জুবায়ের মহিউদ্দীন
শহুরে রাস্তার জ্যাম আর ধুলোবালির অস্থির অচল সময়ের আচল ধরে আর আমার স্বপ্নে পাওয়া গ্রামের মেঠোপথের কুয়াশা ভেদ করে অথবা সূর্যের সাথেই বারবার ডুবতে ডুবতে কখন যে আমার গায়ে ছদরিয়া কোট উঠলো, কখন ঘাড়ে চেপে বসলো আঁচল-ঝুলানো রুমাল কিংবা কখন যে হাতে কিংবা ব্যাগের পকেটে ঢুকে গেলো দাতাদের নাম-ঠিকানা লেখার কলম-প্যাড! কী এক বিপুলমুখো জীবনে মুখ গুঁজে থাকি এখনের দিনকালে। শিক্ষকতার শুরুর শিহরণ, আমার লেখাপড়া, একঝাঁক সদ্য দাড়ি-গোফের স্বপ্নহীন তরুণকে স্বপ্নের আকাশে উড়তে শেখাতে এসে সকালের এই ঝিরঝিরে শ্রাবণ-বর্ষার মতোই চারপাশ আমাকে জড়িয়ে নেয় আস্তে আস্তে প্রবল ঘন বনের মতো। মাদরাসা, পরিবার, প্রেম-ভালোবাসার গল্পেরা এসে একসাথে আছড়ে পড়ে অন্তরের বালুতীরে। নিকটে থেকেও বহুদূরে বসে থাকে কৈশোরের অপাপবিদ্ধ বালকের চেহারার একজন ‘আমি’। হাত নাড়াতে নাড়াতে বালক ক্লান্ত হলেও আমার আশায় থাকে বাবার বাড়িতে শুকনো গাছে হেলান দিয়ে দীর্ঘকাল এক আকাশের ধৈর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শুকনো গাছের মতোই লিকলিকে শরীরের কোন গৃহিণীর স্বপ্নালু দুটি প্রেমমুখর ডাগর চোখ। আমার কল্পিত বালক এখন চির অপেক্ষায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে ‘আমি’ আবারো আসবো ফিরে কোন এক মাহেন্দ্রক্ষণে স্কুলছুটির ঘণ্টার হুল্লোড় তুলে। আমার স্বপ্ন, আমার লেখাপড়া, নির্ঘুম অন্তরঙ্গ মুতালায়ার রাতের সৌন্দর্য, কিংবা ফেলে আসা কোন পাঠাগার বা সিঁড়ির গল্পের পাণ্ডুলিপি বা কবিতার খসড়া এখনো কি আশা করে আবার ফিরে আসব কোন নক্ষত্রজ্বলা শেষ রাতে আমার জন্য কেঁদে চোখের পানিতে মুখ ধুয়ে জায়নামাজ থেকে শান্তভাবে উঠে আসা কোন বাবার মতোন? অথচ এইসব তামসিক জীবনযুদ্ধকেও অভিজ্ঞতা্র প্রলাপ বকে ধোঁকা খেয়ে যাই, অভিজ্ঞতার যিকিরে ইলিয়টের কথার মতোই প্রবোধ দিই, ‘আমার জীবনকে কফির চামচের মতোই মেপে দেখেছি।’
এই গ্রামীণ জীবন, মানুষের ধর্মীয় বোধ, আল্লাহ, রাসূল, মাদরাসা, মসজিদ আর মাহফিলগুলোই তাদের একঘেয়ে জীবনের ভেরিয়েশন হয়ে ফিরে আসে মৌসুমে মৌসুমে। হারাতে হারাতে নিঃস্ব হলেও ভেতরের কই থেকে যেন আত্মবিশ্বাসী সুরে চিরচেনা কেউ গেয়ে যায়, ‘সব হারালেও নিঃস্ব হবার ভয় নেই।’ ভিতরের বুকপকেটে রাখা পুরো মাসের বেতনের টাকার মতোই বুকের গহীনের সেই সুরটাকে আমি বিশ্বস্ত হাত দিয়ে আলতো করে চাপ দিয়ে আবারো বসে যাই জীর্ণ কার্পেটের মিটিংয়ের এক কোণায় আর আলাপ তুলি, এবারের চামড়ার দাম কম, তাতে কী? চামড়া বেশি কালেকশন হলেই হলো। মিটিং আর কুরবানীর ক্যাম্পেইনিং শেষে ক্লান্ত শরীরটাকে যখন মনের শক্তি দিয়ে টেনে টেনে মাদরাসার দোরগোড়ায় এনে ফেলি কোনরকম, তখনই হাঁক ছাড়ে পাশের বাড়ির রিয়াজের আব্বা, রমিজউদ্দীন