|| তাসনিফ আবীদ ||
এদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে মিশে আছে ‘আলিয়া মাদরাসার নাম’। মাদরাসা বলতে এক সময় আলিয়া ও কওমিকে বুঝোনো হলেও নানা কারণে এখন আলিয়াকে মাদরাসার তকমা থেকে অনেকেই সরিয়ে দিচ্ছেন। প্রশ্ন তুলছেন এর শিক্ষাকারিকুলাম, ড্রেসাপ, সহশিক্ষাসহ নানা বিষয় নিয়ে। অনেক অভিভাবক আস্থা হারিয়ে আলিয়া থেকে নিয়ে নিজের সন্তানকে স্কুল বা কওমি মাদরাসায় ভর্তি করাচ্ছেন। এর পেছনে কারণ কী? যুগ যুগ ধরে ঐতিহ্য ধরে রেখে চলে আসা আলিয়া মাদরাসার ঘাটতি বা কমতিটা আসলে কোথায়?
বায়তুশ শরফ আদর্শ কামিল (এমএ) মাদরাসার সাবেক প্রিন্সিপাল ড. মাওলানা সাইয়েদ মুহাম্মদ আবু নোমান এ নিয়ে বেশকিছু বিষয় তুলে ধরেন।
শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে ভূষিত হওয়া এই গবেষক বলেন, অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, আলিয়া মাদ্রাসার বর্তমান যে সিলেবাস এটি খুবই হতাশা ব্যঞ্জক। বর্তমানে আলিয়ার যে সিলেবাস আছে এই সিলেবাসে অধ্যায়ন করে একজন ইসলামিক স্কলার, সচেতন ফকিহ, বিদগ্ধ মুহাদ্দিস, যোগ্য আলেম হওয়া তো দূরের কথা একজন ভালো ইমাম হওয়াও সম্ভব নয়। এটা আমি এমনি এমনি বলছি না, অভিজ্ঞতার আলোকে বলছি।
তিনি বলেন, আলিয়া মাদ্রাসায় দাখিল পাস করার সাথে সাথে যারা সাইন্স নিয়ে পড়ে তারা কলেজে চলে যায়। আলিমে আর ভর্তি হয় না। এরপরও যে কয়জন থাকে তারা আলিম শেষ করার সাথে সাথেই ইউনিভার্সিটিতে চলে যায়। মাদ্রাসায় ফাজিল এবং অনার্স, কামিল হাদিস এবং মাস্টার্স পড়ার জন্য কোন ছাত্র পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও তাদের ডুয়েল এডমিশন থাকে। ইউনিভার্সিটিতেও এডমিশন থাকে, মাদ্রাসাতেও থাকে। মাদ্রাসায় কোনো ক্লাস করে না, করে ইউনিভার্সিটিতে। ফলে নামকাওয়াস্তে কামিলের একটা সনদ, অনার্স এর একটি সনদ, এবং তাফসীর বিভাগের একটি সনদ নেয়। তাকে যদি বলা হয়, বুখারী শরীফ কয় খন্ডে বিভক্ত? সে বলতে পারে না। তাকে যদি বলা হয়, তিরমিজির লেখক কে? সে বলতে পারে না। তারমানে সে জীবনেও কিতাব গুলো দেখে নাই। অথচ মাদ্রাসা থেকে সনদ নিচ্ছে।
‘আলিয়া মাদ্রাসায় শুরু থেকে নিয়ে আলিম পর্যন্ত স্কুল এবং আলিয়া মাদ্রাসার অভিন্ন সিলেবাস দিয়ে পড়ানো হচ্ছে। আগে আলিয়া মাদ্রাসার সিলেবাসে ইসলামী ভাবধারার কবি সাহিত্যিকদের লেখাগুলো প্রাধান্য পেত। কিন্তু এখন সেগুলোর অনুপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। অমুসলিম লেখকদের লেখায় বই ভর্তি। এসব বই পড়ে মাদ্রাসার ছাত্ররা কী আলেম হবে! আমার বোঝা আসে না।’ -যোগ করেন তিনি
তার মতে, ফাজিল এবং কামিল এর মধ্যে আরবি কিতাবাদী রাখা হয়েছে। এখন একজন শিক্ষার্থী যদি নিচ থেকে আরবি না পড়ে আসে, আরবি ভাষা যদি না বুঝে, আরবি গ্রামারে যদি দক্ষতা অর্জন না করে তাহলে সে তখন এসে কিভাবে আরবি কিতাবগুলো পড়বে? তখন সে কোনদিনই ফাজিল পড়বে না, মাদ্রাসায় অনার্স করবে না, কামিল পড়বে না, তাফসীর পড়বে না এবং মাস্টার্সও করবে না। তাই এখন দেখা যাচ্ছে যে মেধাবী ছাত্ররা দিন দিন কলেজ এবং ইউনিভার্সিটিতে চলে যাচ্ছে। মাদ্রাসা বলতে গেলে প্রায় খালি অবস্থা। আলিয়া মাদ্রাসার কর্তৃপক্ষের মধ্যে যারা চিন্তাশীল মানুষ তারা এখনই এ বিষয়ে ভেবে দেখা উচিত।
