেন না। সংক্ষেপে শুধু হাদীস ব্যাখ্যা করে সামনে এগিয়ে যেতেন। কথা বলেন অনেক দ্রুত। কথার মধ্যে কেন যেন বক্তা বক্তা একটা ভাগ চলে আসে। তবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেন। ইলমি জীবনের পাশাপাশি ফিকরিভাবেও উপকৃত হওয়ার থাকে খোরাক রয়েছে হুজুরের দরসে।

আব্দুল খালেক মাদরাসি সাহেবের দরস

দরস সংক্রান্ত আলোচনার সবচেয়ে জটিল এবং নাযুক আলোচনা হচ্ছে মাদরাসি সাহেবের দরস নিয়ে আলোচনা করা। এই মানুষটিকে আমি কোন শব্দ দিয়ে বাঁধবো? আমাদের মুরুব্বি উস্তদগণও হুজুরের কাছে শামায়েলে তিরমিযি পড়েছেন। এখনও তিনি এই কিতাবটি আঁকড়ে আছেন। অথচ চাইলে অনায়াসেই বড় কোনো কিতাব বাগিয়ে নিতে পারেন। নিজেই একবার রসিকতা করে বলেছিলেন, ‘মুতাকাল্লিমের পড়ানোর কোনো শখ নেই। যদি থাকতো তাহলে আমি পালনপুরের মুহাদ্দিসকে কখনও বুখারী পড়াতে দিতাম না।’

পালনপুরী সাহেবের সাথে তার বিশেষ হৃদ্যতা ছিলো। তারা নিজেরা খুব মজা করতেন।

তার দরসের দুটি দিক অনেক প্রসিদ্ধ। একটি তার হাস্য রসিকতা, অপরটি ইশকে রাসুল। তিনি আমাদের সুলাইমান নদভী রহ. এর ‘খুতুবাতে মাদরাস’ পড়ার জন্য কুল্লামার কসম খেতে বলেছিলেন। কিতাবটি আগে থেকেই কিনে রাখলেও পড়া হয় হুজুরের এই কুল্লামার কসমের কথা শুনেই। ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি ইশকে রাসুলের এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। তিনি হাঁটেন, যেভাবে হাদীসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাঁটার বিবরণ এসেছে- ‘যেন উঁচু স্থান থেকে নিচে নামছেন।’ দরসে যখন ইশকে রাসুল নিয়ে কথা বলেন, আবেগে প্রায়ই তার কণ্ঠ বন্ধ হয়ে যায়। সে এক অভাবনীয় দৃশ্য! হুজুর হাত নাড়ছেন, কিছু বলার চেষ্টা করছেন, কিন্তু আবেগে কণ্ঠ দিয়ে আওয়াজ আসছে না।

তিনি শামায়েল শুধু পড়ান না, শামায়েলকে মর্মে মর্মে অনুধাবন করেন এবং নিজের মধ্যে ধারণ করেন।

আল্লাহ তায়ালা তাকে বিশেষ কিছু যোগ্যতা দান করেছেন। তিনি একজন স্বশিক্ষিত ইঞ্জিনিয়ার। দারুল উলুমের মসজিদে রশীদ এবং শাইখুল হিন্দ একাডেমি, কুতুবখানা ও দরসগাহের নতুন ইমারত- যা তিনি তৈরি করেছেন ভারতের পার্লামেন্টের আদলে- এই সবই তার সেই বিশেষ যোগ্যতার অন্যন্য নিদর্শন।

তিনি উঠে এসেছেন একটি অনাথ আশ্রয় থেকে। এরপর নিজ যোগ্যতা বলে আজ এই পর্যায়ে উন্নিত হয়েছেন। আজ তিনি দারুল উলুমের একজন অপরিহার্য ব্যক্তিত্ব। ভাইবোন সবার পড়াশোনা এবং বিবাহের ব্যবস্থা করেছেন। এতসব কিছু করতে গিয়ে নিজের আর বিয়ে করা হলো না। দারুল উলুমের সবচেয়ে সুঠামদেহী এবং উন্নত রুচির অধিকারি তিনি। যারা তার কামরায় গিয়েছে তারা তার উন্নত রুচির প্রশংসা করতে বাধ্য। আল্লাহ তায়ালা এই ছায়াটিকে যত দীর্ঘায়িত করবেন দারুল উলুুমের জন্য তা ততই মঙ্গলজনক। ছায়াটির দীর্ঘায়ু কামনা করছি।

মাওলানা ইউসুফ তাওলাভী সাহেবের দরস

ইউসুফ তাওলাভী সাহেবের যিম্মায় ছিলো মুআত্তা মালেক। দরসের সময় হলো শুক্রবার। কিন্তু পুরো ফাতরায় একবারের জন্যও শুক্রবারে দরস করেছেন কি না সন্দেহ আছে। তিনি সুযোগের সন্ধানে থাকতেন। কোনো ঘণ্টা খালি পেলে ঢুকে পড়তেন। এভাবে যদিও হুজুরের দরস ছিলো সপ্তাহে দুইদিন, কিন্তু প্রায় সপ্তাহেই এরচেয়ে বেশিবার দরস করতেন।

হুজুর প্রথম দরস শুরু করেন আরবিতে। আমাদের আগের বছরগুলোতেও নাকি আরবিতেই করেছেন। কিন্তু আমাদের বছর কয়েকজন পারচা পাঠালো যেন তাকরির উর্দুতে করেন। ফলে হুজুর আরবি তাকরির বন্ধ করে দেন। এতে কয়জনের লাভ হয়েছে জানি না। কিন্তু ক্ষতি হয়েছে আমার মতো বাংলাদেশীদের। হুজুরের মুখে জড়তা আছে। কথা স্পষ্ট বুঝা যায় না। আরবিতে বললে একটু বুঝা যেত। উর্দুতে শুরু করার পর সেটুকুও অস্পষ্ট হয়ে যায়। তবে কাছাকাছি বসলে বুঝা যেত।

হুজুরের ক্ষেত্রে আমার একটি ব্যক্তিগত একটা মূল্যায়ন আছে। আমি মেশকাতের বছর মানাজির আহসান গিলানীর ‘এহাতায়ে দারুল উলুম মে বীতে হুয়ে দিন’ পড়েছিলাম। দেওবন্দে গিয়ে আবার পড়ি। হুজুর যে সময় দরস শুরু করেন সে সময় কিতাবটি আমার তাজা তাজা পড়া। মাওলানা গিলানী কাশ্মীরী রহ. এর দরসের যে চিত্র এঁকেছেন সেগুলো আমার চোখের সামনে জ্বলজ্বলে হয়ে আছে। হুজুরের দরসে বসলে বারবার শুধু সেসব মনে পড়তো। কী অবলিলায় অনবরত বিভিন্ন কিতাবের ইবারত মুখস্ত শুনিয়ে যাচ্ছেন। কখনও পূর্ণ আধা পৃষ্ঠা বা তারচেয়েও বেশি। কাশ্মীরী রহ. দরসে বিভিন্ন শে’র আবৃতি করতেন। হুজুরও করেন। এক-দুই পংক্তি না, টাানা দীর্ঘ কবিতা পড়ে ফেলেন। কখনও আবার স্বরচিত কবিতা শোনান। পুরো দরস মনে হতো শুধু, এক উন্মত্ত সাগর ক্রমাগত গর্জন করে যাচ্ছে। এই সাগর ইলমের। এই সাগর বিদ্যার।

হুজুরের ব্যক্তিগত পাঠাগারে গিয়েছিলাম। দেখলে বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে এটা কারও ব্যক্তিগত পাঠাগার। বড় এক কামরা চারপাশ ভর্তি কিতাব। হুজুর আমাকে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ ছাত্রজীবন থেকে এই কিতাবপত্রের মাঝেই আছি। এর মাঝে থাকতেই আমার ভালো লাগে। সেদিন কথা প্রসঙ্গে আরও বলেছিলেন, আমি ছাত্রজীবন থেকেই উর্দু কিতাব তেমন পড়িনি। কিছু কবিতার বই পড়েছি শুধু। এখানে তুমি কিছু উর্দু কিতাব দেখতে পাবে। এগুলো বিভিন্নজনের দেয়া হাদিয়া।

হুজুরের দরসের অনেক ইতিবাচক দিকের সাথে কিছু নেতিবাচক দিকও আছে। হুজুরের দরস তুলনামূলক দুর্বল ছাত্রদের জন্য খুব বেশি উপকারী হয় না। তাছাড়া আলোচনাও কিছুটা আগুছালো। অথবা বলা যায়, হুজুর নিজস্ব ভঙ্গিতে সেগুলো উপস্থাপন করেন। হয়ত এটাই হুজুরের তারতীব। কিন্তু ছাত্ররা সেই তারতিবের সাথে বিশেষ পরিচিত নয় বলে তাদের কাছে সেগুলো আগুছালো মনে হয়। তাছাড়া আওয়াজ অস্পষ্ট বলেও খুব বেশি ইস্তিফাদা করা যায় না। তবে হুজুরের দরস থেকে নেয়ার মতো অনেক কিছুই আছে। প্রচুর মাওয়াদ পাওয়া যায় হুজুরের তাকরিরে।

আরশাদ মাদানী সাহেবের একটি দীর্ঘ সফরকে কেন্দ্র করে কিছুদিন তিরমিযি দ্বিতীয় খণ্ডের দরস হুজুর নিয়েছিলেন। হুজুর এই ক্ষেত্রেও তার সুযোগ সন্ধানী অভ্যাসের পূর্ণ প্রয়োগ করেন। সে সময় সম্ভবত দারুল উলুমে মজলিসে শূরার মিটিঙ চলছিলো। ফলে দরস তেমন হতো না। এই সুযোগটিই তিনি কাজে লাগান। সকাল, বিকাল, সন্ধ্যা রাত ঘন্টার পর ঘন্টা দরস চালিয়ে যেতেন। তিরমিযিতে সে সময় যে হাদীসগুলো যাচ্ছিলো সেগুলো বেশিরভাগই আদাব এবং আখলাক সম্পর্কিত। এই দরসে হুজুরের এক ভিন্ন ব্যক্তিত্বের পরিচয় পাওয়া যায়। সারা জীবনের মুতালায়ার সার সংক্ষেপ তিনি পেশ করেন সেই দরসগুলোতে। প্রত্যেকটি হাদীসের চমৎকার ব্যাখ্যা এবং শিক্ষা তুলে ধরেন। কিছু কিছু আলোচনা নোট করেছিলাম।

মাওলানা কারী উসমান সাহেবের দরস

কারী উসমান সাহেবের যিম্মায় ছিলো মুয়াত্তা মুহাম্মদ। শশমাহী পর্যন্ত শুক্রবার মুয়াত্তা মালেক, আর শশমাহীর পর মুয়াত্তা মুহাম্মদ। হুজুর অবশ্য শুধু শুক্রবারেই দরস করেছেন। হুজুরের দরসে খুব বেশি শরিক থাকা হয়নি। তাই তার দরস সম্পর্কে বিস্তারিত আর কিছু লেখা সম্ভব নয়। হাসিমুখের সদা হাস্যোজ্জ্বল এই মানুষটি অল ইন্ডিয়া খতমে নবুওত আন্দোলনের আমির। খতমে নবুওয়তের উপর হুজুরের আলোচনা শুনেছিলাম দারুল উলুমের ষান্মাসিক মুনাযারা অনুষ্ঠানে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা ছিলো। আরও একটি আলোচনা শোনা হয়েছিলো সালানা পরীক্ষার শেষে অনুষ্ঠত খতমে নবুওত কর্মশালায়। সেই আলোচনাও অনেক তথ্যবহুল এবং গুরুত্বপূর্ণ ছিলো।

ভর্তি পরবর্তী দিনগুলো

শুরু করেছিলাম প্রথম দরসের আলোচনা। এই ফাঁকে সব দরস সম্পর্কেই কিছু না কিছু বলা হয়ে গেলো। এবার আবার একটু পেছনের দিকে ফিরে যাই। ভর্তি হওয়ার পর থেকে আমার দিনের বেশিরভাগ সময় দরসগাহেই কাটে। মসজিদে রশিদ থেকে ছাত্তা, দূরত্ব কম নয়। বারবার এতদূর আসা-যাওয়া অনেক কষ্টের। তারচেয়ে ভালো দরসগাহেই বসে থাকা। বইটই পড়ে সময় কাটাই।

দরসগাহে বসে থাকার কারণে আরও অনেক কিছুই দেখার সুযোগ হয়। কতজন কতভাবে সময়গুলোকে খরচ করে! কেউ অবসর সময়ে ইংরেজি শিখে। কেউ বক্তৃতা প্র্যাকটিস করে। কেউ আবার মুতালায়ায় সময় কাটায়। মুতালায়ার বিষয়ও ভ্যারাইটিজ। নিজের আসন থেকে বাইরে পর্যন্ত হেঁটে আসতে কত ধরণের কিতাব যে নজরে পড়ে টেবিলে টেবিলে! এসব দৃশ্য ভেতরে অন্য রকম এক প্রভাব ফেলে। নানামুখী পড়াশোনার আগ্রহ তৈরি হয়।

