রহমত ও বাংলাদেশে ইসলামি পত্রিকার ধারা

আশির দশক থেকে পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত মনযূর আহমাদ। কাজ করেছেন দৈনিক, সাপ্তাহিক এবং মাসিক পত্রিকায়। তার সবচে বড় পরিচয়—তিনি বিপুল সমাদৃত মাসিক রহমতের দাপুটে সম্পাদক। সেইসঙ্গে তিনি করে চলছেন অনুবাদ এবং গ্রন্থ রচনা। গত ১৮.৫.২০২০ ইং ফাতেহের পক্ষ থেকে প্রবল দাপুটে এই সম্পাদকের মুখোমুখি হয়েছিলেন আশরাফুল হক। সম্পাদক উপুর করে ঢেলে দিয়েছেন তার অভিজ্ঞতার ঝাঁপি। তুলে ধরেছেন গত তিন দশকে ইসলামি পত্রিকার পরিচ্ছন্ন একটি বয়ান। ফাতেহের পাঠকদের জন্য মুখোমুখি সংলাপটি তুলে ধরেছেন সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী নিজেই।

আশরাফুল হক: লেখালেখি শুরু করেন ছাত্রজীবনেই?

মনযূর আহমদ: সে সময়ে—ছাত্রজীবনে আমাদের লেখালেখি করাবে কে? লেখালেখিও যে করা যায়, এই চিন্তাটা আমাদের ভিতর ছিল না। চিন্তাটা আসে ফারেগ হওয়ার একটু আগ থেকে। তখন একটা পরিবর্তনের হাওয়া লাগতে শুরু করে মাত্র।

আশরাফুল হক: কোন উপলব্ধি থেকে লেখালেখি শুরু করেন?

মনযূর আহমদ: আমার মূল উপলব্ধিটা হলো ফাউন্ডেশন যখন একচেটিয়া অনেক ভালো ভালো অনুবাদ করতে লাগল, যেমন ঈমান যখন জাগল (মূল : আলী নাদাবি রাহ.; আবু সাঈদ ওমর আলী অনূদিত), এই বইটা পড়ার পর আমার ভেতর একটা চেতনা জাগল। তাছাড়া এর আগে পড়েছিলাম শানদার মাজি। এরও আগে পড়েছিলাম সিন্ধি রাহ. এর শাহ ওয়ালিউল্লাহর রাজনৈতিক চিন্তাধারা। এগুলো পড়েছিলাম উর্দু থেকে। এমন কিছু কিছু বই আমাদের চিন্তার জগতে একটা আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তাছাড়া বড়ো একটি বিষয় হলো আমরা ছাত্রজীবন থেকে ছাত্রসংগঠনের সাথে জড়িত ছিলাম। কাজেই আমাদের চেতনাটা ছিল একটু অগ্রসর, বহুমাত্রিক। এই সংগঠনের মাধ্যমে আমরা ভালো ভালো বই নির্বাচন করতাম ছাত্রদের সাংগঠনিক পাঠ্যের জন্য।

আমরা বাংলা পড়া শুরু করেছিলাম ১৯৭৮-৭৯ থেকে। এর আগে চেতনা সম্বৃদ্ধ বাংলা বই ছিল খুব কম। তবে বঙ্কিম, শরৎ, হেমন্ত, রবীন্দ্র ও নজরুলের সাথে পরিচিত ছিলাম শৈশব থেকে। ৭১-এ নানা-বাড়ির পাশের হিন্দু মজুমদার বাড়ির লোকেরা যে বইগুলো হেফাজতের জন্য তাদের বাড়ি রেখে গিয়েছিলো সেগুলো থেকে মূলত পাঠ শুরু। ওপারের ছোট-বড় লেখকদের সাথে তখন থেকে আমরা পরিচিত। তখন বাংলা উন্নয়ন একাডেমির শিশুতোষ বইগুলোও বেশ মান-সম্পন্ন ছিলো। নানাকে তারা দেবের মত শ্রদ্ধা করত। ৭১-এ সে এলাকার হিন্দুদের বিশ্বস্ত আশ্রয় ছিলেন দেওবন্দ-সাহারানপুরে পড়া আমার নানা মাওলানা আব্দুর রব রাহিমাহুল্লাহ। তখনই তো পড়েছিলাম তাদের রেখে যাওয়া আরব্য রজনী—আলফ লায়লা।

আশরাফুল হক: কোন সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন? সংগঠক কে ছিল?

মনযূর আহমদ: ছাত্র ফৌজ। এটির সংগঠক ছিলেন মাওলানা আব্দুল মতিন সাহেব (ঢালকানগরের পীর সাহেব)। লালবাগে ছাত্র থাকাকালীন তিনি এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ফলে তাঁর বড়ো বড়ো মুরব্বিদের পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন ছিল। অনেক বড়ো বড়ো ব্যক্তি ছিলেন তাঁর দিকনির্দেশক হিসেবে।

মরহুম মাওলানা সাখাওয়াত হোসাইন সাহেব, মুফতি আবু সাঈদ সাহেব, জামিয়া রাহমানিয়ার মরহুম নোমান সাহেব, মাও. মাহবুবুল হক কাসেমি, মাওলানা আশেক এলাহি কাসেমি, মাওলানা আবু তাহের জিহাদি, মাওলানা নুরুল হুদা ফয়েজি, মাওলানা জোনায়েদ আল-হাবিব, মুহিব্বুল্লাহ কাসেমি—এরাসহ আরো অনেকে তো এই ছাত্র ফৌজেরই সৃষ্টি।

আশরাফুল হক: আপনারা সংগঠনের মাধ্যমে অগ্রসর হলেন, অথচ আমরা জানি—ছাত্রজীবনে সংগঠনে জড়ালে ক্ষতি হয়!

মনযূর আহমদ: সংগঠন যে ছাত্রদের ক্ষতি করে, এটা ঠিক কথা নয়। এটা আমাদের দুর্বলতা। এমন বলা আমাদের হজমের সমস্যার কথা প্রকাশ করে।

আশরাফুল হক: তাহলে এটা আমরা কেন বলি?

মনযূর আহমদ: আমি মনে করি—আমাদের কেউ অতিক্রম করে কিনা, সেই হীনম্মন্যতা ও সংশয় থেকে আমাদের এসব কথা বলা।

আশরাফুল হক: কিন্তু বাস্তবতাও তো আছে!

মনযূর আহমদ: এখানে সংগঠন কী, সেটা আলোচনার বিষয়। দেখো—প্রতিটি মাদরাসায় সাপ্তাহিক যে অনুষ্ঠানগুলো হয়, সপ্তাহের এক বিকেল বা নির্দিষ্ট যে সময় দেয়া হয়, সেটাকেই সাংগঠনিক কাঠামো দিয়ে সেখান থেকে নেতৃত্বের যোগ্য ছেলেগুলো বাছাই করা কঠিন নয়। দশটা ছেলে কথা বলবে, উপস্থাপন করবে, বিষয়ভিত্তিক আলোচনা করবে, একটি বিষয় নিয়ে দক্ষ দুয়েকজনের তত্ত্বাবধানে একমাস-দুমাস-তিনমাস-ছমাস আলোচনা করবে, সেখানে বিজ্ঞ দুয়েকজন লোক থাকবে, পুরস্কার প্রদান হবে, উৎসাহিত হবে, ছেলেদের কিছু দায়িত্ব দিয়ে দেয়া হবে, দায়িত্বপালনে অভ্যস্ত করা হবে, প্রতিটি ক্লাশে ক্যাপ্টেন থাকবে—এভাবে খুব সহজে ছেলেদেরকে নেতৃত্বের গুণাবলীতে সম্বৃদ্ধ করে গড়ে তোলা মোটেই কঠিন নয়। সংগঠনগুলো তো এই কাজই করে।

আশরাফুল হক: ছাত্র ফৌজের মূল উদ্দেশ্য কী ছিল?

মনযূর আহমদ: মূল উদ্দেশ্য ছিল দক্ষ ব্যক্তিত্ব গঠন করা। নেতৃত্বের উপযুক্ত ব্যক্তি সৃষ্টি করা। মাদরাসার পরিবেশ থেকে যোগ্য মানুষ তৈরি করা। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিকাশের ধারায় এগিয়ে যাওয়া।

আশরাফুল হক: ছাত্র ফৌজের পাঠ্য কয়েকটি বইয়ের নাম!

মনযূর আহমদ: পাঠ্যক্রমটা বিশেষ মনে নেই। কিছুই আর হাতে নেই এখন। সর্বশেষ সূত্র ছিলেন মাওলানা সাখাওয়াত সাহেব, তিনিও পরপারে চলে গেলেন। তবে ছাত্র ফৌজের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল—খুব চৌকস ছেলেদের বাছাই করা হতো। আব্দুল মতিন সাহেব সেই গোড়া থেকেই মানুষ চিনতেন। তিনি এখনও মানুষ চেনেন। কার ভিতর কী আছে, সেটা ধরতে পারেন। এখনও অনেকেই বলে—তার সামনে যেই বসে, তিনি তার ভিতরটা এক্সরে করে ফেলেন—কার ভিতরটা কেমন সেটা তিনি ধরতে পারেন। এটা তার অনেক বড়ো একটি বৈশিষ্ট্য। তিনি এখন অনেক বড়ো পীর! পীররা সাধারণত ফিকরি হন না। আমরা সাধারণত এমনটি দেখি না। ফিকরি মানুষ পীর হলে নিজের সাথে নিজের একটা দ্বন্দ্ব তৈরি হয়ে যায়। আমি ব্যক্তির সাথে আমি আরেক ব্যক্তি—এমন একটি সঙ্কট তৈরি হয়ে যায়। অথচ তিনি অনেক বড় ফিকরি মানুষ। এখানে তার বড়ো একটি বৈশিষ্ট্য হলো—পীরচরিত্রের ভালাভোলা নিরেট ইবাদাতমনার সাথে তিনি নিজেকে সমন্বয় করে ফেলেছেন। তিনি ব্যক্তি হিসেবে অনেক ফিকরি ও বিচক্ষণ। আমার দৃষ্টিতে বৃহৎ নেতৃত্বেরও যোগ্য।

আশরাফুল হক: ছাত্র ফৌজের সামনে কোন বাধা বা সঙ্কট ছিল?

