রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ধর্ম : মিসরে যেভাবে পরিচালিত হয় কেন্দ্রীয় ফতোয়া বিভাগ

রাকিবুল হাসান নাঈম:

২০২২ সালে মিসরের কেন্দ্রীয় ফতোয়া বিভাগ দেড় মিলিয়ন ফতোয়া প্রকাশ করেছে। ১৮৯৫ সালে এই বিভাগ প্রতিষ্ঠার পর এটিই সর্বোচ্চ ফতোয়ার সংখ্যা। সরকারি জরিপমতে, এরমধ্যে ৬৩ শতাংশ ফতোয়া পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যা সম্পর্কিত। বাকিগুলো চরমপন্থা, ইবাদত, মোআমালা, শিষ্টাচার ও নৈতিকতা সংক্রান্ত। তবে কেন্দ্রীয় ফতোয়া বিভাগ পরিচালিত ফেসবুকের এক জরিপমতে, ৭০ শতাংশ ফতোয়া পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যা সম্পর্কিত।

কিন্তু এই ফতোয়াকে মিশরীয়রা কতটুকু বিশ্বাস করে? ২০২০ সালে পরিচালিত মিশরীয় সেন্টার ফর মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক ওপিনিয়ন স্টাডিজের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ৪৬ শতাংশ লোক দারুল ইফতার ফতোয়াকে বিশ্বাস করে না। ৫১ শতাংশ লোকের রাজনৈতিক ফতোয়ায় আস্থা নেই।

মিশরের কেন্দ্রীয় ফতোয়া বিভাগ বিভিন্ন ফতোয়ায় বেশ বিতর্ক সৃষ্টি করে। তাদের ফেসবুক পেইজে তার প্রমাণ বিদ্যমান। শুধু বিভাগই নয়, যারা এই বিভাগের মুফতির পদ গ্রহণ করেন, তারাও বিতর্কের জন্ম দেন। তাদের মধ্যে আছেন প্রাক্তন মুফতি আলি গোমা এবং তার আগে সাইয়্যিদ তানতাভি। ১৯৯৬-২০১০ সালে তিনি আল আজহারের শায়েখ ছিলেন। ছিলেন হোসনি মোবারকের সমর্থক। যেসব সাংবাদিক মোবারক সম্পর্কে সংবাদ প্রকাশ করেছিল, তিনি সেসব সাংবাদিকদের বেত্রাঘাত করার জন্য একটি ফতোয়া জারি করেছিলেন। এমনকি ১৯৯৪ সালে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক এক সম্মেলনের সময় তিনি দারুল ইফতায় একটি জায়নবাদী প্রতিনিধিদলের সম্মানে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন।

আগেকার অনেকের মতো বর্তমান মুফতি শাওকি ইব্রাহিম আল্লাম মিশরের শাসনকে সমর্থন করার জন্য কোনো কসরত রাখেননি। শুধু শত শত বিরোধীদের মৃত্যুদণ্ডের অনুমোদন দিয়েই নয়, সমস্ত বিতর্কিত ধর্মীয় প্রবণতাকে সমর্থন করেও। যখন সরকার ‘মৌখিক তালাক’ বাতিল করতে চেয়েছিল এবং এটিকে ফি-ট্যাক্স সহ নথিভুক্ত একটি বিবাহবিচ্ছেদে পরিণত করতে চেয়েছিল, আল-আজহারের শায়খরা এর বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু তখন শাওকি ইব্রাহিম স্পষ্টভাবে রাষ্ট্রের পদ্ধতিকে সমর্থন করে বলেছিলেন, ‘মৌখিক বিবাহবিচ্ছেদের আইনী সংশোধন প্রয়োজন।’ তিনি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইকারী সেনাবাহিনী এবং পুলিশ বাহিনীর উপর ব্যয় করার জন্য জাকাতের অর্থ বিতরণের অনুমোদন দেন।

