রাশেদ মুহাম্মাদ জিয়া:
শাইখুল ইসলাম তাকী উদ্দীন আবুল আব্বাস আহমদ ইবনু তাইমিয়া রহ. ( ৬৬১- ৭২৮ হিজরী) এ উম্মতের ইতিহাসে জন্ম নেওয়া একজন শ্রেষ্ঠ জ্ঞানসাধক। তাঁর ব্যক্তিত্ব ও ইলমী মাক্বাম ছিলো উম্মতের জন্য আল্লাহর অনেক বড় অনুগ্রহ। আকিদা, ফিকাহ, তাফসীর ও ইলমুল হাদিসের সকল শাখায়ই তার সদর্প বিচরণ ছিল। এটি সম্ভব হয়েছে তাঁর ইলমী যোগ্যতার অতুলনীয় গভীরতা ও প্রশস্ততার কারণে। অবশ্য আকিদা ও ফিকাহের ক্ষেত্রে তিনি মাঝেমাঝে ইজতিহাদি কিছু ভুলের শিকার হয়েছেন। তবে সেটি তার ইলমি অবস্থানকে ম্লান করেনি কখনো।
ইবনু তাইমিয়াকে নিয়ে আমাদের সমাজে দেখা যায় নানা প্রান্তিকতা। একদিকে তার বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই, অন্যদিকে আবার কেউ কেউ ইবনু তাইমিয়ার মতকেই চুড়ান্ত ভাবেন।
এই লেখায় তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলোর প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করা হবে।
তাঁর ব্যপারে বিভিন্ন সময় যে সকল অভিযোগ জন্ম নিয়েছে, তার অধিকাংশই এসেছে বিচ্ছিন্ন বহু মতবাদ ও দলগুলোর পক্ষ থেকে। অভিযোগকারিদের সবার মোটিভ এক নয়। তাই তাদের প্রত্যেকের ব্যপারে পৃথক পৃথক পর্যালোচনা প্রয়োজন।
ইয়াহুদী
বিধর্মীরা, বিশেষ করে ইয়াহুদীরা তাঁকে খুব বেশী খারাপভাবে চিত্রায়িত করে থাকে। ইসলাম সম্পর্কে লিখিত ইয়াহুদীদের সমালোচনামূলক বইপত্রে তাঁকে নিয়ে প্রচুর অযৌক্তিক সমালোচনা দেখা যায়। ইবনু তাইমিয়ার প্রতি ইয়াহুদীদের এ ধরণের মনোভাবের কারণ হলো, তাদের সম্পর্কে লিখিত তার একটি গ্রন্থ । এ গ্রন্থটির নাম ‘কাওয়াইদু ইবনে তাইমিয়াহ ফির-রাদ্দি আলাল ইয়াহুদিয়্যাহ’। এখানে তিনি তাদের ধর্মবিকৃতির ব্যাপারে বিভিন্ন আলোচনা তুলে ধরেছেন। এই সম্পর্কে প্রায় ৭০০ পৃষ্ঠা-সমৃদ্ধ একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় ‘জুহুদু ইবনে তাইমিয়াহ ওয়া ইবনে কায়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ ফি দাহদি মুফতারয়াতিল ইয়াহুদ’ নামে। অর্থ, ইয়াহুদীদের ভ্রান্ত অভিযোগের মূলোৎপাটনে ইবনু তাইমিয়া এবং ইবনুল কাইয়িমের প্রচেষ্টা।
শিয়া
ইয়াহুদীদের পরে শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়াহ (রহ.) সম্পর্কে সবচেয়ে বেশী আপত্তি-অভিযোগ উত্থাপন করেছে শীয়ারা। এর বহু কারণ আছে। একবার শাইখুল ইসলামকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো, দ্বীনের জন্য কারা বেশী ক্ষতির কারণ, ইয়াহুদীরা নাকি রাফিজীরা? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, সার্বিক বিচারে দ্বীনের জন্য শীয়া রাফিজীরাই অধিক ক্ষতির কারণ। এটা ছিল তাঁর ইজতিহাদী ফতোয়া। তবে ঐতিহাসিক ঘটনা-পরম্পরার দিকে দৃষ্টিপাত করলে তাঁর এ কথাটি অনুধাবন করা যায়। এই ফতোয়াটি মাজমুউল ফাতাওয়া’র ৩৫ নং খন্ডে রয়েছে।
