
আবু সাঈদ:
সালাফের পথে মুক্তি খালাফের ইমাম মালিকের বাণী
রাসমে আজানে কোথা আজ রূহে বেলালীর সঞ্জীবনী,
তাই এসো ভাই শপথ করি, আবার নিশি জাগি
আমরা ধরি সুফফার জিন্দেগী ইলমের তরে সর্বত্যাগী।
ওয়াজের ধারা অনেক পুরোনো। সালাফের যুগেও তার সন্ধান মিলে। অনেকে এই ময়দানে সুখ্যাতি অর্জন করেন। ইনজার-তাবসীর যোগে মানব-হৃদয় পরিশীলিত করেন। মহান রবের নেয়ামত স্মরণ করিয়ে সরল পথে ডাকেন। জাহান্নামের ভয়ঙ্কর বিবরণে পরকাল ভাবনা উজ্জিবীত করেন। উপমাযোগে তুলে ধরেন নশ্বর পৃথিবীর কদর্যতা। সুন্নাহ অবলম্বনে বাঙময় করে তোলেন পরকালের সুখ-শান্তি। তাদের বয়ানে ছিলো মোহাচ্ছন্ন প্রভাব। ছিলো ইখলাছপূর্ণ হিতকামনা। কথাগুলো হৃদয়ের অতল থেকে উৎসারিত হতো। হৃদয়ের কথা তাই হৃদয়কাননে ফুটতো। পথভোলা মানুষ তাতে পথের দিশা পেতো। ‘আকারে ইনসান প্রকারে শয়তান’ মানুষগুলো আল্লাহ তাআলার সাথে জুড়ে যেতো। আত্মার খোরাকে জীবন নতুন স্বাদে আস্বাদন করতো। ওয়ায়েজের ফয়েজে ধন্য হয়ে রাহজান রাহবারে উন্নীত হতো। জীবনের ধারাপাত তখন সম্পূর্ণ বদলে যেতো। নিষ্পাপ জীবনের নেশায় ক্লান্তপ্রাণ প্রয়াস পেতো। ওয়াজ-মাহফিলকে তাই সালাফ অনেক গুরুত্ব দিতেন। নিয়ম করে ওয়াজের আয়োজন করতেন। বর্ণিত আছে, প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু প্রতি বৃহস্পতিবারে বয়ান করতেন। মানুষ দূর-দূরান্ত থেকে তাতে ছুটে আসতো। (বুখারী-মুসলিম) তাবেয়ীদের যুগেও এই ধারা প্রবাহমান ছিলো।
সে ধারারই অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন প্রখ্যাত তাবেয়ী হাসান বসরী রহ.। তিনি বিশ্বাস করতেন, ওয়াজ কেবল মৌখিক বক্তব্যের নাম নয়। হৃদয়ের উত্তাপে আমলের ছোঁয়াতে প্রাণ সঞ্চারের নাম। এজন্য তিনি আমলের খুব গুরুত্ব দিতেন। মানুষের সামনে মেলে ধরতেন সাহাবায়ে কেরামের আমালী জিন্দেগী। তিনি বলতেন, আমি সত্তরজন বদরী সাহাবীকে দেখেছি। তোমরা যদি তাদের আমলের অবস্থা দেখতে, বলতে, এরা তো পাগলপ্রায় হয়ে গেছে। আল্লাহকে পাওয়ার জন্য এতো আমল করতে হয়! আর তাঁরা যদি তোমাদের পতনাবস্থা দেখতেন, আশ্চর্য হয়ে বলতেন, এমন উদাস মনেও আল্লাহকে পাওয়া যায়! তাদের অবস্থা ছিলো, দিনে জিহাদের ময়দানে অবদান রাখতেন। রাত হলে জায়নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন। কিয়াম, রুকু আর সুজুদে রজনী দীপিত করে রাখতেন।