আইডি কার্ড বিতরণ

দারুল উলুমে দাখেলাপ্রাপ্ত ছাত্রদের শেনাখতি কার্ড বা পরিচয়পত্র দেয়া হয়। এই কার্ড নানা কারণেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের দর্শনীয় স্থানগুলোতে এই কার্ড দেখিয়ে ফ্রি প্রবেশাধিকার বা অর্ধেক টিকেট লাভ করা যায়। ইন্ডিয়ার জাতীয় পরিচয়পত্র বা আধার কার্ড বানাতে চাইলে এই কার্ডের সাহায্যে আবেদন করা যায়। আমি একবার দিল্লিতে পুলিশের হাতে ধরা পড়তে গিয়ে এই কার্ড দেখিয়ে জান বাঁচিয়েছি। বাংলাদেশী ছাত্রদের জন্য এই কার্ড অনেকটা রক্ষাকবচের ভূমিকা পালন করে। এজন্যই অনেক দাখেলা-বিতাকা ছাত্ররা নকল কার্ডও বানিয়ে নেয়।

দারুল উলুমের বোর্ডিং

দারুল উলুমে খাবার দেয়া হয় দুইবেলা। সকাল দশটা-সাড়ে দশটার দিকে একবার, আসরের পর একবার। প্রত্যেকবার দুটি করে স্বাস্থ্যবান তন্দুর রুটি দেয়া হয়। সাথে গাঢ় করে রান্না করা বুটের ডাল। সপ্তাহে পাঁচদিন সাধারণ বুটের ডাল আর একদিন গোশত দিয়ে রান্না করা ডাল। সাধারণত যেদিন ডালের সাথে গোশত দেয়া হতো সেদিন আমি দেরি করে খানা তুলতে যেতাম। দারুল উলুমের নিয়ম হলো, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে খানা তুলতে না গেলে এরপর বোর্ডিংয়ের ভেতর থেকে গিয়ে আনতে হয়। সেক্ষেত্রে ডেকচি থেকে নিজ ইচ্ছেমতো তুলে নেয়া যায়।

সপ্তাহে একদিন দেয়া হয় মহিশের গোশতের বিরিয়ানি। জনপ্রতি মেপে মেপে এককেজি করে দেয়া হয়। প্রথমদিকে নুডুলস সদৃশ এই বিরিয়ানি খুবই অরুচিকর মনে হয়। খাওয়া যায় না তেমন একটা। কিন্তু এক সময় জিহ্বায় লেগে যায়। এরপর আমার মতো খাবার-বিমুখ মানুষও পুরো এককেজি খেয়ে উঠে পড়তে পারে। (হ্যা, আমি বেশ কয়েকবার পুরো এককেজি বিরিয়ানি সাবার করেছি। আমার খাদ্যরুচি সম্পর্কে যারা পরিচিত তাদের আমি কখনও এই তথ্য বিশ্বাস করাতে পারি না। আপনারা বিশ্বাস করবেন নিশ্চয়ই।)

বিকালের তরকারি সব সময় অপরিবর্তিত থাকে। মহিশের গোশত। সারা বছর এই খাবারের কোনো পরিবর্তন ঘটে না।

দারুল উলুুমে খানা তোলার নিয়ম হলো, খানা জারির তালিকায় নাম আসলে বোর্ডিং থেকে গিয়ে টিকেট সংগ্রহ করতে হয়। দুইবেলার জন্য দুটি টিকেট দেয়া হয়। টিকেটে নম্বর এবং একটিতে সুবহ ও অপরটিতে শাম লেখা থাকে। খানা তোলার জন্য বেশ কিছু সারি আছে। কোন টিকেটের ছাত্ররা কোন সারিতে খানা তুলবে সেটা নির্ধারণ করা থাকে। ভেতরে টিকেট রাখার জন্য বোর্ড করা আছে। একজন থাকেন টিকেটের দায়িত্বে। তার কাজ হলো ছাত্রদের থেকে এবেলার টিকেট নিয়ে যথাস্থানে রেখে সেখান থেকে পরেরবেলার টিকেট দিয়ে দেয়া। এরপর বাবুর্চিরা আমাকে রুটি এবং তরকারি দিয়ে দিবে।

বাংলাদেশের অনেক মাদরাসায় দুইবেলা খানার প্রচলন আছে। এখন কিছুটা কমেছে। এক সময় এর ব্যাপক প্রচলন ছিলো। সকাল নয়টা/দশটার দিকে একবার এবং আসরের পর একবার খানা দেয়া হতো। আমি নিজে এরকম দুই মাদরাসায় পড়েছি। দুইবারের সেই খানা আমরা চারবেলা খেতাম। তারা কাজটা দেওবন্দের অনুসরণে করেন কি না আমি জানি না। কিন্তু বেলা হিসেবে তারা দেওবন্দের অনুসরণ করলেও খাবারের মান রক্ষার ক্ষেত্রে দেওবন্দের কথা ভুলে যান। (যদিও দেশের ভিন্নতায় বেলা হিসেবেও দেওবন্দকে এক্ষেত্রে অনুসরণ করা উচিত কি না সেটাও ভেবে দেখার বিষয়।) আমি যে দুই মাদরাসায় পড়েছি তার একটার খাবারের অবস্থা ছিলো খুবই ভয়াবহ! আমার বোনের বাসা পাশে ছিলো। সেখান থেকে তরকারি আসতো। কয়েকজনকে একটু আধটু দিয়ে সেটা খেতাম। এছাড়া ছাত্ররা বাড়ি থেকে বোতল ভরে শুকনো মরিচ ভেজে নিয়ে আসতো। এসব দিয়েই ভাত চালাতে হতো।

বাংলাদেশে খাবারের মান খারাপ রাখার এই মনোভাব কোত্থেকে এসেছে জানি না। কোনো প্রতিষ্ঠানের যদি সামর্থ না থাকে তাহলে সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু এক সময় এই কাজটা করা হতো বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। আমাদের উস্তাদদের থেকে এক বিখ্যাত মাদরসার মুহতামিম সাহেবের গল্প শুনেছি। তিনি নাকি বলতেন, ‘আমার মাদরাসার ফান্ডে যে পরিমাণ টাকা আছে তাতে আমি চাইলে প্রত্যেক বেলা ছাত্রদের বিরিয়ানি খাওয়াতে পারি।’ কিন্তু সেখানে খাওয়ানো হয় প্রত্যেক বেলা পাতলা ডাউলের পানি। কারণ এতেই ইলম রয়েছে।

দারুল উলুমের এই খাদ্যতালিকা যে বর্তমান সময়ের আবিষ্কার তা নয়, মানাযির আহসান গিলানী তার সময়ের যে খাদ্যতালিকা উল্লেখ করেছেন সেটাও হুবহু এটিই। অর্থাৎ, সকালের ডাল আর বিকেলে মহিশের গোশত। মাওলানা গিলানী যখন পড়েছেন তখন দারুল উলুমের সদরুল মুদাররিসীন তার প্রথম সন্তান শাইখুল হিন্দ রহ.। উস্তাদ আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী রহ.সহ আরও দারুল উলুমের সূর্য সন্তানরা। যার অর্থ হলো, দারুল উলুমের শুরুযুগ থেকেই এই খাদ্যতালিকা চলে আসছে। সেখানে নিম্ন মানের খাবারে বরকত খোঁজার এই অদ্ভুত মানসিকতা আমাদের দেশে কোত্থেকে আসলো?

অবশ্য সময় পরিবর্তন হয়েছে। মানসিকতায়ও পরিবর্তন আসছে। বেশিরভাগ মাদরাসাই এখন এই মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসছে। কেউ সামর্থহীনতার কারণে না পারলে সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গির কারণে নিম্নমানের খাবার দেয়ার মানসিকতার পরিবর্তন ঘটছে। এটা অবশ্যই আশার খবর!

শুটকি কাহিনি!

এবার সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক একটা কথা বলি। কিছুক্ষণ আগে শুকনো মরিচের কথা বলতে গিয়ে কথাটা মনে পড়লো। দেওবন্দে আমরা যে কয়টা জিনিশ মিস করতাম তার মাঝে ছিলো, মুড়ি, মাছ এবং শুটকি। আমাদের ইসমাঈল ভাই একবার দেশ থেকে শুটকি আনালেন। তার দেখাদেখি আমিও শুটকি আর শুকনো মরিচ আনিয়েছিলাম। জাফর সাহেব হুজুর নিয়ে গিয়েছিলেন। হুজুর এই সূত্রেই আমাকে বিশেষভাবে চিনেন। আগে শুধু মালিবাগের ছাত্র হিসেবে চিনতেন। হাফিজুদ্দীন সাহেবের আত্মীয় হিসেবে চেনা শুরু করেন সেই শুটকির সূত্রেই।

আমি শুটকির কথা বলেছিলাম ইসমাইল ভাইয়ের দেখাদেখি। কিন্তু আমার বোন বিভিন্ন জাতের এত্তগুলি শুটকি আর শুকনো মরিচ পাঠিয়ে দেয়। আমার মালিবাগের সাথী এবং পরিচিত কয়েকজনকে সেই শুটকি দিয়ে দাওয়াত খাইয়েছিলাম। ইসমাইল ভাই শুটকির চমৎকার একটি রান্না করতে পারতেন। সবাই সেই শুটকি খেয়ে মুগ্ধ হয়েছিলো।

দেওবন্দ থেকে যখন চলে আসি তখনও কিছু শুটকি রয়ে গেছে। সেগুলো পরবর্তীদের জন্য রেখে আসি।

আঞ্জুমান ভিত্তিক নানা আয়োজন

দারুল উলুমে প্রত্যেক প্রদেশ ভিত্তিক আঞ্জুমান বা ছাত্র সংগঠন আছে। কোনো প্রদেশের একাধিক আঞ্জমানও আছে। আঞ্জুমানের দায়িত্বশীলরা ভর্তির পর দফতর থেকে সেই প্রদেশের ছাত্রদের নামের তালিকা নিয়ে আসে। এরপর তাদের নিয়ে নানান শিক্ষণীয় আয়োজন করে। বক্তৃত প্রশিক্ষণ, বইপাঠ, পাঠ প্রতিক্রিয়া, লেখালেখি সংক্রান্ত দিক-নির্দেশনা, রচনা প্রতিযোগিতা, মুনাযারা বিভিন্ন আয়োজন হয়ে থাকে। নওদারা ভর্তি থাকে বিভিন্ন আঞ্জুমানের পক্ষ থেকে প্রকাশিত দেয়ালিকা দিয়ে। এছাড়া বৃহস্পতিবার মাগরিবের পর নওদারা এবং লাল বিল্ডিং ও তার আশপাশের বিল্ডিংগুলো মুখরিত হয়ে উঠে আঞ্জুমান ভিত্তিক নানান আয়োজনে। আমি মাঝে মাঝে মুলসারি চত্বরে গিয়ে ঘুরাঘুরি করতাম। মালিবাগের দিনগুলো মনে পড়ত। নাহবেমীর থেকে মেশকাত, আট বছর মালিবাগে বক্তৃতা গ্রুপের সাথে ছিলাম। ফাঁকিবাজি অনেক করেছি। তবু এই আয়োজনটির সাথে অন্তর কোথায় যেন বাঁধা পড়ে গেছে। দারুল উলুমের এই আয়োজন তাই আমার ভেতর কেবল হাহাকার তৈরি করতো।

সাপ্তাহিক মুনাযারা

দারুল উলুমের আরেকটি আকর্ষণীয় আয়োজন হচ্ছে সাপ্তাহিক মুনাযারা। দারুল উলুমের শুবায়ে মুনাযারার অধীনে প্রতি সপ্তায় মুনাযারার আয়োজন হয়।

বছরের শুরুতে প্রথমে একটি উদ্ভোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এই অনুষ্ঠান সম্ভবত ছাত্রদের আকর্ষণ লাগানোর জন্য। অনুষ্ঠানটিও এমন ছিলো, যাতে যে কেউ আকর্ষণ বোধ করবেই। অনুষ্ঠান থেকে এই শু’বায় অংশগ্রহণে আগ্রহীদের ফরম সংগ্রহ করতে বলা হয়। ফরম জমা দেয়ার পর পরীক্ষা। শুরুতে নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর বক্তৃতা দিতে হবে। এরপর বিচারকগণ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করবেন। সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে তবেই মুনাযারায় অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে। এভাবে সারা দারুল উলুম থেকে বাছাইকৃত ছাত্রদের নিয়ে প্রস্তুত করা হয় মুনাযারা টিম।

প্রতি শুক্রবার বাদ জুমা মুনাযারা শুরু হতো। প্রথমে দায়িত্বশীল একজন ‘ওয়াজাহাতে মাবহাছ’ শিরোনামে আলোচ্য বিষয়ের উপর প্রাথমিক ধারণা প্রদান করেন। তাখাসসুসাতের ছাত্ররা এটি করে থাকেন। এরপর মুনাযারার শর্ত পড়ে শোনানো হয়। মুনাযারার নানান নিয়ম ও শৃঙ্খলা সংক্রান্ত শর্তের পাশাপাশি অন্যতম একটি শর্ত থাকে- মুনাযারা শেষে ভ্রান্ত পক্ষের তর্জুমান তার মাসলাক থেকে রুজু করবে।

