
ইফতেখার জামিল:
আল্লামা ইকবাল কখনো হেজাজ সফর করেননি। তবুও হেজাজের প্রতি তাঁর টান ছিল অনেক। তিনি তাঁর কবিতায় হেজাজের প্রতি ভালোবাসা ও বেদনার কথা বলেছেন। মক্কা-মদিনার রাস্তায় ঘুরেছেন কল্পনায়। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে কথা বলেছেন; ভারতবর্ষের সংকট ও স্বপ্নের যে কক্ষপথের তিনি অভিযাত্রী ছিলেন, বিনয়াবনত অভিযোগ ও ক্লান্তির সুরে সে-আলাপ করেছেন নবিজির সঙ্গে। এই অভ্যাস ইকবালের একার নয়, ফার্সি ও উর্দু ভাষার অনেক কবি এমন অলৌকিক আলাপচারিতায় মেতেছেন। যিনি সাইয়েদুল কাওনাইন ও রাহমাতুল্লিল আলামিন, তাঁর সঙ্গে তো বলার আছে অনেক কিছুই। আছে আক্ষেপ, জমাটবাঁধা অভিমান। ভালোবাসা যখন গভীর হয়, ভক্তির উচ্চতা থেকেও সম্পর্ক তখন হয়ে ওঠে ব্যক্তিগত।
ইকবালের জীবন নানারকম ব্যস্ততা ও অসুস্থতায় কেটেছে। গুছিয়ে হেজাজ সফরের ফুরসত হয়ে ওঠেনি। শেষজীবনে তিনি হেজাজ সফরের জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। একটা কাব্যগ্রন্থ লেখাও শুরু করেন। তাঁর ইচ্ছে ছিল হেজাজ সফরে উপঢৌকন হিসেবে কাব্যগ্রন্থটি নিয়ে যাবেন, ভালোবাসার দাবি ও নিবেদন হিসেবে পেশ করবেন হাবিবের দরবারে-দরজায়। গ্রন্থটির নাম দিয়েছেন আরমুগানে হেজাজ, হেজাজের হাদিয়া। তবে দুঃখজনকভাবে ইকবালের হেজাজে সফর করা হয়ে ওঠেনি। সবকিছু গোছানোর পূর্বেই তিনি মাওলায়ে মেহেরবানের দরবারে তাঁকে হাজিরা দিতে হয়েছে।
ইকবালের জীবনের এই বেদনা আমাকে নানাভাবে নাড়া দিত। মনে হতো, জীবনের অনেকটা তো চলে গেল, যাঁকে ঘিরে এতকিছু; কালিমায়ে শাহাদাত থেকে শুরু করে নামাজ ও জিহাদ, যাঁর কথা কুতুবে সিত্তায় জেনেছি ঘনিষ্ঠভাবে, তাঁর চিন্তা, যাপন ও সংগ্রাম, খাদিজার প্রতি তাঁর মহব্বত, আয়েশার সঙ্গে কাটানো একান্ত মুহূর্ত থেকে জিহাদ ও মুজাহাদা; তাঁর অস্থিরতা, কান্না, হাসি ও উদ্বেগ, এসব কিছু কত ঘনিষ্ঠভাবে জেনেছি, মুস্তফায়ে রাব্বিল আলামিন, তাঁর আবাসস্থলে না গিয়ে আমিও তো অগুনতি মানুষের মতো পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে পারি। তারচেয়ে বরং সব আগোছালোভাবে ওঠানো থাকুক, একটা ছোট সফরে হেজাজ থেকে ঘুরে আসি। মনে হলো, ইকবালের মতো কৈশোর ও যৌবনে আমারও আছে নানারকম স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা, বেদনা ও অভিমান, আমার একান্ত আরমুগানে হেজাজ।
দুই
ইসলামি ইতিহাসে দূর দেশ থেকে ওমরার জন্য হেজাজে সফর করা অতটা ব্যাপক ছিল না। হজ ছাড়া হেজাজ সফরের ছিল নির্দিষ্ট অর্থ। পড়াশোনার প্রাথমিক পর্ব শেষ করে তালিবে ইলমরা বের হতেন রিহলায়, ইলমি সফরে। মুসলিম বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। ইলমি মাদারেস, দীনি মারাকেজ ও সুফিদের খানকায় বিরতি দিতেন। পথে থাকত মেহমানখানা। মুসলমানরা তালিবে ইলমদের গুরুত্ব বুঝতেন। করতেন যথাযথ সমাদর। তালিবে ইলমরা রিহলায় কালের প্রখ্যাত শায়েখদের হালকা ও দরসে হাজির হতেন। সনদ সংগ্রহ করতেন। এবং সবশেষে হেজাজে আসতেন এবং কিছুদিন থাকতেন। মক্কা ও মদিনা সর্বদাই ছিল ইলম ও ইবাদতের মারকাজ। সারা বিশ্ব থেকে রিহলায় বের হওয়া তালিবে ইলমদের জমায়েত হতো। তাঁরা মুজাকারা, মুনাকাশা ও তাকরার করতেন। চিন্তা ও অভিজ্ঞতা বিনিময় করতেন এবং তারপর খেদমতের জন্য স্বদেশে ফিরে আসতেন। স্বদেশের রাজনৈতিক অবস্থা প্রতিকূল হলে অবস্থানের মেয়াদ বাড়ত। বাড়ত অভিজ্ঞতা।
আমরা আজকাল যেভাবে সংকলিত জ্ঞানভাণ্ডার পাই, একসময় মোটেই এমন ছিল না। ছিল হালকা ও রিহলার সমষ্টি। প্রতিটা হাদিসের সনদ ও ফিকহের কওল সংগ্রহের জন্য সফর করতে হতো। হাদিস ও ফিকহের কিতাবের পেছনে তাই লুকিয়ে আছে এমন শত শত হালকা ও রিহলাহ।
তালিবে ইলমরা শায়েখদের দরসে লিপিবদ্ধ করতেন ইলম। এভাবেই একসময় ইসলামি জ্ঞানব্যবস্থা সংকলিত রূপ পায়। শুরুতে অনেক আলেম এর বিরোধিতা করে বলেছিলেন, ‘ছাত্ররা তো অলস হয়ে যাবে, প্রত্যক্ষ বোঝাবুঝি হাসেল হবে না, কপিতে হবে অনেক সংযোজন ও বিয়োজন। ভুল বোঝাবুঝি।’ তবে ব্যাপকভাবে সংকলন শুরু হলেও রিহলাহ ও হালকা ছিল চলমান।
খোদ উপমহাদেশে ইলমি ও রাজনৈতিক ধারার বিকাশে এই রিহলার ভূমিকা ছিল অনেক। শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভি হেজাজ সফর থেকে ফিরে উপমহাদেশে ব্যাপকভাবে সুনান ও ফিকহের সিলসিলার চর্চা শুরু করেন। তিতুমীর ও হাজী শরীয়তুল্লাহও হেজাজ সফর থেকে নিয়ে আসেন আন্দোলনের স্প্রিহা। এভাবে উপমহাদেশের ইলমি ও রাজনৈতিক ধারার বিকাশে রিহলার ভূমিকা অপরিসীম। তবে উপনিবেশ ও আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের সীমান্তনীতিতে কাটা পড়ে যায় এই ইলমি ব্যবস্থা। ইসলামি ইতিহাসে এই প্রথম ইলম চর্চা দেশের গণ্ডির ভেতরে আটকে পড়ে। মানুষের চিন্তা হয়ে ওঠে জাতীয়তাবাদী। আন্তর্জাতিক হালকা ও রিহলাহ অনেক সীমিত হয়ে যায়। মানুষ এখনো বিদেশে পড়াশোনার জন্য যায়, হজ ও ওমরার সফরে যায় অগণিত মানুষ, তবে ঐতিহাসিক অর্থে রিহলাহ করার সুযোগ কারও হয়ে ওঠে না।