এভাবে তিনি সাহাবা প্রজন্মের সাথে তুলনা করে আমলী অবক্ষয় তুলে ধরতেন। বাতলে দিতেন অবক্ষয় উত্তরণের পথ। তিনি বলতেন, নামাজে বিনম্র হবে। বচনে হবে কল্যাণকামী। ধৈর্যে হবে আনুগত্যের প্রতীক। সদাচারে আন্তরিক। অনাচারে ক্ষমাসুন্দর। কারো তিরস্কারে কান দিবে না। বোকা বলায় ক্ষুব্ধ হবে না। অনাচারের পরোয়া করবে না। অনাচারে নীতিহীন হবে না। আল্লাহ ছাড়া অন্যজনের আশ্রয় চেয়ো না। আল্লাহ তাআলার কাছেই সাহয্য চাও। লোকালয়ে আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন হও। নির্জনে হও কৃতার্থ। রিজিকে অল্পেতুষ্ট। সুদিনে কৃতজ্ঞ। দুর্দিনে ধৈর্যাধার। তোমার নীরবতায় যেন থাকে চিন্তার ছাপ। দর্শনে শিক্ষাপোলদ্ধি। আলিমকুলের সান্নিধ্যে ইলম-পিপাসা। এমনই ছিলেন সাহাবায়ে উম্মাত। এমনই ছিলেন সালাফ-আসলাফ।
মানুষকে কুরআন-সুন্নাহ মুখী করার জন্য তিনি কাতরপ্রাণ ছিলেন। এই চিন্তা সবসময় তাকে আচ্ছন্ন করে রাখতো। এক বয়ানে বলেন, আমি তো প্রবীণ সাহাবায়ে কেরামের যুগ পেয়েছি। তাদের সান্নিধ্য পরশে সময় কাটিয়েছি। তারা ছিলেন কুরআন-সুন্নাহর প্রতিবিম্বিত ভাস্বর। হালালেও তাঁরা এতটা পরিমিতি বজায় রাখতেন, যতটা পরিমিতি তোমরা হারামেও রাখো না। তাদের অতিরিক্ত কাপড় ছিলো না, যা বিছিয়ে মাটিতে শয়ন করা যায়। অতিরিক্ত খাবারের ব্যবস্থা ছিলো না, যা অন্য বেলার জন্য তুলে রাখা যায়। যখন যা ব্যবস্থা হতো, তাতেই সন্তুষ্ট থাকতেন। কোন বেলা জোগান না হলে ধৈর্য ধারণ করতেন। মোটকথা, দুনিয়াবী বিষয় তাদের মোটেই প্রভাবিত করতে পারতো না। এজন্যই তারা আল্লাহ তাআলার পেয়ারা বনেছেন। হয়েছেন উম্মাহর শ্রেষ্ঠ সম্প্রদায়। (মাওয়ায়িজুল হাসান আল বাসরী পৃ. ৪০)
কুরআন-সুন্নাহে উৎসাহ যোগাতে বলতেন, সেই ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহপ্রাপ্ত হয়, যে নির্জনে কুরআন নিয়ে বসে। কুরআনের নিক্তিতে জীবনকে পরিমাপ করে। যেটুকু কুরআনী মানদণ্ডে গৃহিত হয়, আল্লাহ তাআলার শোকর আদায় করে। মিনতি জানায় নেয়ামত আরো বাড়িয়ে দেওয়ার। যেটুকু লঙ্ঘিত হয়, নিজেকে তিরস্কার করে। দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয় ভবিষ্যতে বেঁচে থাকার। (মাওয়ায়েজ পৃ. ৬০)
কুরআন-সুন্নাহে আচ্ছাদিত হতে ইলমের প্রয়োজন। সেজন্য তাঁর ওয়াজে প্রাসঙ্গিক হতো ইলমেরও মহত্ত্ব। ইলমের আসরকে তিনি ‘তিমিরের আলো’ গণ্য করতেন। বলতেন, এই ধরণী নিশীথ নিবিড় কালো। আর আলেমকুলের আসর হলো তিমিরের আলো। (মাওয়ায়েজ পৃ. ৩১)
বয়ানে হাসান বসরী রহ. সময়ের ব্যাপারে খুবই গুরুত্বারোপ করতেন। অলস সময় না যাপনের জোর তাগিদ দিতেন। তিনি বলতেন, হে আদম সন্তান, তুমি তো দিন কয়েকের সমষ্টি মাত্র। একটি দিন চলে গেলো। তোমার জীবনপ্রদীপ ছোট হয়ে এলো। এজন্য তোমাকে সময়ের ব্যাপারে বড় যত্নবান হতে হবে। (মাওয়ায়েজে হাসান বসরী পৃ.৪৫)
