বাংলাদেশের জন্মলগ্ন হতে আজ অবধি শিক্ষানীতি নিয়ে দুটি শ্রেণীর মাঝে তুমুল বিতর্ক চলে আসছে। আদর্শগতভাবে এই দুটি শ্রেণীর অবস্থান দুই মেরুতে। দুটি শ্রেণীই পৃথক পৃথক বলে বলীয়ান। এর মধ্যে একটি শ্রেণী একটি এদেশের জাতীয় বিশ্বাস তথা ধর্ম ও দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর পক্ষ হয়ে বিতর্ক করেন। আরেকটি শ্রেণী পশ্চিমা মতাদর্শ প্রভাবিত বুদ্ধিজীবীতার পক্ষ হয়ে লড়াই করেন। এই দ্বিতীয় শ্রেণীটির হাত ধরে স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭৪ সন থেকে নিয়ে ২০০৯ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ৭টি শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে। প্রত্যেকটি কমিশনই ধর্মীয় শিক্ষাকে যারপর নাই সঙ্কুচিত করে রিপোর্ট প্রস্তুত করেছে। যার ফলে ধর্মীয় মহলগুলো এই রিপোর্টগুলোর বিরুদ্ধে তাদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন এবং প্রস্তাবিত রিপোর্টের বিরোধীতা করেছেন। ২০০৯ এর শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে বর্তমানে ২০২২ সন পর্যন্ত বিভিন্ন সময় পাঠ্যক্রম প্রস্তুত করা হয়েছে। সে সমস্ত পাঠ্যক্রমে সুকৌশলে ধর্মীয় শিক্ষাকে বাদ দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ গত ৩০ মে, প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত নতুন শিক্ষাক্রমের রূপ রেখার চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এ রূপরেখার কোন স্তরে ধর্ম শিক্ষার ব্যবস্থা রাখা হয়নি। মূল্যবোধ ও নৈতিকতা দশম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষাক্রমে রাখা হলেও তা হবে সেক্যুলার। কোন ক্রমেই ধর্মশিক্ষা নয়। একে কেন্দ্র আবার সেই পুরনো বিতর্ক জেগে উঠেছে, যার সূচনা হয়েছি ১৯৭৪ সনে ড. কুদরত-এ-খোদার শিক্ষানীতি প্রকাশ পাওয়ার পর।
ধর্মীয় মহল ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে শিক্ষানীতি নিয়ে যে দ্বন্দ্ব চলে আসছে তা মূলত দুটি বিপরীতমুখী আদর্শের দ্বন্দ্ব। একদিকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র, অপরদিকে ইসলাম। দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জীবন দর্শন ইসলাম হলেও যাদের হাতে শিক্ষানীতি, শিক্ষাক্রম গঠিত হচ্ছে তারা হলেন বাম ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রবক্তা। তাই শিক্ষানীতিতে ঘুরে ফিরে বার বার এই চিন্তারই প্রতিফলন ঘটেছে। ধর্মীয় মহলগুলোর সাথে তাদের সবচেয়ে বড় মতপার্থক্য এই জায়গাটিতেই ছিলো যে, বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষা কোন আদর্শ ভিত্তিক হবে?