এরপর শুরু হয় মুনাযারা। দারুল উলুমের কোনো উস্তাদ বা ওয়াকফ অথবা আশেপাশের অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের একজন উস্তাদ থাকেন বিচারক হিসেবে। প্রথমে এক পক্ষের তর্জুমান দাঁড়িয়ে তার দাবি উত্থাপন করে। এরপর অপর পক্ষকে সুযোগ দেয়া হয় সেই দাবির উপর কোনো প্রশ্ন থাকলে করতে। মুনাযারার মূল মজাটা হয় এখানেই। যার চাপার জোর আর সুদৃষ্টি যত বেশি, এই জায়গায় সে তত বেশি বাজিমাত করতে পারে। এই সিলসিলা কিছুক্ষণ চলার পর অপরপক্ষের তর্জুমান নিজের দাবি উত্থাপন করেন। এখানেও প্রতিপক্ষকে সেই দাবির উপর প্রশ্নের সুযোগ দেয়া হয়। এরপর দাবিকে দলিলসমৃদ্ধ করার পালা। উভয়পক্ষ পাঁচ মিনিট করে সময় পান তার দাবির পক্ষে দলিল উপস্থাপনের জন্য।

দলিল উপস্থাপন শেষ হওয়ার পর মুনাযারা সামনের দিকে এগিয়ে চলতে থাকে। প্রত্যেকবার তর্জুমান পাবেন তিন মিনিট এবং তার দলের একজন সদস্য পাবে পাঁচ মিনিট। মোট আট মিনিট করে প্রত্যেকবার প্রত্যেক ফরিক পাবে। তর্জুমান তার নির্ধারিত তিন মিনিটে প্রতিপক্ষের দলিল ও দাবির জবাব দিবেন। এরপর তার পক্ষের একজন দাঁড়িয়ে তার আলোচনা রাখবে। এরপর আবার অপর পক্ষের তর্জুমান দাঁড়িয়ে এই পক্ষের জবাব দিবে ও তার দলের একজন দাঁড়াবে। আবার এই পক্ষের তর্জুমান ও একজন সদস্য। এভাবে চলতে থাকবে। একটা নির্দিষ্ট সময় পর- মুনাযারার নির্ধারিত সময় যতটুকু- হকপন্থী মুনাযিরকে তার চূড়ান্ত বক্তব্য উপস্থাপনের সুযোগ দেয়া হবে। এরপর অপরপক্ষ দাঁড়িয়ে রুজু করবে।

মুনাযারা সাধারণত হয়ে থাকে বাতিল ও ভ্রান্ত ফের্কাগুলো সম্পর্কে। গাইরে মুকাল্লিদ, কাদিয়ানি, শিয়া, বেরেলভি, আহলে কোরআন, হিন্দুইজম, খৃস্টধর্ম ইত্যাদি বিষয়ে মুনাযারা হয়। দারুল উলুমের একেকটি মুনাযারায় শুধু তর্ক শেখা হয় না, সংশ্লিষ্ট মাসআলার আদ্যোপ্রান্তও জানা হয়ে যায়। মুনাযারায় উসুলে হাদীস, উসুলে ফিকহ সহ নানান ইলমি বিষয় নিয়ে কথা হয়। এর মাধ্যমে ইলমি ফায়দাও হয় যথেষ্ট পরিমাণে।

কুরবানির ঈদ

দেওবন্দের স্মৃতিচারণ অনেকটা রবারের মতো। যত টানি ততই দীর্ঘ হয়। কিন্তু হাতে সময় অনেক কম। তাই যতটা সম্ভব সংক্ষেপে বাকি কথাগুলো বলে সমাপ্তিতে পৌঁছে যাওয়ার চেষ্টা করবো। পরে কখনও সুযোগ হলে আরও অনেক কথা বলা যাবে।

কুরবানি উপলক্ষে মাদরাসা মোটামুটি দীর্ঘ কিছুদিন ছুটি থাকে। এই সময়ে ইন্ডিয়ান ছাত্রদের বেশিরভাগই বাড়িতে চলে যায়। মাদরাসার পক্ষ থেকে ছাত্রদের অর্ধেক মূল্য দিয়ে টিকেট সংগ্রহের ব্যবস্থা রয়েছে। সবাই নিজ নিজ শেনাখতি কার্ড দেখিয়ে মাদরাসার অফিস থেকে সেই ছাড়পত্র সংগ্রহ করে। বাংলাদেশী যেসব ছাত্র হিমাচল বা এ ধরণের কোনো দর্শনীয় এলাকার ঠিকানায় ভর্তি হয় তারা অনেক সময় এই সুযোগে হাফ ভাড়ায় সেই এলাকা ঘুরে আসে।

কুরবানি উপলক্ষে দেওবন্দে বেশ কিছু মহিশ কুরবানি হয়। গোশত ছাত্রদের মাঝে বণ্টন করে দেয়া হয়। লাইনে দাঁড়িয়ে শেনাখতি কার্ড দেখিয়ে গোশত সংগ্রহ করতে হয়। আমাদের আড্ডাখানা তখনও ছাত্তার সেই কামরা। কয়েকজন ততদিনে মাদরাসার ভেতরে চলে গেছে। কিন্তু আড্ডাখানার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি। সেই ঈদে ফয়সাল ভাইয়ের তৈরি কাবাবের স্বাদ এখনও জিহ্বায় লেগে আছে।

ঈদ উপলক্ষে আমরা কয়েক জায়গায় ঘুরতে যাই। ছুটির এক দিন আগে আমিনের সাথে গিয়েছিলাম কালিম সিদ্দিকী সাহেবের খানকায়। সিদ্দিকী সাহেবের সাথে দেখা হয়নি। তিনি হজ্বে চলে গেছেন। তবে চমৎকার আমলি পরিবেশে একটি রাত কাটানোর সুযোগ হয় সেখানে। সেই এক রাতের প্রভাব ভেতরে অনেক দিন অনুভব করি।

ঈদের আগে যাওয়া মাসূরী পাহাড়ে। সেখানে পাহাড়ি ঝর্ণায় গোসল করে আসি। ঈদের পর দিল্লি নিজামুদ্দীন মারকায, হুমায়ুনের মাকবারা, কুতুব মিনার, ইন্ডিয়া গেইট, শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহ. এবং তার সন্তানদের কবর এগুলো দেখা হয় একদিনে। শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহ. এর মাযার সংলগ্ন একটি মাদরাসা আছে। দাওরা পর্যন্ত মাদরাসা। পাশেই আঞ্জুমানে জমিয়তে উলামার অফিস। সেখানে একজন আলেমের সঙ্গে দেখা হয়। যিনি দেওবন্দের সাবেক উস্তাদ। বর্তমানে সেখানে বসে তাফসীরে মাযহারীর উপর পিএইচডি করছেন। আমাদের তার পিএইডি কাজের কিছু নমুনা দেখালেন। তার নিজের লেখা কিছু কিতাবও হাদিয়া দিলেন। বাচ্চাদের হাদীস মুখস্ত করার জন্য তার লেখা বিষয়ভিত্তিক কিছু সহজ হাদীসের সংকলন আছে।

আমাদের কাছ থেকে ঠিকানা রাখলেন। আব্দুল মালেক সাহেবকে চিনি কি না জিজ্ঞেস করলেন। তিনি নিজেও নাকি শায়েখ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দা রহ. এর কাছে হাদীস পড়েছেন। শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহ. এর মাকবারার কাছাকাছিই উস্তাদুল কুল মাওলানা মামলূক আলি রহ. এর কবর। পাশে মাদরাসায়ে রহিমিয়ার ধ্বংশাবশেষ এখনও বিদ্যমান আছে।

দিনভর সফর শেষে সন্ধায় আমরা নিজামুদ্দীন ফিরে আসি। পরদিন ট্রেনে করে আগ্রা। আগ্রার তাজমহল এবং লালকেল্লা দেখে আসি। তাজমহলে সময় বেশি কাটালেও আমাকে আকর্ষণ করে বেশি লালকেল্লা। বাইরে থেকে কেল্লার প্রাচীর নজরে পড়তেই যেন আলতামাশ আর নসীম হিজাজীর সব উপন্যাস একযোগে আমার চোখের সামনে মূর্ত হয়ে উঠে। এই স্মৃতিকথা আমি শুধু দেওবন্দ সংক্রান্ত আলোচনাই সীমাবদ্ধ রাখতে চাচ্ছি। তাই এসব নিয়ে আর কথা বাড়াচ্ছি না।

দেওবন্দে মহামারি

সে বছর কুরবানির ঈদের আগে-পরের সময়টা দেওবন্দে খুবই ভয়াবহ সময় চলছিলো। প্রতিদিন মুলসারীতে কারও না কারও জানাযা অনুষ্ঠিত হতো। কোনোদিন একাধিক জানাযাও হতো। কি এক মরার জ্বর ছড়িয়ে পড়েছিলো দেওবন্দের ঘরে ঘরে। সেই জরে অনেক প্রাণ কেড়ে নেয়। মাদরাসায় একাধিকবার দোয়ার আয়োজন করা হয়।

ছাত্রদের অনেকেও আক্রান্ত হয়। বাংলাদেশি বেশ কয়েকজন পরিচিত ছাত্রও জ্বরে পড়েছিলো। খুশির কথা হলো, বাংলাদেশি কেউ মারা যায়নি। শুধু সপ্তাহ দুয়েক ভুগে কয়েক হাজার টাকা গচ্ছা দিয়ে এরপর প্রাণে মুক্তি পায়। নইলে বিদেশ বিভুঁইয়ে তাদের নিয়ে কি বিপদেই না পড়তে হতো! যারা আক্রান্ত হয়েছে তাদের বক্তব্য ছিলো, এরকম ভয়াবহ জ্বরে এর আগে কখনও পড়িনি। আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ আমাকে সেই রোগ থেকে হেফাজত করেছিলেন।

স্বপ্নের রোয়াকে খালেদে মাথা গুঁজার ঠাই হলো

দারুল উলুমের ছাত্রাবাসগুলোর মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হচ্ছে দারে জাদীদের নতুন বিল্ডিংগুলো। একেকটি কামরায় দশজনের সিট। প্রত্যেকের জন্য সিমেন্টের উঁচু খাট। প্রতি দুই খাটের মাঝে আরও প্রায় এক খাট পরিমাণ ফাকা। বর্তমানের ভাষায় বললে বলা যায়, দুই সিটের মাঝে ‘সামাজিক দূরত্ব’ রাখা হয়েছে। প্রত্যেক খাটের সাথে আবার একটি করে স্টিলের আলমারি। সিটগুলো দুই সারিতে। প্রতি সারিতে পাঁচটি করে খাট। দুই সারির মাঝেও পর্যাপ্ত ফাকা রাখা হয়েছে। সেখানে লম্বা করে আরও এক সারি করে সিট দেয়া যাবে। সর্বসাকুল্যে আমাদের দেশের হিশেবে যে কামরায় কমপক্ষে ত্রিশজনের সিট দেয়া হয় সেই কামরায় মাত্র দশজনের সিট।

আকর্ষণের তালিকায় দ্বিতীয় সারিতে রাখা যায় রোয়াকে খালেদকে। রোয়াকে খালেদের সিটগুলো অত আকর্ষণীয় কিছু না। দারে জাদিদের মতো এখানে খাটের ব্যবস্থা নেই। আলমারিও কাঠের। তবে এর বিশেষত্ব হলো, এর অবস্থান অনেক সুবিধাজনক জায়গায়। বোর্ডিং অনেক কাছে। মসজিদে কদীম এবং সাত্তাও খুব বেশি দূরে নয়। দরসগাহ কিছুটা দূরে। তবে সহনীয়। মসজিদে রশিদের নিচের কামরাগুলো মসজিদ এবং দরসগাহের কাছে হলেও অতটা স্বাস্থ্যসম্মত নয়। আজমি মঞ্জিল বোর্ডিং থেকে দূরে। আর আসামী মঞ্জিল তো রীতিমত সীমান্তবর্তী এলাকায়। সেখান থেকে কোনো কিছুই কাছে নেই। না দরসগাহ, আর বোর্ডিং তো আরেক সীমান্তে।

রোয়াকে খালেদের প্রতি আমার আগ্রহ ছিলো ভিন্ন কারণে। অবশ্য সেই আগ্রহটা দাখেলা ইমতিহানের ফলাফল বের হওয়া পর্যন্তই। ফলাফল প্রকাশের পর তো সেই স্বপ্ন দেখাও আমার জন্য নিষিদ্ধ হয়ে গেলো।

রোয়াকে খালেদের বেশিরভাগ সিট ছিলো বিশেষ সিট। একেক কামরায় সর্বোচ্চ চারজনের সিট দেয়া হয়। যারা পরীক্ষায় বিশেষ ফলাফলে উত্তীর্ণ হতে পারবে তারাই হবে সেই সিটগুলোর উপযুক্ত বলে বিবেচিত হবে। এটিই ছিলো রোয়াকের প্রতি আমার আগ্রহের বিশেষ কারণ। ‘সিট কোথায়? রোয়াকে খালেদে!’ ব্যাপারটা ভাবতেই কেমন যেন একটা উত্তেজনা বোধ হতো।