অন্যত্র বলেন, হে আদম সন্তান, সময় তোমার অতিথি পরাগ। তাকে সাদর সম্ভাষণ জানাও। তার সদ্ব্যবহারে পাবে পরকালীন মুক্তি। অবমূল্যায়নে মিলবে অনিঃশেষ শাস্তি। সময় যত গড়াবে, পরিণতি ততই ঘনীভূত হবে। সুতরাং তুমি সতর্ক হও। প্রস্তুতি নাও যথাযথ। (মাওয়ায়েজ পৃ. ৪৪)
বয়ানে তিনি সময় অপচয়কারীদের পরকালীন বাস্তবতা তুলে ধরতেন। বলতেন, পরপারে গেলে এপারের কদর বুঝে আসবে। মুহুর্ত খানেকের জন্যও তখন পুরো ধরণী উজাড় করে দিতে চাইবে। যেন আর একটি বার তাসবীহ পড়া যায়। সেজদায় লুটানো যায় মালিকের বন্দনায়। এজন্য দুনিয়াতেই সময়কে সম্ভাষণ জানাতে হবে। পরকাল যেন আফসোসের না হয়। (মাওয়ায়েজ পৃ. ৩২)
তাঁর বয়ানের বিরাট অংশ জুড়ে থাকতো দুনিয়া-আখেরাতের বিবরণ। বলতেন, হে আদম সন্তান, প্রতিযোগিতা করবে আখেরাত নিয়ে। দুনিয়া ছেড়ে দাও নশ্বরবাদিদের জন্য। দুনিয়াপ্রেমী আগ্রহভরে দুনিয়ার প্রতি অগ্রসর হয়। তুমিও বিমোহিত মনে ধাবিত হও পরপারের দিকে। দুনিয়া একদিন বিলীন হয়ে যাবে। আখেরাত রয়ে যাবে চিরকাল। কখনো বলতেন, ধর্মীয় বিষয়ে হোক পারস্পরিক প্রতিযোগিতা। দুনিয়া হোক অন্যদের লক্ষ্য-প্রত্যাশা। হে আদম সন্তান, যখন মানুষকে কল্যাণ কাজে ব্রত দেখবে, তুমিও তাতে অংশ নিবে। যখন দেখবে অমূলক কাজে, তাকে আপন অবস্থায় ছেড়ে দিবে। (মাওয়ায়েজ পৃ. ৫৭ )
দুনিয়া পরকাল বিনির্মাণের ক্ষেত্রস্বরূপ। প্রতিটি মুহুর্ত পরকালীন বিনিয়োগে ব্যাপ্ত রাখা উচিৎ। সেজন্য দুনিয়া হতে হবে পরিমিত পরিমাণ। এই জাতীয় বক্তব্যও উঠে আসতো হাসান বসরী রহ. এর ওয়াজে। একবার আমীরুল মুমিনীন উমর ইবনে আব্দুল আজীজ রহ.-কে উপদেশ দিয়ে বলেন, হে আমীরুল মুমিনীন, দুনিয়াতে স্থায়ী হতে আসেননি। ওপারে স্থায়ী হতে হবে। তাই পরিমিত পরিমাণেই দুনিয়া গ্রহণ করুন। আখেরাতের চিন্তায় ব্যাপৃত থাকুন। আরেকবার বলেন, আমীরুল মুমিনীন, দুনিয়া ভীতিপ্রদ স্থান। হযরত আদম আলাইহিস সালামকে শাস্তিস্বরূপ এখানে পাঠানো হয়েছে। যে দুনিয়ার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করে, দুনিয়া তাকে লাঞ্ছিত করে ছাড়ে। এজন্য দুনিয়ার প্রতি আকর্ষণ বোধ হোক ঔষধের মতো। যে আকর্ষণ প্রয়োজন পরিমাণই বজায় থাকে। (মাওয়ায়েজ পৃ. ১১৩)
