এক.
খাঁদ লেগে মন দিনে দিনে পাথর হলো শেষে
সিজদা করি জায়নামাজে রিক্ত ফকির বেশে
পাপ–করা দিল মসজিদে যায় খুশুবিহীন মনে
তওবা করার সময় নীরব; অশ্রু চোখের দেশে।
দুই.
কান্না আমার হয় না গভীর; মন ছুটে যায় দূরে
অন্তর আবার হয় না সরব—ক্ষমার মাতম সুরে
নামায আদায় হয় না আমার খুশু–খুজুর সাথে
চিত্ত আমার দাও গো ভরে তোমার ক্ষমার নুরে।
তিন.
তাহাজ্জুদের সময় আমায় ঘুমের আরাম ডাকে
বেহুঁশ ঘুমের অতল ছোঁয়ায় তওবা বাকি থাকে
অনেক দিনের পাপের বোঝাও—দীর্ঘ হয়ে বাঁচে
তবুও তোমার গোলাম ক্ষমার স্বপন মনে আঁকে।
চার.
তোমার অসীম দয়ার পথের পথিক হবো আমি
কারণ তোমার সৃজনমাঠের আমিই বড়ো দামি
আমায় ক্ষমা না করে আর করবে কারেই ক্ষমা?
ভুলের পরেও সুজুদ নিয়ে তোমার পা‘য়েই নামি।
পাঁচ.
দাসের অলোক জীবন আমি আকুল আশায় খুঁজি
তোমার গাফুর নামটি ছাড়া নাই কোনো আর পুঁজি
রোদন শুধু তোমার কাছেই নাই কোনো আর আশা
এক পৃথিবীর ক্ষুধার জ্বালায় চাই দিয়ো পাক রুজি।
ছয়.
সজীব করো জান্নাতি গাছ; অশ্রু আমার নিয়ে
জাহান্নামের অনল নেভাও চোখের পানি দিয়ে
মুহাব্বাতের কাঙাল আমি একটু আপন করো
শান্ত হতে চাই গো মাবুদ ‘রাহিক‘ তোমার পিয়ে।
সাত.
আমি যারে আমার ভাবি সেতো আমি নই
সারা জনম দখল চাইলাম আমি তবে কই
আমি আমি জইপা গেছি দেখা পেলাম না
আমার ছায়া দেইখা তারে আমি ভেবে রই
আট.
আমি কেবল ইশারাই এক বাকি সবই নাই
নিজের মাঝে খুঁজে শুধু প্রেমের হুকুম পাই
সবাই বলে আমার জিনিস জিনিস আমি না
আমি আমার দ্বন্দ্ব নিয়েই অচিন বাড়ি যাই।
নয়.
রুহের কায়ায় আমি ছায়া গাইছি নিজের গান
অলোক আমি লৌকিকতায় হলাম সরব প্রাণ
আমির নাটাই টানছে বাড়ি চাই না বাড়ির পথ
আমার মাঝে শুদ্ধ আমি ডাকছে আলোর বান।
দশ.
আমি করুণ আমায় নিয়ে পাই না পরিচয়
আমার যত সব সকরুণ আপন শুধু ভয়
ফানা বাকা’র হিসেব নিয়ে নিত্য আমি চুপ
আমার মোহ কেটেই দেখি জীবন মায়াময়।
এগারো.
দেহের সকল কোষের মুখে তোমার জিকির চলে
আমার মনের প্রেমের ধ্বনিও তোমার কথাই বলে
নামাজরত গোলাম তোমার আয়াত পাঠেও কাঁদে
তোমার দিদার পেতেই আমার আয়ুর বরফ গলে।
বারো.
আমার নামাজ হয় না গভীর; অনুভবের অন্তে
মানছি কেবল নীরব কথাই—যা পেয়েছি গ্রন্থে
প্রিয় তোমার গভীর বোধে আমায় নামাও তুমি
ধ্যানের জ্ঞানে তোমায় যেন পাই মন–দিগন্তে।
তেরো.
রাতের ধ্যানে তোমায় দেখার ভাগ্য আমার চাই
মারিফাতের গোপন উসুল আমিও যেন পাই
ফানা বাকা’র কথায় চোখে নামছে প্রেমের ঘোর
সিজদা করার সাহস ছাড়া কোনো চাওয়াই নাই।
চৌদ্দ.
