ইফতেখার জামিল
কোন বনে যে পথ হারাই
হঠাৎ করেই মানুষের মধ্যে ঘুরতে যাবার প্রবণতা অনেক বেড়েছে। হয়ে উঠেছে জীবন ও যাপনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আগে ঘুরতে যাবার মানে ছিল আত্মীয়ের বাড়ি বা ঐতিহাসিক স্থাপনা। শহুরে চাকরিজীবী বা ছাত্রদের ছুটিতে বাড়ি ফেরার তাড়া। এখন সেই তাড়া নেই, তা নয়, তবে তার সাথে যোগ হয়েছে নদী, সমুদ্র বা পাহাড়ে একাকী সময় কাটানোর আহ্বান। ভ্রমণ এখন মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। জীবন-জীবিকায় স্বাচ্ছন্দ্য নেই, না থাকুক, তবুও, মানুষ প্রকৃতির সামনে একাকী দাঁড়ানোর লোভ সামলাতে পারে না।
রমজানের আগে থেকেই ঠিক ছিল দূরে কোথাও ঘুরতে যাবো। শবেবরাতের পরে একদিন ঠিক করেছিলাম মেঘনা নদীতে যাবো । নিম্নচাপে ভেসে গেলো সব পরিকল্পনা। বৃষ্টিতে নদীতে ঘোরাঘুরি ঝুঁকিপূর্ণ। ইমরান রাইহান আগের রাতে জানালেন তিনি যাচ্ছেন না। সুলাইমান সাদী বলল, সাভারে তার জরুরী কাজ আছে। আর কে কে যেন কী বলল। শহুরে জীবনে যে ক্লান্তি এসে জমা হয়েছিল, ফ্যাকাসে আকাশ, বাতাসে কারখানার ঘাম ও গন্ধ, কোথাও পাখির ডাক নেই, সারাদিন হঠাৎ রেগে ওঠা ক্লান্তিকর রোদ, আমার মনে হচ্ছিল, এই শহরে আটকে গেছে সময়।
রমজানের মাঝামাঝি সুলাইমানকে বললাম, ঈদে অবশ্যই কোথাও যেতে হবে। কোথায় যাই? ভ্রমণ পোর্টাল, ফেসবুক গ্রুপ ও ইউটিউবে সার্চ করে মনপুরা যাওয়ার সিদ্ধান্ত স্থির করলাম। ইতিমধ্যে মাসরুর জাকারিয়ার পক্ষ থেকে সুনামগঞ্জে যাবার দাওয়াত পেলাম। সুলাইমান ও ইমরান ভাই উৎসাহিত হয়ে মনপুরা বাদ দিয়ে সুনামগঞ্জের প্রতি আগ্রহ দেখানো শুরু করলেন। আমি নারাজির কোন কারণ দেখলাম না। সিলেট অঞ্চলে কখনো যাইনি। মেঘালয়-কন্যা ভাটির দেশের রক্ত আমার গায়েও আছে কমবেশি। বৃহত্তর মোমেনশাহীর সাথে সুনামগঞ্জের যোগ ও যোগাযোগ অনেক ঘনিষ্ঠ। নদীমাত্রিক সংস্কৃতি ও ধার্মিকতায় বিকশিত সভ্যতায় তারা আলাদা নয়। ভাটির দেশের জীবন ও লিপ্ততার পবিত্র গল্প করা যাবে। আপাতত সুনামগঞ্জ-যাত্রায় মনোযোগী হই। ঈদের পরদিন রাত নয়টায় বাস। তাড়াতাড়ি সায়দাবাদ যেতে হবে।
‘কোথায় আপনারা, বাস ছেড়ে দিয়েছে?’
