রোজা : আমেরিকান দাস মুসলিমদের সংগ্রামের প্রতীক

মুজাহিদুল ইসলাম

সপ্তদশ শতাব্দীর সূচনা থেকে উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত উত্তর আমেরিকার ইসলামের ইতিহাস মুসলিম নির্যাতনের ইতিহাস। পশ্চিম আফ্রিকার দেশ হতে বলপূর্বক মুসলিমদের এনে দাস বানানো ও জমিতে কৃষকের কাজ করানো ছিল ব্যাপকভাবে প্রচলিত। তবে যা অনেকের অজানা, আমেরিকা রাষ্ট্র হওয়ার আগেই সেখানে মুসলিমদের বসবাস ছিলো। যুক্তরাষ্ট্রের ভূখন্ডে আগমনকারী প্রথম পর্যায়ের অভিবাসীদের আটলান্টিক ওপার হতে জোরপূর্বক আমেরিকায় আনা হয়। এই গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক তথ্যের দিকে কেউ গুরুত্বের সাথে দৃষ্টিপাত করেননি।

আমেরিকার দাসইতিহাস-বিষয়ে বিশেষজ্ঞ আমেরিকান স্কলার রাশিদাহ মুহাম্মদ বলেন, আমেরিকার সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, আমেরিকার ১৫ হতে ৩০ ভাগ তথা ১২ মিলিয়ন দাসই মুসলিম। ক্যালিফোর্নিয়ার আইন অনুষদের নৃতাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞ জনাব খালিদের মতে, মুসলিমদ-আবাসভূমি পূর্ব আফ্রিকা হতে দক্ষিন আমেরিকায় ৪৬ ভাগ দাসদের জোরপূর্বক নিয়ে আসা হয়।

নতুন বিশ্বে আফ্রিকান মুসলিম দাসরা তাদের ইমানের দাবী মেটাতে ধর্মীয় শিক্ষা মানতে তাদের আগ্রহ ও চেষ্টার সবটুকুই ব্যায় করেছেন। বিশেষত, রমজানের রোজা, নামাজ আদায়, হালাল খাবার ও সামাজিক আবশ্যকীয় দায়িত্ব পালনে চেষ্টায় কোন ত্রুটি করেননি। যুক্তরাষ্ট, দক্ষিন আমেরিকা ও ক্যরিবীয় অঞ্চলে বেশ মজবুতভাবে এ ইতিহাস ধারণ করেছে।

রাজনৈতিক কর্মকান্ড ও সমাবেশে নিষেধাজ্ঞা

তৎকালীন সময় ধর্মীয় কর্মকান্ডকে বিদ্রোহ হিসেবে দেখা হত। নিজেদের ব্যক্তিত্ব ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ধরে রাখার জন্য আমেরিকার দক্ষিনাঞ্চল ও ব্রাজিলের মতো বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকরা অবিরাম চেষ্টা করেছেন। সে সময় আমেরিকান আইন অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট ও ভার্জিনিয়ায় মুসলিমদের একত্রিত হওয়া নিষেধ ছিলো। যেকোন ধরনের জামায়েত খুবই পৈশাচিকভাবে প্রতিহত করা হত। তদুপরি মুসলিম দাসরা রমজান মাস এলে রোজা রাখতেন। একসাথে ইফতার গ্রহণ এবং তারাবীর নামাজ আদায় করতেন।

সফরে রোজা ছেড়ে দেয়ার অনুমতি থাকা সত্বেও অনেক মুসলিম দাসরা কঠিন পরিস্থিতিতেও রোজা রাখতেন। অনেক মুসলিম দাস তাদের জন্য নির্ধারিত স্থানে রমজানের নামাজসহ ইবাদত বন্দেগী করতেন। দাসআইনে সম্মিলিতভাবে ইফতার করার নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্বেও তারা সম্মিলিতভাবে ইফতার করতেন।