সিট বণ্টনের সময় এলানে লেখা ছিলো, কেউ যেন দারে জাদীদে সিটের আবেদন না করে। আমাদের মতো গাইরে ইমদাদীদের জন্য তো আপাতত কোথাও সিট নেই। জাদীদ মাতবাখের কাজ চলছে। কাজ কখন শেষ হবে জানা নেই। কিন্তু তার আগেই ভিন্ন দিক থেকে সুযোগ চলে এলো। দারুল উলুমে কুরবানির পর একটা বিশেষ হাজিরা হয়। প্রত্যেক নাযেমে দারুল ইক্বামা নিজ নিজ ছাত্রাবাসে গিয়ে ছাত্রদের হাজিরা নেন। কেউ অনুপস্থিত থাকলে তার সিট কেটে দেন। এভাবে কুরবানির পর বেশ কিছু সিট খালি হয়ে যায়। সে সময় কেউ সিট পরিবর্তন করতে চাইলে আবেদন করে সেসব খালি সিটগুলোতে জায়গা করে নিতে পারে।

আমার যেহেতু সিটই নেই তাই এসব নিয়ে ভাবনাও নেই। কিন্তু এর মাঝেই একদিন পরিচিত এক ভাই, (তার নামটা বলা কি উচিত হবে? আমি যতটা অবলিলায় স্বীকার করছি আমাদের দাখেলা গাইরে ইমদাদি ছিলো, সবাই কি এভাবে প্রকাশ করা পছন্দ করবে? নাও করতে পারে। তাই আপাতত তার নামটা গোপন রাখছি।) শুনলাম সে রোয়াকে সিট পেয়ে গেছে। শুনে তো আমি আকাশ থেকে পড়লাম? ক্যামনে কি? তারও তো আমার মতোই গাইরে ইমদাদী দাখেলা। সে সিট পায় কিভাবে? যোগাযোগ করলাম তার সাথে। সে জানালো, গাইরে ইমদাদী ছাত্রদের ইযাফি সিট দেয়া হচ্ছে। প্রক্রিয়া খুবই সোজা। একটা দরখাস্ত দিলেই হবে। (ইযাফি সিট হলো, কামরার জন্য নির্ধারিত ছাত্রের অতিরিক্ত একজনের সিট দেয়া। সাধারণত সেই কামরায় অবস্থানরত কারো অনুরোধে এই অতিরিক্ত সিট দেয়া হয়। সেক্ষেত্রে সে কোনো অতিরিক্ত আলমারি পাবে না। অপরজনের সাথে আলমারি ভাগাভাগি করে নিতে হবে।)

আমি একজনকে দিয়ে দরখাস্ত লেখালাম। বার কয়েক নাযেম সাহেবের কামরার সামনে থেকে ঘুরে আসলাম। এখানে বলে রাখি, রোয়াকে খালেদের বিল্ডিং মোট চারটি। দুই পাশে তিনতলা করে দুটি বিল্ডিং। আর মাঝখানে একটি দুতলা বিল্ডিং। প্রত্যেকটির নাযেম আলাদা আলাদা উস্তাদ। একদম উত্তরদিকের বিল্ডিংয়ের দায়িত্বে আছেন আব্দুল্লাহ মারুফি সাহেব। এগুলো বিশেষ কামরা। মাঝের বিল্ডিংয়ে দুতলার কামরাগুলোও বিশেষ কামরা। এখানে দায়িত্বে আছেন মুফতি উসমান সাহেব। ফরম প্রদানের সময় যিনি ‘বাংলাদেশী’ ধরার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। মজার ব্যাপার হলো, ভর্তি কার্যক্রম শেষ হয়ে যাওয়ার পর তিনি ভিন্ন মানুষ হয়ে যান। বাংলাদেশি ছাত্রদের সাথে তার সম্পর্ক খুবই ভালো।

মাঝের বিল্ডিংয়ের সিটগুলো সাধারণ কামরা। এখানে দায়িত্বে আছেন মাওলানা খুরশিদ সাহেব। আমি প্রথমে গেলাম উসমান সাহেবের কাছে। কয়েকবার হুজুরের কামরার সামনে থেকে ঘুরে আসলাম। হুজুর ছিলেন না। এর মাঝে আবু তাহের ভাই হুজুরকে ধরে আসামি মঞ্জিল থেকে রোয়াকে খালেদের বিশেষ চারজনা কামরায় চলে এসেছেন। কিন্তু আসামি কামরার সাথীদের এখনও জানাননি। তিনি আমাকে প্রস্তাব দিলেন, আপনি আসামি মঞ্জিলে আবেদন করুন। রোয়াকে সিট পেলে তো ইযাফি সিট পাবেন। সেখানে স্বতন্ত্র সিট।

আমি আবু তাহের ভাইয়ের কথায় দরখাস্ত নিয়ে আসামি মঞ্জিলের নাযেমের কাছে গেলাম। হুজুর পরদিন দশটার দিকে যেতে বললেন। পরদিন পালনপুরী সাহেবের দরস মিস দিয়ে গেলাম নাযেম সাহেবের কাছে। তিনি আমার ফরম নম্বর শুনেই বলে উঠলেন, এই নাম্বারে সিট দেয়া যাবে না। তোমাদের তো বলাই হয়েছে জাদীদ মাতবাখে তোমাদের জন্য কামরা করা হচ্ছে। এখানে তোমাদের সিট হবে না। ইহতিমামের নিষেধ আছে। মন খারাপ করে ফিরে এলাম। দরসে আর ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না। চলে আসলাম ছাত্তার কামরায়।

কিন্তু এই বঞ্চনা আমার জন্য রহমত হয় দেখা দিলো। রোয়াকে খালেদের মাঝের বিল্ডিংয়ে দুইজন বাংলাদেশি ছেলে থাকত। একজন মূল আরেকজন এযাফি। কামরার বাকি সব ছেলে বিহারী। বিহারীদের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে তাদের একজন সিট বদল করবে। সে ছিলো জামিয়া রাহমানিয়ার ছাত্র। সেই সুবাদে আমিনের সাথে পরিচয় আছে। আমার হাতে সুযোগ চলে আসলো। একদিন ওকে সাথে নিয়ে সাহস করে গেলাম খুরশিদ সাহেরেব কামরায়। খুরশিদ সাহেব এক আজব মানুষ। তার চেহারায় হাসি খুঁজে পাওয়া দিনের বেলা চাঁদ খোঁজার মতোই ব্যাপার। সেই বছর তিনি প্রথম বাংলাদেশে আসেন। বাংলাদেশ সফর করে যাওয়ার পর বাংলাদেশি ছাত্রদের ব্যাপারে তিনি কিছুটা দয়ালু হয়ে উঠেন। কিন্তু আমি যে সময় সিটের আবেদন নিয়ে যাই তখনও তিনি বাংলাদেশ সফরে আসেননি। দেওবন্দে বাংলাদেশ বিরোধী হিসেবে যে কয়জনের বদনাম ছিলো তিনি ছিলেন সেই তালিকায়। অবশ্য মানুুষটির ইলমি যোগ্যতা বিষ্ময়কর। তার দুটি দরস দেওবন্দে বিখ্যাত। মুখতাসারুল মাআনি এবং হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগাহ। আরও আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, দরসে নাকি তিনি ছাত্রদের প্রচুর হাসান। এই গোমরামুখের আড়ালে যে একটি রসিক মানুষ লুকিয়ে আছে সেটা প্রথম দেখায় কে কল্পনা করতে পারবে?

শুনেছি পালনপুরী সাহেব নিজেই তাকে হুজ্জাতুল্লাহ পড়াতে দিয়েছেন। এর আগে এই কিতাব পালনপুরি সাহেব নিজে পড়াতেন। নিজের যোগ্য ছাত্রের হাতে কিতাবটি তিনি ছেড়ে দেন।

হুজুরের রুমে তখন ছাত্রদের ভীড়। বিভিন্নজন বিভিন্ন আবেদন নিয়ে যাচ্ছে। হুজুর অনেককেই ধমকাধমকি করছেন। প্রতিটি ধমকের সাথে আমার বুকের হার্টবিট পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। এক পর্যায়ে আমাদের পালা আসলো। রাহমানিয়ার সেই ভাইটি নিজের সিট ছেড়ে দেয়ার কথা জানালো। হুজুর তার নাম কাটলেন। আনুষ্ঠানিকতা সমাপ্ত করলেন। এবার সে আমার জন্য সুপারিশ করলে গেলো। তার জায়গায় আমাকে দিয়ে যেতে চায়। মাত্র প্রথম শব্দটা মুখ দিয়ে বের হয়েছে। সাথে সাথে তাকে ধমক দিয়ে বললেন- তু যা, যা! ধমকে বের করে দিলেন তাকে। কোনো ধরণের সুপারিশ শুনতে চান না। এরপর আমার দিকে মনযোগ দিলেন। সম্ভবত যে কাজ সুপারিশ ছাড়াই হওয়ার কথা সেই কাজে সুপারিশ করতে দেখে রেগে গিয়েছিলেন। যাই হোক, নাম-ঠিকানা, জামাতের নাম এসব জিজ্ঞেস করলেন। আমি বলছি আর হুজুর লিখছেন। ঠিকানা বললাম, অরুনাচল! সঙ্গে সঙ্গে কাগজ থেকে মুখ তুলে তাকালেন। তুই বাংলাদেশি না? সত্যি করে বল! বাংলাদেশি না তুই?

আমি ক্ষণিকের জন্য থতমত খেয়ে গেলাম। কি বলবো এই প্রশ্নের জবাবে? শুনেছি দেওবন্দের সব উস্তাদ যদিও জানেন আমরা বাংলাদেশি, তবুও নাকি তালিমাত বা প্রশাসনিক দায়িত্বের সাথে জড়িতদের কাছে কখনও দেশের কথা স্বীকার করতে হয় না। কারণ তারা ফয়সালা করবেন আমার স্বীকারুক্তির ভিত্তিতে, তাদের জানার ভিত্তিতে নয়। সুতরাং কখনও অফিসে কোনো অভিযোগ গেলে শত চাপের মুখেও বাংলাদেশের কথা স্বীকার করা যাবে না।

দারুল ইক্বামাও অফিসিয়াল কার্যক্রমের মাঝেই পড়ে। তাহলে এখন আমার করণীয় কি? মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকবো? কিন্তু তিনি বারবার ধমকের সুরে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন। ফলে সাহস করে বলেই ফেললাম, জি!

এরপর দাখেলা নম্বর জিজ্ঞেস করলেন। আমার নম্বর ছিলো ৪২৪৪। আমি ৪৪ উচ্চারণ করলাম ‘চৌচালিশ’। বাংলা ‘চৌচল্লিশ’ এর উপর কেয়াস করে বলে দিয়েছিলাম। হুজুর তো চৌচালিশ শুনে ভয়াবহ ক্ষেপে গেলেন। বার কয়েক আমাকে দিয়ে মশক করালেন, চোয়ালিস! এরপর চৌচালিশ বলে বলে বার কয়েক মুখ ভেংচি দিলেন। কাজ শেষ করে যখন চলে আসবো তখন আরও একবার বললেন, সামনে থেকে কেউ জিজ্ঞেস করলে কি বলবি? চৌচালিশ বলবি?

যাই হোক, রোয়াকে খালেদের ১০ নম্বর কামরায় আমার সিট হয়ে গেলো। স্বপ্নের রোয়াকে খালেদ। যদিও বিশেষ কামরা নয়, তবুও তো কেউ সিটের কথা বলতে পারলে বলতে পারবো, আমার সিট রোয়াকে খালেদে। বিশেষ কামরা না সাধারণ কামরা, এত কথা বিস্তারিত কে জিজ্ঞেস করবে?

কামরায় অপর যে বাংলাদেশি ছেলেটা ছিলো তার বাড়ি বি-বাড়িয়া। ছেলেটা কিছুটা জিন স্বভাবের। ভর্তি হয়েছে কেরালার ঠিকানায়। প্রতিদিন মোবাইলে এলার্ম দিয়ে তাহাজ্জুদের সময় ঘুম থেকে উঠে। তাহজ্জুদ পড়ে কামরা ত্যাগ করে। এরপর শুধু দুই বেলা খাবারের সময় আর রাতে ঘুমানোর জন্য কামরায় আসে। বাকি পুরোটা সময় দরসগাহে কাটায়। কামরার কারও সাথে কোনো কথা বলে না। আমি আসার পর অবশ্য আমার সাথে টুকটাক কথা বলেছে। বিহারীরা রাত-বিরাতে জোরে কথাবার্তা বললে সে ধমক-টমক দেয়। বিহারিরা তাকে ভয় পায়। তারা সত্য সত্য তাকে কেরালার অধিবাসী মনে করে। কারণ কেরালাদের কথা কেউ বুঝে না। তাই তারা বাইরের কারও সাথে সম্পর্ক গড়তে পারে না। সেও যেহেতু কারও সাথে কথা বলে না তার মানে নির্ঘাত সে কেরালার!