ইমরান রাইহান ভাইয়ের সাথে স্থির ছিল, আমরা গুলিস্তানে একত্রিত হব। লালবাগে লেগুনা ছাড়তে দেরী করছিল। ইমরান ভাইকে গোলাপশাহ মাজারের সামনে দাঁড়াতে বললাম। পোঁছেই রিকশা নিলাম। আমাদের কথা শুরু হল। সফর মানে কিন্তু শুধুই ঘুরে আসা নয়। নিজেদের জীবন ও বাস্তবতার গল্প অকপটে শেয়ার এবং ফেলে আসা শহুরে ব্যস্ত সময়ের দিকে অনমনে ফিরে তাকানোর অবসর। যেনবা দৈনন্দিন তৎপরতায় ব্যস্ত জীবনের টাইপ এন্ড স্পেস থেকে দূরে যাওয়া; ব্যস্ততা, ক্লান্তি ও কপটতায় ঘেরা জীবন ছেড়ে অজানা সন্ন্যাস-যাত্রা। যেভাবে মুসলিম দরবেশরা ছাড়তেন ঘর। হয়তো এই সফরের আয়ু অনেক ছোট। তবু ঘরছাড়ার ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের লোভাতুর ব্যাকুলতা তো থাকবেই।
সায়দাবাদ পৌঁছলাম পৌনে নয়টায়। শুনলাম বাস ছাড়বে সাড়ে নয়টায়। এখন বাকী রাতের খাবার ও নামাজ। বাসের দীর্ঘ সফর। শুকনা খাবারও নিতে হবে। সাদী রাতের খাবার খাবে না বলল। ইমরান রাইহান, জুনায়েদ রাফি ও আমি নামাজ পড়তে গেলাম। যাত্রাবাড়ী জনপথ মোড়ের পাশেই মাজার মসজিদ। বেশ পুরনো মসজিদ। সুবিস্তৃত মাঠ ও প্রাচীন ডিজাইনে অন্য দশ মসজিদের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। শুধু নামাজের মনোযোগ নয়, মসজিদের পরিবেশ ও প্রতিবেশেও ইবাদতের ইতকান ও ইখলাসে পার্থক্য আসে। ছোট ছোট টাইলসে দেয়ালে রচিত হয়েছে বিচিত্র রঙের ডিজাইন। জামাত শেষে মুসুল্লিরা বের হয়ে যাচ্ছিলেন। অনেক বাতি নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে। আলো-অন্ধকারে প্রাচীন ডিজাইনে পবিত্রতার আলো দ্যুতি ছড়াচ্ছিল। মসজিদ থেকে বের হয়ে হোটেলে গেলাম। খানার অবস্থা দেখে ইমরান রাইহান বললেন, তিনি খাবেন না।
আমি ও জুনায়েদ রাফি বসলাম খিচুড়ি খেতে। প্রথম লুকমা মুখে দিতেই বুঝলাম, সিদ্ধান্তটা ভালো ছিল না। ঠিক খিচুড়ি নয়, খুদের চাউল দিয়ে তৈরি খাবার, দুপুরের আগে সম্ভবত রান্না হয়েছে, ফলে একটা গন্ধও আসছিল। শুকনা খাবার হিসেবে কী নেওয়া যায়? আমি মুড়ি-ভর্তার প্রস্তাব করলাম। চানাচুর ও মুড়ি মিশিয়ে পলিথিন বা কাগজের ঠুঙ্গায় বানিয়ে নিলে সাশ্রয়ী মূল্যে ভালো পরিমাণ খানা পাওয়া যাবে। শেষপর্যন্ত শুধু বিস্কুট নিলাম। ইতোমধ্যে সাদি টেক্সট করলো, বাস ছেড়ে দিয়েছে। ইমরান রাইহান দুষ্টামি করে বললেন, ‘আমরা পরের বাসে আসছি।’ কাউন্টারের সামনে আসতে বুঝা গেল, বাস আসলেই ছেড়ে দিয়েছে। গেল কোথায়? আমরা জনপথের মোড়ের দিকে দৌড় দিলাম। কোনমতে বাসে উঠতেই বাস ছেড়ে দিল। বাস চলছিল দ্রুত। আমরা পেছনের দিকে বসেছিলাম। ইমরান রাইহান আমার পাশে বসলেন। লাইট নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা খুচরা আলাপ শুরু করলাম। গসিপ, গল্প ও চুটকির চালে চালে চলছিল বাস, সুনামগঞ্জের পথে মামুন পরিবহন।
