![লাওয়ারিশ](https://fateh24.com/wp-content/uploads/2019/06/লাওয়ারিশ-696x371.jpg)
মাহফুজ আবেদীন
সন্ধ্যা নামার পর অনন্তপুর স্টেশনে মিনিট কয়েক থামল সায়রাদের ট্রেনটি। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। ফলে যাত্রী ওঠা–নামার চাপ নেই বললেই চলে। হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন যথাসময়ে এগিয়ে চলল। সায়রার দৃষ্টি দরজা ভেদ করে বাইরে মেঘের সাথে মিশে গেছে। গাছপালা ঘরবাড়ি সবকিছু বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে নির্মল হয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতির এমন শুদ্ধ রূপ দেখতে কোনো ক্লান্তি নেই। খানিকটা আলো–আঁধারিতে বৃষ্টিস্নাত পরিবেশটা দারুণ লাগছে সায়রার। হঠাৎ ভিজে–টিজে একাকার আট–নয় বছরের একটি বালক ধীরগতির চলন্ত ট্রেনে উঠে এল। আকর্ষণীয় ও মায়াবী চেহারা। পোশাক–আশাকে আভিজাত্যের ছাপ। সায়রাদের বগিতে আর কেউ ওঠেনি এই স্টেশনে। তারপরও কোনো সিট ফাঁকা নেই। তাই সায়রাদের সিটের পাশেই ধবধবে ভেজা কাপড়ে গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকল ছেলেটি।
সায়রাদের গন্তব্য অচিনপুর। স্বামীর সাথে বাবার বাড়ি থেকে নিজ ঠিকানা অচিনপুরে যাচ্ছে। আর কয়েকটা স্টেশন পার হলেই নেমে যেতে হবে তাদের। তখন এই দুটি সিট একসাথে ফাঁকা হয়ে যাবে। সায়রার ইচ্ছা হচ্ছে এখুনি ছেলেটিকে বসতে দিতে। শুরু থেকেই ছেলেটির জন্য অচেনা এক মায়া কাজ করছে তার। সায়রার স্বামীর নাম মামুন। মামুনকে বিষয়টা বলার মন করল দুয়েকবার। কিন্তু মামুন বিষয়টিকে উটকো বা অস্বস্তিকর ভাবে কিনা নিশ্চিত হতে পারল না সায়রা। তাই বলতে যেয়েও বার দুয়েক ঢোক গিলল। ভেজা গতরে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটার দিকে ফের তাকাল সায়রা। ছেলেটা নিশ্চুপ ম্রিয়মাণ দাঁড়িয়েই আছে। দৃষ্টি বাইরের আসীম অন্ধকারে। যেন অন্ধকারে ফেলে আসা কোনো স্মৃতি আওড়াচ্ছে।
মামুন এরইমধ্যে আসন থেকে উঠে দাঁড়াল। এশার নামাজের সময় হয়েছে। দুয়েক কামরা পেরুলেই নামাজের জায়গা। বিয়ের এই সাত বছর বয়সে সায়রা কখনো হেলায় নামাজ ছাড়তে দেখেনি মামুনকে। বিষয়টি সায়রার অত্যন্ত ভালো লাগে। সখী–বান্ধবীদের সাথে গল্পকালে গর্ব করে বিষয়টি বলে সে। মামুন নামাজে চলে যাওয়ার পর সায়রা ছেলেটিকে ফাঁকা সিটটাতে বসতে বলল। ছেলেটি ভেজা কাপড়ে সিটে বসতে যারপরনাই আপত্তি জানাল। সায়রা ব্যাগ খুলে তোয়ালে বের করে সিটে বিছিয়ে দিল। এতে যেন ছেলেটি লজ্জায় আরও কুঁচকে গেল। অন্যের শুকনো পরিচ্ছন্ন তোয়ালেতে এই ভেজা শরীরে কী করে বসবে এই ভেবে শক্ত খুঁটির মতো দাঁড়িয়ে থাকল। সায়রা এবার ছেলেটিকে ধরে জোর করে বসিয়ে দিল। কিছুক্ষণ মাথা নুয়ে থাকার পর লজ্জা ভাঙানোর উদ্দেশ্যে সায়রা ছেলেটির সাথে কথা শুরু করল–‘কী নাম তোমার?’