প্রাথমিক যুগের মুসলিমগণ তাদের ধর্মীয় আচার-পালনে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখী হতেন। যেমন আইয়্যুবা সুলাইমান; তামাকক্ষেত্রে কাজের জন্য তাকে তাদের অঞ্চল থেকে তুলে এনে বিক্রি করে দেয়া হয়। তিনি নামাজ আদায়ের সময় নির্যাতনের শিকার হন। পালিয়ে গিয়েও পরে আবার ধরা পড়েন। অনেকে রোজা ভাঙ্গতে বাধ্য হতেন।

নিজেকে ও নিজের পরিবারকে বাঁচাতে আমেরিকান উপনিবেশ সমিতির মাধ্যমে দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য অনেকে বাহ্যিকভাবে খিষ্ট্র ধর্ম গ্রহন করতেন। যেমন লামিয়া কিবী।আইয়্যুবা সুলাইমান দিয়ালুর মতো অনেকে তাদের আক্বীদা-বিশ্বাস রক্ষায় খিষ্ট্র ধর্ম গ্রহন প্রত্যাখ্যান করেন। আফ্রো-আমেরিকান সাংস্কৃতি ও ইতিহাস-বিষয়ক জাতীয় যাদুঘরের তথ্যমতে বিশ্বাসের প্রতি তার এ নির্মোহ টান তার মালিককে এতটাই অভিভূত করে যে, মালিক তাকে মুক্ত করে নিজ দেশ আফ্রিকা পাঠিয়ে দেন।

আমেরিকান নৃতাত্ত্বিক বিজ্ঞানীদের মতে ক্যামেরুন, গাম্বিয়ার মতো পশ্চিম ও মধ্যআফ্রিকা হতে যুক্তরাষ্ট্রে আনা আফ্রিকান দাসদের সংখ্যার ৩০ ভাগ মুসলিম।যুক্তরাষ্টের ওয়েন স্টেট ইউনিভার্সিটির স্কলার সাইদ আহমাদ খানের মতে যুক্তরাষ্ট্রে ঈমানরক্ষাই ছিলো আফ্রিকান মুসলিমদের সব’চে বড় চ্যলেঞ্জ। খান আরো বলেন, অনেক আফ্রিকান দাসকে তাদের আক্বীদা, ইসলামিক আচার-আচরণ, সভ্যতা ও সংস্কৃতি ত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। তাদের কাউকে কাউকে খ্রিষ্ট্রান বানানো হয়েছে।

রোজার মাধ্যমে দাসবিরোধী আন্দোলনে গতির সঞ্চার

আফ্রো-আমেরিকার দাস মুসলিমদের দৃষ্টিতে রোজা ছিল তাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ রক্ষার বড় মাধ্যম। ব্রাজিলের মুসলিমরা সাধারণত উত্তর আমেরিকার অন্যান্য দেশের তুলনায় অধিক ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করেন। সেখানে তারা একসাথে বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে খাবার গ্রহন ও পোষাক পরিধান করেন। এমনকি রমজান মাসের চাঁদ তারা একসাথে দেখেন।

সে সময়ের আমেরিকান মুসলিমদের আরেক কষ্ট ছিলো হালাল খাবারের সংকট। অথচ শুকরের গোশত যেমন সহজলভ্য ছিল, তেমনি ছিল বেশ সাশ্রয়ী।এভাবে আমেরিকান দাস মুসলিমদের নিকট রোজা কেবল ইবাদতের নাম ছিলো না। ছিলো তাদের স্বতন্ত্র পরিচয় প্রকাশের নিরন্তর প্রচেষ্ঠার নাম।
যদিও বর্তমানে আমেরিকান মুসলিমরা বিশ্বের সব’চে বৈচিত্রপূর্ণ ইসলামিক কমিউনিটি বলে গণ্য করা হয়। কিন্তু নতুন বিশ্বের সূচনাতে আমেরিকা মুসলিমদের ইতিহাস ছিলো সংগ্রামমূখর।

লেখক : তরুণ আলেম ও অনুবাদক

আগের সংবাদমরু-প্রাসাদের ধূসর দেশে
পরবর্তি সংবাদহারেম ফ্যান্টাসি : প্রাচ্যবাদ-নির্মিত মুসলিম নারী