
আশরাফুল ইসলাম সাদ:
১.
‘আমি তোমাকে ফাঁসিতে ঝুলতে দেখে খুবই খুশি হবো’—আত্মতৃপ্তির সাথে বলে উঠলেন ফৌজদারি আদালতের ইংরেজ জজ। যেন জাফর আহমদ থানেশ্বরী রহ.-কে ফাঁসিতে ঝোলানোর জন্যই তার বেঁচে থাকা; যেন তার জীবনের একমাত্র চাওয়াই ছিল এটি; অথচ একটিবারের জন্যও তিনি জানতেন না, তাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হবে না, আর একথা না জেনেই তিনি দুনিয়া থেকে চির বিদায় নেবেন।
রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে আলিগড় থেকে কয়েকজন সাথীসমেত গ্রেফতার হলেন মাওলানা জাফর আহমদ থানেশ্বরী। দিনটি ছিলো ১৮৬৩ সালের ১৫ই ডিসেম্বর। পশ্চিম সীমান্তবর্তী এলাকা ইয়েগেস্তানে ইংরেজদের নাস্তানাবুদ করেছে যে মুজাহিদেরা, তাদের অর্থ ও জনবল দিয়ে সাহায্য করেন তিনি। অভিযোগ প্রমাণিত নয়; কিন্তু অভিযোগ আছে তো —এটাই যথেষ্ট!
অভিযোগ দায়ের করেছে গজন খান নামের ইংরেজপন্থী পুলিশ। সমগ্র বাংলা থেকে হাজার হাজার মুসলিম গাজী বা শহীদ হওয়ার আকাঙ্খায় পাটনার সাদিকপুরে আহমদুল্লাহ সাহেবের বাড়ীতে জমায়েত হতো। সেখান থেকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে সিত্তানার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হতো। এমন একটি দলের চারজনকে আম্বালা যাওয়ার পথে এই পাঞ্জাবী সার্জেন্ট গ্রেফতার করে। ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে তারা নিজদেরকে নির্দোষ ও নিরীহ পথচারী বলে জানালে ম্যাজিস্ট্রেট তাদেরকে মুক্তি দেন। গজন খান মনে বড়ো দুঃখ পায় এবং বলে, থানেশ্বর নিবাসী জনৈক জাফর আলী সিত্তানায় মুজাহিদ ও রসদ পাঠানোর কাজ করেন। অভিযোগের ভিত্তিতে ১১ই ডিসেম্বর তল্লাশি চালানো হয় তার বাড়িতে। তেমন কিছুই পাওয়া যায়নি। শুধু একটি চিঠি। মুহাম্মাদ শফি আম্বালুভির কাছে লিখা চিঠি। সাংকেতিক ভাষায় এই চিঠির কিছুই বুঝতে পারেনি ইংরেজরা। তবে যোগসূত্র তো পাওয়া গেছে। মুহাম্মাদ শফি আম্বালুভি গ্রেফতার হলেন। বাজেয়াপ্ত করা হলো তার পঞ্চাশ লাখ রুপির বিশাল জমিদারী। চলতে থাকলো গ্রেফতারযজ্ঞ।
২.