তিন
ওমরার সফরে যাওয়ার আগে এর মাকাসেদ নিয়ে কিছু পড়াশোনা করার চেষ্টা করেছি। ইমাম গাজালি ইহইয়াউ উলুমিদ দীনের মধ্যে হজ ও জিয়ারতের মাকাসেদ বর্ণনা করার চেষ্টা করেছেন। শাহ ওয়ালিউল্লাহ হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা’র মধ্যেও গুছিয়ে আলোচনা করেছেন। আল-আরকানুল আরবাআহ গ্রন্থে এর সমষ্টি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন আবুল হাসান আলি নদভি। প্রায় পঞ্চাশ পৃষ্ঠার দীর্ঘ আলোচনা।
মূলত হজ ও জিয়ারত বিষয়ে একটা মৌলিক প্রশ্ন আছে। ইসলামের মৌলিক আকিদা হচ্ছে, আল্লাহর ইবাদতের জন্য কোনো মাধ্যম ও অবলম্বনের দরকার নেই। পৃথিবীর সমস্ত ভূমি ইবাদতের জন্য সমানভাবে প্রস্তুত। ইবাদত পেশ করার জন্য কোনো পুরোহিত বা পাদ্রীর দরকার নেই। বরং কোরআন ও হাদিসে এই এই মাধ্যম-ব্যবস্থার নিন্দা জানানো হয়েছে। কেননা পর্যায়ক্রমে এভাবে শেরেকির প্রসার ঘটে। ধর্মের নামে গড়ে ওঠে ক্ষমতাকাঠামো ও ব্যক্তিপূজা। সম্মানের শিরোনামে গড়ে ওঠে বস্তুবাদী প্রাতিষ্ঠানিকতা, পুরোহিত ও মাজারের ব্যবসা। সুরা জুমারের শুরুতে আল্লাহ এই মাধ্যম-ব্যবস্থাকে জুলফা হিসেবে উল্লেখ করে একে খালেস তওহিদের প্রতিবন্ধক হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
এই মাধ্যম-ব্যবস্থার নিন্দা জানালেও ইসলাম মানুষের আত্মিক প্রয়োজন ও আধ্যাত্মিকতাকে অস্বীকার করে না। আত্মিক ভালোবাসা অবলম্বন ও প্রাসঙ্গিকতা চায়; স্থান, আকার বা চিহ্ন চায়। এখান থেকেই ইসলামে শাআয়ের ও মাশায়ের ধারণার জন্ম হয়েছে। অর্থাৎ যদিও মূলগতভাবে ইসলাম মাধ্যম-ব্যবস্থার বিরোধী, তবে মানবিক আবেগের অবলম্বন হিসেবে কিছু কাঠামো ও স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে, যেখানে বান্দারা আবেগের প্রাসঙ্গিকতায় ইসলাম ও ইসলামের ইতিহাসের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারবে।
হেজাযে অনেক নবির স্মৃতিচিহ্ন আছে। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম থেকেও ঐতিহাসিক স্থানে স্মৃতিচারণের প্রমাণ পাওয়া যায়। নবিজি ওয়াদিয়ে আজরাতে মুসা আলায়হিস সালাম ও হারশায় ইউনুস আলায়হিস সালামের স্মৃতি স্মরণ করেছেন। পাশাপাশি কাবা ঘরের আশপাশও ইবরাহিমি স্মৃতিতে পরিপূর্ণ। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম যদিও স্বতন্ত্র শরিয়ত নিয়ে এসেছেন, তবে এই শরিয়ত মিল্লাতে ইবরাহিমের ধারাবাহিকতা। মিল্লাতে ইবরাহিমের সাথে সম্পর্কযুক্তিও ওমরা-জিয়ারতের মৌলিক লক্ষ্য।
হজ ও ওমরায় পৃথিবীর নানাপ্রান্ত থেকে আসেন নিযুত মানুষ। সাথে নিয়ে আসেন আঞ্চলিক সংকট, সম্ভাবনা ও অভিজ্ঞতা। পারস্পরিক মতবিনিময় ঘটে। যদিও আধুনিক রাষ্ট্রের কাঁটাতারে কাটা পড়েছে উম্মাহর শরীর ও সম্পর্ক। উম্মাহর কোনো অঞ্চল আক্রান্ত হলে এখন আর আরেক অঞ্চলে প্রতিবাদ দানা বাঁধে না। সবাই ব্যস্ত একান্ত জাতীয়তাবাদী স্বার্থে। নাগরিক কল্যাণের সীমিত আয়তনে। হজ ও ওমরার মিলনায়তনে উম্মাহের বোধ জাগ্রত হয়। সাদা, কালো, বাদামি ও তামাটে মানুষ, আফ্রিকার নিগ্রো থেকে সোনালি চুলের শ্বেতাঙ্গ নারী, অনেকেই আরবিতে কথা বলছে, কান পাতলেই শুনবেন হিন্দি-উর্দু; বাংলাদেশিও পাবেন, পাবেন ফ্রেঞ্চ ও আফ্রিকান অজানা ভাষা। সব যেন জমায়েত হয়েছে একবিন্দুতে, মিল্লাতা ইবরাহিমা হানিফা!
আমরা সাধারণত যেসব ইবাদত করি, তার স্থায়িত্ব সীমিত। সীমিত সময়ে নামাজ শেষ করা যায়। রোজা ও জাকাত আদায় করার সময়েও যাপিত জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হয় না। ফলে আমাদের স্বাভাবিক লিপ্ততায় অনেক ক্ষেত্রে ইবাদত প্রভাব বিস্তার করতে পারে না; দুনিয়াদারির ব্যস্ততায় ঢেকে যায় ইবাদতের আসর। হজ ও ওমরার মধ্যে এটা সম্ভব নয়। এতে জীবনের নির্লিপ্ত লিপ্ততা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ইহরামের কাপড়সহ আল্লাহর দিকে মুতাওয়াজ্জেহ হতে হয়। একটা দীর্ঘ সময় ইবাদতের জন্য ওয়াকফ করতে হয়। ফলে, আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, একটা আবেশ তৈরি হয়। সবাই এক কাপড়ে, ধনী-গরিব-জাতপাত-বংশে কোনো পার্থক্য নেই। কারও কোনো শিক্ষা বা সামাজিক মর্যাদাগত প্রাধান্য নেই। সবাই একসুরে বলতে থাকে–লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক!
