আহমাদ রফিক
দূরে সমুদ্র ডাকছে। নীলজল–ঘ্রাণ বাতাসের ডানায় করে চলে আসছে জানালায়, আমি ঘুমে–জেগে আছি। সে এক স্বপ্নের মত সমুদ্র দেখার শখ ছিল। শখ ছিল সমুদ্রের বুকে ঝাঁপ দিতে দস্যি ছেলের মতো। শখ ছিল একটি রাত, সমুদ্রের কালো জল, গর্জন, চাঁদের গা ধুয়ে নেমে আসা জোছনার গান। ওসব শখ করতে করতে একদিন শুনি, সমুদ্র দূর, বহুদূর। সেখানে যেতে লাগে ‘বড় হওয়া‘ , লাগে কাড়ি কাড়ি টাকা। আমার তো ওসব ছিল না তেমন, আমার শৈশবের মানিব্যাগভর্তি ছিল বাহানা, ইচ্ছা আর ঘুম–কেড়ে–নেওয়া নানান স্বপ্ন। সমুদ্র দূর–বহুদূর শুনে আমি আমার স্বপ্নের দিকে করুণ চোখে তাকাই। ভাবি একদিন বড় হবো খুব। আমার মানিব্যাগভর্তি টাকা থাকবে কাড়ি কাড়ি। আমি সমুদ্রে যাব সেদিন। কতদূর সমুদ্র? আমার বয়সের কাছে প্রায়শই এ প্রশ্ন ছোড়ে অপেক্ষারা।
ওসবের উত্তর আমার জানা থাকত না বলে, ভেতরে হাহাকারের সমুদ্র ছলকে উঠত। আর মানিব্যাগভর্তি স্বপ্নগুলো পুনরায় ঝনঝন করে উঠতো শ্লোগানের মতো। দিনশেষে বয়স আর কাড়ি কাড়ি টাকার কাছে হেরে যেত সদ্য শৈশব ছেড়ে ওঠা স্বপ্নেরা। তখন সমুদ্র আমার বরিশাল জেলা থেকে পটুয়াখালি–কুয়াকাটার দূরত্বে। ভীষণ গর্জাচ্ছে। যাওয়া হয়নি। কুয়াকাটায় নাকি সূর্যাস্ত আর সূর্যোদয়ের সময় সমুদ্র লাল হয়ে যায়, লাল কাঁকড়া হাঁটে, তীর থেকে অশ্বের মতো ঢেউ তেড়ে আসলে দারুণ গর্জন হয়। আর নেমে যেতে যেতে যেন এক মহা হন্তারক সেই ঢেউ,তটের তাবৎ মাটি হেঁচড়ে নিয়ে যায়। ওসব তখন শুনছি মাত্র। দেখার দারুণ শখ ভেতরে বেতফলের মতো পেকে উঠছে। যাওয়া হয়নি। তারপর সেই স্বপ্নের ভিতর বাস করতে করতে একদিন আমার মানিব্যাগভর্তি ‘বড় হওয়া‘ জমল, জমল কিছু পয়সাকড়িও। কাড়ি কাড়ি অবশ্য না। ওটা নিছক স্বপ্নই রয়ে গেল আজ অব্দি।
ভেতরে সমুদ্র দেখার শখেরা ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ছে। বাইরে পার্থিবতার এক ছোটখাটো হিসেব চুকিয়ে উঠে পড়েছি বাসে। বাস ছুটছে এক শৈশবী স্বপ্নের দিকে দুডানা প্রসারিত ঈগলের মতো। বাসের ভেতরে অসংখ্য চোখের ভেতরে পাঁচ জোড়া চোখ তখন নানান স্বপ্নের ঘোরে বিভোর। হয়তো জুবায়ের ভাই ভাবছেন, সদ্য বিবাহিতা একজন বধূয়ার কথা, এই ভ্রমণে, সমুদ্রের দিকে এই বেশামাল