শিক্ষার আদর্শ কি হবে
ধর্মনিরপেক্ষ ও বামপন্থিদের মত ছিলো শিক্ষা হবে ধর্মীয় প্রভাব থেকে মুক্ত। নীতি শিক্ষার অধীনে কখনো কখনো ধর্মশিক্ষার কিঞ্চিত রাখা গেলেও শিক্ষাকে ব্যপকভাবে ধর্মের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে হবে। তাদের ধারণা, ধর্মমত শিক্ষাকে একদেশদর্শী, সংকীর্ণচেতা, সেকেলে এবং অলৌকিক ও অতি-প্রাকৃতিক বিষয়াদি দ্বারা ভারাক্রান্ত করে দেয়। অথচ শিক্ষাকে হতে হবে সম্পূর্ণ বস্তুনিষ্ঠ, ব্যবহারিক এবং লৌকিক জীবনের সার্বিক উন্নয়ন ও সুখ-সাচ্ছন্দ্য বিধানে সহায়ক। অলৌকিক বা অতি-প্রকৃত বিষয়াদির জ্ঞান নিত্যনৈমিত্তিক জীবন সমস্যার সমাধানে মানুষকে কিছুমাত্র পথ দেখাতে পারে না। কিভাবে মাটির গভীর তলা খুঁড়ে তেল কয়লা গ্যাস কিংবা অন্যান্য খনিজ সম্পদ অবিষ্কার ও উত্তোলন করতে হবে, কিভাবে সমুদ্র গর্বে ডুব দিয়ে মণিমুক্তা আহরণ করতে হবে, কেমন করে আণবিক বোমা তৈরী করতে হবে এবং শক্তিশালী শত্রু পক্ষকে দমন বা খতম করার জন্যে নতুন নতুন মরণাস্ত্র নির্মাণ করতে হবে, ধর্ম তা মানুষকে শেখাতে পারে না; বরং অনেক সময় ধর্মমত মানুষকে এই সব কাজ থেকে বিরতই রাখতে চায়। তাহলে ধর্মকে শিক্ষার ক্ষেত্রে টেনে আনাই ভুল। টেনে আনা হলে বরং জীবনের বিকাশ, উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে চরম পশ্চাদপদতাকেই মেনে নিতে হবে।
কিন্তু ইসলামপন্থীদের বক্তব্য হলো, ইসলাম এমন কোন ধর্ম নয়, যাকে পশ্চিমের খৃষ্টধর্মের মতো খণ্ডিত দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায়। বরং ইসলাম একটি জীবন দর্শন, যা পশ্চিমের জনপ্রিয় অন্যান্য জীবনদর্শনগুলোকে রীতিমতো চেলেঞ্জ করে। ইসলামকে বুঝার জন্য এখানে ড. আলিয়া আলীর ব্যাখ্যাটা প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেন, “জগৎ ভাবনা পরিক্রমায় তিনটি মাত্র পথ বিবেচ্য: ধর্মীয়(খ্রিষ্টধর্মীয়), বস্তুবাদী ও ইসলামী। এই তিনটি পথ তিনটি মূলগত সম্ভাব্যতার নির্দেশক- চৈতন্য, প্রকৃতি ও মানুষ যা যথাক্রমে খ্রিষ্টবাদ, বস্তুবাদ ও ইসলামের কেন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্যের প্রতিনিধিত্ব করে এবং প্রাচীনতম কাল থেকে আজ অবধি প্রচারিত সকল দর্শন ও শিক্ষা এই তিনটি মৌল ভাবনাবৃত্তের যে কোন একটিতে পড়তে বাধ্য। প্রথম ও দ্বিতীয়টির পরিক্রমণ শুরু হয়েছে যথাক্রমে আত্মা ও বস্তুকে মূল ধরে এবং তৃতীয়টির বিকাশ ঘটেছে একাধারে আত্মা ও বস্তুকে সাথে নিয়ে। যদি শুধু আত্মাই সর্বাত্মক হতো, জীবন হয়ে পড়তে নৈতিকতাহীন ও মানবিক অনুভূতিশূন্য। অপরদিকে যদি শুধু বস্তুই সবকিছু মূল হত তাহলে বস্তুবাদই হত দর্শনের একমাত্র উপসংহার। ইসলাম আত্মা ও বস্তুর স্বাভাবিক ঐক্যের এক নাম, যার সর্বোচ্চ রূপ স্বয়ং মানুষ। মানব জীবন সম্পূর্ণ হয় তখনই যখন তা শারীরিক ও আধ্যাাত্মিক আকাক্সক্ষা-উভয়ই আত্মগত করে। মানুষের যে ব্যর্থতা তা হয় জৈব প্রয়োজনের প্রতি ধর্মাশ্রয়ী বিমূখতা থেকে, নয়তো আধ্যাত্মিক আকাঙ্ক্ষার প্রতি বস্তুবাদী প্রত্যাখ্যান থেকে।”