এক বয়ানে বলেন, দুনিয়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ো না। দুনিয়ার ব্যস্ততা কখনো শেষ হবে না। একটা কেটে উঠার আগে আরো দশটা হাজির হবে। (মাওয়ায়েজ পৃ. ১১৩) হে আদম সন্তান, প্রবৃত্তির উপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করো। যদি জাহান্নামে প্রবিষ্ট হও, তখন কোন ধরনের অপরাগতা গ্রহণযোগ্য হবে না। (মাওয়ায়েজ পৃ. ১১৩) পৃথিবীর সময়কে স্বার্থক করার উপযুক্ত পন্থা মুহাসাবা। মুহাসাবার প্রতি তাই জোর তাগিদ দিতেন ইমাম হাসান বসরী রহ.। তিনি বলতেন, মুমিন নিজেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে। এবং আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির লক্ষ্যে মুহাসাবা করে। বিচার দিবস তার জন্য সহজ, যে মুহাসাবার জীবন গড়ে। কিয়ামত দিবসের হিসাব তার জন্য সহজ হবে না, যে মুহাসাবার উপর ওঠে না। (মাওয়ায়েজ পৃ. ৫১)
আধ্যত্মিক রোগ মানুষের আমল ভষ্ম করে দেয়। এজন্য তার সংশোধনেও হাসান বসরী রহ. বেশ জোর দিতেন। বলতেন, অন্যের অবস্থা দেখে প্রতারিত হওয়ার কিছু নেই। মৃত্যু তোমার আলাদাভাবেই হবে। কবরে তুমি একাকীই শায়িত হবে। তোমার থেকেই নেওয়া হবে কৃতকর্মের হিসাব। দিতে হবে ফেরেস্তার জবাব। একবার এক যুবক উন্নত চাদর গায়ে চড়িয়ে উন্নাসিকভাবে হাসান বসরী রহ.-এর পাশ অতিক্রম করে। তিনি তাকে ডেকে বললেন, হে আদম সন্তান, তুমি তো যৌবনে মুগ্ধ। মনে করো, ওপারে চলে গেছো। দাঁড়িয়েছো হিসাবের কাঠগড়ায়। কতটুকু সফল হবে? এজন্য যৌবনে বিমোহিত না থেকে অন্তর পরিশীলনে মন দাও। আল্লাহ তাআলা বান্দার কাছে স্বচ্ছ হৃদয়ই কামনা করেন। (মাওয়ায়েজ পৃ. ৪৮)
এক বয়ানে বলেন, আল্লাহ তাআলা তোমাদের সবাইকে দরিদ্র বানাতে পারতেন। পারতেন সবাইকে ধনী বানাতে। কিন্তু তেমনটি করেননি। পরস্পরে প্রভেদ রেখেছেন। উদ্বুদ্ধ করেছেন পারস্পরিক সহমর্মী আচরণে। যেন যাচাই হয়ে যায় আমলে কে উত্তম। তিনি বলেন, আমরা তো এক সময় ঋণপ্রদানকে কৃপণতা জ্ঞান করতাম। পরস্পরে অনুসরণ করে চলতাম অংশিদারিত্ব ও প্রাধান্যদানের নীতি। আল্লাহর কসম, আমি এমন সম্প্রদায়কে দেখেছি, নিজের কাপড় দ্বিভাগ করে যারা অপর ভাইকে পরতে দিতো। এমনও দেখেছি, কেউ রোজা রেখেছে। তার কাছে পর্যাপ্ত ইফতারও রয়েছে। তথাপি ইফতারের সময় অপর ভাইকে বলতো, ভাই, আমি তো আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্য রোজা রেখেছি। আমি চাই, এই রোজা কবুল হলে তাতে যেন আপনারও অংশ থাকে। এজন্য সামান্য ইফতার নিয়ে আসুন। অন্যজন তখন আনন্দে চিকচিকিয়ে ওঠতো। সওয়াবের আশায় সাধ্যে থাকা পানি ও খেজুর নিয়ে হাজির হতো। রোজাদার তাতেই ইফতার করে নিতেন। (মাওয়ায়েজ পৃ. ৬৬)