‘আরমান।’ মাথা নিচু করেই উত্তর দিল ছেলেটি।
‘বেশ নাম তো তোমার!’ সায়রা আরমানকে উৎসাহ দিয়ে কথা বাড়াল–‘কোথায় যাবে তুমি?’ আরমান আবার মাথা নিচু করল। নিশ্চুপ থাকল। সায়রা তাগিদ দিয়ে আবার জিজ্ঞেস করল, ‘কী হলো, বলো, কোথায় যাবে তুমি?’ বলতে না বলতেই মামুন চলে এল। তাকে দেখে সায়রা খানিকটা থতমত খেয়ে গেল। ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার মতো করে তাকাতে লাগল মামুনের দিকে। ছেলেটা সম্পর্কে মামুনকে কী বলবে এটা ভেবে কূল পেল না সে। মামুন বোধহয় সায়রার অবস্থাটা আঁচ করতে পারল। তাই সে সায়রাকে আস্বস্ত করে বলল, ‘আমার বসে থাকতে থাকতে পা ধরে গেছে। আমি বরং একটু হাঁটাহাঁটি করি।’ মামুন হেটে গিয়ে দরজায় দাঁড়াল। একটু পর সায়রাও গিয়ে মামুনের পাশে দাঁড়াল। ‘ছেলেটার নাম আরমান। অনন্তপুর স্টেশন থেকে উঠেছে। সম্পূর্ণ একা। ভদ্র ঘরেরই মনে হচ্ছে। কোথায় যাবে বলছে না। তুমি একটু বলে কয়ে দেখো কিছু বলে কি না! কি মায়াবী চেহারা ছেলেটার! আমাদের যদি এমন একটা ছেলে থাকত!’ এক শ্বাসে কথাগুলো মামুনের কানে ফেলল সায়রা। মামুন সায়রার আবেগ বোঝে। এ নতুন কিছু নয়। চলতে ফিরতে একা কোনো বাচ্চা পেলেই সে তাকে কাছে টানে, খোঁজখবর নিয়ে দেখে। উদ্দেশ্য একটাই যদি লাওয়ারিশ হয় তাহলে দায়িত্ব নিয়ে লালন–পালন করবে।
ছেলেটা লাওয়ারিশ কিনা তৎক্ষনাৎ জানা গেল না। তবে সায়রাদের সাথে সে অচিনপুর আসতে রাজি হলো সহজেই। এতেই সায়রা ও মামুন অনুমান করে নিল যে আর যাইহোক ছেলেটির যাওয়ার নির্দিষ্ট কোনো গন্তব্য নেই। রাত পৌনে দশটার কাছাকাছি সময়ে তারা অচিনপুর এসে উঠল।
অচিনপুর প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা সায়রা। মামুন একই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। সিদ্ধান্ত হলো আরমান তাদের স্কুলেই পড়বে। আরমান অচিনপুর স্কুলে ভর্তি হলো। পড়াশোনা শুরু হলো। এরপর সময় গড়াল। আরমান হয়ে উঠল সায়রাদের চোখের মণি। পুত্রতুল্য আরমান যেন এখন তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যেন সাত বছর পর সাত রাজার ধন খুঁজে পেয়েছে তারা। চলনেবলনে আরমান পাড়াপড়শিদেরও দৃষ্টি কেড়েছে খুব অল্প সময়ে। স্কুলের সহপাঠী থেকে শুরু করে খেলার সাথিদের কাছে আরমান এখন সুপরিচিত নাম। সব দেখে সায়রার বাসনা যেন ষোলকলায় পূরণ হয়। বিপত্তি দেখা দেয় শুধু তার পরিচয় জানতে চাওয়া হলে। হঠাৎই যেন শ্রাবণের আকাশের মতো চারদিক কালো করে মেঘ জমে আরমানের মনে। গোমড়া মুখে সারাদিন পার করে দেয়। একটি কথাও কারও সাথে হাসিমুখকরে বলে না। কী এক অন্যমনস্ক ভাব যেন তাকে মুহূর্তেই এলোমেলো করে দেয়। সায়রা কয়েকবার এই অবস্থা দেখার পর এখন আর এই প্রসঙ্গ তোলে না। কিন্তু সে বুঝতে পারে এর সাথে এমন কোনো ভয়ংকর স্মৃতি জড়িত আছে যা আরমানকে স্থির থাকতে দেয় না, এর পেছনে এমন কোনো দৃশ্যপট আছে যা আরমানকে স্বভাবিক অবস্থা থেকে দূরে ঠেলে দেয়। এইটুকুন ছেলে! না জানি কী নিদারুণ যন্ত্রণার দাবানল বুকে নিয়ে প্রস্ফুটিত গোলাপের ন্যায় এতটা হাস্যোজ্জ্বল থাকে। সায়রার ভাবতে অবাক লাগে। আরমানের প্রতি মায়াটাও বহুগুণ বেড়ে যায় তার। সে পণ করে আরমানের অতীতপ্রসঙ্গ আর কখনো টানবে না।
