ইরফান তানভীর:
মিসরের দকহলিয়া প্রদেশের মানসুরা নগরীর ছোট্ট এক গ্রাম কুফর গানাম। ১৮৮৮ সালের ২০ আগস্ট শিউলী ফোটা ভোরে সে গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন এক শিশু। বাবা মা তার নাম রাখেন হুসায়ন হাইকল। ছোট্ট শিশু হুসায়ন হাইকল পরবর্তী মিসরের প্রখ্যাত কবি, সাহিত্যিক, ঐতিহাসিক, উপন্যাসিক এবং রাজনীতিবিদ খ্যাতির প্রবাদ পুরুষের আসনে সমাসীন হন।
কেবল মিসরের সাহিত্য ইতিহাসেই নয়, বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসেও হুসায়ন হাইকল এক বিশেষ নাম। মিসরের অলিগলি থেকে প্যারিসের আলো ঝলমলে সড়ক মহাসড়ক হুসায়ন হাইকলকে জড়িয়ে রেখেছে পরম মমতায়।
সৃজনশীল ঔপন্যাসিক, সমাজদরদি সাহিত্যিক এবং রাজনীতির মানবিক পুরোধা হুসায়ন হাইকলকে সবাই চেনেন আরবি উপন্যাসের জনক হিসেবে। আরবি সাহিত্যে উপন্যাসের ভূমিকায় যে নামটি এখনো উচ্চারিত হয়, সেটি হুসায়ন হাইকল। তিনিই প্রথম আরবিতে উপন্যাস লিখেন। এবং যা আরবি সাহিত্যে পরবর্তী সময়ে এক নতুন ধারার জন্ম দিয়েছে। বলতে হয়- বর্তমানে আরবি সাহিত্যে উপন্যাসের যে এত সমৃদ্ধতা, তার রূপকার হুসায়ন হাইকল।
বাবা-মার কাছেই হাইকলের বাল্যশিক্ষার সূচনা হয়।
তীক্ষ্ণ মেধাবী শিশু হাইকল যখন মক্তবে পড়তেন, তখনই তিনি কুরআন মুখস্থ-সহ অক্ষর-জ্ঞান শিক্ষা রপ্ত করে ফেলেন। তারপর ১৯০১ সালে কায়রোর জামালিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে ভর্তি হন খেদিভ বিদ্যালয়ে। ১৯০৫ সালে খেদিভ বিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে আইন শিক্ষার জন্য মনোনিবেশ করলে হাইকল একই শহর কায়রোর খেদিভ আইন বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯০৯ সালে হুসায়ন হাইকল খেদিভ আইন বিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী নিয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য ফ্রান্সে গমন করেন। প্যারিসের সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন হুসাইন হায়কল উচ্চ শিক্ষার জন্য ভর্তি হন, ঠিক সে সময়টাতে হাইকল ফ্রান্সের সভ্যতা-সংস্কৃতি সম্পর্কে বিস্তর ধারণা পান। ফ্রান্সের সাহিত্য অধ্যয়নে ঝুঁকে পড়েন ধীরে। একসময় ফ্রান্সের ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে দারুণ দক্ষতা হাসিল করা হুসায়ন হাইকল ঘুরে বেড়ান অলিগলি থেকে জাদুঘর পর্যন্ত। সাহিত্যে পুরোদস্তুর উদ্যমি হওয়ার দমকা হাওয়া এসে স্পর্শ করে যায় বিশ্ব প্রতিভার এ অংশীদারকে।
১৯১১ সালে প্যারিসের সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে হুসায়ন হাইকল পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