চার
আমাদের ফ্লাইট ছিল মার্চের ২৫ তারিখ বিকেলে। সফর ২২ দিনের, আসা-যাওয়ায় আরও দুইদিন–মোট ২৪ দিন। প্রথমে মক্কায় যাবো, সেখানে ১১ দিন থেকে মদিনায় বাকি ১১ দিন। বাসা থেকে বের হবার আগে আব্বু দোয়া করলেন। বিদেশ সফরের আগে দোয়া করা আমাদের পারিবারিক সংস্কৃতির অংশ। অন্যসময় বিদায় জানাতে গিয়ে আম্মু অঝোরে কেঁদে ফেলেন। এবার সেই প্রাসঙ্গিকতা ছিল না। সপরিবারে যাচ্ছি, তাই আমাদেরকে পারিবারিক বিদায় জানানোর কেউ নেই। আমি ইহরাম পরে উবার ডাকলাম। রাস্তায় বের হয়ে দেখি, সবাই একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। কেউ কেউ হাত মেলানোর চেষ্টা করছে। পুরান ঢাকার লালবাগে কেটেছে আমার শৈশব ও কৈশোর। যেতে যেতে ভাবলাম, যদি আর না ফিরি, যদি দুর্ঘটনায় পড়ি, তাহলে তো আর আরিফের চটপটি খেতে পারব না, শাহী জুস বা রয়েলের গ্রিল থেকে শুরু করে সেলিম মামার বট–অনেক কিছুই মিস করবো। ভাবতে ভাবতে বিমানবন্দরে পৌঁছুলাম। আমার এই প্রথম বিদেশ সফর।
ইমিগ্রেশন সহজেই শেষ হলো। বিমানে উঠে মানচিত্রে দেখলাম অনেক দূরের সফর। আমার মনে হলো, আমি এই প্রথম পৃথিবীর সঙ্গে সংযুক্ত হচ্ছি। গোলাকার পৃথিবীর প্রায় অর্ধেকটা পথ অতিক্রম করছি।
পৌঁছুলাম রাত ১০টার দিকে। সৌদি ইমিগ্রেশনের তরুণ আমার দিকে তাকাতেই আমি আরবিতে উত্তর দিলাম। তরুণ কাজ করতে করতে আমার সঙ্গে আলাপ জমাল। সে আঞ্চলিক আরবিতে কথা বলে। আমি অর্ধেক বুঝি তো বাকি অর্ধেক থাকে অস্পষ্ট। তবু কথা চালিয়ে নেওয়া যায়। মনে হলো, ভাষা অনেক শক্তিশালী মাধ্যম। ভাষা ছাড়া সংযুক্ত হওয়া অনেক কঠিন। বিমানবন্দর থেকে বের হবার আগেই সিম কোম্পানির লোকেরা জোর করে সিম ধরিয়ে দিল। বের হবার মুখে কারপার্কিংয়ে গিয়ে জানলাম কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। আধা ঘণ্টার মধ্যে বাস আসলো। আমরা মক্কার পথে রওনা দিলাম। হাইওয়ে রোড আলোকিত হলেও চারদিকে জমাট অন্ধকার। আমি জানালা দিয়ে চারদিক দেখার চেষ্টা করলাম। চারদিকে মরুভূমি। পাথুরে চরাচর। বড় বড় পাহাড়। জনবসতি নেই বললেই চলে। ভাবছিলাম, এই পথে কি কখনো কোন সাহাবি এসেছিলেন? এই পথের বয়স কত জানি না। গুগল করলে হয়তো জানা যেত।
মক্কায় পৌঁছুলাম একটার দিকে। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। আম্মু কড়াভাবে নির্দেশ দিলেন, আগে খেতে হবে। খাবার কিনতে বের হয়ে ভাবছিলাম, কী কেনা যায়, শুনেছি বাংলা খাবার নাকি পাওয়া যায়। এই মধ্যরাতে পাওয়া তো মুশকিল। একটু সামনে গিয়ে আরবিতে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘বাঙালি হোটেল আছে আশপাশে?’ ভদ্রলোক আমাকে নোয়াখালীর ভাষায় বললেন, ‘আঁর সাথে বাংলায় কন।’
হোটেলে গিয়ে আমি অবাক, এত রাতেও তাদের সব আয়োজন প্রস্তুত। মাছ-মাংস সবকিছুই আছে। রুই মাছ, ভর্তা ও ডাল দিয়ে মোটামুটি ভালোমাত্রায় খাওয়া হয়ে গেল। এবার ওমরার আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে হবে।
পাঁচ
আমরা বাঙালি পাড়ায় উঠেছিলাম। মিসফালায়। মক্কার কবুতর চত্বর থেকে দুটি পথ চলে গেছে সমান্তরালে। বামেরটার নাম শারেউল হিজরাহ। এই পথ ধরে মিনিট দুয়েক হাঁটলেই আমাদের হোটেল। আশেপাশের সবাই প্রায় বাঙালি। হোটেল, দোকান বা খাবারের দোকান, সবখানেই বাংলায় কথাবার্তা চলছে। শারেউল হিজরায় গাদাগাদি করে দালান উঠেছে। চক্রের মতো জড়িয়ে আছে অনেক গলি। আমার কাছে মাঝেমাঝে একে পুরান ঢাকার অংশ বলে ভ্রম হয়েছে।
সে যাই হোক। খাবার পর্ব শেষ। কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে ফজরের পরপর সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করলাম। এবার ওমরার উদ্দেশ্যে বের হবো। অনেক দিন থেকে কাবার যে ছবি মনে এঁকে রেখেছি, তার সাথে মিলিয়ে দেখবো বাস্তবের রূপ ও রূপকল্প। পথে পড়ল কবুতর চত্বর। মক্কা ওয়াচখ্যাত জমজম টাওয়ারের সামনের বিশাল প্রাঙ্গণে উড়ছে হাজারও কবুতর, এই প্রাঙ্গণকেই কবুতর চত্বর বলে। হারামের এরিয়ায় বলে কেউ কবুতরগুলোর কোনো ক্ষতি করে না। এই কবুতর প্রাঙ্গণ যেন মক্কার ঐতিহ্যের অংশ। কবুতরকে বলা হয় শান্তির প্রতীক, মনে হচ্ছিল শান্তির বাতাস গায়ে মেখে আমরা হাঁটছি বাইতুল্লাহর উদ্দেশে। আমি আগে কখনও ওমরা করতে আসিনি। কোন পথ ধরে যাবো বুঝতে পারছি না। জমজম টাওয়ারের বাম পাশের পথ ধরে এগুলাম। হোটেল থেকে তিন-চার মিনিট হাঁটতেই বাইতুল্লাহর চত্বরে পৌঁছুলাম। বাইতুল্লাহর চত্বর অনেক বিশাল, একে কোনো ছবিতে ধরা যায় না, এই বিশালতার চারদিকে মার্বেল পাথরে বাঁধানো সুদৃশ্য প্রাঙ্গণ। ঠাণ্ডা বাতাস। সূর্যের আলো উঁকি মারা শুরু করেছে। আমার কাছে মনে হলো আমি পবিত্রতম কোনো জায়গায় ঢুকে পড়লাম।
কয়েক মিনিট হাঁটতেই কাবা চত্বরে পৌঁছুলাম। বহুল আকাঙ্ক্ষিত সেই স্থান, আমার চোখে হাদিসের বিবৃত ঘটনাগুলো ভাসছিল। এখানেই তো ছিলেন হজরত ফাতেমা ও তাঁর বাবা, তাঁদের ঘিরে কাফেরদের বিদ্রুপ। প্রথম কাবা দর্শনে দোয়া কবুলের ওয়াদা আছে। আমি সাধ্যমতো দোয়া করলাম। আমার বোন কান্না শুরু করল। আমি স্বপ্নের কাবা ঘরকে দেখে দোয়া ভুলে যাচ্ছিলাম। তাওয়াফ করা শুরু করলাম। সকালবেলা বলে অতটা ভিড় নেই। তাওয়াফে হাঁটছি আমিসহ পরিবারের তিনজন, সাথে হাঁটছে অযুত মানুষ, একেকজন একেক দেশের, একেক বর্ণ ও ভাষার, কেউ অনেক লম্বা, কেউ-বা বেটে, কেউ আমাদের মতো মাঝারি আকারের, আমার কাছে মনে হচ্ছিল, আমি হয়তো এই প্রথম বৃহত্তর উম্মাহের সাথে সংযুক্ত হলাম। কাবা ঘরের থেকে কিছুটা দূর দিয়ে তাওয়াফ শেষ করলাম। কাবা ঘরের যত কাছে যাবেন, আনুপাতিকভাবে তত ভিড় বাড়বে, আবার বেশি দূরে গেলে চক্রাকারে ঘুরতে হয় বলে বাড়বে আনুপাতিক দূরত্ব। মাকামে ইবরাহিমকে ঘিরে কিছু মানুষের জটলা দেখলাম। কেউ চুমু দিচ্ছে, কেউ জড়িয়ে ধরে রেখেছে, নির্ধারিত নিরাপত্তা সদস্য বলছেন, এগুলো বিদআত। কিন্তু কে শুনে কার কথা। তাওয়াফের নামাজ পড়ে সাই’র উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। পথে জমজমের পানি খেলাম। সাই মানে সাফা থেকে মারওয়ার উদ্দেশ্যে হাঁটা। যেভাবে হেঁটেছেন ইসমাইল আলায়হি সালামের মা। এখন সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের কিছুই অবশিষ্ট নেই, এগুলোকে ঘিরে গড়ে উঠেছে কয়েক তলাব্যাপী স্থাপত্য। তবে দুই প্রান্তে দুই পাহাড়ের কিছু নিদর্শন রেখে দেওয়া হয়েছে। ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে ওমরার সব কাজ সম্পন্ন করে হোটেলে ফিরলাম।