‘সফর দার সফর’
ইমরান রাইহানের সাথে কী আলাপ হয়েছিল, সেটা বলতে চাচ্ছি না। ব্যক্তিগত আলাপ নিশ্চয় সব পাঠকের সাথে শেয়ার করা যায় না। আমরা খুচরা কথা বলতে থাকি। সাত ঘণ্টার দীর্ঘ সফর। ঘুমও আসছে না। সেই ফাঁকে কিছু জরুরী আলাপ সেরে ফেলা যাক। আগেই বলেছি বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ পর্যটন অনেক বেড়েছে। কেন ও কীভাবে বেড়েছে, ব্যক্তিগতভাবে আমি বা আমরাও কেন নিয়মিত ঘুরতে বের হই, সে নিয়ে কিছু কথা বলা দরকার। নয়তো এই ঘোরাঘুরিগুলোকে নিছক বিনোদন বা সময় নষ্ট মনে হতে পারে।
মনে হতে পারে হয়তো হাতে খরচ করার টাকা আছে, সংসার-পরিবার নেই, তাই আকাশ, নদী বা সাগরের লোভে খেয়ে যাচ্ছে সময়। এমন ভ্রম অনেকের মধ্যেই আছে। শুরুতেই বলেছি, এখন সফরের ধরণ পাল্টে গেছে। মানুষ ঐতিহাসিক স্থানের চেয়ে প্রাকৃতিক নিদর্শন ও খাবারের প্রতি বেশী আগ্রহী। সে হতে পারে সমুদ্র, পাহাড় বা নদী। হতে পারে ঝর্ণা, বাগান বা ঝিরি। পথেই কেটে যায় দুই রাত, আসা ও যাওয়া। মাঝে দুই বা তিনদিন একাকী নিজের সাথে কথা বলা, পরিবার বা পরিচিতদের সাথে জমায়েত হয়ে হাসি বা আড্ডার ফাঁকে ক্লান্তি ভুলে যাবার আপ্রাণ চেষ্টা।
আমরা শহুরে জীবনে সবুজের সাথে অপরিচিত হয়ে যাচ্ছি । চারপাশে ইটপাথরের জঞ্জাল ও জঙ্গল। কৃত্রিম ফ্যাকাসে রঙে বিবর্ণ চারপাশ। সমরেশ মজুমদারের ভাষায় শহরের আকাশও নাকি গ্রামের মতো উদার উজ্জ্বল নয়। শহরের মানুষ বৈদ্যুতিক আলোয় অভ্যস্ত। গাড়ির ফ্যাকাসে হেডলাইট বা নিয়নের বয়স্ক গম্ভীর আলোকচ্ছটায় বিরক্ত। শহরে মানুষ কখনো পাতার ফাঁক গলে আসা আলোতে অভ্যস্ত নয়। শহরের রাত ও দিনের তাপমাত্রায় তেমন পার্থক্য নেই। রাগচটা গ্রীষ্ম থাকলেও শহরে শীত যেন কোথায় হারিয়ে গেছে।
তারচেয়ে বড় জটিলতা শহুরে বাতাস। এখানে বাতাসে কোন প্রাকৃতিক ঘ্রাণ নেই। সকাল, দুপুর বা সন্ধ্যার বাতাসের আঁচ ও আয়োজন যে আলাদা, শহরের মানুষের পক্ষে সেটা বলা কখনোই সম্ভব নয়। সন্ধ্যা নামার সময় গ্রামের রান্নাঘরের ধোয়া ও ঘ্রাণ, নবান্নে ধান সিদ্ধের মিষ্টি আঁচ, বাতাবিলেবু বা বনফুলের অবোধ ঘ্রাণের স্পর্শও শহরের মানুষের কাছে পরিচিত নয়। শহরে মন খারাপ হলে বাগানের পাশে বসার সুযোগ নেই। ক্ষেতের আইল ধরে গঞ্জে যাবার কোন অলৌকিক অনুসন্ধান নেই। গরম লাগলে পুকুরে নেমে সাঁতার কাটা যায় না। মন খারাপ হলে বাড়ির বাইরে রাতের বেলা হাঁটা যায় না। নয়টা-পাঁচটার অফিস বা ভারী ব্যাগের পড়াশোনা। লোকাল বাসে দাঁড়িয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে শহুরে মানুষের মনে হতে পারে মাঝে মাঝে একটু পালিয়ে যাওয়া খারাপ না।
