সাওরা আল বারী:
তাঞ্জিয়ারের ব্যস্ত রাজপথ। অভিজাত চেহারার এক যুবক হেঁটে যাচ্ছেন আত্মমগ্ন ভঙ্গিতে। তার এক হাতে টমাস কার্লাইল রচিত অন হিরোজ, হিরো ওয়ারশিপ বইটা। অপর হাতে বুকের সাথে চেপে ধরে রাখা পবিত্র কুরআনের ইংরেজি অনুবাদ। কত জোড়া বিস্মিত চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে, কতজন তাঁর সম্ভ্রমে পথচলা থামিয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, সেদিকে খেয়াল নেই যুবকের। তিনি আত্মনিমগ্ন। তাঁর মনে ভাবনার প্রজাপতি উড়াউড়ি করছে। বিশ্বাসের জগতে সুর উঠছে বিপ্লবের। এ বিপ্লব মানেই রূপান্তর। উদ্ভাসিত সত্যের সামনে আত্মসমর্পণ।
যুবকটির নাম উইলিয়াম হেনরি কুইলিয়াম। ১৮৫৬ সালে ব্রিটেনে লিভারপুলের এক উচ্চ বংশীয়, ধনাঢ্য পরিবারে জন্ম হয় তার। উইলিয়ামের পরিবার মেথোডিস্ট খ্রিস্ট্রান। তার মা ছিলেন মেথোডিস্টের প্রচারক। এজন্য স্বাভাবিকভাবেই উইলিয়াম বড় হয়েছেন ধর্মীয় আবহে। তিনি স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস রাখতেন। প্রতিদিন স্রষ্টার উদ্দেশে নিবেদন করতেন হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা। স্বভাবের দিক থেকেও উইলিয়াম ছিলেন একজন অভিজাত পুরুষ। মদ্যপান খুবই অপছন্দ করতেন তিনি। প্রাণীদের জন্য বুকের ভেতর পুষতেন অপরিসীম মমতা।
দু’চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে উইলিয়াম পড়াশোনা করেছেন লিভারপুল ইন্সটিটিউট এবং ম্যানক্স কিং উইলিয়াম’স কলেজে। পড়াশোনা করতেন আর ভাবতেন, একদিন তিনি দেশসেরা আইনজীবী হবেন। নিজের সাফল্য দিয়ে আরো উঁচু করবেন পরিবারের সম্মান। উইলিয়ামের এই স্বপ্ন পূরণের সময় এসে গেলো একদিন। ১৮৭৮ সালে তিনি নিয়োজিত হলেন আইন পেশায়। তখন তার মেধা চাঁদের মতো আলো ছড়াতে লাগল। অল্পদিনেই লিভারপুলে ছড়িয়ে পড়ল তার খ্যাতি। বিভিন্ন সাড়া জাগানো হত্যা মামলায় আইনজীবী হিসেবে কাজ করে তিনি অর্জন করে নিলেন মানুষের ভালোবাসা।
তারপর পেরিয়ে গেল বেশ কয়েক বছর। উইলিয়াম ব্রিটেনের গৎবাঁধা জীবনযাপনে ক্লান্তিবোধ করতে লাগলেন। তার মন যেন একটু অবকাশ চাইল তার কাছে। সে সময় উইলিয়ামের ভাগ্যাকাশে হেসে উঠল সৌভাগ্য । তিনি অবকাশ যাপন করতে ফ্রান্স, আলজেরিয়া ঘুরে মরক্কোতে গেলেন। ইউসুফ বিন তাশফীনের দেশে। ইবনে বতুতার শহরে।
যাত্রাপথে জাহাজে তার দেখা হলো কয়েকজন মুসলিমের সাথে। তারা নামাজ আদায় করছিলেন। প্রবল বাতাসে জাহাজ তখন দুলছিল, অথচ সেদিকে তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। তাদের নিমগ্ন চেহারায় ফুটে থাকা প্রশান্তি স্পষ্টই জানান দিচ্ছিল স্রষ্টার প্রতি তাদের অটুট বিশ্বাস ও আনুগত্যের। উইলিয়াম খুবই অবাক হলেন। এই প্রশান্তি তার হৃদয় আন্দোলিত করল। একরাশ মুগ্ধতা তার জন্য নিয়ে এলো আকাশের ঐশ্বর্য। আল্লাহ তাআলা ইসলামের জন্য তার অন্তরকে প্রশস্ত করে দিলেন। মরক্কোতে গিয়ে উইলিয়াম ইসলাম নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলেন। তিনি আশ্চর্য হয়ে দেখলেন, ইসলামের সাথে তার বিশ্বাসের অনেক মিল আছে, বরং ইসলাম আরো বেশি পূর্ণাঙ্গ এবং সুন্দর। তখন তার কাছে ইসলাম গ্রহণ করা খুবই যুক্তিযুক্ত মনে হলো।
