সুলাইমান সাদীর একগুচ্ছ কবিতা

বিধ্বস্ত শহরের জন্মদিন

বছরের পর বছর আমরা আতঙ্কগ্রস্ত ছিলাম

এখন আর মৃত্যুর জন্য আলাদা কোনো দরোজা রাখি না

শহরের প্রতিটা দরোজায় ঈদ আর জন্মমৃত্যুর উৎসব বানাই

আজরাইল আলায়হিস সালাম দলবল নিয়ে আসেন আর দ্বিগুণ দলে ফিরে যান


আমাদের
ঘর গোছানো, ওজুগোসল, ঝাড়ুপোছার আর প্রয়োজন পড়ে না

তায়াম্মুমের জন্য স্তুপের পর স্তুপ ধুলো জমে আছে আমাদের আত্মায় কলিজায়

শহরের শত শত বিল্ডিং হাতপা ভেঙেচুরে বসে আছে আমাদের শৈশব থেকে

প্রতিদিন নতুন নতুন সদস্য যোগ হচ্ছে খুঁড়ো ঘরবাড়িদের দলে

ভয় নেই, ওদের ভিক্ষে করতে হয় না আদৌ; ভিক্ষুকরা শহর বয়কট করেছে প্রায় শতাব্দী আগে

 

আমাদের কোনো কৈফিয়ত নেই, আমাদের কোনো বিধ্বস্ততাও নেই

আমরা জন্মের পর কোনোদিন ফুলগাছ গজাতে দেখিনি আমাদের শহরে

তোমাদের কারখানায় ফোটানো ফুলে আমরা জন্মদিন বানাই

তোমাদের রেট সেঁটে দেয়া ্যাপিং পেপারে মোড়ানো কেকে আমরা জন্মদিন বানাই

আমাদের মৃত্যুদিনও তোমাদের পাঠানো মোম আগরবাতি দিয়ে বানিয়ে নেবে আমাদের নিকটপ্রজন্ম


তোমরা
উঠোনেফোটা টগরবেলির পাপড়ি উড়িয়ে, বাহারি রঙের আতশবাজি ফাটিয়ে সেলিব্রেশন করো তোমাদের আনন্দদিন


জীবগ্রস্ততা

নিরীহ মানুষেরা সবাইকে ধোঁকাবাজ মনে করে

নিরীহ মানুষেরা নিজেদের বুদ্ধিজীবী মনে করে

অসুস্থ অন্তরের সঙ্গে হরহামেশা তারা বিলাপ পাড়ে

রাজনীতির মতো মনে করে মানুষের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা


প্রজাতির মানুষ নদী দেখলে ডুবে যাওয়ার ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ওঠে

ওষ্ঠের কিনারায় এক লুকমা বেলেল্লাপনা নিয়ে ঘুরে বেড়ায় পথেঘাটে

নিজস্ব সংস্কৃতি বলতে বোঝে সকালে নাস্তা খাওয়া আর গভীর রাতে কারো সঙ্গে ইনবক্সে খুনসুটি করা।

পানি গিলতে গিয়ে আহ্লাদে নেচে ওঠে, বুঝি তহুরা শরাবের ধারা বইছে দেহের কোষগুলোতে


একদিন
একটা অচেনা পোকার কথা ভেবে খুব কষ্ট হয়, আরেকদিন অতি পরিচিত কোনও রংবাজের পকেটের ভেতর নিজের রুহুটা খুঁজে পায়।

এসব অদ্ভুত মানুষের ভিড়ে সমাজ যখন কাঙাল হওয়ার দশা তখনই মনে পড়ে অন্য একজনের কথা। যিনি মানুষ নন, মানসীর রূপ মেখে আলোকিত করেন সব অন্ধকার। একফোঁটা হাসির লাবণ্যে ধরে ফেলেন সব নিরসতা। শুধু একটা চাবির গোছা মহল জুড়ে বাজতে থাকে

 

খুব বিহানে আকাশে একটি সুসজ্জিত খাটিয়া ভেসে বেড়ায় ওই নিরীহ আজিব জীবটার অপেক্ষায়


যেভাবে
যেমন করে হোক

কাছের কোনো কাঁচা ধানখেতের বাতাস আসছে

গায়ের পশমে টের পাওয়া যায় গ্রীস্মকালীন ঢেউ

দূরের মরুভূমি নয়, অচেনা সমুদ্দুর নয়

শহরতলীতে কৃষকরা আরো কিছু ধানের চারা বুনতে পারেন

আরো কিছু উদ্যাম বাতাস ছুটে আসতে পারে আমাদের জানালায়

 

