সুমাইয়া মারজান:
বিনতুল খালিফাতি ওয়াল খালিফাতু জাদ্দুহা
উখতুল খালাইফি ওয়াল খালিফাতু জাওজুহা
বলছিলাম এক শাহজাদির গল্প। যিনি ছিলেন পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ভাগ্যের একমাত্র অধিকারী। যার পিতা পিতামহ ভাই ভাতিজা স্বামী সকলেই রাজা-বাদশা ছিলেন। দাদা মারওয়ান (১ম) বিন হাকাম (জন্ম: ২৮ মার্চ ৬২৩; মৃত্যু: ৭ মে ৬৮৫, খেলাফতকাল: ৬৮৪–৬৮৫) ছিলেন ৪র্থ উমাইয়া খলিফা। পিতা আবদুল মালেক বিন মারওয়ান (১ম) (জন্ম: ৬৪৬; মৃত্যু: ৮ অক্টোবর ৭০৫, খেলাফতকাল: ৬৮৫–৭০৫) ছিলেন ৫ম খলিফা। বড় ভাই ওয়ালিদ (১ম) ইবনে আবদুল মালেক (জন্ম: ৬৬৮; মৃত্যু: ২৩ ফেব্রুয়ারি ৭১৫, খেলাফতকাল: ৭০৫–৭১৫) ছিলেন ৬ষ্ঠ খলিফা। মেজো ভাই সুলায়মান বিন আবদুল মালেক (জন্ম: ৬৭৪; মৃত্যু: ২২ সেপ্টেম্বর ৭১৭, খেলাফতকাল: ৭১৫–৭১৭) ছিলেন ৭ম খলিফা। স্বামী ওমর ইবনে আবদুল আজিজ (জন্ম: ২ নভেম্বর ৬৮২/২৬ সফর ৬৩ হি.; মৃত্যু: ৩১ জানুয়ারি ৭২০/১৬ রজব ১০১ হি., খেলাফতকাল: ২২ সেপ্টেম্বর ৭১৭–৪ ফেব্রুয়ারি ৭২০) ছিলেন ৮ম খলিফা। স্বামীর মৃত্যুর পর তার ছোট ভাই ইয়াজিদ (২য়) ইবনে আবদুল মালেক (জন্ম: ৬৮৭; মৃত্যু: ২৬ জানুয়ারি ৭২৪, খেলাফতকাল: ৭২০–৭২৪) হন ৯ম খলিফা। এরপর ১০ম খলিফা হিসেবে খেলাফতের মসনদে বসেন হিশাম বিন আবদুল মালেক (জন্ম: ৬৯১; মৃত্যু: ৬ ফেব্রুয়ারি ৭৪৩, খেলাফতকাল: ৭২৪–৭৪৩)। পিতামহ, পিতা ও ভাইয়ের পর একে একে তিন ভাতিজা খলিফা হন। একাদশ খলিফা হন সেজো ভাইয়ের ছেলে ওয়ালিদ (২য়) বিন ইয়াজিদ (২য়) (জন্ম: ৭০৬; মৃত্যু: ৬ এপ্রিল ৭৪৪, খেলাফতকাল: ৭৪৩–৭৪৪)। দ্বাদশ খলিফা হন বড় ভাইয়ের ছেলে ইয়াজিদ (৩য়) বিন ওয়ালিদ (১ম) (জন্ম: ৭০১; মৃত্যু: ৩/৪ অক্টোবর ৭৪৪, খেলাফতকাল: ১৫ এপ্রিল ৭৪৪–৩/৪ অক্টোবর ৭৪৪)। ত্রয়োদশ খলিফা হন ইবরাহিম বিন ওয়ালিদ (১ম) (জন্ম: অজ্ঞাত; মৃত্যু: ২৫ জানুয়ারি ৭৫০, খেলাফতকাল: ৭৪৪–৭৪৪)।
তারা সবাই ছিলেন উমাইয়া বংশোদ্ভূত শাম সাম্রাজ্যের খলিফা। তাদের খেলাফতকাল তাদের বংশের নামেই পরিচিত—খেলাফতে বনু উমাইয়া। ৫.৭৯ মিলিয়ন বর্গমাইল তথা ১,৫০,০০,০০০ বর্গকিলোমিটার অঞ্চলজুড়ে বিস্তৃত ছিল তাদের রাজত্ব; তদানিন্তন বিশ্বের সবচে বড় সাম্রাজ্য। মাওয়ারাআন নাহার ককেশাস, হিন্দুস্তান, উত্তর আফ্রিকা, আন্দালুস ও তুর্কিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত। বর্তমান সিরিয়া লেবানন জর্ডান ফিলিস্তিন ও ইজরাইল মিলে সর্ববৃহৎ একটি সাম্রাজ্য ছিল শাম। সেই সাম্রাজ্যের পঞ্চম খলিফার একমাত্র কন্যা এই বিরল ভাগ্যের অধিকারিণী। শাহজাদি ও সম্রাজ্ঞী।
