শিক্ষিত মুসলমান ও ঈদসংখ্যার সংস্কৃতি

ইফতেখার জামিল

বাঙালী মুসলমানের জীবনে ঈদ একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসন ও বাঙালীয়ানার নামে ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতির আগ্রাসনে বাঙালী মুসলমানের কাছে আত্মপরিচয়ের প্রশ্নটা আরবের মুসলমানের মতো কখনো অত সহজ ছিল না। ভাব, বোধ ও উপযাপনের মধ্যেও বাঙালী মুসলমানের চিন্তার জগত ছিল আলাদা। একে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দোষনীয় মনে করার কিছু নেই। জাতিগত বৈচিত্র্য আল্লাহর অপার কুদরতের অপূর্ব প্রকাশ। সাংস্কৃতিক সংকরায়নের জরুরী উপাদান। স্বতন্ত্র পরিচয় ও সমন্ময়ের জন্য জাতিগত বৈচিত্র্য গুরুত্বপূর্ণ শর্ত।

ঈদে বাঙালী মুসলমানের আনন্দ উদযাপনের নানাধারা ও রুপ দীর্ঘদিন থেকেই চলে আসছে। মেলা, খেলা ও নাগরদোলায় বাঙালী মুসলমানের গ্রামীণ জীবনে নানারকম রং ও বর্ণের ঝলকানি আমাদের এ অঞ্চলের ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পিঠা-পুলি থেকে শুরু করে আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়ানো, রাতের বেলায় সুলুক বা গানের কলি নিয়ে শীতল পাটির গ্রামীণ রাত বা সম্ভ্রান্ত পরিবারের মোশায়েরা-মুনাজারা, এমন অনেক আয়োজনের কথা বলা যেতে পারে। তবে আমাদের আধুনিক শহুরে সমাজ ও সংস্কৃতিতে গ্রামীণ ঐতিহ্যের অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে। সে কারণেই আজকাল অনেকের মুখে শুনতে হয়, ঈদের দিনের মতো ক্লান্তিকর আর কিছুই নেই।

সকালবেলার সেমাই-ফিরনী-নামাজ, দুপুরে টানা ঘুম ও বিকেলে রিমোট হাতে টিভি-সিরিয়াল, এমন রুটিন আজকাল মোটেই অস্বাভাবিক নয়। এই শিক্ষিত সমাজের বিনোদনের জন্য  ঈদে বিশেষ সংখ্যা আয়োজনের তাই একটা চল গড়ে উঠেছে। তবে আমাদের তথাকথিত মিডিয়াগুলোতে একচেটিয়া সেকুলারদের প্রভাব থাকায় ঈদের বিশেষ সংখ্যায় ঈদ খুঁজে পাওয়া যায় না। খুঁজে পাওয়া যায় না মুসলমানি জীবন, সংস্কৃতি ও প্রশ্ন।

‘শহুরে’ ‘শিক্ষিত’ মুসলমানদের এই সঙ্কটকে অস্বাভাবিকভাবে দেখার কিছু নেই। নিছক ষড়যন্ত্র বা অক্ষমতা আখ্যা দেবারও কিছু নেই। সংস্কৃতি কখনো এক জায়গায় দাড়িয়ে থাকে না। তাতে আসে নিয়মিত পরিবর্তন, সমন্বয় ও সংযোজন। সাংস্কৃতিক সঙ্কটের মুহূর্তে তাই ভূমিকা রাখার সুযোগ বৃদ্ধি পায়। এই শুন্যতা পূরণের জন্য মাসিক রহমত থেকে শুরু করে অনেক ইসলামী পত্রিকা ঈদসংখ্যা প্রকাশের চেষ্টা করেছে এবং জনপ্রিয় হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় ফাতেহ টুয়েন্টি ফোর ঈদ উপলক্ষে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

আমাদের সমকালীন সময়ের যে কোন প্রসঙ্গকে দুই হাজার তেরো সালের সাথে মিলিয়ে দেখার প্রবণতা এখন ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে। শাপলা-শাহাবাগের সংঘর্ষের ভিত্তিতে যে কোন প্রসঙ্গে প্রাসঙ্গিক আরও নানা প্রশ্ন তুলা যায়। শাপলা-শাহাবাগকে শুরু বা শেষ দুই হাজার তেরো সালে হয়নি ও হবেও না। আমার মাঝেমাঝে মনে হয়, শাপলা-শাহাবাগকে সম্পূর্ণ  আলাদা করে দেখারও সুযোগ নেই। শাপলা-শাহাবাগের সঙ্কট মনে হয় বাঙালী মুসলমানের নিজের আত্মবিরোধ ও সংশয়। যার আপাতত কোন স্পষ্ট সমাধান কারো কাছেই নেই। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক রাজনীতি এবং জাতীয় অর্থনীতি ও স্থিতিশীলতায় পিছিয়ে পড়েছে। এই পিছিয়ে পড়া হতাশায় বাঙালী নিজেই জড়িয়ে পড়েছে আত্মবিরোধে।

ঈদ সংখ্যার বিষয়ে কিছু বলি। ইউসুফ সুলতান, খোন্দকার রাকিব ও হাসান রোবায়েতের সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হচ্ছে।  সালাহউদ্দিন জাহাঙ্গীরের সাহিত্য জীবনের স্মৃতি প্রকাশিত হচ্ছে। অনেকগুলো গল্প ও বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ। গণমাধ্যম নিয়ে লেখেছেন আতাউর রহমান খসরু। আছে আরও অনেককিছু। ফাতেহ টুয়েন্টি ফোরের বয়স খুব বেশী দিন হয়নি। অল্পদিনেই অনেকের চোখ কাড়তে সক্ষম হয়েছি আমরা। অনেক ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা আছে, সেই জন্য আমরা নিয়মিত চেষ্টা করে যাচ্ছি। পাঠকরা আমাদের দোয়ায় স্মরণে রাখবেন সেই আশা নিশ্চয় করতে পারি। মাআস সালামাহ।

সম্পাদক, ফাতেহ টুয়েন্টি ফোর 

আগের সংবাদমাহে রমজানের উদ্দেশ্য : আমাদের ‘মুহাসাবাহ’
পরবর্তি সংবাদ‘আমি গদ্যেও শেষ পর্যন্ত কবিই’