আপাতত ভারী আলাপ থাকুক। আমরা পৌঁছে গেছি। বাসে তেমন ঘুম হয়নি। ভোর সোয়া চারটা বাজে। ফজরের এখনো অনেক সময় বাকী।
লাউড়ের গড় : অদিম জনপদে
সুনামগঞ্জ শহর। বাস থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করলাম। মসজিদ খুঁজতে হবে। পথ ধরে এগুতে শুরু করলাম। অনেক দূর পর্যন্ত কোন মসজিদ পেলাম না। আজান শুনছিলাম, তবে অপিরিচিত জায়গা বলে মসজিদটা ঠিক কোথায়, ধরতে পারছিলাম না। শেষপর্যন্ত মার্কেটের দু’তলায় মসজিদ খুঁজে পেলাম। ওজু-ইসতেঞ্জা করে নামাজের জন্য অপেক্ষা। স্থানীয় কয়েকজন মুসল্লি আসলেন। মুরুব্বী মতো একজন নামাজ পড়ালেন। পড়া অনেক সুন্দর নয়, তবে তাতে ভাটি-অঞ্চলের পরিশ্রমী ধার্মিকতার একটা টান আছে। আমাদের শহুরে নাগরিকদের সাথে তাদের দূরত্ব অনেক। গঞ্জের মসজিদের ইমাম মানে অল্প টাকার বেতন, সমাজের ‘মূলধারার’ সাথে দূরত্ব ও সম্মানের সুতায় টান দেওয়া অর্থনৈতিক টানাপড়েনের পরিশ্রমী জীবন।
প্রথমে আমরা যাবো মাসরুরের বাসায়। লাউড়ের গড়। সেখান থেকে জাদুকাটা নদী হাঁটার পথ। সিএনজি রিজার্ভে ছয়শো টাকার পথ। সুরমা ব্রিজ পার হতেই গ্রামীণ অঞ্চল শুরু হল। নাম না-জানা হাওর, ছোট নদী ও বিল, মাঝেমাঝে সুবিস্তৃত ফসলের ক্ষেত ও সাজানো জনপদ। চলতে চলতে ডান দিকে আবছা ছায়ার মতো ঘন সবুজ অবয়ব ভেসে উঠলো। মুহূর্তেই বুঝতে পারলাম আমরা মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশ ধরে চলছি। পাহাড় ধীরে ধীরে কাছে আসতে লাগলো। মনে হয় ছবির মতো সাজানো সংসার। পথের সাথে এগিয়ে চলে পাহাড়ের সারি। পাদদেশে জালের মতো জড়িয়ে ছড়িয়ে আছে জলাভূমি। বাতাসে গ্রামীণ গন্ধ। কাছে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। পবিত্র ভোরে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি বাংলাদেশের সীমান্তে, বহুদূরে, লাউড়ের গড়।
লাউড়ের গড় দুর্গম এলাকায় অবস্থিত। একদিকে জাদুকাটা নদী বেঁকে উজানে এগিয়ে গেছে মেঘালয়ের গভীরে। সামনে আছে বারিক্কার টিলা। পাশে মেঘালয় পাহাড় দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে। এক সময় লাউড় একটি স্বাধীন রাজ্য ছিল। দুর্গম এলাকায় অবস্থানের কারণে মুসলিম শাসনের আওতায় আসতে অনেক দেরী হয়েছে। লাউড়ের একসময়ের মন্ত্রীপুত্রের নাম অদ্বৈতাচার্য (১৪৩৪-১৫৫৮)। তিনি বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তক চৈতন্য দেবের (১৪৮৫-১৫৩৩) শীর্ষস্থানীয় সহচরদের অন্যতম। তিনি নবদ্বীপে শিক্ষালাভ ও শান্তিপুরে অধ্যাপনা করেন। পঞ্চদশ শতকে তিনি ‘চৈতন্যবিষয়ক পদ’ রচনার সূত্রপাত করেন। তিনি বৈষ্ণব সাহিত্যে শ্রীশ্রী অদ্বৈত মহাপ্রভু হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন।