গত এক দশকে দেশটির দারুল ইফতা রাষ্ট্রের অভিযোজন সমর্থন করার জন্য কয়েক ডজন ফতোয়া জারি করেছে। ফতোয়াগুলো কেবল অভ্যন্তরীণ ইস্যুতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং মিশর যখন লিবিয়াতে বাহিনী পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়, তখন দারুল ইফতা তার অবস্থানকে সমর্থন করার জন্য একটি ফতোয়া জারি করে বলে, মিশরীয় সেনাবাহিনী চরমপন্থীদের সাথে লড়াই করছে। যখন তুর্কি সরকার আয়া সুফিয়াকে মসজিদে রূপান্তর করার সিদ্ধান্ত নেয়, মিশরীয় দারুল ইফতা তখন বলে, তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান তার সমর্থকদের মন জয় করতে মসজিদ কার্ড ব্যবহার করছেন। এরদোগান দেশে তার অত্যাচার প্রতিষ্ঠা করতে এবং বিদেশে তার ঔপনিবেশিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে ন্যায্যতা দিতে ফতোয়া অস্ত্র ব্যবহার করে চলেছেন।

মিশরীয় দারুল ইফতার কাজ কেবল মানুষের ধর্মীয় ও পার্থিব বিষয়ে ফতোয়া জারি করা নয়, যে কাজটি মুফতিরা সর্বদাই শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে করে আসছে। বরং তাদের অন্যতম একটি কাজ হলো, সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প ও কাজকে বৈধতা দেয়া। সরকারের প্রকল্প বাস্তবায়নে ধর্মীয় বয়ান তুলে ধরা। যেন সরকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কোনো বাধার সম্মুখীন না হয়।

মোহাম্মদ আলী পাশার যুগ

আধুনিক রাষ্ট্রের নীতিকে বৈধতা দেওয়ার জন্য মুফতি ও শায়খদের ব্যবহার এবং তাদের ফতোয়া ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে মিশরের শাসক মোহাম্মদ আলী পাশার যুগে শুরু হয়। তিনি মিশরে ক্ষমতায় আসার পর আলেম এবং শাসকের মধ্যে বা আরও সাধারণভাবে ধর্ম এবং মিশরীয় রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি নতুন পর্যায় শুরু হয়। এরপর তারা আর কখনও আগের মতো স্বাধীন থাকেননি। কারণ, মোহাম্মদ আলী পাশাই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। আলেমদের প্রভাব একদম হ্রাস হয়ে যায়। যেমন তৎকালীন শাইখুল আজহার আবদুল্লাহ শারকাবি ভয়ানক দুর্গ হত্যাকাণ্ড থেকে পালিয়ে আসা দুজন মামলুক রাজপুত্রকে নিজের বাড়িতে নিরাপত্তা দিয়েছিলেন। তাদের জন্য সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু পাশা তার সুপারিশ গ্রহণ করেননি। শেষ পর্যন্ত রাজপুত্ররা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়।

মুফতিদের শাসক ও জনসাধারণের মধ্যে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করার অনুমতি দেননি মুহাম্মদ আলী পাশা। সৈয়দ ওমর মাকরাম, যিনি মুহাম্মদ আলীকে গভর্নর হিসাবে বসানোর ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন, তিনি যখন সেই ভূমিকা পালনের জন্য জোর দেন, তখন তাকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তাকে রাজনৈতিক জীবন এবং সমগ্র সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় দৃশ্য থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। তৎকালীন মুফতিরা মুহাম্মদ আলীর হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছিল।

পাশা যখন আধুনিক পাশ্চাত্যের আদলে একটি সেনাবাহিনী গড়ে তোলার জন্য তার আধুনিকীকরণ প্রকল্প শুরু করেছিলেন, তার নীতিকে বৈধতা দেওয়ার জন্য তার নতুন প্রকল্পের পক্ষে মুফতিদের নিয়োগ করেছিলেন। তার মাথায় ছিল কয়েক বছর আগে পদচ্যুত হওয়া অটোমান শাসক সালিম তৃতীয়ের কথা। তার বিরুদ্ধে মুফতিরা ফতোয়া দিয়েছিল, ‘যে সুলতান পশ্চিমা সিস্টেমে চলতে প্রজাদের বাধ্য করে, সে শাসক হবার যোগ্য নয়।’ এই ফতোয়ার পরই তাকে পদচ্যুত করা হয়।