উড্ডীনে। হয়তো ফয়জুল্লাহ ভাই ও ভাবছেন তা–ই। সুহাইল ভাই ভাবছেন, কী বললে টুপ করে রসে ডুবে যাবে আরেকটি প্রহর, হল্লা পড়ে যাবে পুরা বাসের ভেতর। মাকসুদ ভাই কৌতূহলী মানুষ। হয়তো সমুদ্র দেখা তারও এই প্রথম। আরেক জোড়া চোখ তখন দূরে, চলে যাচ্ছে বয়স পেরিয়ে, কারিকারি টাকার অভাবকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, নীল জলে,তুমুল গর্জনে। সেই চোখে তুমুল বিভ্রম, এই বুঝি দিগন্ত, নীল জলরাশি, উথাল–পাথাল। গভীর রাতের বনে ফররুখের কবিতার মতই যেন ভেঙে যাচ্ছে এক একটি অনন্ত প্রহর, কী বিচিত্র জৌলুসে জাগে নিথর রাত্রিতল…. বিখণ্ড হচ্ছে জমাট পাথর। দ্রুততম গতিতে কেটে যাচ্ছে পথের পথ, মায়ার শহর, পল্লী– গ্রাম। আর ওসব দেখতে দেখতে বাসের অন্ধকারে মুদে আসছে চোখ। জানলার শার্শিতে দূর থেকে উঁকি দিচ্ছে চাঁদ। মিহি জোছনায় ছেয়ে গেছে সমস্ত সংসার।
ভোরের দিকে শুনি, গাড়ির এক চাকা বিকল হয়ে পড়েছে। এটা টেকনাফের কাছাকাছি প্রায়। ফজরের আজান পড়েনি তখনও। দূর থেকে অন্ধকারের ভিতরে বাতাসের সাথে কোনো কোনো জায়গার আজান মিলিয়ে যাচ্ছে। সুস্পষ্ট আসছে না আমাদের কান পর্যন্ত। আমরা রাস্তায় নেমে গেছি। ফাঁকা রাস্তায় হিম বাতাস। রাস্তার ওপারে বরাবর এক মসজিদের আলো অন্ধকারে উচ্চকিত হয়ে আছে। দু–চার জন মুসল্লি ধীরে হেঁটে আসছেন। মিনিট পাঁচের মাথায় মসজিদের মাইকে টোকা পড়লো, জমাট নিস্তব্ধতার ভেতর নক্সীকাঁথার সুঁইয়ের মত এফোঁড় ওফোঁড় করে আজানের সেই সুর বুনে গেলো এক অপার্থিব নক্সা। আঞ্চলিক ভাষায় গজলও হলো মাইকে, সেই অন্ধকার ভোরে। আমরা সেই ভাষাকে বুঝতে চেয়ে তৎক্ষণাৎ মেতে উঠি কলহাস্যে, ভাষা বোঝা হয়নি যদিও। হয়েছে এক স্মৃতি, পাঁজ জোড়া চোখের পরে দপদপ করে জ্বলতে থাকা এক ভোরের কলহাস্যপ্রবণ স্মৃতি। এদিকে নামাজ শেষে সবাই অন্তর্গত ক্ষুধার প্রতি সহমর্মী হয়ে পড়লো, এটা আসলে মানুষ হিসেবে আমাদের এক নৈমিত্তিক কৌতুহলের ব্যপারও। কৌতূহল এ নিয়ে যে, দেখি এই অঞ্চলের মানুষ কী দিয়ে প্রাতরাশ সারে? কিন্তু এই কৌতূহলের শেষ দেখতে যেয়ে গিলতে হয়েছে বাসি রুটি আর গরম ডালের ঝোল। অবশ্য খারাপ না। দোকান তখন ঐ একটাই ছিল রাস্তার ধারে। কিন্তু বাটারবনে ঝোলের ব্যবহার কি আর কেউ করেছে এর আগে?