অদ্বৈতের সাহিত্যে তৈরি হয় পণাতীর্থের মিথ। তার ভিত্তিতে হিন্দুরা বিশ্বাস করে, জাদুকাটা নদীতে একবার স্নান করলে তাদের সব গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ইসকন এই উৎসবে অর্থায়ন করে ও বিপুল অর্থ খরচ করে বিশাল মন্দির নির্মাণ করে আঞ্চলিক হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতি ও রাজনীতি প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালায়। কীভাবে মধ্যযুগের সাহিত্যের আখ্যান ও আন্তর্জাতিক অর্থায়নে তৈরি হচ্ছে হিন্দুত্ববাদী আত্মপরিচয়, উৎসব ও রাজনীতি, সেটা গভীর ভাবনার অবকাশ রাখে। এর ভালো দৃষ্টান্ত কাশ্মীরের অমরনাথ যাত্রা। আশির দশকে স্থানীয়ভাবে হাজার খানেক মানুষ এই যাত্রায় অংশগ্রহণ করতো। কিন্তু বর্তমানে ভারত সরকার ও হিন্দু এনজিওদের অর্থায়নে দেড় মাসব্যাপী লাখ লাখ হিন্দু জাতীয়তাবাদী এই যাত্রায় অংশগ্রহণ করেন ও অবস্থান করেন। সেখানেও ইসকন ভালো পরিমাণে অর্থায়ন করে থাকে। কাশ্মীরিদের অভিযোগ, স্থানীয় সংস্কৃতি ও জনমিতি পরিবর্তনে এটি বিশেষ ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশেও কি রাখছে?
শাহ আরেফীনের মোকাম : কাঁটাতারে খণ্ডিত দরবার
লাউড়ের গড় এখন সীমান্তগ্রাম। মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে জাদুকাটা নদী বিধৌত জনপদ। সুনামগঞ্জ থেকে পঁচিশ কিলোমিটার পথ। গ্রামে ঢুকেই বুঝতে পারলাম, এখানে প্রচুর ফলফলাদির ফলন হয়। গাছে গাছে ঝুলছে আম, কাঁঠাল ও জামসহ নানারকম ফল। তবে এসব কিছু ছাপিয়ে লাউড়ের গড়ের মূল শক্তি পাথর ও মাদক। জাদুকাটা নদীর স্বচ্ছ পানির নীচে আছে পাথরের অলৌকিক ঢিবি। হাজার হাজার মানুষ এখানে কাজ করেন। এই অঞ্চলের মানুষের কাছে জাদুকাটা নদী ফলফসলের চেয়েও দামী। প্রতিদিন এখান থেকে উঠছে কোটি কোটি টাকার পাথর। পাশাপাশি আছে মাদকের অন্ধকার, ভারতের সীমান্ত ধরে প্রতিদিন আসছে প্রচুর মাদক। জাতীয় পর্যায়েও এর কুখ্যাতি আছে। পরিস্থিতি এতটাই নাজুক যে, র্যাব মহাপরিচালক পর্যন্ত এই এলাকায় এসে হুঁশিয়ারি দিয়ে গেছেন। হুঁশিয়ারি দিলে হবে কী, অপরাধের কালো হাত অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত।