ব্রিটেনে তখন ভিক্টোরীয় শাসনকাল চলছিল। সে সময় ব্রিটিশ পরিচয়ের মূল ভিত্তিই ছিল খৃস্টধর্মের মূল্যবোধ। তখন ধর্মান্তরিত হওয়ার অর্থ নিজের অস্তিত্বকে উপহাস করা। তাচ্ছিল্য করা নিজের পরিচয়কে। উইলিয়াম সবকিছু উপেক্ষা করলেন। পূর্ব পুরুষের ধর্ম, বংশীয় কৌলীন্য বা নিজের খ্যাতি সবই পেছনে ফেলে তিনি ইসলাম গ্রহণ করে নিলেন। এমনকি নিজের নাম পরিবর্তন করে উইলিয়াম হেনরি কুইলিয়াম থেকে হয়ে উঠলেন আবদুল্লাহ কুইলিয়াম।
তাকে গ্রেট ব্রিটেনের প্রথম মুসলিম হিসেবে আখ্যায়িত করতে একটু সংশয় থাকলেও তিনি যে ব্রিটেনের প্রথম সারির একজন মুসলিম, এটা নিঃসন্দেহ। তিনি ব্রিটেনে প্রথম মসজিদ নির্মাণ করেন এবং তার হাত ধরেই ভিক্টোরীয় ব্রিটেনে ইসলামের প্রচার ও প্রসার ঘটে।
উইলিয়াম ইসলাম গ্রহণের পর ১৮৮৭ সালে লিভারপুল ফিরে আসেন এবং ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেন। ভিক্টোরিয়ান যুগে এ ঘটনা ছিল অনেকটা হঠাৎ বজ্রপাতের মতো। একজন সম্ভ্রান্ত ব্রিটিশ ইসলামগ্রহণ করবে, এটা মেনে নেওয়া তাদের পক্ষে ছিল খুবই কঠিন। ফলে উইলিয়াম সম্মুখীন হন বিভিন্ন সমস্যার। তাকে সহ্য করতে হয় প্রিয়জনদের অসহ্য উপেক্ষা।
উইলিয়াম সবকিছু হাসিমুখে মেনে নিয়ে ব্রিটেনে সক্রিয়ভাবে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। তার এই প্রচার ছিল প্রতিবেশীর ছোট্ট ঘর থেকে রাণীর রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত। সর্বত্রই তিনি তুলে ধরতেন ইসলামের মাহাত্ম্য ও সৌন্দর্য। নিজের সাম্রাজ্যের মানুষদেরকে ইসলামের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে লিখতে শুরু করেন একের পর এক বই। এগুলোর মধ্যে তার দ্য ফেইথ অব ইসলাম বইটি সবচেয়ে বিখ্যাত। এ বইটি রানী ভিক্টোরিয়াকেও উপহার দিয়েছিলেন তিনি।
উইলিয়াম ইসলাম প্রচারের কাজে অনেক বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হয়েছেন। সহ্য করেছেন অনেক কষ্ট। তবুও দাওয়াতের কাজ বন্ধ করেননি। ফলে তার এই আন্তরিক প্রচেষ্টা ও আল্লাহর ইচ্ছায় ব্রিটেনের অসংখ্য মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেন। তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখ্যযোগ্য হলেন উইলিয়ামের মা, যিনি ছিলেন মেথোডিস্ট প্রচারক। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি খাদিজা কুইলিয়াম নামে প্রসিদ্ধ হন। এছাড়া বিজ্ঞানী নাসরুল্লাহ ওয়ারেন, প্রফেসর হাশেম উইল্ডে, লর্ড স্ট্যানলিসহ আরো কিছু বিখ্যাত ব্যক্তি তার দাওয়াত পেয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
