মাজেদা রিফা:
জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহ। তীব্র রোদ থাকার কথা। অথচ আকাশজুড়ে ছেঁড়া মেঘের ছুটোছুটি। সকালের কোলজুড়ে রোদ ছিল। দুপুর হওয়ার আগেই বড় বড় ফোঁটার বৃষ্টি কাঁপিয়ে দিচ্ছে সবুজ পাতার সংসার। শীতল হাওয়া উড়ছে মনের আনন্দে। এমন সময় দরজায় ছোট্ট হাতের নক। কুরআন পড়তে এসেছে কয়েকটি শিশু-কিশোরী। ওরা প্রতিবেশীদের সন্তান। আমি ভাবি-আমারই সন্তান।
পাশের বাসার দরজায়ও চঞ্চল হাতের করাঘাত শোনা যায়। গুজরাতি মসজিদের ইমাম সাহেবের ঘর ওটা। ওখানে ছেলেরা পড়তে আসে। করোনার আগে ওরা প্রতিদিন বিকেলে মসজিদে পড়তে যেত। এখন আসে ঘরে। অবশ্য যারা হিফয করছে তারা ভোরেও পড়তে আসতো ইমাম সাহেবের ঘরে। তারপর সকাল আটটার দিকে ছুটতো স্কুলে। গরমকালে সমস্যা হয় না। কিন্তু শীতকালে সকাল আটটা মানে কাকডাকা ভোর। অন্ধকার। অন্ধকারে আলো ছড়ানো ছোট ছোট এই কুরআনি পাখিগুলো দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়।
স্কুল থেকে ওরা ফিরে সাড়ে তিনটা পৌনে চারটার দিকে। এরপর শুধু ওদেরই ছুটি নেই। কুরআন যে শিখতে হবে। এক থেকে দেড়ঘন্টা সময় পায় ওরা। এর ভেতরেই খেয়ে তৈরি হয়ে পৌনে পাঁচটার আগেই মসজিদে উপস্থিত হয়। আমাদের ছোট্ট শহরে তিনটা মসজিদ। তিনটা মসজিদই দুইঘণ্টার জন্য তিলাওয়াত ও দ্বীনি তালিমের সুরে মুখরিত হয়ে উঠে। ব্রিটেনের বেশিরভাগ মসজিদের একপাশে মহিলাদের জন্য আলাদা স্থান আছে। যদিও মুসাফির মহিলাদের নামাজের জন্য দরজাটা খুলে দেয়া হয় কিন্তু প্রতিদিন মহিলাদের নামাজের ব্যবস্থা নেই। ওই আলাদা দরজাটা মুসলিম মেয়ে বাচ্চাদের বিকালের কুরআনি তালিমের জন্য রাখা হয়েছে। ইমাম সাহেবের স্ত্রী অথবা এলাকার আলেমারা ছোট ছোট মেয়েদের কায়দা, আমপারা, কুরআন ও দ্বীনি জরুরী মাসআলার দারস দেন। আবার অনেক বোন আছেন আমার মতো, পড়ানোর আগ্রহ আছে, কিন্তু বাচ্চা ছোট বলে মসজিদে গিয়ে পড়ানো সম্ভব নয়, তারা ঘরেই বৈকালিক মাদরাসা খুলে বসেন। সবখানেই বাচ্চাদের ছুটি হয় সাড়ে ছয়টা অথবা সাতটায়। ঘরে ফিরে একঘন্টা খেলাধুলা করে খেয়ে তৈরি হয়ে বাচ্চারা রাত সাড়ে আটটা থেকে নয়টায় বিছানায় চলে যায়। ওরা ঘুমায়। স্বপ্নের দেশে ঘুরে বেড়ায়।