শীয়াদের বহু উদ্দেশ্যমূলক অথবা ভ্রান্ত কর্মকান্ডের মূলে আঘাত করেছিলেন তিনি তার বিভিন্ন লেখালেখির মাধ্যমে। বিশেষ করে শীয়াদের আকিদাগত বিভ্রান্তির ব্যাপারে যৌক্তিক আলোচনাসমৃদ্ধ তাঁর প্রসিদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য রচনা ‘মিনহাজুস সুন্নাহ লির-রাদ্দি আলাশ শিয়াহ’ ( শীয়া চিন্তার প্রতিরোধে সুন্নাহর পদ্ধতি) নামক গ্রন্থটি এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে কাজ করে। এ কারণে শীয়ারাই তাঁকে প্রথম ‘প্রতারক’ বলে অবহিত করেছিলো। তাকে যারাই বিভিন্ন সময়ে “তাকফীরি ফতোয়া দাতা” হিসেবে প্রচার করে, তারা কোনো না কোনোভাবে শিয়াদের দ্বারা প্রভাবিত।
খৃষ্টান
আরেকটি দল তার ব্যপারে নানা অযৌক্তিক অভিযোগ তোলে। অর্থাৎ, খৃস্টানরা। ইউরোপের বিভিন্ন নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে এখনো যে সকল মুসলিম মনীষী বহু অমূলক সমালোচনায় জর্জরিত, তাঁদের মধ্যে ইবনু তাইমিয়া অন্যতম। এর অনেক মৌলিক কারণের মধ্যে একটি কারণ হলো, তার রচিত অনন্য একটি গ্রন্থ ‘আল-জাওয়াবুস সহিহ লিমান বাদ্দালা দ্বীনাল মাসীহ’ (ঈসা (আঃ) এর দ্বীন-বিকৃতকারীদের বিপক্ষে উপযুক্ত জবাব)। তারা তাঁকে মানুষের নিকট উপস্থাপনা করেছে অপরাধী হিসেবে; ডাকাত সর্দাররূপেও তাকে দেখানো হয়েছে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন ফিকশনে।
অথচ তাতারীরা যখন ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বিভিন্ন জাতির উপর বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছিলো তখন মুসলিম উম্মাহর মধ্য থেকে ইবনু তাইমিয়া (রহ.) বিভিন্ন দেশের খ্রিস্টান রাজাদের কাছে পরামর্শ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ বহু চিঠি পাঠিয়েছিলেন। তখন দিমাশকে অবস্থান করছিলেন তিনি; যার খুব কাছেই ইরাকে তখন তাতারীরা মানুষ হত্যায় মেতেছিল।
পরে তাতার আক্রমণের বিপক্ষে সর্বত্র জিহাদের আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি।
কারামিত্বা
আধুনিক গণতন্ত্র ও পতিত দর্শনবাদী মুসলিমদের বিশাল একটি অংশ ইবনু তাইমিয়ার প্রতি শত্রুভাবাপন্ন মনোভাব পোষণ করে; বিশেষ করে বিভিন্ন মুসলিম দেশের উদারবাদী সেকুলার। এক্ষেত্রে তাদেরকে আদর্শিক সঙ্গ দিয়েছে- ‘কারামিত্বা’দের চিন্তা-ভাবনা।
এর প্রধান কারণ হলো, ‘কারামিত্বা’রা মূলত ইবনু তাইমিয়ার (রহ.) লেখালেখির কারণে বহুস্থানে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিলো। এক্ষেত্রে তার লিখিত একটি গ্রন্থের কথা প্রসঙ্গক্রমে এখানে উল্লেখযোগ্য। নাম, ‘বুগয়াতুল মুরতাদ ফির-রাদ্দি আলাল-ফালাসিফাতি ওয়াল-কারামিত্বা’। এটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই মূলত ক্বারামিত্বারা তার প্রতি এমন মনোভাব পোষণ করা শুরু করে বলে ধারণা করা হয়।