আমি নিজেও বিহারিদের সাথে তেমন কথাবার্তা বলিনি। কিন্তু আমার মন তা মানতে চাইত না। খুব ইচ্ছে করতো ওদের সাথে জমিয়ে আড্ডা দিই। কিন্তু সাহস করতে পারতাম না। কেউ নিজ থেকে কথা বলতে এলে হেসে এড়িয়ে যেতাম। ওরাও আমাকে তেমন ঘাটাত না। একজন শুধু একদিন বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করেছিলো। ওর মূলত খেলার স্কোর জানা প্রয়োজন ছিলো। ওদের কারও মোবাইলে নেট ছিলো না সম্ভবত। তাই আমার মোবাইল থেকে সহযোগিতা নিতে আসে। এজন্যই বোধয় সৌজন্যতামূলক ঠিকানা জিজ্ঞেস করে।

বিহারিরা এক আজব জাতি। ওরা এক/দুইজন কোথাও জায়গা পেলে এরপর পুরো বাহিনী নিয়ে এসে সেখানে থাকতে শুরু করে। আর এই কামরায় তো বেশিরভাগই বিহারী। ফলে এটা ছিলো বিহারিদের অভয়ারণ্য। নয়জনের কামরায় থাকত প্রায় পনেরোজন। এদের অনেকেই আশেপাশের মাদরাসায় পড়ে। একবার একজন ধরা পড়েছিলো। শশমাহী পরীক্ষার অল্প কিছুদিন পরের ঘটনা। আমাদের ঘুম থেকে ডাকা হতো তিন দফা। প্রথমে মুলাযিমরা এসে ডাকতো। সেই ডাক বড় মজার। ‘মৌলভি সাহাব! চলিয়ে চলিয়ে চলিয়ে!!’

মুলাযিমগণ ডেকে চলে যাওয়ার পর আরেকজন উস্তাদ আসেন। সর্বশেষ জামাতের আগ মুহূর্তে আসেন খুরশিদ সাহেব। তিনি এসে বলেন, ‘চল নিকাল নিকাল!’ এ সময় যদি কাউকে শোয়া দেখেন তাহলে তার কপালে খারাবি আছে।সেদিন খুরশিদ সাহেব এসে দেখেন একটা ছেলে শুয়ে আছে। রুম তখন প্রায় খালি। সবাই ওযু-ইস্তিঞ্জা করতে চলে গেছে। আমি যেহেতু আগে আগে উঠে পড়ি, (হ্যা, আপনি ভুল শুনেননি। রোয়াকের এই কামরায় যতদিন ছিলাম, ডাক দেয়ার পর সবার আগে আমি বিছানা ছাড়তাম। ভেতরে ভয় কাজ করতো। শুয়ে থাকতে সাহস হতো না।)

হুজুর যখন এলেন আমি ততক্ষণে ওজু করে চলে এসেছি। হুজুর ছেলেটিকে উঠালেন। এমনিতেই দেরিতে উঠার কারণে তিনি ক্ষিপ্ত। তার উপরে হুজরের নজর গেলো ওর চুলের দিকে। হুজুর ওর চুলের মুঠি ধরে জিজ্ঞেস করলেন, তুই এই চুল নিয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলি কিভাবে? দারুল উলুমে পরীক্ষার আগে নাযেমে দারুল ইকামার কাছ থেকে চুল-দাড়ির ব্যাপারে ইতিবাচক সাক্ষর আনতে হয়। এছাড়া পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার কোনো সুযোগ নেই। সুতরাং এত বড় চুল নিয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার প্রশ্নই উঠে না। হুজুর তাই অবাক হয়ে গেলেন। সে তখন জানালো, আমি এখানে পড়ি না। পাশে আরেক মাদরাসায় পড়ি।

আর যায় কোথায়? লঙ্গরখানা পাইসোস এইটা? লঙ্গরখানা? ক্রমাগত কয়েকটি চর-থাপ্পর মারলেন। এরপর তার আশেপাশের দুইজনের নাম নিয়ে চলে গেলেন।

বিহারিদের আরেকটি বদভ্যাস হলো, ওদের দুই/তিনজন যদি রাত দুইটা বা তিনটায়ও বাইরে থেকে এসে ঘরে এসে লাইট জ্বালিয়ে জোরে গল্প-গুজব করতে শুরু করে। অবাক করা ব্যাপার হলো, ঘরে অন্যান্য বিহারিরাও এতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হয় না। কেউ কিছু বলে না।

এই বিরল প্রজাতিটির সাথে বাংলাদেশীদের মিলের জায়গা হলো, আমাদের মতো এরাও ভাত খায়। মানাযির আহসান গিলানী এই ভাত খাওয়ার পক্ষে একজনের সাথে তর্ক করতে গিয়ে বলেছিলেন, তোমরা সারা বছর রুটি খাও। কিন্তু তোমাদের কাছে যখন কোনো বিশেষ মেহমান আসে বা বিশেষ কোনো আয়োজন হও তখন চাওল (বিরিয়ানি, পোলাও) পাকাও। তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়ালো? রুটি হলো খুবই নরমাল খাবার। আর চাওল বিশেষ খাবার!

যাই হোক, এই একটা দিক ছাড়া ওদের সাথে আমাদের আর তেমন কোনো মিল নেই। আর মনের কথা যদি বলি, তাহলে সেখানে তো আরও বেশি দূরত্ব! অবশ্য দরসগায় আমি তিনজন ব্যতিক্রমধর্মী বিহারিও পেয়েছি। ওরা আমাদের ছোটভাইয়ের মতো জানত। ঘটনা হলো, ওদের পাশে বাংলাদেশি একটা ছেলে বসত। যখন সে জানতে পারলো এরা বিহারি, তখন আস্তে করে সে কেটে পড়ে। এতে তারা খুবই কষ্ট পায়। আমিনের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে বলে, আমরা কি বাঘ-ভল্লুক যে আমাদেও দেখে পালাতে হবে?

এরপর তাদের সাথে আমাদের ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। আবু সাবের আব্দুল্লাহ সাহেবের আওনুত তিরমিযি পড়ে তারা আমাকে বলেছিলো, তোমার উস্তাদ তো ভালো উর্দু জানেন!

আরেকজন একদিন আমাকে ধরে বসলো, কিভাবে পরীক্ষায় আরবিতে উত্তর লিখি এটা তাকে শেখাতে হবে। শশমাহী পরীক্ষায় আমার গড় এসেছিলো ৮৫। এতেই সে আমাকে ধরে বসে। নানান ভুজুং ভাজুং দিয়ে তার হাত থেকে নিস্তার পাই।

পালনপুরী সাহেবের মজলিস

পালনপুর সাহেবের বাসায় আসরের পর মজলিস হয়। দারুল উলুমের অন্যান্য উস্তাদগণও আসরের পর ছাত্রদের বিশেষ সময় দেন। কেউ বসেন নিজের মাকতাবায়, কেউ নিজস্ব কামরায়, কেউ নিজের বাসায়। পালনপুরি সাহেব নিজের বাসায় বসেন। কুরবানির পর থেকে আমি পালনপুরি সাহেবের মজলিসে যাতায়াত শুরু করি। এক সময় মজলিসে নিয়মিত হয়ে যাই। আসরের নামাজ গিয়ে পড়তাম হুজুরের মসজিদে। এরপর হুজুরের পিছু পিছু চলে যেতাম বাসায়। বসতাম একদম হুজুরের সামনে। সব দিন এত আগে যাওয়ার সুযোগ হতো না। কখনও পেছনেও বসতে হতো। হুজুর আস্তে আস্তে কথা বলেন। দূরে বসলে শোনা যায় না। তাই চেষ্টা থাকত যথা সম্ভব কাছাকাছি বসার।

মজলিসে ছাত্ররা চিরকুটের মাধ্যমে প্রশ্ন পাঠায়। হুজুর সেসব প্রশ্নের উত্তর দেন। কখনও দরস এবং সবক সংক্রান্ত প্রশ্ন থাকে, কখনও বা অন্যান্য যে কোনো প্রশ্ন। এই মজলিসে মাঝে মাঝে দারুল উলুমের কোনো কোনো উস্তাদও শরিক হন। বিশেষ করে ইশতিয়াক সাহেব প্রায়ই অংশগ্রহণ করেন। এছাড়া খুরশিদ সাহেবও যান মাঝে মাঝে। আব্দুল্লাহ মারুফি সাহেবও শরিক হন কখনও কখনও। এছাড়া কোনো মেহমান হুজুরের সাথে সাক্ষাত করতে চাইলে তারাও এই সময় দেখা করেন। মেহমানদের উপস্থিতিতে মজলিস বেশ জমজমাট হয়ে উঠে। হুজুরের মজলিস থেকে নানাভাবে উপকৃত হওয়া যায়। হুজুরের এই মজলিসে যাতায়াত করতে গিয়েই হঠাৎ একদিন আমার মনে হলো, দেওবন্দে আরও এক বছর থাকা দরকার। আর কিছু না করি, প্রতিদিন হুজুরের মজলিসে উপস্থিত থাকবো। এরপর এক সময় সে মনে হওয়াটা সিদ্ধান্তে পরিণত হয়ে যায়।

নোটবন্দি!

আমাদের দেওবন্দের বছরের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো নোটবন্দী। হঠাত একদিন ঘুম থেকে উঠে শুনি সরকার ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট বাতিল ঘোষণা করে দিয়েছে। কোনো পূর্ব ঘোষণা নেই, পূর্ব প্রস্ততিও নেই, অকস্মাৎ বজ্রপাতের মতো আপতিত হলো এই সংবাদ। ততক্ষণে আমার হাতের টাকা প্রায় শেষ। বাড়ি থেকে টাকা পাঠাতে বলে দিয়েছি। চলে আসবে কয়েক দিনের মাঝে। কিন্তু এখন টাকা আসা না আসা সমান। যারা হুন্ডি ব্যবসা করে তারা তো ৫০০/১০০০ এই দিবে। এই টাকা হাতে আসা-না আসায় বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। হঠাৎ উপলব্ধি করলাম, আমরা রাতারাতি শুধু গরিবই নয়, রীতিমত ফকির হয়ে গেছি।

সরকার থেকে এই নোটবন্দীর কারণ হিসেবে যা উল্লেখ করা হয়েছে তা হলো, সরকার এর মাধ্যমে কালাধনের মালিকদের ধরতে চায়। যারা অবৈধ পন্থায় কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে তাদের পাকড়াও করার জন্য এই কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে। কারণ তারা যখন ব্যাংক থেকে এই পুরাতন নোট বদলে নতুন নোট আনতে যাবে তখনই ধরা পড়ে যাবে। কোথায় পেয়েছে এত টাকা? এগুলোর ইনকাম ট্যাক্স· আদায় হয়েছে?

এ তো হলো সরকারি ব্যাখ্যা। পাবলিক অবশ্য ভিন্ন কথা বলে। তাদের মতে, আগামী নির্বাচনে বিরোধী পক্ষকে বেকায়দায় ফেলতেই এই পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে। নির্বাচন উপলক্ষে যেন বিরেধী পক্ষ কোনো ধরণের টাকার লেনদেন করতে না পারে, বিরোধী প্রার্থীরা কোনো টাকা-পয়সা খরচ করতে না পারে সেজন্য এই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। অবশ্য এর কারণে জনগণ যে পরিমাণ ভোগান্তিতে পড়েছে তাতে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে অন্তত বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নিশ্চিত করে বলা যেত, বিজিপি সরকার সেই নির্বাচনে নির্ঘাত ভড়াডুবির শিকার হতো। কষ্টের প্রতিশোধ জনগত নিতো ব্যালেট বক্সে। কিন্তু ইন্ডিয়া এক আজব দেশ! কংগ্রেস কর্তৃক আহুত প্রতিবাদ মিছিলে পর্যন্ত জনগণ তেমন সাড়া দেয়নি। নির্বাচনে প্রায় বেশিরভাগ আসনেই বিজিপি সংখ্যাগড়িষ্ঠতা লাভ করে। ইউপিতে মুখ্যমন্ত্রী হয় কসাইগীরিতে মোদির জাতভাই যোগী আদিত্যনাথ। অবশ্য অভিযোগ আছে, সরকার ইভিএমের সুযোগ নিয়ে অবৈধ পন্থায় জয়ী হয়েছে।

এদিকে জনগণকে সমস্যায় ফেলে দিয়ে সরকার বসলো পরবর্তী নোট সম্পর্কে পরিকল্পনা করতে। আগের ৫০০/১০০০ কেই কি নতুন করে আবার ছাপা হবে নাকি নতুন নোট তৈরি করা হবে? শেষে সিদ্ধান্ত হলো, নতুন ২০০০ টাকার নোট করা হবে। এরপরের চিন্তা হলো, সেই নোটের ডিজাইন কি হবে?

