- দেশবরেণ্য আলেমে-দীন ও সংসদ সদস্য মাওলানা আতাউর রহমান খান (রহ.) -এর বড় ছেলে মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী। তিনি একাধারে একজন বিদগ্ধ আলেম, দার্শনিক বক্তা, সমাজকর্মী, শিক্ষক, খতিব এবং সাংবাদিক। দৈনিক ইনকিলাবের স্বর্ণযুগ থেকেই যুক্ত রয়েছেন এবং বর্তমানে তিনি ইনকিলাবের সিনিয়র সহকারী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বরত আছেন। সেই সাথে নিযুক্ত হয়েছেন বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাকের মহাপরিচালক হিসেবে। কওমি মাদরাসা বিষয়ক কিছু প্রশ্ন নিয়ে তার কাছে উপস্থিত হয়েছিল ফাতেহ। তিনি ফাতেহকে সবগুলোর প্রশ্নেরই সংক্ষিপ্ত উত্তর দেন। সাক্ষাৎকারটি ফাতেহের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো। সাক্ষাৎকার গ্রহণ ও গ্রন্থনা রাকিবুল হাসান। সঙ্গে ছিলেন ইখলাস আল ফাহিম এবং মুবিব শেখ।
ফাতেহ: ‘শিক্ষকতায় আগ্রহ হারাচ্ছে মাদরাসা ফারেগীনরা’ এই শিরোনামে ফাতেহের একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। তাতে তরুণ আলেম এবং নবীন শিক্ষকরা শিক্ষকতায় আগ্রহ হারানোর পেছনে কিছু অভিযোগ করেছেন। আপনি কি ভাবছেন? আসলেই এটা ফ্যাক্ট কিনা?
নদভী: কথাটা অনেকাংশেই সত্য। তবে শিক্ষকতা একটা মহান পেশা, এখানে সবাই টিকতে পারে না। অনেক ধৈর্যের দরকার হয়। এখানে টাকা পয়সাও তেমন পাওয়া যায় না। যারা টিকে থাকে, ত্যাগ দিয়েই টিকে থাকে। আর পেশা বদলানোর এই রীতিটা সবখানেই আছে। কেবল যে মাদরাসার শিক্ষকতায়, এমন না।
শিক্ষকতায় আগ্রহ হারানোর পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে অনেকে বেতন স্বল্পতার অভিযোগ করছেন। আমার মতামত হলো, যে মাদরাসা কর্তৃপক্ষের বেতন বাড়ানোর সক্ষমতা নেই, তারা ছাত্রদেরকেই খাওয়াতে পারে না, তারা কিভাবে বেতন বাড়াবে? তবে এটা ঠিক, যাদের সামর্থ আছে, তাদের বেতন বাড়ানো উচিত।
ফাতেহ: অর্ধশতাধিক তরুণ আলেম মুহতামিমকর্তৃক শিক্ষকদের অবমূল্যায়নকেও কারণ হিসেবে দেখছেন।
নদভী: যে মুহতামিম এটা করবেন, এটা তার চরিত্রগত সমস্যা। ইসলামে ইসলাহের বয়ান ও দিকনের্দেশনা আছে। সেটা মানতে হবে। আমরা বলি, যে মুহতামিম শরিয়তের সীমা অতিক্রম করে শিক্ষকদের উপর অন্যায় করবে, সেটা অন্যায়। শরিয়তের সীমায় থাকতে হবে।
ফাতেহ: শিক্ষকদের বড় একটা অংশের অভিযোগ হলো, শিক্ষকরা ছুটি কম পাবার কারণে শিক্ষকতায় আগ্রহ হারাচ্ছেন। এ ব্যাপারে বেফাক কী করতে পারে?