যুক্তিবাদী বিচ্ছিন্ন বিভিন্ন দলের
তিনি কলম ধরেননি এমন কোন বিষয় নেই। বর্তমানকালে নাস্তিক্যবাদের বিপক্ষে সামান্য যে লেখালেখি, এসবের সূচনা করেছিলেন মূলত ইমাম আবু হানিফা (রহ.)। তারপর যিনি সবচেয়ে তীক্ষ্ণতার সাথে নাস্তিকদের মূলে আঘাত করেছেন, তিনি হলেন ইবনু তাইমিয়া (রহ.)।
এর কারণে বিভিন্ন সময় নাস্তিকরা ইবনু তাইমিয়ার সম্পর্কে বহু অমূলক কথা বলেছে। এক্ষেত্রে তাদেরকে সহায়তামূলক সমর্থন দিয়ে আসছে কিছু যুক্তিবাদী বিচ্ছিন্ন দল, যেমন মু’তাজিলা ইত্যাদি। তাঁর প্রতি তাদের এই আচরণের কারণ হলো, তিনি যুক্তিবাদী সম্প্রদায়গুলোকে উদ্দেশ্যে একটি গ্রন্থ লিখেছিলেন ‘আর-রাদ্দু আলাল মান্তিকিয়্যীনাল-মুতাকাল্লিমীন ওয়া ইবতালী কালামিল ফালাসিফাহ’। এটি তাঁদের ভুল চিন্তা-ভাবনা ও যুক্তিতর্কের প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল।
রাফিজী
যখন দেখা যাবে খুব কঠোরভাবে কোন রাফিজী ইবনে তাইমিয়াকে গালমন্দ করছে, কাফির, মুলহিদ ও জিন্দিক বলছে তখন বুঝতে হবে, এটার নেপথ্যে কোন না কোন কারণ আছে। অর্থাৎ, রাফিজীরা আসলে বহু বছর পার হওয়ার পরও তার রচিত প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘আর-রাদ্দু আলা কিসরুয়ান আর-রাফিযিয়্যাহ’-এর না কোন উপযুক্ত প্রতিউত্তর দিতে পেরেছে না, কোন শক্ত কাউন্টার দিতে পেরেছে। এমনকি আজো হাজার হাজার আলেম রাফিজীদের বিপক্ষে কাজ করতে গিয়ে এ কিতাবটিকে শক্ত হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। রাফিজীদের বিপক্ষে অগণিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে এটি বিশেষ উপকারী একটি কিতাব।
অতিরঞ্জনকারী সূফী সম্প্রদায়
কিছু অতিরঞ্জনকারী সূফী সম্প্রদায় ইবনে তাইমিয়ার কঠোর সমালোচনা করে থাকে; ইবনুল আরবী ও মানসুর আল হাল্লাজের প্রসঙ্গকে কেন্দ্র করে। এর কারণ হলো, সূফীদের মধ্যে যারা সীমালঙ্ঘনকারী হিসেবে খ্যাত হয়ে আছেন, তাদের ভুলগুলোর ব্যপারে তার আলোচনাসমূহ স্পষ্টকরে তুলে ধরা হয়েছে ‘আর-রাদ্দু আলা কিতাবিল ইস্তিগাসা ওয়াল মুনাযারাহ মাআ শাইখিত-তারিক্বতির রিফায়িয়্যাহ’ গ্রন্থে। এখানে সূফীদের বিভ্রান্তকর বিভিন্ন ব্যাপারে মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করা হয়েছে।
জাহমিয়্যাহ
যার জ্ঞান যত বেশী তাঁর তত বেশী ধৈর্য থাকা দরকার। ইবনে তাইমিয়ার ইলমের প্রাচুর্যতা যেমন ছিলো, তাঁর ধৈর্যও ছিলো পাহাড়সমতুল্য। অন্যথায় জীবিত থাকা অবস্থায় তাঁর বিপক্ষে যেভাবে লেখালেখি শুরু হয়েছিলো, প্রখর ব্যক্তিত্বের অধিকারী না হলে তিনি বহু আগেই হারিয়ে যেতেন।
