যেভাবে হারিয়ে গেল ফেয়ার মিডিয়া : অস্বচ্ছতা নাকি জালিয়াতি?

|| তাসনিফ আবীদ ||

ফেয়ার মিডিয়া লিমিটেড। অনেক স্বপ্ন আর আশা জাগিয়ে হারিয়ে যাওয়া এক নিরাশার গল্প লুকিয়ে আছে যেখানে।

ইসলামিক মিডিয়ার শূন্যতা আমরা নানা সময়েই অনুভব করে থাকি। অনেকেই অনেকভাবে উদ্যোগ নিই সেই শূন্যস্থান পূরণের। বলা যায়, সেসব উদ্যোগগুলোর একটি ছিল ‘ফেয়ার মিডিয়া লিমিটেড।’

লিখিয়ে তরুণদের মনে অন্য ধরণের দাগ কাটা পত্রিকার নাম ‘সাপ্তাহিক লিখনী।’ এই পত্রিকার কভারে রঙিন কালিতে পৃষ্ঠা জুড়ে বিজ্ঞাপন ছাপা শুরু হয় ‘ফেয়ার মিডিয়া লিমিটেড’র। তুমুল পাঠকপ্রিয় পত্রিকা সাপ্তাহিক লিখনীতে ‘ফেয়ার মিডিয়া লিমিটেড’র বিজ্ঞাপনে চোখ আটকে যায় পাঠকের। মোহ তৈরি হয় এ নিয়ে। তারপর তাদের সামনে আসে ‘ফেয়ার মিডিয়া লিমিটেড’র বিস্তারিত তথ্য। ইসলামের পক্ষে কথা বলবে এমন মিডিয়া বুননের আশায় পাঠকরা অর্থ বিনিয়োগ করে প্রতিষ্ঠানটিতে। কিন্তু তাদের আশার গুড়ে বালি ছড়িয়ে কাউকে কিছু না বলেই হারিয়ে যায় ‘ফেয়ার মিডিয়া লিমিটেড’।

কেন হারিয়ে গেল ফেয়ার মিডিয়া লিমিটেড? গ্রাহকের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির লেনদেনই বা কেমন ছিল? এসব বিষয়ে জানতে ফেয়ার মিডিয়া লিমিটেড ও সাপ্তাহিক লিখনীর একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তাদের কেউই সমাধানমূলক কিছু বলতে পারেন নি। অনেকে বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন নিজেদের মতো করে।

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিষ্ঠানটির প্রকাশিত পত্রিকা লিখনীর সঙ্গে যুক্ত একজন বলেন, ‘ফেয়ার মিডিয়া লিমিটেড’ মূলত লিখনীর তুমুল জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে বড় ধরনের ইসলামিক মিডিয়াসহ বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের অভিজ্ঞতার কমতি, নিজেদের মাঝে বোঝাপড়ার অভাব এবং আর্থিক হিসেব-নিকেশে ঝামেলার কারণে তা আর বাস্তবতার মুখ দেখে নি। একাধিকবার বিভিন্ন গ্রাহক তাদের শেয়ার বিষয়ে যোগাযোগ করলেও তেমন কোনো সাড়া পায়নি।

‘তবে প্রতিষ্ঠানটি যেহেতু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিনিয়োগ নিয়েছিল তাই তা গ্রাহকরা সহজেই ভুলে গেছে। তাছাড়া শেয়ার-হোল্ডারগণ একটি বিশেষ দলের কর্মী, সমর্থক বা গুণমুগ্ধ হওয়ায়- সংগঠন, নেতা ও নিজেদের মান রক্ষায় বিষয়গুলো নিয়ে কোনো জটিলতা তৈরি করেনি।’ –জানান তিনি

প্রতিষ্ঠানটিতে বিনিয়োগ করা বেশ কয়েকজন শেয়ার-হোল্ডারের সঙ্গে যোগাযোগ করেও বিষয়গুলোর সত্যতা পাওয়া গেছে।

‘ফেয়ার মিডিয়া লিমিটেড’-এ বিনিয়োগ করা ১০০০ টাকার একটি রশিদ দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার-হোল্ডার ও ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের জেলা পর্যায়ের সাবেককর্মী মাজহারুল মোল্লা বলেন, আসলে বড় বড় মানুষদেরকে দেখে এখানে টাকা দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, লাভ-লস যাইহোক কিছু পাই আর না পাই- ইসলামের পক্ষে কথা বলার মতো একটি মিডিয়া তৈরি হোক। অনেকটা দানের নিয়তেই দিয়েছিলাম। কিন্তু অল্প ব্যবধানে যখন দেখেছি ‘সাপ্তাহিক লিখনী’ এবং ‘ফেয়ার মিডিয়া লিমিটেড’ দুটোই হারিয়ে গেছে তখন খুব কষ্ট পেয়েছি।