মনযূর আহমদ: আমরা যখন ছাত্র ফৌজ করি, তখন একই সময়ে ছিল লাজনাতুত তুলাবা। এই দুটার মাঝে সঙ্কটের কোন প্রশ্ন ছিল না। কিন্তু সঙ্কট তৈরি করা হয়েছিলো। একপর্যায়ে ছাত্র ফৌজকে জামায়াতি, শিবির, বাম ইত্যাদি অপবাদে আহত করা শুরু হলো। এজন্য ছাত্র ফৌজকে অনেক নিগৃহীত হতে হয়েছে। অথচ দেখো—ছাত্র ফৌজ দশ বছরেরও কম সময় কাজ করেছে এবং এরই মধ্যে অসংখ্য ফিকরি ও নেতৃত্বের যোগ্য ব্যক্তি তৈরি করেছে। আমি যে কজনের নাম বললাম, সবাই ফিকরি মানুষ। নেতৃত্বের গুণাগুণসমৃদ্ধ ব্যক্তিত্ব। নেতৃত্বের পর্যায় এবং নেতৃত্বের নিজ নিজ জায়গায় তারা পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত।

ছাত্র ফৌজ চলল। এটাকে জামায়াত বানানোর চেষ্টা করা হলো। অনেক ছেলে মাদারাসা থেকে বহিষ্কৃত হল। নিগৃহীত হলো। ছাত্র ফৌজের বেশি প্রভাব ছিল ময়মনসিংহে। অযৌক্তিকভাবে এটাকে জামায়াত বানানোর চেষ্টা হলো। এটি ছিল ক্যাডারভিত্তিক সংগঠন। এর চারটি স্তর ছিল। চতুর্থ স্তরটা ছিল খুবই কঠিন—ফকিহ ছাড়া এই স্তরে উন্নীত হওয়া যেনো অসম্ভব ছিল। তবে তৃতীয় ও চতুর্থ স্তরের কেউ উন্নীত হওয়ার আগে সংগঠনটির বিলুপ্তি ঘটে। ছাকনি বা ফিল্টারটা ছিল জটিল। দ্বিতীয় স্তরেই তাকে কোন হক্কানি পীরের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করতে হতো। বিচ্ছিন্ন থাকার সুযোগ ছিল না। নিজের মতো চলার সুযোগ ছিলো না। লাগাম পরানো হতো।

যারা ইসলামি ছাত্র ফৌজে ছিল, যাদের বাংলাদেশে ও দেওবন্দে জামায়াতি প্রতিপন্ন করার চেষ্টা হলো, মাহবুবুুল হক কাসেমি, সাখাওয়াত সাহেব, মুফতি সাঈদ সাহেব, আশেক এলাহি কাসেমি, আবুল কালাম কাসেমি, হাকিম আব্দুল হামিদ কাসেমি—এরা দেওবন্দে শক্ত ঘাঁটি তৈরি করেছিল। এরা তখন দেওবন্দ থেকে আসলাফ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করত। এদের ফিনিশ ও ভিনিশ করার জন্য বাংলাদেশ থেকে দেওবন্দে তৎপরতা চালানো হলো—বহিষ্কার করানোর জন্য। বাংলাদেশ থেকে একটি ওয়াফ্দ গিয়েছিল। কিন্তু পালনপুরি সাহেবের আশ্রয়ে এরা রক্ষা পেয়েছিল। তাঁর বক্তব্য ছিল—এরা তো সব ক্ষেত্রে ফাস্ট—পড়াশোনায় ও আদব-আখলাকে—এদের বহিষ্কার করা হবে কেন!

কী বলবো, বলো! আমাদের সবচে বড়ো পরীক্ষা হয়েছে হেফাজতের সময়। ‘গণজাগরণ’ কী ছিল? এটি ছিলো আমাদের বিশ্বাসকে ধুলিস্মাৎ করে দেয়ার চেষ্টায় প্রচণ্ড বেগের সর্ববিধ্বংসী এক সাইক্লোন। এটা যদি ভালোভাবে আঘাত করতেই পারতো আমাদের অস্তিত্ব ধ্বসিয়ে দিতো। বাংলাদেশের মানুষ হল ঈমানদার, বিশ্বাসী। এজন্য বাংলাদেশীদের বিশ্বাস ও চেতনার কাছাকাছি হলেন ইকবাল, নজরুল, ফররুখ। একাত্তরের পর থেকে কিছু সুবিধাভোগী মানুষ বাংলাদেশ থেকে ইকবালকে বিদায় করার চেষ্টায় একটু একটু করে অগ্রসর হয়েছে যে কারণে, রবীন্দ্রনাথকে ভাষার নামে বিশ্বাসের জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করার পাঁয়তারা একটু একটু করে অগ্রসর হয়েছে যে লক্ষ্যে, সেই সূত্র থেকেই ‘গণজাগরণ’ এর জন্ম।

বস্তুত গণজাগরণ এবং হেফাজত ছিল বেঈমান ও ঈমানের সবচে বড়ো বিভাজন-রেখা। তখন কে কোন রেখায় ছিল, বলো! হেফাজতের পক্ষে কারা ছিল, আর বিচ্ছিন্ন কারা ছিল! ঈমানের ডাকের পক্ষে কারা ছিল, আর বেঈমানের ‘গণজাগরণ’ এর পক্ষে কারা ছিল—যেখানে সেকুলার এবং নাস্তিকদের সমর্থন ছিল, ইসলামকে মুছে ফেলার সকল আয়োজন ছিল—ছাত্র ফৌজের প্রতিটি সদস্য ও ব্যক্তিত্ব হেফাজতের পক্ষে ও নেতৃত্বে ছিল, আর ওই দলের লোকগুলো কোন পক্ষে ছিল? ঈমানদারদের পক্ষে থাকার সৌভাগ্য থেকে তারা তো বঞ্চিত হলো। কেন? ‘আমিই সত্য’ এই তাআসসুবিয়াত বড় ভয়ংকর। এই অহংকারের ভেতরে ঈমান হারানোর উপাদান থাকে।

আশরাফুল হক: ছাত্র ফৌজের সবচে বড়ো সাফল্য কী?

মনযূর আহমদ: আমরা যখন হাটহাজারীতে ছাত্র ফৌজ করি, তখন কজন ছিলাম আমরা! দশ-পনেরো জন! সেদিনের প্রতিটি ছেলে এখন কোথাও না কোথাও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে ভালো অবস্থানে সম্মানের সাথে আছে। সবচে বড়ো সাফল্য হলো একটা অসচেতন ও বোকা ছেলেও তুমি পাবে না এখানে। আরো বড়ো ব্যাপার হলো মানুষ নিজেকে অগ্রসর বা বিকশিত করতে গিয়ে কতোভাবে হোঁচট খায়, ধোকা খায়, বিভ্রান্ত হয়, আকিদাগত ফিরকাগত মানহাজগত ঝামেলায় ফেঁসে যায়; কিন্তু ছাত্র ফৌজের একটা ছেলেও এমন পাবে না। এখানের প্রতিটি ছেলে এখনও সহিহ। কারণ এদের মূল চেতনায় ছিল থানবি থেকে নাদাবির মতো মুতাদিল-ভারসাম্যপূর্ণ মানুষ! আমাদের কাজ ছিল সালফে সালিহিনের পদাঙ্ক অনুসরণ করা। এর বাইরে না।

আশরাফুল হক: ছাত্র ফৌজের পাঠ্য কয়েকটি বইয়ের নাম জানতে চেয়েছিলাম।

মনযূর আহমদ: থানবি রাহ. এর কয়েকটি বই, ফরিদপুরি রাহ. এর কয়েকটি বই, এরপর নাদাবি রাহ. এর বই ছিল আমাদের পাঠ্য। দাওয়াতের জন্য একটি বই ছিল পাকিস্তানি খুররম মুরাদের। বইটি ভালো ছিল । পড়ার মত, জানার মত।

আশরাফুল হক: লেখালেখিতে আপনার প্রথম কাজ কী?

মনযূর আহমদ: আমার প্রথম কাজ ছিল মুফতি আমিমুল ইহসান সাহেবের হাদিস সংকলনের ইতিহাস। এটি ছিল অনুবাদ। প্রকাশ করেছিল রশিদিয়া লাইব্রেরী। টোটালটা আমারই অনুবাদ ছিল, কিন্তু ওটা আমার নামে আসেনি। অনুবাদটা এসেছিল আমার উসতাজ ইউসুফ শরীফ সাহেবের নামে।

আশরাফুল হক: আপনার প্রথম মৌলিক রচনা কী?

মনযূর আহমদ: আমার মৌলিক কাজ তো খুব হয়নি। প্রবন্ধ-নিবন্ধ ছিল বেশি। প্রথম প্রবন্ধটা প্রকাশ পায় দৈনিক আজাদে— শামসুল হক ফরিদপুরীর সাহিত্য সাধনা। অনেক বড়ো একটি আর্টিকেল ছিল সেটি। দারুর রাশাদের সালমান সাহেব লিখিয়েছিলেন এবং তিনিই অফিসে গিয়ে লেখাটি জমা দিয়েছিলেন। বলা যায় তারই বদান্যতায় লেখাটি প্রকাশ পায়।

আশরাফুল হক: পত্রিকার সাথে যুক্ত হন কীভাবে?