ছয়
যেহেতু এটি ধর্মীয় সফর, তাই যথাসম্ভব অধিকাংশ সময় মসজিদেই কাটাতাম। তিলাওয়াত করতাম, কিতাব পড়তাম বা জিকির-দোয়া করতাম। ক্লান্তি লাগলে এমনিতেই চোখ বন্ধ করে বসে থাকতাম। মনে অদ্ভুত রকমের শান্তি এসে ভর করত। মক্কায় প্রতিবছর কোটি কোটি মানুষ আসেন। চারদিকে মুসাফিরদের জন্য ব্যবস্থাপনা। বাইতুল্লাহকে ঘিরে যে সংস্কৃতি বিকশিত হয়েছে, সেখানে সৌদির নাগরিক সমাজের খুব একটা বসবাস নেই। ফলে বাইতুল্লাহকে কেন্দ্র যে সংস্কৃতি ও চর্চা গড়ে উঠেছে, তাতে আরবদের প্রভাব কম। যেহেতু ভারতবর্ষ থেকে প্রচুর মানুষ আসে, তাই সেখানে ভারতবর্ষের প্রভাব অনেক বেশি।
ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও উপমহাদেশের নিয়ন্ত্রণ বেশি। তবে তার মধ্যে একটা আরবের মিশ্রণ আছে, সবাই একটা বিকৃত কথ্য আরবিতে কথা বলে, তাতে কিছু ইংরেজি ও উর্দু শব্দও ঢুকে গেছে।
বাইতুল্লায় ঢুকলে মনে অদ্ভুত শান্তি আসলেও আশপাশের পরিবেশ ও প্রতিবেশে সবকিছু অপরিচিত লাগে। বাইতুল্লাহ বাদে আশপাশের ঐতিহাসিক স্থাপত্যগুলো বিদআত চর্চার অজুহাতে গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তার বদলে চারপাশে নির্মিত হয়েছে পশ্চিমা স্টাইলে বহুতল ভবন। এতে জীবনযাপনের মান অনেক উন্নত হয়েছে, তবে হারিয়ে গেছে স্মৃতি ও ইতিহাস। বাইতুল্লাহতেও হয়েছে অনেক সংস্কার ও সম্প্রসারণ। যদিও আশপাশের অনেক স্থাপত্যকলায় মুসলিম ঐতিহ্যের প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়েছে, তারপরও এতে তো ঐতিহাসিক স্থাপত্যের উপস্থিতি ফিরিয়ে আনা যায় না। বাইতুল্লাহ থেকে বের হলেই মনে হয় আপনি বুঝি কোনো শপিং অঞ্চলে চলে এসেছেন। বাইতুল্লাহর পাশেই কেএফসি। বিশাল বিশাল শপিং মল। একে কে কীভাবে দেখবেন জানি না, তবে ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে এই পরিবেশে বেশ অস্বস্তি লেগেছে।
মক্কা পাথুরে শহর। চারদিকে বড় বড় পাহাড়। একটু হাঁটলেই কোনো পাহাড়ি পথে উঠে যাবেন। ঘরবাড়ি সেভাবেই নির্মিত হয়। ফলে বাংলাদেশে যেমন সবকিছু সমান্তরাল, মক্কায় এমন সমান্তরাল নয়, চারদিকে উঁচুনিচু বাড়ি। একটু দূরে তাকালেই দেখবেন, পাহাড়ের ওই উঁচুতে উঠে আছে জনপদ। মক্কার অবকাঠামো অত্যন্ত গোছানো ও শক্তিশালী। এই যে নিযুত মানুষের ভিড়, তবুও অবকাঠামো ও ব্যবস্থাপনার কল্যাণে অনেক সহজেই চলাফেরা করা যায়। বাইতুল্লাহর ভেতরের ব্যবস্থাপনাও অনেক গোছানো। জায়গায় জায়গায় জমজম পানের সুব্যবস্থাপনা। বিপুল সংখ্যক ব্যবস্থাপনা ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছেন। চারদিক ঝকঝকে পরিষ্কার। যদিও ঐতিহাসিক স্থাপত্য মোচনের অভিযোগ থেকে যায়, তবুও সৌদির অবকাঠামো ও ব্যবস্থাপনার প্রশংসা করতেই হবে।
সাত
মসজিদে হারামের আছে নিজস্ব সংস্কৃতি। মসজিদে হারাম শুধু ইবাদতের জায়গা নয়, শিক্ষা, চর্চা ও আলাপেরও জায়গা। মসজিদপ্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে এখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে, যাকে মা’হাদ বলে। অনেক হালকায় পড়াশোনায় লিপ্ত থাকেন শত শত ছাত্র। মা’হাদের বাইরেও শায়েখদের দরস, ওয়াজ ও মাসায়েলের চর্চা আছে। অন্য সকল মসজিদে থাকে শুধু আমল ও ইবাদত, বাইতুল্লায় এর পাশাপাশি আছে ইলম ও তাদরিস। বাইতুল্লাহর অভিজ্ঞতা থেকে মনে হলো, ইলমের চর্চাহীন মসজিদ অনেকটা নিষ্প্রাণ। আমি সুযোগমতো অনেকগুলো মা’হাদে বসেছি। ছাত্রদেও সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছি। তাঁদের মেজাজ ও চিন্তা বোঝার চেষ্টা করেছি। কয়েকদিনের অভিজ্ঞতায় আমার মনে হয়েছে, দেশভেদে ছাত্রদের চরিত্র ও আচরণ ভিন্ন হয় না। তাঁদের দেখে আমার কৈশোরকালের কথা মনে হলো, দরস শেষ হলে আমরাও তো ওদের মতো দুষ্টামিতে লিপ্ত হতাম। একজন আরেকজনের জুব্বা ধরে টান দেওয়া, গোল গ্রুপ পাকিয়ে বসা বা দরসের পেছনে বসে ফিসফিসিয়ে কথা বলা–আমাদের সাথে ওদের পার্থক্য খুব বেশি নেই।
এর পাশাপাশি মসজিদুল হারামে আগত মুসাফিরদের সঙ্গেও আলাপ জমিয়েছি। একটু ক্লান্তি লাগলে বা ঘুম পেলে আমি পাশের জনের সঙ্গে কথা বলা শুরু করতাম। তার দেশ কোথায়, দেশের পরিস্থিতি ও অগ্রগতি কী, সংস্কৃতি ও উন্নতি কেমন–এমন অনেক খুচরা আলাপ। মোটামুটি আরবি জানার কারণে কথা বলতে কষ্ট হতো না। এই আলাপের অভিজ্ঞতায় আমি বুঝেছি, পত্রিকা ও ম্যাগাজিনের সাথে প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনার পার্থক্য অনেক। কয়েকজন ইয়ামানির সাথে কথা বলে জানতে পারলাম, জায়দিদের একটা বড় অংশ হুতি নয়, বরং অনেক বড় জায়দি আলেম তাদের বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়েছেন। হুতি বরং ইরান প্রভাবিত রাজনৈতিক গোষ্ঠী, যাতে কিছু সুন্নিও আছে। কিছুক্ষণ কথা চালাচালির পর জানলাম, সে নিজেও জায়দি, তবে সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে সুন্নিদের সাথে তাদের তেমন কোনো পার্থক্য নেই। তবে ইয়ামানিরা সবাই বললেন, সময় ভালো যাচ্ছে না। নিরাপত্তা ও নাগরিক সুবিধার বেহাল দশা, অনেক অঞ্চলে বিদ্যুৎ নেই, তবুও ইয়ামানির মুখে হাসি–‘আল্লাহ ভালো রেখেছেন।’