মানব জীবন বিজ্ঞান বা আধ্যাত্মবাদ এ দুয়ের খণ্ডাংশকে লালন করে জীবনের পূর্ণঙ্গায়নে অবদান রাখতে পারে না। তাই এমন কোন তৃতীয় ধারার ব্যবস্থাপনা আবশ্যক যা এই দু’টি দৃষ্টিভঙ্গির একক সন্নিবেশ ঘটিয়ে অতঃপর এদের ওপরে স্থান পেতে পারে? ড. আলিয়া আলী বলেন যে, ইসলামই সেই তৃতীয় ধারার ব্যবস্থা যা বিপরীত নীতি সমূহের সমন্বয় ঘটিয়ে এমন একটি অবকাঠামোতে এসে দাঁড়ায় যার মধ্যে জীবন বিকশিত হয় স্বতঃসিদ্ধ স্বাভাবিকতায়। একটি উপযুক্ত, স্থায়ী ও কল্যাণকর শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নের জন্য জীবন দর্শন হিসেবে একমাত্র ইসলামকেই সামনে রাখা যায়। বস্তুবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা বা সাম্যবাদ কোনটিই সামগ্রিকতা ও ফলপ্রসুতার বিচারের ইসলামের সমকক্ষ হতে পারে না।
মুসলিম শিক্ষাবিদ ড. মাজেদ উরসান কিলানীর মতে, ধর্মভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ের ক্ষেত্রে পাঁচটি মৌলিক জিজ্ঞাসাকে আমলে আনা আবশ্যক। এই জিজ্ঞাসাগুলোর সুসম বাস্তবায়নের মাধ্যমেই ইসলামী শিক্ষানীতি বাস্তবায়িত হতে পারে। জিজ্ঞাসাগুলো হলো, স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির সম্পর্ক কী? মানুষে মানুষে সম্পর্ক কী? মহাজগতের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক কেমন হবে? পরকালে মানুষের বিশ্বাস কি হবে? মানুষ ও জীবনের সম্পর্ক কী?
এই জিজ্ঞাসাগুলোর মাধ্যমে মূলত শিক্ষা ব্যবস্থায় দু’টি বিষয়ের অন্তুর্ভুক্তি নিশ্চিত করা হয়েছে। আর তা হলো আধ্যাত্মিকতা ও প্রগতি। নিশ্চিত করা হয়েছে সেই বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গিরও, প্রগতি ও বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে যা ক্রিয়াশীল থাকবে। উপরের সম্পর্কপঞ্চকে এখানে একটি শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করা যায়। আর তা হলো ইবাদাহ। ইবাদাহ হলো মানুষের চিন্তা, কর্ম, কথা, আবেগ ও অনুভূতির একটি বিশেষ অবস্থার নাম যার প্রতিফলন ঘটে ব্যক্তির চিন্তা ও অন্তর্জগত থেকে শুরু করে তার ব্যক্তি জীবনে, সামাজিক জীবনে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে এবং সামরিক জীবনে। ইবাদাহর তিনটি প্রকাশস্থল রয়েছে। ধর্মীয়, সামাজিক ও মহাজাগতিক। ধর্মীয় ইবাদাহ বলতে বান্দার সঙ্গে আল্লাহর সম্পকর্কে বোঝায়। স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস, রসূলগণ, ফেরেশতাগণ, আসমানী কিতাবসমূহ ও ধর্মীয় আচার অনুশীলন হলো এস্তরের অন্তর্ভুক্ত।
ইবাদাহর দ্বিতীয় প্রকাশস্থল হলো সামাজিক। সমাজের সংহতি রক্ষা ও উন্নয়নের জন্য সমাজের বৈশিষ্ট্যাবলী জানা ও সে অনুপাতে আচরণ করা। এ স্তরের পূর্ণতার জন্য আবশ্যক হলো শিক্ষাব্যবস্থায় সমাজ গঠনের উপাদানসমূহ নিয়ে আলোচনা করা, সভ্যতা ও নগর সমূহের উত্থান-পতনের কারণ সমূহকে জানা এবং ঘটনা সমূহের পারস্পরিক সম্পর্ক, ফলাফল ও অনুঘটক সমূহ নিয়ে চিন্তা করা। এর মাধ্যমে জানা যাবে সমাজের উত্থান-পতন ও ধ্বংস-বিনির্মাণে আল্লাহ তাআলার কোন রীতিটি কর্যকর থাকে।