একদিনের কথা। সায়রা বিকেলে বাড়ি এসে দেখে আরমান স্কুল থেকে ফেরেনি। অথচ আড়াইটার মধ্যেই তার ফেরার কথা। প্রতিদিন সবকিছু গুছিয়ে ফিরতে ফিরতে সায়রার বিকেল গড়ায়। আজ বরং সে বেশ খানিকটা বিলম্ব করেই এসেছে। এতক্ষণে আরমানের অবশ্যই এসে পড়ার কথা ছিল। মামুনকে ফোন করল। সে জানাল স্কুলেও নেই। সায়রা আর বিলম্ব করল না। আরমানের খোঁজে তৎক্ষনাৎ বেরিয়ে পড়ল। উদ্ভ্রান্তের মতো এদিক–সেদিক ছুটল। যেন সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল তার। বহু প্রতীক্ষার পর পুঞ্জীভূত মেঘমালা যেন দমকা বাতাসে নিমিষেই হাওয়া হয়ে গেল। খোঁজাখুঁজি করা হলো সব জায়গায়। স্কুলের খেলার মাঠ, চার রাস্তার মোড়ে রতন চাচার দোকান, পাশের বকুলতলা বাজারসহ সম্ভাব্য প্রত্যেকটা জায়গায়। পাগলের মতো সব জায়গায় দু–একবার ঢুঁ মেরে এসেছে সায়রা।
সন্ধ্যা নেমে এসেছে। অন্ধকারে সবকিছু যেন আবছা দেখছে সে। ক্লান্ত পা দুটো আর চলছে না। নিজেকে নিজের কাছে বোঝার মতো লাগছে। কী করবে দিশা করে উঠতে পারছে না কিছুতেই। মামুন তার বন্ধুবান্ধব ও পরিচিত লোকদের সহায়তায় হণ্যে হয়ে খুঁজে এসেছে সব জায়গায়। উপায়ান্তর না পেয়ে অপেক্ষায় রইল। হয়তো রাত নামলে চলে আসবে। কিন্তু রাতের আগমন তাদের জন্য পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ করে তুলল। কোথা রেখে কোথা খোঁজ করবে স্থির করতে পারল না। রাতের এক প্রহর এভাবেই দুশ্চিন্তা আর আশা–নিরাশায় কেটে গেল। এতক্ষণ মনে মনে এই সান্ত্বনা ছিল যে, হয়তো দুষ্ট ছেলেপুলেদের পাল্লায় পড়ে দূরে কোথাও চলে গিয়ে থাকবে। এখুনি এসে পড়বে নিশ্চয়ই। অথবা পথ ভুলে অচেনা কোনো জায়গায় গিয়ে পড়েছে বোধহয়। খোঁজ করে ঠিকঠাক চলে আসবে। কিন্তু রাত বাড়ার সাথে সাথে সেই আশাটা আর জিইয়ে রাখা সম্ভব হলো না তাদের পক্ষে।
রাত বেড়েই চলল। ঘড়ির কাঁটার টিকটিক শব্দটা বড্ড বিকট শোনাচ্ছে আজ। ঝিঁঝিঁ পোকাদের আওয়াজগুলোও আজ খুব বেসুরো লাগছে। অত্যন্ত বিশ্রীভাবে বাদুড়ের ডানা ঝাপ্টানোর আওয়াজও ভেসে এল। হুতুম পেঁচা ভৌতিক সুরে ডাকাডাকি করছে মুহুর্মুহু। ভয়ানক গলায় শিয়ালের পাল চিৎকার করে গেল বিক্ষিপ্তভাবে। এক নিদারুণ উৎকণ্ঠা আর দুঃস্বপ্নের রাত পার করল সায়রা আর মামুন।
সকাল সাড়ে নয়টার পর। ঘরের বারান্দায় দূরের পথের দিকে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মামুন ও সায়রা। আরমানের খেলার সাথি ইয়াসিন। রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ে আসছে এদিকে। সায়রা ও মামুন ইয়াসিনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে ঝটপট উঠে দাঁড়াল। নিশ্চয় আরমানের কোনো খবর তার কাছে আছে। তা নাহলে এ বেলায় এভাবে তার এদিকে আসার কথা নয়। ইয়াসিন ক্ষিপ্রগতিতে এগিয়ে আসছিল। সায়রার তর সইছিল না। এইটুকু পথ রাজ্যের দীর্ঘ মনে হচ্ছিল। ইয়াসিন কাছে আসতেই সায়রা ঝাপটে ধরল তাকে। কাঁদোকাঁদো গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘আমার আরমান কোথায় বল?’