নোয়াখালী সদরের বাসিন্দা আমিনুল ইসলাম নামে এক শেয়ার-হোল্ডার বলেন, আমাদেরকে ব্যবসার কথা বলে টাকা নেওয়া হয়েছিল। বিনিয়োগকারী অনেকেই তখন ছিল ছাত্র। তাদের কষ্টের টাকাগুলোই বিনিয়োগ করেছিল। এটা সম্পূর্ণই আমানত। আমার মতে, লাভ-লস যাই হয়েছে সেটা কোনো অনুষ্ঠান করে গ্রাহকদেরকে যদি ভালোভাবে বুঝিয়ে বলা হতো তাহলে খুবই ভালো হতো। ফেয়ার মিডিয়ার আনফেয়ার কর্মকাণ্ড অনেকের আস্থা নষ্ট করেছে। মানুষের মাঝে একটা বাজে ধারণা তৈরি হয়েছে। এখন যদি সত্যি সত্যিই আলেমরা ভালো কোনো উদ্যোগ নেয়, তাহলে মানুষ আর আলেমদেরকে সহজে বিশ্বাস করবে না।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ফেয়ার মিডিয়া লিমিটেড’র চেয়াম্যান ছিলেন গাজী আতাউর রহমান, এম.ডি. ছিলেন আশরাফুল আলম এবং ডিএমডি ছিলেন শাহ ইফতেখার তারিখ। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির ডিরেক্টর পদে ছিলেন ৯ জন। যাদের অন্যতম কবি মুহিব খান।

প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে বিনিয়োগকারীদের অভিযোগসহ নানা বিষয়ে যোগাযোগ করা হয় কবি মুহিব খানের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমি ‘ফেয়ার মিডিয়া লিমিটেড’র মূল কোনো দায়িত্বশীল ছিলাম না। তাই এর আর্থিক বিষয়ে কীভাবে কী হয়েছে বা শেয়ার-হোল্ডারদের সঙ্গে পরবর্তীতে কী লেনদেন হয়েছে? তা আমার জানা নেই। বিষয়টি প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে হয়তো জানা যাবে।

‘অন্যান্য ৯ জন ডিরেক্টরের মতো আমিও একজন ডিরেক্টর ছিলাম। ফেয়ার মিডিয়ায় ডিরেক্টর হিসেবে আমার ২ লাখ টাকা বিনিয়োগ ছিল। আমি সেটি পাই নি। আমার জানা মতে, চেয়াম্যান থেকে নিয়ে ফেয়ার মিডিয়ার কেউই তাদের বিনিয়োগের টাকা ফেরত পায় নি। কারণ এটি বিশালভাবে লস করে।’ –জানান কবি মুহিব খান

তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানটির প্রকাশিত পত্রিকা ‘সাপ্তাহিক লিখনী’র নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলাম। তাই লিখনীর আর্থিক কোনো বিষয়ের সঙ্গেও আমি যুক্ত ছিলাম না। আমার দায়িত্ব ছিল পত্রিকাকে কীভাবে সমৃদ্ধ করা যায়, এর কন্টেন্ট’র মান কীভাবে বাড়ানো যায়; সেগুলো। যতটুকু মনে পড়ে, আমি নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে মাসিক ১৫ হাজার টাকা বেতনে নিযুক্ত ছিলাম। পত্রিকাটি আড়াই বছরের মতো প্রকাশিত হয়। প্রজেক্ট লসের কারণে আমি শেষের দেড় বছরের মতো কোনো বেতন পাই নি। আসলে আমাদের চেষ্টা ছিল পাঠক ও বিনিয়োগ কারীদের জন্য ভালোকিছু করার। কিন্তু তা সম্ভব হয়ে উঠে নি।

‘ফেয়ার মিডিয়া লিমিটেড’-এ আমার জানা মতে যারা বিনিয়োগ করেছে তাদের মাঝে সবাই ছিল দ্বীনদার। কেউ ছাত্র, কেউ ইসলামী রাজনৈতিক দলের কর্মী বা ধর্মপ্রাণ মানুষ। আর ফেয়ার মিডিয়ায় চেয়ারম্যান, এম.ডি, ডিএমডি ও ডিরেক্টর ছাড়া অন্যকারো বড় কোনো বিনিয়োগ ছিল বলে মনে পড়ছে না। ১ হাজার, ২ হাজার, ৫ হাজার –বিনিয়োগের সংখ্যাগুলো অনেকটা এমনই ছিল। তবে যারা বিনিয়োগ করেছে, তারা যদি ১ টাকাও বিনিয়োগ করে থাকে; সেই টাকার কী হলো সে বিষয়ে জানার অধিকার তারা রাখে। গ্রাহকদের সঙ্গে তাদের বিনিয়োগের বিষয়ে লেনদেনগুলো ক্লিয়ার করা হয়েছিল কী না তা আমারও জানা নেই।’ –বলেন ফেয়ার মিডিয়া লিমিটেড’র এই ডিরেক্টর