ভালোবাসার কথায় তুমি, রাগ করো না প্রিয়
তোমার নামের আরাধনাও আপন করে নিয়ো
আমি শুধু গোলাম তোমার এটাই বড়ো পাওয়া
প্রেমের অভাব হলে আমার তোমার দরদ দিয়ো।
পনেরো.
আমার চোখে সুরমা এবং তোমার চোখে কাজল
এই পৃথিবীর চোখের ভেতর অনন্য এক পাজল
হাজার কবির রাত কেটেছে এই পাজলের ভেতর
তাই কবিদের জন্য তোমার উদার রঙিন আঁচল।
ষোলো.
আগুন পোড়ায় পুড়তে দিলে হোক না সেটা জীবন
বাচ–বিচারেও পায় না সময় অলোক রোদের কিরণ
আমার কেবল বিভাজন আর বাছাই করার আলাপ
প্রেম–প্রেমিক আর আগুন শুধু চায় কেবলই মিলন।
সতেরো.
নগর আমায় গ্রাম্য ভেবে ঠাঁই দিলো না থাকতে
আমিও নগর চাইনি আমার মন–মগজে রাখতে
যার ফলে আজ লজ্জা পেয়ে নগর কাঁদে নিত্য
নগর এখন চায় যে শুধু আমার অভাব ঢাকতে।
আঠারো.
আমার শরাব আমার আবেগ তোমরা পিলাও মদ
আমার ভেতর যায় বয়ে রোজ অচিন নেশার নদ
পেটের ভেতর জল ঢেলে দাও করতে আগুন দূর
আমার আগুন বশ মেনে আজ; পান করে ‘শহদ‘।
ঊনিশ.
সলতেবিহীন রাতের প্রদীপ আলোয় ভরে আছে
সন্যাসী তার ধ্যানের ভেতর চলছে প্রেমের কাছে
রাতের মিনার ঘুমের ঘোরে দেখছে নদীর আলো
অলোক পথিক প্রেমের দিদার পেলেই তবে বাঁচে।
বিশ.
অচল কয়েন করছে বহন হাজার বোধের মাথা!
ঝরছে ক্রমশঃ নৃবিজ্ঞানের জটিল গোপন পাতা
আমার প্রেমের আলাপগুলো থাকুক নীরব রাতে
তোমার ভাবের পরশ পেলেই খুলবে কথার খাতা।
একুশ.
চোখের পাতার মিলন হলে কালোর বাসর নামে
ঠোঁটের সাথে ঠোঁঠের মিলন খিদেয় শরীর ঘামে।
জীবন যেন আগুন–পাহাড় বয়েস পোড়ায় শখে
অচিন আবেগ আলো আনে দু’চোখ প্রেমে থামে।
বাইশ.
তোমার কাছে ভালো থাকার কঠিন কসরতে
দু’চোখ আমার আড়াল করি হাসির নদী হতে
কান্নাকে দিই স্বাধীন করে ভেজাও মনের মাটি
আমায় ডেকে নিয়ো তোমার প্রেমের ছায়াপথে।
তেইশ.
সিকি পয়সার মানুষ আমি তোমায় নিয়ে ভাবি
তোমার কাছেই নিলাজ আমি করি হাজার দাবি
আমার আমি পাই না খুঁজে তোমার খুঁজে মরি
বোকা আমায় দাও বলে চুপ আমাকে তুই পাবি।
চব্বিশ.
মাথার ভেতর অচিন সাওয়াল সকাল–সন্ধ্যা জমে
কোথায় পাবো জাওয়াব এদের ভাবছি দমে দমে
তোমার দয়ায় মগজটাকে দাও যদি আজ খুলে
আমার জানার তড়পানি আজ একটু যদি কমে।
পঁচিশ.
কে ডাকে সাড়া দিতে আমাকে তার ছলনায়
সে জানে কি? আমার কপালে প্রেম চমকায়
গোপনে এসে চায় নিজেকে সঁপে দিতে নারী
কত যে লোকে দু’চোখে দেখে বড় ঈর্ষায়।
ছাব্বিশ.
আমাকে জয় করে প্রেমের ইতিহাসে তুমি
চেয়েছ হয়ে যাবে অজেয় কবিতার রুমি
আমি তো সাধনার অতীত নারীদের কাছে
সহজে পাবে না হে! প্রেমিক হৃদয়ের ভূমি।
সাতাশ.