মনযূর আহমদ: আমি ঢাকা এসেছিলাম লেখালেখি শেখার জন্য, কোন চাকরি করার জন্য নয়। হাটহাজারী গিয়ে যখন সংগঠনে জড়ালাম, এরপর থেকে ‘আমাকে মাদরাসায় পড়াতেই হবে’—এমন ধারণা আমাকে আলোড়িত করেনি। ফারেগ হওয়ার পরপর মাদরাসায় পড়ানোর ভালো ভালো প্রস্তাব ছিল, মুহতামিম হওয়ার প্রস্তাব ছিল, কিন্তু ওসবে আমার আগ্রহ ছিলো কম। তখন আমি কায়িক-শারীরিকভাবে অতটা মানানসই ছিলাম না। খুবই হাল্কা-পাতলা—মাত্র পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ কেজি ওজনের এক যুবক মাত্র। তখন বয়সও কম ছিলো। কাঁথা জড়িয়ে শুয়ে থাকলে ওখানে কেউ আছে বলে মনে হতো না। শুয়ে থাকলে মরহুম লশকর সাহেব আমাকে বলতেন ‘লাশ’—একেবারে বিছানার সাথে মিশানো।

আশরাফুল হক: ঢাকা এসেই কোন পত্রিকায় সম্পৃক্ত হয়েছেন, নাকি আরো সময় পড়ে?

মনযূর আহমদ: না। ঢাকায় এসে অলিগলি অনেক ঘুরেছি। আব্দুল লতিফ নেজামি রাহ. কদিন আগে মারা গেলেন। তার একটা পত্রিকা ছিল সরকার। এই পত্রিকার জন্মসময়ে তাঁর সাথে আমিও ছিলাম। ডিক্লারেশন, প্রেস, এটাসেটা। ক্রয় করার জন্য আমাকে প্রেস দেখতে বলা হলো। আজিমপুরের শেখসাহেব বাজারে তখন প্রচুর প্রেস ছিল। ওখানে গিয়ে প্রতিদিন দুতিন ঘন্টা করে প্রেস দেখতাম। পরে অবশ্য নতুন প্রেস ক্রয় করা হল। এরপর পত্রিকা প্রকাশ হলো। প্রথম সংখ্যায় আমার কাশ্মীর নিয়ে বিশাল একটি লেখা ছাপা হলো। এভাবে বেশ কবছর পত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছিল।

আশরাফুল হক: সরকারে কী পরিমাণ সময় ছিলেন?

মনযূর আহমদ: কী পরিমাণ থাকা বলতে ওখানে আমি স্টাফ ছিলাম না। ওটার সম্পাদকও বেতনভুক্ত ছিলেন না। এমনিই চলছিলো। বেতন-টেতনের কোন বালাই ছিল না। যা পেয়েছি—শুধু অভিজ্ঞতা। লেখালেখি করা, লেখার সাথে থাকা, লেখকদের সাথে থাকা, লেখার জন্য নিজেকে তৈরি করা, এইসবের জন্য সেখানে থাকা।

আশরাফুল হক: আব্দুল লতিফ নেজামিকে কেমন দেখেছেন?

মনযূর আহমদ: অনেক সরল-সহজ মানুষ ছিলেন। তখন একটি পত্রিকা ছিল দৈনিক শক্তি। খুব ভালো একটি পত্রিকা ছিল। মুসলিম লীগ ঘরানার পত্রিকা ছিল। এটার চীপ রিপোর্টার ছিলেন আব্দুল লতিফ নেজামি। তার লেখার হাত ছিল যথেষ্ট ভালো। কিন্তু লোকটি কখনো সচ্ছলতার মুখ দেখেননি। একটু সচ্ছলতা যদি না থাকে, সারাদিন যদি ডালচালের চিন্তা করতে হয়, তাহলে সৃষ্টি আসে কী করে! উনি সারা জীবনে এই জায়গা থেকে বেরুতে পারেননি।

আশরাফুল হক: লেখালেখি করে সচ্ছলতার মুখ কি আসলেই দেখা যায় না—যেটা অনেকেই বলেন!

মনযূর আহমদ: মুহিউদ্দিন খান রাহ. ছিলেন এর ব্যতিক্রম। তিনি এই জায়গাটা অতিক্রম করতে পেরেছিলেন। তিনি নেজামি সাহেবের সমসাময়িক ছিলেন। পরস্পর ঘনিষ্ট ছিলেন। মুহিউদ্দিন খান সাহেব ছিলেন সচেতন ও চৌকস মানুষ। তিনি লিখতেন, খেদমত করতেন, নিজে ভালোভাবে চলতেও পারতেন। আসলে ওনার ‘ধার’ ছিল। তিনি ধারালো মানুষ ছিলেন। এটা নেজামি সাহেবের ছিল না। নেজামি সাহেবের ছিল নিষ্ঠা। অনেক সৎ মানুষ ছিলেন। গোঁজামিল ছিল না তার চরিত্রে। দুনিয়ার প্রতি কোন মোহ ছিল না। এই চরিত্রের মানুষ বর্তমান সমাজে বিরল। নেজামি সাহেব কখনো ধান্ধা করেছেন, এ কথা কেউ বলতে পারবে না। অথচ এক সময়ে তিনি ধান্ধার কেন্দ্রে ছিলেন!

আশরাফুল হক: আপনার ভালো লাগা পত্রিকা ছিল কী কী?

মনযূর আহমদ: ভালো লাগে মানে কী! আসলে ইসলামি ঘরানার পত্রিকাগুলো কখনো ভালো লাগার মতো করে প্রস্তুত হতে পারেনি ও সাজানো যায়নি। তবু আমরা ইসলামি ঘরনার পত্রিকাই করেছি। প্রচুর পাঠক পেয়েছি।

আশরাফুল হক: কী কারণে?

মনযূর আহমদ: বিষয়বৈচিত্র, সাজ-সজ্জা, ভঙ্গিমা, বলন, লেখন, উপস্থাপন, সবকিছুতেই অন্যদের বৈচিত্র ছিল, অগ্রসরতা ছিল। আরেকটু খুলে বলি—আমরা যখন একটা গল্প বলি, এখানে ইসলামকে টেনে নিয়ে আসি পোষাকসুদ্ধ। সরাসরি ইসলামের পোষকটা পরিয়ে দেই, কিন্তু ইসলামের মিশেলটা দিতে চেষ্টা করি না। একজন মুসলিম যখন গল্প লিখবে, তাতে তার সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের একটা মিশেল ও ফ্লেভার থাকবে। পাঠক পুরোটা পড়ে একটা গন্ধ পাবে। বিমোহিত হয়ে মূল চেতনা খুঁজে নিবে। আমরা সেই কাজটা করি না। শুধু পোষাকটা দেই, প্রাণ দেই না। এজন্য আমাদের গল্প কখনো গল্প হয় না। জীবনের গল্প হয় না। কবিতাগুলো জীবনের কবিতা হয় না। দেখো—আল মাহমুদের অনেক কবিতায় ইসলামের ফ্লেভার আছে। উনি ইসলামের পোষাকে কবিতা লিখেননি, কিন্তু মুসলিম হিসেবে কবিতা লিখেছেন। সেখানে ইসলাম জীবনের কথা রূপে উপস্থাপিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের কবিতা পরিচয় দেয়—উনি পৌত্তলিক। আল মাহমুদের কবিতা পরিচয় দেয়—উনি মুসলিম। গল্প-কবিতায় এটা হলো আসল ব্যাপার।

আশরাফুল হক: আপনারা কোন পত্রিকা বেশি পড়তেন?

মনযূর আহমদ: দেশ পত্রিকাটি বেশি পড়তাম। আর ছিল দৈনিক বাংলার সাপ্তাহিক আয়োজন বিচিত্রা। ভালো মানের পত্রিকা ছিল। কিন্তু লাভ হবে কী! সেখানে আমাদের বিশ্বাসের শিকড়ের লোকেরা কাজ করতো না। সেখানে কাজ করতো বামচিন্তার মানুষরা। যেখানে আমাদের বিশ্বাসের কোন স্থান থাকতো না। বরং বিশ্বাসকে আহত করার চেষ্টা করা হতো এবং পাশ কাটানোর চেষ্টা করা হতো। তারা পাঁচজন মানুষের কাতারে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটা উক্তি উল্লেখ করতো। এটা অন্যায়। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিশেষভাবে হাইলাইট করার সাহস তাদের হয়নি।

তখন আরেকটা ভালো কাজ ছিল ইনকিলাবের আয়োজন পূর্ণিমা। ইনকিলাবের আরেকটা ভালো আয়োজন ছিল প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর স্মরণিকা। এটার ভিতর বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাংবাদিকতা ইত্যাদির শিকড়ের কথাগুলো নিয়ে এসেছিল।

আশরাফুল হক: পত্রিকা জগতে আমাদের প্রধান সঙ্কট কী মনে হয় আপনার দৃষ্টিতে?

মনযূর আহমদ: অনেককিছু। আমরা একটা বিষয় এখনো বুঝি না—মাওলানা আকরাম খাঁ সাংবাদিকতা করেছেন। তিনি বাঙালী মুসলিমদের সাংবাদিকতার জনক। তার রচনাগুলো ইসলাম সম্বৃদ্ধ। এর বাইরে কোন রচনা খুব কম। তার পরে আর কোন মৌলভি সাহেব পত্রিকা করতে পারলো না। অথচ আজাদকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান। এখানে যতো তৎপরতা ছিল, সব আজাদ প্রকাশ করতো। কতো বড়ো ভূমিকা আজাদের ছিল—সাতচল্লিশে। এর দ্বারা বুঝা যায়, মৌলভিরা পত্রিকা করার অনুপযুক্ত না। কিন্তু আমরা মানসিকতা লালন করি না। ত্যাগ দিতে রাজি না। আমাদের প্রথম প্রশ্ন থাকে—বেতন দিবেন কতো! মাওলানা আকরাম খাঁ পত্রিকা করেছেন মিশন হিসেবে। মানিক মিয়া সাহেব ইত্তিফাক করেছেন মিশন হিসেবে। এদের ত্যাগের পাল্লাটা জুনাইদ বাগদাদির মতো। নিজের কাজে তারা মুখলিস ও নিঃস্বার্থ ছিলেন। তাদের টার্গেটের জায়গা ছিল অব্যর্থ—আমাকে ঐ জায়গায় যেতেই হবে। এই মিশন ও ত্যাগ আমাদের নেই।

আশরাফুল হক: আমরা আমাদের বলয়ে গ্রহণযোগ্যতার জন্য আলেম লেখক এবং অ-আলেম লেখকের একটা বিচার করি অনেকে!