লাউড়ের গড় গ্রামের শেষমাথায়, মেঘালয় পাহাড়ের ঠিক পাশে একটা বাউল-আস্তানা আছে। স্থানীয়ভাবে শাহ আরেফীনের মোকাম নামে পরিচিত। কথিত আছে শাহজালালের সাথী শাহ আরেফীন দাওয়াতি কাজে লাউড়ের গড়ে আসেন, রাতে এখানে অবস্থান করেন এবং পরবর্তীতে মেঘালয় পাহাড়ের কোন গুহায় আস্তানা তৈরি করেন। ওইটাই ছিল তার একমাত্র আস্তানা, বাংলাদেশে তার কোন আস্তানা নেই। স্থানীয়রা তাকে জিন্দাপীর হিসেবে পরিচয় দেন। আমরা প্রাথমিক নাস্তা সেরে মোকামের দিকে রওনা দিলাম। তার মৃত্যুর পর কেটে গেছে শত শত বছর। তাকে ঘিরে তৈরি হয়েছে লোককথা ও গল্প। এর সাথে যোগ হয়েছে ভাটিঅঞ্চলের নিজস্ব পীর ও বাউল সংস্কৃতি। পাশেই হিন্দুদের পনাতীর্থের লোককথা। সবমিলিয়ে শাহ আরেফীনের মোকামেও চালু আছে নানারকম কীর্তি ও কিংবদন্তী। মোকামের খাদেম আমাদেরকে সেই গল্প ও ‘তাবীল’ বলছিলেন। আমাদের শরীয়তী মন, আমরা বেরসিকের মতো লুকিয়ে লুকিয়ে হাসছিলাম।
প্রতিবছর এখানে ওরস অনুষ্ঠিত হয়। তার ‘ভক্ত-আশেকান’রা প্রতিবছর ভিড় জমান ও মোকাম থেকে মেঘালয়ে শাহ আরেফিনের মাজারে গমন করেন। তবে দুই হাজার এক সালে বিএসএফ এই যাত্রা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং বাউল ও বাউলপ্রেমীদের কাঁটাতারের বেড়ায় আটকে দেয়। ফলে লাউড়ের গড় সীমান্তের জিরো পয়েন্ট ১২০৩ পিলারের কাছে দাঁড়িয়ে অনেক দূরে মাজারের দিকে তাকিয়ে জিয়ারত শেষে মনে ‘কষ্ট’ নিয়ে ফিরে যান ‘ভক্ত ও আশেকান’ ২০০১ সাল থেকে দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে। বাংলাদেশে পনাতীর্থ মেলায় বিদেশী অর্থায়ন ও ভারতীয়রা আগমন করতে পারলেও বাংলাদেশীরা শাহ আরেফীনের মাজারে যেতে পারেন না। মজার বিষয় হচ্ছে, ভারতীয় শিখদের পুণ্যভূমিতে গমনের জন্য পাকিস্তানকে করিডোর দিতে বাধ্য করে ভারত। ভারতীয় আধিপত্যবাদ অনেক গভীরে প্রোথিত। মাজার ও পূণ্যযাত্রার মতো বিষয়েও তারা ছাড় দিতে রাজি নন।
জাদুকাটা নদী, নিলাদ্রি লেক ও বারিক্কার টিলা
অনেক ইতিহাস বিবৃত হল। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। গোসল করতে হবে। দুপুরের আগে আমরা জাদুকাটা নদীতে নামলাম। নদীর পানি খুবই পরিষ্কার, কোমর পানিতেও পা স্পষ্টভাবে দেখা যায়। মেঘালয় পাহাড় থেকে নেমেছে বারিধারা, পানি যথেষ্ট ঠাণ্ডা। নদীতে কাদা নেই, পাথর ও বালিতে সমতল নদীর তীরদেশ, বহুদূর পর্যন্ত হেঁটে যাওয়া যায়। নদীতে বসে ডানে তাকালেই আকাশছোঁয়া মেঘালয় পাহাড়। সামনে বারিক্কার টিলা। মেঘালয় পাহাড় ও বারিক্কার টিলার মাঝপথ ধরে নেমে এসেছে জাদুকাটা নদী। গোসল করতে করতে নৌকায় করে চা ও পান নিয়ে আসলো জল-দোকানদার। নদীর ঠাণ্ডা পানিতে বসে মেঘালয় পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে চা পান করতে ভালোই লাগে। বেচতে বসে দোকানদার পুথির আসর নিয়ে বসলেন। আঞ্চলিক মিথ ও লোককথা বলছিলেন। আমরা অবাক হয়ে শুনছিলাম। মনে মনে বলছিলাম, কল্পনায় তো সত্য-মিথ্যে নেই। নাকি আছে?