এই তো মুসলিম বাচ্চাদের জীবন। সুবোধ বাচ্চাদের জীবন। যারা দ্বীনি তারবিয়াত অথবা বাবা মার কঠোর শাসনে বড় হচ্ছে। বিশেষ করে ইসলামিক স্কুলে যে বাচ্চাগুলো পড়ে তাদের আখলাকের ভিন্নতা শৈশবেই চোখে পড়ে। অহেতুক গালাগালি বুলিং করা ইত্যাদি থেকে বিরত থাকে বেশিরভাগ শিশুই। শৈশবেই তাদের বিশেষভাবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় উত্তম আখলাকের সাথে। যেমন আমার ছেলেমেয়ে যে ইসলামী স্কুলে পড়ে ওখানে চার খলিফার নামে চারটি গ্রুপ আছে। প্রত্যেক শিশুই কোনো না কোনো গ্রুপের সদস্য। প্রত্যেকেরই ভালো কাজগুলোকে মূল্য দেয়া হয়। প্রতিটা ভালো কাজের জন্য পয়েন্ট দেয়া হয়। বছর শেষে যার পয়েন্ট বেশি এবং যে গ্রুপের পয়েন্ট বেশি তাদেরকে পুরস্কৃত করা হয়। এভাবে ওরা ভালো কাজের প্রতি দারুণভাবে উৎসাহী হয়ে উঠে। দুঃখের বিষয় ইসলামিক স্কুলের শিক্ষার্থী অথবা ঘরেই দ্বীনের সঠিক তারবিয়াত প্রাপ্ত এইসব শিশুর সংখ্যা অল্পই বলা চলে।
দ্বীনি তরবিয়াতের বাইরে অথবা শিক্ষার আলোকিত বলয়ের বাইরে যেসব পরিবার আছে, তাদের সন্তানরা রাত জেগে ট্যাব টিভিতে গেইম খেলাসহ নানারকম অপকর্মের সন্ধান পেয়ে গভীর রাতে ঘুমাতে যায়। দিনের রুটিনটা যদিও সবার জন্যই অপরিবর্তনশীল, কিন্তু ঘরোয়াভাবে দ্বীনের সঠিক তারবিয়াত নেই বলে, বাবা মার সঠিক গাইডেন্স নেই বলে অনেক বাচ্চা বড় হতে হতে জড়িয়ে পড়ে ড্রাগ ব্যবসায়ীদের সাথে। মাদক, ক্লাব, ঘর পালানোসহ অবাধ্যতার যা যা আছে সবই শিখে নেয় অল্প বয়সেই। তবে মেয়েদের ব্যাপার ভিন্ন। এরা ড্রাগে কম জড়ালেও উচ্ছৃঙ্খলতার ষোলো আনা ঠিকই পূর্ণ করে। রাত করে ঘরে ফিরে। যার তার সাথে অবৈধ রিলেশনে জড়িয়ে পড়ে। মুসলিমের সন্তান বলে অনেক মেয়ে হিজাব পরলেও নামাজসহ ইসলামের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিধানের পরওয়া করে না। রক্ষণশীল ফ্যামিলি হলে বেছে নেয় গোপনীয়তা। বাইরে এক, ভিতরে আরেক। মেয়ে বন্ধুদের সাথে হলিডের নামে চলে যায় ছেলেবন্ধুর সাথে অন্য কোনো দেশে। একসময় পুলিশ ডেকে বাবা-মার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় নির্দ্বিধায়। কোনো কোনো বাবা-মা মেনে নেয়, মানিয়ে নেয়। আর কেউ কেউ সম্পর্ক ছিন্ন করে রাখে বহুদিন। কিছুদিন আগে ‘দোভাষীর ডায়েরি’ নামে একটা বই পড়েছিলাম। লিখেছেন ব্রিটেনে পুলিশ, আদালত ও অন্যান্য সংস্থার দোভাষী হিসেবে নিযুক্ত মোহাম্মদ মুফিদুল গণী নামে এক ভদ্রলোক। বইটি পড়লে বুঝা যায় সাধারণ মানুষের জীবনবোধ আসলে কত করুণ। সাংসারিক জীবনগুলোর প্রতিটি বাঁকে কত অসংখ্য অনাচার, অবিচার, দুঃখগাথা, হতাশা! তবুও জীবন চলছে। সাংসারিক, সামাজিক এই চলাটা যেন চিরকালীন। আজকের শিশু আগামীকাল জন্ম দিচ্ছে নতুন আরেক শিশু। বেড়ে উঠছে সেই শিশুটিও…। কী তার ভবিষ্যত, জীবনের মাকসাদ তার কী হওয়া উচিত, কেউ ভাবে না।
দুই.