মনযূর আহমদ: আলেম মানে যে ইসলাম জানে। সবাই তো আর আলেম না। অনেকে ইসলামকে বিভিন্ন জায়গায় পড়ে একটা আবেগ লালন করে, কিন্তু সে আলেম না। তো আমরা নজরুল-ফররুখের মতো সবাইকে টানতে পারি, যারা ইসলামের আবেগ লালন করেন। আলেম না হওয়ায় কাউকে দূরে ঠেলে দিতে পারি না। আহসান হাবীব, জসিমউদ্দীনকে কেন টানতে পারবো না! যে প্রকৃতির কথা বলে, আকাশ বাতাস গাছগাছালি পাখপাখালি নিয়ে যে কথা বলে, সে আল্লাহর সৃষ্টির কথাই তো বলে। আসল কথাই বলে। তাকে কেন টানা যাবে না!

আশরাফুল হক: এই উদারতা দেখাতে পারি না কেন?

মনযূর আহমদ: সঙ্কটটা হলো আমরা কুদরতকে বুঝি না। কুরআনের শুধু অর্থ পড়ি, তাত্ত্বিক তাৎপর্য ধরতে পারি না। দুয়ে দুয়ে চার বুঝি, কিন্তু দুয়ে দুয়ে চার কেন হয় তা বুঝি না। যদি বুঝতে পারি—দুয়ে দুয়ে চার কেন হলো, তখনই বুঝতে পারবো প্রকৃতি জিনিসটা কী! এটাকে বলে ভিতরের বুঝ, শিকড়ের বুঝ, গভীরের বুঝ। সবচে বড়ো বিষয় হলো— রাসূলের হাদিস পড়ার আগে রাসূলের সীরাত পড়া উচিৎ। না হয় বোকামি হবে। সীরাত না পড়ে হাদিস পড়লে মনে হবে কিছু বিক্ষিপ্ত বাণী। ব্যক্তিত্ব ধরতে না পারায় তার কথাগুলো মিলানো যাবে না। সীরাত পড়ে যখন বুঝবো রাসূল কী, তখন হাদিসকে জীবনঘনিষ্ঠ বানানো একদম সহজ হবে। কোন প্রশ্ন আসবে না, সংশয় থাকবে না।

ইতিহাস না পড়লে নিজেকে জানতে পারবে না। আমি কে, চিনতে পারবে না। আচ্ছা বলো— আজ পর্যন্ত কোন মৌলভি সাহেব চিন্তা করেছি— এই ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এতটুকু জায়গায় ষোল কোটি মুসলমান! হলো কীভাবে! এ তো বিরাট সম্পদ। আমি এর উত্তরাধিকারী হলাম কীভাবে! কেউ এই গবেষণার প্রয়োজন মনে করে! কার কাছে হাদিস পেয়েছি সেই গবেষণা করি, কার কাছে ঈমান পেয়েছি সেই গবেষণা করছি! ঈমান এতোই সস্তা জিনিস! তুমি যদি বাংলাদেশে রাজনীতি করতে চাও, তোমাকে বুঝতে হবে বাঙালী কী! আমার ভাইয়েরা কী চায়! না বুঝলে তুমি রাজনীতিকে রাজাকারির সাথে মিলিয়ে ফেলবে। এটা বুঝেছেন বঙ্গবন্ধু, শহীদ জিয়া। আমার ভাইদের জন্য কাজ করতে হবে, এজন্য আমাকে আগে আমিকে চিনতে হবে। আমিকে চিনলে আমার ভাইদেরও চিনতে পারবো। তখন ওদের চাহিদা, মুখের কথা, চোখের ভাষা বুঝতে পারবো।

আশরাফুল হক: অধ্যাপক আখতার ফারুক এবং মুহিউদ্দিন খান সাহেব রাহ. দের হাতে আপনার লেখালেখি। তাদের নিয়ে যদি কিছু বলতেন!

মনযূর আহমদ: অধ্যাপক আখতার ফারুক আমার আইডল। ওনাকে আমি অনুসরণ করতাম। উনি ছোট ছোট বাক্য লিখতেন। খুবই শক্তিশালী শব্দ চয়ন করতেন। ওগুলো আমি অনুসরণ করার চেষ্টা করতাম। এজন্য আমিও আমার সম্পদকীয়গুলোয় ছোট ছোট বাক্য ব্যবহারের প্রায় চেষ্টা করতাম। ছোট বাক্যের বক্তব্য অনেক শক্তিশালী হয়। বাক্য যখন বড়ো হয়, ভাব দুর্বল হয়ে যায়। অধ্যাপক আখতার ফারুকের এই জায়গাটা আমরা আলোচনা করি না। আখতার ফারুক অনেক বড়ো ছিলেন, অনেক কিছু লিখেছেন, এতটুকুই উনার মূল্যায়ন করি। কিন্তু এই পর্যন্ত ওনার রচনা ও লেখা নিয়ে কোন মূল্যায়ন তৈরি হয়েছে? পেরেছি আমরা কেউ? অথচ ওদিকে তাকাও! তারা তাদের লোকদের ভালোটুকু যত্ন করে রাখে। স্মরণিকা মানে এটাই—ঐ লোকের ভালোগুলো জমা করে রাখা। স্মরণিকা মানে সমালোচনা না। দেখো আমার হাতে এই একটি স্মরণিকা— সমাজ রাষ্ট্র বিবর্তন : জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক-গুণিজন বক্তৃতামালা। এখানে আব্দুর রাজ্জাক নিয়ে কোন কথা নেই। আব্দুর রাজ্জাক কোন প্রসঙ্গই নেই। কিন্তু এই বইটা পুরো বাংলাদেশের মতো ওজনদার। এতো মূল্যবান একটি সংকলন!

আশরাফুল হক: মুহিউদ্দীন খান সাহেব!

মনযূর আহমদ: মুহিউদ্দীন খান সাহেব ছিলেন কর্মবীর ও দরদী মানুষ। ওনার ভিতর উম্মাহর দরদ ছিল। কারণ উনি রাজনীতি করতেন। পরিবর্তন চাইতেন। উনি সৌভাগ্যবান আলেম ছিলেন। প্রচুর সম্মান সমাদর পেয়েছেন। বাংলাদেশের আলেমদের ভিতরে সর্বমহলে এমন সমাদৃত হতে কাউকে দেখিনি। মাসিক মদীনা ছিল তো ওনার, এটি বাংলাদেশের শিকড়ের একটি কাগজ। এটি এদেশে সাহিত্যে বিপুল অবদান রেখেছে, বিশেষত পাঠক-লেখক তৈরিতে। হিম্মতওয়ালা মানুষ বলেই এই পত্রিকা গড়তে পেরেছেন এবং নিরবিচ্ছিন্নভাবে অবিরাম পঁয়ষট্টি বছরে উপনীত করেছেন।

আশরাফুল হক: মাসিক মদীনা ছাড়া আপনার দৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা আর কোনটি?

মনযূর আহমদ: আদর্শ নারী বিশাল পত্রিকা। বাংলা সাহিত্যে এর বিপুল অবদান। এতো বড়ো পত্রিকা শুধু ইসলামী সাহিত্যে নয়, বাংলা সাহিত্যেই বিরল। আরেক আছে শিবিরের—কিশোর কণ্ঠ। আদর্শ নারী বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি বিশাল পত্রিকা। কতো লেখক! কতো পাঠক! কতো ছাপা! কী একটা জাগরণ! এখন একটা পরিণতি এসেছে। তখনকার পাঠকরা এখন লেখক। কতো চমকদার একটা উন্নতি। তখন কটি বই বেরুতো! তখন বছরে যে কটি বই বেরুতো, এখন সপ্তাহে ততো বই বেরোয়। এই বই কারা পড়ে! এই লেখক-পাঠক কারা তৈরি করেছে! এজন্যই আমি আদর্শ নারীকে আদর্শ কাগজ বলি।

আশরাফুল হক: মাসিক মদীনা, রহমত, আলকাউসার, আদর্শ নারী—তুলনামূলক বেশি অবদানশীল পত্রিকা কোনটি?

মনযূর আহমদ: সবকটির ভিতর সবচে বেশি অবদান আমি বলবো মাসিক মদীনার। সার্কুলেশন ছিল ধারণার বাইরে। সিরাত সংখ্যাগুলো লক্ষ লক্ষ কপি ছাপা হতো। সবচে বড়ো বিষয়— বাংলার সর্ব মহলের মানুষ এর পাঠক ছিলেন। উচ্চশিক্ষিত, কম শিক্ষিত সবাই পড়তো। মাওলানা মুহিউদ্দিন খান ছিলেন সিরাত বিশারদ। তিনি বিপুলভাবে-বিভিন্নভাবে মানুষকে সিরাত চর্চায় উদ্বুদ্ধ করেছেন।

আশরাফুল হক: রহমতের প্রতিষ্ঠাকালীন বৈশ্বিক ও রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক আবহাওয়া কেমন ছিল?

মনযূর আহমদ: সবচে জটিল। সবচে সঙ্কটাপন্ন ও অনিরাপদ।

আশরাফুল হক: এতো গ্রহণযোগ্যতা ও পাঠকপ্রিয়তা সত্ত্বেও বিভিন্ন মাদরাসায় রহমত নিষিদ্ধের তালিকায় ছিল কেন?