ইবাদাহর তৃতীয় প্রকাশস্থল হলো মহাজাগতিক। এর অর্থ হলো মহাজগতের গতিপ্রকৃতি অনুধাবন করে নিজের ধর্মীয় সত্ত্বাকে আরো গতিশীল করা। মহাজাগতিক ঘটনাবলী নিয়ন্ত্রণ করে যে সকল আইন-কানুন, সেগুলো বৈজ্ঞানিক সূত্র আবিষ্কার করা। অতঃপর ঐশ^রিক নির্দেশনা অনুসারে সেগুলো থেকে থেকে সর্বোচ্চ উপকার লাভ করার জন্য সচেষ্ট হওয়া। ইবাদাহর উপরোক্ত ব্যাখ্যা থেকে ধর্মীয় জ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান ও মহাজাগতিক বিজ্ঞানের অসংখ্য শাখা প্রশাখা বের হয়। শিক্ষানীতিতে সেগুলোর সন্নিবেশ ঘটলে একটি ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থার অবয়ব দাঁড়াতে পারে।
অতএব, প্রগতির পথে ধর্ম অন্তরায় বলে সেক্যুলার মহলে যে কানাঘুষা রয়েছে ইসলাম ধর্মের বেলায় তা একেবারেই বেমানান। ধর্মীয় মহলগুলোর দাবি হলো, বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে সেক্যুলার বা অন্য কোন মতাদর্শ নয়, বরং ধমীয় মতাদর্শকেই প্রাধান্য দেয়া আবশ্যক। বিশেষতঃ শিক্ষাকে যদি গণমুখী করতে হয় তাহলে এছাড়া কোন উপায় নেই। কেননা, বাংলাদেশের সিংহাভাগ মানুষ বিশ্বাসের দিক থেকে ধর্মীয়। ধর্মনিরপেক্ষতা বা বামপন্থার প্রতি গুটি কয়েক বুদ্ধিজীবীর আস্থা থাকলেও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আস্থা নেই। ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থার জন্য কমিশনগুলো বরাবরই একটি যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন যে, বাংলাদেশ বহুজাতিক দেশ, এখানে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাই একমাত্র অবলম্বন। এক্ষেত্রে মুসলিমগণের বক্তব্য হলো, ইসলামী শিক্ষা-দর্শনের অন্যতম একটি বিশেষত্ব হলো এটি সার্বজনীন। নারী-পুরুষ, শহরবাসী-গ্রমাবাসী, মুসলিম-অমুসলিম সকলরই জন্য এ শিক্ষা অবাধ ও নিরপেক্ষ। এ ব্যাপারে রূপ শ্রেণী-বর্ণ-গোত্র-ধর্ম ইত্যাদি কোন প্রতিবন্ধক হতে পারে না।
ইসলামপন্থিদের বক্তব্য, পরিসংখ্যান মতে বাংলাদেশের আড়াই কোটি শিক্ষার্থী স্কুল-কলেজে শিক্ষা নিতে যায়। যদি কতক বামপন্থিদের চাহিদা অনুযায়ী সেখান থেকে ধর্মীয় শিক্ষাকে দূরে রাখা হয় তাহলে দেশের এই প্রজন্ম ধর্মশিক্ষা থেকে বি ত হয়ে যায়। একটি স্বাধীন ও মর্যাদাবান জাতির জন্য এটি কেবল বেদনাদায়কই নয়, লজ্জাকরও বটে। বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ সকল মানুষের চাহিদা থাকে, তাদের সন্তান যেনো ধর্মশিক্ষা লাভ করে বেড়ে উঠে। সন্তানের ধর্মহীন ভবিষ্যত গড়ে উঠুক এটা কোন অভিভাবকেরই কাম্য নয়। অতএব, বাংলাদেশের আপামর জনতার আন্তরিক দাবি এটিই যে, ধর্মকে পুঁজি করে তাদেরকে সুন্দর নৈতিকতাপূর্ণ একটি শিক্ষাব্যবস্থা উপহার দেয়া হোক।
বাঙালী জাতীয়তা