নদভী: শিক্ষাঙ্গনে তো ছুটি কমই থাকবে। তবে ছুটি নিয়ে যদি কারও কোনো অভিযোগ থাক, সে বেফাক বরাবর লিখিতভাবে জানাতে পারে। যদি বাস্তবসম্মত অভিযোগ হয়, তাহলে আমরা ব্যবস্থা নিব।
ফাতেহ: মাদরাসার ফারেগিনরা মাদরাসায় শিক্ষকতার বদলে অন্য পেশা গ্রহণ করে নিচ্ছে, ব্যাপারটা পুরাটাই যে নেতিবাচক এমন নয়। বরং, অনেকে বলছেন, বিষয়টা ইতিবাচক। মাদরাসার ছাত্রদের কর্মক্ষেত্র বিস্তৃত হচ্ছে।
নদভী: এটা কওমি মাদরাসার ঐতিহ্য। শুধু এক পেশায় থাকবে না। অন্য পেশাতেও কাজ করবে। আমাদের আকবিররা মাদরাসায় পড়ানোর পাশাপাশি অন্য কাজও করেছেন। সুতরাং এটাতে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।
ফাতেহ: তাকমিল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার জন্য ফযিলত (মেশকাত) ও সানাবিয়াতে (শরহেবেকায়া) উত্তীর্ণ হওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর আলোচনায় উঠে এসেছে মাদানি নেসাবের প্রসঙ্গটি। কারণ বেফাকের পাঠ্যক্রম এবং মাদানি নেসাবের পাঠ্যক্রম আলাদা। বেফাকের কেন্দ্রীয় পরীক্ষাতে একটা সময় অংশগ্রহণ করতো না মাদানি নেসাবের শিক্ষার্থীরা। এখনও করে না অনেক মাদরাসা। বেফাকও শিথিল ছিল। তাকমিল পরীক্ষায় বসতে লাগতো না আগের কোনো কেন্দ্রীয় পরীক্ষার সার্টিফিকেট। ফলে মাদানি নেসাব সমাপ্ত করে এসেও তাকমিল পরীক্ষায় বসতে পারতো শিক্ষার্থীরা। কিন্তু এখন বেফাক কেন্দ্রীয় পরীক্ষাগুলো বাধ্যতামূলক করায় জটিলতা তৈরী হয়েছে। এই জটিলতা নিরসনে মাদানি নেসাবের সঙ্গে কোনো সংলাপে বসেনি বেফাক।
নদভী: মাদানি নেসাবের সঙ্গে সংলাপে বসার আগ্রহ আমাদের আছে।
ফাতেহ: দেশে বিদেশে সার্টিফিকেট কার্যকর বিষয়ে কিছু জানতে চাই।
নদভী: এখন বেফাক কেবল মেশকাত পর্যন্ত সার্টিফিকেট কার্যকর করতে পারবে। কারণ তাকমিল এখন হাইয়াতুল উলয়ায়। তাকমিলের ব্যাপারটা তারা দেখবে।
ফাতেহ: বাংলাদেশি ছাত্ররা দেওবন্দ মাদরাসায় যেতে পারছে না কোলাবরেশনের অভাবে। বিষয়টা নিয়ে কী ভাবছেন?
নদভী: বিষয়টি নিয়ে আগেও চেষ্টা হয়েছে, এখনও হবে। যারা আগে চেষ্টা করছে, দেওবন্দের সঙ্গে যাদের যোগাযোগ আছে, তারা চেষ্টা করলে আমরা সাহায্য করবো।
ফাতেহ: আপনারা মুরুব্বী। আপনারা উদ্যোগ না নিলে কারা উদ্যোগ নিবে।
নদভী: আমরা উদ্যোগ নিব।
ফাতেহ: বেফাকের অধীনে আগে জাতীয় ফিকাহ বোর্ড নামে একটি বোর্ড ছিল। দেশের বড় বড় মুফতিরা সেখানে ছিলেন। কিন্তু সেটা এখন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কেন বন্ধ করা হলো?
নদভী: আসলে ওই বোর্ডের অভিজ্ঞতা তেমন ভালো ছিল না। মুফতিদের মতামত আলাদা হয়ে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। আর আমাদের মধ্যে একজনকে মান্য করে সবাই চলবে,. সেটা হয় না। তাই অন্যান্য রাষ্ট্রের মতো সরকার যদি এটার উদ্যোগ নেয়, তাহলে সহজেই হবে। কারণ, সরকার উদ্যোগ নিলে সবাই সেখানে আসে। তবে পরিচালনা থাকবে আলেমদের হাতে। আমরা বিষয়টি নিয়ে ভাববো।
ফাতেহ: বেফাকের অধীনে অধিকাংশ হেফজখানা। সম্প্রতি হেফজখানায় নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়ছে বিভিন্ন কারণে। বিষয়টি নিয়ে কী পরিকল্পনা আপনাদের।
নদভী: আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। হেফজখানাগুলোকে আমরা বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছি। যেমন বয়সভেদে ছাত্রদের ভাগ করা, ছাত্র-শিক্ষকদের রুম বিন্যস্ত করা, সিসি ক্যামেরা লাগানো ইত্যাদি। আরও পরামর্শ দিব।
ফাতেহ: ফাতেহের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ইসলামি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের চাহিদা বাড়ছে। ধর্মীয় শিক্ষায় নতুন এই উদ্যোগকে কিভাবে দেখছেন?
নদভী: বিষয়টি ইতিবাচক। বাংলাদেশে কওমি মাদরাসায় আসে ৩ শতাংশ । বাকি ৯৭ শতাংশ কিন্তু বাইরে আছে। তাদেরকে ইসলামি শিক্ষার আওতায় আনতে হবে। সে হিসেবে, ইংলিশ মিডিয়াম ও বাংলা মিডিয়াম চালু করা দরকার।
ফাতেহ: আমাদেরকে সময় দেয়ার জন্য শুকরিয়া।
নদভি: আপনাদেরকেও শুকরিয়া।