জাহমিয়্যাহ একটি চিন্তাগত বিদআতী দল। জাহমিয়্যাহ এবং ইবাদ্বীরা তাঁকে খুবই রূঢ় চোখে দেখে থাকে। কারণ তাদের প্রধান ভ্রান্তিগুলো মানুষের সামনে তুলে ধরে তিনি যে গ্রন্থটি লিখেছেন সেটা আজ পর্যন্ত মানুষের কাছে গৃহীত হয়ে আসছে জাহমিয়্যাহ সম্প্রদায়ের বিপক্ষে অকাট্য প্রামাণ্য স্মারক হিসেবে। সেই গ্রন্থটির নাম হলো ‘তালবিসুল জাহমিয়্যাহ ফির-রাদ্দি আলা তাঅসিসি বিদায়িহিমুল কালামিয়্যাহ’।
রাসুল-অবমাননা
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অবমাননার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহনের ক্ষেত্রে ইবনে তাইমিয়া বলা যায় পথিকৃৎ-এর ভূমিকা পালন করেছেন। নবী পরিবার ও সাহাবায়ে কিরামের ব্যাপারে যারা কটুক্তি করে তাদের ব্যাপারে শরয়ী হুদুদের আলোচনা করে সর্বপ্রথম শাতিমে রাসূলের শাস্তির পক্ষে আওয়াজ তুলেছিলেন তিনি।
এ সম্পর্কে তাঁর প্রণিত গ্রন্থটি হলো, الصارم المسلول على شاتم الرسول। এটি প্রায় বিশোধিক ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এটির ইংরেজি সংস্করণটি প্রথম প্রকাশ হওয়ার পর নাস্তিকদের কাছে তার ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠে চরম অশ্রদ্ধার পাত্র। সম্ভবত এটির বাংলা অনুবাদও বের হয়েছে।
দিমাশকে আসসাফ নামক এক খৃস্টান নবীজির শানে গোস্তাখি করলে ইবনু তাইমিয়া তাঁর সাথে ইমাম যায়নুদ্দীন আল ফারুকী (রহ.) কে সাথে নিয়ে শাসকের দ্বিতীয় প্রধান সহকারী ইযযুদ্দীন আইবেক আল হামুবীর কাছে ঐ ব্যক্তির শাস্তির দাবী নিয়ে হাজির হন। শাসক প্রথমে ঐ লোকটির শাস্তির ব্যাপারে গড়িমসি করলে ইবনু তাইমিয়া (রহ.) এই গ্রন্থটি রচনা করেন। তারপর এটির আলোচনা তুঙ্গে উঠে এবং খ্রিস্টান লোকটি ইসলাম গ্রহণ করে। পরবর্তীতে দিমাশকের শাসক তার এ ভুলের কারণে শাইখুল ইসলামের কাছে ক্ষমা চান। ( ইবনু কাসির : আল বিদায়া ওয়ান নিহায়াহ, খন্ড ১৩, পৃষ্ঠা ৩০৩)
তাকফীর
শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়ার (রহ.) উপর বড় আরেকটি অভিযোগ হলো, তিনি তাকফীরের ধারা মুসলিম উম্মাহর মাঝে ব্যাপকতর করেছেন। এটি মূলত মর্ডানিস্ট,সেক্যুলার ও কিছু লিবারেল মুসলিমের বক্তব্য; যা তারা বিভিন্নদিকে ছড়াচ্ছেন।
অথচ অযাচিত ও উসূলবিহীন তাকফীরি চিন্তা ( মুরতাদ হয়ে যাওয়ার হুকুম প্রদান করা) ক্রমশ যখন উম্মতের ভিতর তীব্রহারে বেড়ে চলছিল তখন ইবনে তাইমিয়া (রহ.) তাকফীরের মূলনীতি নিয়ে বিশুদ্ধ আলোচনার ভিত তৈরী করেন। তিনি বলেছেন, “মুসলিম উম্মাহর উচিত, ছোট-বড় পাপ এবং মানবীয় বিভিন্ন ভুলত্রুটির কারণে অবিবেচনাপ্রসূত ও অযৌক্তিকভাবে তাকফীর করা থেকে যথাসাধ্য বিরত থাকা। কারণ দ্বীনের ভিতর অনুপ্রবেশকারী সর্বপ্রথম বিদ’আত হল, শর’ঈ সীমারেখার বিপরীত তাকফীরি অযাচিত ব্যবহার; যা মুসলিম উম্মাহর মধ্যকার এক ভাইয়ের রক্তপাত আরেক ভাইয়ের জন্য হালাল করে দিয়েছিলো।” ( তারিক ফিকরী : ইবনু তাইমিয়া ফি উয়ূনিল গারব)