তিনি মানুষকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা বলতে নিরুৎসাহিত করতেন। বলতেন, যে বেশি কথা বলে, তার অসত্যও বেশি প্রকাশ পায়। কখনো বলতেন, যে জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণ করে না, সে ধর্মের মানসাই বুঝে না। (মাওয়ায়েজ পৃ. ৭১)
তিনি বলতেন, কারো ভেদ প্রকাশ করবে না। মনে রেখো, ভেদ প্রকাশ করাও খেয়ানতের শামিল। পরনিন্দা করবে না। অন্যজনের পরনিন্দাও শুনবে না। যে তোমার কাছে অন্যজনের পরনিন্দা করে, অনুসন্ধানে দেখা যাবে, অন্যজনের কাছেও সে তোমার পরনিন্দা করবে। (মাওয়ায়েজ পৃ. ৭২)
অর্থনৈতিক স্বচ্ছতার প্রতিও স্ববিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন হাসান বসরী রহ.। তিনি বলতেন, সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখার জন্য নয়। তা দ্বারা নিজের প্রয়োজন পূরণ করবে। অন্যের প্রয়োজনেও ব্যয় করবে। তবে আল্লাহ তাআলার রহমতের আশা করা যায়। (মাওয়ায়েজ পৃ. ৩৫)
নিফাক বা কপটতা সম্পর্কেও সতর্ক করতেন। তিনি বলতেন, কথা ও কাজে মিল না থাকা, প্রকাশ্য ও নির্জনে তফাত হওয়া, ভেতর ও বাহির ভিন্ন হওয়া, সবই নিফাকের আলামাত। আল্লাহর কসম, নেফাক মুক্তির সংবাদ আমার জন্য পৃথিবী ভর্তি স্বর্ণ অপেক্ষাও অধিক আনন্দদায়ক। নেফাককে তো মুমিনই ভয় করে। তা থেকে নিশ্চিন্ত থাকে মুনাফিক। (মাওয়ায়েজ পৃ. ৫০)
মানুষকে রাজদরবারের আজ্ঞাবহ হতেও নিষেধ করতেন। বলতেন, কখনো রাজা-বাদশাদের দরবারে যাবে না। যদিও তা সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের ইচ্ছায় হয়ে থাকে। একবার উমর ইবনে আবদুল আজীজ রহ. লিখে পাঠান, হযরত, আমাকে কিছু লোকের সন্ধান দিন, আল্লাহর নির্দেশ পালনে আমি যাদের সহযোগিতা নিতে পারবো। উত্তরে হাসান বসরী রহ. লিখে পাঠান, ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি আপনার কাছে যাবে না। দুনিয়াপ্রেমী আপনার কাজে আসবে না। সেজন্য আপনি সম্ভ্রান্তদের কাছে টানতে পারেন। তারা নিজ সম্মান রক্ষার্থে আপনার সাথে খেয়ানত করবে না। (মাওয়ায়েজ পৃ. ৬৯)
এভাবে বয়ানের ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন রোগের পথ্য বাতলে দিতেন। এক বয়ানে সংক্ষেপে আধ্যাত্মরোগ উত্তরণের পথ নির্দেশ করেছেন। তিনি বলেন, মানুষ যদি দুটি অভ্যাগ ত্যাগ করতে পারে, পরিশুদ্ধি অর্জন তার জন্য সহজ হয়ে যাবে। অন্যায় প্রবণতা ত্যাগ করতে হবে। আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামতের দাবি রক্ষা করতে হবে। অতপর তিনি তেলাওয়াত করেন, তোমরা অনাচারীদের প্রতি ঝুঁকে পড়ো না। যেন জাহান্নামের আগুন তোমাদের স্পর্শ না করে (সূরা হুদ আয়াত নং ১১৩)। তোমরা আমার নেয়ামতের নাশুকরি করো না। যেন তোমাদের উপর আমার ক্রোধ সৃষ্টি না হয় (সূরা ত্বহা আয়াত নং ৮১)।