ড. মুহাম্মদ হুসায়ন হাইকল একজন সচেতন রাজনৈতিক, গবেষক পণ্ডিত এবং বিশিষ্ট লেখক ছিলেন। তার অধিকাংশ লেখা ছিলো ঐতিহাসিক। ইতিহাস নির্ভর। মহানবি হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম – এর জীবনী প্রণয়ন করা হলে তা বাদশাহ ফয়সাল প্রতিযোগিতায় পুরষ্কারে ভূষিত হয়। লেখক হাইকল কতোটা উচু দরের লেখক তা সহজে অনুমান হয় এখানে। ইসলামিক হিস্ট্রি তথা ইসলামের ইতিহাসকে এক নতুন আঙ্গিকে অলংকৃত করে লেখার শুভসূচনা করেন তিনি। লেখাকে গ্রহণযোগ্য করতে এখন যেসকল বইয়ে আমরা তথ্যসূত্রের উল্লেখ পাই সে তথ্যসূত্রের অবদানও তার হাত ধরে।
মিসরীয় হুসায়ন হাইকল ছিলেন বিশ্ব প্রতিভার অন্যতম এক যোগ্য অংশীদার। একাধারে সাহিত্য, রাজনীতি, এবং সমাজ ভাবনায় তার ছিলো দৃঢ় পায়চারি। তবে সাহিত্যে তার সবচেয়ে বড় অর্জন হলো জয়নব উপন্যাস। জয়নব রূপী একজন কিশোরীর চরিত্রে পুরো মিসরের সমাজব্যবস্থাকে স্পষ্ট চিত্রায়ণ করা হয়েছে এ উপন্যাসে। এটি আরবি ভাষার রচিত প্রথম উপন্যাস। উপন্যাস জয়নবে ড. হাইকল মিসরের গ্রামীণ জীবনের নানান মোড়কের নিষ্ঠুর আর বাস্তবতাকে নিরিখ করে বলে গেছেন নানান কথা ।
১৯১০ সালের এপ্রিলে আরবি ভাষার রচিত প্রথম উপন্যাস ‘জয়নব’ যখন লেখা শুরু হয় , হুসায়ন হাইকল তখন প্যারিসে। ফ্রান্সে অধ্যয়নকালীন উপন্যাসের সাথে তার পরিচয় ঘটে। ফ্রান্সের উপন্যাস পড়ে হুসায়ন হাইকল ভাবলেন, ফ্রান্সের এসব উপন্যাসে বর্ণিত নদী-ঝর্ণা, রাখাল বালকের গান, গেঁয়ো ছেলেমেয়েদের উৎসব উদ্দীপনা, লোকাচার সংস্কৃতি এসবতো মিসরেও আছে। মিসরে কেবল এসব প্রাকৃতিক স্পন্দনই নয়, পাশাপাশি ছিলো সাধারণ মানুষদের উপর শাসক শ্রেণীর অবর্ণনীয় অত্যাচার আর নিগ্রহও। হাইকল ভাবলেন এ বাড়তি চরিত্র আধুনিক উপন্যাসের জন্য দারুণ উপাদান হতে পারে। তারপরই জয়নব উপন্যাসের অবয়বে মিশরীয় সমাজ জীবনের বিস্তারিত আলাপ করে গেলেন লেখক।
জয়নব উপন্যাস দিয়েই যেহেতু আরবি ভাষায় উপন্যাসের সূচনা, প্রথম শুরু করাটা যে কারোর জন্যই খুব সহজসাধ্য ব্যপার নয়। এ কষ্টসাধ্য কাজটি যখন হুসায়ন হাইকল অত্যন্ত সফলভাবে সম্পন্ন করেন, তখন আরবি সাহিত্যে উপন্যাসের কাজে আরো অনেকেই এগিয়ে আসেন হাইকলের হাত ধরে। যা পরবর্তী সময়ে আরবি উপন্যাসের সমৃদ্ধতা এনে দিয়েছিল।
জয়নব উপন্যাসটি লেখা শুরু হয় ১৯১০ সালের এপ্রিল মাসে। আর এটি সম্পূর্ণ শেষ হয় ১৯১১ সালের মার্চে। তারমানে একবছরেও বেশী সময় ধরে লেখা হয়েছিল জয়নব। এটি বই আকারে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯১৪ সালে। মজার বিষয় হচ্ছে, জয়নব উপন্যাস প্রকাশের পরপরই তখনকার সমসাময়িক সাহিত্যিকদের তুমুল সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয় হুসায়ন হাইকলকে। তবে যুদ্ধোত্তর স্বদেশী আন্দোলনে জয়নব ভূয়সী প্রশংসা পায়।