সরকার–এই দশ দিনের যেই রোজার ভিতরে দুধ নিতেছেন এইগুলার টাকা লাগব না। আপনে আমার মেহমান এই দশ দিনের। দাতাদের নামের রেকর্ড বই আর কালেকশনের ফিকিরে ঘুরতে থাকা পুরোদস্তুর মিডিয়া কল্পিত একজন হুজুর নিমিষেই হারিয়ে যান ভিন্ন একটি জগতে। নিজের চেনা সত্ত্বাকে খুঁজে নেয় এই দীঘিরপাড়ের লোকদের এমন অকৃত্রিম ভালোবাসার আবেশে। মনে মনে গল্প আঁকেন বিড়বিড় করে রমিজউদ্দীন কিংবা দীঘির এই পাড়ের মনির ভুঁইয়া আর মোটর সাইকেল হাঁকিয়ে বেড়ানো বাকের ডাক্তারদের নিয়ে। কী এক মায়াতে আচ্ছাদিত ঢাকা-চিটাগাং মহসড়কের এক পলকের এই দীঘিরপাড়!
গরুর হাট, হাশিলঘর, খড় আর গোবরের প্রিয় গন্ধের ব্যস্ততা ফেলে প্রায় একযুগ পরে আবারো মাদরাসায় কুরবানির চামড়া কালেকশনে নিজেকে উজাড় করে দিই সকল ছোট-বড় মনখারাপকে পাশ কাটিয়ে। ঈদের দিনের সকালে সেই কবে বাইতুস সালামে চোখের জল শুকিয়েছে কিংবা আমারই অন্তর আরেক শিশুর আকাশি পাঞ্জাবিতে ভর করে হেঁটে হেঁটে আড়ালে যায় বাবার হাত ধরে ঈদগাহের দিকে, অসহায়ের মতো ছুড়ি হাতে ঝাপসা চোখে দেখা সেদিনের স্মৃতিরা এইসব ঈদে আবারো যেন আমার কাছে নিজ বাড়িতে ফিরে আসে। ঢাকা-চিটাগাং হাইওয়ের নির্লিপ্ত প্রিয় মাখন হাইওয়েতে কত শত বাসভর্তি স্বপ্ন বাড়ি চলে যায় আমার চোখের সামনে দিয়ে। মাদরাসার মাঠ থেকে ছুটে চলা স্বপ্নভর্তি এসব গাড়ী কিংবা নাড়িরটানের মানুষদের থেকে হঠাৎ যেন ছিটকে আমি পড়ে থাকি গৌরিপুর, দাউদকান্দির হাইওয়ের পাশে। আমার হাহাকার উঠতে চায় হেঁচকি দিয়ে, স্বপ্ন যাবে বাড়ি আমার। রাতে আধোঘুম আধো জাগরণের ঘোরে কানের কাছে ফিসফিস করে পরীর কণ্ঠ, যেনো আমারই পাশে মাথায় হাত বুলিয়ে মন খারাপ করে বলতে থাকে, তুমি ঈদে বাড়ি আসবে না কেন, ভালোলাগে না। আমি মনখারাপকে ছুড়ে ফেলতে শিখি পাশেই পদ্মার মতোই নির্বিকার দ্বিধগ্রস্থহীন বয়ে যাওয়া হাইওয়েতে হর্ন বাজিয়ে ছুটতে থাকা কোন বাসের নিচে। তুমি কি ঈদের আগে আসবা না–বাবা কিংবা ভাইদের এসব প্রশ্নের উত্তরে আমি দুঃখকে ঝেড়ে ফেলি আমার হাইওয়ের প্রেমের ধুলোময় সাগরে। ছুটি পাওয়া ছাত্ররা ঈদে বাড়ি যায়, হাত বাড়িয়ে দেয় মুসাফাহার জন্য, দুয়ার জন্য। ওদের চোখেমুখে আমি আমাকেই দেখতে দেখতে বলতে থাকি, আসতাও দিয়ুকুমুল্লাহা…।
কিছুই হবে না অবশেষে এমন এক ধোঁকার রাজ্য থেকে বের হই না আলসেমি করে। হয়তো আরো ভিন্ন কোন উপকারী পন্থা ছিলো আমাদের জন্য, আরো সম্মানজনক কোন ব্যবস্থা, কিংবা পরিবারকে নিয়ে ঈদ করা যায় এমন কোন পক্রিয়া হয়তো ছিলো বা আছেও আমাদের, যা এই মাদরাসায় এখনো সেইভাবে কার্যকর হতে পারেনি বা হয়নি। এইসব হয়তো যদি কিংবা কার্যকরী পরিকল্পনার উল্টোপিঠেরো কত কথা বেরিয়ে আসতে চায় জেনারেটরের মেশিন স্টার্টের পর গদগদ করে বের হতে থাকা কালো ধোঁয়ার মতন!