শাহজাদি ফাতেমা বিনতে আবদুল মালেক বিন মারওয়ান। এমনই রাজপরিবারে জন্ম তার। এ তো সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম গ্রহণ করা। অনিন্দ্য সুন্দরী, রাজকীয় ঠাটবাট আর কেতাদুরস্ত চালচলনে সদ্য যৌবনে পা-রাখা অপরূপ নিটোল তরুণী। যার চোখে-মুখে মোহনীয় রাজকীয় আভিজাত্যের ছাপ। রূপবতী হওয়ার সাথে সাথে রাজপরিবারের সমস্ত গুণ আয়ত্ত করায় তার চারিত্রিক সুষমাও মাধুর্যপূর্ণ । রূপে যেমন অনন্য তেমনই শিক্ষা-দীক্ষায়ও তিনি শীর্ষস্থানে। আবু জুরআ বলেন, তৎকালীন শামে নারীদের মধ্যে তিনিই ছিলেন একমাত্র হাদিস বর্ণনাকারী হিসেবে প্রসিদ্ধ। অসংখ্য আলেমে দীন, মুহাদ্দিস ও তাবেয়ি তার থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন আতা ইবনে আবু রাবা আল মাক্কি; যিনি ছিলেন মক্কার প্রসিদ্ধ মুফতি ও মুহাদ্দিস এবং আবু উবায়দা ইবনে উকবা বিন নাফে।
এমনিতে শাহজাদি, তার উপর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আধার। মোহনীয় রূপ-সৌন্দর্য আর মুগ্ধকর চারিত্রিক গুণাবলী, অসাধারণ আভিজাত্য ও জৌলুশে ভরা ব্যক্তিত্ব তার। এমন উর্বশী তরুণীর পাণিপ্রার্থী হতে কে না চায়? দামেস্কের অলি-গলিতে লাইন লেগে যায় শাহজাদির প্রণয়প্রার্থীদের। কিন্তু হীরের টুকরো পাওয়ার যোগ্যতা আছে কেবল পরশ পাথরের। শাহজাদির জীবনসঙ্গীকে হতে হবে সর্বগুণে গুণান্বিত, সচ্চরিত্রবান আর সম্ভ্রান্ত বংশের যোগ্য ছেলে। তেমন কাউকে মেলেনি বলে বাইরের সব প্রণয়প্রার্থীকেই ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সিদ্ধান্ত নিলেন খলিফা নিজে পরখ করবেন পরশ পাথর। পেয়েও গেলেন! নিজের বংশের শ্রেষ্ঠ সন্তান, আপন ভাতিজা ওমর বিন আবদুল আজিজকে বেছে নিলেন কলিজার টুকরো কন্যা ফাতেমার জন্য। পিতৃকুল উমাইয়া বংশেরই আর তার মা ছিলেন দ্বিতীয় খলিফায়ে রাশেদ আমিরুল মুমিনিন ওমর বিন খাত্তাব রা. এর দৌহিত্রী। চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সাথে মিল থাকায় যাকে বলা হয় দ্বিতীয় ওমর ও পঞ্চম খলিফায়ে রাশেদ। সুদর্শন জ্ঞানী মহানুভব এক সুপুরুষ। শাহজাদি ফাতেমা আর ওমর বিন আবদুল আজিজ। সোনায় সোহাগা এক জুটি। খলিফা আবদুল মালেক তার কলিজার টুকরোকে তুলে দিলেন যোগ্য পাত্রের হাতে। নির্ভয়ে, নিশ্চিন্তে। খলিফা পিতার প্রাসাদ ছেড়ে ভাবি খলিফা স্বামীর প্রাসাদে শাহজাদি আগমন করলেন। স্বামী তখন হেজাজের গভর্নর। এখানেও ধন-সম্পদের প্রাচুর্য। দিন কাটতে লাগল সুখে-শান্তিতে।
ওমর বিন আবদুল আজিজ ছিলেন খুবই সৌখিন। বিশেষ একটা আভিজাত্যের ছাপ থাকত চলাফেরায়, পোশাক-আশাকে। বাজারের সবচে পাতলা-মিহি কাপড় তিনি পরিধান করতেন। হিন্দুস্তানি মৃগনাভি নির্দিষ্ট করে আনা হতো তার জন্য। তিনি কোনো রাস্তা অতিক্রম করলে লোকে না দেখেই বলে দিতে পারত, এ পথে ওমর বিন আবদুল আজিজ গিয়েছেন।