সবার সাথে এমন ‘প্রেমপূর্ণ’ আলাপ হয়েছে ভাবলে ভুল করবেন। এক জুমার দিন আমার দুইপাশে দুইজন এসে বসলো। কথা বলার একপর্যায়ে জানতে পারলাম, বামেরজন ইবাদি (যাদেরকে আমরা ঐতিহাসিকভাবে খারেজি নামে চিনি) আর ডানেরজন সৌদি শিয়া। আমরা উম্মাহর ঐক্য, সংকট ও সমাধান বিষয়ে কথা বলছিলাম। আমরা তিনজনই উচ্চশিক্ষিত। শিয়াকে বললাম, ‘আমি কিন্তু তোমাদের অনেক বই পড়েছি। তোমাদের বাকের সদরের অনেক লেখা আমার খুব পছন্দ।’ সে খুব চমৎকৃত হলো। কথা চালাচালির এক পর্যায়ে আহলে বাইতের প্রামাণ্যতা প্রশ্নে শিয়া ও ইবাদির মধ্যে ঝগড়া লেগে গেল। আমি থামাতে চেষ্টা করেও সফল হলাম না। শিয়া লোকটি রেগে কয়েকটি কথা বলেই দ্রুত প্রস্থান করল। বুঝলাম, সে অত্যন্ত অন্ধচিন্তার মানুষ, পাশাপাশি সৌদি নাগরিক বলে নিরাপত্তা নিয়েও আশংকায় আছে। তাই দ্রুত কেটে পড়ল। ইবাদির বাড়ি ওমান। ব্যক্তিগতভাবে আমি ইবাদিদের সম্পর্কে তেমন কিছু জানতাম না। তার কাছে জিজ্ঞাসা করলাম সমস্ত বৃত্তান্ত। তার কথা শুনে আমার মনে হলো, ইবাদিদের সম্পর্কে বইয়ে যেসব লেখাজোখা আমরা পাই, তার অধিকাংশই অর্ধেক বা প্রান্তিক। তার কাছ থেকে কিছু ইবাদি কিতাব ও শায়েখের খোঁজ নিয়ে নিলাম। এবং একটা চমৎকার তথ্য হচ্ছে, এই ইবাদি ব্যক্তি ইখওয়ানুল মুসলিমিনের প্রতি বেশ দুর্বল।
তবে এর মধ্যে সবচেয়ে ভালো সম্পর্ক হয়েছে সুদানের ইবরাহিমের সাথে। সে পারিবারিকভাবে সালাফি। তার পূর্বপুরুষেরা ইরিত্রিয়ার অধিবাসী ছিলেন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও যুদ্ধে টিকতে না পেরে হিজরত করে সুদানে এসেছেন। ইবরাহিম আফ্রিকার সেই অঞ্চলের ইতিহাসের বিবৃতি দিতে থাকল। আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম নাজানা ইতিহাস ও সংগ্রাম। ইবরাহিম খারতুম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রযুক্তি শাখায় অধ্যয়নরত। মাথা অনেক পরিষ্কার। বয়স কম হলেও অনেক কিছু জানে। পরিষ্কার যুক্তি দিতে পারে। তার সাথে বিকেল চারটা থেকে শুরু করে রাত সাড়ে নয়টা পর্যন্ত আড্ডা দিলাম। সুদান ও বাংলাদেশের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে নানামুখী আলাপচারিতা চলল। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ভবিষ্যতে কী করার ইচ্ছা?’ সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বলল, ‘সুদানের আন্দোলন সফল হলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হবে। নয়তো দেশত্যাগ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই।’ ইবরাহিমের সাথে কথা বলার কয়েকদিনের মধ্যেই সুদানের সরকারের পতন ঘটল। আমি ওকে ম্যাসেঞ্জারে লিখলাম, ‘কাদ সাকাতান নিজাম!’
আট
দিনগুলো দ্রুত ফুরিয়ে আসছিল। দেখতে দেখতে মদিনা সফরের সময় চলে আসলো। মক্কায় থাকাকালীন আশপাশের এলাকা ছাড়াও জেদ্দা ও তায়েফে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। মক্কা থেকে জেদ্দা পৌনে এক ঘণ্টার দূরত্ব। ১০-১৫ রিয়ালের শেয়ারড ট্যাক্সিতে খুব সহজেই জেদ্দায় যাওয়া যায়। জেদ্দা স্বর্ণের শহর। বিকিকিনি ও সৈকতের শহর। শহরের পাশেই আছে লোহিত সাগরের অপূর্ব বিস্তৃতি। সৈকতে গেলেই চোখে পড়বে বিশ্বের সর্ববৃহৎ কৃত্রিম ঝর্ণা। তবে অস্বস্তির বিষয় হচ্ছে, স্থলভূমির মতো এখানকার সৈকতও পাথুরে। তাই সমুদ্রে নামার সংস্কৃতি চালু নেই। নামার পথ গ্রিল করে আটকে দেওয়া। বাঁধানো সৈকতে সমুদ্রের তীরকেও লেকের প্রাঙ্গণ বলে ভ্রম হয়। সন্ধ্যায় সেখানে হাঁটতে এসেছেন অনেকে। যুবক তার যুবতীকে নিয়ে এসেছেন। চল্লিশের কোটার দম্পত্তিদের সাথে অনেকগুলো শিশু চারদিকে মৌমাছির মতো দৌড়াদৌড়ি করছে। বৃদ্ধরা এসেছেন বৃদ্ধাদের হাতে হাত রেখে। চারদিকে আয়োজন করে সন্ধ্যা নামছিল। ইটপাথরের জঞ্জালে এই আয়োজনটা দেখা যায় না। খুব দ্রুত সূর্য ডুবে যাচ্ছিল। মোবাইল বের করে ছবি তুলতে তুলতে সূর্যটা ফাঁকি দিয়ে ডুবে গেল।
তায়েফ পাহাড়ি এলাকা। আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে বহু উঁচুতে যেতে হয়। আবহাওয়া অনেক সুন্দর। বাংলাদেশের কাছাকাছি। যেন নদীর পাশে হাঁটছি, এমন মৃদুমন্দ বাতাস। মক্কা থেকে অনেকটা দূরে। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এত দূরে এসেছিলেন ভাবতেও কেমন লাগে। মক্কা ‘ত্যাগ’ করে এসেছিলেন। তৎকালীন মক্কায় গোত্রব্যবস্থায় ‘‘ত্যাগ’ করার অর্থ ছিল চিরবিদায়। তায়েফের মসজিদে ইবনে আব্বাসে জোহরের নামাজ পড়লাম। অনেক সুন্দর ও গোছানো মসজিদ। আশপাশে কোথাও ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর কবর আছে। লোকজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কোথায় তাঁর কবর?’ একেকজন একেকদিকের কথা বলল। শেষপর্যন্ত বুঝলাম, বিদআতের ভয়ে এখানেও ঐতিহাসিক চিহ্ন মুছে ফেলা হয়েছে। তায়েফ মূলত আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়েছিলাম। এই প্রথম আরবের কোনো আবাসিক এলাকা দেখার সুযোগ হলো। বাড়ির প্রাঙ্গণে নানারকম গাছ লাগিয়ে রাখা হয়েছে। মরিচ গাছ। আম গাছ। এক কোণায় একটা বড়ই গাছে বড়ই ঝুলে আছে। খেয়ে দেখলাম আরবের মাটি ও আবহাওয়ায় স্বাদ পাল্টে গেছে। চারপাশে পাথরের পাহাড়। মাঝেমাঝে জনবসতি। যোগাযোগের অবকাঠামো অনেক ভালো। তবে নগরী থেকে দূরের বসতিগুলোতে নিজস্ব গাড়ি না থাকলে বেশ অসুবিধা।
সুযোগ পেয়ে পাশের এক পাথুরে টিলায় উঠলাম। শত শত পাথরের সংযুক্তিতে গড়ে উঠেছে একেকটা টিলা। একেক পাথর একেক রং ও বর্ণের। কোনো পাথর এমনভাবে কাঁত হয়ে আছে, দেখলে মনে হয়, বোধহয় এখনই পড়ে যাবে। টিলার ওপর দাঁড়ালে আশপাশের জনবসতি দেখা যায়। দেখা যায় সুশৃঙ্খলভাবে দাঁড়িয়ে থাকা হাজার বছরের ইতিহাসের সাক্ষী শত শত টিলা। গাড়িতে ফিরতে ফিরতে তায়েফে নবিজির দাওয়াত অভিযানের কথা ভাবছিলাম। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম আক্রান্ত হলেন। ফেরার পথে প্রচণ্ড অসহায় বোধ করলেন। মক্কায় ফেরার পথ বন্ধ। পথিমধ্যে আকুল হয়ে দোয়া শুরু করলেন–‘আল্লাহুম্মা আলাইকা আশকু দু’ফা কুওয়াতি ও কিল্লাতা হিলাতি ও হাওয়ানি আলান নাস… আল্লাহ, আমি দুর্বল, সম্বলহীন, অপমানিত, আমাকে কার কাছে ছেড়ে দিলা? আল্লাহ, তুমিও কি আমার ওপর রাগ করে আছো?’ মুফতি আমিনী রহমতুল্লাহি আলায়হি এই দোয়া বারবার পড়তেন এবং অঝোরে কান্না শুরু করতেন। এমন কত সুনানের স্মৃতি জড়িয়ে আছে তায়েফের সাথে!