প্রত্যন্ত অঞ্চল, গ্রামাঞ্চলের একমাত্র কওমি মাদরাসা, আলিয়ার সাথে লড়াই করে টিকে থাকা লজিংবাড়ি-ভিত্তিক ছাত্রের লেখাপড়া, চাল-ভুট্টা কালেকশনে পরিচালিত মাদরাসা, ক্ষেত নিংড়ানো, গরু বাছুর দাবড়িয়ে বেড়ানো অনাবাসিক হুজুরের ছবকে পরিচালিত গ্রামের কওমি মাদরাসা, টাকার অভাবে চশমা কিনতে না পারা ছেলেটার বড় লাইটের নিচে দাঁড়িয়ে চোখের সাথে লেপ্টে ধরে কিতাব মুখস্ত করা মাদরাসা কিংবা অভাবী কিন্তু মাথা নোয়াবার নয় এমন মানসিকতার অধিকারী ছাত্রের মাদরাসায় খাবারের দুইশ টাকার শর্তে দুইগ্রাম দূরের কোন টিউশনির ব্যবস্থা করে দেয়া মাদরাসায় কর্মজীবনের কিছু সময় দিয়ে যাপিত জীবনের আরো কিছু রূপ দেখার সুপ্ত ইচ্ছায় এসে জড়িয়ে পড়ছি দিনদিন আমি তাঁদের সাথে। আরব বিশ্বের স্বপ্নে বিভোর আমার ছাত্রজীবন অবাক হয়, কত সুন্দর ছোট ছোট স্বপ্নের জীবন বুনে কত সুখে রয়েছে এখানকার মানুষজন! গাছের প্রথম ফল, গাভীর প্রথম দুধ কিংবা বিদেশ থেকে পাঠানো ছেলের প্রথম মাসের বেতনে কেনা মোটা মোটা জিলাপিতেই খোশদিল উস্তাদদের এসব মাদরাসায় কিভাবে ‘ইন্না আরাযনাল আমানাতা’র ধারণাতীত বিশাল ইলম সহজলভ্য হয়ে ওঠে! দীন ও ধর্মের যথাসম্ভব সঠিক ও আদি চর্চায় অভ্যস্ত পিতার বয়েসী আমার সহকর্মী উস্তাদদের জীবনের ঘনিষ্ঠ গল্পে বিহ্বল হয়ে যাই প্রতিনিয়ত! আবার সমবয়সী কলিগের দুঃখবোধ আমাকে আচ্ছাদিত করে নেয়, নতুন বিবাহিত বউকে রেখে মাদরাসায় ঈদ করার হাহাকার যেন বন্ধুসম সহকর্মীর ইমোর একাউন্ট থেকে আমাদেরকেও পেয়ে বসে টুকটাক! তবুও দিনশেষে সবাই ভালো থাকি, অন্তত অভিনয় করে হলেও! এখানে ছাত্ররা যারা ঈদে কিংবা ঈদের পরেও বাড়িতে না যেয়ে মাদরাসায় থাকবে তাদের অনেকের মনে তেমন কোন দুঃখবোধ নেই। আমি এদের আরো কাছাকাছি হওয়ার চেষ্টা করি, জিজ্ঞেস করি, ‘বাবা-মা ছাড়া ঈদ করতে খারাপ লাগে না?’ এদের কী নির্মোহ স্বাভাবিক কণ্ঠের উত্তর! মাথা নাড়িয়ে লাজুক মৃদু হাসিতে বলতে থাকে, ‘খারাপ লাগলেও থাকোন লাগবো না! নাইলে মাদরাসায় খামু কি। কেউ বলে রোজার ঈদ তো করলামই বাড়িত আর এই ঈদ মাদরাসায় করমু।’ কেউ আরো অবাক করে দেয়, ‘জি না হুজুর, খারাপ লাগার কী আছে।’ আবার কেউ আমার শুদ্ধ কথা প্রথমেই বুঝে উঠতে না পেরে বলে ‘বুঝি নাই হুজুর।’ দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করার উৎসাহ হারিয়ে যায় আমার।