মনযূর আহমদ: সরকার যেটা চায় না, সেটা তুমি কতক্ষণ চাইতে পার! মাদরাসাগুলোর করার কিছু থাকতো না। এর চেয়ে সাহসী হতে পারতো না। হেফাজতের সময়টা চিন্তা করো। আওয়ামীলীগের হাত ধরে অনেকে মুহতামিম হয়েছে। এদের জন্য হেফাজতের উত্থানটা ছিল মৃত্যুর সমান। আওয়ামীলীগ যদি ফল করেই ফেলে, তাহলে মুহতামিমি শেষ। এই মুহতামিমির জন্য অনেকেই হেফাজতের সঙ্গ দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এই মুহতামিমির জন্যই অনেকে জিহাদকে এবং মুজাহিদদের সাথে প্রকাশ্যে কঠোরতা করেছে ও করছে। আমি কঠোরতা বলেছি, কারণ আমি মনে করি না কোন মৌলভি সাহেব জিহাদের বিপক্ষে থাকতে পারে। যার ঈমান আছে, সে জিহাদের বিপক্ষে থাকে কী করে! ঈমান আর জিহাদে দূরত্ব কী! একই তো! জিহাদের বিপক্ষে গেলে ঈমান থাকবে কীভাবে! জিহাদের মানসিকতা না থাকলে সে মুনাফিক। মুনাফিকের মতো মৃত্যুবরণ করে। মানে কি! ঈমানের জন্য জিহাদ কতো গুরুত্বপূর্ণ! বরং তুমি ঈমানই গ্রহণ করেছো জিহাদ করার জন্য।

আশরাফুল হক: রহমতকে নিগৃহীত হতে দেখে বা রহমতের পাঠককে নিগৃহের খবর পেয়ে সম্পাদক হিসেবে আপনার কেমন লাগতো!

মনযূর আহমদ: এটাই তো! রহমত বন্ধই তো হয় এসব কারণে। এই যন্ত্রণা থেকেই আস্তে আস্তে দেখলাম এটা করা ঠিক না। সবকিছু কলাপ্স হয়ে আসছে। বিভিন্নভাবে সবকিছু সীমিত হয়ে আসছে। একদিকে প্রশাসনের নজরদারি, আরেকদিকে মাদরাসাগুলোর ভিতরগত কিছুটা বিরোধিতা ও অসহযোগিতা, সবকিছু মিলিয়ে একটা বিরূপ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে— না, এখন আর এটা চালানো যায় না। এ জিনিসগুলো আমার অনেক সুহৃদ বুঝে না। তারা মনে করে— আমার যথেষ্ট হয়ে গেছে বা আমার বুঝি এখন এখান থেকে খাওয়া-দাওয়া খুব একটা হয় না, এজন্য বন্ধ করে দিয়েছি। অথচ আমি শেষ সময়ে তাফসীর লিখে যে টাকা পেয়েছি, সেটা রহমত চালানোর জন্য ব্যয় করেছি। ওখান থেকে বিশ হাজার টাকাও আমার সংসারের জন্য ব্যয় করতে পারিনি। আমি দায়িত্ব নেয়ার আগে পত্রিকা অনেক ঋণ ছিল, ঐ ঋণের দায়-সহই আমি দায়িত্ব নিয়েছিলাম। এই পত্রিকা আমি অনেকদিন চালিয়েছি শুধু নিজের উদ্যোগে। কিন্তু আমার বন্ধুরা এটা বুঝে না। অথচ আমার জীবনে আর্থিক প্রতিষ্ঠা হয়নি শুধু এই পত্রিকার জন্য। শুরু থেকে এই উপলব্ধি থাকা সত্ত্বেও আমি এটি করেছি অমার চেতনার জায়গা থেকে। ভালো লাগতো বলে।

আশরাফুল হক: রহমত থেকে জীবনের সবচে বড়ো প্রাপ্তি কী?

মনযূর আহমদ: ত্যাগ। ত্যাগের স্বাদ।

আশরাফুল হক: রহমত থেকে আপনার জীবনে কোন অপ্রাপ্তি …

মনযূর আহমদ: না। আমার কোন অপ্রাপ্তি নেই। আমার মতো ক্ষুদ্র একজন মানুষ, যে মক্তবে শিক্ষকতা করারও যোগ্য না, সে রহমতের মতো পাঠকপ্রিয় পত্রিকার সম্পাদক হয়েছে, এর চেয়ে বড়ো প্রাপ্তি আর কী থাকতে পারে! আল্লাহর অনেক বড়ো শুকরিয়া। এ কথা আমি অনেক সময় বলি। আমার সন্তানদেরও বলি।

আশরাফুল হক: আপনার সার্বিক জীবনের কোন সুখ-দুঃখের স্মৃতি বলবেন!

মনযূর আহমদ: আমার জীবনে ওরকম কোন দুঃখ নেই। বাবার এক সন্তান আমি। আদরে যত্নে লালিত। পারিবারিকভাবে আর্থিক অসচ্ছলতাও ছিল না। একটা জমিদারি ভাব ছিল। পরে নদীভাঙ্গনে অনেক জমি-জিরাত নষ্ট হয়ে যায়। তো ছোটবেলা থেকে আর্থিক দৈন্য অসচ্ছলতা অভাব আমি অনুভব করিনি। এরপর নিজে যখন চলতে শুরু করেছি, তখন অনেক অভাবগ্রস্ত হয়েছি।

আশরাফুল হক: আপনার দৃষ্টিতে একটি পত্রিকার প্রধান বৈশিষ্ট্য কেমন হওয়া উচিৎ?

মনযূর আহমদ: একটি পত্রিকায় বহুমতের স্থান পাওয়া উচিৎ, বৈচিত্র থাকা উচিৎ—যেগুলো ভুল নয়। সঠিক বহুমতের ধারা ত্যাগ করে এককেন্দ্রিকতা কোন পত্রিকার চরিত্র হওয়া উচিৎ নয়। ভিন্নমত মানে নতুন একটি বিশ্লেষণ। ভুল না হলে সেটিকে অগ্রাহ্য করা অন্যায়। তদ্রুপ পত্রিকার লেখক-পাঠকও একশ্রেণির থাকা উচিৎ নয়।

আশরাফুল হক: একটা পত্রিকার প্রাতিষ্ঠানিকতা কেমন হওয়া উচিৎ?

মনযূর আহমদ: রাইট পয়েন্ট। তোমার অবস্থান। তোমার অবস্থানটা সঠিক। তুমি যা বলছ, গুরুত্বের দাবিদার। বিবেচ্য বিষয়। তা সবাই নিচ্ছে। উপকৃত হচ্ছে। তুমি ধান্ধা করছ না, হাবিজাবি করছ না, অমূলক কিছু করছ না। তুমি গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করছ, এটাই হলো মূল প্রাতিষ্ঠানিকতা। এক সময়ে এসে প্রতিষ্ঠান কারো উপর নির্ভর করবে না। স্বয়ং সম্ভর। নিজের পায়ে দাঁড়ানো। এটা হলো প্রাতিষ্ঠানিকতার মূল অর্থ। চলছে; আয় হচ্ছে, ব্যয় হচ্ছে, কোনো ঋণ নেই।

মূলত পত্রিকা মানে একজন সম্পাদকের চিন্তা। সম্পাদক একজন থাকে, সাথে হয়তো সহযোগী থাকে। সম্পাদককে সকলের মতের সম্মান দিতে হবে। না হলে সেটি পত্রিকা হয় না, হয় পত্র বা গ্রন্থ।

আশরাফুল হক: আমাদের অঙ্গনে পত্রিকাগুলো আর্থিক সঙ্কটে মুখ থুবরে পড়ার কাহিনী শোনা যায়। তো একটি মনযূর আহমাদ: পত্রিকার ফান্ডিং, আয়ের উৎস, অর্থচিন্তা কেমন থাকা উচিৎ? শুধু বিজ্ঞাপন নির্ভরতাই যথেষ্ট?

মনযূর আহমদ: পত্রিকা কোন মাদরাসা-মসজিদ বা স্কুল-কলেজের মতো না। সমিতিকেন্দ্রিক বা সঞ্চয় হাতে রেখে পত্রিকা হয়েছে এমন কথা শোনা যায় না। অর্থের যোগান আস্তে আস্তে পাঠক সংগ্রহের মাধ্যমেই করতে হয়। এরপর বিজ্ঞাপন থাকতে পারে। চাঁদা ব্যবস্থা থাকতে পারে। তবে পত্রিকার জন্য চাঁদা বেশিদিন টিকে না। আর বাস্তবতা হলো, ইসলামি ঘরানার কোন পত্রিকা এখনো কোন স্থায়ী অর্থব্যবস্থার আয়োজন করতে পারেনি। করতে পারলে ভালো হত। সারা পৃথিবীর একই অবস্থা। একটা মানুষ যখন নিজেকে বিকাশ করার জন্য, নিজের চিন্তা আরেকজনের কাছে পৌঁছানোর জন্য ব্রত গ্রহণ করে, তখন সে একটা পত্রিকায় হাত দেয়। যেমন মাওলানা আবুল কালাম আজাদ। নিজের বাবার টাকা দিয়ে পত্রিকা করতেন। সৌখিন কাজ। এখন তো পত্রিকা বানিজ্যের ভিতর ঢুকে গেছে। এটা হচ্ছে বানিজ্যের স্বার্থে পত্রিকা, পত্রিকার স্বার্থে বাণিজ্য না। বিষয়টা অনেকখানি এমন—আমার বেটাগিরি দেখানোর জন্য একটা চৌকিদার দরকার আছে! বহু পত্রিকা এখন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর চৌকিদারি করে। জাতির চৌকিদারি করে না। এটা আমার অভিজ্ঞতা।

আশরাফুল হক: পত্রিকার জন্য বানিজ্য করা যায় না?

মনযূর আহমদ: কেউ করতে পারলে ভালো। তবে বাস্তবতা হলো পত্রিকার জায়গাটা বানিজ্যের জায়গা না।

আশরাফুল হক: তাহলে পত্রিকাগুলোর অর্থসঙ্কট কাটানোর কোন ব্যবস্থা হতে পারে না?