গাড়ি ছুটছে আবার, যেন উড্ডীনের ডানা মেলে। ওদিকে সকাল উঠে গেছে আকাশে। সূর্যের মৃদু তাপে হেসে উঠছে টেকনাফের মাটি। সকাল সাড়ে সাতটা বা আটটার দিকে, দেখা গেল রোহিঙ্গা শিবিরগুলো। রাস্তা থেকে ডান পাশে যতদূর চোখ যায় ধূ ধূ খলফার ছাউনী। কোথাও জিড়োতে পারে না চোখ, ফাঁক নেই। শহুরে আলহামদু আমোদ ছাড়া এভাবে বাঁশের বেড়ার ভেতর কেটে যাচ্ছে কত শত জীবন। এক ঘরের কোল ঘেঁষেই আরেক ঘর দাঁড়িয়েছে। কোনো মাচার উপর সবুজ তরুলতা বেয়ে উঠেছে, শাক–শবজির ঘরোয়া চাষবাস হচ্ছে বোধহয়। কয়েক বাড়ি পরপর একেকটা টিউব অয়েল। পাহাড়ি খাঁজগুলো ধরে ধরে দোকানের মালপত্রের মতো থরে থরে সাজানো আছে কিছু ঘর। এখানে প্রকৃতির রূপ বিভৎস। যেখানে মানবতা হু হু করে হাহাকার করে ,সেখানে আসলে কোনো প্রকৃতি থাকে না। এই মাটি,রোদ,পাহাড়,সাজানো ঘর বাড়ি প্রত্যেকটি যেন প্রকৃতির বিভৎস রূপ একেকটা। এখানে চোখ পড়ার পর মন চলে গেলো সুদূর সিরিয়ার দিকে। সিরিয়ার মুসলমানদের জীবন এর চেয়েও কষ্ট–দৈন্যের ভিতর কাটছে।বাংলাদেশের আশ্রিত রোহিঙ্গা আর সিরিয়ান শরণার্থীদের প্রতি মায়া,মমত্বের এক চুলও ভেদাভেদ নেই। বিদায় হজে রসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘কোনো আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই আজমের, উপর কোনো শেতাঙ্গের নেই কৃষ্ণাঙ্গের উপর।‘
মনের ব্যাথারা ও বোধ হয় কোনো ভেদাভেদ জানে না। তবু যারা ভেদাভেদ তৈরি করতে চায়, তাদের প্রতি করুণা রইলো। ঐ রোহিঙ্গা শিশুটির করুণ চোখের করুণা, যে আমাদের বাসের ডান পাশ ধরে স্কুলে যাচ্ছিলো সকাল বেলার আলোয়, আমাদের দিকে তাকাতে তাকাতে। এবড়ো থেবড়ো রাস্তা হওয়ায় বাস চলছে শ্লথ গতিতে, দুলে দুলে। রাস্তার ডান পাশে ফুটপাতের মত কাঁচা বাজার বসেছে। মানুষ হাঁটছে,আমরা দেখছি, জায়গার নাম হ্নীলা, টেকনাফ। এই বাজারে নাম পড়তে যেয়ে আমরা একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।
সকাল ন‘টা নাগাদ টেকনাফ নদী বন্দরে গিয়ে বাস থামল। এখান থেকে সাড়ে ন‘টা বা দশটার দিকে সেন্টমার্টিনের দিকে একমাত্র শিপটি সাঁতার দেবে। শিপ তো আর না, তথৈবচ অবস্থার একটা লঞ্চ, কেয়ারি… । কিন্তু এই নদীর নাম নাফ–একথা শুনে করোটির ভেতর যেন এক স্মৃতির নদী চলকে উঠেছে। এই তো কদিন আগে, কত কত বার নাফের নাম আমাদের ভেতরে বিভৎস কিছু চিত্র জাগিয়ে দিতো! শিশু–কিশোর, যুব–বৃদ্ধ কত রাখাইনকে এ নদী সাঁতরে পার হতে হয়েছে! ওসব ছবি তো এখন ও মলিন হয়ে যায়নি। সেই ছবিই বারবার স্মৃতির পর্দায় দুলে উঠছে, সেখানে শান্ত এই নাফের মতই মৃদু ঢেউ, কালো কষ্টের। অথচ নদীটি এতো শান্ত,দেখলে বোঝাই যায় না, কত ব্যাথা বেদনার ইতিহাস সে। পশ্চিমে বাংলাদেশ আর পূর্ব দিকে আরাকান রেখে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে এর মোহনা। সেখানে গিয়েই একপাশে শাহ পরীর দ্বীপ, অন্যপাশে সেন্টমার্টিন। শিপ বা তথৈবচ ঐ লঞ্চ নাফের পানি কেটে কেটে চলার সময়, সুপারভাইজার এসবই বলে দেয়। দুকূলে সবুজ পাহাড়ের ছবি ভেসে ওঠে। আরো সুদূরে মায়ানমারের সারিসারি পাহাড় দেখা যায়। কাঁটাতার এতো কাছ থেকে যায় যে, ওখান থেকে ট্রিগার টিপলে সেই গুলি শিপের যাত্রির গায়ে লাগতে পারে। কাছাকাছির এই বর্ণনাটি ফয়জুল্লাহ ভাই–এর। ফয়জ ভাই ভূগোলবিদ। ওনার বর্ণনা নিশ্চয় ভুল না।