উইলিয়াম আফগানিস্তানের তৎকালীন যুবরাজ নাসরুল্লাহ খানের কাছ থেকে অনুদান পেয়ে লিভারপুলে প্রতিষ্ঠা করেন ব্রিটেনের প্রথম ইসলামিক সেন্টার ‘লিভারপুল মুসলিম ইনস্টিটিউট’ এবং এর একটি অংশে নির্মাণ করেন ব্রিটেনের প্রথম মসজিদ। ভিক্টোরীয় ব্রিটেনের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ শহরে হাতেগোনা মুসলিমদের এমন দুঃসাহসিকতায় ভিক্টোরিয়ানরা ভীষণ চমকে ওঠে। তবে এ মসজিদ নির্মাণের ফলে মুসলিমরা খুবই আনন্দিত হন। তাদের ভালোবাসায় যোগ হয় নতুন মাত্রা। মুয়াজ্জিনের আল্লাহু আকবরের সুরে তাদের বুকে অনুরণিত হতে থাকে বিশ্বাসের আযান।
উসমানী সালতানাতের শেষ খলিফা সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামীদ উইলিয়ামের ধর্মপ্রচার ও ধর্মীয় কার্যক্রমের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে ব্রিটেনের ‘শায়খুল ইসলাম’ উপাধি দেন। আফগানিস্তানের তৎকালীন আমীরও তাকে একই উপাধি দিয়েছিলেন, ফলে তিনি ব্রিটেনের মুসলিমদের নিকট হয়ে উঠেন শায়খ অব দ্য ব্রিটেন। হয়ে উঠেন তাদের প্রাণপুরুষ।
উইলিয়ামের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি উসমানী সালতানাতের পক্ষে থাকায় তিনি খৃস্টানদের নিকট বেশ নিন্দিত ছিলেন। এমনকি তাকে বিশ্বাসঘাতক বলতেও দ্বিধা করেনি তারা। তাদের এই অত্যাচার ও ইসলামফোবিয়ার যন্ত্রণায় তিনি বাধ্য হয়ে ইংল্যান্ড থেকে তুরস্ক চলে যান। সে সময় তার অনুপস্থিতিতে ব্রিটেনের মুসলিমরা যেন প্রাণ হারিয়ে ফেলে। লিভারপুলে ইসলাম প্রচারের কাজ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। পরে ১৯১৪ সালে তিনি হারুন মুস্তফা লিওন নাম ধারণ করে আবার ফিরে আসেন নিজের জন্মভূমিতে। তার প্রত্যাবর্তনে সাড়া জাগে মুসলিম মহল্লায়। শুরু হয় দাওয়াতী কার্যক্রম। তবে নাম পরিবর্তন করে তিনি লিভারপুল ফিরে এলেও ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত তার বেশিরভাগ সময় আইরিশ সাগরে অবস্থিত দ্বীপাঞ্চল আইল অব ম্যান-এ অতিবাহিত করতেন। সেখানেও তিনি দাওয়াতী কাজে মগ্ন থাকতেন। তার এ প্রচেষ্টা ও আল্লাহ তাআলার ইচ্ছায় ইসলামের আলো লিভারপুল থেকে পুরো ব্রিটেনে ছড়িয়ে পড়ে। যে ভূমিতে ইসলামের নাম শুনলেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ত, সেখানে মুসলিমদের সংখ্যা ধীরে ধীরে শত থেকে সহস্র ছাড়িয়ে যায়। এক আবদুল্লাহর ত্যাগ ও প্রচেষ্টায় আলো ছড়ায় হাজার আবদুল্লাহ।
ব্রিটেনের এই মহান দায়ী ১৯৩২ সালে লন্ডনে ইন্তেকাল করেন। তাকে ইংল্যান্ডের বিখ্যাত কবরস্থান ব্রুকউডে দাফন করা হয়। আল্লাহ তার ভুলক্রুটি মাফ করুন এবং তার কবরকে রহমতের শিশিরে সিক্ত করে রাখুন!
সূত্র :
ইসলাম ইন ভিক্টোরিয়ান ব্রিটেন : দ্য লাইফ এন্ড টাইমস অব আবদুল্লাহ কুইলিয়াম By রন গেইভস
ফরগটেন চ্যাম্পিয়ন অব ইসলাম : ওয়ান ম্যান এন্ড হিজ মস্ক, দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট নিউজপেপার, লন্ডন।
আবদুল্লাহ কুইলিয়াম সোসাইটি ওয়েবসাইট