২০০৯ সালে গঠিত অধ্যাপক কবির চৌধুরির শিক্ষানীতির অধীনে যে পাঠ্যবই পরবর্তিতে রচিত হয়েছিলো তাতে ব্যাপকভাবে ইসলামী ভাবধারার প্রবন্ধ-নিবন্ধ, নটক ও গল্প-কবিতা বাদ দেয়া হয়েছে। তার স্থলে আনা হয়েছে ব্রাহ্মণ্যবাদী ও বিজাতীয় সংষ্কৃতির বিভিন্ন গল্প-কবিতা ও নাটক-রচনা। যেমন দ্বিতীয় শ্রেণীতে আগে পড়ানো হতো ‘সবাই মিলে করি কাজ’ শিরোনামে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহানবী (সা.) এর সংক্ষিপ্ত জীবন চরিত। তৃতীয় শ্রেণীর বইয়ে ইসলামের প্রথম খলিফা ‘খলিফ হযরত আবু বকর’ শিরোনামের সংক্ষিপ্ত জীবনী। চতুর্থ শ্রেণীতে দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর রাযি. এর জীবনী পড়ানোর ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু কবির চৌধুরীর শিক্ষানীতির অধীনে প্রণতি পাঠ্যবই থেকে মহানবী (সা.) এবং ইসলামের প্রথম ও দ্বিতীয় খলিফার জীবনী বাদ দেয়া হয়েছে। একইভাবে পঞ্চম শ্রেণীর পাঠ্যবই থেকে মহানবী সা. এর এর জীবনী, কাজী কাদের নেয়াজের ‘শিক্ষা গুরুর মর্যাদা’ শীর্ষক কবিতা, ‘শহীদ তিতুমীর’ নামক একটি জীবনীর পরিবর্তে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে হুমায়ুন আজাদ লিখিত ‘বই’ নামক একটি কবিতা, যা পবিত্র কোরআন বিরোধী বলে পরিচিত।
ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে ধর্মীয় শিক্ষণীয় ঘটনা সম্বলিত ড. শহীদ উল্লাহর সততার পুস্কার নামক একটি লেখা, কায়কোবাদের লেখা ‘প্রর্থনা’ কবিতা বাদ দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে দেবী দূর্গের প্রশংসা সম্বলিত কবিতা ‘বাংলাদেশের হৃদয়’ এবং ‘লালগরুটা’ নামক ছোট গল্প, যাতে গরুকে দেবতার আসনে বসানো হয়েছে। একই শ্রেণীতে পাঠ্য ‘নীলনদ আর ‘পিরামিডের দেশ’ নামক ভ্রমণ কাহিনীর পবির্তে ‘রাঁচির ভমণ কাহিনী’ প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। সপ্তম শ্রেণীর বই থেকে মরু ভাস্কর নামক শেষ নবী (সা.) এর জীবন চরিত বাদ দিয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে পাঁঠা বলি দেয়ার নিয়মকানুন সম্বলিত লালু নামক একটি গল্প। অষ্টম শ্রেণী থেকে বাবরের মহত্ত্ব ও বেগম সুফিয়া কামালের লেখা ‘প্রার্থনা’ কবিতা বাদ দেয়া হয়েছে। এর পরিবর্তে সংযোজন করা হয়েছে রামায়ণের সংক্ষিপ্ত কাহিনী। নবম-দশন শ্রেণীর জন্য লিখিত বই থেকে কবি শাহ মুহম্মদ সগীরের লেখা বন্দনা, কবি আলাওলে ‘হামদ’ ও আব্দুল হাকিমের ‘বঙ্গবাণী’, ‘জীবন বিনিময়’ এবং কাজী নজরুল ইসলামের ‘ওমর ফারুক’ নামক কবিতা বাদ দেয়া হয়েছে। পক্ষান্তরে একই শ্রেণীর বইয়ে বেদী অন্নপূর্ণার প্রশংসা সম্বলিত মঙ্গল কাব্য আমার সন্তান, সাঁকোটি দুলছে ও রাঁধা-কৃষ্ণর লীলা কীর্তন সুখের লাগিয়া প্রভৃতি কবিতা প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। সাঁকোটা দুলছে কবিতাটিতে ৪৭-এর ভারত বিভক্তিকে হেয় করা হয়েছে।
পাঠ্যসূচী পরিবর্তনের এই দীর্ঘ ফিরিস্তি যখন জনসম্মুখে হাজির হয় তখন ইসলামী মতাদর্শী বাঙালী মুসলিম ও বাঙালী জাতিয়তাবদী সেক্যুলাদের মাঝে নতুন বিতর্ক আরম্ভ হয় যে, জাতীয় শিক্ষানীতির ভিত্তি কী হবে? হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি নাকি ইসলাম। এই বিতর্কের মূল জায়গাটা আসলে এখানে যে, বাঙালী জাতীয়তাবাদ বা বাঙালী সংস্কৃতি মূলত কী? যা প্রতিবিম্বিত হবে জাতীয় পাঠ্যপুস্তকে?