কিন্তু কথা হলো, প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা লঞ্চে এক ঘেয়ে বসে থাকা তো সম্ভব না, তো কী করবো,কী করবো—এমন ভাবনা মাথায় উঁকিঝুঁকি দিতেই মনে হলো কবি জসীমউদ্দিনের ‘আত্নকথা‘। লঞ্চের তৃতীয় তলাটা অর্ধেক ছাদ। গোড়ায় কিছুটা মাজামোছা একটা সিঁড়ি। সকাল বেলার মিহি রোদ আকাশে। সিঁড়ির খাঁজগুলোতে শুয়ে পড়ছে এসে,যেন বইপত্রের ভাঁজে গোজা পুরানো ফুল। সিঁড়ির দেয়ালে পীঠ ঠেকিয়ে জসিমুদ্দিনের আত্নকথা খুলে বসতেই সময় উন্মাতাল হয়ে গেছে। দ্রুততর কেটে যাচ্ছে জসিমুদ্দিনের আত্নকথা, ডানে বায়ের সবুজ পাহাড়ি সারি,নাফের সবুজ পানি আর অসংখ্য গাঙচিল। ইতিমধ্যে আমরা সাগরে ঢুকে পড়েছি। কূলকিনারাহীন, কখনো পাহাড়ের মত উঁচু দূরের পানিগুলো। কখনো সাদা পানি–কালো পানির স্পষ্ট বিভাজনে বিস্ময়ের রেখা, কখনো পানি সবুজাভ,কখনো নীল,কালো—সে এক অলৌকিক মায়াজাল খণ্ডকালজুড়ে। স্মৃতিজুড়ে মূর্ছিত হবে আজীবন।
সাড়ে তিন ঘন্টার জায়গায় আড়াইঘণ্টার মাথায় শিপের অদূরে ভেসে উঠেছে সেন্টমার্টিন। আকাশটা চকচকে নীল। এমন আকাশকে সুচিত্রা ভট্টাচার্য বলেছিলো, এই মাত্র কেউ সাবান ঘষেছে,এখনো সাদা সাদা কিছু ফেনা লেগে আছে। আকাশের সেই নীলের দিকে উদ্যত কিশোরের মত মাথা উঁচু করে আছে নারিকেল গাছের সাড়ি। গাঙচিলের মত সমুদ্রের বুক জুড়ে ডানামেলা বাতাস। নারিকেল গাছের ঝিরিঝিরি পাতা দূর থেকে দেখা যাচ্ছে,মৃদু কাঁপছে। আর তটে ঠোট লাগিয়ে কিছু সাম্পান ঘুমুচ্ছে। ছোট ছোট স্পিডবোট কাগজের নৌকার মত দুলছে পানিতে। একমাত্র স্থির হয়ে আছে, মাছ ধরার বড় নৌকাগুলো। ওগুলো দোলানোর মত এত বড় ঢেউ বোধহয় সমুদ্রে এখন নেই। সমুদ্র বেশ শান্ত। নৌকার পাটাতনে পানির ধাক্কা লেগে সরাৎ সারাৎ শব্দ হয়। কে জানে এগুলো সাগরের কীসের ভাষা,দুঃখের না সুখের। দেখতে দেখতে এক স্বপ্নঘোরের মত কেটে গেলে লঞ্চের সময়টুকু। এবার সেন্টমার্টিনের বুকে আমাদের সবুজ বয়সের পা। স্থানীয়রা এটিকে নারিকেল জিঞ্জিরা হিসেবেও চেনে। জিঞ্জিরা মানে কী? জাজিরার বিকৃত রূপ? হতেও তো পারে। আর মার্টিন অবশ্যই বঙ্গদেশীয় নাম না! জানা যায়, তৎকালিন টেকনাফ জেলার জেলাপ্রশাসক ছিলেন একজন খ্রীস্টান,তার নামই ছিলো মার্টিন। এবং সেই নামানুসারেই এই নাম রাখা
। আরো দেড়শো বছর আগে যেহেতু এটি আবাদ হয়, তাই এর মাঝে আরো ইতিহাস ঘাপ্টি মেরে আছে এই বিশ্বাস করা যায়। আপাতত আমরা একটি থাকার আশ্রয় খুঁজে বের করবো। এর মধ্যে বেশ ক‘জায়গায় হামিদ ভাই এর নাম কয়েকয়ে চলেছি। হামিদ ভাই আমাদের সাথে বাসে পরিচয় হওয়া এক সুহৃদের ভাগিনা, শিপে কাজ করেন। না দেখা–না চেনা এই হামিদ ভাইএর নাম করেকরে কত জায়গায় যে আমরা সুবিধা ভোগ করেছি, আল্লাহ মাফ করেন। সেই রকম একটা ব্যপার হলো আশ্রয় ঠিক করতে যেয়েও। মুন্নূ ভাই নামে এক লোক কত বুঝিয়ে সুঝিয়ে চেষ্টা করলো একটা রুম দিতে। আমরা সুবিধার কথা মাথায় রেখে বল্লাম, হামিদ ভাই আমাদের জন্য একটা ভালো রিসোর্টের কথা বলেছেন দক্ষিণপাড়ায়। এই বলে বলে কেটে গিয়ে আরেক রিসোর্টে গিয়ে বলি, আমরা তো হামিদ ভাইএর গেস্ট, রুম ভাড়া কত নেবেন?