দুই
খলিফা সুলায়মান বিন আবদুল মালেক মৃত্যুশয্যায় শায়িত। উমাইয়া রাজপ্রাসাদে ছোট-বড় সবার মনে চরম অস্থিরতা। বিষাদের ছাপ পুরো প্রাসাদ জুড়ে। অনাড়ম্বর, বিষণ্নতায় ছাওয়া এক পরিস্থিতি বিরাজমান প্রাসাদে। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে খলিফা। এই যেন এক্ষুণি নিভে গেল জীবনপ্রদীপ। খলিফার নৈকট্যশীল আস্থাভাজন সবাই শিয়রে উপবিষ্ট। সকলের মাঝখান থেকে ৭১৭ খ্রিষ্টাব্দের এক সন্ধ্যায় খলিফা চলে গেলেন অমোঘ মৃত্যুর আহ্বানে। শোকের মাতম ছড়িয়ে পড়ল প্রাসাদের আনাচে-কানাচে।
নিয়ম হলো, একজন খলিফার ইন্তিকালের পরপরই আরেকজন খলিফার নাম ঘোষিত হওয়া। তাই শোকের ভেতরও সকলে নতুন খলিফার নাম শোনার প্রতীক্ষায় উৎকণ্ঠিত। মহলের সবার মনেরই আকাঙ্ক্ষা তার ভাই, পিতা, পুত্র, স্বামী থেকে একজন খলিফা হোক। সকলের মনেই অস্থিরতা। সবার ভেতরেই সুর তুলছে প্রতীক্ষা। অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।
সকল প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে ঘোষকের কণ্ঠে ঘোষিত হলো ওমর বিন আবদুল আজিজের নাম। তিনিই হবেন পরবর্তী খলিফা। শাম সাম্রাজ্যের রাজাধিরাজ। খলিফা সুলাইমান বিন আবদুল মালেক মৃত্যুর পূর্বে তার নাম ঘোষণা করে গিয়েছেন।
শাহজাদি ফাতেমার ললাটে এসে পড়ল চাঁদের চুমু। তাকে ঘিরেই সকলের আগ্রহ। আমির-উমারার বিবিরা ফাতেমাকে অভিনন্দন জানাতে লাগল। শাহজাদি এখন আর সেই শাহজাদি নেই; তিনি বর্তমান সম্রাজ্ঞী। শাম সাম্রাজ্যের রানী; মালিকায়ে আজম। সোনালী রঙয়ের রোদ্দুর গড়াগড়ি খেতে লাগল তার মনের করিডোরে। হৃদয়ের ক্যানভাসে সুখের রংতুলি আঁকতে শুরু করল স্বপ্নীল কত ভাবনা। রাজমহলের নরম কেদারায় বসে ভাবছেন নিজের সৌভাগ্যের কথা। মনে মনে আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করছেন।
কিন্তু যার বদৌলতে আজ তার এত সৌভাগ্য, সেই প্রেমাস্পদ, হৃদয়েশ্বরের দেখা নেই আজ তিনদিন হলো। একবারের জন্যও মহলে আসেননি তিনি। এখনও স্বামীকে অভিনন্দন জানাতে পারেননি। মন চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়েছে। তিনদিন পর ওমর বিন আবদুল আজিজ মহলে আসেন। প্রিয়তমা স্ত্রীর সান্নিধ্যে। এলোমেলো চুল, টকটকে লাল নির্ঘুম চোখ, বিধ্বস্ত অন্যমানুষ যেন। এ কি অবস্থা তার! তিনদিন আগে দেখা মানুষটার সাথে কোনো মিলই নেই যেন। প্রিয়তমের এই অবস্থা দেখে ফাতেমার মন কেমন করে উঠল! ভয় পেয়ে গেলেন যেন। অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলেন— ‘আমিরুল মুমিনিন! এ কী অবস্থা আপনার?’