বিকেলে নদী পার হয়ে নিলাদ্রি লেকের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। বারিক্কার টিলা থেকে মোটরসাইকেলে মিনিট পঁচিশ-আধা ঘণ্টার পথ। বারিক্কার টিলা থেকে স্থল পথে নিলাদ্রি যাওয়া যায়। তবে পর্যটকরা পাহাড়ি পথ বেয়ে যেতে চান। তাই শুরুতেই খাড়া পাহাড়ে উঠতে হয় এবং কিছুক্ষণ চলে আবার স্থলপথে নামতে হয়। পাহাড়ি পথের পাশেই গভীর উপত্যকা। ছবির মতো সাজানো সবকিছু। আস্তে আস্তে মেঘালয় পাহাড়ের সাথে দুরত্ব কমে আসতে থাকে। একপাশে পাহাড় আর আরেকপাশে গ্রামীণ জনপদ। মাঝেমাঝে পাহাড় থেকে নেমে এসেছে জলধারা। পাহাড়ের পাদদেশে সারিসারি সুপারি গাছ। শিল্পীর আলপনায় আঁকা সবুজ ধানক্ষেত। পাহাড়ের সাথে দূরত্ব কমতে কমতে নিলাদ্রি লেকে এসে পাহাড় জলধারার সাথে মিশে যায়।
নিলাদ্রি লেকের পানি স্বচ্ছ ও সুন্দর। পাহাড়ের পাদদেশের টিলাময় লেককে বাংলার সুইজারল্যান্ড বলা হয়। নিলাদ্রিতে পাহাড়ের কিছু অংশ বাংলাদেশও পেয়েছে। পাহাড়ের ঢালুতে গিয়ে বসলাম। ভাড়ার নৌকায় করে লেকের মাঝামাঝি গেলাম এবং পাথুরে অংশে নামলাম। পাহাড়ের পাদদেশে বিশাল বিশাল পাথরের চাই। আমরা কিছুক্ষণ ছবি তুলে লেকের পাশের টিলায় বসলাম। মাগরিবের কিছুক্ষণ আগে নিলাদ্রি থেকে রওনা দিলাম। আগেই বলেছি, পথটা অনন্য। এরসাথে একমাত্র মেরিন ড্রাইভের তুলনা হতে পারে। মেরিন ড্রাইভের একপাশে সাগর। আর এখানে দৈত্যকায় পাহাড়। বারিক্কার টিলায় ফিরে মাগরিবের নামাজ পড়লাম।
একজন পথসঙ্গীর অর্থায়নে মুড়িভর্তার আয়োজন করা হল। স্থানীয় দোকানে যা পাওয়া যায়, সব কিনে নেওয়া হল। এবং কিনে সরাসরি বারিক্কার টিলার চূড়ায় গিয়ে বসলাম। একদিকে জাদুকাটা নদী। পেছনে কয়েকশো গজ হাঁটলেই ভারতের সীমান্ত। টিলা ও উপত্যকা। সামনে ও বাঁপাশে শান্ত সুন্দর জাদুকাটা নদী। এখানেই নদী বাঁক নিয়েছে। চারদিকে অন্ধকার। অন্ধকারেই মুড়ি মাখানো হল এবং খেয়ে সবাই মাটিতে শুয়ে পড়লো। আশেপাশে কোন জন ও জনপদ নেই। ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। মাঝেমাঝে জলকণা আগাম বৃষ্টির জানান দিচ্ছে। সফরসঙ্গীদের মধ্যে খুচরা আলাপ চলছিল। আমি একটু তফাতে দাঁড়ালাম। নদীর দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম জন ও জীবনের কথা। ভাটিঅঞ্চলের জল ও জঙ্গলের মধ্যে বিকশিত মারিফতি গান, বিরহ আখ্যান ও লোককথা। নিজেকেই প্রশ্ন করলাম, আমি লক্ষিন্দর নাকি চাঁদ সওদাগর?