একসময় হামিদ ভাইএর পরিচয় অপরিচিত হয়ে উঠলে, নিজেদের পরিচয় ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বড় করে যার সাথে কথা বলছি তার সাথে আমাদের সম্বন্ধ জড়িয়ে দিচ্ছি। হলো কি, ১৯৯৭ এ দাওড়া ফারেগ হওয়া এক প্রৌঢ় মাওলানার রিসোর্টে গিয়ে উঠলাম। তারপর তাকে যাচ্ছেতাই ভাবে আমাদের হুজুর,ওস্তাদ, বস বানিয়ে রুম ভাড়াকে সহনীয় করে আনার চেষ্টা করি। এমনিতেই দরাদরি এখন সহনীয় পর্যায়েই আছে। এই সময়কে স্থানীয়রা শুদ্ধউচ্চারণ সমেত বলে ‘অফসিজন‘। সকাল সকাল পাঁচটা কচি ডাব খেয়ে নামাজে বের হই। নামাজের পর মধ্যাহ্নভোজের জন্য কড়া করে পাঁচটা ইলিশ ভাজতে বলে, সমুদ্রের গর্জনের দিকে কান পেতে আছি সবাই, ক্ষুদার সমুদ্রে পৃথিবী গর্জনময়।
ঐদিন বিকালের দিকে সমুদ্রে যাই। সূর্যের আলো নরম হয়ে আসছে। সমুদ্রে এখন ভাটা। এই সুযোগে তটের উপর জেগে উঠেছে পানির নীচের প্রবালগুলো। জানা যায় এগুলো জীবিত, দিনদিন বেড়ে উঠছে সাগরের কোলেপিঠে। এদের গায়েই সুদূর থেকে ভেসে এসে আছড়ে পড়ে সমুদ্রের ঢেউয়েরা। কাছাকাছি দূরত্বে অজানা আশঙ্কের মত দুলছে সাম্পানগুলো। আমরা ঈষৎ ভয়ে,ঈষৎ উন্মাদনায় সমুদ্রে পা ফেলি। সুদূর থেকে গর্জন করে তেড়ে আসে নোনা পানির ‘অশ্বদল‘। হাঁটতে হাঁটতে বেশ দূরেই বোধহয় চলে গিয়েছিলাম আমরা।
এখন বুক কাঁপছে, কখন কোন ঢেউ নিজের সাথে করে নিয়ে যায় দিকদিগন্তহীন সমুদ্রের মাঝখানে! তারপর ছেড়ে দেয়!! এই ভয়ে শক্ত করে ধরি সাম্পানের কাঁধ। তবু সাম্পান দোলে। বুকের ধুকপুক বেড়ে যায়। ত্বড়িত তীরে ফিরতে চেয়ে আবার সমুদ্রে ঢেউয়ে পা ফেলি। অদিকে সূর্যাস্ত জুড়ে নেমে আসে দিনের নোঙর। সূর্য ছোট হতে হতে যেন কোনো কমলা রঙের ম্যাজিক বল, ডুবে যাচ্ছে। সেই বল নিয়ে খেলছে আমাদের পাঁচ জোড়া চোখ,পাঁচ জোড়া হাত। ঢেউ বাড়ছে। মুছে যাচ্ছে তীর থেকে মানুষের পদচ্ছাপ। প্রবালগুলোও ধীরে ধীরে সাগরের অন্তর্গত হচ্ছে। সূর্যের দিকে মুখ করে আমরা নামাজে দাঁড়াই। ভেজা বালু, কপালে রাজতিলক হয়ে লেপ্টে যায়। রাতে এখানে এসে চাঁদের আলোতে বসে সমুদ্র দেখতে কেমন লাগবে? আমাদের কেমন লেগেছিলো? বলতে পারবো না। এখানে ভাষার ভাষা নেই।
পরদিন সকাল সকাল সূর্যোদয় দেখতে সাগরের কাছে চলে আসি, আমি ও মাকসুদ ভাই। বাকিরা ঘুমঘুম চোখে দু রাকাত ফজর পড়েই আবার চিত। বিছানা যে মানুষকে কত কিছু থেকে বঞ্চিত করে! সকালে সূর্যোদয় দেখতে গিয়ে এই অনুভূতি হচ্ছিলো। সাগরের পানি এখন তীরের অনেক উপরে উঠে এসেছে। গতকাল যেখানে দাপিয়ে বেড়িয়েছি,সেখানে এখন থৈ থৈ পানি। কয়েকটা সাম্পান ডাঙায় বাঁধা ছিলো ,এখন সেগুলোও ঢেউয়ের তালে তালে দুলছে। কালো প্রবালের আদিগন্ত জুড়ে সূর্যের রঙ ফেটে পড়েছে। বাতাসে ঝিরিঝিরি কাঁপছে নারিকেল গাছের পাতাগুলো। আমরা সমুদ্রের তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে বাজারে এসে উঠি।