‘ফাতেমা, আমি এখন অত্যন্ত জরুরি কিছু কথা বলবো তোমাকে। আশা করি মনোযোগ দিয়ে শুনবে।’ নিরাবেগ একটা কণ্ঠ যেন খলিফার গলা দিয়ে বের হলো। ‘দেখো, আমার উপর অর্পিত হয়েছে বিশাল এক দায়ভার। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মতের ছোট-বড় সকল বিষয়ের জবাবদিহিতা আমাকে করতে হবে আল্লাহর কাছে। আমার কাঁধে কঠিন এক দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। তা পুঙ্খানুপুঙ্খ পালন করা আমার ঈমানি কর্তব্য। এক বিন্দু হেরফের যদি করি, আমার জন্য আল্লাহর শাস্তি অবধারিত। খেলাফত যেমন আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ তেমনই তুমিও আমার জীবনের পুরোটা জুড়ে আছ। রাজ্য পরিচালনার গুরুদায়িত্ব পালনের সাথে সাথে তোমাকে হয়তো আগের মতো সময় দিতে পারব না। আমার ততটুকু ফুরসত আর মিলবে না। তবু আমি চাই না তোমাকে হারাতে। চাই না তোমার পরিবর্তে আমার জীবনে আর কেউ আসুক। আবার তোমার উপর বিন্দু পরিমাণ জুলুম হোক, তা আমার সহ্যসীমার বাইরে। কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে, আমি নিজের জন্য যে জীবনযাপনের পথ বেছে নেবো, আশৈশব রঙিন মখমল জীবনে অভ্যস্ত তুমি হয়তো কণ্টকময় এ পথে আমার সঙ্গিনী হয়ে থাকতে পারবে না। তাই তোমার জন্য আমি আরেকটা পথ ভেবে রেখেছি। তুমি চাইলে তোমার বাবার বাড়ি চলে যেতে পারো।’
সব মনোযোগ দিয়ে শোনার পর ফাতেমার ঠোঁটে দেখা দিলো মুচকি হাসির রেখা। বললেন, ‘আচ্ছা! আপনি কেমন জীবনযাপন করবেন শুনি?’
খলিফা বলতে শুরু করলেন, ‘এই যে আমাদের এত সহায়-সম্পত্তি তোমার ভাই ও আত্মীয়-স্বজন ভোগ করছিল, এসব বাইতুল মালের অংশ। সকল প্রজা তাতে অংশীদার। আমি প্রতিজ্ঞা করেছি প্রজাদের হক তাদের ফিরিয়ে দেবো। আর তা শুরু করব আমার ঘর থেকেই। নিজের উপার্জনে কেনা একখণ্ড জমি ছাড়া আমি সব জমা দিয়ে দেবো বাইতুল মালে। একখানা কাপড় ছাড়া আর কিছুই রাখবো না। অনাড়ম্বর এক জীবন শুরু করব আমি। তুমি কি পারবে বিলাসবহুল ঐশ্বর্যমণ্ডিত জীবন ছেড়ে আমার জীর্ণ কুটিরে বাস করতে? তাই বলছি, তুমি তোমার বাবার বাড়ি যেতে পারো।’
ফাতেমার ঠোঁটে তখনও লেগে আছে হাসির রেখা। ঠোঁটের কোণে স্নিগ্ধ হাসির ঝিলিক মেখে বললেন, ‘এই পর্যন্তই তো?’