মক্কা থেকে মদিনার দূরত্ব অনেক। সাড়ে চারশো কিলোমিটার। গুগল ম্যাপ বলছে যেতে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা লাগবে। লাগল ছয় ঘণ্টার মতো। সারাক্ষণ বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ওই অঞ্চলের অবকাঠামো ও প্রাকৃতিক পরিবেশে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। চারদিকে পাথুরে চরাচর। অনেক দূরে দূরে ছোটখাটো জনবসতি এবং মসজিদ। বাসে কিছুক্ষণ ঘুমানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। আমার ঠিক পেছনে এক আফ্রিকান দম্পতি অপরিচিত ভাষায় জোরে জোরে কথা বলছেন। কখনো হাসিতে ভেঙে পড়ছেন। কিছু বলি বলি করে মদিনায় পৌঁছে গেলাম।
নয়
মক্কার সাথে মদিনার মূল পার্থক্য হচ্ছে, মসজিদে নববি মসজিদুল হারামের মতো বৃত্তাকার নয়। মসজিদুল হারামের মতো চতুর্দিকে এর কেবলা নয়। মক্কার তুলনায় মদিনায় ভিড়ভাট্টা কম। পরিবেশ বেশ শান্ত ও সুন্দর। গুগল ম্যাপ বলল, ঐতিহাসিক বিরে বুদাআর কাছেই হোটেল। বিরে বুদাআহ ফিকহ ও হাদিসে অনেক আলোচিত কূপ। হোটেল থেকে ওহুদ দেখা যায়; সেই ওহুদ, যেখানে নবিজি সাল্লাল্লহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের রক্ত ঝরেছে। বিকেলে রওজা জিয়ারত করে মদিনার আন্তর্জাতিক বইমেলায় গেলাম। বইমেলা বসেছে মদিনা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে। মসজিদে নববি থেকে ১০-১৫ রিয়ালের বিনিময়ে ট্যাক্সিতে ২০ মিনিট-আধা ঘণ্টার দূরত্বে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়।
মেলায় রকমারি বই। বিপুল পরিমাণ অমুসলিম লেখকের বইও আছে। পরিমাণটা বাংলাদেশের বইমেলার ‘ইসলামি’ বইয়ের চাইতে বেশি। বাংলাদেশের সেকুলাররা কী পরিমাণ কট্টর, তার একটা চিত্র এখান থেকে পাওয়া যাবে। দর্শকদের মধ্যে বই কেনার প্রবণতাও অনেক বেশি।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, এখানে বইয়ের একটা চরিত্র দাঁড়িয়ে গেছে। গবেষণামূলক বইয়ের সংখ্যা বিপুল। প্রাচীন বইয়ের পরিমাণও কম নয়। এমন অনেক বই দেখলাম, যেগুলোর সাথে আমি পিডিএফের মাধ্যমে পরিচিত। ধরতে পেরে অদ্ভুত রকমের আনন্দ হলো। আবদুল্লাহ দাররাজের আদ-দীন ও দসতুরুল আখলাক আমার প্রিয় দুই বই। ধরতে পেরে মনে হলো, বিদেশের অদেখা আত্মীয়ের সাথে অবশেষে সামনাসামনি দেখা হলো। তবে খেয়াল করে দেখলাম, এখানে কোনো ইসলামপন্থী বা আশায়েরির বই স্থান পায়নি। যে যার এলাকায় যাকে হুমকি মনে করে, তার বই স্থান দেয় না।
আমার ভাই মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরিয়ে দেখালেন। সাজানো-গোছানো শক্তিশালী অবকাঠামো। এখানেই বাংলাদেশের সাথে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পার্থক্য টের পাওয়া যায়। বইমেলায় ঘুরে বেশ মজা পেলাম। একদিনে সব দেখে শেষ হলো না। এর পরদিন আমি একা গেলাম। আরেক দিক থেকে দেখা শুরু করলাম। আজকেও সব দেখে শেষ করতে পারলাম না। মেলার সেমিনারে বিগব্যাং থিউরি নিয়ে আলোচনা চলছিল। আমার মনে হলো, এটা তো বিশ্বায়নের যুগ। পৃথিবীর কোথাও কোনো তর্ক উঠলে সেটা সবখানে ছড়িয়ে যায়। কয়েকটা কিতাব কিনতেই টাকা সব শেষ হয়ে গেল। এর মধ্যে এক লাইব্রেরিতে ঢুকে পছন্দের একটা বই দীর্ঘক্ষণ দেখছিলাম। লাইব্রেরির মালিক বললেন, ‘তোমার কি বইটা পছন্দ হয়েছে? আমি সংশয় নিয়ে বললাম, ‘জি, পছন্দ হয়েছে।’ তিনি বইটা হাদিয়া দিয়ে দিলেন। আমি না করলে তিনি জোর করে গছিয়ে দিলেন।
এবার ফিরতে হবে। ট্যাক্সিস্ট্যান্ডের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। পথে এক বাঙালি শ্রমিকের সাথে দেখা হলো। তিনি ক্যান্টিনে কাজ করেন। গত বছর বাংলাদেশ থেকে ছয় লাখ টাকা খরচ করে এখানে এসে বিপদে পড়েছেন। বেতন মাত্র এক হাজার রিয়াল অর্থাৎ ২২ হাজার টাকা। এর মধ্যে টুকটাক নানারকম খরচ আছে। দেশে ঋণ করে এসেছেন। ফেরার সুযোগ নেই। আমি দেখলাম, তাঁর মুখে হতাশার চিহ্ন। তিনি জানালেন, তাঁর মতো এমন বাংলাদেশিী শ্রমিকের সংখ্যা মোটেই কম নয়। আমি অস্ফুট সুরে বললাম, একে কি ব্রোকেন আরব ড্রিম বলা যায়?