আধুনিক বিশ্বে ইবনু তাইমিয়ার চর্চা
বিভিন্ন সময় শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়ার (রহ.) উপর সমালোচনা হয়েছে। প্রতিপক্ষের আঘাতে তাঁর চিন্তাধারার উপরে লেগেছে বহু দাগ। তাঁর অনুসারীদের মন হয়েছে ক্ষতবিক্ষত। তবুও থেমে নেই ইতিহাসের এই মহান মনিষীর প্রতিভার নানা চিন্তাধারার সুস্থ চর্চা ও প্রচার-প্রসার। তিনি সমগ্র পৃথিবীবাসী, বিশেষভাবে মুসলিম উম্মাহকে যা দিয়ে গেছেন, তা অনন্য।
শরীয়ার বিভিন্ন শাখায় ছোটবড় ৬০০-এর অধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। যেগুলোকে খণ্ড আকারে হিসেবে আনলে তাঁর রচিত গ্রন্থের সংখ্যা আড়াই থেকে তিন হাজার ছাড়িয়ে যাবে। এর মধ্যে শুধু তাফসীর ও উলূমুত তাফসীরের উপর রচনা করেছেন প্রায় ১১৯টি গ্রন্থ। তাসাউফ ও তাজকিয়ার উপর রচনা করেছেন ৭০-এর অধিক মূল্যবান গ্রন্থ। ফিকাহ ও ফতোয়া সম্পর্কিত তাঁর রচনার সংখ্যা ১৪০টি। ২০১০ সালের শেষের দিক বিখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসিয়াল প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়েছে “ইবনু তাইমিয়া ওয়া আসরুহু” (ইবনু তাইমিয়া ও তাঁর যুগ) নামক একটি গবেষণাগ্রন্থ। যেখানে বলা হয়েছে, তিনি না হলে পাশ্চাত্য দর্শনের সামনে ইসলামী দর্শনের টিকে থাকা কঠিন হয়ে যেতো। গবেষণাপত্রটির ইংরেজি মূল নাম “Ibn Taymiyya and his time”।
মুসলিম জ্ঞানীকুলের মধ্যে ইমাম আবু হামিদ গাজালী ও ইমাম রাজীর (রহ.) পর শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়াই (রহ.) একমাত্র জ্ঞানসম্রাট যিনি ইউরোপীয় দর্শনের জনক এরিস্টটলের দার্শনিক চিন্তাকে চ্যালেঞ্জ করে পাশ্চাত্য দর্শনের ভিতকে প্রবল ঝাঁকুনি দিতে পেরেছিলেন।
ইবনু তাইমিয়া সম্পর্কে দুটি গবেষণাপত্র
(১) অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। এখান থেকে তাঁকে নিয়ে শতাধিক গবেষণা জার্নাল বের হয়েছে। তার মধ্যে ২০১১ সালে ইবনু তাইমিয়ার দর্শন ও গ্রিক দর্শনের সংঘাত নিয়ে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হওয়া ‘Ibn Taymiyya Against the Greek logicians’ নামক বইটি উল্লেখযোগ্য। এখানে গ্রিক দর্শনের বিপক্ষে ইবনে তাইমিয়ার দার্শনিক চিন্তার ভিত্তি নিয়ে গবেষণামূলক আলোচনা করা হয়েছে।
(২) জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের হিস্টরি অব ফিলোসফি বিভাগে ইবনু তাইমিয়া একটি আলোচিত ও সমালোচিত নাম। এ বিভাগ থেকে প্রকাশিত একটি উল্লেখযোগ্য গবেষণাপত্রের নাম “The Poison of Philosophy: Ibn Taymiyya’s Struggle for and Against Reason,”
প্রাচ্যবিদদের দৃষ্টিতে ইবনে তাইমিয়া (রহ.)