‘হ্যাঁ এইটুকুই। ফাতেমা, আমি একজন উচ্চাভিলাষী। জীবনে যা চেয়েছি তাই অর্জন করে ছেড়েছি। জীবনের বড় বড় লক্ষ্যে পৌঁছেছি। আমির হতে চেয়েছি, আমির হয়েছি। খলিফার মেয়ে বিয়ে করতে চেয়েছি, তাই করেছি। খেলাফত চেয়েছি, আজ তাও পেয়ে গেছি। সেই আমি এখন জান্নাত চাইছি এবং দুনিয়ার সুখ বিলাসিতা সব ছেড়ে দিয়ে হলেও আমি তা অর্জন করব।’ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন খলিফা ওমর বিন আবদুল আজিজ।
ফাতেমা আশ্বাস দিয়ে বললেন, ‘আপনি একদমই চিন্তা করবেন না খলিফাতুল মুসলিমিন। আমি আপনার চাওয়া অনুযায়ীই নিজেকে গড়ে তুলব। এটা আপনি কীভাবে ভাবলেন, যে আমি আপনার সুখের সঙ্গী ছিলাম, সে কি-না আপনার দারিদ্র্যের ভয়ে আপনাকে ছেড়ে যাব? আপনি যেভাবে সন্তুষ্ট আমি সেভাবেই সন্তুষ্ট।’
হাসিমুখে মেনে নিলেন কণ্টকময় পথের যাত্রা। শাম সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী বাদশাহর সাথে যেকোনো পরিস্থিতিতে আমরণ একসাথে থাকার প্রতিজ্ঞা করলেন।
তিন
চোখের পলকেই বদলে গেল তাদের জীবনযাত্রার চিত্র। বিলাসী জীবন পরিত্যাগ করে স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তি ফেরত দিলেন বাইতুল মালে। ছোট ঝুপড়িতে সংসার শুরু করলেন। ফাতেমার মুকুট থেকে শুরু করে বাবার শখ করে দেওয়া আংটি পর্যন্ত খুলে বাইতুল মালে জমা দিয়ে দিলেন। শুরু হয় এক সংগ্রামী জীবন। নফসে আম্মারার বিরুদ্ধে অদম্য সংগ্রাম। রাজমহলের চাকচিক্য নেই। নেই নরম গালিচা, গোলাম-বাঁদির ফুট-ফরমায়েশ। আলোয় ঝলমল মর্মর পাথরের সুদৃশ্য ভবন ছেড়ে বাস করতে লাগলেন মাটির দেয়াল, খেজুর পাতা ও খড়ে ছাওয়া ছোট খুপরিতে। খাট-পালঙ্ক ও আসবাবপত্র কিচ্ছু নেই। নেহায়েৎ দরিদ্র ঘরের আর দশজন গৃহিণীর মতোই তার জীবন। কাপড় ধোয়া, আটা পেষা, ঘর ঝাঁট দেওয়া, রান্নাবান্না থেকে শুরু করে সমস্ত কাজ একা নিজহাতে সামলান। ছোট ঘর জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অভাব।তাদের গোলাম রোজ রোজ ডাল খেতে খেতে বিরক্ত হয়ে একদিন বলেই বসলো, ‘তাই বলে প্রতিদিনই ডাল?’