জীবিত সাইয়েদ আহমাদ থেকে মৃত সাইয়েদ আহমাদ ছিলেন ইংরেজদের বড় হুমকি। বালাকোট বিপর্যয়ের পর আন্দোলন আর কেন্দ্রীভূত থাকেনি, ছড়িয়ে পড়ে পুরো ভারতে। মাওলানা এনায়েত আলী, মাওলানা বেলায়েত আলী পরবর্তীতে মাওলানা ইয়াহহিয়া আলী, মাওলানা আহমাদুল্লাহ, মাওলানা আব্দুর রহিম, মাওলানা জাফর আহমদ থানেশ্বরীদের নেতৃত্বে চলা এই আন্দোলনের উৎস খুঁজতে গিয়ে চৌকস ইংরেজ গোয়েন্দারাও হয়রান হয়ে যায়।
গোপনীয়তা রক্ষার্থে তারা অসাধারণ সাংকেতিক ভাষা আবিস্কার করেছিলেন; যেমন, যুদ্ধকে বলতেন মোকাদ্দামা, মোহরকে লালমুতি আর দলনেতা মাওলানা আহমাদুল্লাহ সাহেবকে কিতাবওয়ালা।
জাফর আহমাদ থানেশ্বরী গ্রেফতার হলে ইংরেজরা সূত্র পেয়ে গেল। তার সাথে যাদেরই যোগাযোগ ছিল গ্রেফতার হতে থাকলেন। গ্রেফতার হলেন মাওলানা ইয়াহইয়া আলি, মাওলানা আব্দুর রহিম রহ.-সহ অনেকে। মাওলানা আহমাদুল্লাহ রহ. যেহেতু ডেপুটি মেজিস্ট্রেটের মত প্রভাবশালী সরকারী কর্মকর্তা ছিলেন, তাই তাকে গ্রেফতার শুধু সন্দেহের ভিত্তিতে গ্রেফতার করা গেল না। তাছাড়া আরেকটা ব্যাপারও ছিল, সিপাহী বিদ্রোহের সময় তাকে গ্রেফতার করে অপরাধ প্রমাণ করা যায়নি। উল্টো নির্মমতার দায়ে তদন্ত কমিশনার টেইলারকে কমিশনারের পদ থেকে অপসারণ করা হয়।
৩.
وَلَسْتُ أُبَالِي حِينَ أُقْتَلُ مُسْلِمًا* عَلَى أَيِّ جَنْبٍ كَانَ فِي اللهِ مَصْرَعِي
وَذَلِكَ فِي ذَاتِ الإِلَهِ وَإِنْ يَشَأْ * يُبَارِكْ عَلَى أَوْصَالِ شِلْوٍ مُمَزَّعِ
‘মুসলিম হিসেবে নিহত হলে আর কিছু পরোয়া করি না, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যেভাবেই আমাকে শোয়ানো হোক, আমি রাজি। আল্লাহর জন্যই আমার এই মৃত্যু । তিনি চাইলে আমার খণ্ডিত টুকরাতেও বরকত দিতে পারেন।’
বন্দি হওয়ার পর থেকেই মাওলানা ইয়াহইয়া আলি খুবাইব রাদি.-এর এই শের আবৃত্তি করে যাচ্ছেন। আদালতে উঠানো হচ্ছে। শুনানি হচ্ছে। কিন্তু কারো মধ্যে কোনো বিকার নেই। কোন হাতাশা নেই। কোন আফসোস নেই।
অন্য বন্দীরা উকিল নিয়োগ করলেও মাওলানা থানেশ্বরী নিজের মামলা নিজেই লড়ছেন। বন্দীদের বিরুদ্ধে সাক্ষী পেশ করা হচ্ছে। মুহাম্মাদ শফির বিরুদ্ধে সাক্ষী বানানো হয়েছে তার ভাই মুহাম্মাদ রাফিকে। মাওলানা থানেশ্বরীর বিরুদ্ধে তার ভাই মুহাম্মাদ সাইদ আর কাজের ছেলে আব্বাস।
মুহাম্মাদ সাইদ কাঠগড়ায় দাঁড়ালো সাক্ষী দিতে। নিজের ভাইয়ের বিরুদ্ধে। বলতে শুরু করলো। কিন্তু ইংরেজদের শিখিয়ে দেয়া কোনো কথাই বলতে পারলো না। শেষে রেগে গিয়ে সাক্ষী তালিকা থেকে তার নাম কাটা হলো।