তখন মুহাম্মদ আলীর একটি শক্তিশালী আইনি সহায়তার প্রয়োজন ছিল। কারণ, তিনি নতুন এক শাসনের দিকে জনগণ ও সৈন্যদের বাধ্য করেছিলেন। তখন তিনি তার স্বপক্ষে কথা বলার জন্য খুঁজে পান মিশরে বসবাসকারী আলজেরিয়ান মুফতি শেখ মুহাম্মদ বিন মাহমুদ আল-জাজারি ইবনে আল-আন্নাবিকে। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে তার দেশে হানাফী মাযহাবের মুফতির পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন তিনি। তারপর ১৮২০ সালে হজে যান। কিন্তু হজ শেষে তিনি আলজেরিয়ায় আর ফিরে যাননি। মিশরে চলে আসেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুফতিদের একটি দল তার কাছ থেকে জ্ঞান গ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে একজন শেখ ইব্রাহিম আল-সাক্কা। মোহাম্মদ আলী শেখ আল-আন্নাবীর বইয়ের একটি সংক্ষিপ্ত রূপ লিখতে বলেন সক্কাকে। ১৮২৬ সালে আন্নাবি সামরিক বাহিনী আধুনিকীকরণের বিষয় নিয়ে বইটি লিখেছিলেন। অনুরূপভাবে যখন পাশা নাগরিক ওয়াকফ সম্পত্তি বাতিলের আইন করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন আন্নাবিকে এ বিষয়ে কথা বলার নির্দেশ দেন। আন্নাবি তখন নাগরিক ওয়াকফ সম্পত্তি জায়েজ নেই বলে ফতোয়া দেন। তার ফতোয়ার পরই নাগরিক ওয়াকফ সম্পত্তি বাতিল হয়ে যায়। অথচ এটি ইসলামের সুস্পষ্ট একটি বিধান।

পাশা মিশরীয়দের জীবনে ধর্মীয় ফতোয়ার গুরুত্ব সম্পর্কে খুব সচেতন ছিলেন। তাই তিনি তার সব কাজে মুফতিদের ফতোয়া নিতেন। এমনকি যখন তিনি ১৮৪৬ সালে মিশরে জনসংখ্যার একটি আদমশুমারি পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন পরামর্শসভায় অন্যান্যদের সঙ্গে মুফতিদেরও ডাকেন। আদমশুমারির গুরুত্ব তাদেরকে বুঝান।

এভাবেই মিশরে ফতোয়া ক্ষমতার সাথে যুক্ত হয়ে যায়। মুফতিরা হয়ে যান সরকারি মুফতি।

দারুল ইফতা: আমলাতন্ত্রের শক্ত ঘাঁটি

মিশরের রীতি ছিল—চার মাযহাবের মুফতিদের উপস্থিতিতে মুফতি নির্বাচন কর হতো। তাদের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তিদের মধ্য থেকে তাদের মুফতি নির্বাচন করতো। তারপর তাকে গভর্নরের কাছে নিয়ে যেতো। গভর্নর তার মাথায় পাগড়ি পড়িয়ে দিতেন। কিন্তু মোহাম্মদ আলীর শাসনামলে সেই ঐতিহ্যের ইতি ঘটে। তিনি মুফতিদের নিয়োগ ও বরখাস্তের ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করতে শুরু করেন। ওমর মাকরামকে সুপারভিশন ইউনিয়ন থেকে অপসারণ করার ফতোয়ায় স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করায় হানাফি মাযহাবের মুফতি শেখ আহমেদ আল-তাহাভিকে তিনি বরখাস্ত করেন।

মোহাম্মদ আলীর শাসনের শেষের দিকে হানাফী মাযহাবের মুফতি ‘মিশরের মুফতি’ হয়ে ওঠেন। রাষ্ট্র, পরিষদ এবং আদালতের কর্মচারী হিসাবে প্রতিষ্ঠানের সাথে মুফতিদের সংযুক্ত করা হয়। বলা হয়, বিচার হবে কেবল হানাফী মাযহাব অনুযায়ী। বিচারক হানাফী না হলেও। এভাবে অন্যান্য মাযহাবের মুফতিদের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে। ফতোয়ার ক্ষেত্রে যে বিস্তৃত সুযোগ ছিল, তা হারিয়ে যায়। মানুষ বিভ্রান্ত হয়। কারণ, মিশরে হানাফি মতবাদের খুব বেশি অনুসারী ছিল না। বিশাল একটা অংশ শাফেঈ এবং মালেকি ছিল।