তার মতে, এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান দায়িত্বশীল যারা ছিলেন তারা নানাভাবে নানা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। নিজেদের জায়গায় সবাই-ই সামাজিকভাবে ভালো অবস্থানে আছেন। তাদের মাঝে আর্থিক স্বচ্ছতার কোনো অভাব ছিল বলে মনে হয় না। বিভিন্ন ব্যবসা যেমন নানা সময়ে ‘লস’ প্রজেক্টে চলে যায় ‘ফেয়ার মিডিয়া লিমিটেড’ও তেমনই হয়েছিল বলে আমি জানি।

‘ফেয়ার মিডিয়া লিমিটেড’-এ বিনিয়োগ করা শেয়ার-হোল্ডারদেরকে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লস বা সার্বিক বিষয়ে জানানো হয়েছিল কীনা জানতে চেয়েছিলাম এর চেয়ারম্যান গাজী আতাউর রহমানের কাছে। তিনি বলেন, আসলে প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন ছিল। তা আর সম্ভব হয়নি। আর্থিক ক্ষতির বিষয়ে আমাদের অফিস থেকে গ্রাহকদের জানানো হয়েছে। আরো বিস্তারিত জানতে চাইলে আপনি আমাদের অফিসে আসুন।

তবে একাধিক গ্রাহক গাজী আতাউর রহমানের এই কথার বিপরীত বলছেন। তাদের দাবি, তাদেরকে এ বিষয়ে কিছুই জানানো হয়নি।

‘ফেয়ার মিডিয়া লিমিটেড’ এর কথা উল্লেখ করে আমাদের দেশে আলেমদের ব্যবসায়িক প্রজেক্টগুলো কেন আলোর মুখ দেখে না? এ বিষয়ে জানতে চেয়েছিলাম ইসলামী অর্থনীতিবিদ এবং আই এফ এ কনসালটেন্সি লি. এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক মুফতি আব্দুল্লাহ মাসুমের কাছে।

তার মতে, আমাদের দেশের আলেমসহ ধার্মিক যারা উদ্যোক্তা হতে চায়, তাদের স্বাভাবিকভাবে শরীয়ার অন্যান্য বিষয়ে যেমন জ্ঞান রয়েছে মোআমালা (লেনদেন) বিষয়ে ওই রকম ধারণা নেই। ব্যবসার সবকিছু শরীয়া মোতাবেক হচ্ছে কী না তা একজন শরীয়া কনসালটেন্ট’র মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করেন না তারা। এর বড় কারণ অস্বচ্ছতা, অবহেলা ও অসচেতনতা।

‘ব্যবসায় আসা আলেমদের অনেকেই একটা ভুল আত্মতৃপ্তিতে ভোগেন। তাহলো, আমি যেহেতু আলেম তাই আমি সবজানি। আসলে কিন্তু বিষয়টি এমন নয়। একটা কথা বুঝতে হবে, সবার ফিল্ড আলাদা। যারা যে বিষয়ে অভিজ্ঞ তাদের কাছ থেকে সে বিষয়ে সহযোগিতা নেওয়া উচিৎ।’ –যুক্ত করেন তিনি

তার মতে, আলেমদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে আর্থিক ঝামেলা হওয়ার বড় কারণ, তারা আলাদা একাউন্টেন্ট রাখার প্রয়োজন মনে করে না। নিজের মতো করে হিসেব রাখে। এরপর একসময় গিয়ে দেখা যায় নানা কারণে আর্থিক একটা বড় গড়মিল সামনে আসছে। তাছাড়া পোস্টিং এনালাইসিসেরও একটা বিষয় আছে। কোন খাত থেকে কোন খরচ করবো? কীভাবে করবো? কোনো কারণে কোনো খাতে লস দেখা দিলে তা সামাল দিবো কীভাবে তা নিয়ে বিস্তর জানাশোনার বিষয় আছে। এসব বিষয়ে জানার ও বোঝার কমতি থাকলেই ঝামেলাগুলো তৈরি হয়।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘পাবলিক মিডিয়ায় সততা ও স্বচ্ছতার প্রতীক’ প্রতিপাদ্যকে ধারণ করে যাত্রা শুরু করেছিল ‘ফেয়ার মিডিয়া লিমিটেড’। ব্যবসায় লাভ-লস হতেই পারে। বিশেষ করে মিডিয়া ব্যবসায় লসের পরিমাণটাই নানা সময়ে বড় হয়ে যায়। বিষয়টি এই প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ সুন্দরভাবে সমাধান করতে পারতো। এখন দুনিয়ায় তো নানাভাবে বিষয়টি চাপা পড়ে গেছে, পরকালের বিচারের কথাও তো স্মরণ রাখা উচিৎ। তাছাড়া ‘আলেমদের একটি প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে’ বিষয়টি নিশ্চয়ই সাধারণ মানুষের মনে ভালো কিছু বয়ে আনবে না।

আগের সংবাদনেতানিয়াহুকে গ্রেপ্তারের ঘোষণা নরওয়ের
পরবর্তি সংবাদঘূর্ণিঝড় রেমালে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানালেন চরমোনাই পীর