ফাতেমা বলেন, ‘বাবা, এটা তোমার মনিব খলিফাতুল মুসলিমিনেরও নিত্যদিনের খাবার।’
কোনোদিন তেলের অভাবে কুপি জ্বলছে না। ঘর অন্ধকার হয়ে আছে। কোনোদিন আটার অভাবে চুলো জ্বলছে না। ঘরের সবাই ক্ষুধার্ত। এমন করেই গুজরান হয় দিন। অভাব ঝেঁকে বসবে না কেন? খলিফা তার ভাতা হিসেবে প্রাপ্ত চল্লিশ হাজার দিনারের সবটাই ফিরিয়ে দেন বাইতুল মালে। দিন প্রতি রাখেন দুই দিনার করে।
খলিফা একদিন ফাতেমার কাছে টাকা ধার চাইলেন আঙুর কিনবেন বলে। কিন্তু ফাতেমার থলে তো বিরান মরু। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, একজন শাম সাম্রাজ্যের রাজা আরেকজন শাহজাদি, সম্রাজ্ঞী। অথচ কারোরই আঙুর কিনে খাওয়ার সাধ্য নেই।
এক বেদুইন মহিলা এলেন খলিফার সাথে দেখা করতে। লোকেরা একটি সাধারণ বাড়ি দেখিয়ে দিলো। মহিলা তো অবাক! মনে কিছুটা সন্দেহ। এটা কি কোনো খলিফার বাড়ি হতে পারে? ভুল দেখছি না তো! সাত-পাঁচ ভেবে কড়া নাড়লেন দরজায়। একজন মহিলা দরজা খুলে দিলেন। হাতে লেগে আছে আটার খামির। পাশেই একজন চাকর ছেঁড়া পোশাক পরে মাটির দেয়াল ঠিক করছে। তার হাতে লেগে আছে কাদামাটি। বেদুইন মহিলা ভাবলেন, মহিলাটি খলিফার দাসী। তেজ গলায় বললেন, যাও খলিফাকে বলো একজন বেদুইন মহিলা দূর থেকে এসেছে দেখা করতে।
মহিলার ঠোঁটে মৃদু হাসি দেখা গেল। দেয়ালের পাশের লোকটার কাছে গেলেন। মহিলার এবার বিরক্ত হয়ে গেলেন। আমিরুল মুমিনিনের বাড়িতেই দেখছি পর্দা নেই। কী আজিব! গোলাম-বাঁদি সবাই বেপর্দা চলাফেরা করে। শেষতক বলেই ফেললেন, ‘তোমাদের কী হয়েছে বলো তো? পর্দার বিধান কি তোমরা ভুলে গেছ?’
ফাতেমা এবার হেসে ফেললেন। বললেন, ‘আরে! ইনিই খলিফাতুল মুসলিমিন ওমর বিন আবদুল আজিজ আর আমি তার স্ত্রী ফাতেমা।’
মহিলা বিস্ময়ে থ হয়ে গেলেন। একজন রাজা ও রানীর এ কি জীবনযাপন! এমনও হয়!!
শাহজাদি ফাতেমাকে তার বাবা আবদুল মালেক বিয়ের সময় কিছু গয়না উপহার দিয়েছিলেন। লোকে বলে, এমন অলঙ্কার কেউ দেখেনি আগে। সোনা-রূপা হীরা-জহরত মণি-মুক্তা—কী ছিল না তাতে! তখনকার হিসেবে একলক্ষ দিনার হবে ওগুলোর দাম। খলিফা একদিন প্রিয়তমা স্ত্রীকে দেখছিলেন। প্রাণভরে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে। সহসাই মনে পড়ল সেই গয়নাগুলোর কথা। ফাতেমাকে বললেন, ‘তোমার মনে আছে সেই গয়নাগুলোর কথা? আমার ইচ্ছে তুমি ওগুলো বাইতুল মালে জমা দিয়ে দাও। যদি তা না পারো, তাহলে আমাকে বিচ্ছেদের অনুমতি দাও। আমি চাই না এই গয়নাগুলো আমাদের মাঝে কাঁটা হয়ে আমাদের ঘরে থাকুক।’
ফাতেমা বললেন, ‘এরচে কয়েকগুণ দামি গয়না হলেও আমি আপনাকেই বেছে নিতাম।’ তারপর সেগুলোকে কোষাগারে জমা দেওয়া হয়।