ড. হুসায়ন হাইকল এ উপন্যাস লেখেন তার যৌবনে। বইয়ের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় রয়েছে যৌবনের কল্পনা ও নানাবিধ স্বপ্নের ঢালা। হাইকল বলতে দ্বিধা করেননি, তারুণ্যের অদম্য ইচ্ছে, প্রেম-প্রতিরোধ, নান্দনিক কল্পনার প্রেমময় ঝংকার এসবের সম্মিলনই আমার জয়নব উপন্যাস। প্যারিসের আলো বাতাস থেকে মুক্ত হয়ে আমি এ উপন্যাস লিখেছি। আমার মস্তিস্কে কেবলই মিসরের অপার সৌন্দর্য। আমি যখন জয়নব লিখতে বসতাম, তখন ঘরের জানালাতে পর্দা টেনে দিতাম। কোনোপ্রকার বাইরের আলো যেন আসতে না পারে। বৈদ্যুতিক বাতির নিচে বসে লিখেছি। কেননা, আমি চাইনি আমার কল্পনাতে ভীড় করা মিসরের সৌন্দর্যে প্যারিস এসে সখ্যতা জমাক।
ড.হুসায়ন হাইকলের জীবন ছিলো বর্ণাঢ্য। তবে সে বর্ণাঢ্য জীবনে চড়াই-উতরাইও কম ছিলো না। মিসরে ফিরে আসার পর নিজ শহর মানসুরাতে আইন পেশায় নিযুক্ত হলেন। ১৯১৭ দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। পাশাপাশি সাংবাদিকতার পেশাতেও যুক্ত হন। শেষে ১৯২২ সালে রাজনৈতিক কারণে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চাকরিচ্যুত হন। তার পরের বছর ১৯২৩ সালে মিসরের স্বায়ত্তশাসন ও সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন হুসায়ন হাইকল। তিন বছর পর, ১৯২৬ সালে, সাপ্তাহিক রাজনীতি’র সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করার মাধ্যমে একসাথে সাহিত্য এবং রাজনীতি করার সুযোগ পান। তিনি দ্য লিবারেল সংবিধানবাদি দলের মুখপত্র ‘সিয়াসা’ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
১৯৩৭ সালে মুহাম্মদ মাহমুদ পাশার দ্বিতীয় মেয়াদের সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৪৫ সালে তাঁকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরবর্তী তাকে শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব অর্পণ করা হলে তিনি বিভিন্ন সংস্কার প্রবর্তন করেন। ১৯৪৩ সালে হাইকল মিসরের স্বাধীন সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন।
হুসায়ন হাইকল ছিলেন এক উজ্জ্বল মহিরুহ। যার নির্যাস মিসরের প্রতিটি অলিগলি থেকে পৃথিবীর নানানদিকে ধাবমান হয়ে সুবাস ছড়াচ্ছে। ক্ষণজন্মা মিসরীয় এ প্রতিভা ৬৮ বছর বয়সে তার বর্ণাঢ্য জীবনের যবনিকা টেনে পরপারে পাড়ি দেন।
সাহিত্যমোদিদের কাছে এক জয়নবের কারণেই তিনি বেঁচে থাকবেন। সুসাহিত্যিক এবং মিসরের রাজনীতির সাথে ওৎপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা আরবি উপন্যাসের জনক ড.হুসায়ন হাইকল দাম্পত্য জীবনে সাত সন্তানের জনক।