ফাতিমা হাফেজ তার বই ‘ফতোয়া ও আধুনিকতা’য় লিখেন, মুফতিদের তার উদীয়মান আমলাতান্ত্রিক যন্ত্রের সাথে সংযুক্ত করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সম্প্রসারণ নতুন সরকারী ফতোয়া সম্প্রসারণের দিকে পরিচালিত করে। আল আজহারের মুফতিরাসহ বিভিন্ন দেশের মুফতিরা যে ফতোয়া দিচ্ছিল, তার সাথে সরকারী ফতোয়াগুলোর বিরোধ ঘটছিল। খেদিভ ইসমাইল ১২৮১/১৮৬৪ সালে এই সমস্যাটি নিয়ে আলোচনা করার জন্য মুফতিদের কাউন্সিল ডাকেন। কাউন্সিলে সিদ্ধান্ত হয়, ‘সরকারি মুফতিরা তাদের সঙ্গে বিশেষায়িত বিষয়ে ফতোয়া দিবেন। তবে অন্যরা এ বিষয়ে লিখিত ফতোয়া দিবেন না। যদি দেন, সেটা গ্রহণযোগ্য হবে না।’

১৮৮০ সাল নাগাদ মুফতিরা বিশাল সরকারী আমলাতান্ত্রিক যন্ত্রপাতির নিছক কর্মচারীতে পরিণত হন। ১৮৮১ সালে হানাফি মুফতিরা আনুষ্ঠানিকভাবে ‘মিশরের মুফতি’ হয়ে উঠেন। ফতোয়া জারি করার প্রক্রিয়াটি আর মুফতির স্বাধীন এখতিয়ারে থাকেনি। বরং এটি রাষ্ট্রের একটি বৈধ প্রতিনিধি হয়ে ‍উঠে।

প্রজাতন্ত্রের সময়ে দারুল ইফতা

১৯৫২ সালে অফিসারদের আন্দোলন এবং আবদেল নাসেরের ক্ষমতায় উত্থানের ফলে মিশরে আলেম এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মর্যাদায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে। নতুন সরকার এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের মধ্যে তীব্র সংঘর্ষের পর ১৯৬৬ সালে চিন্তাবিদ সাইয়্যিদ কুতুবের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। তখন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র শায়েখরা সমর্থন এবং বৈধতার সন্ধানে নতুন শাসনের উপযুক্ত অংশীদার হয়ে ওঠেন।

যাইহোক, রাষ্ট্রের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে সমর্থন করার জন্য ধর্ম যে কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছিল তা ধরে রেখে নতুন সরকারব্যবস্থা আরও ধর্মনিরপেক্ষতার দিকে অগ্রসর হয়। ২১শে সেপ্টেম্বর ১৯৫৫-এ, শরিয়া আদালতের বিলুপ্তি, খ্রিস্টান এবং ইহুদিদের (মিলিয়ন আদালত) আইন বন্ধ এবং শেষ করে এবং ব্যক্তিগত মামলা পরিচালনার জন্য বিচারকদের দেওয়ানি আদালতে স্থানান্তর করার জন্য একটি আইন পাস করা হয়। তখনই আল-আজহার পুনর্গঠিত আইন জারি হওয়ার সাথে সাথে প্রজাতন্ত্রের মুফতির নেতৃত্বে দারুল ইফতা সরকারী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে যায়। যেসব মুফতিরা বিরোধী মত লালন করতো, তাদেরকে মিডিয়ায় আসতে দেয়া হতো না। মুফতিদের কাজ ছিল জনগণকে রাষ্ট্র কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্তের দিকে পরিচালিত করা। যেমন জন্মনিয়ন্ত্রণ প্রকল্প।

সুইডিশ গবেষক জ্যাকব স্কোভগার্ড তার ‘মিশর রাষ্ট্রের ইসলাম’ শিরোনামের গবেষণায় বলেন, রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের আইনি ন্যায্যতা খোঁজা হতো মুফাতিদের কাছে। যখন মিশর ১৯৭৯ সালে ইসরায়েলের সাথে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করে, যখন প্রজাতন্ত্রের মুফতি শেখ জাদ-আল-হক শান্তি চুক্তিকে সমর্থন করে একটি ফতোয়া জারি করেন এবং এটিকে রাসূলের হুদায়বিয়া চুক্তির সাথে তুলনা করেন। এরপর গ্র্যান্ড মুফতির পদে আসেন শেখ আবদ আল-লতিফ হামজা। তিনি রাজনীতি থেকে দূরে সরে গিয়ে সামাজিক সমস্যা এবং মিশরীয়দের দৈনন্দিন জীবনের দিকে মনোনিবেশ করেছিলেন। ১৯৮৫ সালে জাতীয় পার্টি যখন কার্যত অনির্দিষ্টকালের জন্য শরিয়া আইনের প্রয়োগ স্থগিত করার আইন সংসদ থেকে পাস করিয়ে নেয়, তখন শেখ হামজাহ টু শব্দটি পর্যন্ত করেননি। তবে দুদিন পর এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘তিনি বা আল-আজহারের কেউই রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করবেন না, কারণ তাদের বিচারকদের মতো নিরপেক্ষ হতে হবে।’