একদিন খলিফা গনিমতের মাল বণ্টন করছিলেন। তার ছোট ছেলে না বুঝে একটি আপেল তুলে নেয় খাওয়ার জন্য। কামড় বসাবার আগেই খলিফা তার হাত থেকে আপেলটি ছিনিয়ে নেন। ছেলে কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কাছে এসে সব বলে। মা টাকা ধার করে বাজার থেকে আপেল আনিয়ে ছেলেকে খেতে দিলেন। খলিফা ওমর ফিরে এসে ছেলের হাতে আপেলের টুকরো দেখে জিজ্ঞেস করেন, ‘ঘরে কি গনিমতের মাল ঢুকেছে?’ ফাতেমা না করেন এবং সব খুলে বলেন। ওমরের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। বলেন ওর হাত থেকে আপেলটি নেওয়ার সময় আমার কলিজা ফেটে যাচ্ছিল। তবু নিয়েছি। আমি চাই না একটা আপেলের বিনিময়ে আল্লাহর কাছে আমার প্রাপ্ত হক নষ্ট করতে। বলতে বলতে তার চোখ দিয়ে পানি এসে গেল।
আরেকদিন খলিফা ঘরে এসে দেখলেন তার প্রিয়তমা তার ছেঁড়া জামায় তালি দিচ্ছেন। তিনি পাশে বসে চুপচাপ দেখলেন। বুকের ভেতর কোথাও যেন একটা কষ্ট চিনচিন করছিল। শাহজাদি, সম্রাজ্ঞী হয়ে নিজ হাতে প্রিয়তমের ছিন্ন পোশাক সেলাই করতে হচ্ছে। ফাতেমার মনে পড়ে গেল পুরানো দিনের কথা। ফেলে আসা বিলাসবহুল জীবনের স্মৃতিচারণ করছিলেন মনে মনে। একসময় মুখেও বলে ফেললেন। কিছুটা কান্নাভেজা কণ্ঠে। খলিফা স্ত্রীকে টেনে নিলেন কাছে। বললেন, ‘মনে আছে দাবেকে কাটানো সেই স্বপ্নীল রাতের কথা?’
ফাতেমা বললেন, ‘হুম। সেই রাত আর আজকের দিন। কত পার্থক্য!’
‘নিশ্চয়ই আমি আমার প্রভুর নাফরমানি করতে ভয় করি।’ অদ্ভুত কণ্ঠে খলিফা জবাব দিলেন। ফাতেমা সাথে সাথে চুপ হয়ে গেলেন। নিজের হালতের উপর শুকরিয়া জ্ঞাপন করলেন। এভাবেই একসময় ফাতেমা দুনিয়াবি সব প্রকার বিলাসিতা, সাজসজ্জা থেকে বিমুখ হয়ে পড়েন। তাকে নিয়ে আমির-উমারার স্ত্রীরা আড়ালে টিপ্পনি কাটত। তিনি শুনেও না শোনার ভান ধরে এড়িয়ে যেতেন। একদিন কে একজন সামনাসামনি বলে ফেলল।
ফাতেমা তাকে নম্রভাবে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা তোমাদের এই সাজসজ্জা কার জন্য?’
সবাই জবাব দিলো, ‘আমাদের স্বামীদের জন্য।’
ফাতেমা বললেন, ‘আমার এই সাদামাটা সাজসজ্জাও আমার প্রিয়তমের জন্য। আমার এই অবস্থাতেই আমি তার কাছে হুরের মতো।’
ফাতেমার এই জবাবে তাদের মুখে আর রা কাটার সুযোগ থাকল না।
চার
খলিফা ওমর অন্তিমশয্যায় শায়িত। পরনে মলিন পোশাক। ফাতেমার ভাই মাসলামা বিন আবদুল মালেক ভগ্নিপতিকে দেখতে আসেন। বোনকে বলেন মলিন পোশাক পাল্টে দিতে। দ্বিতীয় দিন এসে দেখেন একই কাপড়। মাসলামার কিছুটা রাগ হয়। তিনি বোনকে তিরস্কার করেন। বোন জবাবে বলেন, ‘কিছু করার নেই ভাইয়া। খলিফার এই একটিই জামা।’
তিনি সেই ওমর যার শরীরের সুগন্ধিতে পথঘাট মোহিত হয়ে থাকত!
ওমর বিন আবদুল আজিজের খেলাফতকাল স্থায়ী হয়েছিল মাত্র আড়াই বছর। এই অল্পসময়ের ভেতরেই তিনি ন্যায়পরায়ণতা খোদাভীতি দুনিয়াবিমুখিতার অনন্য নজির প্রতিষ্ঠা করে যান। ৩৮ বছর বয়সে তিনি মাওলার ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যান তার সান্নিধ্যে। মৃত্যুকালে তার সম্পদ ছিল পরিহিত কাপড়টি আর নিজের রুজিতে কেনা একখণ্ড মাটি। তিনি সেই ওমর যার জন্ম রাজপুত্তুর হয়ে; রাজমহলে। যিনি ছিলেন শাম সাম্রাজ্যের সম্রাট!