মনযূর আহমদ: অর্থসঙ্কট কোন সঙ্কট না। অর্থ প্রয়োজনীয় বিষয়। এটি আয়-অর্জন করতে হয়। কে কীভাবে অর্জন করবে, সেটা তার ব্যাপার। অর্থের অন্য প্রয়োজন যেভাবে সাড়ে, সেভাবেই সাড়তে হবে।

আশরাফুল হক: আপনি দীর্ঘদিন সম্পাদকের ডেস্কে ছিলেন। সম্পাদনা মানে কী? একজন সম্পাদকের বৈশিষ্ট্য কী?

মনযূর আহমদ: বহুমত ধারণ করার ক্ষমতা। সবার কথা সহনীয় মাত্রায় উপস্থাপন করা। বহুমত থাকবে, কেউ কাউকে আক্রমণ করবে না। সম্পাদকের এই উদারতা জরুরি। বৈচিত্রের মাঝে যে ঐক্য, তা দরকার। তা না থাকলে পত্রিকা ব্যক্তিগত লিফলেট হয়ে যায়।

একটা হলো বাক্য সম্পাদনা, একটা বানান সম্পাদনা। আরেকা হচ্ছে বিষয় সম্পাদনা। বিষয় সম্পাদনা হলো পত্রিকাটি যে চিন্তার, সেই চিন্তার সাথে লেখা ও লেখকের বিষয়টি মিললো কিনা, তা দেখা। মূল সম্পাদনার কাজটা এখানেই।

আশরাফুল হক: পত্রিকা সম্পাদনা এবং বই সম্পাদনা—দুটো কি এক জিনিস? একজন বই সম্পাদক পত্রিকা সম্পাদনার জন্য যথেষ্ট?

মনযূর আহমদ: পত্রিকা এবং বই ভিন্ন জিনিস। একটি পত্রিকা হয় একদিনের, এক সপ্তাহের বা একমাসের। কিন্তু একটি বই সারাজীবনের। এজন্য পত্রিকার সবকিছু দিয়ে বই করা যায় না। পত্রিকার যে বিষয়গুলো স্থায়ী হওয়ার মতো থাকে, সেগুলো বই হয়। তো পত্রিকার সম্পাদককে ঐ একদিন বা একমাসের সময়টাকে ধারণ করতে হয়। মনে রাখতে হয়, এই সময়ের ঘটনাপ্রবাহ আত্মস্ত করে পত্রিকার নীতি অনুযায়ী বা নিজের মত করে পাঠককে দিতে হয়। সম্পাদককে পাঠকের মন ও মনোভাব বুঝতে হয়। পত্রিকা সম্পাদনার জন্য অনেক সজাগ থাকতে হয়, কিন্তু বই সম্পাদনা এমন না। এক্ষেত্রে শুধু একটি বিষয় মনে রাখলে কাজ সম্পাদন হয়।

আশরাফুল হক: কখনো দৈনিকের স্বপ্ন দেখেছিলেন?

মনযূর আহমদ: দৈনিকের স্বপ্ন দেখিনি কোনদিন। সাপ্তাহিকের স্বপ্ন ছিল। কিন্তু তা হয়েও হয়নি।

আশরাফুল হক: হয়েও হয়নি! কেন?

মনযূর আহমদ: কদিন আগে আমি এক সাক্ষাৎকারে বলেছি— সাপ্তাহিক পত্রিকার জন্য আমরা এখনও উপযুক্ততা অর্জন করতে পারিনি। মানসিকভাবেও নয়, আর্থিক বিচারেও নয়। এই ক্ষেত্রে আমাদের দৈন্যতা কত মারাত্মক ও ভয়াবহ তা কাজে নামলে অনুমান ও উপলব্ধি করা যায়। আমাদের সামর্থ্য এখনও মাসিক পর্যন্ত সীমিত। মাসিক পর্যায়ে পত্রিকা মূলত সংবাদপত্রের আওতায় পড়ে না—সাংবাদিকতা বলতে যা বুঝায় তা সাপ্তাহিকের মাধ্যমে শুরু হয়। আর যে কোন আলিমের পক্ষে বর্তমান ধারার সাংবাদিকতার সঙ্গে নিজেকে লাগসই করা আদৌ সহজ ও স্বাচ্ছন্দদায়ক নয়। অনেক ক্ষেত্রে বিষয়টি অস্বস্তিকর হয়ে দাঁড়ায়। সবচে বড় কথা, বহু-শক্তির প্রভাব বলয়ের ভেতরে থেকে যে কোন ঈমানদার ব্যক্তির পক্ষে এ দেশে স্বাধীন সাংবাদিকতা চর্চা করার ইচ্ছা এক বড় স্পর্ধা। হয় আপনাকে কোন বলয়ের আশ্রয় নিতে হবে, না হয় অবরোধের কবলে আপনাকে নিঃস্ব হতে হবে। বিষয়টি মিডিয়াতে এর চেয়ে খোলাসা করা সম্ভব নয়।

আশরাফুল হক: দৈনিকের স্বপ্ন দেখেননি কেন?

মনযূর আহমদ: এটা অনেক বড়ো কাজ। আমি অত বড়ো ব্যক্তি না। এটা মাওলানা আব্দুল মান্নান পারতেন, করেছেন। অধ্যাপক আখতার ফারুক বড় ব্যক্তি ছিলেন, পারছেন, করেছেন। আমি ছোট মানুষ, ছোট চিন্তা করি।

আশরাফুল হক: কওমি বলয় থেকে একটি দৈনিকের প্রয়োজন মনে করেন?

মনযূর আহমদ: কওমি বলয় থেকে তুমি পত্রিকা চালাতে পারবে না। পাঠক পাবে না, কিছুই পাবে না। সবচে বড় ব্যাপার হলো বলয়টা ভেঙ্গে ফেলো। দেখ কিছু হয় কিনা!

আশরাফুল হক: বলয় ভেঙ্গে বলতে পারি— ওলামায়ে কেরামের তত্ত্বাবধান বা নির্দেশিকায় একটি পত্রিকা পরিচালনার প্রয়োজন মনে করেন কিনা?

মনযূর আহমদ: পাকিস্তানে আল-ইসলাম নামে একটা পত্রিকা হয়। আলেমরাই করে। তবে সেটি কওমি পত্রিকা না। বাংলাদেশেও প্রয়োজন আছে। তবে সম্ভাবনা কম। এখানের আলেমরা সমাজের চোখে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ রূপে বিবেচিত নয়। অবস্থান মজবুত না থাকলে জাতীয় পর্যায়ে অবদান রাখাও সম্ভব নয়। তারা কেন রাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত নয়, কেন তারা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদে পরিণত হতে পাছেন না সে এক বিশাল আলাপ। এখন থাক।

 আশরাফুল হক: কেন হবে না?

মনযূর আহমদ: অযোগ্যতা, অক্ষমতা—দুটোই। দ্বিতীয় কথা হলো পত্রিকার জন্য প্রয়োজনীয় মশলার অভাব।

আশরাফুল হক: যেমন?

মনযূর আহমদ: কী বলবো! পত্রিকার পিছনে শক্তি লাগে। প্রচণ্ড শক্তি লাগে। প্রতিদিন তোমাকে লাখ লাখ টাকা খরচ করতে হবে। আয় নেই। এই যে বিভিন্ন পত্রিকা দেখ, তুমি কি মনে করো এরা পত্রিকা দিয়ে আয় করে! প্রতিটি পত্রিকায় লস হয়। তবু পত্রিকার রং বাড়ে। কারণ, যাদের কাছে রং আছে তাদের পত্রিকার দরকার হয়। এখন তোমার সেই লোকটি কে যার একটি পত্রিকা দরকার? কী স্বার্থে একজন তোমাকে শক্তি যোগাবে? এখন পত্রিকা মানে বাণিজ্য। বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপন মানে নারী প্রদর্শন। বিজ্ঞাপন আসবে। তুমি পারবে নারী প্রদর্শন করাতে? একটা বিজ্ঞাপনও তুমি ছাপাতে পারবে? বিজ্ঞাপন ছাপাতে না পারলে কীভাবে পত্রিকা বাঁচাবে?

আশরাফুল হক: তার মানে আমরা ভবিষ্যতে এমন সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি না!

মনযূর আহমদ: প্রয়োজন নেই। এখন নতুন কোন পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করার খুব প্রয়োজন নেই। বরং আমাদের চিন্তার কাছাকাছি কোন পত্রিকাকে ডেভলপ করার চিন্তা করা যেতে পারে। এভাবে শুরু করা যেতে পারে। এটি সহজ।

আশরাফুল হক: লেখালেখি এবং সাংবাদিকতায় পার্থক্য কেমন?

মনযূর আহমদ: লেখালেখি এবং সাংবাদিকতায় অনেক পার্থক্য। লেখা তো লেখাই। কিন্তু সাংবাদিকতা হলো সংবাদ সংগ্রহ করা। এখন হয়তো সংবাদের অপেক্ষায় থাকতে হয় বা সংবাদ তৈরি করতে হয়। অপেক্ষায় থেকে সংবাদ তৈরি করতে অনেকেই পারে—লেখক মাত্রই পারে—একটা ছবি যোগ করে কিছু লিখে দিবে বা বলে দিবে। কিন্তু সংবাদ তৈরি করাটা হলো আসল ব্যাপার। কঠিন ব্যাপার। সাংঘাতিক কাজ। একদম ভিতরের কথা তুলে ধরতে হবে। পিঁয়াজ কেন দুশ টাকা দরে কিনতে হচ্ছে, এর ভিতরের খবর নিয়ে আসতে হবে। সাধারণ লেখকরা এটা পারে না।

আশরাফুল হক: মাসিক পত্রিকায় সাংবাদিকতা চর্চা হয়?

