অবরুদ্ধ কাশ্মীর : কলকাতার বাঙালিরা যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে

অবরুদ্ধ কাশ্মীর : কলকাতার বাঙালিরা যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে

ইমরান আবদুল্লাহ :

কাশ্মীর ইস্যুতে কেবল বাঙালিই নয়, ভারতের প্রায় সকল নাগরিকই প্রধানত এই ব্যাপারে একমত যে, কাশ্মীর ভারতের দখলদারিতেই থাকুক। অনেকে ইচ্ছায়, অনেকে দেশদ্রোহিতার তকমা থেকে বাঁচতে অনিচ্ছায় এই দৃষ্টিভঙ্গি লালন করেন। তবে কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন নিয়ে বড় একটা শ্রেণির মতানৈক্য আছে।

কলকাতার হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়েরই উল্লেখযোগ্য একটি অংশ কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে। ৫ আগস্ট বিজেপি সরকার যখন ভারতীয় সংবিধানে থাকা কাশ্মীরিদের বিশেষ মর্যাদা সংবলিত ৩৭০ ধারা বাতিল করে দেয় এবং কাশ্মীরকে পরিণত করে অবরুদ্ধ একটা জনপদরূপে তখন তাদের অনেকেই এর প্রতিবাদ এবং বিজেপি সরকারের সমালোচনা করেছেন।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল কংগ্রেসের নেত্রী মমতা ব্যানার্জি এ ক্ষেত্রে বেশ সরব ছিলেন। একই সঙ্গে তাঁর দলও কঠোর সমালোচনা করেছে বিজেপি সরকারের এ সিদ্ধান্তের।

তুলনামূলক উদার ও বামধারার উল্লেখযোগ্যসংখ্যক হিন্দু অ্যাক্টিভিস্টও কাশ্মীরকে এভাবে অবরুদ্ধ করে ফেলার তীব্র সমালোচনা করেছেন। কলকাতার অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট দিলীপ কুমার ফাতেহ টুয়েন্টি ফোরকে বলেন, বিজেপি সরকার কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন বাতিল করে চূড়ান্ত পর্যায়ের হটকারিতা করেছে। তিনি বলেন, পুরো উপত্যকার মানুষকে বাইরের পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে এভাবে অবরুদ্ধ করে রাখা নিতান্ত পর্যায়ের অমানবিক আচরণ।

তবে কাশ্মীরিদের স্বাধীনতার ব্যাপারে তিনি ভিন্নমত পোষণ করেন। দিলীপ কুমারের মতে, কাশ্মীরিদের স্বাধীনতা মানে পাকিস্তানের অংশ হয়ে যাওয়া। তাঁর দাবি, কাশ্মীরিরা যে স্বাধীনতা চাচ্ছে, সেটা পাকিস্তানেরই ষড়যন্ত্র। যথাযথ অধিকার নিয়ে স্বায়ত্তশাসনের মধ্য দিয়ে ভারতের অংশ হয়ে থাকলে স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্রের চেয়েও বেশি সুফল লাভ করতে পারবে কাশ্মীরিরা।

কেবল দিলীপ কুমার নন, উদার ও বামপন্থী হিন্দুদের প্রত্যেকেই কাশ্মীরের বর্তমান দমনপীড়নের বিরোধিতা করলেও কেউই চান না কাশ্মীর স্বাধীন হোক। এমনকি একশ্রেণির মুসলিমরাও এমন মত লালন করেন। বলছেন চব্বিশ পরগনা জেলার ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টিট ইউনিভার্সিটির মুসলিম ছাত্র জসিম উদ্দীন (ছদ্মনাম)।

তিনি বলেন, হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ফলে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি ও আরএসএসের সমর্থন বাড়ছে দ্রুতহারে। সাধারণ হিন্দুদের বড় একটি অংশ এখন বিজেপি ও আরএসএসের অন্ধ সমর্থক। তাই বিজেপির যেকোনো ধরনের সিদ্ধান্তকে তারা হিন্দুত্ববাদ ও ভারত রাষ্ট্রের কল্যাণ হিসেবেই দেখতে চান। ফলে কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন কেড়ে নেওয়া ও উপত্যকাটিকে অমানবিকভাবে অবরুদ্ধ করে রাখাকে বিজেপির সঠিক সিদ্ধান্ত হিসেবেই বিবেচনা করেন।