দশ
মদিনায় একদিন বিকেলে মসজিদে নববি থেকে ফিরছিলাম। থোকা থোকা বৃষ্টি পড়ছিল। হোটেলে ফিরে মনে হলো, আয়োজন করে জ্বর আসছে। আম্মুরা বাইরে ছিলেন। ইতিমধ্যে প্রচণ্ড জ্বর চলে এলো। প্রচণ্ড জ্বর বলতে যেমন জ্বরে সবকিছু কাল্পনিক লাগে। চারপাশ উলট-পালট মনে হতে থাকে। আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। ডাক্তার ঝুঁকি নিতে চাইলেন না। ওষুধের পাশাপাশি স্যালাইন দিলেন। তবে এতেও জ্বর কমল না। এর পরদিন সকালে আবার হাসপাতালে যেতে হলো। মোবাইল হাসপাতালের নার্সদের দেখে নজিব কিলানির আমিরাতুল জাবাল উপন্যাসের কথা মনে পড়ল। আমিরাতুল জাবাল আমার পড়া অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। বেশ কয়েকবার পড়ার ফলে উপন্যাসটাকে মনে হয় আমার পরিচিত কারও জীবনের অংশ। নার্স নিশ্চয় উপন্যাসটা পড়েননি। পড়লেও বলাটা ধর্মীয়ভাবে ‘ভদ্রতা’ হবে না। ডাক্তার বলে দিলেন, দিনের বেলায় হোটেল থেকে বের হওয়া চলবে না। সকাল ও সন্ধ্যায় মসজিদে যেতে পারব। মদিনায় আরও বেশ কয়েকদিন থাকব, তবে ডাক্তারের নির্দেশের ফলে অনেকটাই হোটেলবন্দী হয়ে গেলাম।
মক্কা-মদিনায় প্রধানত আমরা হোটেল থেকে কিনে আনা খাবার খেতাম। তবে এতে অনেক খরচ পড়ে যেত। খেয়েও তৃপ্তি মিলত না। একদিন আব্বু ইলিকট্রিক চুলা কিনে নিয়ে আসলেন। আগুনের চুলা সচরাচর পাওয়া যায় না। সাথে কাঁচাবাজার। আপু ও আম্মু আয়োজন করে রান্না-বান্না শুরু করলেন। ভাত, ডাল ও ছোটখাটো ভর্তাভাজি দিয়ে বেশ তৃপ্তিসহ খাওয়া শুরু করলাম। মদিনায় প্রথম দিন ভাই রুজ-বুখারি নামের খাবার আনলেন। পাকিস্তানি চাউলের সাথে মুরগির গ্রিল। স্থানীয়দের মতে এটি আফগানি খাবার। তবে দীর্ঘদিনের চর্চায় এটি এখন সৌদির নিজস্ব সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। রুজ-বুখারির পাশাপাশি সৌদিতে আলবাইক নামে একটি ফাস্টফুডের ব্র্যান্ড আছে। বেশ জনপ্রিয়, সাশ্রয়ী ও সুস্বাদু। সৌদিতে গেলে কোনোভাবেই আলবাইক মিস করা যাবে না। মদিনায় আম্মু-আপুরা মক্কার মতো ইলিকট্রিক চুলায় রান্না শুরু করলেন। তবে এখানে তেমন সুবিধা করতে পারলেন না। দুয়েকদিন যেতেই বারবার তার পুড়ে যেতে লাগল। একবার একটু ধোঁয়াও বের হলো। তাই বাধ্য হয়ে রান্না-প্রকল্প বাদ দিতে হলো। কেটারিং বা বাসায় রান্না করা খাবার কিনে খাওয়া শুরু করলাম। অনেক বাংলাদেশি এই কেটারিংয়ের সাথে যুক্ত। তাঁরা বাসায় রান্না করে হোটেলে খাবার সরবরাহ করেন। এমনিতে মক্কা-মদিনায় প্রশাসনিকভাবে মুসাফিরদের জন্য আগুনের চুলায় রান্না করা নিষিদ্ধ। তবে লুকিয়ে চুরিয়ে অনেকেই রান্না করেন।
মক্কার মতো মদিনার দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখলাম। মসজিদে কুবা, মসজিদে কিবলাতাইন ও ওহুদ প্রান্তরে গেলাম। আশপাশে আরও কিছু জায়গায়ও ঘুরলাম। কুবা অঞ্চলটা খুব সুন্দর। গ্রামের মতো। একটু পর পর বিশাল বিশাল খেজুরবাগান। খেজুরবাগান দেখলে বাংলাদেশের ফলবাগানের কথা মনে পড়ে। অবশ্য খেজুরবাগান আরও গোছানো থাকে। ভেতরে থাকে মালিকের বিলাসবহুল আবাসস্থল। শ্রমিকরা মালিকের অনুমতি নিয়ে বাগানের পাশে তরিতরকারির ক্ষেত করে থাকেন। মসজিদে কুবা মাঝারি আকারের মসজিদ। মসজিদের ভেতরে নামাজের পাশাপাশি সেলফি তোলার অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। দেখে অত্যন্ত বিরক্তি লাগল। ওহুদ প্রান্তরে বেশিক্ষণ থাকতে পারলাম না। প্রচণ্ড রোদ উঠেছে। কিছুক্ষণ থেকে গাড়িতে ফিরে আসলাম। ফেরার পথে মদিনার পাইকারি মার্কেটে গেলাম। কী নেই এখানে! আম থেকে শুরু করে বড়ই, হরেক রকমের তরিতরকারিও। আমরা নিলাম তুতফল, ময়মনসিংহের গ্রামের ভাষায় বলে তিপফল। সৌদির তিপফলগুলো অনেক বড় ও মিষ্টি। একে তায়েফের বিশিষ্ট ফল হিসেবে ধরা হয়। তায়েফে ও মদিনার বাজারে প্যাকেটে বাঁধাই করা অনেক গোলাপ ফুলও দেখলাম। কিনতে খুব ইচ্ছা করছিল, কিন্তু দেবো কাকে? এখনো তো কোনো নারীর হাত আমার একান্ত হয়নি।
এগারো
শেষ করার আগে মদিনা ও আরবের সংস্কৃতি ও রাজনীতি নিয়ে কয়েকটি মন্তব্য করতে চাই। মক্কার তুলনায় মদিনায় মানুষের চাপ কম। মনে হয়েছে তুলনামূলক স্থানীয় অধিবাসীর সংখ্যা বেশি। মসজিদে হারামের মতো মসজিদে নববিতেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। সম্ভবত মদিনায় পড়ালেখার পরিধি একটু বড়। মসজিদে একটু পর পর জায়গায় জায়গায় দায়িত্বশীল মুয়াল্লিম। তাঁদের কাছে নির্দিষ্ট ছাত্ররা কোরআন শোনাচ্ছে। কেউ দেখে দেখে, কেউ মুখস্থ, কেউ অন্য রেওয়ায়েত ও কেরাআতে। মুসাফিররাও তেলাওয়াত শোনাচ্ছেন। কাউকে আবার মুয়াল্লিমরা নিজেরাই ডেকে নিচ্ছেন।
একদিন আমার পাশে বসে এক পাকিস্তানি তেলাওয়াত শোনাচ্ছিলেন। তিনি ওলাজজাল্লিন পড়লে মুয়াল্লিম ভুল ধরলেন, পাকিস্তানি কোনোভাবেই তাঁর ভুল স্বীকার করতে রাজি ছিলেন না। বললেন, আমাদের ওইখানেও অনেক আলেম আছেন, আমি তাঁদের থেকেই শিখেছি। মসজিদুল হারাম ও নববিতে খাবারের কোনো অভাব নেই। একটু পর পর একেকটা খাবার আসছে। বিশেষত সোম ও বৃহস্পতিবার ইফতারের সময় প্রচুর খাবার আসে। কেউ যদি সারাদিন হোটেলে না গিয়ে মসজিদে বসে থাকে, তাহলে তার দিন চলে যাবে। বিলিকৃত খাবারে পূর্ণ হবে তার খাদ্যচাহিদা। সৌদির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থা এখন খুব একটা ভালো নয়। তেলের দাম পড়ে গেছে। সৌদি ইয়ামান-যুদ্ধে জড়িয়ে লুকসান গুণছে হাজার হাজার কোটি টাকা। তেলনির্ভর বলে সৌদির অর্থনীতি উৎপাদনশীল নয়। অলসতা ও বেকারত্বের হার অনেক বেশি। শিক্ষার অবকাঠামো ভালো হলেও নাগরিকদের মধ্যে শিক্ষার মান অনেক কম। তবে তুলনামূলকভাবে মানুষের মধ্যে ধর্মীয় শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রভাব অনেক বেশি। যেহেতু রাজতন্ত্র, তাই নাগরিকদের মধ্যে