সাধারণ মানুষের জীবনের মাকসাদ বুঝি একটাই; ফাইন্যান্সিয়াল উন্নতি। প্রতিটি মুহূর্তে মানুষ ছুটে যাচ্ছে মহাকালের পথে। তবুও কী এক অমোঘ আকর্ষণে পৃথিবীর আলিঙ্গন থেকে মানুষের মুক্তি নেই। চারদিকে এত দুঃখ, এত যুদ্ধ, এত মলিনতা, মুসলিমের রক্তের ঘ্রাণ ভেসে বেড়াচ্ছে পুরো পৃথিবীর মানচিত্রে, তবুও মানুষের নিজেকে ছাড়া ভাবনা নেই।
ভালো কাজের খোঁজে ও ভালো থাকা-খাওয়ার জন্যই উনিশ শতক থেকে বাঙ্গালীরা ব্রিটেনে আসা শুরু করে। ব্রিটেনের নাইনটি পার্সেন্ট বাঙ্গালীই হচ্ছে সিলেটি। সিলেটিরা রক্ষণশীল হয়ে থাকেন বলেই হয়তো প্রথমদিকে কেউই পরিবারকে নিয়ে আসেননি। কেউ কেউ তো নিজে একদিনও ব্রিটেনে থাকা মুনাসিব মনে করেননি। ‘বেদ্বীন নাসারার দেশ, মহিলারা ভালো করে কাপড় পরে না’ এই বলে এক জাহাজে এসেছেন অন্য জাহাজে ফেরত চলে গেছেন। পরবর্তীতে পঞ্চাশ, ষাট, সত্তরের দশকে যারা এসেছিলেন তারা পরিবার-পরিজনকে নিয়ে আসতে শুরু করেন এবং ধীরে ধীরে ব্রিটেন হয়ে উঠে দেশের মানুষের কাছে স্বপ্ন ও আর্থিক উন্নতির আরেক নাম। প্রথমদিকের অভিবাসীরা নিম্ন আয়ের খাতগুলোতে কাজ করতেন। শ্রম প্রয়োজন হয় এমন বিভিন্ন কারখানায় কাজ করতেন। কেউ কেউ ট্যাক্সি চালাতেন। পরবর্তীতে রেস্টুরেন্ট টেইকওয়ে ইত্যাদির বিজনেস জনপ্রিয় হয়ে উঠে এবং ধীরে ধীরে বাংলাদেশী সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার প্রভাব ও অবস্থান দৃঢ় হতে থাকে।
তাই ব্রিটেনে মুসলমানরা প্রথমদিকে বর্ণবাদী আক্রমণের শিকার হলেও এখন মুসলমানরা সুখী। শহরের যে এলাকায় মুসলমানরা থাকে সব দেশের মুসলমানরা দলবেঁধে থাকে। বিশেষ করে পাকিস্তানি, গুজরাটি, বাঙালীদের একসাথে বসবাস। ব্রিটেনে ধর্ম পালনে বাধা নেই, মাথার উপর বোমারু বিমানের শব্দ নেই, ক্ষিধের কষ্ট নেই, সুনিশ্চিত জীবন। এই জীবনে মসজিদ, মাদরাসা সবই আছে। বেশিরভাগ শহরেই তাবলীগের কল্যাণে সপ্তাহে একদিন তালিম হয়। আমাদের ছোট্ট শহরে মহিলাদের তালিম হয় উর্দু বাংলা ইংরেজী তিন ভাষাতেই। এছাড়াও সপ্তাহে একদিন বয়স্ক মহিলা পুরুষদের জন্য আলাদাভাবে কুরআন শিক্ষার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। আমাদের বাঙালি মসজিদে সপ্তাহে একদিন আমি নিজেও এলাকার মা-বোনদের কুরআন শেখাই। মসজিদে বিভিন্ন ইসলামী প্রোগামও হয়। মহিলাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা থাকে। করোনার আগে পুরুষ ও মহিলাদের