এসব করতে চলে গেলো বেশ কিছু দিন। এদিকে দোকানগুলোতে ৫০০/১০০০ টাকার নোট নেয়া বন্ধ হয়ে গেলো। বড় দোকানগুলোতে বেশি টাকার কেনাকাটা করলে মাঝে মাঝে জবরদস্তি গছানো যায়। ছোট দোকানগুলো পুরোপুরি বন্ধ করে দিলো। শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে কিছুটা সুবিধা করা যায়। অনেকে সে সময় শুধু নোট ভাঙানোর জন্য ট্রেনে ছোটখাটো সফর করতো। যেমন ধরা যাক, দেওবন্দ থেকে সাহারানপুর ১০ টাকা ভাড়া। ভাড়ার জন্য ৫০০ টাকার নোট দিলে ভাংতি পাওয়া যাবে। সুতরাং তারা কোনো প্রয়োজন না থাকা সত্বেও শুধুমাত্র টাকা ভাঙানোর জন্য দেওবন্দ-সাহারানপুর-দেওবন্দ সফর করে। ৫০০ টাকার একটা নোট ভাঙানোর জন্য ২০ টাকা গচ্ছা দেয়।

অপরদিকে ব্যাংকগুলোতে শুরু হয় নোট বদল। শেষ রাতে উঠে সিরিয়ালে দাঁড়ালে দুপুরের দিকে সিরিয়াল পাওয়া যায়। তাও একদিন সর্বোচ্চ দুই হাজার টাকা ভাঙানো যায়। এজন্য আবার ব্যাংকের কার্ডও লাগে। যার কার্ড আছে তার কাছেও সিরিয়াল ধরতে হয়। সে এক বিরাট কাহিনি!

নোটবন্দীর কবলে আমাদের ভাত খাওয়া পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেলো। ততদিনে বোর্ডিংয়ে আমার খানা জারি হয়ে গেছে। মাদরাসায়ও থাকা শুরু করে দিয়েছি। কিন্তু খানা খেতাম তখনও ছাত্তার সেই কামরায়। একেক দিন একেকজন রান্না করতাম। নোটবন্দী শুরু হওয়ার পর আমাদের ভাত খাওয়া বন্ধ। বোর্ডিং থেকে দেয়া তরকারি আলু-বেগুন দিয়ে প্রসেসিং করে খেয়ে ফেলি। সকালের নাস্তা রীতিমত বিলাসিতা। এখন বিলাসিতার সময় নয়। আর তরকারি প্রসেসিং করে যতটুকু হয় তাতে দেড়টা রুটিও ঠিকমতো খাওয়া যায় না। সেই সময়গুলোতে পেটের ক্ষিধাও কেন যেন বেড়ে গিয়েছিলো অনেক বেশি। সম্ভবত টুকটাক নাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণেই। বইপত্রে দুর্ভিক্ষের গল্প পড়েছি। জীবনে প্রথমবারের মতো তার কিছুটা নজির নিজ চোখে দেখার সুযোগ হয়।

শশমাহী পরীক্ষা এবং লখনৌ সফর

দারুল উলুমে মোট দুটি পরীক্ষা হয়। শশমাহী এবং সালানা। শশমাহীতে অল্প কিছু কিতাবের পরীক্ষা হয়। যে কিতাবগুলো শশমাহীর আগে শেষ হয় সবগুলোর পরীক্ষাও হয় না। শুধু বুখারী, মুসলিম, তিরমিযি এবং আবু দাউদ। বুখারী পরীক্ষা হবে সবার শেষে। এর আগে তিরমিযি, তার আগে মুসলিম। বার্ষিক পরীক্ষার ক্ষেত্রেও একই নিয়ম। মুয়াত্তা দিয়ে শুরু হয়ে বুখারী দিয়ে শেষ হয়। বাংলাদেশের সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র।

শশমাহী পরীক্ষা আমার অনেক ভালো হয়েছিলো। এর একমাত্র কারণ আমিন। ওর জবরদস্তিতে আমার প্রত্যেকটি কিতাব ওর সাথে তাকরার করতে হয়। আমি সুযোগ পেলেই ভাগার তালে থাকতাম। সে ধরে নিয়ে আসতো। এভাবে ওর জোর-জবরদস্তিতে যতটুকু পড়া হয় তাতে পরীক্ষায় ৮৫ গড় আসে।

পরীক্ষার পর আমি আর আমিন লখনৌ সফরে যাই। নদওয়াতুল উলামা, রায়বেরেলি সাইয়েদ আহমদ শহিদ একাডেমি, ফিরিঙ্গিমহল এসব এলাকা ঘুরে আসা হয়। মেহমান হিশেবে ছিলাম কলকাতার এক বাঙালি ছেলের কাছে। সে কলকাতার সাথে জড়িত কিপ্টেমির যত গল্প আছে সবগুলোর কাজা-কাফফারা করে দিয়েছে। এরপর থেকে আমার সামনে কেউ কলকাতার কিপ্টেমির বদনাম করলে আমি প্রতিবাদ করি। সেই ছেলেটির আন্তরিকতা এবং বদান্যতা আমাকে সেই বদনাম হজম করতে দেয় না।

ফিরিঙ্গি মহল গিয়ে আব্দুল হাই লখনভী রহ. এর নিবাস খুঁজতে গিয়ে অনেক মজার অভিজ্ঞতা হয়। সেসব সময় করে এক সময় বলা যাবে। এখন ফিরে যাই দেওবন্দে।

লখনৌ সফর থেকে অনেক কিতাব নিয়ে এসেছিলাম। এটা ছিলো এই সফরের বড় অন্যতম বড় প্রাপ্তি। আর খারাপ দিকটি হলো, এই সফরেই আমিনের সাথে আমার বন্ধুবিচ্ছেদ ঘটে। সেটা ভাঙা সম্পর্ক জোড়া লেগেছিলো একদম রমজানে দেশে আসার সময়। এর মাঝে ওর সাথে আর কোনো যোগাযোগ বা কথা হয়নি।

লখনৌ থাকতেই আব্দুল হক আজমি সাহেবের ইন্তেকালের সংবাদ পাই। এর দুইদিন পর আমরা দেওবন্দে ফেরত আসি। হুজুরের জানাযায় শরিক হওয়ার তাওফিক আমার হয়নি। দেওবন্দে এসে যখন মুলসারী চত্বরে থামি তখন চত্বরের বকুল গাছের গোড়ায় শোভা পাচ্ছে হুজুরের স্মরণে প্রকাশিত হওয়া দুটি দেয়ালিকা। দেয়ালিকার দিকে তাকিয়ে হঠাতই ভেতরটা হু হু করে উঠে। উথলে উঠা কান্না বাধ ভেঙে বেরিয়ে আসতে চায়। হুজুর চলে গেছেন। আর কখনও কারণে-অকারণে ধমকে উঠবেন না। হুজুরের চেহারার দিকে তাকালে কাজী সাহেব রহ. এর কথা মনে পড়তো। শেষ পর্যন্ত তিনিও চলে গেলেন।

পরীক্ষার ফল প্রকাশ

আগেই বলেছি, পরীক্ষায় আমার গড় হয়েছিলো ৮৫। ফলাফল প্রকাশের সেই দিনটি আমার জন্য একটি বিশেষ দিন ছিলো। দীর্ঘ সময় নিয়ে খুটিয়ে খুটিয়ে আমার চেয়ে বেশি নম্বর পাওয়া ছাত্রদের তালিকা বের করি। দারুল উলুমে শুধু এক, দুই এবং তিনের সিরিয়াল দেয়া হয়। বাকিদের সিরিয়াল দেয়া হয় না। শুধু প্রত্যেক কিতাবের নম্বর এবং মোট ও আওসাত (গড়) নম্বর উল্লেখ করা হয়। তবু আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছি আমার উপরে ঠিক কয়জন আছে। অর্থাৎ, যদি সিরিয়াল দেয়া হতো তাহলে আমার সিরিয়াল কয়জনের মধ্যে আসতো। দেখা হলো, সিরিয়াল দেয়া হলে আমি ৫০ জনের ভেতরে চলে আসতাম।

এই কাজটি আমি করেছি নিজের সান্ত্বনার জন্য। প্রথমবার ভর্তির জন্য ঘোষিত ৩৫৭ জন ছাত্রের তালিকায় আমার নাম আসেনি। তাই নিজের আত্মবিশ্বাসকে তলানি থেকে কিছুটা উপরে তোলার জন্যই এই চেষ্টা। হয়ত আপনাদের কাছে ব্যাপারটা হাস্যকর মনে হচ্ছে। তবে সে সময় এর মাধ্যমেই আমি মিছে সান্ত্বনা লাভ করেছিলাম।

পরীক্ষায় বাংলাদেশী ছাত্ররা ঈর্ষণীয় ফলাফল করেছিলো। এক দুই তিন থেকে শুরু করে শুরুর দিকের সব সিরিয়াল বাংলাদেশে। এই ক্লাসে শুরু থেকে প্রথম দুটি স্থান ধরে রাখা দুই ভাই, সালমান বিজনুরি সাহেবের দুই ছেলে যাকওয়ান এবং সফওয়ান সম্ভবত জীবনে প্রথমবারের মতো এতটা পিছিয়ে গেলো। সেদিন জোহরের পর হাবিবুর রহমান রহমান আজমি সাহেবের দরসে সামনের দিকে বসেছিলাম। যাকওয়ান ভাই একটা রোমাল অনেকটা ঘোমটার মতো করে দিয়ে বসেছিলেন। আজমি সাহেবের ঘন্টায় ছাত্ররা হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ছে। কিন্তু বেচারার মুখে হাসি নেই।

অবশ্য সালানা পরীক্ষায় ওরা ঠিকই ঘুরে দাঁড়িয়েছিলো। এবারে শুরুর দিকের সব সিরিয়াল ইন্ডিয়ানদের দখলে। এবার নিশ্চয়ই যাকওয়ান ভাইয়ের মুখে হাসি ফুটেছে!

যাকওয়ান ছেলেটা নানামুখি প্রতিভার অধিকারী। কণ্ঠ অনেক চমৎকার। যেমন চমৎকার তার তারানা, তেমনি চমৎকার হাদীসের ইবারত পাঠ। যেদিন যাকওয়ান ভাই ইবারত পড়তেন সেদিন দরসে অন্যরকম এক স্বাদ লাগতো। যাকওয়ান ভাইয়ের কণ্ঠ যেমন চমৎকার, সাফওয়ান ভাইয়ের কণ্ঠ তেমনি খারাপ। তবে দুই ভাই-ই অসম্ভব মেধাবি। আরও বড় ব্যাপার হলো, দাওরায় সারা বছর তারা একটি দরসও মিস করেনি। সামনের টেবিলে ঠিক উস্তাদের সামনে বসতো। তাকরির নোট করতো। সকাল বিকেল কিংবা সন্ধারাত, কোনো দরসেই তাদের অনুপস্থিতি নেই।

প্রজাতন্ত্র দিবস

১৫ ই আগষ্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবস। কিন্তু এই দিবসটি সেখানে পালিত হয় খুবই অবহেলার সাথে। ভারতে যে দিবসটি অত্যন্ত জাঁকজমকের সাথে পালিত হয় সেটি হলো ২৬ জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবস। হিন্দু কিংবা মুসলিম, সরকার বা জনগণ সবার মাঝেই দেখি এই দিন উপলক্ষ্যে ভিন্ন রকম সাড়া পড়ে গেলো। সরকারিভাবে ইন্ডিয়া গেইটের সামনে কুচকাওয়াজের আয়োজন করা হলো। ইন্ডিয়ান ছাত্ররা চলে গেলো সেই অনুষ্ঠান উপভোগ করতে। আমরা যেতে সাহস পেলাম না। কারণ প্রজাতন্ত্র উপলক্ষে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিশেষ সতর্কতা ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। সর্বত্র কঠিন চেকিং চলছে। ধরা পড়লে উপায় নেই।

এদিকে ইন্ডিয়ান মুসলিমরাও এই দিনটি নিয়ে বিশেষভাবে আগ্রহী। আরশাদ মাদানী সাহেব এই দিনে দেওবন্দ এলাকায় জমিয়তের সমাবেশ আয়োজন করলেন। ড. ইয়াসির নাদিম সাহেবের আব্বা মাওলানা নাদীমুল ওয়াজদি সাহেব একটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু সমৃদ্ধ বই লিখলেন ‘আযাদী সে জুমহুরিয়ত তক’ নামে। সর্বত্রই ভিন্ন এক উৎসবের আমেজ।

ঘটনা হলো, ইংরেজরা যখন ভারত ছেড়ে চলে যাওয়ার ব্যাপারে সম্মত হলো, এদিকে ভারতবর্ষ পাকিস্তান এবং ভারত নামে দুটি অংশে বিভক্ত হয়ে গেলো, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হলো সম্পূর্ণরূপে ইসলামের নামে, তখন ভারতবর্ষের সংবিধান কি হবে এটা ছিলো একটি বড় প্রশ্ন। ইসলামকে ভারতের সংবিধান বানানোর কোনো সুযোগ নেই। কারণ ইসলামের নামে পাকিস্তান আলাদা হয়ে গেছে। এখন যাদের ইসলাম পছন্দ তারা পাকিস্তানে চলে যাক। বাকি থাকলো হিন্দু ধর্ম অথবা জুমহুরিয়ত। কংগ্রেস চাইলেও ভারতকে সম্পূর্ণ হিন্দু রাষ্ট্র বানাতে পারবে না। কারণ তাদের সাথে আছে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ। স্বাধীনতা সংগ্রামে যাদের অবদান অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। আবার তারা পাকিস্তানকেও সমর্থন করেনি। ভারতেই রয়ে গেছে। সুতরাং তাদের উপেক্ষা করেও কিছু করা সম্ভব নয়। শেষে ১৫ আগষ্ট ভারত স্বাধীন হলেও ভারত সংবিধান কি হবে সেই সিদ্ধান্ত আসতে আসতে হয়ে গেলো ২৬ জানুয়ারি। এই দিন সিদ্ধান্ত আসলো, জুমহুরিয়তই হবে ভারতের সংবিধান। ভারত হবে সেক্যুলার রাষ্ট্র।

এই সিদ্ধান্তে গনতন্ত্রপন্থীদের পাশাপাশি ভারতের মুসলিমরাও খুশি। কারণ এটি এমন এক ঘোষণা, যা তাদের সাংবিধানিকভাবে অধিকার দিয়েছে নিজেদের অধিকার নিয়ে কথা বলার। নিজেদের পক্ষে আওয়াজ তোলার। তাই এই দিনটি তাদের কাছে রহমত। এই ঘোষণা তাদের জন্য নেয়ামত। নাদিমুল ওয়াজদি সাহেব এই ঘোষণাকে নেয়ামত শব্দেই উল্লেখ করেছেন।

দারুল উলুমে বাংলাদেশী মেহমান!