মনযূর আহমদ: দরকার নেই। সাপ্তাহিকে রিপোর্টিং হয়। মাসিকে হয় না, তা না। মাসিকেও হয়। আমরা রহমতে প্রচুর অনুসন্ধানী সংবাদ দিয়েছি। এনজিও নিয়ে অনেক সংবাদ করেছি। ব্র্যাকের মামলা খেয়েছি। লড়েছি। জিতেছি। রহমত একটি অগ্রসর পত্রিকা ছিল। এর চিন্তা ও চেতনা ছিল অদম্য। ভয় পেয়ে সত্য লুকিয়ে রাখার প্রবণতা আমাদের ছিল না। আমরা প্রচুর সত্য উন্মোচন করেছি। তো মাসিকেও করা যায়। সবাই এই কাজটি করে না। সামর্থ ও সাহসের দরকার হয়।

আশরাফুল হক: রহমতের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা বলয়ের কাছে আপনার আশা কেমন?

মনযূর আহমদ: সমাজে তো আমাদের করার কিছু নেই ‘ওয়াজ’ ছাড়া। খেদমত তো আমরা করি না। তাদের কাছে আমার আশা হলো খেদমতের মানসিকতা তৈরি করা, জাতির জন্য কিছু উদ্ভাবন করা।

আশরাফুল হক: তারা এটা পারবে? আপনার আস্থা হয়?

মনযূর আহমদ: এটা করা উচিৎ। আমরা তাদের একটা পর্যায়ে একটা চেতনার জায়গায় নিয়ে এসেছি। স্থবির একটা জায়গা থেকে তাদের আমরা সচল করে তুলেছি। এখন তারা একটু হাঁটুক, দৌড়াক, একটু অগ্রসর হোক।

আশরাফুল হক: ফেসবুকে লেখালেখিকে কতটুকু ইতিবাচক দেখেন, কতটুকু নেতিবাচক দেখেন?

মনযূর আহমদ: আসলে যারা খুব পরিণত, খুব সমঝদার, আত্মসম্মানবোধ যাদের প্রগাঢ়, তারা ফেসবুকে নড়াচড়া করে না। কে কখন কি বলে ফেলে, এই একটি ঝামেলা। আমি বললাম কী, আর সে বুঝলো কী এবং কমেন্ট করলো কী! আর এতো লোকালয়ে সবাইকে মানায়ও না। সবার কথা বলার একটা শ্রেণি আছে। সবার উদ্দেশে উন্মুক্ত প্লাটফর্মে নিজেকে উপস্থাপন করা ঠিকও না। আমি যতটুকু সামলাতে পারি, আমার দৃষ্টিভঙ্গি যতটুকু প্রসারিত, আমাকে যারা চিনবে ও বুঝবে, এদের ভিতরে থাকা ভালো। আমার একটা কথা তুমি যে অর্থে নিবে, আরেকজন সে অর্থে নেয় না। এজন্য সতর্ক থাকা উচিৎ।

তবে ফেসবুক একটি বৈশ্বিক প্লাটফর্ম। বিশাল প্লাটফর্ম। এর সুবিচার করা গেলে খুবই ভালো। খেদমত করার সুযোগ অনেক। চিন্তার গঠন, নিজের বিকাশ, অনেক কিছুর সুযোগ আছে এখানে। অনেক পাঠক লেখক শুভানুধ্যায়ী পাওয়া যায়। এজন্য সচেতন থেকে লেখালেখি করতে পারলে মন্দ নয়।

আশরাফুল হক: এখন অনলাইনের যুগ। ভবিষ্যতে প্রিন্ট মিডিয়ার আবেদন কতটুকু থাকবে বলে মনে হয়?

মনযূর আহমদ: হয়তো নতুন যেগুলো হচ্ছে, সেগুলো থাকবে না। কিন্তু কাগজের লিখা মানবজন্মের সভ্যতার সাথে জড়িত। এর আবেদন কখনো ফুরাবে না। অহি যখন নাযিল হতো, হার্ড কপি লিখা হতো। অনিবার্য কারণেই কাগজে লিখার বা হার্ড কপির আবেদন অনিঃশেষ। কাজেই এগুলো অক্ষয়। অমর। নতুন এগুলো হলো উপসর্গ। আজ হচ্ছে এভাবে, কাল হবে ওভাবে, পরশু হবে আরেকভাবে, হয়তো নাও থাকতে পারে। কী স্বাচ্ছন্দে আমরা হার্ডকপি পড়ি, আর এগুলো কী পড়ি! আমাদের চোখ সৃষ্টি হয়েছে আসলে হার্ড কপির উপযুক্ত করে। চোখের সৃষ্টি স্ক্রীনের উপযুক্ত করে নয়।

আশরাফুল হক: পত্রিকায় আর কখনো ফিরে আসার ইচ্ছে আছে?

মনযূর আহমদ: এটা আমার জন্য কোন কঠিন ব্যাপার না। আমার হায়াত পর্যন্ত আমি এটি পারব। যে কোন সময়ে করতেও পারি, ছাড়তেও পারি, ধরতেও পারি। তবে নিজে কিছু করার মতো স্বপ্ন দেখি না। কেউ যদি বলে আমার এটি চলছে, একটু গতি দিন, তখন হয়তো এগিয়ে আসতে পারি। তবে আনতারা নিয়ে স্বপ্ন আছে। বড়ো করে বছরে এক-দুটি কাগজ পাঠকের হাতে দেয়া। এর মাধ্যমে লেখক তৈরি হয়। লেখা ও পর্যালোচনা অনেক কিছু থাকে এখানে। আনতারার দুয়েকটি সংখ্যা অনেক লেখক আবিষ্কার করেছে। সবচে বড়ো ব্যাপার হলো লেখে সবাই। কিন্তু লেখার পর যখন মলাটবদ্ধ আকারে আর দশজন লেখকের পাশে নিজের অবস্থান দেখে, তখন আত্মমর্যাদাটা বা সাহসটা অনেক বৃদ্ধি পায়। বুকটা ফুলে ওঠে। মনে করে—আমি পারবো। এ জন্য আনতারা দরকার।

আশরাফুল হক: কখনো অনলাইন নিউজ পোর্টালে আসবেন!

মনযূর আহমদ: আমি ওটার উপযুক্ত না। আমি তো ফেসবুকেরই উপযুক্ত না।

আসলে আমরা অতটা যান্ত্রিক সময়ে আসিনি। এখনকার ছেলেরা যেভাবে নিজেকে যান্ত্রিকতার সাথে মিলিয়ে ফেলা, আমরা সেটা পারি না। এখনকার প্রজন্মটা যান্ত্রিক প্রজন্ম। আমরা হয়তো চালাতে পারি, ভিতরটায় ঢুকতে পারি না। আমার ছোট নাতনী এখনো স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারে না, অথচ সে যতটুকু বুঝে, আমার বাবা বা তোমার বাবাকে দাও—বহুদিন প্রশিক্ষণ নিয়েও তা পারবে না। কারণ ঐ একটাই। আমরা পৃথিবীতে একটু আগে আসছি বলে।

আশরাফুল হক: দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক—সবকিছুই কি আমাদের জন্য প্রয়োজন? কোনটার প্রয়োজন কতটুকু? একটি অপরটির পরিপূরক হতে পারে কি?

মনযূর আহমদ: সবগুলো হলে ভালো হয়। প্রত্যেকটির ক্ষেত্র ও অবদান ভিন্ন। তবে মাসিকের আবেদন কায়েমি। সবচে বেশি। এটা সেই পড়ে, যে পরিশীলিত চেতনা লালন করে। দেখো— একটা দৈনিক আমাদের টেবিলে চব্বিশ ঘন্টা থাকে, আর একটি মাসিক আমাদের টেবিলে এক মাস থাকে! তো একদিনের চেয়ে একমাসের প্রভাব অবশ্যই বেশি! এজন্য একটি জাতি গঠনে একটি মাসিকের প্রচুর প্রভাব ও কার্যকারিতা থাকে।

আমি চিন্তা করে দেখেছি—মাসিক মুহাম্মাদীর আলোচনা যতোটা হয়, দৈনিক আজাদের আলোচনা ততোটা হয় না। ষাটের দশকের বা পঞ্চাশের দশকের লেখকরা সবাই মাসিক মুহাম্মাদীর লেখক। একটি মাসিক কিন্তু লেখক জন্ম দেয়, আর লেখকরা দৈনিকে কাজ করে।

ঐ সময়টাতে আমাদের জাতিসত্ত্বাটা সবে গঠিত হচ্ছে। আবুল মনসুর, আব্দুল মওদুদ, ড. শহীদুল্লাহ, এদের সময়ে জাতির ভ্রুণ তৈরি হয়েছে। এই সময়টাতে মাওলানা আকরাম সাহেব পুরোভাগে ছিলেন। আমি মনে করি, সুন্নি-মিলাদ-কিয়াম কেন্দ্র করে কাউকে একদম ফেলে দেয়া ঠিক না। ওনার যে স্প্রিট ছিল, উনি যেভাবে লেখক ও জাতি তৈরি করেছেন—পুরো পাকিস্তান গঠনে মাওলানার আজাদের ভূমিকা ছিল একাত্তরে বাংলাদেশ গঠনের সময়ে ইত্তেফাকের মতো। তো তখন মাসিক মুহাম্মাদী ছিল। উভয় বাংলার সর্বাধিক প্রচারিত ও পঠিত পত্রিকা ছিল। আমার কাছে এর কয়েকটি সংকলন আছে। মুহাম্মাদীতে একটা লেখা ছিল ইকবালকে নিয়ে। সুদীর্ঘ লেখা। অমন লেখা কোথাও পাবে না।

আশরাফুল হক: ইসলামী ঘরানার এবং ভিন্ন ঘরানার পত্রিকার মধ্যে দৌড়ে এই সময়ে কাদের অগ্রসর মনে করেন?