প্রাচ্যবিদদের অনেকে ইবনু তাইমিয়ার কঠিন সমালোচক ছিলেন। তবে তাদের মধ্যে অনেকে ইবনু তাইমিয়ার প্রয়োজনীয়তা ও মুসলিম উম্মাহর চেতনার বিকাশে তাঁর অবদানকে বিনাবাক্যে স্বীকার করতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। তন্মেধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি মন্তব্য নিম্মে উল্লেখ করা হলো :
১.
হাম্বলী চিন্তাধারা নিয়ে গবেষণাকারী ফরাসী প্রাচ্যবিদ হেনরী লাউস্ট ( ১৯০৫-১৯৮৩) তার ‘নাজরিয়াতু ইবনে তাইমিয়া ফিল ইজতিমায়ী ওয়াস সিয়াসাহ’ ( ইবনু তাইমিয়ার সামাজিক ও রাজনৈতিক চিন্তাধারা) বইয়ে লিখেছেন, ইবনু তাইমিয়া এমন একজন প্রতিভূ ছিলেন, যাঁর চিন্তাধারার ব্যাপারে খোদ তাঁর স্বজাতি ও স্বধর্মের লোকেরা পর্যন্ত বহুকাল যাবত অবজ্ঞা করে এসেছে।
হেনরী লাউস্ট আরো লিখেছেন, “ইবনু তাইমিয়ার ‘আস-সিয়াসাতুশ শারয়িয়াহ’ (ইসলামী রাষ্ট্রনীতি) কিতাবটি মামলুক রাজত্বকালে মিসরের শাসক মানসুর সাইফুদ্দীন আস সালিহী রাষ্ট্রের সংবিধান হিসেবে গ্রহণ করে এ গ্রন্থে বর্ণিত প্রতিটি নীতি অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন করে রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নতি সাধন করেছিলেন।
২.
নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ এর অধ্যাপক ড. জন হোভার তাঁর Ibn Taymiyya : Makers of the Muslim World (ইবনু তাইমিয়া : মুসলিম বিশ্বের সংস্কারক) বইয়ে লিখেছেন “ইবনু তাইমিয়া তাঁর সময়ের সবচে’ বড় জ্ঞানসাধক ছিলেন। তিনি ইসলামের প্রাথমিক ও পরবর্তী চিন্তাধারার সমন্বয় কাজে একজন মৌলিক সেতুবন্ধনকারী হিসেবে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ইসলামের বিপক্ষে অন্যান্য ধর্মের আক্রমণ এবং ইসলামে অনুপ্রবিষ্ট শীয়া চিন্তাধারার ভ্রান্তি প্রতিহত করার ক্ষেত্রে তাঁর ছিল গভীর সাধনা।”
৩.