স্কোভগার্ড যুক্তি দেন, মুফতি তানতাভির নিয়োগ সম্পূর্ণরূপে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল। তিনি ছিলেন হোসনি মোবারকের প্রতি সম্পূর্ণ অনুগত। তিনি মিশরীয়দের বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন যে, বর্তমান সরকার একটি ইসলামি সরকার। তানতাভি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে ভূমিকা পালন করেছিলেন, তা ছিল মিশরীয় দারুল ইফতাকে পুনর্গঠন করা। এটিকে রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত করা।

তানতাভি একজন প্রবীণ ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব হিসাবে তার অনুমিত ভূমিকার বিপরীতে মিশরীয় রাষ্ট্রের রাজনৈতিক মেশিনে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। ৩০শে ডিসেম্বর ২০০৩-এ, তানতাভি সেই সময়ের ফরাসি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোলাস সারকোজিকে আল-আজহারে পেয়ে বলেছিলেন, ‘ফরাসি কর্মকর্তাদের তাদের স্কুলে হিজাব পরা নিষিদ্ধ করার আইন জারি করার অধিকার রয়েছে। কারণ এটি একটি অভ্যন্তরীণ ফরাসি বিষয়।’ ২০০৭ সালে, নিউইয়র্কে জাতিসংঘ কর্তৃক আয়োজিত আন্তঃধর্মীয় সংলাপ সম্মেলনে, ইসরায়েল এবং হোসনি মুবারকের সরকারের মধ্যে সম্পর্ক জোরদার হওয়ার পর, তানতাভি ইহুদিবাদী রাষ্ট্রপতি শিমন পেরেসের সাথে খুব উষ্ণতার সাথে হাত মেলান। তানতাভির যুগে মিশরে ফতোয়া বিভাগ রাষ্ট্রের চাওয়া ফতোয়াগুলোর কারখানায় পরিণত হয়েছিল। মনে হয়েছিল, এটি সরকারি ফতোয়া ছাপানোর ছাপাখানা।

মিসরের সাবেক প্রধান হোসনি মোবারক এবং প্রজাতন্ত্রের মুফতি সাইয়েদ তানতাভি

২০২০ সালের জুলাইয়ে মিশরীয় সংসদ আল-আজহার থেকে দারুল ইফতাকে সম্পূর্ণ আলাদা করার জন্য একটি খসড়া আইন তুলে। বিচার বিভাগের পরিবর্তে মন্ত্রী পরিষদে এর অধিভুক্তি হস্তান্তর করে এবং এটিকে একটি স্বাধীন ধর্মীয় সত্তা হিসাবে বিবেচনা করে। কিন্তু আল-আজহারের প্রতিনিধিরা তা প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ তারা এটিকে আল-আজহারের স্বাধীনতার লঙ্ঘন হিসাবে দেখেছিল। আল-আজহারের আপত্তি এবং সংসদে পাস করতে না পারার কারণে শেষ পর্যন্ত আইনটি পাস হয়নি। কিন্তু রাষ্ট্র ও ফতোয়ায় জোট আসলে পুরোদমে এগিয়ে চলেছে। দেশটির দারুল ইফতা এমন একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে, যা আল-আজহার থেকে কার্যত স্বাধীন এবং মিশরীয় রাষ্ট্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

সূত্র: আল জাজিরা

আগের সংবাদমুসলিম সভ্যতায় কৌতুক ও কৌতুক অভিনেতা
পরবর্তি সংবাদসুইডেনের পর এবার ডেনমার্কে পোড়ানো হলো পবিত্র কোরআন