ইখলাছ ছাড়া আমলের গুরুত্ব নেই। এই বিষয়টিও উচ্চারিত হতো হাসান বসরী রহ. এর ওয়াজে। বরং বয়ানের বিরাট অংশ জুড়েই থাকতো ইখলাস অনিবার্যতার বিবরণ। ইখলাস গুণে ব্যক্তির নিফাক দূর হয়। দূর হয় আত্মতৃপ্তি। গড়ে ওঠে মুহাসাবার অভ্যাস। ইখলাস চিত্রায়নে বলেন, অনেক সময় দেখা যায়, মুখলিস ব্যক্তি দশকের পর দশক ইবাদত করে যায়। প্রতিবেশি কোন টেরই পায় না। পরবর্তীতে যখন মানুষ জানতে পারে, তার আলোচনা করে। তাদের নিষেধ করে দেন। তারা নিবৃত না তিনি অগোচরে চলে যান। (মাওয়ায়েজ পৃ. ৯৮)
বয়ানে তিনি তাওবার প্রতিও অনেক উদ্বুদ্ধ করতেন। বলতেন, কোন গুনাহ হয়ে গেলে সাথে সাথেই আল্লাহ তাআলার কাছে তাওবা করবে। ব্যথিত মনে ক্ষমা প্রার্থনা করবে। অনুশোচিত মনে আল্লাহর দরবারে হাজির হলে আশা করা যায়, আল্লাহ তাআলা ক্ষমার ফায়সালা করবেন। (মাওয়ায়েজ পৃ. ৯৯)
তবে সাথে সাথে এই বিষয়েও সতর্ক করতেন, তাওবার সুযোগে যেন গুনাহ না হয়ে যায়। তিনি বলতেন, হে আদম সন্তান, গুনাহ ছেড়ে দেওয়া তাওবার সুযোগে গুনাহ করার চেয়ে অধিক সহজ। কেননা গুনাহের নেতিবাচক প্রভাবে তাওবার ইচ্ছাও তো বিলোপিত হতে পারে। তখন তো আর তাওবা নসীব হবে না। (মাওয়ায়েজ পৃ.৯৯)
ইমাম হাসান বসরী রহ. এভাবে খুঁজে খুঁজে সমাজের সংশোধনযোগ্য বিষয়গুলো ওয়াজে তুলে আনতেন। উন্নত ভাষার মর্মস্পর্শী প্রকাশে মানুষকে নছিহত করতেন। তবে নছিহতের ক্ষেত্রে তিনি কারো নাম নিতেন না। ‘হে আদম সন্তান’ সম্বোধনে উল্লেখ করতেন। লক্ষ্য রাখতেন শ্রোতার অবস্থা ও সম্মান, পরিবেশ ও পরিস্থিতি। বয়ান করতেন হিতকামনার স্থান থেকে। আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে। কুরআন-সুন্নাহ ও সালাফের আলোচনায় বয়ান সীমাবদ্ধ রাখতেন। মাধুরী মিশাতেন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে। এভাবেই বয়ানের মাধ্যমে উম্মাহর ইসলাহ ও সংশোধন করতেন।
সালাফের যুগে ওয়াজের আরেক কিংবদন্তি ছিলেন ইমাম আবু আবদিল্লাহ হারেস ইবনুল আসাদ আল মুহাসেবী রহ.। তিনি ছিলেন হিজরী তৃতীয় শতকের মানুষ। চলছিলো আব্বাসী সালতানাত। খেলাফতের মসনদে সমাসীন খলীফা মামুনুর রশিদ। সময়টা মুসলিম ইতিহাসের অত্যন্ত দুর্যোগপূর্ণ মুহুর্ত। রাষ্ট্রীয়ভাবে খলকে কুরআনের মাসয়ালা প্রমোট করা হচ্ছিলো। মুতাযিলা কাদরিয়া রাফেজিয়াসহ বিচ্যুত মতাদর্শের অভয়ারণ্য ছিলো খেলাফতের প্রাণকেন্দ্র বাগদাদ। জনসাধারণের মাঝে তারা ছড়িয়ে দিচ্ছিলো খালকে কুরআনের বিষ। উলামায়ে উম্মতের উপর চালানো হচ্ছিলো নির্যাতনের স্ট্রীম রোলার। উম্মাহর এই ক্লান্তিলগ্নে যে কজন সালাফ মানুষের মনে বিশুদ্ধ ঈমান দীপিত রাখার চেষ্টা করেছেন, ইমাম হারিস ইবনুল আসাদ আল মুহাসেবী রহ. তাদের অন্যতম।