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত “Ibn Taymiyya, one of the greatest and most prolific thinkers in medieval Islam” শীর্ষক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, “এরিস্টটলের দার্শনিক চিন্তাধারাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ইবনে তাইমিয়া খোদ ইউরোপিয়ানদের বিবেকে তীব্র নাড়া দিয়েছিলেন। পরে ইউরোপে এরিস্টটলের দর্শনের উপর বিস্তর পর্যালোচনা শুরু হয় এবং তাদের নজরে ইবনু তাইমিয়ার চোখে পড়া এরিস্টটলের দার্শনিক ভুলগুলো ধরা পড়তে থাকে। এ কারণে অনেক গবেষক মনে করেন, ইউরোপের জাগতিক দর্শনে টুকটাক যা বিশুদ্ধির ছোঁয়া পাওয়া যায়, তা মূলত ইবনে তাইমিয়ার হাত ধরেই অস্তিত্ব লাভ করেছিল।”
আধুনিক মুসলিম চিন্তাবিদদের দৃষ্টিতে ইবনু তাইমিয়া
এখনো কেনো শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়ার প্রাসঙ্গিকতা এত বেশী, সেটা উপরের দীর্ঘ আলোচনায় আমি কিছুটা তুলে ধরেছি। পরিশিষ্টে আমি গত দুই শতকের কতিপয় মুসলিম চিন্তাবিদের দৃষ্টিতে ইবনু তাইমিয়াকে মূল্যায়ন বর্ণনা করে লেখাটির ইতি টানবো। ইবনু তাইমিয়া সম্পর্কে কয়েকজন বিখ্যাত মুসলিম চিন্তাবিদের মন্তব্য :
১. শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.) বলেন, “আমার সুক্ষ্মদর্শী চিন্তার ফলশ্রুতিতে আমি বলতে পারি, কুরআনের অর্থগত গভীরতা ও বিধানগত বিষয়ে ইবনু তাইমিয়ার দক্ষতা ছিল অনেক বেশী। নবীজির (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হাদীসের হিফজের পাশাপাশি হাদিসের ফিকহি ভাবার্থ, শাব্দিক অর্থ ও বিধান উদ্ভাবনে তিনি ছিলেন মহান আলিম। মৌলিক ও শাখাগতভাবে তিনি হাম্বলী ফিক্বহের অনুসরণ করতেন। মুসলিম সমাজ থেকে বিদ’আত ও পাপাচার প্রতিরোধে তিনি আহলুস সুন্নাতের একজন সাহসী তীরন্দাজ ছিলেন”। (ড. আকরাম নদভী, লিমাযা নুহিব্বু ইবনা তাইমিয়া)
২. সাইয়িদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) বলেন, “ইবনু তাইমিয়ার জন্মের সময়কালটাই মূলত তাঁর জীবনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছিলো। কারণ তখন সিরিয়ার আলেপ্পো ও দিমাশক শহরে মুসলিম উম্মাহর বড় বড় আলিমগণের উপস্থিতি ছিল অন্যান্য সময়ের চেয়ে অনেক বেশী। শাইখুল ইসলাম ইমাম ইযযুদ্দীন আবদিস সালাম, ইমাম ইবনুস সালাহ ও ইমাম নববীর মতো জ্ঞানসম্রাটের যুগেই তাঁর জন্ম হয়েছিল।
তিনি হাম্বলী ফিকহের অনুসরণে আগ্রহী থাকলেও স্বয়ং নিজেও একজন মুজতাহিদ ছিলেন। জীবনের প্রাথমিক শিক্ষা তাঁর দাদা মাযদুদ্দীন (রহ.) থেকে প্রাপ্ত হন। ইমাম জাহাবী (রহ.) সিয়ারু আ’লামীন নুবালা’য় তাঁর দাদাকে রিজাল শাস্ত্রের ইমাম হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর দাদা হাম্বলী মাজহাবের বড় আলিমগণের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এসব কারণে শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়ার জীবনে ইজতিহাদী চিন্তার এক অনন্য সাধারণ প্রতিভা গড়ে উঠে।