এটা উত্তর সেন্টমার্টিন। বাজারে সামুদ্রিক মাছ ওঠে সকালে। তরি তরকারি প্রায় সবই পাওয়া যায়। দাম একটু চড়াই মনে হলো। তবে সামুদ্রিক মাছ বেশ সস্তায়ই পাওয়া যায় বোধ হয়। পূর্ব সেন্টমার্টিনের দিকে মাছের আড়ৎ আছে। সাতটা –আটটার দিকে ঐদিকে সামুদ্রিক জাহাজগুলো এসে মাছ দিয়ে যায়। আমরা যেহেতু এমনিই ঘুরছিলাম এজন্য মিনিট দশেকের মত হেঁটে ঐদিকটাও দেখে আসলাম। মাছ কেনার মত টাকা তখন দু‘জনের কেউই সঙ্গে আনিনি, তাই কিনিনি। তাছাড়া মাছের পাকশাকের ভাবনাটাও একটু প্যাচালো মনে হয়েছে। এখানে সকাল বেলার বাজারে শহুরে তেল চিটচিটে পরোটা আর মামলেট থাকলেও নিম্নবিত্তদের নাশতার জন্য আছে সেকারিনের শিরায় ভেজানো নুডুলস সিদ্ধ। দশ টাকায় প্রায় একজনের প্রাতরাশ চুকে যায় এই খাদ্যে। স্থানীয়দের ভাষায় এর কী নাম জানি না। তবে সকাল এগারোটা পর্যন্ত ঢের চলে এই খাদ্যের বিকি।
এর মধ্যে দেখা হয় আমাদের রিসোর্টের মালিক চাচার সাথে। বাজারে ওনার দুইটা আছে। একটা মুরগির ফার্ম,দ্বিতীয়টা মোদি মালের। চাচা এই দ্বীপের মধ্যে বেশ সচ্ছল মানুষ। দুই দোকান আর স্থানীয় হওয়ার সুবাদে নিজস্ব জমির উপর একটা রিসোর্ট,আশেপাশে আরো কিছু জমিজিরাত আছে হয়ত। এই সম্পত্তির জেরেই চাচাকে সচ্ছল বলছি। কেননা সেন্টমার্টিনের স্থানীয়রা এতোটাই অসচ্ছল যে সিজনে কারি কারি টাকা কামালেও এদের ঘর বাড়ি অনেকটাই চালচুলোহীন। এই হিসেবটা আমার কোনোভাবেই মেলে না, সিজনে রিসোর্টগুলার একেকটা রুম ভাড়া হয়, দিনে প্রায় পাঁচ থেকে বারো তেরো হাজার টাকা করে। ভাবা যায়? তবু ভাবতে হয় এবং এটি বাস্তবও। যাদের ডাব–নারিকেলের ব্যবসা তারাও সিজনে এই ডাব বিক্রি করে কয়েকগুণ বেশী দামে। তবু এদের দুঃখ দৈন্য কাটছে না। গায়ে গতরে ভালো জামা চোখো পড়ে নি কারুরই। অধিকন্তু সবারই চোখেই দারিদ্রের অনুযোগ।
এক ব্যবসায়ীকে জিজ্ঞাসা করেই বসেছিলাম, এতো এতো টাকা আপনারা কামাচ্ছেন, তবু আপনাদের দারিদ্রতা কাটছে না কেন? সে বল্লো, কই আর টাকা? সিজনে কামাচ্ছি, সারা বছর ও দিয়েই যাচ্ছে। ব্যবসাপাতি করছি, জমাচ্ছি, ঘরদোর উন্নত করছি। আমি বলি, কাউকে চাঁদা দিতে হয় নাকি আবার? সে খুব জোরেশোরেই নাকচ করে। বলে, ”কার বেটার সাহস,আমাদেরর থেকে চাঁদা নেবে? প্রসাশনও আমাদেরকে যথেষ্ট সাহায্য করে। এই দ্বীপে কোনো উপজাতি নেই, হিন্দু নেই, সব ঝেটিয়ে বিদায় করেছে। এখানে শুধু বাঙালি মুসলমানরাই আছে।