আমার আমিত্বে উপমা নেই কোনো আর
একাকী সন্যাসী আমাকে কেন দরকার
ভেতরে আমি একা বাইরেও ঠিকই তাই
আমার আমিত্বে তুমিই করো তবে সংসার।
আটাশ.
কোথায় কারা আছ ধরো আমার এই হাত
গোপনে এই হাতে দাও হে—চুমু সারা রাত
এ হাতে প্রেম লেখা নিতেও পারো অনায়াসে
প্রেমিক তোমাদের হবে না বোর কোনো রাত!
ঊনত্রিশ.
জাল পেতেছি মাছের লোভে ঢেউ লেগেছে জালে
এমন সময় লাগল হাওয়া আমার পিনিক পালে
ঢেউ গুণে মন ভরেছে তাও অসুখ পাঁজর–পাড়ায়
ঘরের ভেতর মন ভালো নাই টোল পরে না গালে।
ত্রিশ.
অনুরাগে বেকুব হলেও তোমার কাছে আসি
আত্মভোলা হয়েও আমি তোমায় ভালোবাসি
আমার ভেতর আমি শূন্য থাকে তোমার ছায়া
প্রেমের দামে সব হারিয়েও বোকার মতো হাসি।
একত্রিশ.
ফাঁদ পেতেছি পাখির জন্যে করব শিকার তারে
পাখি আমার ঘরের ভেতর আমায় হুকুম ছাড়ে
অন্দরে তাই অলোক মশাল ফাঁদের ফাঁদে আমি
পালক ফেলে পাখি আমায় ডাকে মেঘের ধারে।
বত্রিশ.
পাড়ের পথিক ডাক দিলো না চালক চেয়ে দেখে
যাত্রী ভীষণ দ্বন্দ্বে এবার যায় কারে আজ রেখে
মালিক যদিও নির্বিকারেই দেখছে লোকের জ্বালা
দিনের শেষেই মালিক আমার নেয় আমাকে ডেকে।
তেত্রিশ.
তোমার দীপ্তি আমার তৃপ্তি অপার
তোমার জন্মবিহীন পৃথিবী অসার
দরদে তোমার হৃদয়–জমিন অলোক
আলোয় রাঙা করেছে জীবন সবার।
চৌত্রিশ.
রূপের চেয়েও অনেক অপরূপ তুমি
কবিতা–ছন্দে বলেছে হাফিজ ও রুমি
তোমার গুণের তারিফ করেন মাবুদ
সেই তারিফের সুর ভরে পরান ভূমি।
পঁয়ত্রিশ.
সুরের লহরীতে আকুল আবেদন ভোরের মোনাজাতে
গোলাম অবনত অলোক সুধা কোরআন তেলাওয়াতে
দিনের যাত্রা শুরু রাতের মায়াবনে জীবন খেয়ে খেয়ে
অপার সুধা–সুখে ব্যাকুল ফেরেশতা রবের কায়েনাতে।
ছত্রিশ.
কুজন কলরবে ফুলেরা মসজিদে এনেছে মায়া–ভোর
অধীর সাধনায় খুলেছে পৃথিবীতে ওহির আলো–দোর
ভোরের প্রতিবেশে অচেনা সুর আসে ক্ষমার চিৎকারে
আগত জীবনের পাথেয় হয়ে আজ হৃদয়ে নামে ঘোর।
সাঁইত্রিশ.
রাতের নীরবতা বুকের পাঁজরের পাশে
অচিন তরঙ্গ জলজ ঠোঁটে নেমে আসে
বিবিধ অনুরাগে প্রেয়সী গায় প্রিয় গান
মগ্ন–কোষে চুপ কামনাগুলো খুব হাসে।
আটত্রিশ.
বুকের বামে কলবে আমার, অসুখ যখন বাড়ে
নীরবে রাতে আকুল প্রেমে ফিরি তোমার দ্বারে
মিনতি আর অলোক ধ্যানে আত্ম–শোধন করি
রোদন–গমক আঁচড়ে পড়ে বুকের নদীর পাড়ে।
ঊনচল্লিশ.