অন্যদিকে ইবনু তাইমিয়ার (রহ.) জিহাদী চিন্তার উন্মেষও তাঁর জন্ম ও শৈশবের সময়ের যুগপৎ মিশ্রণে তৈরী হয়। কেননা তিনি যখন জন্মগ্রহণ করেছেন তখন মিসরে মামলূক রাজত্ব চলছিলো। যে রাজত্ব রুকনুদ্দীন বাইবার্সের মতো শাসকের দেখা পেয়েছিল। যিনি সালাহুদ্দীন আইয়ূবীর পর উম্মতের চিন্তায় জিহাদের বীজ বপন করেছিলেন। এই কারণে পরবর্তী জীবনে সিরিয়া অভিমুখে তাতার সাম্রাজ্যের আক্রমণ প্রতিহত করতে ইবনু তাইমিয়ার (রহ.) ঐতিহাসিক আহ্বানে রুকনুদ্দীন বাইবার্সের চিন্তার প্রতিফলন পরিষ্কারভাবে প্রতিভাত হয়ে উঠে”। ( আবুল হাসান আলী নদভী, রিজালুল ফিকরী ওয়াদ দা’ওয়াহ ফিল ইসলাম, পৃষ্ঠা ৪৩৭- ৪৭০)
৩. আল্লামা শিবলী নোমানী (রহ.) বলেন, “আমি মনে করি শাইখুল ইসলাম আহমদ ইবনু তাইমিয়ার (রহ.) জীবনের উপর আরো বেশী লেখালেখি করা উম্মতের সত্যনিষ্ঠ আলিমগণের অন্যতম ফরজ দায়িত্ব। ইবনু তাইমিয়াকে অধ্যয়ন করার পর থেকে আমার নজর থেকে ইমাম গাজালী ও ইমাম রাজী (রহিমাহুমুল্লাহ) পর্যন্ত প্রথম স্তর থেকে দ্বিতীয় স্তরে নেমে গেছে!”। ( ড. আকরাম নদভী, লিমাযা নুহিব্বু ইবনে তাইমিয়া )
ইবনু তাইমিয়ার রহ. সামাজিক, দার্শনিক, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাধারার উপর পড়াশোনা করে অভিভূত হয়ে আল্লামা শিবলী নোমানী (রহ.) এ মন্তব্য করেন।
৪. শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ (রহ.) বলেন, ইবনু তাইমিয়াকে শাইখুল ইসলাম বলার ব্যাপারে আমার উস্তাদ জাহিদ আল কাউসারীর (রহ.) যে আপত্তি ছিল তা আপন স্থানে সঠিক নয়। কারণ এক্ষেত্রে জাহিদ আল কাউসারী (রহ.) রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক স্থূলতার শিকার হয়েছিলেন। তাই ইবনু তাইমিয়াকে তিনি শাইখুল ইসলাম মনে না করলেও আমি তাঁকে শাইখুল ইসলাম মনে করি। ( ড. আকরাম নদভী, লিমাযা নুহিব্বু ইবনে তাইমিয়া ,)
উপমহাদেশের ইলমী মহল বিশেষ করে দেওবন্দ, সাহারানপুর ও নাদওয়া ঘরানায় আহমদ ইবনু তাইমিয়াকে শাইখুল ইসলাম উপাধিতে অভিষিক্ত করার উপর আরবের বিভিন্ন সূফী ও কতিপয় দরবারি আলিমের ঘোর আপত্তি রয়েছে। এই আপত্তির প্রতিউত্তরে আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ (রহ.) উল্লেখিত কথাটি বলেন।
সর্বোপরি, উম্মতের আকাশে শাইখুল ইসলাম আহমদ ইবনু তাইমিয়ার মতো একাধারে মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফক্বিহ, মুজতাহিদ ও মুজাহিদ আলিমের আবির্ভাব খুব কমই ঘটেছে। মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর সকল ইলমী ও ফিকরী কর্মসাধনা কবুল করুন এবং আমাদেরকে তাঁর ইলম ও ফিকর থেকে উপকৃত হওয়ার তাওফীক দান করুন, আমীন।
লেখক : শিক্ষার্থী : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।