তবে সমস্যা হলো, এখানে কেউ কারো উন্নতি দেখতে পারে না। একজনের পিছনে একজন না একজন লেগেই থাকে,শত্রুতাবশত। এইজন্য অনেকেই উন্নতি করতে পারে না ”। এই একই কথা ছেঁড়াদ্বীপের সাদ্দাম ভাই ও বলেছেন। বলেছেন, মাস দুয়েক আগেও তার পয়ত্রিশ হাজার টাকা দামের একটা তাবু কারা যেন হিংসাবশত আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে। সিজনে লাখ লাখ টাকা কামাই করলেও সেন্টামার্টিনের মানুষের জরাগ্রস্ত জীবন দেখলে এসব অভিজ্ঞতা অবাস্তব মনে হয় না। শিক্ষা দীক্ষাও তাই দ্বীপে খুব উন্নত করতে পারছে না মনে হয়। যদিও স্থানীয়রা তাদের প্রায়মারি–মাধ্যমিক–উচ্চমাধ্যমিক স্কুল কলেজ নিয়ে বেশ সন্তুষ্ট।
বিস্ময়ের কথা হলো, গুটি কয়কজনের দারিদ্র ছাড়া দ্বীপের আর কোনো অবস্থা নিয়েই কারো অভিযোগ নেই। এটা বিস্ময়েরই ব্যপার। উপরন্তু এদের সবার চোখের ভাষাই যখন তৃপ্তি। পূর্ব সেন্টমার্টিনে দুটি মাদরাসাও নজরে আসলো। একটায় মক্তব। একটায় হেফজ ও কিতাব খানা। শিক্ষকদের কথাশুনে বোঝা গেলো তারা বেশ সাচ্ছন্দেই আছেন, মাদরাসা শিক্ষা প্রয়োগেও কারো কোনো বাঁধা নেই,বরং আগ্রহই বেশী। অর্থের প্রশ্ন তুল্লে দেখা গেলো, এই সাচ্ছন্দ নিতান্তই আল্লাহমুখী। কারণ তিনশো চারশো ছেলেমেয়ে এখানে আবাসিক – অনাবাসিক থাকলেও বেতন ভাতা দেওয়ার সক্ষমতা সবার তেমন নাই। বেশ বড়সড় জায়গা নিয়েই এই মাদরাসা। নীচে বালু, উপরে খলফা বা বাঁশের ছাউনী। প্রচণ্ড গরমে পৃথিবীর তাবৎ আয়েশের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে আলিফ–বা–তা–র শান্তির বাণী। কালিমায়ে তায়্যিবাহ বা উত্তরম কালিমা।
ভাষাগতভাবে দ্বীপের মানুষরা চট্রগ্রামের চেয়ে একটু ভিন্ন মনে হলো। ঘনঘন পর্যট আসা যাওয়া করতে থাকায় এদের অনেকেই ভাঙাভাঙা শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে পারে। আবার আঞ্চলিক টানের সাথো গুলিয়েও ফেলে। এভাবে এক স্বতন্ত্র আঞ্চলিক ভাষার মত শোনা যায় তাদের ভাষাকে। তবে ভাষাগত কারণে দ্বীপে খুব বেগ হতে হয় না, ঐ পর্যটকদের আসা যাওয়ার কারণেই। তবে কালচারগতভাবে আর ওভাবে শহুরে হতে পারে নি তারা। তা সম্ভবত দারিদ্রের জন্যই। অথবা শহর থেকে বেশ দূরে হওয়ার কারণেও হতে পারে।