সে বছর বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি মেহমান দেওবন্দ সফর করেছেন। আমাদের উস্তাদ মাওলানা জাফর আহমদ সাহেব তো প্রতি বছরই যান। সেবার গিয়েছেন তিনবার। আমাদের উস্তাদদের মধ্যে মুফতি হাফিজুদ্দীন সাহেব, মাওলানা এনায়েতুল্লাহ সাহেবও সে বছর দেওবন্দ সফর করেছেন। এছাড়া মাওলানা মাহফুজুল হক সাহেব, ফরিদাবাদের মাওলানা আব্দুস সালাম সাহেব, দারুর রাশাদের মাওলানা সালমান সাহেব প্রমুখও সেই বছর দেওবন্দে গিয়েছিলেন। যতদূর মনে পড়ছে, বারিধারার নায়েবে মুহতামিম সাহেবও সেই বছর দেওবন্দে গিয়েছিলেন। আমার ভাই মুফতি লুতফুর রহমান ফরায়েজিও গিয়েছিলেন সে বছর দেওবন্দে। আরও কে কে গিয়েছিলেন সঠিক মনে পড়ছে না।

মাহফুজুল হক সাহেব গিয়েছিলেন মূলত মুম্বাই। সেখানে মকতব শিক্ষার অনেক কার্যকরী একটি বিশেষ কার্যক্রম চলছে। সে ব্যাপারে সরেজমিনে জেনে আসতেই মূলত তার এই সফর। সেখানে কয়েকদিন ছিলেন। তাদের কার্যক্রম কাছে থেকে দেখেন। দেওবন্দে আসার পর বাংলাদেশি ছাত্রদের নিয়ে বাবুয যাহেরের ছাদে বসেন। সেখানে সেই সফরের কারগুজানি শোনান। মক্তব শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করেন। এরপর কিছু গুরুত্বপূর্ণ নসিহত করেন। একটা নসিহতের কথা আমার বিশেষভাগে মনে আছে। তিনি বলেছিলেন, এখানে তোমরা বিভিন্ন ঘরানার ছেলেরা আছো। তোমরা একটা ব্যাপারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হও। দেশে উলামায়ে কেরামের মাঝে পরস্পর যে মানসিক দূরত্ব সেটা তো তোমরা ভালোভাবেই জানো। তোমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হও, আমরা এই দূরত্ব ঘুচাবো। আমরা যারা এখানে পড়ছি, আমরা নিজেরা সব সময় একতাবদ্ধ থাকবো। তোমরা যদি এই প্রতিজ্ঞা নিতে পারো তাহলে অবস্থার পরিবর্তন হবেই ইনশাআল্লাহ!

দুঃখজনক ব্যাপার হলো, দেশীয় ইখতিলাফের বীজ দেওবন্দের বাংলাদেশিদের মাঝেও তার শিকড় ছড়িয়ে রেখেছে খুবই ভয়াবহভাবে। এখানকার ছাত্র সংগঠনগুলোর পারস্পরিক ঝগড়া আর কাঁদা ছুড়াছুড়ি সেখানেও চলে সমানতালে। আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন।

সে বছর মাওলানা ফরিদ উদ্দীন মাসউদও জমিয়তের মাহমুদ মাদানী অংশের এক সেমিনার উপলক্ষে ইন্ডিয়া গিয়েছিলেন। সেখান থেকে তিনি দেওবন্দে আসেন। তখন স্বীকৃতি দেশের হট টপিক। ছাত্ররা তাকে ঘিরে ধরেছিলো। বিভিন্ন ধরণের প্রশ্ন করে। তিনি হাসিমুখে সবাইকে জবাব দেন। অনেকগুলিই গুঁজামিল জাতীয় জবাব। অনেক প্রশ্নের জবাবে তিনি (পালনপুরি সাহেবের শব্দে) গোলমোল জবাব দেন, যা শোনার পর প্রশ্নকর্তা বুঝে উঠতে পারে না, সে কি আদৌ তার প্রশ্নের উত্তর পেয়েছি নাকি পায়নি?

সেদিন স্বীকৃতি সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, তোমরা এখানে যে কষ্ট করে থাকো এটা তো আমরা বুঝি। তোমাদের এই কষ্ট দূর করার জন্যই আমাদের এই প্রচেষ্টা। তিনি আমাদের বুঝান, স্বীকৃতি চলে আসলে আমরা স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে দেওবন্দে পড়তে যেতে পারবো। তখন আমাদের আর এভাবে লুকোচুরি খেলতে হবে না। বুক ফুলিয়ে চলতে পারবো। স্বীকৃতির মাধ্যমে কিভাবে দেওবন্দের ভিসা আসবে সেটা এখনও আমাদের বুঝে উঠা হয়নি। তবে যা দেখা হয়েছে তা হলো, স্বীকৃতি পাওয়ার এক বছর পর দেওবন্দ যাওয়ার প্রচলিত যে পদ্ধতি ছিলো সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে। দেওবন্দ এখন বাংলাদেশি ছাত্রদের জন্য নিষিদ্ধ এরিয়া।

শেষ দরস

সর্বপ্রথম ইবনে মাজাহ দরসের সমাপ্তির মাধ্যমে যে ধারাবাহিকতা শুরু হয় সারা বছর সেটা চলতেই থাকে। একে একে সব কিতাবই শেষ হয়ে আসে। কিতাব শেষের দিন ছাত্ররা স্বরচিত তারানা পড়ে। বড় হৃদয়বিদারক সেই তারানা! ‘দিলে বুলবুল সে পুছো দূর হো যব ওহ গুলিস্তাঁ সে!’ এরকম তারানা শুনলে তো ভেতরে এমনিতেই হাহাকার উঠে যায়।

এভাবে একদিন সর্বশেষ কিতাবটিও সমাপ্ত হয়ে গেলো। সবার শেষে সমাপ্ত হয়েছে পালনপুরী সাহেবের দরস বুখারী প্রথম খণ্ড। দারুল উলুমে খতমে বুখারী অনুষ্ঠান হয় না। বুখারী শরিফ ঘোষণা দিয়ে সমাপ্তও হয় না। ব্যাস, পড়তে পড়তে যখন শেষ হয়। কিতাব শেষ হওয়ার দুই/তিনদিন আগে থেকেই মনে হতে থাকে, আজ মনে হয় শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু দেখা গেলো হুজুর দরসে কোনো একটি বিষয় নিয়ে কথা বলা শুরু করেছেন। দরস সেদিনের মতো শেষ হয়ে গেলো। এভাবে নানা সম্ভাবনা আর জল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে একদিন দুপুরে কিতাব শেষ হলো। হুজুর ছাত্রদের উদ্দেশে কিছু দিক-নির্দেশনামূলক কথা বললেন। পরবর্তী জীবনের পাথেয় বাতলে দিলেন। এরপর মুনাজাত। মুনাজাতে ছাত্ররা কান্নায় ভেঙে পড়লো। সে এক অভাবনীয় দৃশ্য। বিশাল দরসগাহ হাউমাউ করে কাঁদছে। এক সময় মুনাজাত শেষ হলো। কিন্তু কান্না আর শেষ হয় না। হুজুর চলে যাওয়ার পর আরও ঘন্টখানেক ছাত্ররা বসে বসে কেঁদেছে। বেশি কেঁদেছে ইন্ডিয়ান ছাত্ররা। বিশেষ করে যারা অনেক বছর ধরে দারুল উলুমে পড়ছে। তাদের বেশিরভাগের জন্যই তো দারুল উলুমে এটাই শেষ বছর। তাখাসসুসের সীমিত কোটায় দাখেলা কয়জনের আর হবে?

দরসে মুসালসালাত

শাইখে ছানী আব্দুল হক আজমি সাহেব যতদিন জীবিত ছিলেন, মুসালসালাতের দরস তিনিই দিতেন। তার ইন্তেকাল হয়ে যাওয়ায় সে বছর আল্লামা কমরুদ্দীন সাহেব মুসালসালাতের দরস দেন। তাদের উভয়ের মুসালসালাতের সনদ শাইখুল হাদীস যাকারিয়া রহ. এর থেকে। শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহ. এর লেখা মুসালসালাতের একটি কিতাব আছে। সেই কিতাবটি মূলত পাঠ করা হয়। জোহরের পর থেকে শুরু হয়ে ইশার পর গিয়ে শেষ হয়। এরপর হুজুরের পক্ষ থেকে সবার জন্য খেজুর এবং জমজমের ব্যবস্থা করা হয়। কারণ শেষে যে হাদীসটি পড়া হয় সে হাদীসটি বলে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উপস্থিত সাহাবিকে খেজুর এবং জমজমের পানি খাইয়ে ছিলেন।

দেওবন্দের রমজান

 

রমজানে দেওবন্দে অবস্থান করতে হলে আলাদা করে দরখাস্ত দিতে হয়। নির্ধারিত ফরম পূরণ করে জমা দিতে হয়। সেখানে কেন থাকতে চাই, কোন কামরায় অবস্থা করবো ইত্যাদি বিস্তারিত বিবরণ লেখা থাকে।

আমি আসজাদ মাদানী সাহেবের বাসায় তারাবিতে সামে’ হওয়ার সুযোগ পাই। তারাবি পড়াতো বিহারের একটা ছেলে। চমৎকার তেলাওয়াত ছিলো ওর। আমি শুধু সামে’ হিসেবে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকতাম। আসজাদ মাদানী সাহেব ইশার নামাজ পড়েন মহল্লার মসজিদে। বাসা থেকে বেশ কিছুটা জায়গা হেঁটে এরপর মসজিদে যেতে হয়। ইশার ফরজ এবং সুন্নত পড়ে বাসায় চলে যেতেন। এরপর বাসায় তারাবির জামাত হতো। হুজুর তারাবি বসে পড়লেও ইশার ফরজ এবং সুন্নত পড়তেন দাঁড়িয়ে। একবার আমি জ্বরের ওসিলা দিয়ে একদিন যাইনি। পরদিন গেলে হুজুর জরের কারণ জিজ্ঞেস করেন। জানতে চান, বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম কি না? বললাম, গতকাল ফজরের সময় বৃষ্টি ছিলো।

হুজুর বললেন, বৃষ্টি আসলে ঘরে নামাজ পড়ে নিবো। ভিজে মসজিদে যাওয়ার দরকার নেই। এটা তোমাদের বাংলাদেশের বৃষ্টি নয়। এই বৃষ্টি বড় খতরনাক! তাই এই বৃষ্টি থেকে যতটা সম্ভব বেঁচে থাকার চেষ্টা করবে।

এরপর তিনি নিজের অবস্থা শুনান। বলেন, মাঝে মাঝে সেজদায় গেলে এমনভাবে চক্কর আসে, মনে হয় যেন আর উঠতে পারবো না..।

হুজুর নিজের অসুস্থতার বিবরণ দিচ্ছিলেন আর আমি লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যাচ্ছিলাম। এই মানুষটি এই শরীরেও প্রতিদিন এতটা পথ হেঁটে মসজিদে আসেন। আর আমি যুবক ছেলে সামান্য ওসিলায় জামাত মিস করি।

দেওবন্দে রমজানে ভোররাতের খাবারে কিছুটা পরিবর্তন আসে। ঘি দিয়ে মাখানো ভাত দেয়া হয় ভোররাতে। এই ভাত বিক্রি করা যায় আগের চেয়ে বেশি দামে। আর সাপ্তাহিক বিরিয়ানি দেয়া হয় বিকেলে। এছাড়া সন্ধায় লাল বিল্ডিংয়ে ইফতারির আয়োজন থাকে।