ওমর বিন আবদুল আজিজের পর খলিফা নির্বাচিত হন ফাতেমার ভাই ইয়াজিদ বিন আবদুল মালেক। কিন্তু ফাতেমা আর রাজপ্রাসাদে ফিরে আসেননি। তিনি তার সেই জীর্ণ কুটিরে সাদাসিধে জীবন কাটিয়ে দেন। ইয়াজিদ তার ভাতা বাড়িয়ে দিতে চাইছিলেন। ফিরিয়ে দিতে চাইছিলেন তার পূর্বের সব অলঙ্কারাদি। তিনি আল্লাহর নামে শপথ করে বললেন, ‘কী করে ভাবলে! স্বামীর জীবদ্দশায় যা পছন্দ করিনি, তার মৃত্যুর পর সেসব ফিরিয়ে নেব। আমাদের ভালোবাসার ভীত এতটা ঠুনকো নয়।’
আমৃত্যু বিমুখ থেকেছেন বিলাসবহুল জীবনযাপন থেকে। অনাড়ম্বর জীবন কাটিয়ে গেছেন। অল্প বয়সে বিধবা হয়ে জীবনের বন্ধুর পথে হেঁটে গিয়েছেন স্বামীর দেখানো তরিকায়।
হিশাম বিন আবদুল মালেকের শাসনামল। ফাতেমা বিনতে আবদুল মালেকের জীবন আয়ু ফুরিয়ে এলো। সিদরাতুল মুনতাহার বৃক্ষ থেকে ফাতেমার নাম আঁকা পাতাটি ঝরে পড়ল পৃথিবীর সবার অলক্ষ্যে। সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মানো শাহজাদি অদম্য সংগ্রামের জীবন থেকে অবসর গ্রহণ করলেন। চলে গেলেন সেখানে, যেখানে তার প্রেমাস্পদ, হৃদয়েশ্বর তার জন্য প্রতীক্ষায় আছেন। হালব শহরে তার প্রিয়তমের মাকবারার পাশে তাকে দাফন করা হয়।
ভালোবাসার মিনার কতটা উঁচু হলে স্বামীর এক কথায় ছেড়ে দেওয়া যায় ভোগবিলাস। রাজমহল, রাজ্য। চলে আসা যায় অভাবের আধিপত্য ঘেরা জীর্ণ কুটিরে। যেখানে নেই খাদেম-খাদেমা। চারিদিকে শুধু দারিদ্র্য। অথচ তার আগে অভাব অনুভব করা তো দূরের কথা! আপেলপেলব দেহে কোনোদিন কষ্টের আঁচও লাগেনি। আড়াই বছর খেলাফতকালে স্বামী দুনিয়ার বুকে রেখে গেছেন দুনিয়াবিমুখিতার এক অনন্য নজির। আর ফাতেমা! তিনি স্বামীর দেখানো সেই আড়াই বছরের তরবিয়াতে বাকি জীবন কাটিয়ে তৈরি করেছেন অনুপম দৃষ্টান্ত। এই মানিকজুটি খোদাভীতি ও পতিভক্তির জ্বলন্ত উদাহরণ যেন। রাজকুমার আর রাজকুমারী মিলে পৃথিবীর বুকে সৃষ্টি করেছেন নতুন এক ইতিহাস! হাজার বছর পরেও সে ইতিহাস আমাদের কাঁদায়, শিক্ষা দেয়, অনুপ্রাণিত করে। আমরা সে ইতিহাস পড়তে পড়তে কেঁদে উঠি। আপনা-আপনি মুখ থেকে বের হয়ে আসে—শাহজাদি, তুমি অনন্যা; অপরাজিতা।
তথ্যসূত্র:
১. আল আমিরাতু ফাতিমা বিনতে আবদুল মালিক। উমাইমা আবদুল আজিজ আল-ইশা
২. হিস্টোরি অব ইসলাম
৩. গ্রেট ওমেন অব ইসলাম