গণপরিসরে অংশগ্রহণ অনেক কম। ফলে সৌদিতে রাজনৈতিক সম্মতি ও বৈধতার একটা বড় সংকট আছে। এখন কার্যত রাষ্ট্রক্ষমতায় আছেন মুহাম্মদ বিন সালমান, এমবিএস। তিনি পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত। আগের শাসকদের মতো সাধারণ নন। অসাধারণ, তবে সেটা ভালো নাকি খারাপ অর্থে, সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে অনেকদিন। তিনি অর্থনীতি ও রাজনীতিতে সংস্কার আনার চেষ্টা করছেন। তেলের উপর নির্ভরতা কমাচ্ছেন। ট্যাক্স ও ভ্যাট চালু করেছেন। পর্যটন ও উৎপাদনে জোর দিচ্ছেন। সাংস্কৃতিক প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে রাজনৈতিক সম্মতি ও বৈধতা লাভেরও চেষ্টা চালাচ্ছেন। বিনোদনের ব্যাপক আয়োজন করছেন। ধর্মীয় ও মানবাধিকার সংশ্লিষ্টদের ওপর অনেক বিধিনিষেধ আরোপ করেছেন। তাতেও না থামানো গেলে পুরছেন জেলে। বিদেশিদের ওপর আরোপ করেছেন মোটাঅংকের ট্যাক্স। ট্যাক্সে গৃহীত টাকা আবার গরিব সৌদিদেরকে দিচ্ছেন। এই দ্বৈত চরিত্রের কারণে তিনি অনেক সৌদি তরুণের দৃষ্টিতে সংস্কারক, গরিবদের চোখে রবিনহুড।
সৌদিতে সবমিলিয়ে একটা উৎকট জাতীয়তাবাদী পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। সৌদিতে অভিবাসনের আইন থাকলেও কার্যত ভিনদেশি কেউ নাগরিকত্ব পাচ্ছেন না। ফলে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশগুলো যেভাবে বিদেশি মেধা ও বিনিয়োগকে আকর্ষণ করছে, সৌদি সেভাবে এগুতে পারছে না। তবে সৌদিতে আছে বিপুল সংখ্যক প্রবাসী। অবশ্যি সে আরেক দুর্ভাগ্যের গল্প। প্রবাসীদের স্বাধীনভাবে কোনো ব্যবসা বা উদ্যোগ নেবার সুযোগ নেই। মালিকানা গ্রহণের কার্যত অনুমতি নেই। কোনো স্থানীয় সৌদিকে স্পন্সর বা কাফিল বানিয়ে কার্যক্রম চালাতে হয়। তাকে দিতে হয় মোটাঅংকের টাকা। এতে একদিকে যেমন পণ্যের দাম বাড়ছে, অপরদিকে অনেক টাকা চলে যাচ্ছে অনুৎপাদনশীল খাতে। এই কাফালাতব্যবস্থা অনেকটা পুরান ঢাকার বাড়ির ব্যবসার মতো। আপনার বাড়ি আছে। আপনি পায়ের ওপর পা তুলে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছেন। এই দুষ্টচক্রের ধাঁধাঁয় পড়ছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। অর্থনীতি দুর্বল হচ্ছে, সামাজিক ব্যবস্থা ও মূল্যবোধ সক্রিয় হতে পারছে না।
আগেই বলেছি, সৌদির মানুষের মধ্যে স্বভাবজাতভাবে অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে ধর্মীয় প্রভাব অনেক বেশি। মসজিদে মসজিদে শিক্ষার আয়োজন থাকায় ধর্মীয় সচেতনতাও বেশি। তবে ছদ্মবেশী জাতীয়তাবাদ খেয়ে ফেলছে এই অর্জন। কাফালতব্যবস্থার ফলে বিদেশিদের প্রতিষ্ঠিত হবার সুযোগ কার্যত বন্ধ। এভাবে একরকম জাতীয়তাবাদী ঘৃণারও সৃষ্টি হচ্ছে। বিয়ের জন্য প্রচুর শর্ত-শারায়েত আছে। প্রচুর অবিবাহিত মেয়ে থাকা সত্ত্বেও কার্যত বিদেশিদের কেউ বিয়ে করে না। পাশাপাশি উগ্র সালাফিবাদের প্রসারের ফলে সাংস্কৃতিক চর্চা একদম নাই হয়ে গেছে। তবে কোনো কিছুই তো শূন্য থাকে না। এখানে ঢুকে যাচ্ছে পশ্চিমা সংস্কৃতি। সৌদিদের মধ্যে পশ্চিমাদের প্রতি মুগ্ধতা অনেক বেশি। মুহাম্মদ বিন সালমান এই শূন্যস্থান পূরণের চেষ্টাই করছেন, তবে সেটা কতটা ইসলামিক পন্থায় সে নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
বারো
মদিনার অবস্থানের সময়ও শেষ হয়ে আসছে। ওমরার সফর মাত্র ২২ বা ২৪ দিনের হলেও সে স্বাভাবিক ২৪ দিন নয়। এই কয়েক দিনের আছে অনেক স্মৃতি ও গল্প। আমি গল্প শুনতে ও বলতে ভালোবাসি। ফলে এই কয়েক দিনের সফরের আছে অসংখ্য গল্প। তাই যত বড় ভ্রমণকথাই লিখি, আমার কাছে মনে হবে লিখছি অসমাপ্ত আখ্যান। এই লেখায় সৌদির সংস্কৃতি ও রাজনীতির অনেক সমালোচনা করেছি। তবে আবুল হাসান আলি নদভির মতো আমারও মনে হয়েছে, আরবরা সম্ভাবনার আঁধার। তাদের আবেগ, ইখলাস ও জজবা অনেক বেশি।
মসজিদুল হারামে একদিন বসে আছি। পাশের বৃদ্ধের সাথে কথা বললাম। তিনি রিয়াদ থেকে এসেছেন। মাঝেমাঝেই আসেন। এসে সপ্তাহ দুয়েক থেকে যান। তাঁর কাছে আমার সমালোচনাগুলো বললাম, তিনি মাথা নেড়ে একমত প্রকাশ করলেন। বললেন, ‘জামিল, দ্যাখো, অনেক ত্রুটি হয়তো আছে। তবে আছে অনেক সম্ভাবনা। আসলে আমাদের সভ্যতার সংকট। উম্মাহের সামগ্রিক সংকট। শুধু রাষ্ট্রের দিকে তাকিয়ে পর্যালোচনা করলে সেটাও জাতীয়তাবাদী পর্যালোচনায় রূপান্তরিত হবে। এখনো এখানে আমার মতো অনেকে আছে, যারা নিজের চেষ্টায় ইলম শিখছে, চর্চা করছে ও জজবা ধরে রেখেছে। উম্মত যখন জাগবে, কোনো নেতা আমাদের ডাক দেবেন, তিনি পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুন, তাঁর পতাকাতলে ছুটে যাব।
ওমরার সফরটা ছিল অসাধারণ এক কালযাত্রা। অনেক ও অনেক স্মৃতি। আমি অনেক সময় মসজিদের চারপাশে পায়চারি করতে করতে ভেবেছি নিজের কথা, দেশ ও উম্মাহের কথা। রমজানের আগে মদিনায় রওজা জিয়ারত করা ছিল বেশ সহজ। কখনো চার-পাঁচ মিনিটেই জিয়ারত শেষ করতে পেরেছি। একদিন রওজার পাশে দাঁড়িয়ে তরুণ কবি হাসান রোবায়েতের কবিতা পড়লাম। মনে হলো আমি কিছু কবিতা লিখলেও স্বভাবকবি তো নই, আমার ভাষিক অক্ষমতা অনেক, তবুও হাসান রোবায়েতের দোহাইয়ে ইকবালের অসমাপ্ত আরমুগানে হেজাজের আনুষ্ঠানিকতা তো সারতে পারি। আমি কবিতা পড়া শুরু করলাম:
সাক্ষ্য দুপুরের মালিদও
সাক্ষ্য ঘুঘুভরা মেঠো তারা
সাক্ষ্য ভোরশীতে মায়ারোদ
নানির হাতে মাখা আস্বাদ
সাক্ষ্য কঞ্চিতে মাছরাঙা
সাক্ষ্য জেলেদের কালো গাও
সাক্ষ্য এক ডুবে ধরা মাছ
বাঁশের ফুলে ফোটা সন্ধ্যাও
সাক্ষ্য বেনেবউ পাখিটার
সাক্ষ্য হাতে বোনা ছোট ডালা
সাক্ষ্য বাতাসের রন্ধ্রতে
কাঁদছে হুসেনের কারবালা
সাক্ষ্য ভেড়াদের ঝুনঝুনি
সাক্ষ্য বন্ধুর কাছে ঋণ
মোহাম্মাদ, প্রিয় দরদিয়া
রাহমাতাললিল আলামিন—
লেখক : সম্পাদক, ফাতেহ টোয়েন্টি ফোর ডটকম