তিনি ওয়াজ-নছিহতের মাধ্যমে সমাজ সংশোধনের প্রয়াস পেতেন। নানাভাবে ঈমান সংরক্ষণের সবক দিতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, একমাত্র কুরআন-সুন্নাহর মাধ্যমেই বিচ্যুত মতাদর্শের সফল মুকাবেলা সম্ভব। এজন্য ওয়াজের সময় কুরআন-সুন্নাহ আকঁড়ে ধরার প্রতি স্ববিশেষ গুরুত্ব দিতেন। বলতেন, আল্লাহ তাআলা যার হৃদয় প্রসারিত করেন, এবং যার হৃদয় ঈমানের আলোয় উদ্ভাসিত, সে অবশ্যই কুরআন-সুন্নাহ ও উলামায়ে উম্মাতের সিদ্ধান্ত মেনে নিবে। তিনি আরো বলেন, কোন বিষয় হক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য তা কুরআন-সুন্নাহর মানদ-ে উত্তীর্ণ হওয়া আবশ্যক।
তাঁর ওয়াজে বিশেষভাবে স্থান পেতো সাহাবায়ে কেরামের পদাঙ্ক অনুসরণের অনিবার্যতা। তিনি বলতেন, আসহাবে রাসূলের অনুসরণ হতে পারে তাকওয়া অবলম্বনের উত্তম সহায়ক। নব আদর্শ এড়িয়ে চলো। সাহাবায়ে কেরামের অনুসৃত পথে অবিচল থাকো। তাদের বিরোধিতা করো না। তারা হলেন হেদায়েতের আলোকমশাল।
তিনি বলতেন, হে আদম সন্তান, আল্লাহ তাআলার বিধান মান্য করো। নববী আদর্শে থাকো অবিচল। অনুসরণ করো সাহাবায়ে কেরামের পথ। চেষ্টা করো তাদের জীবনাদর্শ ধারণের। তারাই হিদায়েতের আলোকমিনার।
ইমাম মুহাসেবী রহ. বয়ানে বলতেন, উম্মাহর সরলতা ও বিচ্যুতি উলামায়ে উম্মতের উপরই নির্ভরশীল। আলেমকুল ভালো থাকলে ভালো থাকে উম্মাহ। আলেমকুলে বিচ্যুতি ঘটলে বিচ্যুত হয় উম্মাহ। এজন্য তিনি বলেন, আলেম সমাজ দুই শ্রেণীর হয়ে থাকে। একশ্রেণীতে উম্মাহ ভাগ্যবান হয়। অন্যদলে হয় ক্ষতিগ্রস্ত। অতপর মুহাসেবী রহ. এই দ্বিতীয় শ্রেণীর আলেম সমাজ থেকে মানুষকে সতর্ক করতেন। বলতেন, এরা শয়তানের উত্তরসূরী। দোসর ইবলিসের।
মুহাসেবী রহ. এর যুগে আবির্র্ভূত হয় বিচ্যুত সুফিবাদের বিশেষ একটি দল। তারা দাবি করে, ইবাদতের মাধ্যমে অর্জিত হতে পারে বিস্ময়কর শক্তি। যার মাধ্যমে অবগত হওয়া যায় অদৃশ্যের সংবাদ। তখন ইবাদতেরও প্রয়োজন হয় না। কথা বলা যায় আল্লাহ তাআলার সঙ্গে। একরাতে পাড়ি দেওয়া যায় বাগদাদ থেকে দূর মক্কার পথ। মুহাসেবী রহ. বয়ানে তাদের বিষয়েও আলোচনা করতেন। সতর্ক করে বলতেন, যারা ইবাদতের মাধ্যমে বিস্ময়কর শক্তি লাভের দাবি করে, তারা ভন্ড। অধিক ইবাদতের ফলে কেউ ইবাদতের স্তর উতরে যায় না। যারা এই দাবি করে, তাদের থেকে নিবৃত থাকো। আঁকড়ে ধরো হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের পথ।