১৯৪৭ সালে যখন দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টি হয় তখন এই প্রশ্ন সমানে আসে যে, বাঙালী মুসলমানের আত্মপরিচয় কী হবে? বাঙালী নাকি মুসলমান? অথবা কতখানি বাঙালী বা কতখানি মুসলমান? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে একটি শ্রেণী তাদের ইসলামী পরিচয়কে বিলীন করে সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞানের আলোয় নিজেদের সত্তা ও অস্তিত্বকে আবিষ্কার করতে চেয়েছেন। তারা বাঙালী সংস্কৃতির নামে ইসলামী আদর্শ বিবর্জিত সংস্কৃতিতে নিজেদের পরিচয় খুঁজতে চেয়েছেন। তারই প্রকাশ ঘটেছে সেই মতাদর্শীদের হাতে রচিত পাঠ্যক্রমের পাতায় পাতায়।
বাঙালী সংস্কৃতির বয়ানে ইসলামপন্থিদের তাত্ত্বিক অবস্থান মজবুত। তারা বলেন, সাতচল্লিশের দেশ ভাগ কেন, তার আগে বা পরেও এদেশের মানুষের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের সঙ্কট দেখা দেয়নি। বরং একটি শ্রেণী কৃত্তিম সঙ্কট তৈরী করে ভিন্নতরো পথে বাঙালী জাতীয়তাবাদের ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। ঢাকায় প্রকাশিত ‘ফেলে আসা দিনগুলো’ বইয়ে ইব্র্রাহিম হোসেন লিখেছেন যে, কমিউনিজম মতাদর্শে বিশ্বাসী একটি শ্রেণী পরিকল্পিতভাবে বাঙালী জাতিয়তাবাদের প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন। সাতচল্লিশের দেশ ভাগের সময় তারা পাকিস্তানের পক্ষে আন্দোলন করেছেন। পাকিস্তান হয়ে গেলে তারা বলতে শুরু করলেন এটা নাকি ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক দেশ এবং সর্বপ্রকার প্রগতি বিরোধী মধ্যযুগীয় কান্ড-কারখানা। ইব্রাহিম হোসেনের বই থেকে জানা যায়, তাদের জাতীয়তাবাদের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বাংলা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের জন্ম তারাই দিয়েছিলেন। এরপর কালক্রমে তারা মনোযোগ দেন মুসলমানদের ধর্ম ও ধর্মীয় সংস্কৃতি বদলে দেয়ার দিকে। কৃত্তিম উপায়ে ডিম ফোঁটানোর মতো বাংলাভাষী মুসলমানদের ধর্ম ও ধর্মীয় সংস্কৃতি বদলে দেয়ার মূল কর্মসূচি হিসেবে তারা আনলেন বাঙালী জাতীয়তাবাদ এবং বাঙালী সংস্কৃতির কথা। ধর্মভিত্তিক হোক, ভাষা ভিত্তিক হোক, কিংবা অ ল ভিত্তিক হোক যে কোন নামে তারা সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পছনে নিরন্তর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। প্রতিবেশী সমাজের হিন্দুদের লেখা তাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, ধর্ম ও ধর্মীয় সংস্কৃতিপ্রধান সাহিত্যকে আমাদের সাহিত্য ও পাঠ্যক্রম হিসেবে গ্রহণ করছেন। বিপরীতে এদেশীয় মুসলমানদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, ধর্ম ও ধর্মীয় সংস্কৃতিকে সম্প্রদায়িক বলে প্রচার করতে শুরু করেছে।
নারী শিক্ষা
ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাবিদদের সঙ্গে ইসলামপন্থীদের আরেকটি মতপার্থক্য হলো নারী শিক্ষা নিয়ে। এমনিতে নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে ইসলামের বক্তব্য হলো, তা পুরুষের শিক্ষার মতোই জরুরী। নারীদেরকে অনগ্রসর রেখে কোন জাতিই পৃথিবীতে অগ্রসর হতে পারে না। তবে এক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষানীতিতে যে সহশিক্ষার কথা আছে সেখানেই ইসলামপন্থীদের মতভেদ। তাদের বক্তব্য হলো, পাশ্চাত্যের মতো শিক্ষার অধিকার আদায়ের জন্য নারীদের পুরুষ সেজে বিদ্যালয়ে আসার অর্থ হয় না। তাদের শিক্ষাব্যবস্থাটা তাদের স্বভাবের দাবি ও প্রয়োজন অনুযায়ীই হওয়া উচিত। পুরুষদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে তাদের জন্য নিরাপদ শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। ছেলে ও মেয়ে জন্মগত ভবেই স্বতন্ত্র দৈহিক ও মানসিক যোগ্যতা এবং ভাবধারার বাহক হয়ে থাকে। জীবনের পরিণত স্তরে স্বাভাবিক দায়িত্ববোধের তাগিদেই তারা স্বতন্ত্র কর্মক্ষেত্র গ্রহণে বাধ্য হয়। এ ব্যাপারে কোন মিলই থাকে না ছেলে ও মেয়ের জীবনে। কিন্তু তা সত্তে¡ও উভয়কে ঠিক একই বিষয় একই ধারায় শিক্ষা দেয়ার কুফল যে কত ভয়াবহ তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না।
পরিশিষ্ট
ঘানার বুদ্ধিজীবি ড. কুফি বুসিয়া বলেন, ‘কোন স্বাধীন জাতি যদি কোন বিদেশী শিক্ষাব্যবস্থার অনুসরণ করে তাহলে তাদের স্বাধীন সত্তার পরিস্ফুটন ঘটবে না।’ বাঙালী জাতি হলো একটি স্বাধীন জাতি। ধর্মীয় দিক থেকে স্বতন্ত্র আত্মপরিচয়ের অধিকারী। তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক, ঐতিহ্যিক, ও ঐতিহাসিক পরিচয় আছে। তাদের জাতীয় ধর্ম আছে এবং জাতীয় বিশ্বাস আছে। জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নে কিংবা পাঠ্যক্রম নির্ধারণে তাদের সেই স্বাধীন চেতনার মূল্যায়ন করা আবশ্যক বলে ইসলামপন্থীরা মনে করেন।
এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকার লেখক শিক্ষার উদ্দেশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘একটি সমাজের পুঞ্জিভূত জ্ঞান ও মূল্যবোধের হস্তান্তর হচ্ছে শিক্ষার উদ্দেশ্য’। তাই দেশীয় ধার্মীকশ্রেণী মনে করেন, আধ্যাত্মিক, মানবিক, নৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতিই শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষ হওয়া উচিত। ঐশী চেতনায় লালিত আদর্শ ও মূল্যবোধ ছাড়া শুধু ইহজাগতিক ও বস্তুতান্ত্রিক উদ্দেশ্য নিয়ে রচিত শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে কোন আদর্শ ও সৎ নাগরিক তৈরী হতে পারে না।
তথ্যসূত্র
এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা
মাজেদ উরসান কিলানী, ফালসাফাতুত তারবিয়াতিল ইসলামিয়া
উস্তায মুহাম্মাদ কুতুব,মানহাজুত তারবিয়াতুল ইসলামিয়া
শিক্ষকমিশন সমূহের রিপোর্ট সমূহ