দিনের আমল হলো, সকালে উঠে সবাইকে কুতুবখানায় হাজির হতে হবে। বারোটার দিকে সেখানে হাজিরা হবে। এই সময়টা আমি কাটাতাম আল-ফুরকানের শাহ ওয়ালিউল্লাহ সংখ্যা পড়ে। পরের বছরের জন্য আমার পরিকল্পনা ছিলো শাহ ওয়ালিউল্লাহকে পড়া। তাকমীলে উলুমে দাখেলা নিয়ে দরসে হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগা পড়বো। আর দরসের বাইরে ব্যক্তিগতভাবে পড়বো শাহ সাহেবের অন্যান্য কিতাব। কিছু কিছু পড়া শুরুও করেছিলাম। আল-ইনসাফ সে সময়ই পড়া হয়।

অসুস্থতা এবং দেশে ফেরার আকুতি

রমজানের শুরুর দিকে একবার হালকা জ্বরে তারাবি ফাঁকি দেয়ার পর বিশ রমজানের দিকে এসে ভয়াবহ জ্বরে পড়ে যাই। সেদিন দুপুরের আগুনঝড়া রোদে রোয়াক থেকে বার দুয়েক দারে জাদিদের সামনের রাস্তা পেরিয়ে বাজারে গিয়েছিলাম। ঘটনা হলো, মাত্র তরতাজা একটি হিমু পড়ে উঠেছি। যখন বাজারের জন্য বের হই তখন মাথায় পুরোপুরিভাবে হিমু সওয়ার হয়ে আছে। তাই বোর্ডিংয়ের পাশের ছায়াময় পথ এড়িয়ে দারে জাদিদের সামনের সেই রৌদ্রময় পথটাই বেছে নেই। হাঁটতে অবশ্য মজাই লাগছিলো। মাথায় হিমু সওয়ার থাকায় সেই আগুনঝড়া রোদও উপভোগ্য হয়ে উঠে। সেদিন মাগরিবের পর থেকেই শরীর খারাপ করতে থাকে। তারাবি পড়তে প্রচণ্ড কষ্ট হয়। বার বার ইচ্ছে করছিলো বসে পড়ি। তারাবি শেষ করে এসে এক গ্লাস আমের জুস খেলাম। আমার প্রিয় এই আমের জুসও তখন বিস্বাদ হয়ে উঠলো। ভাবলাম, হয়ত দোকান পরিবর্তন করার কারণে এরকম হচ্ছে। চলে আসলাম মাদরাসায়। দুধ রোজিনা করেছিলাম। দুইজনে খেতাম। আমি আর আনোয়ার ভাই। সেদিন না খেয়েই শুয়ে পড়লাম। প্রায় আধা ঘন্টার মতো শুয়ে থাকার পর অনুভব করলাম আমি জ্বরে পড়তে যাচ্ছি। সময়ের সাথে সাথে জ্বরে প্রচণ্ডতা বাড়তে লাগলো। সকাল হতে হতে সেই জর ভয়াবহ রুপ নিলো।

পরদিন আনোয়ার ভাই ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন। ডাক্তার পরীক্ষা করে জানালেন, টাইফয়েড হয়েছে। ইঞ্জেকশন নিতে হবে তিনদিন। ওষুধ খেয়েও টানা কয়েকদিন ভুগলাম। এরই মাঝে আসজাদ মাদানী সাহেব তার বাড়ির মুলাযিমকে দিয়ে আমার জন্য পাঞ্জাবি-পায়জামার কাপড় এবং সেলাই বাবদ এক হাজার টাকা পাঠিয়ে দেয়। আবার জ্বরের কথা শুনে চিকিৎসার জন্য আরও দুই হাজার টাকা পাঠান।

জ্বর থেকে পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার আগেই দারুল উলুমের বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ পায়। আমার গড় আসে ৭৬। এই পরীক্ষার সময় আমিন পাশে ছিলো না। জীবনের সবচেয়ে বেশি অবহেলাময় পরীক্ষা ছিলো এটা। গল্প-গুজব আর ভবিষ্যত পরিকল্পনা, এসব করেই কেটে যায় সময়। পড়ালেখার সময় কোথায়? ফলাফল যা হওয়ার তাই হলো। ইচ্ছে ছিলো তাকমিলে উলুমে দাখেলা নিবো। হুজ্জাতুল্লাহ পড়বো। তাকমিলে উলুমে দাখেলা নিতে সর্বনিম্ন ৭৫ গড় তুলতে হয়। আমি পেয়েছি মাত্র ১ বেশি। এই গড় নিয়ে তাকাবুলে টিকতে পারবো কি না জানি না। এদিকে কয়েক দিনে জ্বরে ভুগে মনও অস্থির হয়ে উঠলো প্রচণ্ডভাবে। বারবার মনে হতে লাগলো, দেশে ফিরে যাই!

শুরুর দিকে এমনি এমনি বলতাম, দেশে ফিরে যাবো। বলতে বলতে এক পর্যায়ে কথাটা ভেতরে গেঁথে যায়। তার মাঝে আবার আনোয়ার ভাই আগুনে ঘি ঢালেন। আমি যখনই দেশে ফেরার কথা বলি তিনি বলেন, যাবেন না তো জানি। শুধু শুধু কেন বলেন?

তাই এই কথা আমার ভেতর এক ধরণের চ্যালেঞ্জের জন্ম দেয়। এক পর্যায়ে দেশে ফেরাটাই আমার প্রতিজ্ঞা হয়ে দাঁড়ায়। ভাইকে ফোন দিয়ে দেশে ফেরার কথা বলি। তিনি আগে থেকেই আমার আরেক বছর থাকার পক্ষে না। বলার সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন। হাফিজুদ্দীন সাহেব তখন উমরায়। তাকে ফোন দিলাম। তিনিও রাজি। অবশেষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, দেশে ফিরে আসবো।

 দেশে ফেরা

পরদিন সকালে নুরুল করিম ভাইয়ের সাথে দেখা করলাম। বললাম, দেশে চলে যাবো। নুরু ভাই প্রথমে বিশ্বাস করতে চাইলেন না। হেসে উড়িয়ে দিলেন। কিন্তু আমি জানালাম, আমি সিরিয়াস। হুজুরের সাথেও কথা হয়েছে। নুরু ভাই জিজ্ঞেস করলেন,কবে যাবে?

বললাম, দুই একদিনের মধ্যেই রওনা হবো।

তিনি বললেন, আজ জোহরের পর কয়েকজন দেশে যাচ্ছে। যদি সত্যিই চলে যেতে চাও তাহলে তাদের সাথে চলে যাও। তোমার জন্য ভালো হবে। পরে গেলে একা যেতে হবে।

তখন দশটার বেশি বাজে। হাতে সময় আছে অল্প কয়েকটা ঘন্টা। এতটা অকস্মাৎ দেশে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে হবে ভাবিনি। আমি মনে করেছিলাম নুরু ভাইয়ের সাথে কথাবার্তা বলি। এরপর না হয় দুই/তিন দিন পর সময় সুযোগ দেখে রওনা করবো। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই রওনা হয়ে যেতে হবে, এরকম মানসিক প্রস্তুতি ছিলো না। তবে করারও কিছু নেই। দেরি করলে একা আসতে হবে। যা প্রায় অসম্ভব। তাছাড়া দিল্লি আনন্দ বিহার স্টেশন থেকে সরাসরি আগরতলা পর্যন্ত যে ট্রেন যাতায়াত করে এটি সপ্তাহে মাত্র একবারই যায়। আজ মিস করলে আরও এক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে। সুতরাং আমার হাতে আর কোনো অপশন রইলো না। বাধ্য হয়ে রাজি হয়ে গেলাম।

নুরু ভাই আমাকে নিয়ে মসজিদে রশিদের অপর পাশে টিকেট কাউন্টারে নিয়ে গেলেন। সেখানে সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে তৎকালের টিকেট পাওয়া গেলো। তৎকালের নিয়ম হলো, ভাগ্যে থাকলে সিট পাওয়া যাবে। না থাকলে নাই। আমি নিজেকে ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়ে তৎকালের টিকেট সংগ্রহ করে ফেললাম। এরপর গেলাম আসজাদ মাদানী সাহেবের সাথে বিদায়ী সাক্ষাত করতে। হুজুর তখন অফিসে। দাড়োয়ান জানালো, কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি নামবেন। নিচে দাঁড়িয়ে রইলাম। সময় বয়ে যাচ্ছে। হুজুরের নামার কোনো খবর নেই। প্রায় ঘন্টাখানেক হয়ে গেছে। আমার এদিকে গুছগাছ কিছুই করা হয়নি। অবশেষে সাহস করে দুতলায় উঠলাম। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম হুজুরের সাথে সাক্ষাত করা যাবে কি না? তিনি আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে ভেতরে গেলেন। ফিরে এসে আমাকে নিয়ে গেলেন হুজুরের কামরায়। হুজুর আমাকে দেখে প্রথম যে প্রশ্নটি করলেন সেটি হলো, কতক্ষণ আগে এসেছো?

আমি একটু কমিয়ে বললাম, এই তো পনেরো-বিশ মিনিট!

হুজুর শুনে প্রচণ্ড রেগে গেলেন। সাথে আসা লোকটাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, নিচে ঐ গাধাগুলিরে কি জন্য রাখি? ছেলেটা অসুস্থ। ওরে এতক্ষণ ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছে!

এরপর আমার জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করতে বললেন। আমি জানালাম, আজ রোজা রেখেছি। জ্বর সারার পর সেদিনই প্রথম রোজা রেখেছিলাম।

হুজুর রোজার কথা শুনে অনেক রাগ করলেন। তোমাকে এখনই রোজা রাখতে বলেছে কে? তাড়াতাড়ি রোজা ভাঙ্গো।

আমি দেশে চলে আসার কথা বললে প্রথমে কিছুক্ষণ বুঝালেন। বললেন, তুমি অসুখে পড়ে ভয় পেয়ে দেশে চলে যাচ্ছো? ভয় পাওয়ার তো কিছু নেই। এখানে চিকিৎসা অনেক ভালো।

আমি জানালাম, দেশে চলে যাওয়ার পেছনে অসুখটা মূল কারণ নয়। এটা এখন আমার পারিবারিক সিদ্ধান্তও। তখন হুজুর আমাকে বাসায় নিয়ে গেলেন। আগেই বাসায় ফোন করে খাবারের ব্যবস্থা করে রাখতে বললেন। আমি তাড়াহুড়ো করছিলাম। হুজুর আমাকে খাইয়ে তবেই ছাড়লেন। আবার একটা কাগজে করে কতগুলো পেয়ারা দিয়ে দিলেন রাস্তায় খাওয়ার জন্য। অবশেষে হুজুরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসলাম।

মাদরাসায় আসতে আসতে জোহরের সময় হয়ে গেছে। আড়াইটায় দেওবন্দ থেকে ট্রেন। নামাজের পর আমার হাতে সময় রইলো মাত্র দশ থেকে পনেরো মিনিট। এর মাঝেই আমাকে ব্যাগ গুছাতে হবে। আনোয়ার ভাই সহযোগিতা করলেন। মাত্র দশ মিনিটে ব্যাগ গুছিয়ে অতৃপ্ত আত্মা নিয়ে আমি দেওবন্দ ত্যাগ করলাম।

রাত বারোটায় দিল্লি আনন্দবিহার স্টেশন থেকে সুন্দরী এক্সপ্রেসে প্রায় ৫৮ ঘন্টার সফর শেষে এক ভোরে আগরতলা স্টেশনে এসে নামলাম। সেখান থেকে ত্রিপুরা রাজ্য দিয়ে বাংলাদেশের কুমিল্লা প্রবেশ করি। সে এক থ্রিলার উপন্যাস!

আমিনও এই কাফেলায় ছিলো। এই সফরে ওর সাথে ভাঙা বন্ধুত্ব আবারও জোড়া লাগে। ওর সিট ছিলো এসি কামরায়। আমি সিট পেয়েছি পরদিন। তাও সাধারণ কামরায়। আমার অসুস্থতা বিবেচনায় সে তার এসি কামরা আমার জন্য ছেড়ে দিয়ে নিজে চলে যায় সাধারণ কামরায়।

পরিশিষ্ট

 

আমি দেওবন্দ ছেড়েছি অতৃপ্তি নিয়ে। যদি অন্যদের মতো স্বাভাবিকভাগে দেশে ফিরে আসতাম তাহলে হয়ত এতটা অতৃপ্তি থাকতো না। কিন্তু এভাবে আরও এক বছরের জন্য এতসব পরিকল্পনা করে অবশেষে দশ মিনিটে ব্যাগ গুছিয়ে দেশে চলে আসায় ভেতরে যে অতৃপ্তিবোধ রয়ে গেছে সেটাই সম্ভবত দুই দিন পর পর স্বপ্নে এসে হানা দেয়। আমি কারণে-অকারণে দুই দিন পর পর স্বপ্নে দেওবন্দ দেখি। নানান রঙ্গে, নানান পরিবেশে। এই স্বপ্ন আমি আজীবন দেখে যেতে চাই। অন্তত স্বপ্নের মাধ্যমে হলেও তো অতৃপ্ত আত্মা সাময়িক তৃপ্তি পায়!

 

আগের সংবাদহুসায়ন হাইকল : আরবি উপন্যাসের জনক
পরবর্তি সংবাদখাইবার কন্যা সাফিয়্যা বিনতে হুয়াই রাদিয়াল্লাহু আনহা