রাত্রি শেষে জেগে থেকে ধ্যান করি যাঁর কায়া
বুক–পাঁজরে গোপন থাকে তাঁর না দেখা ছায়া
করুণ আমার সুর হয়ে যায় তাঁর বিরহে জ্বলে
আল–আরাবি কাল হাশরে দিও তোমার মায়া।
চল্লিশ.
গভীর সমুদ্রে জাহাজ নাবিকের পূর্ণ ভরসায়
হাতের আঙ্গুল এবং মগজের প্রবল ক্ষমতায়
সুদূর নোঙরে মানুষ ও বাহন সমান মূল্যবান
অথচ এ মানুষ চায়নি উদ্ভাস কাঠের সমতায়।
একচল্লিশ.
অচল আমি এই সময়ে একটু সাদা–সিধা
একা থাকি আড়াল হয়ে আবির্ভাবে দ্বিধা
প্রেমের দোষে লাঞ্ছনা সই বন্ধ রাখি কথা
পতিত হই তবুও থাকি প্রেমের জন্য ফিদা।
বিয়াল্লিশ.
চোখের পাতায় তন্দ্রা নামে সজাগ থাকে মন
ঘুমের ঘোরে প্রেম খুঁজে যাই আমি সারাক্ষণ
প্রেমের পথে পথ ভুলে যাই প্রিয় জনের গন্ধে
বুকের ভেতর প্রেমের শহর সজাগ অকারণ।
তেতাল্লিশ.
আমার আমি শূন্য করুণ তুচ্ছ আরও বেশি
তোমার প্রকাশ হচ্ছি আমি নিত্য মানুষবেশী
আমি শুধুই ঘুড়ি যেন নাটাই তোমার হাতে
মোহের ঘরে আটকে রাখে যেন এলোকেশী।
চুয়াল্লিশ.
ওমর খৈয়াম আঁকে আমায় আমিও তারে আঁকি
ঘোর অঘোরেই এই দু’জনের চলছে ডাকা–ডাকি
খৈয়াম কহেন আমিই সেরা আর বাকি সব দুইয়ে
আর আমি কই আপনি মরেন দুইয়েই আমি থাকি।
পঁয়তাল্লিশ.
দিন কাটেনা রাতের আশায় দৃষ্টি পলক হারা
রাত কেটে যায় এক নিমিষে রাতের ভীষণ তাড়া
প্রিয়ার চোখে চোখ রেখেছি অনেক আরো বাকি
মায়াবী রাত! ডাকছে প্রিয়া একটু সময় দাঁড়া।
ছেচল্লিশ.
মেঘ জমেছে! কী হয়েছে? নীল আছে তার পিছে–
আসুক ছায়া! জমুক মায়া ভয় কেন তোর মিছে!
মেঘের কায়া টানবে ছায়া সরোদ রবির চোখে–
জোয়ান–বুড়োর জমাট দুপুর কদম তরুর নিচে।
সাতচল্লিশ.
তোমার ভেতর অনেক তুমি তোমায় খুঁজে ফিরে
তখনো তুমি তোমায় নিয়ে লুকাও নিজের ভিড়ে
নিজের মাঝে আলোর খনি ভুল মালিকের হাতে
উদাস পথের পথিক তুমি হারাও তোমার নীড়ে ।
আটচল্লিশ.
উদাস পথিক পথ হেঁটে যায় পথের টানে একা
নিজেই আবার পথ হয়ে যায় ভাবের সাথে দেখা
কালের বাসর সুর টেনে দেয় দেহের পথ–গানে
ভাবের জগৎ মন জুড়ে চায় স্বপ্ন–মিলন রেখা।
ঊনপঞ্চাশ.
ফুল কেন তার সুবাস ছাড়ে কোন সে লোভের আশায়
মেঘ কেন তার জীবন নামায় নদ–নদীকে ভাসায়
ফাগুন কেন রূপ–মেলা এক সবুজ শাড়ির আঁচল
কোন কারণে আকুল সবাই করতে প্রেমিক যা চায়?
পঞ্চাশ.
পথিক হয়ে নেমেছি পথে ছুটতে অজানায়
হঠাৎ আমি পথ হয়েছি দেখছি না আমায়
এখন শুধু আমিই আছি নেই তো অনুভব
তবু আছি আশায় বাঁচি পথেরই সে মায়ায়।
লেখক : কবি ও গীতিকার