আদিম পথে চলতে চলতে
মাসরুর এখানে স্থানীয়। তাই অতটা নিরাপত্তা সমস্যা নেই। বিডিআর ক্যাম্পের প্রায় সবাই ওকে চেনে। ক্যাম্পে তার নিয়মিত যাতায়াত আছে। তবুও বেশী রাত পর্যন্ত টিলার চুড়ায় থাকা যাবে না। যাতায়াতের ইঞ্জিন নৌকা বন্ধ হয়ে যাবে। নয়টা সাড়ে নয়টার দিকে আমরা আবার লাউড়ের গড় আসলাম। এবং সরাসরি মাসরুরের বাড়ি। রাতের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিছুক্ষণ গল্প করে রাতের খাবার গ্রহণ করলাম। যেভাবে বারবার খানা দেওয়া হচ্ছিল, তাতে মনে হচ্ছিল আমরা কি শশুরবাড়িতে চলে এসেছি? গতরাতে ভালো ঘুম হয়নি, দিনেও না, শরীর ঘুম চাচ্ছিল। তবে ঘুমালেই তো রাতটা হয়ে যাবে সাধারণ রাতের মতো। খানাশেষে আমরা মসজিদে নামাজ পড়তে গেলাম এবং মসজিদ থেকে জাদুকাটা নদীর তীরে।
মাসরুর আগেই বলেছিল, কিছুক্ষণের চেষ্টায় আরও পরিষ্কার হল যে, এখানে ছোট ইঞ্জিন নৌকা ভাড়া নেবার কোন সুযোগ নেই। আমরা তীরেই দাঁড়ালাম। বসার কোন জায়গা নেই। চাদর মতো কিছু আনলেও হত। ভুলে গিয়েছি। তবে মাসরুরের কাছে সমাধান ছিল। ও বালিতে বসে পড়লো। পাথুরে বালি শরীরে লাগলেও নাকি অসুবিধা নেই। ঝাড়া দিলেই শরীর পরিষ্কার হয়ে যাবে। সবাই মাসরুরের অনুসরণ করে প্রথমে বালিতে বসলো এবং পরে শুয়ে পড়লো। বালিতে শুয়ে আছে সাতজন যুবক। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। জাদুকাটা নদীতে প্রবল ঢেউ নেই, মৃদু পানির আওয়াজ ছাড়া আর কোন আওয়াজ নেই। গাছপালা না থাকায় পাখিদের আনাগোনাও কম। এই শান্ত চরাচরে আমরা প্রবল উচ্ছ্বাসে কথা বলতে লাগলাম। বৈদ্যুতিক আলো ও বাতাসের দূষণ নেই। প্রকৃতি ছাড়া আমাদের অবস্থানের কোন সাক্ষী নেই। অন্ধকারে মোবাইল ক্যামেরাতেও ধরছে না আমাদের চেহারা ও অবস্থান।
প্রথম আমার গালেই পড়লো, আমি বললাম, বৃষ্টি পড়ছে? কিছুক্ষণের মধ্যে নিশ্চিত হলাম, হুম, বৃষ্টি পড়ছে। বাসায় ফিরতে হবে। আমরা একটু দূরে চলে এসেছি। কাছে হলেও বাসা অন্তত আধা মাইলের রাস্তা। চলতে হবে নদীর তীর ধরে। যেখানে মাঝেমাঝে আছে পাথরের স্তূপ। বালিয়াড়ি। হাতে কোন বাতি নেই। বৃষ্টির প্রচণ্ডতায় মোবাইলগুলো পলিথিনে ভরতে হয়েছে। মাঝেমাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আমার মনে হল, এই বছর দেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। আমি কি ভয় পাচ্ছি, মরে গেলে কী হবে, আমার কথা কি কেউ স্মরণ করবে? পলিথিনের ভেতর থেকে মোবাইল টর্চের আলোয় আমরা দ্রুত চলতে লাগলাম। কারো মুখেই ক্লান্তি বা অভিযোগ নেই। ছয়জন মানুষ সার বেঁধে এগিয়ে যাচ্ছি। সবার আগে আছে মাসরুর। তার আবার সব মুখস্থ। জন্মভূমি বলে কথা। অন্ধকারেই সে পার হচ্ছে পাহাড়ের স্তূপ ও বালিয়াড়ি। আমি নিজেকে প্রশ্ন করলাম, আমরা কি লাউড়ের রাজ্যের আদিম ইতিহাসে ঢুকতে যাচ্ছি?
বাসায় ফিরতে ফিরতে বৃষ্টি থেমে গেল। গোসল করে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলাম। লাউড়ের রাজ্যে আমাদের সফর দেড়দিনের। আগামীকাল সকালে সিলেট রওনা হবো। সিলেট থেকে আবার ঢাকা। আবার ইটপাথর, আবার ফ্যাকাসে আকাশ ও আবার রুটিন ভিত্তিক চব্বিশ ঘণ্টার জীবন।
লেখক : তরুণ আলেম ও ফাতেহ টুয়েন্টি ফোরের সম্পাদক