এদিকে রাজধানী ঢাকার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দারুননাজাত সিদ্দীকিয়া কামিল মাদরাসার মেধাবী সন্তান ও দারুন নাজাত আইডিয়াল মাদরাসার কিতাব বিভাগের প্রধান মাওলানা আবু বকর সিদ্দিক তাওহীদ বলেন, আলিয়া মাদরাসার ছাত্রদের ইলমি নাজুকতার প্রথম কারণ সিলেবাসে অতিমাত্রায় আধুনিকায়ন এবং যাচ্ছেতাই পরিবর্তন। আমাদের পড়াকালীন আরবি ছিল ৬০ থেকে ৭০ পার্সেন্ট আর জেনারেল বিষয় ছিল ৩০ থেকে ৪০ পার্সেন্ট। কিন্তু এখন সেটা হয়ে গেছে পুরোপুরি উল্টো।
তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, আপনি শুনলে অবাক হবেন নেসাবে যেসব আরবি কিতাব আছে সেগুলো ছাত্ররা তো ধরেই না, একসময় সেগুলোর নোট পড়লেও এখন সেটাও হয় না। বছরের শুরুতেই গাইড পড়া শুরু হয়ে যায়। এমনকি অনেক জায়গায় শিক্ষকরা ক্লাসে বছরের শুরুতেই গাইড পড়ানো শুরু করে। ছাত্ররা নির্দিষ্ট কিছু প্রশ্নোত্তর পড়ে রেজাল্টের জন্য।
তিনি আলিয়া মাদরাসার ইলমী নাজুক অবস্থার কারন বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, আমি দীর্ঘ বিশ বছর আলিয়া মাদরাসা জগতে পড়াশোনা করেছি। আগের যুগে আলিয়ায় যোগ্য ইলমী আলিম তৈরি হলেও বর্তমান আলিয়া মাদরাসার অবস্থা খুবই করুন যা বলার মত নয়। আমি নিজে এ অবস্থার প্রত্যক্ষদর্শী ও সাক্ষী । এর বহুবিধ কারন নজরে পড়ল; যার মধ্যে মোটাদাগে হল, এক. আধুনিকায়নের নামে আরবী সিলেবাস সংকোচন ও অপরিকল্পিত সিলেবাস। দুই. পরীক্ষার রেজাল্ট নির্ভরশীল পড়াশোনা ও নোট গাইডের সয়লাবতা। তিন. চাকরি জগতে ইসলামি জ্ঞানের অবমূল্যায়ন। চার. উর্দু ফার্সী ভাষা উঠিয়ে দেয়া। পাঁচ. জেনারেল সাবজেক্ট চরমভাবে বৃদ্ধিকরন। ছয়. অযোগ্য শিক্ষকদের নিযুক্তি ও তাদের গাফিলতি। সাত. পরীক্ষার খাতা সঠিকভাবে মূল্যায়ন না হওয়া। আট. ছাত্রদের গাফিলতি ও দারসে অনুপস্থিতি। নয়. সহশিক্ষার মত জঘন্য মুসীবত ও ফিতনা। দশ. সালাফের তুরাস ও বর্তমান ইলমী জগৎ সম্পর্কে চরম অজ্ঞতা ও বেখবরী।
‘যেখানে অনেক স্কুল কলেজে র্যাগ ডে নিষিদ্ধ হচ্ছে দিন দিন, সেখানে অনেক আলিয়া মাদরাসায় এসব যুক্ত হচ্ছে। তাছাড়া শিক্ষার্থীদের লেবাস-পোশক নিয়ে তো না-ই বললাম।’ যুক্ত করেন তিনি
তবে আশাবাদ ব্যক্ত করে মাওলানা আবু বকর সিদ্দিক বলেন, আলহামদুলিল্লাহ, আমাদের দারুন নাজাত, ছারছিনাসহ দেশের কিছু মাদরাসা এখনও সচেতন। তারা ছাত্রদের সঠিকভাবে পরিচালনা করার জন্য সরকারী সিলেবাসের পাশাপাশি নিজেরাও নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে। এখনো তারা মূল আরবি কিতাব থেকে দরস দেন। আলিয়া মাদরাসার ইতিহাস ঐতিহ্য ধরে রাখতে হলে এখনই সচেতন হতে হবে। না হয় এক যুগ পর এই শিক্ষাব্যবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে কেউ বলতে পারে না।