দীর্ঘ মোনাজাতের মতো একেকটা সমকালীন সন্ধ্যা

যেভাবে আমাদের ভেতরে রাতের প্রতীক্ষা ঘনীভূত করছে

যেভাবে গাছপাকা আমের জুসের ভেতর ছড়িয়ে পড়ে রোজাদার ঘুম

ঠিক মেঘের রাজ্য জয়ের অনুভূতি জেগে থাকে রিলেক্সেবল বাতাসের শীতে

 

মাড়ানো ঘাসের অনুনয়

অবহেলিত খড়ের মনখারাপ

শুকিয়ে যাওয়া গোবরের দলা নিয়ে পিচঢালা সাদা রাস্তাটা যেভাবে রাতের গায়ে বিছিয়ে আছে

ঠিক অর্ধেক পৃথিবীর নেশা বুকের লোমশ আদরে ঢেকে পড়বে এখনই

 

কাছেই দুটো বাতি পরস্পর কী ফিসফাস করছে

কুপির দিনগুলোতে যেমন পড়তে বসে ফিসফাস করতাম তুমিআমি

যেমন স্মৃতির মতো লাগে আমাদের শৈশবের গান

যেমন করে হোক একজোড়া পিলারের হৃদয় ভালো থাকুক নিভৃতের সাক্ষ্য বুকে নিয়ে

 

রোমন্থন

মানুষটারে বেঁধে রাখতে হয়, আষ্টেপৃষ্ঠে

মানুষটার সমূহ উৎসবে জড়িয়ে পড়তে হয়

মানুষটা নিরবচ্ছিন্ন হোক, হতে পারে, হতে দেয়া যায় না

উনুনের ঘের কেটে দমিয়ে ফেলুন অবাঞ্ছিত আগুন

 

এমনিতে পাটের পড়শি হয়ে দিনভর রাখালি করা যায়

রাতভর সময়ের চৌরঙ্গী থেকে নামিয়ে ফেলা চাই যৌবনের ঘ্রাণ

ইন্দ্রীয় সে তো জগত প্লাবিত জল, ধারা বহে প্রাণের ঔরশে

ওড়ালে তারে ধরা যায় না, করাল গ্রাসের মতো লাগে মেঘ

 

হেমন্তের বাঁশি বেয়ে যে সুর গড়িয়ে আসে গ্রীষ্মের জানালায়

হাওয়ায় নয়, বৃষ্টির কলরোলে তারে মোহাবিষ্ট করি

তারে জড়িয়ে রাখি প্লাবিত কামনার ঢেউয়ে, মথিত উচ্ছাসে

 

বর্ণলতা মোহ

কোনো ডাইনির ঘরে তোমাকে দাসত্ব খাটতে দেব না

 

তোমার নৃত্যের প্রতিটা মুদ্রায় আমার স্পর্শ লেগে আছে

তোমার প্রতিবিন্দু অশ্রুতে মিশে আছে আমার কান্নার নুন

ওই শাকচুন্নীর বোধোদয় হোক

তুমিও নাইতে নামতে জানো ওর তেরোহাত আরামের গভীরে

তোমার চুড়ির শব্দে কেঁদে উঠতে পারে ওর প্রস্তরমন

 

বর্ণলতা আমার, শব্দময়ী যাদু

শেষবার তোমার ভাঙা পায়ে দাঁড়ি বাঁধতে গিয়ে চোখ পড়েছিল বাঁকানো কমায়

মুহূর্তে বিস্ময়চিহ্ন এঁকে দিয়ে সরে পড়েছিলাম

তোমাকে অপ্রকৃতস্থ করে আমার সাধে বরফ জমে না কখনো

কখনো তীর্যক ধনুকের মোহে ভাঙে না তোমাকে পাবার ধ্যান

পৌরুষ নয়, তোমায় আমি নাবিকের অশ্রু দিয়ে মাখি

ভিখিরির আবেদন এনে ঢেলে দিই তোমার নৃত্যবতী পায়

আদিপর্বে ঢেকে রাখি তোমার সমস্ত ছন্দঅন্ত্যমিল

লেখক : তরুণ কবি ও সহকারী সম্পাদক, দৈনিক আমার সংবাদ  

আগের সংবাদশাহাদাৎ তৈয়বের একগুচ্ছ কবিতা
পরবর্তি সংবাদসমুদ্র শিরোনামে কোলাহলের কথা