এতটুকু পথ রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ে আসায় ইয়াসিন প্রথমে জোরে জোরে কয়েকবার শ্বাস নিল। তারপর সে যা বলল তা সায়রা কিংবা মামুন কেউই বিশ্বাস করতে চাইল না। তারপর ইয়াসিনকে নিয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে গেল। দেখল এক ভয়ংকর দৃশ্য। হাকারি বিলের তীরে আরমানের লাশ ভেসে আছে। পায়ের বুটজোড়া, গায়ের জামা আধো ভাসমান আধো ডুবো। আরমানের নিষ্পাপ মায়াবী মুখখানি পানিতে ডুবে থাকলেও পরিষ্কার পানিতে ধবধবে চেহারার প্রতিবিম্ব বোঝা যাচ্ছিল। শুধু সায়রা কিংবা মামুন নয়, এই দৃশ্য যেকোনো পাষণ্ডের হৃদয়ও কাঁপিয়ে দেবে। শক্ত মনের মানুষও হু হু করে কেঁদে উঠবে এই মর্মান্তিক অবস্থা দেখে। সায়রার রোনাজারি আর মামুনের ডাকাডাকিতে লোকজনের ভিড় পড়ে গেল। প্রশাসনের লোকজনও এল।
প্রাথমিক তদন্ত থেকে বেরিয়ে এল, হাকারি বিলে এমন ঘটনা দুয়েক বছর পর পরই ঘটে। ভর দুপুরে এদিকটাতে ছেলেমানুষ যাতায়াতের ব্যাপারে মুরব্বিগণ তাই বারণ করে থাকেন। আরমান কেন এদিকে এসেছিল সেটা অবশ্য স্পষ্ট জানা গেল না। তবে সায়রা এবং মামুনের জবানবন্দী থেকে জানা গেল যে, আরমানের অতীতস্মৃতি মনে পড়লে সে একাকী সময় পার করতে এখানে চলে আসত। হয়তো তেমন কিছু হয়ে থাকতে পারে। লাশ ওঠানো হলো। সারা রাত পানিতে থেকে ফুলে ফেঁপে উঠেছে লাশ। ফর্সা চেহারাটা আরও লাবণ্যময় হয়ে উঠেছে। সবাই আহাজারি–আক্ষেপ করছে আরমানের জন্য। পরিচিতরা কান্নায় ভেঙে পড়ছে। সায়রাকে কোনোভাবেই স্থির রাখা যাচ্ছে না। রোনাজারি আর কান্নায় বারবার মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে। একটু পর পর বেহুঁশ হয়ে পড়ছে। এতকাল পর একটা অবলম্বন খুঁজে পেয়েছিল সে। সমস্ত অপূর্ণতা ভুলে নতুন সংসার শুরু করেছিল। কখনো ভাবেনি, আকস্মিকভাবে জীবনে আসা ধন অকস্মাৎই তার জীবন থেকে হারিয়ে যাবে।
লাশ ফুলে যাওয়ায় বেশিক্ষণ দেরি করা গেল না। জোহরের নামাজের পর পরই আরমানের জানাজা হলো। এক অচেনা অজানা লাওয়ারিশ ছেলের জন্য মানুষের এতো আহাজারি আর চোখের জল অচিনপুরের কেউ আগে কখনো দেখেনি।
লেখক : তরুণ গল্পকার