কাজের ছেলে আব্বাস ও নিজের মালিকের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে গেল। তারও একই অবস্থা। কিন্তু মুহাম্মাদ সাইদের মত তার ভাগ্য ভালো ছিল না। নির্যাতনে মৃত্যু হলো। বাইরে প্রচার হলো, রোগে ভুগে স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে।
এমন কয়েকজন আত্মীয়তার বন্ধন ভুলে সাক্ষী দিতে না পারলেও সাক্ষীর অভাব ছিলো না। পুরো এক সপ্তাহ শুধু সাক্ষী গ্রহণই চলল। সকল সাক্ষী প্রমাণের উপর ভিত্তি করে ১৮৬৪ সালের ২রা মে ঐতিহাসিক এই মামলার রায় ঘোষণা হলো। মাওলানা ইয়াহইয়া আলি, মাওলানা জাফর আহমদ থানেশ্বরী ও হাজি মোহাম্মদ শফির ফাঁসি, বাকি আটজনকে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের আদেশ দেয়া হলো। পাশাপাশি সমুদয় সম্পদ বাজেয়াপ্ত।
উচ্চ আদালতে আপিল হলো। আসামী পক্ষের আইনজীবী প্লোডন আদালতে প্রমাণ করলেন, ‘আইনের ১২১ দফা মোতাবেক এ ব্যাক্তিদের গ্রেফতার করাই আইন সঙ্গত নয়।’ তার যুক্তি বিচারক সকলের সামনে মেনে নিলেন। কিন্তু পরামর্শের অযুহাতে আদালত মুলতবি করলেন কোনো রায় না দিয়েই। পত্রিকায় নিউজ হয়ে গেল ষড়যন্ত্র মামলার আসামিরা মুক্তি পেতে যাচ্ছেন।
এই আদালত মুলতবি থাকল দীর্ঘ আট মাস। এই পুরো সময় তারা আটকে আছেন কনডেম সেলে। এ সেল সম্পর্কে মাওলানা থানেশ্বরী বলেন, নবাব সিরাজুদ্দৌলার ব্ল্যাক হোল কামরা থেকে অন্ধকার সঙ্কীর্ণ প্রাকোষ্ঠ। প্রথম রাতেই মনে হলো, এ যেন জাহান্নামের নমুনা।
ফাঁসির আদেশ মাথায় নিয়ে এমন জাহান্নামসম প্রাকোষ্ঠে থেকেও তারা কোনোরূপ বিচলিত হননি। একদম স্বাভাবিক বরং আরো উৎফুল্লতায় তাদের দিন কাটছিলো। ইংরেজ কর্মকর্তারা স্বপরিবারে অনেকটা চিড়িয়াখানা দেখার মতই তাদের দেখতে আসতো। দেখে বরং তারা বিচলিত হতো। কোনো ফাঁসির আসামিকে তো এমন প্রফুল্ল দেখেনি!
প্রবল ঈমানের এই তেজ কারাপ্রহরীদেরও ভক্ত বনিয়ে দিল। এক রাতে তাদের কাছে প্রস্তাব আসল, আমরা গেট খুলে দেই। এই অন্ধকারে আপনারা পালিয়ে যান। সহাস্যবদনে এই প্রস্তাব তারা ফিরিয়ে দিলেন।
একদিন হঠাৎ বাতিল হয়ে গেল ফাঁসির আদেশ। আদেশ আসলো যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের। অদ্ভুত কারণ। চিফ কোর্টের আদেশে লেখা হলো, তোমরা ফাঁসির রশি গলায় পরতে অনেক পছন্দ করো। একে মনে করো শাহাদাত। তাই সরকার তোমাদের কাঙ্ক্ষিত এই সাজা তোমাদের দেবেন না। ফাঁসির বদলে তোমাদের কালাপানির দ্বীপে যাবজ্জীবন নির্বাসন দেয়া হচ্ছে। ক্যালেন্ডারে সেদিন ছিল ১৮৬৪সালের ১৬ই ডিসেম্বর।
পঁচিশ বছরের যুবক মাওলানা থানেশ্বরী। জীবনের সুখময় অধ্যায় চলছে। যৌবনের মধুময় এই সময়কে তিনি বিসর্জন দিলেন এক স্বপ্নের পেছনে। এই স্বপ্ন দেশ ও জাতির স্বপ্ন।দেশ জাতির স্বাধীনতার স্বপ্ন।
৪.