আমার ব্যক্তিগত দুঃখবোধ থমকে থাকে। আমার শিক্ষকদের জন্য দুয়া আসে। তাঁরা কিতাবী ইলমের সাথে তারবিয়াহ আর হিকমাহ শেখানোর চেষ্টাও করেছেন। কতটুকুই-বা শিখতে পেরেছি। তবুও এইটুকু বুঝতে পারি যে, দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা একটা কাজের এমন উলঙ্গ সমালোচনা গুরুজনদের প্রতি আস্থা নষ্ট করে দেয়। বর্তমানের ব্যাপক উন্নত চিন্তার চর্চা, উদার মানসিকতা ও আর্থিক সচ্ছলতার প্রেক্ষাপটে এই পুরনো রীতি সময়ের অনেকের কাছে ভালো নাও লাগতে পারে, বরং না লাগাটা কাম্য। তবুও পদ্ধতির সমালোচনা করতে যেয়ে ইলমের গুরুত্বপূর্ণ দিক ‘আদব’-কে মনে মনে অজস্রবার হত্যা করা তো আমাদের সামগ্রিক পতনেরই সম্মিলিত আয়োজন। আগে ইসরাইলী, জাল বর্ণনায় আমাদের তাফসীরের ক্লাস, ওয়াজ ভরপুর থাকতো। এসব দিনদিন কমেছে। উলুমুল হাদীসের চর্চা অনেক ভুলকে শুধরিয়ে দিচ্ছে। তাহকীকী লেখাপড়া, গবেষণাধর্মী আলোচনা সত্য ও উত্তমকে সামনে তুলে ধরছে। এইযে, সামগ্রিক একটা বিপ্লব, অনেক মারাত্মক মারাত্মক ভুলের আলহামদুলিল্লাহ এতো এতো পরিবর্তন! নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারে সক্ষম পরিধিতে নীরব সংস্কারই বিশৃঙ্খলাহীন এই অপ্রতিরোধ্য পরিবর্তনের ঝামেলাহীন যাত্রাপথ। দূর থেকে দেখে মায়া কিংবা সত্যিকারের কান্নারা বন্দী থাকে মিডিয়ার সাদা-নীলাকাশে। অথচ মাদরাসায় চামড়া টানতে যেয়ে হৈ-হুল্লোড়, হঠাৎ ঝুম বৃষ্টিতে চামড়াকে চাদর বানিয়ে দৌড়ানো কিংবা নারায়ে তাকবীর বলে মাদরাসার মাঠে আরেকটি গরু শোয়ানের উল্লাসের আনন্দে আনন্দে ত্যাগ ও তিতিক্ষার যেই এক নীরব পাঠশালার গল্প আমাকে মুগ্ধ করে তার আনন্দও তো সেই ইমাম মুহাম্মদের চ্যালেঞ্জের মতই অনেকটা–‘আইনা আবনা-উল মুলূক মিন হাযিহিল লাযযাত?’
দিনশেষে চামড়ার সংখ্যার কমবেশির মহাভাবনা নিয়ে দায়িত্বশীলেরা যেন বসে যান ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ডিজিটাল ডিসপ্লের সামনে! আশা-আকাঙ্ক্ষা আর ভয় মেশানো এইসব প্রহর খুব অচিরেই রূপকথায় জায়গা করে নেবে ইনশা-আল্লাহ! আর আমিও বুঝে পাবো আমার পাওনা, তার আগে হয়তো নড়বড়ে মাড়ি নিয়ে এসবের গল্প করে সময় কাটাব আরো অভিজাত মানসিকতার তালিবুল ইলমদের সাথে। সেই সময় ও এই সময়ের তাবত গল্পের নায়কেরা ভালো থাকুক, সুখে থাকুক, নিরাপদ সময়ে বন্দী থাকুক।
লেখক : মুহাদ্দিস ও গদ্যলেখক