মনযূর আহমদ: পাঠকের দিক থেকে ইসলামি পত্রিকা অনেক অগ্রসর। এর কাছে ওদের পাত্তা নেই। প্রথম আলো বলয় বাদে ওদের কোন্ পত্রিকাটা আছে—পাঁচ হাজার দশ হাজার চলে! আর মাসিক হলেও আমাদের কোন পত্রিকাটা পাঁচ হাজার দশ হাজার চলে না! এছাড়া বানানে ও উপস্থাপনে এখন নবীন আলেম-ওলামা অনেক অগ্রসর। অনেক সচেতন। আমাদের তরুণ প্রজন্ম এখন অনেক ভালো লেখে। আমাদের ছেলেরা যে চেতনা ও যন্ত্রণা থেকে লিখছে, এটা এখন সেকুলারদের ভিতর নেই। ওরা চেতনা হারিয়ে ফেলেছে। আমাদের ভিতর আত্মগঠনের একটা জোয়ার এসেছে।

আশরাফুল হক: তাহলে বলতে পারি—আমাদের ভবিষ্যৎটা উজ্জ্বল!

মনযূর আহমদ: তা বলতে পারি না। কারণ রাহবার নেই। এই মুহূর্তে আমাদের একজন রাহবার প্রয়োজন। প্রয়োজন একজন মুহিউদ্দিন খান সাহেবের। একজন আখতার ফারুকের, নূর মুহাম্মাদ আজমীর, আকরাম খাঁর। যাদের দেখে দেখে নবীনরা হাঁটবে।

আশরাফুল হক: ইসলামি ঘরানার নিউজ পোর্টালগুলোকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?

মনযূর আহমদ: নিউজ পোর্টালগুলোর পাঠক আছে অনেক। তবে মাদরাসা-বলয়ের বাইরের পাঠক খুব একটা নেই। এটা আমাদের দুর্বলতা। আমরা কেন যেনো সাধারণ পাঠকের উপযোগী করে নিজেদের উপস্থাপন করতে পারি না। মনে হয়—সাধারণ পাঠকের চাহিদাটা আমরা বুঝি না।

ফাতেহকে আমার কাছে অগ্রসর মনে হয়। এর এটিচিউট ভালো। তাকে পাঠকের প্রতি আরেকটু মনোযোগী হতে হবে। ফাতেহ এ পর্যন্ত যে কথাগুলো বলে ফেলেছে, আমাদের দীর্ঘ ইতিহাসে কেউ বলেনি।

আশরাফুল হক: আমাদের ছাত্র লিখিয়েদের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় অনেক উদাসীন দেখা যাচ্ছে। আমলেও ঘাটতি প্রচুর। এ বিষয়ে আপনি কী বলেন?

মনযূর আহমদ: স্বপ্নহীনতা। ছেলেদের চোখে স্বপ্ন নেই। ছেলেটা পড়ার পর কী করবে, জানে না। তার দায়িত্বের পরিধি ও পরিমাপ বিলকুল জানে না। সে পথ পাচ্ছে না। এই সমস্যাটা মারাত্মক পর্যায়ের। ক্যান্সারের মতো অনিবার্য মৃত্যুসম। আমাদের সম্ভাবনাগুলো সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ছেলেদের একটাই বলা হয়—পড়ার পর পড়াতে হবে। আর কোন গতি নেই নিজেদের বিকশিত করার। অথচ সবার পড়ানোর মানসিকতা থাকে না। অথবা অধ্যাপনার মানসিকতা আছে, কিন্তু সে এর পাশাপাশি অন্যকিছু চায়। বিজ্ঞান প্রযুক্তি তর্ক দর্শন গণিতে তার মানসিকতা। আমার মনে হয়—একটা ছেলে শরহে বেকায়া পড়ার পর অনার্স পর্যায়ে তাকে বিষয় ভিত্তিক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ শিক্ষায় পারদর্শী করে গড়ে তোলা দরকার।

আশরাফুল হক: একজন লেখকের জন্য বহুভাষা শেখার প্রয়োজনীয়তা কতটুকু?

মনযূর আহমদ: ভালো। শিখে রাখা ভালো। বড়ো লেখক হওয়ার জন্য অন্তত মাতৃভাষার পর আরবি ও ইংরেজি খুবই জরুরি। এগুলো ছাড়া কেউ চলতে পারে না। ফ্রেন্স জার্মান চাইনিজ উর্দু ফার্সি—এগুলো বড়ো বড়ো ভাষা।

আশরাফুল হক: আগে তো আমাদের সিলেবাসে উর্দু-ফার্সির গুরুত্ব ছিল এবং সে উসিলায় শিখা হতো। এখন তা ক্রমশ নেই বললেই চলে।

মনযূর আহমদ: হ্যাঁ। এই সময়ে ওর গুরুত্ব আগের মতো নেই। একসময় উর্দু শরাহ ছাড়া বাজারে কিছু ছিল না। এখন আরবি শরাহ, সাধারণ ছাত্রের জন্য বাংলা শরাহ অহরহ। কাজেই উর্দু-ফার্সি আগের মতো সবার জন্য অনিবার্য না। একটা বিষয় হলো তুমি লেখক, তোমার জন্য প্রয়োজন। সবার প্রয়োজন নেই। আরেকটি বিষয় হলো যেভাবে একটি ছেলেকে শুরুতেই কতগুলো ভাষার বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়, এটা ঠিক নয়।

আশরাফুল হক: নবিনদের স্বচ্ছ সাহিত্য চর্চায় আপনি একটি পাঠ্য-সিলেবাস প্রস্তুত করতে চেয়েছেন। তা কতদূর?

মনযূর আহমদ: এটা তৈরি হয়েছে। উন্মুক্ত করা হবে।

আশরাফুল হক: কওমি মাদরাসার বাংলা পাঠ্যগুলো একদম দৈন্যের শিকার। এ ব্যাপারে আপনি কী বলেন?

মনযূর আহমদ: বিস্তৃত ইসলাম এবং বিস্তৃত বাংলাকে ধারণ করে এই বইগুলো তৈরি হয়নি। যারা প্রস্তুত করেছেন, তারা জানেন না এর চেয়ে ভালো লেখা আছে, লেখক আছে। আর আলেম লেখকরা যদি স্বীকৃত হন, তাহলে তাদের লেখা আসতে পারে। কারণ একটি জাতীয় পাঠ্য বইয়ে স্বীকৃত লেখকের লেখা স্থান পাওয়া উচিৎ।

আশরাফুল হক: জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃত বলতে কী বুঝাচ্ছেন? বেফাক তো এমসিটিবির আওতায় চলে না। তো কে স্বীকৃতি দিবে! তাছাড়া মুহিউদ্দিন খান সাহেব-সহ অনেক আলিম লেখক জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃত। তাদের কোন লেখা কি এই পাঠ্যে গুরুত্ব পেতে পারে না এখনও!

মনযূর আহমদ: বিপজ্জনক প্রশ্ন। এর ইতিহাস তোমাকে জানতে হবে। তোমরা কেন একটা লোক থেকে বেরুতে পারলে না! কেন তোমরা পরিমার্জন করছ না। যারা পরিমার্জন করে, তারা বাংলায় কতটুকু দক্ষ! এই চিন্তাগুলো ধারন করবে কে! মুহিউদ্দিন খান সাহেবকে পাঠ্যে নেয়া উচিৎ। অনিবার্য। মুনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, আখতার ফারুক, কতো লেখক—আমাদের পাঠ্যে আসার মতো!

আশরাফুল হক: আরেকটি বিষয় হলো আমাদের অনেকে রবীন্দ্রসাহিত্যকে না করেন। এ ব্যাপারে কী বলেন?

মনযূর আহমদ: ভাষার জায়গা থেকে রবীন্দ্রনাথ অপরিহার্য। চেতনার জায়গা থেকে নজরুল ও ইকবাল অনিবার্য। পঁচিশ কোটি মানুষের ভাষার পরিচালক রবীন্দ্রনাথ। তাকে অস্বীকার করা যায় না। আমি কিন্তু ভাষার বিচারে বলছি।

আশরাফুল হক: লিখিয়েদের প্রথম পাঠ হিসেবে আমাদের বলয়ে কোনো বইয়ের পরামর্শ দিবেন!

মনযূর আহমদ: আমাদের ভেতর মৌলিক লেখক কোথায়! তরুণদের ভাষায় পা রাখতে উপযোগী রচনা নেই। এখনো সেই আজাদের কিশোরসমগ্র বা তাদের লেখায় ভর করতে হয়। হ্যাঁ, আমাদের আবু তাহের মিসবাহ সাহেব চমৎকার লিখেন। তার পুষ্প এবং কিশোর-রচনাগুলো অনেক ছেলের ভেতর লেখার জোয়ার সৃষ্টি করে। সমস্যা হলো তার লেখাগুলো বাংলার মতো করে নয়। তিনি তার মতো লিখেন। তো ওনার লেখার মতো একটা প্রজন্ম যখন টোটাল দেশে তৈরি হয়ে যাবে, তখন ওনারটাই প্রতিষ্ঠা পাবে। তা না হলে ওটা বাংলা ভাষার আইডল হতে পারবে না।

তবে আমার দুঃখ লাগে, আমাদের ছেলেরা অনুবাদ পড়ে লেখক হতে চায়। তা-ও অন্তত পক্ষে শাহেদ আলী অনুদিত মক্কার পথে বইটাও পড়ে না। শাহেদ আলী একজন শক্তিমান লেখক ছিলেন। অথচ তার নাম শোনো! তারপর দীন মুহাম্মাদ স্যারের গদ্যও তো পড়ার মতো।

আশরাফুল হক: ফাতেহকে সময় দেয়ার জন্য শুকরিয়া।

মনযূর আহমদ: আসলে ফাতেহের সঙ্গে মতবিনিময় করে আমিও আনন্দিত। ফাতেহ এগিয়ে যাক। স্বপ্ন এবং ভালোবাসা তৈরী করে। আমরা পাঠকরা তার পাশে আছি।

 

আগের সংবাদরাজমহলের অপরাজিতা
পরবর্তি সংবাদকৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা ও ইসলামি কার্যক্রমে তার প্রভাব