এদের কাছে টেকনাফই ঢাকার মত। সে অর্থে টেকনাফকেও তো অতোটা উন্নত মনে হলো না। তবে এদের ব্যবহার,আচরণ, সততা ও আতিথেয়তা বর্ণনাতীত সুন্দর। গ্রামের সরল জীবন এখনো এদের রক্তে মাংশে। অন্যের জন্য সব করতে পারার সেই যে নববী শিক্ষা, তা এদের মধ্যে অবচেতনে ঢুকে আছে। যে কোনো বাড়িতেই সাদরে গ্রহণ করবে মেহমান, এবং সর্বোচ্চ ব্যয় করবে তাদের যত্ন আত্তির জন্য। এখানে এলে শহুরে আনোখা জীবনকে মনে হয়, বন্দিশালা। আমরা গুটি কয়েকজন কয়দিরা ওখানে হাঁসফাঁস করেই কাটাচ্ছি জীবন,অথচ শহুরে শহুরে এক মিথ্যা দম্ভের আড়ালে লুকিয়ে আছে প্রকৃত সমু্দ্রে জীবন। যে সমুদ্র মানুষ, সততা আর শান্তির সমুদ্র।
দুপুর বারোটার দিকে মোটর সাইকেলে করে আমি আর জুবায়ের ভাই গেলাম ছেঁড়াদ্বীপে। ছেঁড়াদ্বীপের সৌকর্য দূর থেকে তেমন একটা আঁচ করা যায় না। তবু এর ভাসমান অবয়বটি এতোটাই মোহিত করলো আমাদের যে পূর্বের দেখা দ্বীপের সকল সৌন্দর্যকে আমরা অস্বীকার করে বসি। এখন ভাটা থাকায়, সমুদ্রের উপর দিয়েই হেঁটে চলে যাচ্ছি। বিকালের দিকে সব ডুবে তলিয়ে যাবে। তখন পনেরো–বিশ মিনিটের দূরত্ব পরিমাণ ছোট আয়তনের এই ছেঁড়া দ্বীপ ছাড়া চতুর্দিকে শুধু পানি থাকবে। সমুদ্রের গর্জন থাকবে। ভয়ে দূর দূরান্ত পর্যন্ত শুধু ধ্বনিত হবে, রাত পোহাবার আর কত দেরী পাঞ্জেরী!
দ্বীপের অলৌকিক সৌন্দর্য হলো কেয়া গাছ। কাঁটাওয়াল, বিশাল উঁচুউঁচু। আর শক্তিশালী। ছেঁড়া দ্বীপের একমাত্র অধিবাসী এখানকার স্থানীয় সাদ্দাম ভাই। মা আর ছোট ভাই–বোন নিয়েই পৈতৃক ভিটার উপর চালচুলোহীন একখানা ঘর তুলেছেন। আয় রোজগার সিজনের সময়ই কিছুটা হয়। এরপর এভাবেই দিন কেটে যায়। ছোট ভাই রিয়াজ, সদ্য কৈশোরে আলোড়িত। স্কুলে যায়। মাঝেমাঝে সমুদ্রে বর্শী ফেলে মাছ ধরে আনে। রিয়াজের সাথে কী এক টানে আমরা ও গিয়েছিলাম মাছ ধরতে। ছোট ছোট শামুক ভেঙে বর্শীতে গেঁথে পাথরের ফাঁকে ফাঁকে ধরলেই টুপ করে মাছ চলে আসে। এত দ্রুত এরা শামুকের গন্ধ টের পায় যে বিস্ময়ের ব্যপার! আর মাছের কী রঙ,সুবহানাল্লাহ! এ্যাকুরিয়ামের মাছের মতই সুন্দর, উহুম আরো সুন্দর যেন এরা। লালের উপর কালো–হলুদ ডোরা কাটা এক ধরনের মাছই আমাদের দুই বর্শীতে বেশী পড়েছে। এই মাছের নাম স্থানীয়দের ভাষায় বুর মাছ। সুন্দরী মাছ নামেও এক ধরনের মাছ আমরা পেয়েছি। আর ধরা পড়েছে রূপ চাঁদা। এর বাইরে কালো সাদা ডোরা কাটা এক প্রজাতির মাছ পড়েছিলো বর্শীতে, রিয়াজ বলেছে এগুলো খাওয়া যায় না। কেউ খায়ও না। মাছের টোপ হিসেবে আনা ছোট ছোট শামুকগুলো সুযোগ পেলেই টুকরী থেকে বেরিয়ে এসে হাঁটা ধরে। এটা ভারি যন্ত্রণার বিষয় হয়ে দাড়িয়েছিলো। নীলজল সমুদ্রে মাছ ধরে আমাদের শহুরে জীবনের প্রতি কেবলই বাড়ছিল বিরক্তি আর বিতৃষ্ণা। জীবন এখানে এতো সুন্দর, অথচ আমরা সে জীবনে ছুটে চলছি কী এক দুনিয়ারির প্রতিযোগিতায়, এদিকে খোয়া যাচ্ছে জীবনের মৌলিক স্বাদ…।
লেখক : তরুণ শিক্ষক