আলাদাভাবে লাশের গোসল ও কাফন পরানোর প্রশিক্ষণ দেয়া হলো এক মসজিদে। কখনো কখনো দ্বীনি প্রতিযোগিতা হয়। এ বছর রমজানে আমাদের শহরে অনলাইনে ইসলামী প্রশ্নোত্তর প্রতিযোগিতা, কুরআন তিলাওয়াত প্রতিযোগিতাসহ নানা ধরনের প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। অবশ্য সমাজে দ্বীন প্রচার ও প্রসারের এইসব আয়োজনে ও কাজে বাঙালী কমিউনিটির অবদান একেবারেই কম। দ্বীন প্রচারের মেহনতে গুজরাটিরা সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছে। আল্লাহ তাআলা তাদের ব্যবসা বাণিজ্যেও অনেক বরকত দিয়েছেন। দ্বীন মানার ক্ষেত্রেও তারা এগিয়ে আছে। আমরা তাদের অনুসরণ করার চেষ্টা করছি। বাঙালী অনেক নারী অদ্ভুত কারণে ভালো করে কুরআন পর্যন্ত পড়তে জানেন না। এখন তারা বহু আগে যে ভুল সুরে ভুল পদ্ধতির পড়া শিখেছিলেন শেষ বয়সে তা শোধরানোর জন্য প্রাণপন চেষ্টা করছেন।
এই চেষ্টায় আশার আলোর ঝিলিক লাগে আমাদের চোখেমুখে; আমরা তাই শুধু শুদ্ধ করে কুরআন পাঠই নয়, দ্বীনি মাসআলা, আকিদা, সিরাহ, তাফসীর ইত্যাদি শেখার জন্যও নারীদের জড়ো করি। আমরা চাই নারীরা শিখবেন। তারপর শেখাবেন তার ঘরের প্রতিটা সদস্যকে। দ্বীনের প্রতি উদ্বুদ্ধ করবেন বয়স্কদের। জান্নাতের স্বপ্ন দেখাবেন বাচ্চাদের।
স্বপ্ন নয়, প্রেম নয়, বোধ নিয়ে বেঁচে আছে মানুষ। এই বোধ সাংসারিক, সামাজিক। সাংসারিক সুখ-দুঃখের চাদরে জড়ানো সামাজিক অবক্ষয় ও উন্নয়ন; এই যেন জীবন। বেশিরভাগ মানুষের রাজনৈতিক বোধ নেই-ই বলা চলে। পৃথিবীর কোথায় কী হচ্ছে তা আমরা শুনি, আমরা দুঃখিত হই, আমাদের মন কাঁদে, কিন্তু আমরা ঘটনা তলিয়ে দেখি না, ঘটনার গুরুত্ব বুঝার চেষ্টা করি না।
আলেম উলামাদের মধ্যে যারা বুঝতে পারেন, যারা উম্মাহ নিয়ে ফিকির করেন, তারা জানেন এই সুখ-দুঃখ, প্রাচুর্যের জীবন ক্ষণস্থায়ী; আকাশের রংধনুর মতো রঙের খেলা মাত্র। তারা ভয় পান। ভয় পান বলে কিছু দরদী মানুষ ব্রিটেনের মুসলমানদের জীবন আপাদমস্তক দ্বীনি হোক এই চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
তাদের মেহনত দেখে আমরা আশা করি ব্রিটেন একদিন পুরোপুরি মুসলমানের হবে। প্রতিটি ঘর শিশুদের কুরআনি সুরে মুখরিত হবে। ব্রিটেনের অলিগলিতে শোনা যাবে কবির সেই পুরনো কবিতা-
মুসলিম হে হাম ওয়াতান হে সারা জাঁহা হামারা
তাওহীদ কি আমানত সীঁনো মে হে হামারে
আঁসা নেহি মিটানা নাম ও নিশা হামারা।