জসিম উদ্দীন ফাতেহ টুয়েন্টি ফোরকে আরও বলেন, এদের এই মনোভাব তৈরির পেছনে বিজেপি ও আরএসএসের অ্যাক্টিভিটির বাইরে ভারতীয় মিডিয়াগুলোর প্রোপাগাণ্ডামূলক সংবাদের ভূমিকাও কম নয়। ভারতের প্রতিটা মিডিয়া কাশ্মীরের জনসাধারণকে সন্ত্রাসী ও আতঙ্কবাদী হিসেবে উপস্থাপন করতে মরিয়া। একই সঙ্গে কাশ্মীরে যে জুলুম ও নির্যাতন চালাচ্ছে নিরাপত্তা বাহিনী, সেটাকে আড়াল করে এসব বাহিনীর সদস্যদেরকে বীর হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। ফলে হিন্দু তো বটেই, মুসলমানদের অনেকেও বিভ্রান্ত হন কাশ্মীর প্রশ্নে।

কাশ্মীর প্রশ্নে বাঙালি মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গি ঠিক কী, জানতে চাইলে জসিম উদ্দীন বলেন, দৃষ্টিভঙ্গি বিচার করতে গেলে তাদেরকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করতে হবে। প্রথম ভাগের কথা তো বললামই। এরা বংশ পরম্পরায় মুসলমান হলেও তাদের চাল-চলন ও মনোভাব হিন্দুয়ানি। নিজেদের ধর্ম থেকে যতটা দূরে থাকতে পারে, নিজের পরিচয়কে যতটা গোপন করতে পারে, ততটাই নিজেকে ‘আধুনিক’ মনে করে। এবং চিন্তা ও আচারে হিন্দুদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখাকে আভিজাত্য হিসেবে দেখে। এরা কাশ্মীরের স্বাধীনতা তো চায়ই না, কট্টর হিন্দুদের মতো উল্টো আরও কাশ্মীরের সংগ্রামী তরুণদের সন্ত্রাসী ও আতঙ্কবাদী জ্ঞান করে। কাশ্মীরকে অবরুদ্ধ করে রাখার পক্ষেও কেউ কেউ মতামত পেশ করে।

জসীম উদ্দীন বলেন, আরেক ধরনের মুসলিম আছেন, যারা প্রধানত চাকরিজীবি। এরা কাশ্মীর বিষয়ে বিজেপির সিদ্ধান্তকে সাপোর্ট করে না ঠিক, কিন্তু ভারতীয় সেনাবাহিনীর ওপর তাদের অগাধ ভালোবাসা। কাশ্মীরে এই সেনাবাহিনী যে জুলুম নিপীড়ন চালাচ্ছে এটাকে তারা বিশ্বাস করতে চায় না। এরা তাদের পরিবার নিয়েই সন্তুষ্ট। মুসলিম হিসেবে কাশ্মীরের প্রতি তাদের আলাদা কোনো দরদ নাই। বরং নিজেদের চাকরিবাকরি ও স্বার্থ হাসিলে ইসলাম থেকে যতটা দূরে সরার দরকার পড়ে, তারা সরে।

জসীম উদ্দীন বলেন এসবের বাইরে শিক্ষিত মুসলিমদের বেশিরভাগই অবশ্যি চান কাশ্মীর শান্ত হোক। অনেকে ভেতরে ভেতরে কাশ্মীরের স্বাধীনতাও প্রত্যাশা করেন। কিন্তু জনসম্মুখে এই মনোভাব জাহির করেন না। কারণ, এতে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ তুলে অনেকেই তাকে গালমন্দ করবে।

জসীম উদ্দীন বলেন, সর্বশেষ মুসলমানদের যে অংশটির কথা বলতে চাই, এরা সংখ্যায় খুব বেশি না এবং আত্মমুখী। তাঁরা কাশ্মীরি মুসলমানদের মনে প্রাণে সমর্থন করেন। তাদের ওপর জুলুম-অত্যাচারকে দখলদার বাহিনীর জুলুম-অত্যাচার মনে করেন। তবে কাশ্মীরিরা যে প্রক্রিয়ায় স্বাধীনতা চাইছেন, সেই প্রক্রিয়াকে সমর্থন করেন না। এবং এই প্রক্রিয়ায় যে কখনোই তারা স্বাধীনতা লাভ করতে পারবে না, করলেও পাকিস্তানের মতোই অসৎ ও স্বার্থবাদী নেতৃত্বের হাতে শাসন ক্ষমতা চলে যাবে, এটা তারা বিশ্বাস করেন। তাদের স্বপ্ন ভূখণ্ড কাশ্মীর সবধরনের দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত হয়ে প্রকৃত ইসলামের হুকুমত প্রতিষ্ঠিত হোক সেখানে।

আগের সংবাদইসলাম, চরমপন্থা ও কাশ্মীরের যন্ত্রণা
পরবর্তি সংবাদধর্ষণ যখন অস্ত্র : কাশ্মীরে নারী নির্যাতনের দীর্ঘ ইতিহাস