মাওলানা আহমাদুল্লাহ রহ.-কে এখনো গ্রেফতার করা যায়নি। তাঁর বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ নেই। প্রমাণ লাগবে। প্রমাণ না পেলেও বানাতে হবে। সেই উদ্দেশে মাওলানা থানেশ্বরীদের প্রস্তাব দেয়া হলো মাওলানা আহমদুল্লাহর বিপক্ষে সাক্ষী হতে। সাক্ষী হলে সব মাফ। বাজেয়াপ্ত সম্পদও ফিরে পাবে। কিন্তু কেউ রাজি হলো না।
উপরে রিপোর্ট গেল, মাওলানা ইয়াহইয়া আর মাওলানা থানেশ্বরী থাকলে কাউকে সাক্ষী বানানো যাবে না। তাদের লাহোর জেলে বদলি করা হলো। তাঁরা যেতে না যেতেই মুহাম্মাদ শফিসহ আরো কয়েকজন সাক্ষী হয়ে গেল। ফাঁসির আসামি হয়েও তিনি মুক্তি পেয়ে গেলেন। তাদের সাক্ষীর ভিত্তিতে ১৮৬৫সালে মে মাসে মাওলানা আহমাদুল্লাহ রহ. বন্দি হলেন। তাকে বন্দি করেই তার বাড়িকে মিউনিসিপ্যাল (পৌর) মার্কেটে পরিণত করা হয়। এর নির্মাণকার্যের ব্যয় বহন করা হয় এ পরিবারের অন্যান্য সম্পত্তির বিক্রয়লব্ধ অর্থ দিয়েই। সাদিকপুরের ঐতিহ্যবাহী কবরস্থান —যেখানে শুয়ে আছেন বিখ্যাত আলেমগণ— চাষ দিয়ে উপড়ে ফেলা হলো। শেষে জমিটি দিয়ে দেয়া হলো হিন্দুদের।ইংরেজ সরকার তার উপর এত নির্মম হয়েছিল যে, ঈদের দিনে তার পরিবারকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয় শুধুমাত্র একবস্ত্রে ও খালি হাতে।
একই বছরের জুনেই তাঁকে পাঠিয়ে দিল কালাপানিতে। ১৫ই জুন তিনি কালাপানি পৌঁছেন।
৫.
১১ই জানুয়ারি ১৮৬৬ সালে জাহাজে করে মাওলানা ইয়াহইয়া আলি ও মাওলানা জাফর আহমদ থানেশ্বরী আন্দামানের কালাপানি দ্বীপে পৌঁছেন। আগে থেকে সাজাপ্রাপ্ত বন্দিরা তাঁদের বন্দরে এসে গ্রহণ করে নেয়। তখন আন্দামান মূলত উন্মুক্ত বন্দিশালা ছিল। নিয়ম কানুনের তেমন কঠোরতা ছিল না। সকলকে নির্দিষ্ট কিছু কাজ দেয়া হতো। এগুলো আদায় করে, ইংরেজদের অনুমতিক্রমে ঘরবাড়ি, ব্যাবসা-বাণিজ্য, বিবাহশাদী সব করা যেত।
মাওলানা থানেশ্বরী যোগ্যতাবলে সরকারী চাকুরী পেয়ে যান। বিয়ে করেন এক কাশ্মিরী মহিলাকে । বিয়ের এক মাসের মধ্যে ২০শে জানুয়ারি ১৮৬৮সালে মাওলানা ইয়াহইয়া আলি ইন্তেকাল করেন। মাওলানা থানেশ্বরীর স্ত্রী ছিলেন তাঁর মুরিদ। শায়খের শোকে কয়েক মাস পর তিনিও ইন্তেকাল করেন। ১৮৭০সালে তিনি আরেকজন নওমুসলিমাকে বিয়ে করেন।
১৮৮১সালে অসুস্থ হয়ে পড়েন মাওলানা আহমাদুল্লাহ রহ.। মাওলানা আব্দুর রহিম রহ. সেবা করার জন্য ইংরেজদের অনুমতি চান। তাদের পক্ষ থেকে বলা হলো, এই দুজনই ওহাবী। তাই তাদের প্রতি কোনো দয়া দেখানো যাবে না। ঐ বছর ২১ নভেম্বর তিনি ইন্তেকাল করেন।
মাওলানা ইয়াহইয়া আর মাওলানা আহমাদুল্লাহ রহ.-এর মৃত্যুর পর ইংরেজরা শঙ্কা মুক্ত হলো। বুঝতে পারলো ওহাবীদের একদম ভেঙ্গে দেয়া গেছে। তাই সকল বন্দীদের মুক্তি দেয়া শুরু হল। ২২শে জানুয়ারি ১৮৮৩ সালে সকলকে মুক্তি দেয়ার আদেশ আসে। পঁচিশ বছর বয়সে বন্দি হওয়া মাওলানা জাফর আহমদ থানেশ্বরী রহ.বাড়ি ফিরেন পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে। অবশ্য এক সময়ের এই জমিদার বাড়িতে ফিরেননি, ফিরেছেন ভাড়া বাড়িতে।