ইমাম মুহাসেবী রহ. ওয়াজের সময় আধ্যাত্ম ব্যাধিরও চিকিৎসা দিতেন। এক্ষেত্রে তার নীতি ছিলো বেশ অভিনব। তিনি ব্যাধির মৌল নির্ণয় করতেন। অতপর তার সমাধান বলতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, মৌল ব্যাধি নিরাময়ে নিরাময় হয় বাহিত ব্যাধি। বাহিত রোগে সময় দিলে মৌল ব্যাধির নিরাময় হয় না। তাই সমস্যা দেখা দেয় পুনরায়।
তিনি বলেন, আত্মগরিমা একটি মৌল ব্যাধি। এর ভিত্তিতে বাহিত হয় পদ-পদবীর লোভ, গর্ব ও অহঙ্কার, ক্রোধ ও হিংসা, বিদ্বেষ ও গোঁড়ামী। এখন আত্মগরিমা বধ হলে বধ হবে বাহিত ব্যাধিসমূহও। কিন্তু বাহিত রোগের নিরাময়ে বধ হবে না মৌল ব্যাধি। ভিন্নরূপে তাই ফিরে আসবে পুনর্বার। অতপর মুহাসেবী রহ. বলেন, মানুষ যতদিন বাহিত রোগের নিরাময়ে ঘুরবে, তার পেরেশানী ঘুচবে না। ব্যাধি রূপ বদলে ফিরে আসবে পুনরায়। কিন্তু সে যদি মৌলের সমাধান করে, সমাধান হয়ে যাবে বাহিতেরও।
ইমাম মুহাসেবী রহ. মুহাসাবার খুবই গুরুত্ব দিতেন। এজন্য তাকে মুহাসেবী অভিধায় অভিহিত করা হয়। তিনি মুহাসাবার গুরুত্ব সম্পর্কে বলেন, মানুষ থেকে বড় ধরনের বিচ্যুতি প্রথমবারেই ঘটে না। বরং বিন্দু বিন্দু যোগে একসময় তা সিন্ধু হয়ে দেখা দেয়। এই বিন্দুগুলো বন্ধের ক্ষেত্রে উত্তম নিয়ামক হতে পারে মুহাসাবা। এজন্য মুহাসাবার জীবন গড়া উচিত।
ইমাম মুহাসেবী রহ. পরিশুদ্ধির বিষয়টিও বহুল পরিমাণে আলোচনা করতেন। তিনি বলতেন, নামাজের জন্য পবিত্রতা অর্জন আবশ্যক। এজন্য নামাজের পূর্বে পবিত্রতা অর্জন করতে হয়। তদ্রুপ আত্মশুদ্ধির জন্যও আবশ্যক শুচিতা অর্জন। সেজন্য আমলের পূর্বেও অর্জন করতে হবে শুদ্ধি। শুচিতা অর্জনে প্রয়োজন গুনাহমুক্ত হৃদয়। আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জনের প্রয়াস।
মুহাসেবী রহ. বলেন, অন্তরের শুচিতা অর্জন আমলের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। কেননা আমলের পূর্বে স্বচ্ছতা অর্জিত না হলে কল্যাণের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে অস্বচ্ছতা। এজন্য প্রথমে অস্বচ্ছতা দূর করতে হবে। পরে আমলের পথে হতে হবে অগ্রসর।
এভাবে সমাজের সংশোধনযোগ্য বিষয়েই কেবল মুহাসেবী রহ. বয়ান করতেন। কুরআন সুন্নাহর আলোকে সমাধান দিতেন। অপ্রয়োজনীয় আলোচনা তিনি পছন্দ করতেন না।